আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২৮

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২৮
অবন্তিকা তৃপ্তি

দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়েছে। পাশেই কোনো মসজিদে আসরের আজান হচ্ছিল। বৃষ্টি কমেছে সেই কখন! আকাশ তখনো মেঘলা! অদিতি ভেজা গায়ে; কোনরকম শাল পেঁচিয়ে ছোট-ছোট পা ফেলে হোস্টেলের করিডোর থেকে রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে এক নিঃশ্বাস ফেলল। গায়ে ভেজা জামা; লম্বা কোমর-ছড়ানো চুল কয়েকটা কপালের কাছে লেপ্টে গেছে, অথচ চোখদুটো যেন বৃষ্টির চেয়েও ভারী-অস্থির!
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল অদিতি। ঘরটা অন্ধকার; রুমে তানিয়া নেই। অদিতি ভেজা গায়ে রুমে ঢুকে দরজায় সিটকিনি দিল।

তারপর দৌড়ে জানালার সামনে দাড়িয়ে বাইরে তাকাতেই দেখল; ধ্রুব বাইকের সিটে বসে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। সাদা শার্টটা ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে;কয়েকবার হাঁচিও দিচ্ছে। অদিতির তাকিয়ে রইল; হঠাৎ ধ্রুব সিগারেটের ধোয়া উড়াতে উপরের দিকে তাকাল। অদিতি ওকে তাকাতে দেখে মুহূর্তেই সরে গেল জানালার আড়াল থেকে। ধ্রুব এলোমেলো পর্দার নড়াচড়া দেখে যা বোঝার বুঝে গেল! ও আর তাকাল না একবারের জন্যেও; একটা ম্লান হাসি দিয়ে সিগারেট ফেলে বাইক স্টার্ট দিল।
বাইকের আওয়াজ শুনে অদিতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার পর্দা টেনে দিল। ধ্রুব রেগে আছে এখনও। কিন্তু অদিতির এখানে দোষটা কি? ধ্রুব কেন বুঝতে চাইছে না ওকে!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মন খারাপ করে অদিতি পেছন ফিরতেই দেখে,তানিয়া গামছা চুলে পেঁচিয়ে সামনেই দাড়িয়ে। ভেজা গায়ে অদিতিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে তানিয়া জিজ্ঞেস করলো——‘কই ছিলি তুই? আর ভিজে এসেছিস? তোর কাছে না ছাতা থাকে সবসময়।’
অদিতি নজর লুকিয়ে;দ্রুত শুকনো কাপড় ড্রয়ার থেকে নিতে নিতে বললো——-‘বা…বাইরে যাওয়া লেগেছে।ছা…ছাতা হারিয়ে গেছে।’
তানিয়া হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, পুরো রুমটা দেখে বললো——‘তুই রুমের কী অবস্থা করেছিস? এখন গোসল করে আবার সব মুছতে হবে।’
অদিতি শুকনো জামা কাপড় হাতে নিয়ে বললো——‘ আমার ঠান্ডা লাগছে ভীষণ।ফ্যান চালিয়ে দাও। গোসল করে এসে মুছে দিচ্ছি।’

অদিতি মাথা নিচু করে শুকনো জামা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। গরম পানির স্পর্শে কিছুটা স্বস্তি পেলেও বুকের ভেতরের সেই অস্থিরতা কমল না। ও অনেকক্ষণ পর জামা বদলে বেরিয়ে দেখে; তানিয়া ফ্যান চালিয়ে ঘর মুছছে। অদিতি তানিয়ার হাত থেকে ঘর মোছার লাঠি নিয়ে নিজে মোছা শুরু করলো।
তানিয়া চুল থেকে গামছা খুলে; সেটা মেলে নিয়ে বিছানায় এসে বসলো। ব্যস্ত অদিতির দিকে চেয়ে হাসি মুখে বললো——‘ধ্রুব ভাইর সাথে ছিলি?’
অদিতি ঘর মুছতে মুছতে একটু ইতস্তত করে বলল——‘হু।’
তানিয়ার কাছে অদিতিকে ঠিক লাগছে না। ও চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করলো——-‘সব ঠিক আছে তোদের মধ্যে? তোকে এমন শুকনো লাগছে কেন?’

অদিতির ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। কী বলবে সে? ধ্রুব বয়ফ্রেন্ড হিসেবে ভীষণ রাগী; জেদি! ছোট-মোটো অদিতির দ্বারা তাকে সামলানোই যাচ্ছে না আজকাল। আজ দুপুরে ধ্রুবর সেই রাগী চেহারা, কর্কশ কণ্ঠ, আর চোখের সেই কঠিন দৃষ্টি যেন এখনও তার সামনে ভাসছে। ধ্রুব এমন কেন? এতটা রাগী কেন হতে গেল?
অদিতি বুঝতে পারছে না— আদৌ ও ধ্রুবর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে কি না। কিন্তু অদিতি তো বোকা! মনটা তো পুরোটাই দিয়ে বসেছে ওই রাগী-জেদি ধ্রুবকেই!
ফ্যান অফ করে দিয়ে অদিতি বিছানায় বসলো! ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে ফোনটা হাতে নিল। ধ্রুবর এখন অব্দি কোনো মেসেজ; কল আসেনি। অদিতি মনটা খারাপ করে ফোন রেখে দিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন হঠাৎ বেজে উঠল। বাড়ি থেকে কল এসেছে। কল ধরতেই ওপাশে ফাহিমা বললেন———‘কি রে? তোকে কল দিচ্ছি দুপুর থেকে, তুই ধরলি না?”
অদিতি থামল! কি জবাব দেবে ও? কখনোই মিথ্যা না বলা অদিতি এবার মিথ্যা-টাই শোনালো তার মা-কে——-‘বাইরে ছিলাম মা, ভার্সিটিতে কাজ ছিল।’

ফাহিমা বললেন——‘ওহ। ভালো আছিস তো?’
অদিতি ছোট্ট করে উত্তর দিল——-‘হ্যাঁ। তোমরা?’
ফাহিমা কিছু বলার আগেই; পাশ থেকে ইফাজ ফোনটা কেড়ে নিল তার থেকে। শুরুতেই ভালো-মন্দের ধার ধারলো; বলে বসলো—‘অ্যাই আপু, জানিস আজ গ্রামে বিচার বসেছিল। ওই যে রুমা আপা আছে না? করিম চাচার মেয়ে? তাকে সাহেদ ভাইয়ের সাথে পাকড়াও করেছে স—-‘
ফাহিমা বাকি-কথা আর বলতে না দিয়ে তৎক্ষণাৎ ইফাজকে থামিয়ে ওর থেকে ফোন কেড়ে নিলেন; ধমকে উঠলেন ছেলেকে ফোনের মধ্যেই——‘ একটা চড় দেব। এই ছেলে, তোর বয়স কত? এসব কথার কি তুই বুঝিস? সবসময় পাকনামি। তোর আব্বারে বলবো?’

ইফাজ হয়তো চলে গেছে। অথচ এই কথা-গুলো আবারো অদিতির কানে আসলো! ভয় আগের ন্যায় অদিতির গলা-টা যেন চেপে ধরলো। বর্তমান সুখের আশায় অদিতি যে সবচেয়ে বড় ভুল করে বসে আছে। গলার স্বরটা এলোমেলো হয়ে এলো ওর; জিজ্ঞেস করলো——-‘ওরা… শাহেদ ভাইদের তো করিম চাচাদের সাথে জমি নিয়ে আগে থেকেই ঝামেলায় ছিল,তাহলে এসব?’
ফাহিমা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন———‘কি ঝামেলা? ছেলে-মেয়ে ওরা আগেই লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। আজ তোর বাবা বিচারে ওদের আবার সবার সামনে বিয়ে দিয়েছে।’
অদিতির কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে এলো——-আর… একঘরে?’

ফাহিমা জবাব দিলেন——-‘না রে, একঘরে করেননি। বিয়ে তো করেই ফেলেছে, এখন আর কি বিচার করবেন। তাই তোর বাবা শাহেদকে চাকরি নিতে বলে; বিয়ে দিয়ে আলাদা থাকতে বলেছেন। গ্রামেই আছে ওরা।’
তারপর অদিতির আর কিছুই শুনতে পারলো না। পুরনো ভয়-গুলো আবারও ঝেঁকে ধরেছিল ওকে। ফাহিমা নিজের মতো করে অনেকক্ষণ কথা বলে তারপর ফোন কাটলেন। ফোন কেটে যাওয়ার পর অদিতি বিছানায় বসে রইল।মাথার ভেতর হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ধ্রুব-অদিতির সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের শেষ কোথায়? অদিতি কি কখনো পরিবারকে লুকিয়ে ধ্রুবকে বিয়ে করার মতো সাহস আদৌ কোনোদিন করতে পারবে? এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি আদৌ আছে?
জানালার বাইরে আবারো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে। অদিতির চোখে আবারও পানি জমতেই; দুহাতে অদিতি চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করলো। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন আর এসব ভেবে কি হবে? বাকি যা হবার দেখা যাবে।

অদিতি মলিন হেসে জানালার দিকে তাকাল! জানালার কাঁচে এখনো টপটপ করে জমে থাকা ফোঁটাগুলো গলে নামছে। হঠাৎ ওর মনে হলো— ধ্রুব এখন কী করছে? ও কি সুস্থ আছে? এমন রাগ নিয়ে বেরিয়ে গেছে, তার ওপর ভিজেছে বৃষ্টিতে। ধ্রুব এমনিতেই ঠাণ্ডা লাগলে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরে শুনেছে অদিতি। আসার পর রেগে কল করেনি, মেসেজ করেনি। এত্ত রাগ এই ছেলের! অদিতি না চাইতেও হার মানলো। কল লাগাল ধ্রুবর নম্বরে।
ওপাশ থেকে একজন মধ্যবয়স্ক লোক কলটা ধরলেন——-‘সালামুআলাইকুম। কে?’
অদিতি কিছুটা থামল; কে কল ধরেছেন বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর ও জবাব দিল ——-‘ওয়ালাইকুম সালাম। এটা ধ্রু…ধ্রুবর নম্ব—-‘

ওপাশ থেকে সঙ্গেসঙ্গে কথা ফুরাবার আগেই বললেন——-‘জি, ধ্রুব স্যারের নম্বর এটা। আমি হারুন। ধ্রুব স্যারের বাসার কাজ করি। আপনি কেডা?’
অদিতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দিল——‘ফ্রেন্ড।’
হারুন চিন্তিত গলায় বললেন——-‘ ও, ফেরেন্ড! আপা স্যার খুব জ্বরে ভুগছেন। শুয়ে কাতরাচ্ছেন। আমি জলপট্টি দিচ্ছি তারে। বড় স্যার বিদেশে । বাড়িতে কেউ নাই। আপনারা কেউ এসে দেইখা যান উনারে।’
অদিতি মুহূর্তেই ব্যাকুল হয়ে গেল। হবে না জ্বর! গতকাল এতবড় এক্সিডেন্ট করে দুদিন যায়নি আজ আবার ঝুম বৃষ্টিতে ভেজা। অদিতি চিন্তা নিয়ে বললো———‘জ্বর? কখন থেকে জ্বর?’
‘বাইরে থেকে আসবার পর থেকেই। মুখটা লাল হয়ে গেছে, কয়েকবার বমিও করেছেন।’
অদিতির চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে যেন। উঠে দাড়িয়ে গেল বিছানা থেকে; জিজ্ঞেস করলো——-‘চাচা, সে কি কিছু খেয়েছিলেন? কোনো মেডিসিন?’
হারুন বিরস কণ্ঠে বললো——-‘না আপা, কিছুই খায়নাই। বড় স্যার তো এখন কাতারে। আমি তো এসব বুঝি না। কী অসুদ খাওয়ামু?’

অদিতি শুনে গেল! কি করবে এখন? অদিতি বললো——-‘ ধ্রুবর বাকি ফ্রেন্ডদের খবর দিয়েছেন?’
হারুন জবাবে হতাশ শ্বাস ফেলে বললো——‘ বলসিলাম আমি। স্যার তো ডাইরেক্ট মানা করে দিসেন। আপনাদের বন্ধুগো মধ্যে কি কিছু হইছে আপা?’
অদিতির কণ্ঠ শুকিয়ে গেল। ও ছোট করে বললো——-‘ আপনি উনার পাশে বসুন চাচা। আমি আসছি।’
অদিতি আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। হাত পা কাঁপছে ওর। ও ঘরে ছোট ইলেকট্রিক চুলা দিয়ে, পাত্রে চাল আর ডাল দিয়ে খিচুড়ি বসিয়ে দিল। খিচুড়ি রান্না শেষ হতেই একটা ছোট টিফিন ক্যারিয়ারে সেসব ভরল। ড্রয়ার থেকে একটা বড় শাল গায়ে জড়িয়ে নিয়ে, তানিয়াকে বলে দ্রুত বেরিয়ে এলো।

অদিতির টিফিন হাতে ধ্রুবদের বাড়ির সামনে দাঁড়াল! বিশাল বাড়ি; নেমপ্লেটে লেখা——‘Iyamin’s family’
অদিতি কলিং বেল বাজাতেই দরজা খোলা হলো। হারুন অদিতিকে দেখতেই মুহূর্তেই চিনে ফেললো। বিস্ময় নিয়ে বলল——-‘আপনি অদিতি ভাবি না? ধ্রুব স্যার যারে ভালোবাসেন? একটু আগে আপনি আমারে কল দিসিলেন?”
অদিতি কিছুটা হকচকিয়ে গেল! এ বাড়ির সবাই কি অদিতিকে চিনে? কিভাবে? ও তো কোনোদিন এ বাড়িতে পা-ও রাখেনি। অদিতি ইতস্তত করে বললো——-‘আপনি আমাকে কীভাবে চিনলেন?’
হারুন মৃদু হেসে বললো——-‘আপনার ইয়া বড় একটা শাড়ি পড়া ছবি ধ্রুব স্যারের রুমে টাঙ্গানো আছে। আপনারে তো এই বাড়ির সবাই চিনে। আসেন ম্যাডাম, ধ্রুব স্যার রুমেই আছে। আমি আপনারে নিয়ে যাই।”
অদিতি লজ্জায় মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল। ধ্রুবদের বাড়িটা বিশাল। অভিজাত পরিবেশ, দামি আসবাব, নিখুঁত সজ্জা—সব কিছুতেই পরিপূর্ণতা। অথচ বাড়ির ভেতরে এক ধরনের নিঃসঙ্গতা। কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু দু-একজন কাজের মানুষ বাড়ি-ময় হাঁটাচলা করছেন।

হারুন অদিতিকে এগিয়ে নিয়ে গেল ধ্রুবর রুমের দিকে। দরজা ধাক্কা দিয়েই ভেতরে প্রবেশ করল তারা। অদিতি দেখল্লো; ধ্রুব বিছানায় দুটো কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছে। কপালে জলপট্টি রাখা, মুখটা ফ্যাকাশে এবং রক্তিম। পাশে খাবার ঢেকে রাখা ট্রে। খাওয়া হয়নি তার এখনো বোঝা যাচ্ছে। রুমে বেডের উপরে দেয়ালে কালচারাল প্রোগ্রামে অদিতির নীল শাড়ি পড়া একটা বিশাল ছবি ফ্রেম টাঙ্গানো; যেখানে অদিতি গিটার হাতে হাসছিল কারোর সঙ্গে।
অদিতি ছবিটা দেখে মনেমনে অস্বস্তি বোধ করল। সবাই কি ভাবছে বাড়ির কে জানে? ও টিফিন হাতে এগিয়ে গেল ধ্রুবর দিকে। ধ্রুবর পাশে বেডে বসলো না, চেয়ার টেনে বসলো।
হারুন বললো———‘আপনি খাবার আনসেন? দেন আমি প্লেটে বেড়ে দিতেসি।’

হারুন অদিতির হাত থেকে টিফিন হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হতেই অদিতি চুপচাপ চেয়ারে বসে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে রইলো! কি শান্ত-ইনোসেন্ট লাগছিল ধ্রুব ইয়ামিনকে। অথচ এই ছেলেটাই রেগে গেলে চারপাশ লন্ড-ভন্ড করে ফেলে। অদিতি হাত বাড়িয়ে জ্বর দেখল!ইয়া আল্লাহ, চমকে হাত সরিয়ে ফেলল ও। এত্ত জ্বর! অদিতির মন আরও ব্যাকুল হলো যেন। ও দ্রুত জলপট্টি দেওয়া শুরু করলো! কপালে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেতেই ধ্রুব বিড়বিড়ালো—‘ম..মা! ঠা…ঠান্ডা লাগছে।’
অদিতির অস্থির হলো ভীষণ; ধ্রুবর চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল ——-‘ধ্রুব? শুনছেন? অ্যাই ধ্রুব!’
ধ্রুব জবাব দিল না। হারুন ততক্ষণে এসে গেছে——-‘ম্যাডাম, এই নেন, স্যাররে খাওয়াইয়া দেন। আর কিছু দরকার হলে ডাকবেন আমাকে। আমি পাশের রুমেই আছি।’

অদিতি হারুনের থেকে প্লেট নিলো। হারুন হাতে করে বাড়ির মেডিসিনের বক্সও এনেছে। অদিতি বক্স থেকে নাপা বের করে রাখলো। হারুন বক্স রেখে দিল টেবিলে। অদিতির দিকে চেয়ে বললো———‘আপনে এত্ত বালা ম্যাডাম। ধ্রুব স্যার ভাগ্য করে এমন একটা লক্ষ্মী পাইসেন।’
হারুনের কথাতে অদিতি চুপ হয়ে গেল! মাথাটা নিচু করে শুয়ে থাকা ধ্রুবর দিকে তাকাল; মনেমনে ভাবলো———‘ সত্য বলতে আমি না; বরং সে-ই আমার জীবনের ব্লেসিং।’
হারুন চলে গেল; যাবার আগে দরজা হালকা করে ভিড়িয়ে দিয়ে গেলো। রুমে এখন শুধুই অদিতি আর ধ্রুব। জানালার পর্দা হালকা দুলছে। রুমের বাতাস ভারী। ধ্রুব একটু নড়ে উঠল, যেন ঘুমের ভেতরেও ওর অশান্তি হচ্ছে ভীষণ।

অদিতি ধীরে ধীরে ধ্রুবর চুলে হাত রাখলো; ডাকলো আলতো গলায়——-‘ধ্রুব? উঠুন। খেয়ে নিন। মেডিসিন নিতে হবে আপনার।’
ধ্রুব কয়েকবার ডাকাডাকির পর ধীরে ধীরে চোখ খুলল। ঝাপসা দৃষ্টিতে শুরুতেই অদিতির চিন্তিত মুখটা দেখতে পেল। অদিতির ওর দিকে ঝুঁকে আছে! ধ্রুব শুরুতে যেন বিশ্বাস করতে পারলো না। ওর বাড়িতে ওকে না জানিয়ে অদিতি আসার মতো মেয়ে তো অবশ্যই নয়!
‘ত…তুমি এ..এখানে কেন?”—ধ্রুব অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করলো।
অদিতি খিচুড়ির ধোয়া উঠা প্লেটে ফুঁ দিতে দিতে বলল——‘আপনার অসুস্থতার খবর পেয়ে এসেছি। এখন উঠুন, খেয়ে নিন।”

ধ্রুব মুখ কুঁচকে ফেলল খাওয়ার কথা শোনা-মাত্রই! মুখটা সম্পূর্ণ তেতো হয়ে আছে ওর। মজা পাচ্ছে না কোনও খাবারেই। ও চোখ-মুখ কুঁচকে বিরক্ত হয়ে বললো———‘ খ…খাব না। খ..ক্ষুধা নেই।’
অদিতি এবার রাগ দেখিয়ে বলল——‘আমি অনেক কষ্টে বানিয়ে এনেছি।আমার আনা খাবার নষ্ট করবেন আপনি?’
ধ্রুব চুপচাপ অদিতির রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এই রাগে ভরা মুখটা যেন অদ্ভুত ঠেকলো ওর কাছে। মায়ের পর কেউ কখনো এভাবে তাকে যত্ন করেনি। অসুস্থতার দিনগুলোতে সে বরাবরই একা থেকেছে। দরজাটা বন্ধ করে নিজেকে পৃথিবী থেকে আলাদা করে রেখেছে সৌরভ ইয়ামিনকেও দূরে রেখেছে। কিন্তু আজ অদিতি তার রুমে বসে তাকে এভাবে শাসন দেখাচ্ছে; এসব ধ্রুবর জন্যে নতুন একদম। ধ্রুব এসবে অভ্যস্ত নয়!
অদিতি ধ্রুবকে এখনও শুয়ে থাকতে দেখে, আবার চোখ রাঙালো; বললো———‘আপনি উঠবেন না? আমি খাবার নিয়ে বেরিয়ে যাব ঘর থেকে?’
ধ্রুব অসুস্থতার মধ্যেও মলিন হাসল। রাগী অদিতিকে ওর মারাত্মক লাগছে! ও আস্তে আস্তে উঠে বসার চেষ্টা করলে, অদিতি সাহায্য করল তাকে। ধ্রুব বালিশ পেছনে দিয়ে আরাম করে বসল। ক্লান্ত দৃষ্টিতে অদিতির দিকে তাকিয়ে বলল——-‘দাও।’

অদিতির ঠোঁটে এবার হাসি ফুটল।ও প্লেট এগিয়ে দিলো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব চামচ দিয়ে খেতে শুরু করল। খিচুড়ির ধোঁয়া উঠছে, ধ্রুব এক এক চামচ খাবার মুখে নিচ্ছে। অদিতির চোখের সামনে যেন পুরো দৃশ্যটা ভয়াবহ সুন্দর দেখালো। ধ্রুব ওর হাতের বানানো খাবার এই জ্বরের মধ্যেও তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে; অনুভূতির আঁচড় অদিতির মনে এবারেও দাগ কেটে গেল। ও নির্নিমেষ চেয়ে দেখতে লাগলো ধ্রুবর খাওয়া।
ধ্রুব খাওয়া শেষ করে প্লেটটা অদিতির দিকে বাড়িয়ে দিল। অদিতি মেডিসিন এগিয়ে দিল। ধ্রুব ওষুধ খেয়ে নিল।
অদিতি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ধ্রুব খাওয়া শেষ করে ক্লান্ত-ভঙ্গিতে বেডে হেলান দিল। অদিতি বললো——-‘শুয়ে পড়বেন?’
ধ্রুব উত্তর দিল——-‘না; বসি কিছুক্ষণ।’

অদিতি এবার সাহস সঞ্চয় করে বলল——-‘আপনার সাথে ইমন ভাইদের কী কোনো সমস্যা চলছে?’
ধ্রুবর ভ্রু কুঁচকে গেল।মাথাটা এতক্ষণ কের ধরে ছিলো, অদিতির কথা শোনা-মাত্রই ওর চোখে-মুখে যেন ছড়িয়ে গেল সেই মাথা-ব্যথা। ধ্রুব ঠান্ডা গলায় পাল্টা প্রশ্ন করলো———‘তোমাকে কে জানিয়েছে?’
অদিতি ঠোঁট চেপে উত্তর দিল———‘হারুন চাচা।’
ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার চোখ শীতল; ও সেভাবেই জবাব দিল———‘শাস্তি দিচ্ছি কিছু ভুলের জন্য। ক’দিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।’
অদিতি শ্বাস আটকে শুনে গেল কথাগুলো। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অদিতি চোখ ছোটছোট করে ধ্রুবর মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে; ভয়ে-ভয়ে প্রশ্ন করল——-‘আর আমার ওপর? আমার উপরও কি আপনি এখনো রেগে আছেন?’
ধ্রুব ভ্রু তুলে তাকাল। অদিতির দিকে শীতল চোখে চেয়ে হেয়ালি করে বললো———-‘রাগ করার মতো কিছু কি করেছো তুমি?’

অদিতি মৃদু কণ্ঠে বললো———‘আজ দুপুরে নদীর পাড়ে…’.”
ধ্রুব কথাটা শেষ করার সুযোগ দিল না। হাতে থাকা পানির গ্লাস টেবিলের উপর রেখে; ঠান্ডা গলায় বললো——-‘জানিনা আমি কিছু।’
ধ্রুবর কণ্ঠে যে রাগ ছিলো; সেটা বোঝাই যাচ্ছে। অদিতির বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। ধ্রুবকে এভাবে এড়িয়ে যেতে দেখে তার কান্না পেয়ে গেল।
সে ধ্রুবর হাতটা আলতো করে ধরে ফেলল——-‘সরি ধ্রুব। আপনি রাগ করেছেন আমি জানি। আপনি আমার উপর রাগ না করলে এভাবে শান্ত গলায় কথা বলতেন না।”

ধ্রুব অদিতির চেপে রাখা দুজনের হাতের দিকে একবার চেয়ে অদিতির গোলগাল মুখের দিকে তাকাল! অদিতির চোখে অনুময়; অপরাধবোধ স্পষ্ট! ধ্রুব হতাশ শ্বাস ফেলল সেটা দেখে! শীতল গলায় সোজাসোজি একটা প্রশ্ন করল——-‘অদিতি; আজ অব্দি আমি কখনো তোমার অনুমতি ছাড়া তোমাকে স্পর্শ করেছি? একবারের জন্যেও?’
অদিতি সঙ্গেসঙ্গে বললো——‘ধ্রুব আমি—-‘
ধ্রুব কথা থামিয়ে আবারও দৃঢ় গলায় প্রশ্ন করলো ——-‘ফার্স্ট আনসার ম্যাই কুয়েসশন! হ্যা কি না?’
অদিতি মাথাটা নিচু করে বলল —-‘ন..না।’
ধ্রুব এবার কিছুটা রাগ নিয়েই বললো———‘তাহলে সেদিন কেন তুমি আমাকে ধাক্কা দিলে? কেন তোমার আচরণে মনে হলো আমি… অ্যাই অ্যাম অ্যা ব্লাডি ইফটিজার; যে তোমাকে জোর-জবরদস্তি করছে। অথচ আমি তোমার অনুমতি তখনও চেয়েছিলাম; চাইনি আমি?’

অদিতি মাথা তুলে তাকাল ধ্রুবর দিকে। তার গলা কাঁপছে; ও উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলো———‘ধ্রুব, আমি সেটা ভেবে ধাক্কা দিইনি। আমি… আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
ধ্রুব তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল——‘ভয়? আমাকে ভয় পেয়েছিলে তুমি? তোমার কি মনে হয়েছে, আমি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে….ওহ গড! অদিতি আমি তোমাকে ভালোবাসি; তোমাকে জাস্ট ছোয়ার জন্যে আমি এতটা কষ্ট করিনি। তুমি একবার বলতে; এসব তুমি চাওনা। আমি একবারের জন্যেও তোমাকে টাচ-ই করতাম না। তুমি আমার ব্যাপারে এসব ভাবলেই বা কিভাবে? জাস্ট স্পিচলেস!’

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২৭

অদিতি টলমলে চোখে চেয়ে অধৈর্য‍্য গলায় বললো——-‘ধ্রুব, প্লিজ আমাকে ভুল কেন বুঝছেন? আমি ভেবেছি— আপনি বোধহয় এসব চান। শহরে না থাকায় হয়তো আমি-ই এসব নিতে পারছি না। ধ্রুব, বিয়ের আগে এসব ব্যাপার নিয়ে আমি ভয় পাই ভীষণ। আমি ওরকম আপডেটেড মেয়ে ছিলাম না কোনোদিন।’
ধ্রুব এবার সরাসরি অদিতির দিকে তাকাল! কিছুক্ষণ অভাবেই তাকিয়ে থেকে; তারপর হঠাৎ করে বললো——-‘ওহ; সবকিছুর মুলে তাহলে এক বিয়েই। বিয়ে হলেই তোমার ভরসা হবে ধ্রুব ক্যারেক্টারলেস নয়। ওকে দেন! লেটস গেট ম্যারিড। আজকেই; এই মুহূর্তেই।’

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২৯