আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ২৮
ইয়াসমিন খন্দকার
ঈশিতা চট্টগ্রামের একটি ছোট এপার্টমেন্টে কোনরকমে মানিয়ে নিয়েছে। যদিওবা এখানে মানিয়ে নিতে তার অনেক কষ্ট হচ্ছে। তবে দেখতে দেখতে ৯ মাস এই এপার্টমেন্টেই কাটালো সে। বর্তমানে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি মেডিকেলে সে ডাক্তার হিসেবে আছে। বর্তমানে তার প্রেগ্ন্যাসির শেষ সময় চলছে। তাই অনেক সচেতন থাকতে হচ্ছে। শেষ সময়ে সবকিছু সামলানোর জন্য একটা কাজের মেয়েও রেখেছে সে। কুলসুম নামের মেয়েটা তার হাতে হাতে সমস্ত কাজ করে দিচ্ছে। তাই অনেকটা স্বস্তিতে থাকতে পারছে। নাহলে তো একা হাতে সব সামলানো এক প্রকার অসম্ভব হয়ে যেত। ঈশিতা এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই মানিয়ে নিয়েছে। কারণ এরই নাম তো জীবন। জীবন কখনো কারো জন্য থেমে থাকে না। এগিয়ে চলে নিজস্ব গতিতে। যেই গতি অপ্রতিরোধ্য এবং দূর্নিবার।
আয়ুশের বিগত নয় মাস গেছে অনেক দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত ভাবে। ঈশিতা না ফেরা পর্যন্ত বাড়িতে না ফেরার প্রতিজ্ঞা সে বজায় রেখেছে। বাড়ি থেকে দূরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকছে। জাহানারা বেগম এসে রোজ তার সাথে দেখা করে এবং দুঃখবিলাস করে যায়। আজও তিনি এসে আয়ুশের সাথে কথা বলছেন। তিনি আয়ুশকে বাড়ি ফিরে যেতে জোর করছেন কিন্তু আয়ুশ বরাবরের মতো তার প্রস্তাব নাকচ করে দিচ্ছে। জাহানারা বেগম নিজেকে দোষ দিয়ে বলছেন,”আমার জন্য ঈশিতা চলে গেছে। আমারই দোষ সব।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আয়ুশ হতাশার শ্বাস ফেলে বলে,”এভাবে নিজেকে দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই মা। যা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে। ভাগ্যে যদি থাকে তাহলে ঈশিতা আবার ফিরবে আমার জীবনে। আর আমিও ওকে সসম্মানে ফিরিয়ে নিয়ে যাব তালুকদার ভিলায়।”
এরইমধ্যে হঠাৎ আয়ুশের ফোন বেজে ওঠে। আয়ুশ ফোনটা রিসিভ করতেই তার বন্ধু রাসেল বলে ওঠে,”তোর জন্য একটা সুসংবাদ আছে আয়ুশ। আমি ঈশিতা ভাবির খোঁজ পেয়েছি। সে বর্তমানে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি মেডিকেলে ডাক্তার হিসেবে কর্মরত আছে। আমি তোকে তার ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
আয়ুশ ভীষণ খুশি হয়ে যায়। এতদিন ধরে সে যেটার অপেক্ষায় ছিল অবশেষে আজ সেই দিনটি এসে গেলো। ফোন কেটে দিয়ে জাহানারা বেগমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আয়ুশ। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে,”আমি তোমার বৌমার খোঁজ পেয়েছি মা। আমার জন্য দোয়া করো, যেন আমি তোমার ঘরের বউকে আমার ঘরে ফিরিয়ে আনতে পারি।”
জাহানারা বেগমও খুশি হয়ে বলেন,”যা বাবা, ঈশিতাকে জলদি ফিরিয়ে আন। আমাদের সবার তরফ থেকে ওর কাছে মাফ চাস।”
আয়ুশ চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায়।
ঐশীর বর্তমান দিনগুলো অনেক ভালো যাচ্ছে। নাহিদের সাথে তার বিয়ের সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না সেটা এখন একদম শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে ঐশী। নাহিদ তাকে সবসময় সুখী রাখার চেষ্টা করে। নিজেকে ভীষণ লাকি মনে হয় ঐশীর। এত ভালো স্বামী পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের বিষয়। এজন্যই হয়তো বলা হয়, আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। আয়ুশের সাথে বিয়ে হলে হয়তো ঐশী এত সুখী হতো না। ঐশী-নাহিদের এই সুখ আজ আরো বেড়ে গেছে তাদের জীবনে নতুন অতিথি আগমনের কথা শুনে। ঐশী মা হতে চলেছে। নাহিদ এই খুশিতে পুরো এলাকায় মিষ্টি বিলিয়েছে।
ঐশীকে নিয়ে এখন সে আহ্লাদে আটখানা। এই নয় মাসে তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল সুখে-শান্তিতে পরিপূর্ণ। কখনো কোন দুঃখ তাদের স্পর্শ করে নি। আজও নাহিদ ঐশীকে গভীর বাহুডোরে আবদ্ধ করে রাত্রীযাপন করছে। নাহিদ ঐশীর কপালে ভালোবাসার পরশ একে বলে,”তুমি জানো না ঐশী, তুমি আজ আমাকে কত বড় খুশির সংবাদ দিয়েছ। আমার খুশি আজ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আমি বাবা হতে চলেছি, আমাদের সন্তান আসতে চলেছে এই পৃথিবীতে।”
“আমিও আজ ভীষণ খুশি। কিন্তু মন থেকে খটকাও যে পুরোদমে দূর হচ্ছে না!”
“খটকা কেন?”
“আমার সাথে তো কখনো ভালো হয়নি। এখন কি আবার ভালো কিছু হবে?”
“এটা কোন কথা নয় ঐশী। এসব নেতিবাচক চিন্তা করো না। দেখবে আল্লাহ আমাদের জন্য ভালো কিছুই লিখে রেখেছেন।”
“তাই যেন হয়। আমি বেশি কিছু চাই না, শুধু এটাই চাই, যেন আমাদের সন্তান সুস্থভাবে এই পৃথিবীতে আসে।”
“তুমি যা চাও তাই হবে দেখো।”
বলেই নাহিদ ঐশীকে নিজের বাহুডোরে আরো শক্ত করে আগলে নেয়। যেন কখনো ছেড়ে যেতে দিবে না। তাদের এই সম্পর্কের বন্ধন যেন ভীষণ অটুট।
আজ হাসপাতালে প্রভার শেষ কর্মদিন। আজকের পর থেকে সে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে চলে যাচ্ছে। তাই শেষদিন অনেক কলিগই তাকে শুভেচ্ছা বার্তা জানাচ্ছে। ঈশিতার এক মহিলা কলিগ তার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমার তোমার জন্য ভীষণ চিন্তা হয় জানো। আমি যৌথ পরিবারের বউ। আমার শ্বাশুড়ি, ননদরা আমার ছেলেকে দেখে রাখে তবুও আমার সবটা ম্যানেজ করতে কতটা কষ্ট হয়৷ আর তুমি একজন সিঙ্গেল মাদার হয়ে কি করে এত দিক সামলাবে?”
ঈশিতা মলিন হেসে বলে,”কি করবো বলো? আমাকে তো বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতে হবে। আমার এই পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ নেই, যাদের আপন ভেবেছিলাম তারাও আমায় পর করে দিয়েছে। তাই এখন নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে। সাথে নিজের সন্তানেরও।”
“কোন সাহায্য লাগলে আমাকে বলো। আমি নিজের সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করব।”
“আচ্ছা।”
কথা বলা শেষ করে ঈশিতা নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আজ তার উপর দিয়ে অনেক ধকল যাচ্ছে। এই সময়ে এত ধকল সহ্য করা টাফ। তবুও ঈশিতা যতটা সম্ভব ট্যাকেল দেবার চেষ্টা করছে। সব কাজ সেরে ঈশিতা এবার এপার্টমেন্টে ফেরার জন্য প্রস্তুতি হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই পেটে ভীষণ ব্যাথা অনুভব করে। ঈশিতা বুঝতে পারছিল না এর কারণ। তার তো ডেলিভারি ডেট এখনো অনেক দেরি। তাহলে এত তাড়াতাড়ি এই ব্যাথার মানে কি? ঈশিতা বেশিক্ষণ নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। ব্যাথার চোটে আর্তনাদ করে ওঠে। সাথে সাথেই আরো কয়েকজন ডাক্তার ছুটে এসে বলে,”কোন সমস্যা?”
“আমার পেটে ভীষণ ব্যাথা হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না এর কারণ কি। আমার ডেলিভারি ডেইট তো এখনো এক মাস দেরি আছে।”
কয়েকজন তাকে একজন গাইনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। তিনি চেকআপ করে বলেন,”আপনার প্রেগ্ন্যাসিতে কিছু কমপ্লিকেশন দেখা দিয়েছে। তাই আপনাকে আপাতত হাসপাতালে এডমিট করতে হবে। যে কোন সময় বাচ্চার ডেলিভারি করতে হতে পারে।”
ঈশিতা চিন্তিত হয়ে বলে,”বেশি সিরিয়াস কিছু নয়তো?”
“এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না, তবে একটু জটিলতা হতে পারে।”
ঈশিতা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলে,”ইয়া মাবুদ, তুমি আমার সন্তানকে ঠিক রেখো আর ওর স্বার্থে আমায় ঠিক রেখো। আমি ছাড়া যে ওকে দেখে রাখার আর কেউ নেই।”
আয়ুশ দ্রুতবেগে চট্টগ্রামের দিকে রওনা দিচ্ছিল। কিন্তু ভারী বৃষ্টি এবং ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে মাঝরাস্তায় তাকে আটকে পড়তে হয়। আয়ুশ একটি হোস্টেলে অবস্থান করে এক রাতের জন্য। কিন্তু তার ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল। আয়ুশ বলে,”ঈশিতার কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমি শান্তি পাবো না। আল্লাহ, তুমি দ্রুত আমাকে ওর কাছে পৌঁছে দিও। আমার যে ওর মান ভাঙাতে হবে।”
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ২৭
বলেই আকাশের পানে চায় আয়ুশ। আমাবস্যার কারণে আকাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। কি বার্তা দিচ্ছে এই অন্ধকার আকাশ?!