আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২২

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২২
অবন্তিকা তৃপ্তি

সকাল-সকাল তোফাজ্জল তৈরি হচ্ছেন বাজারে যেতে! ধ্রুব তখন ঘুমাচ্ছিল। সারারাত অস্থিরভাবে এদিক-ওদিক পায়চারী করে সে অনেককিছু ভেবেছে; সঙ্গে ইমনের সঙ্গেও আলোচনা করেছে। এসব করতে করতে ভোররাতে চোখ লেগেছে। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে ধ্রুবর এলার্ম বেজে উঠল! জীবনেও এলার্ম শুনে ঘুম থেকে না ওঠা ধ্রুব এবারেও ভ্রু-ট্রু কুঁচকে মহাবিরক্ত হয়ে হাত দিয়ে মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করে ফেলল। তারপর আবার আরেক ঘুম!
হঠাৎ করে ফ্যান-টাও বন্ধ হয়ে গেল! গরমে ধ্রুব অসহ্যভাবে চোখ খুলে ফেলল; বুঝলো কারেন্ট চলে গেছে।রেগেমেগে এলোমেলোভাবে-হেলেদুলে চোখ ঘষতে ঘষতে ধ্রুব ঘুম থেকে উঠে বসলো; চোখ উল্টে সিলিং ফ্যানের দিকে চেয়ে গালি দিয়ে বসল——‘বা//লের কারেন্ট!’

ধ্রুব ফোন হাতে নিল! ফোনের টাইম দেখতেই তার চোখ কপালে উঠল; ‘ শিট; শিট’—- ও দ্রুত বিছানা থেকে উঠে উদোম গায়ে শার্ট খুঁজতে লাগল! আজ তাকে পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে হবে! ধ্রুব দৌড়ে ড্রয়ারে শার্ট খুঁজছে; আর অপরহাতে ঘড়ি কব্জিতে লাগাচ্ছে। আজ তার পুরোদিন অভিনয় করতে হবে— বখাটে-উগ্র ধ্রুব থেকে হতে হবে ডিসেন্ট-শান্ত-ইনোসেন্ট ধ্রুব!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এসব মাথায় আগে কখনো আসেনি। গতকাল ইমন একটা বুদ্ধি দিয়েছে। ধ্রুব ফলো করতে চায়নি; কিন্তু ইমন বলেছে জোর দিয়ে— এটা করা জরুরি! প্ল্যানের অর্ধেক এটা। তাই না চাইলেও এসব করতে রাজি হয়েছে ধ্রুব। আপাতত ধ্রুবর কাছে অপশনাল প্ল্যান নেই; তাই এটাই স্বাহ ভরসা!
রেডি হয়ে ভাঙা আয়নার সামনে দাঁড়াল ধ্রুব! নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখে; হঠাৎ ঠোঁট উল্টে নিজেই নিজের কাঁধে থাপ্পড় দিয়ে বলল——-‘ গুড জব; ধ্রুব ইয়ামিন।’
তারপর চুল ঠিক করে বেরিয়ে এল মেহমানদের ঘর থেকে। নিচে নামতেই তার চোখ গেল— দুজন কাজের মহিলা বাড়িঘর পরিষ্কার করছে। ধ্রুব সেটা দেখে কিছুক্ষণ সেভাবেই দাড়িয়ে রইলো; একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বড়বড় পা ফেলে হেঁটে গেল বড় ঘরে। তোফাজ্জল তখন সবে খেতে বসেছেন। পাশেই বাজারের ব্যাগ এনে রেখেছেন ফাহিমা। ধ্রুব যেতেই তোফাজ্জল তাকালেন তার দিকে; গম্ভীর স্বরে চেয়ার ইশারা করে বললেন——-‘খেতে বসো।’

ধ্রুব তোফাজ্জলের থেকে বেশ দূরের চেয়ারে গিয়ে খেতে বসলো! তোফাজ্জল খেতে খেতে ফাহিমাকে জিজ্ঞেস করলেন——‘ইফাজ কোথায়?’
ফাহিমা তোফাজ্জলের পাতে আটার রুটি তুলে দিতে দিতে উত্তর দিলেন——-‘ঘুমোচ্ছে।’
তোফাজ্জল শুনে রেগে গেলেন; রুটি ছেড়া বাদ দিয়ে কঠোর স্বরে বলে উঠলেন——-‘আজ বাড়িতে মেহমান আসবে; আর তোমার ছেলে ঘুমোচ্ছে? ডেকে তুলো ওকে; আমার সঙ্গে বাজারে যাবে।’
ফাহিমা কিছুটা অনুরোধ করে বললেন— ‘সবে ফজর হয়েছে; এখন ঘুম থেকে উঠাব?’
তোফাজ্জল কিছু বলবেন; তার আগেই ধ্রুব খাবার খাওয়া থামিয়ে বলল——-‘আঙ্কেল, আপনি চাইলে আমি যেতে পারি আপনার সঙ্গে।’

তোফাজ্জলের ভ্রু কুচকে গেল মুহূর্তেই; জিজ্ঞেস করলেন——-‘তুমি বাড়ির মেহমান হয়ে যাবে আমার সঙ্গে?’
ধ্রুব নিজেকে নম্র দেখানোর চেষ্টা করে বললো ——-‘আপনি-আন্টি আমার জন্যে এত করছেন; আ’ম গ্রেটফুল ফর দিস! তাই যাবার আগে কিছুটা শোধ করে দিতে চাইছি বলতে পারেন।’
ফাহিমা তো গদগদ হয়ে গেলেন ধ্রুবর এমন নম্র ব্যবহারে! তোফাজ্জল না করবেন ভেবেছিলেন। উনি চুপচাপ ধ্রুবর কথা পাশ কাটিয়ে গেলেন। ধ্রুব সেটা দেখে আবারও বললো—— ‘বাজার করা আমি তেমন পারি না। আপনার কাছ থেকে শিখতে চাইছিলাম।’

তোফাজ্জল এবার আর না করলেন না; খেতে খেতে বললেন—-‘আচ্ছা যেও।’
রাজি করিয়েই অবশেষে ধ্রুব থামল! তোফাজ্জল ধ্রুবকে নিয়েই বাজারে গেলেন। বাজারে সবাই ধ্রুব-তোফাজ্জলকে দেখে বারবার তাকাচ্ছিল। একজন তো জিজ্ঞেস করেই ফেলল——‘হায়াত সাব, মেয়ের জামাই নাকি?’
তোফাজ্জল অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন; ধ্রুব মনে-মনে হাসে! তোফাজ্জল আড়চোখে ধ্রুবকে দেখলে; ও দ্রুত এমন একটা ভাব করল যে জীবনেও ধ্রুব এমন আজব কথা শুনেওনি! তোফাজ্জল গলা পরিস্কার করে উত্তর দিলেন——-‘না, বাড়ির অতিথি।’

বলে আবার হাঁটা ধরলেন। ধ্রুব-তোফাজ্জলকে পাশাপাশি হাঁটার সময় একদম জামাই-শ্বশুর লাগছিল।শহুরে জামাই; তার গ্রাম্য গম্ভীর শ্বশুর! দারুণ মানিয়েছিল ওদের। তাই বোধহয় ওরা বাজারে যেতে যেতেই কয়েকবার একই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। ধ্রুব তো এতে ভীষণ মজা নিচ্ছে। অথচ মুখ করে রেখেছে—- চূড়ান্ত গম্ভীর-নিষ্পাপ! তোফাজ্জল এসব বারবার দেখে অস্বস্তিতে কাঠ হয়ে গেলেন। কিছুটা গম্ভীরভাবে ধ্রুবকে বললেন——-‘একটু দূরে থেকে হাঁটো আমার থেকে।’
ধ্রুব না বোঝার ভান করে বলল——-‘কেন আঙ্কেল?’

তোফাজ্জল জবাব দিলেন না; বরং নিজেই ধ্রুবকে ফেলে আগে আগে হাঁটা ধরলেন। ধ্রুব পেছন-পেছন হাঁটছে; তার ঠোঁটে অদ্ভুত মশকরা খেলা করছে।
ফেরার পথে ধ্রুব নিজে থেকে তোফাজ্জলের হাতে থাকা সব বাজারের ব্যাগ নিয়ে নিল নিজের হাতে। তোফাজ্জল মানা করতে চাইলেন; তখন ধ্রুব বলে ফেলল——-‘সমস্যা নেই আঙ্কেল। আপনি বয়স্ক লোক হয়ে এসব ক্যারি করার দরকার নেই; আমি সাহায্য করি না?’
তোফাজ্জল আর না করলেন না। ধ্রুব ইতিমধ্যেই তোফাজ্জলের মন কিছুটা জয় করে ফেলেছে। উনি বারবার ধ্রুবকে দেখছিলেন; ছেলেটা এত ভালো!

ধ্রুব যখন বাজার করে বাড়ি ঢুকেছে; তোফাজ্জল তখন গোসল করতে পুকুরে নেমেছেন। ধ্রুব বাজার নিয়ে ডাকলো বাড়ির বাইরে——-‘আন্টি, বাজার।’
ফাহিমা আসার আগেই চোখে পরলো অদিতিকে। তার মাথায় ঘোমটা টানা; চোখটা অদ্ভুতভাবে শান্ত আজ! ধ্রুবর দিকে অদিতি সেভাবেই চেয়ে এগিয়ে এলো। ধ্রুব অদিতির ওই চোখ দেখে অনেকককিছু বুঝে গেল। ধ্রুব অদিতির দিকে চেয়ে ভীষণ স্বাভাবিকভাবে ওর দিকে ব্যাগ এগিয়ে দিল। অদিতি ব্যাগ নিলো না; বরং চাপা গলায় এটুকু বলে উঠলো——‘আমার বিয়েতে আপনার আনন্দ দেখে ভালো লাগছে আমার!’

ধ্রুব চোখ তুলে দেখল অদিতিকে; ওর চোখের ভাষা অদিতি বুঝেনা। অদিতি চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল ——‘কি চাইছেন; কি করছেন—খোদ আপনি ছাড়া কেউই ভালো জানে না।’
ধ্রুব উত্তরে নিজেও চাপা গলায় ধীমে আওয়াজে বললো——‘ কিচ্ছু চাইবো না; যদি এক্ষুনি তুমি আমার প্রপোজের জবাব দিয়ে দাও! সময় আছে এখনো অদিতি; আমার এসব কিছু করার দরকারি ছিলো না। তুমি আমাকে ঘোরাচ্ছো নিজের পেছনে; আর আমি ধ্রুব ঘুরছিও; গড!’

অদিতি কিছু বলবে; তার আগেই ফাহিমা আঁচলে তখন হাত মুছতে মুছতে উঠোনে এলেন। ফাহিমাকে দেখে অদিতি দ্রুত বাজারের ব্যাগ ধ্রুবর হাত থেকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল! ধ্রুব ফাহিমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে কপালের ঘাম মুছল; ফাহিম সেটা দেখে বললেন——-‘বাবা, বিশ্রাম নাও ঘরে গিয়ে; অনেক করেছ তুমি।’
ধ্রুব নম্রভাবে হাসল; উত্তর দিল——-‘নো প্রবলেম আন্টি।’
ফাহিমা ধ্রুবর এমন দায়িত্ববোধ দেখে হঠাৎ ভেবে বললেন——-‘বিয়ে করেছো তুমি?’
ধ্রুব বুঝল—প্ল্যান লাইন মতোই আছে। ও লাজুক গলায় মাথার পেছনটা চুলকে নত মুখে উত্তর দিল——-‘ মনমতো পাত্রী পাইনি আন্টি; পেলে করে ফেলার ইচ্ছে আছে।’
ফাহিমা এবার মশকরা করে বললেন——-‘খুঁজে দিই আমরা তোমার জন্যে পাত্রী? এই গ্রামে অনেক ভালো মেয়ে আছে কিন্তু ধ্রুব।’

ধ্রুব লাজুক ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে উত্তর দিল——-‘আপনারা যা ভালো মনে করেন।’
ফাহিমা ধ্রুবর অভিনয়ের লজ্জা দেখে হেসে ফেললেন। ধ্রুব পাশ কাটিয়ে দ্রুত ঘরে চলে গেল। রুমে গিয়েই কল লাগাল ইমনকে; ওপাশে ইমন কল ধরলে ধ্রুব দিয়ে উঠে রাম ধমক——‘শা/লা! কী বুদ্ধি দিছোস এগুলা? একটিং অনেক লেইম হয়ে যাচ্ছে ইমন! আমি পারব না এসব। অন্য আইডিয়া দে।’
ইমন তখন খাচ্ছিল; ও খাবারের লোকমা হাতে তুলে আবার ফেলে দিল। মুহূর্তেই দ্রুত বলে উঠল——-‘আমার ভাই, ঠান্ডা হ। এছাড়া আর উপায় নাই। তুই আমার কথামতো কাজ করে দেখ না একবার; তারপর অদিতি তোরই; গ্যারান্টি।’
ধ্রুব চোখ ছোট ছোট করে তাকালো; বলল——-‘যদি তোর এই আজগুবি প্ল্যান ঠিকঠাক কাজে না লাগে, তোকে তো আমি খাইসি।”
ইমন হেসে, আত্মবিশ্বাসী গলায় বললো———‘করবে বাপ; করবে। তুই জাস্ট আমি যা বলছি ঠিকঠাক করে যা।”

সন্ধ্যা থেকেই অদিতির ঘরে সাজসাজ রব। ছেলেপক্ষের জন্য নতুন কাপড়, মিষ্টি আর খাবারের আয়োজন চলছে। অদিতির মা ব্যস্ততায় শ্বাস ফেলার সময়-টুকুও পাচ্ছেন না। আর অদিতি? সে চুপচাপ, তার মুখ থমথমে। খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গাছের দুলতে থাকা পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মনে এক অদ্ভুত শূন্যতা। ধ্রুবকে অত্যন্ত স্বাভাবিক লাগছে; বরং মনে হচ্ছিল ধ্রুব নিজে এই বিয়েটা নিয়ে ভীষণ আনন্দিত। অদিতির মুখটা থমথমে হয়ে এলো। হবে না কেন আনন্দিত! এক সময় যে ছেলে অদিতির সঙ্গে সামান্য কথা বলার জন্য মরিয়া হয়ে ছিল, তাকে অদিতি পরিবারের দোহাই দিয়ে পাত্তা দেয়নি। ধ্রুব অদিতিকে ছেড়ে দিলেও আজ অদিতি অবাক হবে না। অদিতিদের সঙ্গে তো এমনই হওয়া উচিত!
ধ্রুব ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে চেয়ার সাজাচ্ছে; হঠাৎ ওর চোখ গেল জানালার দিকে; অদিতিকে দেখে ও। ঠোঁটে একবারেও হাসি নেই; চোখ-দুটো মলিন! ধ্রুব চেয়ার হাতে নিয়ে সেভাবেই দাড়িয়ে রইলো; বিড়বিড় করে বলে গেল ——‘তোমার চোখ আমাকে ভালোবাসে ঠিকই; কিন্তু তোমার ঠোঁট আমার সঙ্গে বারবার বেইমানি কেন করে; অদিতি।’

ধ্রুব অদিতির দিকে তাকিয়ে ছিলো! অদিতির এলোমেলো দৃষ্টি হঠাৎ রে গেল ধ্রুবর চোখে; অদিতি সোজা হয়ে দাড়িয়ে মলিন হাসল। ধ্রুব চোখ নামিয়ে; ছোট করে শ্বাস ফেলে ভেতরে চলে গেল। অদিতি কিছুটা অবাক হয়ে গেল—- ধ্রুব কি ওকে পাশ কাটিয়ে; এড়িয়ে গেল এইমাত্র?
রাত হতেই গোটা গ্রাম হয়ে গেলো জমজমাট। তোফাজ্জল হায়াতের উঠোনে মানুষের ভিড়, আলো ঝলমল করছে। কিন্তু অদিতি নিজের ঘরে সাদা চাদরের ওপর বসে আছে। তার চোখ ফোলা, মুখ শুকনো। বারবার মনে পড়ছে ধ্রুবর সেই গম্ভীর মুখ, সেই নিরাসক্ত গলা।

ওদিকে ধ্রুব খাবারের তদারকি করছিল। তোফাজ্জল সারাদিন ধ্রুবর কাজ দেখে যারপরনাই খুশি! কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করলেন না। তিনি ধ্রুবর কাছে এগিয়ে গেলেন; ধ্রুব উনাকে দেখেই আগবাড়িয়ে বলল ——‘ আংকেল মশলাপাতি কম হয়েছিল; আমি এক্সটা আনিয়ে রেখে দিয়েছি। আর চিকেন এক্সট্রা লেগেছে; ওগুলো আনতে পাঠিয়েছি বাজারে।’
তোফাজ্জল ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলেন ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব বাজারের এক্সট্রা ফর্দ এগিয়ে দিল উনার দিকে। তোফাজ্জল সেটা হাতে নিলেন; একবার দেখেই আবার ভাঁজ করে পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিলেন।
ধ্রুব আরও কিছু বলবে; তার আগে তোফাজ্জল শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে বসলেন——‘ তুমি আমাদের জন্যে এসব কেন করছো? কি উদ্দেশ্যে?’

ধ্রুব থেমে গেল; কি বলবে এখন? ওর মন বেপরোয়া হয়ে গেল হঠাৎ; বলতে চাইল নিজের আসল উদ্দেশ্য; কিন্তু বলতে পারেনা এবারেও। ও মাথাটা নিচু করে ফেলে: দোনামনা করে বলে——‘নিজের শান্তির জন্যেই করছি আমি। আপনাদের আমার অনেক আপন মনে হচ্ছিল; তাই করছি। এর অন্য কোনো উ..উদ্দেশ্য নেই।’
তোফাজ্জল এবার কিছুটা গলে গেলেন। যতই হোক! গ্রামের মানুষ তো। সহজেই লোককে বিশ্বাস করা উনাদের কাজ; যাকে একবার মনে ধরে তার প্রতিটা কাজ তখন চোখে পরে একে একে। তোফাজ্জল ধ্রুবর কাঁধে হাত রাখলেন।আবেগ যেটুকু প্রকাশ না করলেই নয় সেটুকু প্রকাশ করে বললেন ——‘তোমার কি আর বাকিদের মতো মনে হচ্ছে আমি খুব তাড়াহুড়ো করছি?’

ধ্রুব অবাক হলো——‘ জি আংকেল?’
তোফাজ্জল আবারও বললেন—-‘বাকিরা আমাকে দোষারোপ করছে; আমি মেয়েকে অল্প বয়সে নিজের কাছ থেকে বিদায় করে দিচ্ছি।’
ধ্রুব চোখ নামিয়ে নিচু গলায় বলল ——‘আমি এসব ভাবি নি আংকেল।’
তোফাজ্জল থামলেন; পরপর গম্ভীর স্বরে বলে যেতে লাগলেন—-‘ সবাই আমার সিদ্ধান্তে খুশি নয়। কিন্তু আমার আজকাল ভয় হয় ভীষণ! অদিতিকে বিয়ে দিয়েই আমার মুখ বাঁচে। আজকাল গ্রামের মানুষ আমার দিকে বাঁকা নজরে তাকায়—কেউ কেউ অপেক্ষা করছে আমার মেয়ের প্রেমের খবর রটানোর। তাই আমি ঠিক করেছি- আমি আজকে ওদের আকদ করিয়ে দিয়ে গ্রামের লোকদের মুখ বন্ধ করে ফেলতে পারে।’

ধ্রুব চুপচাপ শুনে গেলো এসব কথা; ও শান্ত চোখে চেয়ে তোফাজ্জলকে দেখে। তোফাজ্জল হয়তো বাইরে যতটা কঠোর প্রকাশ করেন; ভেতরে ভেতরে ততটাও নন। তার মধ্যেও আবেগ; ভালোবাসা আছে; তবে সম্মান হারানোর ভয়টা গ্রাস করেছে তার অন্তর সবচেয়ে বেশি। ধ্রুব অপরাধবোধে ভুগে ভীষণ;ও এসব কি করছে? ইমনের বুদ্ধি নেওয়াটা কি উচিত হয়েছে? তোফাজ্জল জানতে পারলে: কষ্ট পাবেন ভীষণ। ধ্রুব হালকা স্বরে বলে—-—‘ডোন্ট ওরি আংকেল; আকদ আজকেই হবে।’

তোফাজ্জল ধ্রুবর কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে ফেললেন; গলা পরিষ্কার করে বললেন ——‘ভালোয় ভালো সব কাজ মিটে গেলেই হয়। তুমি এদিকটা দেখো; আমি ঘর থেকে আসি।’
অদিতি জানালার দিকে তাকিয়ে নিজের আতঙ্ক ঢেকে রাখার চেষ্টা করছিল। ঠিক এমন সময় ধ্রুব খাবারের দিক সামলে উঠোনে এলো। ঘড়িতে প্রায় সন্ধ্যা। ছেলেপক্ষ আসার কথা, কিন্তু কেউ এখন অব্দি এসে পৌঁছায়নি। লোকজন কৌতূহলী হয়ে আছে। তোফাজ্জলের অন্তর এইপর্যায়ে মোচড় দিয়ে উঠল! তিনি কল লাগালেন ফারদিনকে। ওপাশ থেকে কল ধরতেই তোফাজ্জল শুরুতে শান্ত থাকার চেষ্টা করে বললেন——‘তোমরা কোথায় আছো?’

ফারদিন অকপটে জবাব দিল ——‘চাচা, আমি দুঃখিত। পারিবারিক কারণে আমি এই বিয়ে করতে পারব না। আমি পর্তুগাল চলে যাচ্ছি, ওখানেই সেটেল হওয়ার পর বিয়ের চিন্তা করব। আমাদের পরিবার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আপনি যদি কিছু মনে না করেন…’
অদিতির বাবা এসব শুনে রেগে গেলেন ভীষণ। পুরো উঠোন স্তব্ধ তখন। সবার মুখে চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। তোফাজ্জল শেষ দেখে একটু দূরে গিয়ে নিচু কণ্ঠে বললেন ——‘গ্রামের মানুষদের দাওয়াত করা হয়ে গেছে ফারদিন; মশকরার সময় না এখন।’

তোফাজ্জল থেমে আবার বললেন —— ‘তোমার বাবা কোথায়? ওকে ফোন দিয়ে কেন পাচ্ছিনা? আমি ভেবে পাচ্ছিনা- তোমরা কথা দিয়ে এভাবে কিভাবে কথার বরখেলাপ করতে পারো।’
ফারদিন নম্র গলায় জবাব দিল ——‘আমি আসলেই অনেক দুঃখিত চাচা। পুরো সিদ্ধান্ত আমার; আব্বার এতে দোষ নেই। আমার প্লেনের টিকিট আজ রাত ১০টায়; আমি এয়ারপোর্ট যাচ্ছি চাচা। আপনার মেয়ের জন্য আশা রাখছি আমার চেয়ে ভালো কাউকে খুঁজে পাবেন।’
তোফাজ্জল আর শুনলেন না; উনার মুখ কঠিন হয়ে গেল। উনি ফোন কেটে দিলেন মুহূর্তেই। ধ্রুব পাশে দাঁড়িয়েই শুনছিল। যা হচ্ছে, ওর প্ল্যানমাফিক হচ্ছিল। ও এবার নিজের শেষ চালটা চালাল; তোফাজ্জলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল ——‘আংকেল; ছেলে আসবে না?’

তোফাজ্জলের রাগে কাঁপছেন; উনি কঠিন গলায় কাপতে কাপতে বললেন ——‘বেইমানি করেছে ওরা আমার সঙ্গে- ওদের এতো বড় সাহস কি করে হলো আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।’
ধ্রুব বলল ——‘আংকেল; গ্রামের মানুষ জানে আজ আকদ! এভাবে বিয়ে ভেঙে গেলে——আপনি বললে আমি ওকে শহর থেকে নিয়ে আসতে পারি।’
ধ্রুব এমনভাবে কথা বলছে- যেন ও কিছুই জানে না এ ব্যাপারে। তোফাজ্জল উঠে দাঁড়ালেন; লুঙ্গি সামলে নিয়ে শান্ত গলায় শুধু বললেন——‘আমাকে ভাবতে দাও।’

ছেলেপক্ষ না আসার খবর পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। চারদিকে গুঞ্জন, কানাঘুষা। তোফাজ্জল হায়াতের কপালে ঘাম জমেছে। তিনি নিজের সম্মানের কথা ভেবে গম্ভীর মুখে চুপ করে বসে আছেন। কিন্তু চারপাশের গ্রামবাসীর খোঁচা কথা তার মুখ আরও ফ্যাকাসে করে তুলছিল।
একজন তো বলেই ফেলল ——‘বড় গলায় সবাইকে জানালেন বিয়ে হবে। আর এখন জামাই না করে দিয়েছে।’
তোফাজ্জল দাঁতে দাঁত চেপে সব শুনছিলেন। অপমানে তার মুখ লাল হয়ে উঠছিল। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, ভেতরে চলে গেলেন। ক্ষোভের খবর ফাহিমার কানে পৌঁছতেই ফাহিম দ্রুত শোবার ঘরে সামির কাছে আসলেন। তোফাজ্জল জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। ফাহিমা গিয়ে তোফাজ্জলের কাঁধে হাত রাখলেন; তোফাজ্জল কেঁপে উঠলেন। ফাহিমা বললেন——‘ভেঙে পড়বেন না। পাত্রের অভাব নেই দেশে। আমরা অদিতিকে এর থেকেও ভালো জায়গায় বিয়ে দেব।’

তোফাজ্জল জবাবে বললেন——‘কিন্তু সম্মান যা যাওয়ার তা আজকেই চলে গেল ফাহিমা। সবাই জানে আজ আকদ! অথচ আজ সবাইকে যখন দাওয়াত করা হয়েছে, তখন ফারদিন কীভাবে মানা করতে পারল? আগে বললেই আমি একটা ব্যবস্থা করে ফেলতে পারতাম।’
ফাহিম হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে ; উনি তোফাজ্জলের মুখের রাগী ভাবের দিকে চেয়ে দোনামনা করে বললেন——‘আ..আমার কাছে ভালো পাত্র আছে। আপনি সাহস দিলে বলতে পারি।’
তোফাজ্জল তখন গা-ছাড়া ভঙ্গিতে বিছানায় গিয়ে বসলেন; বললেন——‘কে?’
ফাহিমা সরাসরি বলে ফেললেন ——‘ধ্রুবকে কেমন লাগে আপনার?’
তোফাজ্জল অবাক হয়ে ফিরে তাকিয়ে বললেন——‘কোন ধ্রুব? আমাদের মেহমান?’
ফাহিমা বললেন——‘হ্যাঁ; ও আজ বলছিল ভালো পাত্রী পেলে বিয়ে করতে চায়। আমাদের অদিতির সঙ্গে ওকে মানাবেও ভালো; একটু ভেবে দেখুন না?’

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২১

তোফাজ্জল শুনলেন; তারপর বিরক্ত হয়ে বললেন—-‘ এভাবে একটা অজানা মেহমানের সঙ্গে— বেশি বুঝো তুমি?’
ফাহিমা বসলেন তোফাজ্জলের পাশে; মতামত দিলেন——-‘একবার খোজ নিয়ে দেখতে সমস্যা কোথায়? ছেলে আপনার সামনেই; বরিশালে ভালো চাকরি করে। দেখতে শুনতেও ভাল; লম্বা-উচা। ওকে কোনোদিক থেকে খারাপ মনে হয়েছে আপনার?’
তোফাজ্জল তারপর কি যেন মনে করলেন; ফোন নিয়ে উনি কল লাগালেন কাউকে; ওপাশ থেকে সালাম এলো! তোফাজ্জল গম্ভীর স্বরে নির্দেশ দিলে ——-‘ধ্রুব ইয়ামিন সম্পর্কে খোঁজ নাও তো।’

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২৩