আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১১

আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১১
ইয়াসমিন খন্দকার

ঈশিতার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তামিম। ঈশিতার দৃষ্টিও ছিল অনড়। তাদের এহেন দৃষ্টি বিনিময় কারো নজর এড়ায় না। নাহিদ তামিমকে প্রশ্ন করে,”তোরা কি একে অপরকে চিনিস?”
নাহিদের এই প্রশ্নের বিপরীতে তামিম বেশ ঠান্ডা গলায় বলে,”ও আমার স্টুডেন্ট ছিল। একসময় ওকে টিউশনি পড়াতাম। এর থেকে বেশি কিছু না।”

❝এর থেকে বেশি কিছু না❞ এই কথাটা বারবার বাজতে থাকে ঈশিতার কানে। তার মনে তীব্র ব্যাথার সৃষ্টি করেছিল এই কথা। এক সময় তো সে ভালোবাসত এই লোকটাকে। অথচ লোকটা কখনো তার ভালোবাসার গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু তাই বলে তাকে এত সামান্য কেই ভাববে! ঈশিতা বাকরুদ্ধ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এদিকে আয়ুশের জন্মদিনের আয়োজন আবার শুরু হয়। সে কেক কে*টে সেই কেক সবাইকে খাইয়ে দেয়। এসব দৃশ্য ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে দেখছিল ঐশী। ঈশিতার নজর তামিমের দিকেই নিবদ্ধ। বারংবার আড়চোখে তামিমকেই দেখছিল সে। মন যেন বড্ড অবুঝ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আয়ুশ কেকের টুকরো নিয়ে ঈশিতার কাছে আসতেই সে বেশ দাম্ভিকতা দেখিয়ে বলে,”আমি কেক খাবো না। আমার পছন্দ না।”

আয়ুশও ঈশিতাকে এই ব্যাপারে জোর করে না। তবে তার ঈশিতার এমন ব্যবহার মোটেই ভালো লাগে না।
ঐশী সবার দৃষ্টির আড়ালে থাকলেও নাহিদের আঁখি যুগল ঠিকই খুঁজে নেয় তাকে। নাহিদ ঐশীর একদম কাছাকাছি গিয়ে বলে,”হ্যালো, কেমন আছ তুমি?”
“জ্বি, ভালো। আপনি?”
” আমিও। তা তুমি এখানে একা দাঁড়িয়ে কি করছ? সবাই ওখানে কত আনন্দ করছে।”
“আসলে আমার শরীরটা ভালো নেই।”
“সেকি কি হয়েছে?”

“তেমন কিছু না। একটু মাথা ব্যাথা করছে। আমার এত গ্যাদারিং ভালো লাগে না।”
নাহিদ আর কথা বাড়ায় না। অপলক দেখতে থাকে ঐশী। নাহিদের এহেন দৃষ্টি ঐশীকেও করে তুলেছিল অস্থির। তাই সে বলে,”আমি রুমে যাচ্ছি। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।”
কথাটা বলেই প্রস্থান করে। নাহিদ ঐশীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলতে থাকে,”কবে এই মায়াবতীকে আমি নিজের করে পাবো গো আল্লাহ!”

বর্তমানে সবাই খাওয়া-দাওয়ায় ব্যস্ত। আয়ুশ তার কিছু বন্ধু ও সহকর্মীর সাথে আড্ডায় ব্যস্ত। জাহানারা বেগম ও আলতাফ তালুকদারও অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত। ঈশিতার কাছে এটাই ছিল সুবর্ণ সুযোগ। সে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে তামিমের কাছে গেলো। তামিম ঈশিতাকে দেখে চলে যেতে নিতেই ঈশিতা বলে উঠল,”তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছ কেন তামিম ভাই? আমার সাথে কথা বলবে না।”

তামিম ধীর পানে ঈশিতার পানে তাকায়। ঈশিতাদের গ্রামে তারও বাড়ি। গ্রামের অন্যতম মেধাবী ছাত্র তামিম৷ বর্তমানে পড়াশোনা করছে ঢাকা মেডিকেলে। সে কলেজে পড়াকালীন ঈশিতা সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। সেই সময় ঈশিতার মায়ের কথায় তাকে গণিত পড়াতো তামিম। ঈশিতা যেহেতু মেধাবী ছাত্রী ছিল তাই তামিম তার প্রতি কনসার্ন ছিল৷ তাদের গ্রামের কোন মেয়েই ভালো স্তরে যেতে পারে নি। সবাই বাল্যবিবাহের ফলে অকালে ঝড়ে গেছে। তবে তামিমের আশা ছিল ঈশিতা গ্রামের মেয়েদের কাছের আইডল হয়ে উঠবে। কিন্তু সেই ঈশিতাও বিয়ে করে সংসারে ব্যস্ত হয়েছে। এই জিনিসটা তামিমকে ব্যথিত করেছে। এজন্য সে ঈশিতাকে এড়িয়ে চলতে চাইছে। কিন্তু ঈশিতা নিজে থেকে কথা বলতে আসায় আর এড়াতে পারল না। ঈশিতার উদ্দ্যেশ্যে বলল,”কেমন আছ তুমি?”
ঈশিতা মলিন হেসে বললো,”আমায় দেখে কেমন মনে হচ্ছে?”

তামিম হচকচিয়ে গেল। একটু থেমে বলল,”তোমার থেকে আমি এটা আশা করিনি ঈশিতা। তুমি কতো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলা। তোমার কত সুন্দর ব্রাইট ফিউচার ছিল অথচ বিয়ে করে নিজের ভাগ্যটাকে নিজেই ধ্বংস করে দিলে!”
ঈশিতার চোখের কোণে অশ্রু জমল। সে চোখের জল মুছে বলল,”আমি এই বিয়েটা করতে চাইনি। আমার বিয়ে করার কোন ইচ্ছেই ছিল না। আমার ইচ্ছে ছিল আগে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তোলা। কিন্তু এক দমকা হাওয়া এসে সবকিছু এলোমেলো করে দিলো।”
তামিম অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,”মানে?”

ঈশিতা তামিমকে প্রথম থেকে সব ঘটনা সবিস্তারে বলে। কিভাবে তাকে মিথ্যা নকল করার জন্য ফাসানো হয়েছিল তার মায়ের মৃত্যু এবং তার পরের সব ঘটনাও। সব শুনে তামিম ব্যথিত হলো। সে এখন বুঝতে পারছে ঈশিতা কতোটা অসহায় ছিল। তাই সে ঈশিতাকে ভরসা জুগিয়ে বলে,”কিচ্ছু চিন্তা করো না তুমি। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“কিভাবে সব ঠিক হবে তামিম ভাই? আমি একবার এক্সপেল হয়েছি, দ্বিতীয় বার এক্সাম দিলেও আমার এই দূর্নাম আজীবন থেকে যাবে। এখন আমি যত ভালো রেজাল্টই করি না কেন এই দেশের ভালো কোন ভার্সিটি পড়তে পারব না। আমার মেডিকেলে পড়ার সব স্বপ্নও শেষ। এখন কি করব আমি?”

বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে ঈশিতা৷ তামিম ঈশিতাকে ভরসা জুগিয়ে বলে,”এভাবে ভেঙে পড়ো না তুমি। কোন না কোন উপায় ঠিকই আছে। এই দেশে তুমি ভালো কোন যায়গায় পড়াশোনা করতে না পারলেও বিদেশে তোমার সেই সুযোগ আছে। তুমি চাইলে এসএসসি এক্সামের পর বিদেশে গিয়ে সেখানকার কোন কলেজে ভর্তি হতে পারো। তারপর সেখানেই মেডিকেলে ভর্তি হয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নও পূরণ করতে পারো।”
ঈশিতার নিভে যাওয়া আশার আলো যেন পুনরায় জেগে ওঠে। চোখের জল মুছে প্রবল আনন্দ নিয়ে বলে,”সত্যিই এটা সম্ভব?”

“হ্যাঁ, সম্ভব। আমার মামা সপরিবারে লন্ডনে থাকে। আমার মামাতো বোনও তো বাংলাদেশ থেকে স্কুলের পড়া শেষ করে সেখানকার একটা মেডিকেলে পড়াশোনা করছে।”
ঈশিতা একটা আশার আলো খুঁজে পেয়েও যেন হারিয়ে ফেলে। বাস্তবতায় পা রেখে বলে,”কিন্তু আমি কিভাবে বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করব? সেই সামর্থ্য যে আমার নেই!”
তামিম বলল,”কেন? তোমার স্বামী আয়ুশ তালুকদার নাকি তোমার স্বপ্ন ভাঙার দায় নিয়ে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছে। তো তাকেই বলো ব্যবস্থা করে দিতে।”
ঈশিতার মধ্যে বিদ্রোহি মনোভাব জেগে ওঠে। সে বলে ওঠে,”আমি তাই করবো।”

অতিথিরা সব বিদায় নিয়েছে। নাহিদও তামিমকে নিয়ে চলে গেছে।
রাতে রুমে এসে জামা-কাপড় বদলে একটা সালোয়ার পড়ে নেয় ঈশিতা। আয়ুশও রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে সোফায় শুতে যায়। এমন সময় ঈশিতা আয়ুশের সামনে এসে বলে,”আমার আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে।”
“হ্যাঁ, বলো।”

“আমার ইচ্ছা ছিল একজন বড় ডাক্তার হওয়া। কিন্তু আপনি ভুল বুঝে আমায় এক্সপেল করেছেন জন্য এখন আমি দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দিয়ে যতোই ভালো রেজাল্ট করি না এই দেশ থেকে কেন আমি ডাক্তার হতে পারব না। এর দায়ভার এখন আপনাকেই নিতে হবে।”
“মানে? কি চাইছ টা কি তুমি?”

“আমি চাই এসএসসি পরীক্ষার পর বিদেশে চলে যেতে। আপনি সেই ব্যবস্থা করুন।”
“এসব কি বলছ তুমি ঈশিতা? এত কম বয়সে তুমি বিদেশে গিয়ে কি করবে? কিভাবে থাকবে?”
“জন্ম নিবন্ধন অনুযায়ী যেহেতু আমার বয়স ১৮ তাই আমার বিদেশ যাওয়া নিয়ে কোন সমস্যা হবার কথা না৷ আর রইল একা থাকার কথা, বিদেশে আমার এক আত্নীয় আছে। আমি তার বাসায় গিয়ে থাকতে পারব।”
“কিন্তু..”

“কোন কিন্তু নয়। আপনি যদি সত্যি মনে করে থাকেন আপনার একটা ভুল সিদ্ধান্ত আমার জীবনকে নরকে পরিণত করেছে এবং এখন আপনি যদি সেটার প্রায়শ্চিত্ত করতে চান তিনি আপনাকে আমার কথা শুনতেই হবে।”
ঈশিতার এই কথা আয়ুশকে চুপ করিয়ে দেয়। সে কিছুক্ষণ ভেবে বলে,”বেশ, তুমি যা চাও আমি তারই ব্যবস্থা করব। যদি তুমি চাই বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করতে তো আমি তোমাকে বাঁধা দিব না। নিজের জীবনটা তুমি নিজের মতো গুছিয়ে নাও ওখানে গিয়ে। কোন দেশে যেতে চাও তুমি?”

আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১০

“UK”
“ঠিক আছে। তুমি এসএসসি পরীক্ষাটা দাও। তারমধ্যে আমি তোমার পাসপোর্ট, ভিসার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আর তোমার সব পড়াশোনার খরচও আমি বহন করব। চিন্তা করো না।”

আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১২