আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১৩

আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১৩
ইয়াসমিন খন্দকার

আজ ঈশিতার জীবনের এক অন্যতম বিশেষ দিন। আজকের ঘটনা হয়তো তার জীবনে অনেক বড় প্রভাব ফেলতে চলেছে। আজ সে নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে বিদেশের মাটিতে পা রাখতে চলেছে।
সকাল থেকেই নিজের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো। লন্ডনে গিয়ে তামিমের মামার পরিবারের কাছে থাকবে ঈশিতা। তামিম সেই ব্যবস্থা করে ফেলেছে। এদিকে সকাল থেকে ঈশিতার দিন কাটছে বিষন্নতায়। আজ তো তার ভীষণ খুশি হওয়ার কথা ছিল। সে আজ তার স্বপ্নের দিকে পা বাড়াবে।

কিন্তু কোন এক বিশেষ কারণে খুশি করতে পারছে না ঈশিতা। কারণটা কি তবে আয়ুশ? তাকে ছেড়ে যেতে কি কষ্ট হচ্ছে ঈশিতার। এটা সে জানে না। ছোটবেলায় মা বলত, বিয়ে এক অদ্ভুত সম্পর্ক। এক হালাল সম্পর্ক, যা দুটি হৃদয়কে একই সুতোয় বাধে। তবে কি সেই সম্পর্কের বাধনে আটকা পড়ে গেলো ঈশিতা। না, ঈশিতাকে এখন এসব ভাবলে চলবে না। এখন তার একটাই উদ্দ্যেশ্য, নিজের আর নিজের মায়ের স্বপ্ন পূরণ করা। অন্য কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামাবে না সে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঈশিতা আজ সকালে আবার এলো জাহানারা বেগমের সাথে দেখা করতে। জাহানারা বেগম প্রথমে তো ঈশিতার সাথে কথা বলতে চাইলেন না। তাকে এড়িয়ে যেতে চাইলেন কিন্তু পরে ঠিকই ঈশিতাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো করে বলতে লাগলেন,”লন্ডনে না গেলে তোমার হয়না মা? তুমি তো চাইলে এখান থেকেই পড়াশোনা করতে পার। আমার সংসারটা এভাবে ভাসিয়ে দিয়ে যেও না তুমি। আমার এই অনুরোধটা রাখো।”

ঈশিতার ভীষণ খারাপ লাগলো জাহানারা বেগমের মুখে এমন কথা শুনে। বিবেকের কাছে কি তবে এবার সে প্রশ্নের সম্মুখীন। একবার তার মনে চিন্তা এলো জাহানারা বেগমের কথাটা মেনে নেওয়ার৷ কিন্তু পরোক্ষণেই সে নিজেই নিজেকে ধমকে বোঝালো। তার কাছে আগে তার স্বপ্ন এরপর বাকি কিছু। ঈশিতা জাহানারা বেগমের কাছে আশ্বাস দিয়ে বললেন,”আপনি একদম চিন্তা করবেন না মা। আমি আপনার সংসার ভাসিয়ে দিয়ে কোথাও যাচ্ছি না। আমি আবার ফিরবো। নিজের পড়াশোনা শেষ করে আবার ফিরব এখানে। এই আমি আপনাকে কথা দিলাম।”

জাহানারা বেগম বিষন্নতায় মগ্ন হলেন। তিনি ভেবেছিলেন ঈশিতা তার সিদ্ধান্ত থেকে সড়ে আসবে। কিন্তু এই মেয়ে তো নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। তাই তিনিও আর কিছু বললেন না।
ঈশিতা উঠে চলে এলো নিজের রুমে। আয়ুশ সেখানে ঈশিতার জন্য অপেক্ষা করছিল। ঈশিতা আসতেই আর বললো,”তোমাকে কাল যে ডিভোর্স পেপারসটা দিয়েছিলাম সেটা কোথায়?”
ঈশিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”এখন এসব নিয়ে কিছু বলতে চাইছি না। আমি বিদেশ থেকে ফেরার পর এই নিয়ে কথা বলবো।”

“কিন্তু…”
“কোন কিন্তু নয়।”
আয়ুশ আর কথা বাড়ালো না।

যাওয়ার আগে পুরো তালুকদার বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো ঈশিতা। এমনি ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে গেল ঐশীর সাথে। ক্রাচে ভড় দিয়ে ঈশিতার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে আছে সে। ঈশিতা ঐশীকে পাশ কা*টিয়ে যাওয়ার সময় ঐশী বলে উঠল,”এভাবে আয়ুশ ভাইয়াকে ঝুলিয়ে রেখে যাচ্ছ কেন তুমি?”
ঈশিতা থামলো। ঐশীর উদ্দ্যেশ্যে বললো,”ঝুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছি মানে?”

“দুঃখিত, গতকাল রাতে আমি তোমার আর আয়ুশ ভাইয়ার কথোপকথন শুনে ফেলেছিলাম। তোমাদের এই বিয়েটা তো একটা শর্ত ছিল তাই না? তুমি তো কখনো এসব সংসার করতে চাওনি। তোমার ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা করার। আয়ুশ ভাইয়া তো তোমাকে সেই সুযোগ করে দিলো। গতকাল তোমার হাতে ডিভোর্স পেপারস ও তুলে দিলো৷ তো তুমি কেন আয়ুশ ভাইয়াকে মুক্তি দিলে না? কি চাও তুমি? আয়ুশ ভাইয়া আজীবন তোমার অপেক্ষায় বসে থাকুক?”
ঈশিতা লম্বা শ্বাস টেনে বললো,”এটা আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার। এর মাঝে তুমি না ঢুকলেই বোধহয় ভালো হবে। আর একটা কথা, আমি তোমার আয়ুশ ভাইয়াকে ঝুলিয়ে রেখে কোথাও যাচ্ছি না। আমাদের বিয়ে হয়েছে, সংসারটা এখনো হয়নি সেভাবে। তবে তার মানে এই না যে, কখনো হবে না। আমি আবার ফিরবো আমার সংসারে। আগে নিজের স্বপ্নটা পূরণ করি তারপর ভাববো সংসার নিয়ে!”

“তোমার মনে হচ্ছেনা তুমি ভীষণ স্বার্থপরতা করছ?”
“পৃথিবীর সকল মানুষই স্বার্থপর। আমিও তাদের বাইরে নই। নিঃস্বার্থ কেউ হতে পারে না। যারা পারে তারা মহামানুষ। তবে আমি বা তুমি কেউ সেই মহাপুরুষের তালিকায় পড়ি না।”

বলেই ঈশিতা চলে গেলো। ঐশী ঈশিতার বলা শেষ কথাটা ভাবতে লাগলো। কি বোঝাতে চাইল মেয়েটা? ঐশী স্বার্থপর?! ঐশী একটু ভাবল, আসলেই তো ব্যাপারটা তাই। এতদিন ঐশী আয়ুশের থেকে দূরে থেকেছে কারণ সে ভেবেছে আয়ুশ ঈশিতার সাথে সুখে আসে। তারা একে অপরকে ভালোবাসে। কিন্তু এখন যখন ঐশী সত্যিটা জানতে পেরেছে তখন তার মনে নতুন করে আশারা দানা বেঁধেছে আয়ুশকে নিয়ে। ভীষণ স্বার্থপর হতে মন চাইছে। তার মন তাকে বলছে,”কার জন্য স্বার্থ ত্যাগ করবি তুই? যেই আয়ুশের কথা ভেবে তুই সরে এসেছিলি সেই আয়ুশই তো এই বিয়েটা করে সুখে নেই। তোর আয়ুশ ভাইয়া এখনো সম্পূর্ণরূপে ঐ মেয়ের হয়ে যায়নি। কারণ ওদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তাই এখনো তোর সুযোগ আছে আয়ুশকে নিজের করে নেওয়ার।”

আর ব্যস, এমন ভাবনায় কাবু হয়ে পড়েছে ঐশী। ঈশিতার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,”আর ফিরো না তুমি ঈশিতা। তুমি আয়ুশ ভাইয়াকে সুখী করতে পারবে না। আয়ুশ ভাইয়াকে কেবল আমিই সুখী করতে পারব। আর কেউ পারবে না, কেউ না। আল্লাহ, তুমি দেখো ঈশিতা যেন আর না ফেরে। আর যেন না ফেরে ও। জীবন বারবার সুযোগ দেয় না। কিন্তু আমাকে যখন একবার সেই সুযোগ দিয়েছে তখন আমি সেই সুযোগ লুফে নিতে চাই।”

ঈশিতাকে নিয়ে ঢাকা শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছে আয়ুশ। তাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিলো। ঈশিতার ফ্লাইটের সময় হয়ে এলো। আয়ুশ বললো,”যাও এবার।”
ঈশিতা হঠাৎ করে একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলো। আয়ুশকে জড়িয়ে ধরে বললো,”আমার জন্য একটু অপেক্ষা করবেন প্লিজ। আমি আবার ফিরবো আপনার কাছে। দয়া করে আমি না ফেরা পর্যন্ত অন্য কাউকে নিজের জীবনে আসতে দেবেন না।”

আয়ুশ হতবাক। বরফের মতো জমে রইলো৷ ঈশিতা আয়ুশকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো ফ্লাইটের দিকে। আর আয়ুশ তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার পানে। হঠাৎ আয়ুশের ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল।

ঈশিতা এসে বসলো ফ্লাইটে তার বরাদ্দ আসনটি। তার সামনের আসনটিতে একটা ভীষণ কিউট বাচ্চা বসে৷ ঈশিতা বাচ্চাটির গাল টিপে দিয়ে বললো,”তোমার নাম কি বাবু?”
বাচ্চাটা বেশ গম্ভীর প্রকৃতির মনে হলো। বয়স আনুমানিক ৩-৪ বছর হবে। গাল ফুলিয়ে বলল,”আমার নাম পোহোর চোধুরি”

ঈশিতা হেসে বললো,”প্রহর চৌধুরী?”
বাচ্চাটা মাথা নাড়ালো। এমন সময় একজন মহিলা এসে বসলো বাচ্চাটির পাশে৷ ঈশিতার দিকে তাকিয়ে মহিলাটি সামান্য হেসে বললো,”ও আপনাকে বিরক্ত করে নি তো?”
“আরে না, না৷ আমিই তো ওকে বিরক্ত করলাম।”
মহিলাটি বললো,”আপনাকে দেখে তো মনে হয়না খুব বেশি বয়স। একা একা যাচ্ছেন?”

“জ্বি, বিদেশে পড়তে যাচ্ছি।”
“আপনার নাম?”
“ঈশিতা। আপনার?”
“আমার নাম, প্রণালী।”
হেসে কথাটা বললো সে। এমন সময় প্রণালীর পাশের সিটটিতে এসে বসলো তার স্বামী সমুদ্র চৌধুরী। সে এসেই প্রহরের গাল টিপে বললো,”আমার বাবাই কেমন আছে এখন?”
প্রহর বললো,”বালো।”

আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১২

ঈশিতা প্রণালীদের প্রশ্ন করলো,”আপনারা লন্ডনে কেন যাচ্ছেন?”
প্রণালী বলল,”আমার শাশুড়ী পুষ্পা চৌধুরী লন্ডনে চিকিৎসাধীন আছেন। ওনার সাথেই দেখা করতে যাচ্ছি।”
“ওহ আচ্ছা।”
এভাবে টুকিটাকি কথা চলতে থাকে।

আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১৪