আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৪৬
সালমা খাতুন
মায়া বিষণ্ণ মনে বসে আছে বারান্দায়, দৃষ্টি তার বাড়ির মূল ফটকের দিকে। চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছে—কখন সেই কাঙ্ক্ষিত গাড়িটি ভেতরে প্রবেশ করবে।
সন্ধ্যাবেলাতেও মায়ার মেজাজটা ছিল বেশ ফুরফুরে, বিশেষ করে বিকেলের সেই ঘুমটার জন্য। অনেক দিন পর এতটা শান্তিতে ঘুমিয়েছিল ও। তবে ঘুম থেকে উঠেই আর দেখা মেলেনি সেই ‘গম্ভীর সাহেবের’। এতে মন কিছুটা খারাপ হলেও, নিজেই আবার নিজের মনকে বুঝিয়েছে—মানুষটা সত্যিই ব্যস্ত। ওর জন্যই তো সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছিল—কেন জানি এই ভাবনাতেই মনটা আবার খুশি হয়ে উঠেছিল।
আর এখন এই বিষণ্ণতার কারণ— রাত প্রায় ১১ টা বাজতে চলল, আরমান এখনো বাড়ি ফিরেনি। মানুষটা কথা দিয়েছিল, আজ রাতে ওকে সবকিছু জানাবে—ওর জীবনের সমস্ত সত্য। আজ ও জানবে নিজের সম্পর্কে সবকিছু… অথচ, মানুষটা এখনও ফিরলো না।
“আপু খেয়ে নেবে আসো। অনেক রাত হয়েছে।”
সামিরার ডাকে নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলোমেলো মায়া।
“গম্ভীর সাহেব..না মানে উনি..মানে তোমার বড়ো ভাইয়া এখনো আসেনি?”
সামিরা— “না এখনো আসেনি। অনেক রাত হয়েছে, তুমি খেয়ে নাও মেডিসিন আছে তোমার।”
সামিরার গলাটা কেমন যেন বিষণ্ণ শোনালো। বারান্দাটা অন্ধকারে ঢাকা, তাই স্পষ্ট করে সামিরার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। মায়া বারান্দা থেকে রুমে ঢুকল, সামিরাও পেছন পেছন এলো। রুবি সোফার পাশে রাখা টি টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। ওর আচরণেও আজ একরকম নির্লিপ্ততা মায়ার চোখে পড়ল। মায়া মৃদু গলায় জিজ্ঞাসা করলো, “কিছু কি হয়েছে? তোমারা আজ এমন চুপচাপ কেনো? আর সামিরা? তুমি কি কান্না করেছো? তোমার চোখ গুলো কেমন জানি লাল হয়ে আছে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সামিরা:- “ওহ কিছু না আপু। তুমি এসো খেয়ে নাও।”
মায়া:- “কেন উনি আজ আসবেন না? কোথায় গেছেন উনি?”
সামিরা:- “ভাইয়া অফিসের কাজে একটু ব্যস্ত আছে। হয়তো অনেক রাত হবে ফিরতে?”
মায়া মন খারাপ করে বলল, “আ.. আমার খিদে নেই। খাবো না।”
সামিরা অসহায় গলায় বলল, “একদিন কি ভাইয়া না খাইয়ে দিলে নিজে হাতে খাওয়া যায়া না? ভাইয়া কখন আসবে তার ঠিক নেই, আদেও জানি না আজ রাতে ফিরবে কিনা।”
মায়া মাথা নিচু করে বলল, “অভ্যাস হয়ে গেছে, চাইলেও ছাড়তে পারি না।”
এরপর মুখ তুলে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করলো, “উনি..উনি ঠিক আছেন তো। তোমাদের মুখটাও কেমন যেনো শুকনো লাগছে। সবকিছু ঠিক আছে তো?”
সামিরা:- “কেন? কেন মনে হলো উনি ঠিক নেই?”
মায়া বিচলিত হয়ে বলল, “মনটা কেমন যেনো অস্থির অস্থির লাগছে। ভালো লাগছে না কিছু। শুধু মনে হচ্ছে উনি..উনি ঠিক নেই। প্লিজ রুবি তুমি তো অন্তত কিছু বলো, সবকিছু ঠিক আছে তো?”
রুবি অসহায় চোখে তাকালো মায়ার দিকে, মুখে কিছু বলল না। সামিরা মনে মনে বলল, “ঠিক নেই ভাবী মনি, কিছুই ঠিক নেই। আমার ভাইয়াটা যেন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে—ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে ওর ভিতরটা। কবে সব ঠিক হবে? কবে আমার ভাইয়াটা সত্যিকারের সুখের মুখ দেখবে?”
সামিরা রুবিকে উদ্দেশ্য করে বলল,“রুবি আপু মায়া আপুকে খাইয়ে দিও আমি রুমে গেলাম।”
সামিরা কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। মায়া অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইল ওর চলে যাওয়ার দিকে।
রুবি:- “প্লিজ ম্যাম খেয়ে নিন। আজ অন্তত জেদ করবেন না।
মায়া:- “তুমি আগে বলো উনি কোথায়? ঠিক আছে তো? কেনো ফিরবেন না আজ রাতে?”
রুবি:- “হ্যাঁ ঠিক আছে। আর স্যার একটু কাজে আটকে গেছে, আমাকে কল করেছিলেন যেনো আপনাকে সময় মতো খাইয়ে দিই। এখন আপনি না খেলে স্যার আমার উপরে রাগ দেখাবে।”
মায়ার প্রচন্ড অভিমান হলো আরমানের উপর। কি এমন কাজ যে আজ রাতে বাড়ি ফিরতে পারবে না? উনি তো কথা দিয়েছিলেন আজ সবকিছু জানাবে ওকে। কিন্ত উনি তো বাড়িই আসছে না, সত্যিই কি কাজে আটকে গেছে নাকি অন্য কিছু?
মায়া মনে একরাশ অভিমান নিয়ে খেতে বসলো। কিন্তু অল্প একটু খেয়েই আর খেতে পারলো না। কেনো জানি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। এটাই এখন ওর সাথে হয়, নিজের আবেগ অনুভূতি গুলো ধরে রাখতে পারে না। রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে, আবার একবার কাঁদতে শুরু করলে থামতেই চায় না।
আরমান প্রতিদিন রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসে। এই দুই মাসে এটাই ওর নিয়মিত রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আজ এখনও পর্যন্ত সে ফিরে না আসায় বাড়ির সবাই খুব চিন্তায় পড়ে যায়। ফোন করেও যোগাযোগ করা যায় না—ওর ফোন বন্ধ।
অফিসে ফোন করে জানা যায়, প্রতিদিনের মতো অনেক আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে আরমান।
আবির অনেক আগেই বাড়ি ফিরে এসেছিল, কিন্তু আবারও বেরিয়ে পড়ে ওকে খুঁজতে। কিছুক্ষণ আগে আবির ফোন করে জানায়, আরমানকে পাওয়া গেছে—একটা বারে। প্রচণ্ড ড্রিঙ্ক করেছে, পাগলের মতো আচরণ করছে আরমান। সে বাড়ি ফিরতে চাইছে না। বলছে, বাড়ি ফিরলেই মায়ার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। আর সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার সময় এখনো আসেনি।
ডাক্তাররা স্পষ্টভাবে বারণ করেছে—এই মুহূর্তে মায়ার ব্রেনে কোনও চাপ দেওয়া যাবে না। কিন্তু মায়া তো মানতেই চাইছে না! বরং দিনকে দিন আরও বেশি ডেসপারেট হয়ে উঠছে।
আর যেই আরমান কখনো প্রয়োজন ছাড়া ড্রিঙ্কস করে না, সেই আরমান আজ গভীর রাতে মাতাল অবস্থায় ধরা পড়ল এক বারে। অথচ এই মানুষটাই, সবসময় গম্ভীর, কারও সামনে আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করেনি কখনো—সেই আরমান আজ ভেঙে পড়েছে। হ্যাঁ, কিছু পার্টি বা মিটিংয়ে, ক্লায়েন্টদের জোরাজুরিতে ভদ্রতার খাতিরে সামান্য সিপ নিয়েছে, তবে সেগুলো কখনোই মাত্রা ছাড়ায়নি। কিন্তু আজ?
আজকের এই ভাঙা আরমান যেন একেবারে অচেনা। নিজের ভার নিজেই আর বইতে পারছে না। হৃদয়ের ভেতরে একটা ভার জমেছে—কেউ দেখে না, কেউ বোঝেও না। ওর মায়াবতী—যার জন্য কত বছর নির্ঘুম রাত কাটিয়েছ, পাগলের মতো খুঁজে বেরিয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। আজ সে ওর খুব কাছে, অথচ সবচেয়ে দূরে। মায়া ওর কাছে থেকেও যেন শত সহস্র মাইল দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আর এখন, মায়াকে সামলানো যেন প্রতিদিনের যুদ্ধ।
রাত তখন অনেক টা গভীর। মায়া বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে, চোখে এক ফোঁটাও ঘুম নেই। হঠাৎ শোনা গেল গাড়ির হর্ন এর আওয়াজ। মায়া ধরফর করে উঠে বসলো বিছানায়। আরমান এলো কি? প্রশ্ন জাগলো মায়ার মনে। হ্যাঁ উনি ছাড়া আর কে আসবেন? মায়া এক ছুটে নিচে গেলো, ততক্ষণে বাড়ির বেল টা বাজতে শুরু করেছে।
মায়া দরজাটা খুলতেই অবাক হয়ে গেলো। আরমান দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে, দেওয়াল ধরে নিজের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। দুপুরে গায়ে যেই ব্লেজার টা ছিল সেটা এখন আর নেই, মাথার চুল গুলো এলোমেলো, পরনের শার্টটাও কুঁচকে আছে। এতোটা বিদ্ধস্ত অবস্থায় আরমানকে কখনো দেখেনি মায়া। শরীর থেকে ভেসে আসছে অ্যালকোহলের ঝাঁঝালো গন্ধ। মায়ার ভিতর টা সেই গন্ধে গুলিয়ে উঠলো, সাথে সাথে নাকে মুখে হাত চাপা দিলো ও।
মায়া:- “এই অবস্থা কেনো আপনার? আপনি ড্রিংক করেছেন?”
আরমান নিভু নিভু চোখে চাইলো মায়ার দিকে। জড়িয়ে যাওয়া আওয়াজে বলল, “আ..আমার এই অ..অবস্থা তো..তোমার জন্য। হুম ক..করেছি ডিংকস। তা..তাতে তো.. তোমার কি?”
কথা গুলো বলতে বলতেই টলমল পায়ে এগিয়ে এলোমেলো আরমান। নিজের পায়ের সাথে নিজেরই পা লেগে সামনের দিকে পড়তে নিলো, কিন্তু মায়া তাড়াতাড়ি ওকে ধরে ফেললো। পুরো শরীরের ভর ছেড়ে দিলো আরমান মায়ার উপর। এতো বলিষ্ঠ বান পুরুষের ভর কি আর ওর মতো মেয়ে নিতে পারে? মায়া কিছুটা হেলে পড়লেও কোনো রকমে সামলে নিলো নিজেকে এবং আরমানকে।
মায়া:- “আমার জন্য আপনার এই অবস্থা হয়েছে? কি করেছি আমি?”
আরমান:- “তু..তুমি তুমি একটুও বো..বোঝো না আমায়। খালি ক..কষ্ট দাও।”
মায়ার অভিমানী মনে আরো কিছুটা অভিমান জমা হলো। অভিমান মিশ্রিত গলায় প্রশ্ন করলো, “কি কষ্ট দিয়েছি আমি আপনাকে?”
আরমান:- “হুম, দি..দিয়েছো তো। নি.. নিজেকে আ..আশ্রিতা বলেছো। জা..জানো এই ক..কথাটা আ..আমার হৃদয়ে ক..কতটা আঘাত করেছে?”
মায়া ছলছল চোখে কান্না ভেজা গলায় জিজ্ঞাসা করলো, “কেন? কেন কষ্ট হয় আপনার? নিজেকে আশ্রিতা বললে কেনো আপনার হৃদয়ে আঘাত লাগে? আশ্রিতা না হলে এই বাড়িতে আমার পরিচয় কি?”
আরমান এই অবস্থাতেও নিজেকে মায়ার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা ঝাঁঝ মিশ্রিত গলায় বলল, “নাহ আ..আশ্রিতা নও তুমি। তু..তুমি এই বাড়ির…”
নিজের বলা কথাটা শেষ করলো না আরমান, মাঝ পথেই থামিয়ে দিলো।
মায়া অসহায় গলায় বলল, “কি হলো থেমে গেলেন কেনো? বলুন? আমি এই বাড়ির কি?”
আরমান মাথা নিচু করে নিলো। শোনা গেলো মিসেস সাবিনা বেগমের গলার আওয়াজ।
“মায়া আম্মু, আরমানকে ওর রুমে দিয়ে এসো। দেখছো তো ওর অবস্থাটা, এখনো ও নিজের হুঁসে নেই।”
আরমান:- “আ..আমি যেতে পা..পারব মম।”
কথাটা বলেই আরমান এগিয়ে যেতে শুরু করলো, কিন্তু আবারও পড়ে যেতে নিলো ও। সাথে সাথে মায়া ছুটে গিয়ে আঁকড়ে ধরলো আরমানকে। চোখে চোখ পড়তেই সময় থমকে গেলো। আরমানের দৃষ্টিতে ছিল মায়াবতীর জন্য ছুটে চলা সীমাহীন প্রেম, আর মায়ার চোখে সেই প্রেমেরই বিপরীত প্রতিচ্ছবি—শূন্যতা, নীরবতা আর হারিয়ে যাওয়ার ক্লান্তি।
মায়া নিজের চোখ সরিয়ে নিয়ে আরমানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করলো। মিসেস সাবিনা বেগম নিজের চোখের পানি মুছলেন শাড়ির আঁচলের কোনা দিয়ে। কখনো কল্পানাতেও ভাবেনি নিজের ছেলেকে এমন অবস্থায় দেখতে হবে কোনোদিন।
মিসেস সাবিনা বেগম রুবিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “রুবি আবির তো আরমানের সাথেই ছিল ও কোথায়?”
রুবি:- “আমার আসার আগেই ভাবী মনি দরজা খুলেছে, হয়তো উনি আগেই নিজের রুমে চলে গেছেন।”
সাবিনা বেগম:- “আচ্ছা দরজা টা লাগিয়ে দাও তাহলে।”
রুবি মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। মিসেস সাবিনা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে গেলেন নিজের রুমের উদ্দেশ্যে। রুবি দরজাটা লাগাতেই যাবে এমন সময় ওর পায়ের কাছে কেউ একজন হুমরি খেয়ে পড়লো। ভয়ে চমকে উঠে লাফিয়ে পিছিয়ে গেলো ও। পুরো ড্রয়িংরুমের উজ্জ্বল লাইট গুলো বন্ধ করে মৃদু আলো জ্বালানো আছে।
নিচে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ব্যাক্তিটিকে কিছুটা চেনা চেনা লাগলো ওর। তাই ভয়ে ভয়ে ব্যাক্তিটির সামনে বসলো, কাঁধ ধরে উপুড় হওয়া থেকে ঘুরালো। হ্যাঁ, ওর মন যা ধরেছিল ঠিক তাই, আবির নিচে চিত হয়ে শুয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে।
আবির:- “আ..আমাকে না নিয়েই দ..দরজা লাগিয়ে দি..দিচ্ছো রুবি ডা..ডার্লিং?”
রুবি নিজের কপালে চাপড় মেরে বলল, “এই আপনি না স্যারকে আনতে গিয়েছিলেন? এখন নিজেই মদ গিলে বসে আছেন?”
আবির দাঁত বের করে হেসে বলল, “ম..মদ খাইনি নি তো। এ..একটু হু..হুইস্কি খেয়েছি। এ..এই এত্তু খানি।”
রুবি কটমট করে তাকালো আবিরের দিকে। রাগী গলায় বলল, “এই মদ আর হুইস্কি কি আলাদা?”
আবির নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, “হুম আলাদা তো, তুমি জানো না রুবি ডার্লিং?”
রুবি:- “না জানি না। আর জানতেও চাই না। আর কে ডার্লিং আপনার? হুম? কে ডার্লিং? একদম আমাকে ডার্লিং ডার্লিং করবেন না। উঠুন তো এখান থেকে। আমি দরজা লাগাবো।”
আবির হঠাৎ করেই ধরফর করে উঠে বাবু হয়ে বসলো ফ্লোরেই।
“তু..তুমিই তো আ..আমার ডার্লিং। এই চ..চলো না বিয়ে করি ফেলি। আর ভা..ভালো লাগছে না এ..একা একা থাকতে।”
রুবি মুখ বেঁকিয়ে উঠে দাঁড়ালো, “বয়েই গেছে আমার আপনাকে বিয়ে করতে। হুঁ। 😏 😏 আমি কোনো মাতালকে বিয়ে করবো না।”
আবির হামাগুড়ি দিয়ে সোফার কাছে গিয়ে ওখানে বসে সোফায় হাত দিয়ে বলল, “আ..আর কোনো দিন ম..মদ খাবো না। এ..এই সোফার দি..দিব্বি করে বলছি।”
রুবি বিড়বিড় করে বলল, “শুরু হয়েছে মাতালের মাতলামো। মদ না খেয়েইতো মাতলামো করে আর এখন গলা অবদি গিলে আছে।”
রুবি বাড়ির দরজাটা লাগিয়ে দিলো। তারপর আবিরের কাছে গিয়ে বললো, “চলুন রুমে চলুন। অনেক রাত হয়েছে, ঘুম পেয়েছে আমার। আপনাকে রুমে দিয়ে এসে ঘুমাবো আমি।”
আবির হাত বাড়িয়ে দিলো রুবির দিকে, “তুলো আ..আমায়।”
রুবি আবিরের হাত ধরে টেনে তুলার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না বরং আবির এক টান দিতেই ও গিয়ে আবিরের উপর পড়লো।
রুবি বিরক্ত হয়ে বলল, “আরে কি করছেন টা কি? উফফ ছাড়ুন আমায়।”
আবির বাচ্চামো গলায় বলল, “নাহ ছা..ছাড়বো। একতুও ভা..ভালোবাসো না তুমি আমায়। স..সব সময় দূ..দূরে দূরে থাকো।”
রুবি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “প্লিজ ছাড়ুন। এইভাবে কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
আবির নাছোড়বান্দার মতো করে বলে উঠলো, “হ..হয়ে যাক কে..কেলেঙ্কারি। তাহলে স..সবাই আমাদের বি..বিয়ে দিয়ে দেবে।”
রুবি বিড়বিড় করে বলল, “হুম, জাতে মাতাল তালে ঠিক।”
এদিকে আরমানের রুমে…
মায়া অনেক কষ্টে আরমানকে ওর রুমে নিয়ে আসলো। এতো ভারী মানুষটার ভর নিজের উপর নিয়ে এতোদূর সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠে আসতে হাঁপিয়ে উঠলো ও। তার উপর আরমানের মুখ থেকে ভেসে আসা মদের উটকো গন্ধে ভিতর টা গুলিয়ে উঠছে মায়ার।
বেডের কাছে নিয়ে এসেই আরমানকে ছেড়ে দিলো মায়া। আরমান ধপাস করে বেডের উপর পড়ে গেলো, ততক্ষণে মায়া ছুট লাগিয়েছে ওয়াশরুমের দিকে। মায়া ওয়াশরুমে গিয়েই বেসিনের কাছে দাঁড়াতেই হরহর করে ভেতরের সবকিছু বাইরে বের করে দিলো। পেটের ভিতর টা মুচড়ে উঠলো ওর, ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে নিলো।
ততোক্ষণে আরমান টলতে টলতে উঠে এসেছে মায়ার কাছে। মায়ার পিঠে মাথায় হাত বুলাচ্ছে, আর বলছে, “এই মায়..মায়াবতী, তু..তুমিও ড্রিঙ্কস ক..করেছো নাকি আ..আমার মতো? জা..জানো আ.. আমারও এইসব স.. সহ্য হয়না। বা..বাড়ি আসার সময় আ.. আমিও বমি করেছি।”
মায়ার প্রচন্ড রাগ লাগলো আরমানের কথা শুনে। নিজে এইসব ছাইপাশ গিলে এখন ওকে জিজ্ঞাসা করছে ও ড্রিঙ্কস করেছে কিনা। ওর জন্যই এমন অবস্থা হলো মায়ার সেটা কি এই লোক বুঝছে না। হঠাৎই মায়ার শরীরটা প্রচন্ড খারাপ করতে শুরু করলো। নিজের শরীরের ভর নিজেই ধরে রাখতে পারছে না এমন অবস্থা।
আরমান বুঝলো কি? হয়তো বুঝলো, আর তার জন্যই মায়াকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিজের কোলে তুলে নিলো। সাথে সাথে আরমানের পা দুটো টলে উঠলো।
মায়া যেনো আঁতকে উঠলো, “আরে কি করছেন? আপনি নিজেও পড়বেন সাথে আমাকেও ফেলাবেন। নামান বলছি। আরে নামান আমাকে।”
না মায়ার কোনো কথা আরমানের কানে গেলো বলে মনে হলো না। ও কোনো রকমে মায়াকে কোলে নিয়েই টলতে টলতে রুমে আসলো। বেডের কাছে এসে মায়াকে নিয়েই আরমান ধপাস করে নিজের শরীর টা এলিয়ে দিলো বিছানায়। আরমান মায়াকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে ছিল, তাই মায়াও আরমানের শরীরের উপরেই পড়লো। নিভু নিভু চোখে আরমান তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে। আরমান জড়িয়ে যাওয়া আওয়াজে বলল, “তু..তুমি আমার বু..বুকে আছো। এ..এতদিন ধরে খালি বু..বুকটা আজ তো..তোমার স্পর্শে পূ..পূর্ণ হলো। ভেতরটা অ..অদ্ভুত শান্তিতে ভ..ভরে গেছে…শুধু এ..এতটুকু কাছাকাছি থা..থাকো, আ..আমি আর কিছু চা..চাই না। তুমি থাকলে আ..আমার বুকটা আর শূ..শূন্য লাগে না।”
আরমানের জড়িয়ে যাওয়া আওয়াজে বলা কথা মায়ার হৃদয়ে স্পর্শ করলো জেনো। কি হলো কে জানে? শারীরিক দূর্বলতার জন্য আর উঠতে মন চাইলো না ওর নাকি নিজে থেকেই আর উঠতে চাইলো না ও। একটা ঘোরের মধ্যে থেকে মাথা রাখলো আরমানের বুকে। আরমান আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মায়াকে। মাথার চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছোঁয়াল আরমান। এতো দিন ধরে ছটফট করতে থাকা দুটো রক্তাক্ত হৃদয়ে শীতল বারিধারা নেমে এলো যেনো।
সকালে সূর্যের মৃদু আলো চোখে এসে পড়তেই ঘুমটা হালকা হয়ে এলো আরমানের। বুকের উপর ভারী কিছু একটা অনুভব হলো। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো আরমান। আর তাকাতেই ওর জীবনের সবচাইতে সুন্দর দৃশ্য টা দেখতে পেলো ও, মায়া ওর বুকে গুটিসুটি মেরে একেবারে বাচ্চাদের মতো করে ঘুমিয়ে আছে। মনে মনে এই দৃশ্য কতবার যে কল্পনা করেছে তার হিসাব নেই। আর এখন সেটা বাস্তবে দেখে ওর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল একটা প্রাপ্তির হাসি।
তারপরই হঠাৎই ওর মুখে চিন্তার ছাপ দেখা গেলো। ওর স্পষ্ট মনে আছে কাল ও ড্রাঙ্ক ছিল। ও কি মায়ার রুমে এসে নেশার ঘোরে মায়াকে জোড় করে…
চারিপাশ তাকালো আরমান, না এটা তো ওরই রুম। তাহলে মায়া কি নিজে থেকে ওর রুমে এসেছিল? নাকি ও জোড় করে মায়াকে নিজের রুমে নিয়ে এসেছে?
মাথায় অনেক টা জোড় দিতেই আবছা আবছা মনে পড়লো ওর। না মায়ার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করে নি ও। মন চাইছে সময় টা এখানেই থেমে যাক, মেয়েটার ঘুম ভাঙলেই তো আবার দূরে চলে যাবে ওর থেকে। আবার শূন্য করে দেবে ওর বুকটা।
“কেন, মায়াবতী? কেন এমনটা হলো আমাদের সঙ্গে? এত সহজে ভুলে গেলে তুমি আমায়? তোমার গম্ভীর সাহেবকে ভুলে গেলে এতটাই সহজে? কতটা পর করে ফেলেছো আমায়—চাইলেও আর তোমার কাছে আসতে পারি না, ছুঁতেও পারি না!
বারবার জিজ্ঞেস করো—‘আমি তোমার কে?’ ‘কি সম্পর্ক আমাদের?’
সত্যিই কি এগুলো জানা খুব জরুরি? মুখে উচ্চারণ করাই কি একমাত্র প্রমাণ?
আমার অনুভূতির কোনও দাম নেই তোমার কাছে?
একটু বোঝার চেষ্টা করো না কেন সেই অনুভূতি গুলো? বুকটা পুড়ে যাচ্ছে ভেতর থেকে।
একটু… একটু কি আপন করে নিতে পারো না আমায়?”
আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৪৫
মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অসহায় গলায় কথা গুলো বলল আরমান। এরপর কি জেনো ভেবে মায়াকে খুব সাবধানে নিজের বুক সরিয়ে পাশে শুইয়ে দিলো ও। তারপর উঠে গেলো বিছানা থেকে।
আরমান উঠে যেতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো মায়া। ঘুমটা ওর অনেক আগেই ভেঙে গেছে। তবে কেনো জানি আরমানের হাত ছাড়িয়ে ওর বুক থেকে উঠতে মন চাইলো না। ভীষণ শান্তি অনুভব করছিল আরমানের বুকে এই ভাবে থাকতে। তারপর হঠাৎই বুঝতে পারে আরমানের ঘুম ভাঙছে। সাথে সাথে প্রচন্ড লজ্জা ঘিরে ধরে ওকে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে চুপটি করে পড়ে থাকে আরমানের বুকে। আর এরপর আরমানের বলা কথা গুলো, সবই শুনেছে ও। সবটা।
