আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ৩৪
অবন্তিকা তৃপ্তি
তোফাজ্জল ধ্রুবর দিকে চেয়ে আবার সৌরভের দিকে তাকালেন। সৌরভ তোফাজ্জলের কঠোর-কঠিন মুখ-টুকু দেখে ঢোক গিলে বললেন ———‘আমার ছেলের জন্যে তোমার অদিতির হাত চাই। অদিতি মাকে আমার বাড়ির বউ করতে চাই সৌরভ!’
তোফাজ্জলের মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। ইফাজ চোখ বড় করে ধ্রুবর দিকে চেয়ে আছে। ওর ছোট-মোটো হৃদয় ভয়ে নিভে আছে।বিয়ের কথাটা শোনামাত্রই সঙ্গেসঙ্গে এক দৌড়ে ভেতরে অদিতির রুমে চলে গেলো ইফাজ।
তোফাজ্জল সৌরভের কথা শুনে অবিশ্বাস নিয়ে বললেন ——‘অসম্ভব! এ দাবি আমি মানতে পারব না।’
ধ্রুব চেয়ারের হাতল চেপে ধরে শীতল চোখে তাকিয়ে রইলো তোফাজ্জলের দিকে। সৌরভ তোফাজ্জলের অগোচরে চেয়ারের হাতলে রাখা ধ্রুবর হাত চেপে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। সয়রভের দিকে চেয়ে অনুরোধ নিয়ে বললেন ——-‘প্লিজ তোফাজ্জল! আমি তোমার কাছে কোনোদিন কিছু চাইনি! আমার ছেলে কিছু চেয়েছে তোফাজ্জল! ও মা মারা যাবার পর ওকে আমি এখন অব্দি কিছু দিতে পারিনি!তোমার মেয়েটা এত সরল-সহজ। আমার ছেলেটার লাইফ শুধরে যাবে। ছেলেটার একটা হিল্লে করতে না পারলে তোমার প্রয়াত ভাবি আমাকে কোনোদিন মাফ করবেন না তোফাজ্জল! আমাকে দয়া করো! দয়া করে; করুনা করে নাহয় তোমার মেয়েটাকে দাও!’
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
তোফাজ্জল দাঁড়িয়ে গেলেন! ধ্রুবর দিকে তীক্ষ চোখে চেয়ে; অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। নিজের সন্দে অটুট থেকে সরাসরি বললেন ——-‘আমার মেয়ের বিয়ে কালকে! দাওয়াত খেতে আসায় আমি ভীষণ খুশি হয়েছি! আমাকে আর এসব বলে লজ্জা দিয়ো না সৌরভ! তোমরা বসো। আমি তোমাদের জন্যে খবরের ব্যবস্থা করছি!’
তোফাজ্জল এটা বলার সাথেসাথে লুঙ্গি সামলে বাইরের ঘরে চলে গেলেন! সৌরভ হতাশ গলায় ছেলের দিকে তাকালেন! ধ্রুব তোফাজ্জলের যাওয়ার দিকে চেয়ে ব্যাকুল ভন্যিতে আবার সৌরভের দিকে তাকাল। সৌরভ হতাস চোখে ধ্রুবর দিকে তাকালে; ধ্রুবর এবার উনার কিছু বলার আগেই বলে ফেলল———‘নো; নো! আমি কিছু শুনতে চাইনা! তুমি জানো তুমি এ বিষয়ে আমাকে হেল্প না করলে আমার হেল্প ফিউচারের জন্যে তুমি ভুলে যাও! এন্ড অ্যাই মিন ইট!’
বলে ধ্রুব সৌরভকে আর কিছু বলারই সুযোগ দিল না, চুপ করে উঠে গেলো চেয়ার থেকে। উঠোনের দিকে যেতেই দেখে জানালার ফাঁকে অদিতি দৌড়ে এসেছে! ধ্রুব ওর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল! অদিতির চোখ ভেজা! ধ্রুব ঢোক গিলে! অদিতিকে কি খুব বেশি কেদেছে? হৃদয়টা যেন নড়ে উঠল ওর। ধ্রুব নরম চোখে তাকিয়ে এগিয়ে গেল। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়াল!
মাঝখানে গ্রিল; গ্রিলের ওপাশে দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা! ধ্রুব গ্রিলের ওপাশে হাত বাড়িয়ে আঙ্গুলের ডগায় অদিতির চোখের পানি আঙুলে নিয়ে টোকা দিয়ে ফেলে বলল——-‘ইউর টিয়ার্স হার্টস মি! এই এইখানটায়!’
বলে ধ্রুব আঙুল দিয়ে নিজের বুকের বা পাশ ইশারা করল। ধ্রুবর চোখ ছোট হয়ে আছে; কপাল কুঁচকে; অসহায় এক ভঙ্গিতে চেয়ে আছে অদিতির দিকে। ওমন মুখ-ভঙ্গি দেখে অদিতি কান্নার মধ্যেও মাথাটা নিচু করে নিশব্দে হেসে ফেলল!
ওই হাসিতে ধ্রুব কুপোকাত! সেও হাসল! তারপর গ্রিলের ওপাশেই অদিতির কপালে নিজের কপালটা ঠেকালো। অদিতির আবার কান্না আসছে। ধ্রুব কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে জোরে জোরে নিঃশ্বাস টানছে। ধ্রুব একপর্যায়ে ঠান্ডা গলায় বলে——-‘কেঁদেছিলে কেন?’
কথাটা বলার সাথেসাথে অদিতির গাল বেয়ে আরেক ফোটা জল গড়ালো। ধ্রুবর গালে এসে লাগলো ওই জল। ধ্রুব দ্রুত মাথা সরিয়ে অদিতির দিকে তাকিয়ে অস্থিরভাবে দু গাল চেপে; চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো———‘ওকে; ওকে! ডোন্ট ক্রাই! অ্যাই ওয়াজ জাস্ট আস্কিং! ডোন্ট ক্রাই! হু? চোখ মুছো!’
অদিতি চোখ মুছে না; ফুপিয়ে উঠে বলল ——-‘এই বিয়ে হলে আমি ম-রে যাব ধ্রু…’
ধ্রুব অদিতির ঠোঁটে আঙুল চাপল; থেমে গেল এই মেয়ের কণ্ঠের সকল শব্দ। শুধু অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব বোঝাল সময় নিয়ে—-—‘হুশ! আমি আছি; রাইট? ডোন্ট ই্যয়ু ট্রাস্ট মি?
অদিতি মাথা নাড়ল; যার অর্থ সে বিশ্বাস করে ধ্রুবকে। ধ্রুব হাসার চেষ্টা করে বলল ———‘আমায় বউ আমি কাউকে দিব না; ই্যয়ু নো দ্যাট। আজ এলাম; কাল তুমি আমার ঘরের বউ হয়ে আমার ঘরে থাকবে। প্রমিজ!’
অদিতিকে ধ্রুব সেবার বেশ সময় নিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে।
উঠোন থেকে ফিরে ধ্রুব বসার ঘরে এসে দেখে সৌরভ-তোফাজ্জল কেউ নেই! চেয়ারে বসতে বসতে ইমনের দিকে চেয়ে বলল ———‘এরা কোথায়?’
ইমন আইসক্রিম খেতে খেতে জবাব দিল——-‘আঙ্কেল তোর শশুরের সাথে কথা বলতে ভেতরের ঘরে গেছে।’
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে ফেলল। পাশ থেকে সুমন বিরক্ত গলায় বললো——-‘ভাই; আপনার শশুর এত্ত ঘাড় ত্যাড়া ক্যান?’
ধ্রুব উত্তরে চোখ উল্টে হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল ———‘এই বিয়ে হলে অ্যাই সয়ার উনাকে আমি শেখাব বেস্ট বাবা হওয়া কাকে বলে। আমি কক্ষনো আমার চাইল্ডদের সাথে এত রূড হবো না; ডিফেনেটলি।’
পাশ থেকে রাজন টিপ্পনি কেটে বলল ——-‘বাপের দিক থেকে ভাবি কিন্তু আমাদের এক্কেরে সেরা! কোনও প্যাচ নেই; সরল সোজা! আর বাপ;পুরাই এক হিটলার!’
ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন পকেট থেকে বের করে স্ক্রোল করতে লাগলো।
ইমন এবার সিরিয়াস হয়ে জিজ্ঞেস করলো ——‘ভাবির সাথে দেখা হয়েছে তোর?’
ধ্রুব ফোনে কিছু একটা টাইপিং করছে! চোখ-মুখ ভয়াবহ গম্ভীর; দাঁত দিয়ে ঠোঁটের এক কোন চেপে ভ্রু কুঁচকে টাইপিং করছে। সেভাবে থেকেই উত্তর দিল——-‘হু!’’
ইমন একটু অস্বস্তি নিয়ে বললো——-‘ঠিক আছে?’
ধ্রুব মোবাইল থেকে মাথা তুলল; জবাবে ছোট শ্বাস ছেড়ে বললো———-‘ঠিক আছে? কাঁদছে! অনেক কষ্টে সামলে এসেছি।’
ইমোন হেসে ফেলল হঠাৎ! বলল ———‘ভাই তুই জেলাস হোস না। আমার না অদিতির জন্যে আসলেই দুঃখ লাগে। ও আর দুনিয়ায় ছেলে পেলো না! তোরেই ক্যান…’
ধ্রুব বাকি কথা শোনার আগেই নিজের পেছন থেকে একটা সোফার কুশন ছুড়ে ফেলল ইমনের মুখের উপর; খ্যাকিয়ে উঠল——-‘শাট অ্যাপ!’
ইমন কুশন চেপে ধরে ধরে হাসছে রাক্ষসের মতো!
কেটে যায় ঘন্ট! সৌরভ-তোফাজ্জল এখনও বদ্ধ ঘরে কি কথা বলছেন কেউ জানে না। ওদিকে ধ্রুব প্রায় অস্থির তখন! নখ খুঁটিয়ে বারবার বাইরের তাকাচ্ছে। ওর মন-মেজাজ এই মুহূর্তে চুড়ান্ত চঞ্চল!
ঠিক ওই মুহূর্তে ইফাজ পাশ দিয়ে যেতেই; ধ্রুব দ্রুত ডাকলো————‘শালবাবু? এদিকে আসো!’
ইফাজ ডাক শুনে দৌড়ানো থামালো। সতর্ক ভঙ্গিতে আশপাশটা দেখে নিল! কেউ নেই আশেপাশে; ভেবেই স্বস্থির শ্বাস ফেলে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। ইফাজ ধ্রুবর পাশে এসে দাঁড়াতেই; ধ্রুব ওকে নিজের হাটুর উপরে বসিয়ে দিল! ইফাজের ঝাকরা চুল এলোমেলো করতে করতে বলল ——-‘তোমার বাবা কোথায়? ঘরের দরজা বন্ধ এখনো?’
ইফাজ মাথা নাড়ল——‘না তো! একটু আগেই বেড়িয়েছে। আংকেল আর আব্বু আপুর ঘরে এখন। আপুর সঙ্গে কি কথা বলছে যেন।’’
ধ্রুবর ভ্রু কুঁচকে গেলো মুহূর্তেই। এরা অদিতির ঘরে করছেটা কি? অদিতিকে কিছু উল্টাপালটা জিজ্ঞেস করছে? এমনিতেই এই মেয়ে যা সেনসিটিভ! হতে পারে; কেঁদে-কেটে বেহাল অবস্থা করে ফেলেছে নিজের।
ধ্রুব নিজের বেপরোয়া চিন্তা-গুলোকে চাপা দিয়ে; অস্থির ভাবে বলল——‘তুমি গিয়ে লুকিয়ে শুনে আসতে পারবে কি কথা হচ্ছে ওখানে?’
ইফাজ সঙ্গেসঙ্গে আঁতকে উঠে বলল ——-‘না না! আমার ঠেঙ্গাবে আব্বু।’
ধ্রুব এ কথা শুনে পকেট থেকে একটা মিউজিক ট্যাপ বের করল! আসার সময় ইফাজের জন্য গিফট হিসেবে এনেছিল! ইফাজের সামনে সেটা নাড়িয়ে-নাড়িয়ে দেখিয়ে বলল ——‘তোমার জন্যে এনেছি। ১০০+ মিউজিক আছে এটাতে। লাগবে তোমার?’
ইফাজের মুখটা চকমক করে উঠলো। ও নেচে উঠে বলল ——‘দেবের গান আছে এটায়?’
‘দেব?’ —- ধ্রুব প্রথমে চিনল না; ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
পরপর বলল ———‘যার গান ইচ্ছে; ডাউনলোড করতে পারবে তুমি; মেমোরি আছে এটাতে।’
ইফাজের খুশি কে দেখে! পরপর ওর খুশি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল; মুখটা হুতোম পেঁচার ন্যায় করে বলল ——‘আমাকে যেতে হবে আপুর রুমে?’
ধ্রুব ঠোঁট উল্টে; অবুঝের ন্যায় দু-কাঁধ ঝাকাল; যার অর্থ হ্যাঁ! ইফাজ কি করবে আর! অগ্যতা ধ্রুবর কোল থেকে নেমে গেলো! তারপর এক দৌড়ে গেলো অদিতির রুমে! দশ মিনিট পরে ফিরে এলো ও! এসেই ধ্রুবর সামনে হাপাতে শুরু করেছে; পালিয়ে এসেছে বোঝাই যাচ্ছে!
ধ্রুব ওর দিকে চেয়ে আছে; চুড়ান্ত আগ্রহ নিয়ে! ধ্রুবর নিজেরই বুক ধুকপুক করছে। ইফাজ শ্বাস ফেলে নিজেকে ঠান্ডা করলো। ধ্রুব পানি এগিয়ে দিল। ইফাজ সেটা নিল না; বরং চঞ্চল ভঙ্গিতে এক স্যাস বলল ———‘ওরা অপুকে জিজ্ঞেস করছে; আপু তোমাকে বিয়ে করতে রাজি কিনা। ‘
‘কি?’ ——- সুমন চেঁচিয়ে উঠল! পাশ থেকে ইমন ফল খাওয়া থামিয়ে হা করে ইফাজের দিকে তাকাল! রাজনের রীতিমত থুতনি ঝুলে গেছে!
ধ্রুব নিজেও চুড়ান্ত হতবম্ব! ও নিজের হতবাক ভাব-টুকু কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করে; ঢোক গিলে শিউর হতে আবারও বলল ——‘শি…শিওর তুমি? এটাই শু..শুনেছো?’
ইফাজ প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল ——‘হ্যা তো! আপুও অবাক হয়েছে!’
ধ্রুব অনুভব করছে; ওর হাত কাপছে। গলাও কাপছে; ধ্রুব কম্পিত গলায় বলল ——‘তোমার আপু কি বলেছে উত্তরে?’
ইফাজ এক শ্বাসে জবাব দিল——-‘রাজি আপু!’
‘হুহোহো!’—— পাশ থেকে বাকি তিনজন চেঁচিয়ে বলে উল্লাসে মেতে উঠলো! ইমন এসে ঝাপিয়ে পরেছে ধ্রুবর গায়ে। বাকিরাও একে একে ধ্রুবর গায়ের উপর পরে উল্লাস করছে। ধ্রুবর শরীর স্তব্ধ হয়ে গেছে রীতিমত; ও ঢোক গিলে চোখ বুজে পরপর হেলে পরলো সোফাতেই!
ওর চোখ-দুটো বুজে,শ্বাস অস্থির; অশান্ত! সোফার হাতল চেপে রাখা হাত রীতিমত কাঁপছে! ইমন ওর কেঁপে কেঁপে উঠা হাত চেপে ধরল খুশিতে! ধ্রুব চোখ খুলে টলমলে চোখে তাকালো ইমনের দিকে! ইমন খুশিতে যেন নাচছে!
ও ধ্রুবর হাত ধরে হেসে বললো——-‘শালা; ঢং করস কেন এখন! বিয়ে করছিস; ট্রিট চাই আমাদের! জনে ১০,০০০ হাজার!’
ধ্রুবর বুক এখন কাঁপছে! ও তাকিয়ে রইল শুধু! বিশ্বাস হচ্ছে না ওর! ধ্রুবর এডামস অ্যাপল বারবার উঠছে-নামছে। ওর বুকের হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক না; চুড়ান্ত বেগে ছুটছে। ধ্রুব সোফার হাতল আঙ্গুলের নখে খামচে ধরলো পরমুহূর্তে!
সৌরভ এসে বসলেন ধ্রুবর পাশে! ধ্রুব তখন সোফায় বসে মুখে দু-হাত চেপে চুপচাপ বসে রয়েছে। চোখ-দুটো চুড়ান্ত শীতল! সৌরভ এসে সোজা ধ্রুবর সামনে দাড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললেন ———-‘রেডি হও; কাজী আসছে!’
ধ্রুব মাথা তুলে তাকালো! পাশ থেকে ইমন বলল ——-‘এক্ষুনি বিয়ে? ক্যামনে কি?’
সৌরভ উত্তর দিলেন——-‘তোফাজ্জল জানতে পেরেছেন শহরে অদিতির কোনো প্রেমের সম্পর্ক আছে। তাই ও দ্রুত অদিতির বিয়েটা দিয়ে দিতে চাইছে। আজ বিয়ে করে ওরা এখানেই থাকবে; আগামীকাল আমরা অদিতিকে বাড়ি নিয়ে যাব। এক সপ্তাহ পর আমাদের পক্ষ থেকে রিসেপশন করা হবে।’
ধ্রুব শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! ওর মুখে একটা শব্দও কেন যেন এখন আর আসছে না। ওর হাত-পা এখনো অস্বাভাবিক কাঁপছে! নিজেকে স্থির-ই করতে পারছে না।
ইমন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো———‘আংকেল; আপনি উনাকে রাজি করালেন কিভাবে? এটা তো অসম্ভব ছিল!’
সৌরভ রহস্য করে হাসলেন; ধ্রুবর দিকে তীক্ষ চোখে চেয়ে বললেন ———‘অবশ্যই জানবে একদিন! সময় আসুক; ততদিন সবুর করো; আর বন্ধুকেও সবুর করতে বলো!’
আধা ঘন্টার মাথাতেই সেদিন কাজী আসলো! ধ্রুবকে শেরওয়ানি গ্রামের বাজার থেকেই কিনে দেওয়া হয়েছে।অদিতির জন্যে আসার পথে তৃণা তখন কি মনে করে ধ্রুবর মায়ের বিয়ের বেনারসি শাড়িটা এনেছিলেন! হয়তবা মনে করেছিলেন; ধ্রুব যা জেদ; আর ওর বাবা সৌরভ ছেলের প্রতি যতটা অন্ধ! তাতে এই বিয়ে কেউ হওয়া থেকে আজ কেউই আটকাতে পারবে না সম্ভবত। আসার পথে এই বেনারসি আনার জন্যে; যখন ধ্রুবর থেকে ওর মায়ের আলমারির চাবি চেয়েছিলেন; ধ্রুব সরাসরি মানা করেছে। পরে অবশ্য নিজে চাবি দিয়ে আলমারি খুলে; নিজেই বেনারসি খুঁজে বের করে নিজেই ইস্ত্রি করেছে; তারপর প্যাকেট করে নিজে গাড়িতে নিয়েছে। একদিকে ভালো হয়েছে; বেনারসি আনায় কাজে লাগছে!
ধ্রুব ধবধবে সাদা রঙের; সোনালি কারুকাজ করা শেরওয়ানি গায়ে সোফায় বসে আছে! ওর মুখ ভয়ঙ্কর গম্ভীর! চোখ-দুটো লাল; রক্তিম! ইমন সব কাজ সামলে ধ্রুবর পাশে বসল! সেই তখন থেকে ধ্রুবকে এতটা নীরব-শান্ত দেখে ও কিছুটা চিন্তিত হয়ে গেল!
ধ্রুবর কাঁধে হাত রাখল———‘অ্যাই ধ্রুব; ঠিক আছিস তুই?’
ধ্রুব উত্তর দিল না! ইমন আবার ডাকলো——‘অ্যাই ধ্রুব!’
ধ্রুব টলমলে চোখে পাশ ফিরে ইমনের দিকে তাকাল! ইমন ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে ধ্রুবর দিকে। অনেকক্ষণ পর ধ্রুব এবার মুখ খুললো; কম্পিত কণ্ঠে স্রেফ বললো ——-‘ব..বিয়েটা কি সত্যিই হচ্ছে ইমন?’
ইমন ভ্যাব্যাচ্যাকা খেয়ে গেলো! ধ্রুবর দিকে চেয়ে অবিশ্বাস নিয়ে বললো—-—‘ভাই তুই ভাবির বাপের দেওয়া বিয়ের শেরওয়ানি পরে আছিস! কাজী ওই ঘরে তোর বিয়ের কাবিননামা রেডি করছে! বাস্তবে ফির ভাই!!’
ধ্রুব জবাবে কিছু বলল না! ওর চোখ অন্যরকম হয়ে গেছে আজ! চেনাই যাচ্ছে না ধ্রুবকে! ধ্রুব চুপ হয়ে গেল; আর কথাই বাড়াল না! ইমন মাথা নিচু করে দেখে— ধ্রুবর হাত কাপছে! ইমন অবাক হয়ে চেয়ে রইল ধ্রুবর মুখের দিকে! ভালোবাসা ধ্রুবকে কবে এতটা দূর্বল করে ফেলল! এই ধ্রুবর সঙ্গে ছয় মাস আগের ধ্রুবর সঙ্গে কোনো মিল নেই; বিন্দুপরিমাণ মিলও নেই! অদিতির হাতে ওই বখাটে ধ্রুব আরো চার-মাস আগেই খু-ন হয়ে গেছে!
অদিতি নিজের রুমে! কাজী অদিতির রুমে আগে নেওয়া হল!
অদিতি ধ্রুবর মায়ের লাল বেনারসি পরে বসে আছে বিছানায়! মুখে সামান্য সাজ! জুয়েলারি বলতে চিকন গলার হার; আর হাতে তৃণার পরিয়ে দেওয়া আংটি!
ঠিক এই মুহূর্তে; অদিতির কি মনে হচ্ছে সেটা স্বয়ং অদিতি নিজেও জানে না। ওর চোখ-মুখে এখনও বিস্ময়! ও বারবার হাত দিয়ে নিজের শাড়ি ছুঁয়ে দেখছে; আংটি ছুঁয়ে দেখছে। এসব…এসব সত্যিই ধ্রুবর নামে পরেছে ও? ওই বখাটে ধ্রুব ইয়ামিনের নামে? ধ্রুব; অদিতির ওই পাগলাটে প্রেমিকের নামে আজ অদিতি কবুল বলবে? এটা সত্যি বাস্তব তো? অদিতির ভীষণ মাথা ঘুরাচ্ছে এই মুহূর্তে! শরীরটা হেলে পড়তে চাইছে যেন। বহু-কষ্টে নিজেকে ধরে রেখেছে ঘর-ভর্তি মানুষের সামনে।
ফাহিমা একটা প্লেটে খেজুর এনে রাখলেন টেবিলে! তৃণা বাথরুমে গেছে! সেই সুযোগে ফাহিমা অদিতির কাছে এগিয়ে মাথায় শাড়ির আঁচল ভালো করে টেনে ফিসফিস করে বললেন——-‘শহরে যে ছেলের সঙ্গে তোর সম্পর্ক ছিলো; ওই ছেলেটা কিন্তু তোর খবরও নেয়নি। এই যে তোর বিয়ে হচ্ছে; ভালবাসলে এই কথা সে কোনোভাবে না কোনোভাবেই জানতে পারতো। ওই ছেলে খবর নিল একবারও? শোন অদিতি; ধ্রুব ভালো ছেলে! ওদের পরিবার বড়! তুই সুখে থাকবি! ধ্রুবকে যদি কষ্ট দেওয়ার চিন্তা করে থাকিস; আগেই বলে রাখছি এসব উল্টাপালটা চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল এক্ষুনি। ছেলে ভালো; মন দিয়ে সংসার করবি! আমি যেন আমার মেয়ের নামে তার শশুরবাড়ি থেকে বদনাম না শুনতে পাই। তোর বাপ জীবিত আছে এখনও; বন্ধুর সামনে তার ইজ্জত খাইস না; দোহাই তোর!’
অদিতি শুধু শুনে গেল! ফাহিমা মেয়ের মাথায় আরো ভালো করে আঁচল তুলে দিলেন; কোমরের কাছের শাড়ি ঠিক করে দিলেন। অদিতির খুব ইচ্ছে হলো বলতে—- মা, ওই শহরের ছেলেটাই ধ্রুব মা. তোমার বলা,দেখা ভালো ছেলেটাই ধ্রুব! আমি যাকে ভালোবাসি; যাকে ভোলার জন্যে তোমরা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছো! কত বোকা তোমরা মা! ধ্রুব ইয়ামিনকে তোমরা চেনোই নি! সে এসেছে মা; আমাকে বিয়ে করার জন্যই সে এসেছে। ধ্রুব আমার ব্যাপারে কোনোদিন দায়িত্বহীন ছিলোনা! তোমার অদিতি ভুল কাউকে নিজের জীবনে বাছাই করেনি; মা!
ওসব আর বলা হলো না অদিতির। ফাহিমা বেরিয়ে যেতেই; তোফাজ্জল ডাকলেন উনাকে। ফাহিমা এগিয়ে গেলেন; তোফাজ্জল বললেন ——-‘কাজী অদিতির রুমে যাবে। তুমি গিয়ে বসো ওখানে। মেয়েকে বুঝিও; অতিরিক্ত কান্নাকাটি যেন না করে। কাজী গ্রামের লোক; কি না কি ভেবে বসে থাকবে।’
ফাহিমা মাথা নাড়লেন; তারপর আবার যেভাবে এসেছিলেন; ওভাবেই ফিরে গেলেন মেয়ের ঘরে। তৃণা তখন অদিতির পাশে বসে আছেন! অদিতি মাথাটা নামিয়ে রেখেছে; তৃণা তখন অদিতির কানে ফিসফিস করে বললেন ——-‘তোমার বরের এতো বুদ্ধি! লাভ ম্যারেজ-কে কি করে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ বানিয়ে দিলো! তোমরাও পারো বটে!’
বলে শব্দ করে হেসে উঠল তৃণা! ফাহিমার কানে ওদের হাসির আওয়াজ গেলো! ফাহিমা ঘরে ঢুকে মেয়ের পাশে বসলেন——‘কি নিয়ে হাসছেন ভাবি?’
তৃণা নিজেকে সামলে অদিতির দিকে চেয়ে মজা নিয়ে জবাব দিল——‘এইতো! বুঝাচ্ছি আপনার মেয়েকে. সংসার করবে যার সাথে সে কিন্তু এক পিস!’
ফাহিম সেটা শুনে গদগদ ভঙ্গিতে শুরু করলেন নিজের মেয়ের গুণগান——‘অদিতি এমনিতেও অনেক বুঝদার মেয়ে; ভাবি। রান্না পারে; ঘর গোছগাছ করে রাখে ছোটবেলা থেকেই। আপনারা একটু সাহায্য করলেই সংসার চালানোও শিখে যাবে। বুদ্ধি আছে ওর।’
তৃণা এসব কথা শুনে সঙ্গেসঙ্গে ফাহিমাকে থামিয়ে দিয়ে হেসে বললেন——-‘ও ঘরে অদিতি কাজ করতে যাবে না। ওর বরের সংসার করতে যাবে আপনার মেয়ে! বরকে খুশি রাখতে পারলেই; ওর কাজ শেষ!’
এটা শুনে ফাহিমা মলিন হেসে মেয়ের দিকে তাকালেন; চোখের চাহনিতেই শাসালেন —— পুরনো প্রেমিক তোর সংসারে আসলে; তোর খবর আছে।
অদিতি হতাশ শ্বাস ছাড়ল! ঠিক তখন তোফাজ্জল কাজী নিয়ে ঘরে ঢুকলেন!
কাজী অদিতির সামনে বসতেই; বুকের কাপুনি এবার যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল ওর। অদিতি আঙ্গুলের নখ দিয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরে চোখ বুজলো। কাজী অদিতির সামনে বসে সুরা পড়ছেন। আল্লাহর কালাম অদিতির কানে যাচ্ছে! শুনেছে আল্লাহর কালাম পড়েই নাকি একজন বিয়ের মাধ্যমে অপরজনের সঙ্গে সারাজীবনের জন্য জুড়ে যায়। অদিতিও তাহলে কালাম পরেই ধীরে ধীরে জুড়ে যাচ্ছে ধ্রুবর সঙ্গে! অদিতির চোখ টলমল করে উঠল। ও ঢোক গিলে বিছানার চাদর খাঁচা ধরতেই; তৃণা ওর অস্থিরতা বুঝতে পেরে হাত চেপে ধরলেন। অদিতির হাত কাপছিলো! তৃনা অদিতির পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ধীরে ধীরে ও শান্ত হয়ে এলো।
কাজী এবার জিজ্ঞেস করলেন——-‘দশ লক্ষ টাকা মোহরানা ধার্য করে সৌরভ ইয়ামিনের একমাত্র পুত্র ধ্রুব ইয়ামিনের সঙ্গে তোফাজ্জল হায়াতের কন্যা অদিতি হায়াতের বিবাহ ধার্য করা যাচ্ছে। কন্যা রাজি থাকলে বলুন, কবুল!’
অদিতির পুরো গা যেন কেঁপে উঠলো! অদিতি মনে হচ্ছে, ওর হৃদপিণ্ড বাইরে আসবে বুকে চিরে! এতটাই জোরে লাফাচ্ছে সেটা! মুখ থেকে শব্দই বেরোচ্ছে না আর! হাত কাঁপছে! তৃণা ওর কাঁপতে থাকা হাতটা চেপে ধরে; অদিতি চোখের জল ছেড়ে দিল। ফাহিমা বড্ড নরম গলায় বললেন——-‘ কবুল বলো, মা!’
অদিতি দুবার জোরে জোরে শ্বাস নিল; তারপর নিচু গলায় ধীরে ধীরে বলল——‘কবুল!’
‘আলহামদুলিল্লাহ!’ ——- কাজী সশব্দে বললেন!
সাইন করতে বলা হয়েছে অদিতিকে! অদিতি কলম হাতে বসে আছে। চোখের সামনে ভাসছে; কাবিননামায় লেখা —-‘ধ্রুব ইয়ামিন-অদিতি হায়াত’ নামটা! ঢোক গিলে তাকাল আবার অদিতি; চোখ থেকে কাবিননামার উপরেই এক ফোঁটা জল পড়লো। অদিতি ধীর হাতে নিজের নামটা সাক্ষর করে দিল বধূর জায়গায়!
তোফাজ্জল এতক্ষণে যেন স্বস্তির শ্বাস ফেললেন! কাজী চলে গেলেন ধ্রুবর কাছে। অদিতি কাজী যেতেই অদিতি ফুপিয়ে কেঁদে উঠল! ফাহিমা দুহাতে অস্থির অদিতিকে আগলে নিলেন! অদিতি মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে যায় ফুপিয়ে।
এখন থেকে ওর স্বামী ধ্রুব! ধ্রুবকে নিয়ে আর কোনো সংশয় নেই অদিতির! আর কেউ অদিতিকে কলঙ্কিনী বলবে না। আর কেউ অদিতি-ধ্রুবর সম্পর্কে আঙুল তুলবে না! অদিতি ধ্রুবকে নিয়ে খোলা রাস্তায় হাঁটলে কেউ বাঁকা চোখে দেখবে না। খুশিতে মরতে ইচ্ছে করছে ওর!
ধ্রুবও কবুল বলেছে! ও কবুল বলার সাথেসাথেই ইমন ঝাঁপিয়ে ধরল ধ্রুবকে! ধ্রুব নিষ্প্রাণ হয়ে তাকিয়ে আছে; নিজেদের কাবিননামার দিকে! যেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা ধ্রুবর পাশে; অদিতির নামটুকু! কাজী সাইন করার জন্যে কাবিননামা ধ্রুবর হাতে দিলেন। ধ্রুবর হাতে কলম; ওর নামের পাশে অদিতির নামের সাক্ষর! ধ্রুব কম্পিত হাতে সেই সাক্ষর-টুকু ছুয়ে দেখে! বুকটা এত বেপরোয়া গতিতে ছুটছে কেন? ধ্রুব কলম টেনে খসখসে আওয়াজ সাক্ষর করে দিল অদিতির নামের পাশের জায়গায়।
রাতে মেহমানদের খাবারের সময়-টুকুতে অদিতির শোবার ঘরটায় বাসর সাজানো হয়েছে! অদিতিকে তখন অন্য রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে! তৃণা অদিতিকে হালকা সাজিয়ে দিলেন! চোখে কাজল; ঠোঁটে হালকা রেড লিপস্টিক; ব্যাস এটুকুই! গলায় চিকন চেইন রয়ে গেছে; বেনারসিও এখনো গায়ে!
তৃণা সাজানো শেষে অদিতির কাঁধে থুতনি রেখে ওকে জড়িয়ে ধরে আয়নায় ওর দিকে তাকায়; হেসে মজা করে বলে ———-‘ধ্রুব কিন্তু সাজগোজ তেমন একটা পছন্দ করেনা। মানে ভারি মেকআপ আরকি! ওর বাবাও তেমন। কিন্তু আমি মেকআপ করি নিজের মর্জিতে; ঐক্ষেত্রে সৌরভের মত আমার বেলায় খাটেনা। তবে আশা করি তুমি আমার মতো নও! ধ্রুব যা বলে; আমার কাছে মনে হয় তুমি সেটাই মানো। রাইট?’
আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ৩৩
অদিতি লজ্জায় মাথাটা নামিয়ে নিল। তৃণা হেসে সরে গেল; একটা চেয়ার টেনে বসে অদিতির দিকে চেয়ে বললো———‘আমি ওর সৎ মা হলেও ধ্রুবর ব্যাপারে আমি অনেক কিছু জানি! সবটাই ওর বাবার জন্যে। সেই জ্ঞ্যান থেকে বলি— ধ্রুব বাসর ঘরে ঢোকার জন্যে অস্থির হয়ে আছে। খবর নিয়ে এলাম আমি।’
অদিতির বুক কেপে উঠলো মুহূর্তেই। আজ ওরা একসঙ্গে; এক ঘরে; এক বেডে শোবে!
ধ্রুব এমনিতেও যা অসভ্য; আজ কিভাবে সামলাবে নিজেকে! অদিতির সেসব ভেবে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে!