আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৬১

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৬১
suraiya rafa

কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় ভর করে নেমে এসেছে সন্ধ্যাবেলা। চারিদিকে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো জমতে শুরু করেছে ধূসর কুয়াশা। তাপমাত্রা মাইনাসের ঘরে, আজ রাতে নির্ঘাত স্নোফল হবে।
আজ বিয়ে। বিস্তৃত জঙ্গলের সীমানা ছাড়িয়ে, গোটা মস্কো শহর অতিক্রম করে লোকচক্ষুর আড়ালে একটা অজ্ঞাত রহস্যঘেরা দ্বীপ। নাম তার বিগ ডায়োমেট, সেখানেই আয়োজন করা হয়েছে অভিজাত্যপূর্ণ এক চিরস্বরণীয় বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানের। চারিদিকে সমুদ্র, ঠিক তার মাঝখানে যেন একটুকরো জমকালো শহর। খুব বেশি অতিথি নয়, কিছু বিশ্বস্ত মাফিয়া বস, আর তাদের পরিবারের লোকজনেরাই আমন্ত্রিত শুধু ।

পাইথন লিডারের জীবদ্দশায় এক এবং একমাত্র আলোকসজ্জিত দিনটির স্বাক্ষী হতে তাদের একেক জন, একক দেশ থেকে উড়ে এসেছে আজ।
দ্বীপের চারিপাশে শয়ে শয়ে সশস্ত্র স্নাইপার। demon Knight রাও দাঁড়িয়ে আছে শেকলবন্দি পিট বুল গুলোকে সঙ্গে নিয়ে। আকাশ সীমানায় সুবিস্তীর্ণ হেলিকপ্টারের টহল।
চারিদিকের এতো নিরীক্ষণ, এতো সতর্কতা পর্যবেক্ষণ করে আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঈশানী। আশপাশটা ওয়েডিং ভেন্যু কম যুদ্ধক্ষেত্র বেশি মনে হচ্ছে। যেন এক্ষুণি শত্রুপক্ষের অতর্কিত আ’ক্রমণে শুরু হয়ে যাবে ধ্বং’সের গোলযোগ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিয়ৎক্ষণ উদ্দেশ্যহীন চেয়ে থেকে বাইরে থেকে চোখ সরালো ঈশানী। ঘুরে এসে ভেতরে মেকআপ রুমের ওয়াল মিররে নিজেকে দেখা মাত্রই আচানক বুক ধড়ফড় করে উঠলো তার। চিরাচরিত মলিন চেহারাটা হুট করেই অপরিচিত লাগছে ভীষণ । ফ্যাকাসে মুখের সবটুকু মলিনতা উবে গিয়ে আয়নার প্রতিবিম্বে ভেসে উঠেছে অপ্সরার মতো দেখতে গাঢ় নীল চোখের এক রুপবতীর মুখ। চারিদিকের এতো আলো,এতো চাকচিক্য সবকিছুই যেন ম্লান হয়ে এসেছে ওই ভূবণমহিনীর নজরকাড়া লাবন্যতায়।
আগুন সুন্দরী বোধহয় একেই বলে, নীলাভ দৃষ্টির প্রখরতায় সামনে থাকা কাঁচের প্রতিবিম্বটাও ঝলসে যেতে চাইছে যেন।

আজ নিজেকে সত্যিই সাকুরা মনে হচ্ছে ঈশানীর। ধীর, শান্ত, মোমেরপুতুলের মতো কোমল চেহারায় চিকচিক করছে স্যাটিন মেকআপের ক্ষীণ প্রলেপ। নানান রকম শোভাবর্ধক হেয়ার অ্যাক্সেসারিস দিয়ে একটা ফ্লাফি টেকচারে পরিপাটি করা হয়েছে তার রেশমের মতো ঝরঝরে কুন্তলরাশি। মাথার অগ্রভাগে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে শ্বেত পাথরের নান্দনিক হেডপিস। সেটিকে পর্যবক্ষেন করে মনেমনে ভাবতে লাগলো ঈশানী,
—এতো ঝলমল করছে টায়রাটা? হীরের নিশ্চয়ই!
— তোমাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে ঈশু।
অযাচিত এক মন্ত্রমুগ্ধ কণ্ঠের দাপটে মতিভ্রম কেটে গেলো রমণীর,অকস্মাৎ পেছনে তাকাতেই দেখলো,
তার থেকে কয়েক হাত দূরে হুবহু একই রকম সাজসজ্জা নিয়ে হাসোজ্জল মুখে দাঁড়িয়ে আছে রুশ রমণী। তার অভাবনীয় সৌন্দর্যের বিস্তীর্ণতায় মুগ্ধ হয়ে তাকালো ঈশানী। মোমঢালা চেহারার পলকা গোলাপি আভায় চারিদিক আশ্চর্য আলোকিত!মেয়েটার ঈষৎ স্বর্ণাভ চুলের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে উপচে পড়া আকর্ষণ। যে কেউ দেখলে নির্ঘাত ডুবে যাবে সেই সোনালু আভায়। বিয়ের পাত্রীকে নজরাবদ্ধ করেই আনমনে হাসলো ঈশানী। ঠোঁট উল্টে মজার ছলে বললো,

— সোনালী চুলের রুশকন্যা বুঝি বাঙালি রূপে অভিভূত হচ্ছে?
— হচ্ছিতো, বিশ্বাস করো চোখই সরছে না। কি সুন্দর গায়ের রঙ তোমার ঈশু! এতো মসৃণ আর নিখুঁত, কোনো ফাউন্ডেশনের প্রয়োজন নেই।
কথা বলতে বলতেই এগিয়ে এসে ঈশানীর পেলব গালে আঙুল বোলালো ফ্লোরা। অপলক তাকিয়ে মোহাবিষ্ট স্বরে ফের আওড়ালো,

— আর তোমার অতুলনীয় নীল চোখের কথা কিইবা বলবো? এর আলাদা কোনো বিশেষত্ব নেই, পুরোটাই আকর্ষন। আমি ভুল না করে থাকলে আজ আবারও এই সমুদ্রনীল চোখের চাহনিতে ঘায়েল হবে মাফিয়া বস। তার ভেতরের দূর্দমনীয় বেপরোয়া সত্তাটা আরও একবার অবলীলায় মুখ থুবড়ে পড়বে এই নীলাম্বরীর তরে।
ঈশানী এবার মিররের দিকে ঘুরলো। আনমনা নীলাক্ষীযুগল অচিরেই কেড়ে নিলো সব আকর্ষন। শীমারি গ্ল্যামের স্মোকি আই লুকটা নীল চোখের সঙ্গে মানিয়েছে ভীষণ । এক মূহুর্তের জন্য ঈশানীর মনে হলো ওর চোখ দু’টো ফ্লোরার চেয়েও সুন্দর আর নিখুঁত। শুধু ফ্লোরা নয়, সবার চেয়ে সুন্দর । যতটা আস্বাভাব্য ঠিক ততটাই নজরকাড়া। মানুষের চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্যের হওয়া দোষের কিছু নয়, বরং একটু বেশিই অতুলীয়। যা সবার নেই, তা তোমার আছে , এর চেয়ে গর্বের আর কিই হতে পারে?

সর্বদা চুপচাপ, অন্তর্মুখী স্বভাবের মেয়েটার বুকের ভেতর বানভাসি নদীর মতোই আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত হয়। আজ প্রথমবার উপলব্ধি করে, নীল চোখ ওর অভিশাপ নয় বরং স্রষ্টা প্রদত্ত অভিনব এক আশির্বাদ।
ফ্লোরা আরেকটু এগিয়ে ওর কাঁধে চিবুক ঠেকাতেই ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আয়নার প্রতিবিম্বে পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ঈশানী। ফ্লোরা ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,
— এই যে বিয়ের কনে, কি ভাবছো এতো?

মলিন হাসির ঝলকে ঠোঁট প্রসারিত হলো ঈশানীর । জবাবে বিষাদ ভরা কণ্ঠে আওড়ালো,
— আজ আমি এরীশের জন্য বিয়ের গাউন গায়ে চড়াবো, সেই এরীশের জন্য, যে আমাকে একদিন এখানে প্রস্টিটিউড বানাতে নিয়ে এসেছিল। আজ আমি তার সন্তানের মা। একটা মাফিয়াকে ভালোবেসে দুনিয়ার সকল সম্পর্কের বাঁধন পায়ে ঠেলেছি আমি, ভুলতে বসেছি পরিবার। মাহিনের মতো অসাধারণ মানুষটিকেও ফিরিয়ে দিয়েছি নিঃসংকোচে বহুবার। ভালোবাসার দহনে নিজে পুড়েছি, সাথে এরীশকেও পুড়িয়েছি। হয়েছি অদৃশ্য, অস্তিত্বহীন। তবুও আমি আজ ভীষণ খুশি ফ্লোরা। কেন জানো?
ফ্লোরা না সূচক মাথা নাড়ালে, ফের প্রত্যুত্তর করে ঈশানী,

— কারণ এরীশই সেই ব্যক্তি যে আমার চোখের মাঝে প্রথমবারের মতো আকর্ষন খুঁজে পেয়েছিল। হোক যে যতই নিকৃষ্টতম আকর্ষন। আকর্ষিত হয়েছিল বলেই হয়তো তুলে নিয়ে এসেছিল রাশিয়ায়। অনুভূতিহীন নির্জীব মাফিয়া বসটা আমাকে হাজার রকম কষ্ট দিয়ে পুরোপুরি ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল,অথচ আমার নীলাভ চোখের দৃষ্টি উল্টো ওর দম্ভ, অহংকার, কাঠিন্যতা সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিলো। এরীশের ভেতরকার এই ভাঙন, আমার জন্য তার এই উন্মাদনাকে আমি আমার জিত মনে করি ফ্লোরা। আর জিতে গিয়েই আজ আমি পরিপূর্ণ । আমার এই অভাবনীয় জয়ের পুরষ্কার হলো আমার ছেলে, আমার ইয়াশ। যা স্বয়ং আমার প্রতিদ্বন্ধী আমাকে উপহার দিয়েছে।
তৎক্ষণাৎ মজার ছলে টিপ্পনী কাটলো ফ্লোরা,

— প্রতিদ্বন্ধীর সঙ্গে বেড শেয়ার করলে ট্রফিতো হাতে আসবেই ম্যাডাম।
বলেই খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করলো মেয়েটা। ঈশানী তাতে প্রশ্রয় দিয়ে বললো,
— তোমার মাফিয়া বস আমাকে ম্যানিউপুলেট করেছে, নয়তো আমি সেরকম মেয়েই না,হুহ!
ফ্লোরা হাসি থামালো। নিভে আসা কণ্ঠে একরাশ কৌতুহল নিয়ে বললো,
— আই থিংক হি ইজ ওয়াইল্ড লাইক অ্যান এ্যানিমেল! না মানে, এমন একটা কোল্ডহার্টেট লোক কাউকে আদর কিভাবে করতে পারে ? ওর চাহনি দেখলেই তো আত্মা কেঁপে ওঠে আমার।

ফ্লোরার কথায় থমকে গেলো ঈশানী। চোখেমুখে লজ্জমিশ্রিত রক্তিম আভাটা স্পষ্ট প্রতীয়মান। বুকের ভেতর অদৃশ্য এক শিহরণ জাগ্রত হয়ে বুদবুদ করে ছড়িয়ে পড়লো সমগ্র নারী শরীরে। সহসা তরল কণ্ঠে জবাব দিলো রমণী,
— সর্বদা আঁধারে নিমজ্জিত চোখ আর শূন্য দৃষ্টির রীসষ্কার আড়ালে শিথিল হয়ে থাকা একটা অরণ্য আছে জানো? সেই অরণ্যর আসল চেহারাটা দেখলে অবাক হতে তুমি ফ্লোরা। কতোটা ব্যাকুলতা, কতটা মাদকীয়তাই না ধরে রাখে তার ওই মৌহ দৃষ্টি। তার হিমশীতল গভীর নজরের সেই সুপ্ত অভিলাষ বহুবার টের পেয়েছি আমি । এখনো তার অদ্ভুত প্রেমিক চোখের প্রদীপ্ত প্রখরতায় বারবার দুনিয়া ভুলে যাই আমি। ওই ধূসর চোখে চোখ পড়লে শুধু হৃদয় নয়, সমগ্র অস্তিত্ব কেঁপে ওঠে আমার। নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ এই দুনিয়ার কঠোর নিষেধাজ্ঞাকে পায়ে ঠেলে ভুলে যাই সব বাস্তবতা। তখন মনে হয়, এরীশ যেন কোনো নেশাতুর পদার্থ। যার সুদীপ্ত চাহনী, পুরুষালি অভিব্যক্তি, আর মাতাল করা সুঘ্রাণে নিজেকে হারিয়ে ফেলতেও দ্বিধা নেই কোনো। দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তিটির বাহুতে আমি সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। শুধুমাত্র এই একটা অনুভূতিই অদৃশ্য শেকলের শক্ত বাঁধনের মতোই আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয় কোন এক ঐশরীক ইন্দ্রজালে। তখন আর ভয় হয় না, বরং নিজের সবটা উজাড় করে বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে সেই হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর মানুষটার মাঝে ।

একনাগাড়ে কথাগুলো বলতে গিয়ে অকস্মাৎ থমকালো ঈশানী । নিজের ব্যাপারে এতোটা খোলাখুলি ভাবে শেষ কবে কথা বলেছিল সেই ভেবেই আশ্চর্য হলো মেয়েটা । অথচ অনুভূতি যেন বাঁধ ভেঙেছে আজ। সমগ্র দ্বিধা, সমগ্র দোটানা ভুলে হয়ে উঠেছে মাফিয়া বসের সেই আকাঙ্ক্ষিত পরিণিতা।
অন্তর্মুখী ঈশানীর মিঠে মধুর বাক্যালাপে নিজের মাঝেও অযাচিত এক সুখের গুঞ্জন টের পেলো ফ্লোরা। মানস্পটে যন্ত্রের মতো মানবের থমথমে চেহারাটা ভেসে উঠতেই জাফরানি রঙে রঙিন হলো তার গোলাপি কোমল মুখ। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললো,

— তোমার প্রাপ্তির আনন্দে আমারও ভীষণ আনন্দ হচ্ছে ঈশু। এরীশের মতো মানুষকেও যে কেউ এতোটা ভালেবাসতে পারে, তা আমার ধারণার বাইরে।
বিপরীতে একটুকরো দীর্ঘশ্বাস ফিরিয়ে দিলো ঈশানী। রুশকন্যার হাসি বিজরিত মুখটা পরখ করতেই আষাঢ়ে আঁধার ঘনালো তার প্রতিমার মতো নিখাদ চেহারায়। ব্যথাভরা কণ্ঠে আওড়ালো,
— অথচ আমার পরিচিতদের কাছে আমি ডেড কোল্ড ফিসের মতোই অনুভূতিহীন আর স্বার্থপর।
— তুমি ঠিক কার কথা বলছো ঈশু?
ফ্লোরার কণ্ঠে উদ্বেগ। নিরুত্তাপ স্বরে জবাব দিলো ঈশানী,
— আমার পরিবার। আমার বন্ধু জিসান।

এবারে নিশ্চুপ ফ্লোরা । মেয়েটাকে কিভাবে সান্ত্বনা দেওয়া যায় ঠিক বুঝতে পারছে না আসলে। ওকে অবাক করে দিয়ে আজ প্রথমবারের মতো নিজে থেকেই বলতে আরম্ভ করলো ঈশানী,
— জিসান ছেলেটা অদ্ভুত! হুট করেই কোথায় কোথায় উধাও হয়ে যায়। আবার যখন ফিরে আসে তখন সবকিছু শান্ত, স্বাভাবিক একদম নিরিবিলি । জিসান আশেপাশে থাকলে আমার কোনোকিছু নিয়ে বেগ পোহাতে হয়না, তবুও আমার প্রতি ওর অনুভূতি গুলো ছিল বরাবরই রহস্যঘেরা। ঠিক বোধগম্য নয় আসলে। কখনো মনে হতো ও আমাকে খুব পছন্দ করে , পাগলের মতো ভালোবাসে । আবার কখনো মনে হতো আমার প্রতি ওর ভীষণ ক্ষোভ। অব্যক্ত কোনো আ’ক্রোশ ছাইচাপা আগুনের মতোই ধিকধিক করছে ওর অন্তরজুড়ে!
ফ্লোরার ভ্রু কুঁচকে গেলো । ঈশানীর বিষণ্ণ মনের গতিহীনতা টের পেয়ে কিছুটা উদাসীন হয়ে এলো তার কণ্ঠস্বর। বললো,

— আজকেই হঠাৎ এসব কথা কেন বলছো বলোতো?
— জানিনা, হয়তো প্রাপ্তির উৎফুল্লতায় স্মৃতিরা সব মাথাচাড়া দিয়েছে আজ।
ঈশানীর মোলায়েম কণ্ঠস্বর কান্নায় বুজে আসে, মূহুর্তেই পেছন থেকে অনুভূত হয় রুশকন্যার উষ্ণ আলিঙ্গন। মেয়েটা গভীর কণ্ঠে বলে,
— কষ্ট কিভাবে লুকাতে হয়, সেটা বোধ হয় তোমার কাছ থেকেই শিখেছি আমি ঈশু।
ঈশানীর বিষাদবিধূর অভিব্যক্তি হঠাৎ করেই কৌতুহলী হয়ে ওঠে। কিছু না ভেবেই জানতে চায় ,
— তোমার আবার কষ্ট কিসের ফ্লোরা?
ফ্লোরা হাসে। অনুভূতিহীন,নিস্তেজ সেই হাসির রেশ। হায়েনার কবলে সর্বস্ব বিবর্জিত হয়ে কনের সাজে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার হাসিতে কলঙ্ক নেই। তবুও দুনিয়ার চোখে কলঙ্কিত সে। হয়তোবা তুষারের চোখেও। তুষার কি আদৌও ওকে ভালোবেসে বিয়ে করছে? নাকি শুধুই এরীশের কথামতো দ্বায়িত্ব পালন? রমণী সন্দিহান! সহসা ম্লান কণ্ঠে জবাব দেয়,

— এমন একটা শুভ মূহুর্তে, নিজের বিভৎস অতীতের স্মৃতিচারণ করা মোটেই সহনীয় নয়। অন্য কোনোদিন না হয় বলবো। তখন শুনবে তো আমার দুঃখ গাঁথা?
ঈশানী উদগ্রীব হয়ে ওঠে। চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে কিছু বলতে যাবে, তন্মধ্যে শোরগোল ভেসে এলো বাইরে থেকে। দু’জন করে মোট চারজন মেকআপ আর্টিস্ট একপ্রকার ছুটে এসে রুমে ঢুকলো ওদের। ন্যুজ্ব হয়ে কুর্ণিশ জানালো প্রথমে, অতঃপর পোশাক পড়ার তাড়া দেখিয়ে হইরই করে বললো,
— আপনারা প্লিজ তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিন ম্যাম! রীশষ্কা চলে এসেছে।

সিঁদুর রাঙা দিগন্তে অমানিশার আঁধার গুলে নেমে এসেছে ধূসর সন্ধ্যা। উত্তাল সমুদ্রে ঢেউয়ের গর্জন। শীতল কনকনে হাওয়ায় জমতে শুরু করেছে প্রকৃতি। এরই মাঝে অবিশ্রাম পায়ে বিস্তৃত হেলিপ্যাডের অভিমুখে ঠক ঠক শব্দ তুলে এগিয়ে গেলো কয়েক জোড়া সতর্ক পা। গন্তব্যে পৌঁছে পর্যায়ক্রমে সারিবদ্ধ ভাবে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সব। একটুবাদেই ধূসর আকাশের কুয়াশা ভেদ করে জমিনে এসে নামলো কালোরঙের চকচকে এক যান্ত্রিক বাহন। যার ধাতব পাখার ঘূর্ণনে ঝোড়ো হাওয়ার মতোই এলেমেলো চারিপাশ। ইঞ্জিনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতেই, ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে এলো সেই ঘূর্ণন, থেমে গেলো বাহনটি।
অতঃপর নৈঃশব্দ্য।

কিয়ৎক্ষণ বাদে মূর্তিমান গার্ডদের মাঝে অব্যক্ত এক সতর্ক সংকেত ধরিয়ে দিয়ে,নিস্তব্ধ ককপিটের দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো একজোড়া মবপলিশড চকচকে বুট। তার নিরবধি দাম্ভিক পদক্ষেপে ক্রমশ গুমোট হয়ে উঠলো চারিপাশ। যেন একমুঠো ধুলোমাখা অবরুদ্ধ বাতাস এদিকওদিক ঢপ খেয়ে ঝটিকা প্রবাহের মতোই উড়ে গেলো কোথাও।
আগন্তুকের নিশ্চল কদম ক্রমশ জোরালো হতেই গার্ডরা সব একযোগে মাথা নামিয়ে কুর্নিশ জানালো তাকে, অতঃপর চোখ তুললো সবিনয়ে। দৃষ্টি সীমানার ঠিক শেষ প্রান্তে, ধোঁয়াসার মতোই ভেসে উঠলো সৌম্যকান্ত চেহারা অথচ কঠোর অভিব্যক্তি ধরে রাখা দীর্ঘদেহী সেই আগন্তুকের মুখ ।

কুয়াশা আবৃত ধূসর সন্ধ্যাকে পথযাত্রী করে হেলিপ্যাডের ঠিক মাঝ বরাবর বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে মাফিয়া বস। কোলে তার মাস চারেকের ছোট্ট অস্তিত্ব। অতি সংবেদনশীল হাতে ছোট্ট কোমল শরীরটিকে বুকের বাম পাশে জায়গা করে দিয়ে নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে চোখে সানগ্লাস লাগালো সে ।
বাবা ছেলের রসায়ন আজ চমৎকার। দু’জনার শরীরেই স্থান করে নিয়েছে প্যাস্টেল ব্ল্যাকের আকর্ষনীয় ব্লেজার স্যুট। কোটের সৌন্দর্য বাড়াতে, না-কি শীত নিবারনের উদ্দেশ্যে ঠিক জানা নেই, তবে দু’জনারই কাঁধের উপর ঝোলানো মসৃণ লিনেন ফেব্রিকসের হাঁটুসম লম্বা টেইল কোট। ছোট্ট ইয়াশ, তার কচি কোমল ঠোঁটে অকারণ একটা হাসি ঝুলিয়ে রেখে মনের আনন্দে হুটোপুটি খাচ্ছে স্বীয় বাবার বাহুমাঝে। যেন দূর্দমনীয়, চঞ্চল ভীষণ!

আজকে হঠাৎ মাফিয়া বসের কোলে ছোট্ট এই প্রাণকে দেখে স্বয়ং গার্ডরাও আশ্চর্যের শিয়র ছুঁলো। তবে অভিব্যক্তি নির্লিপ্ত। অবশ্য আশ্চর্য হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়, চার মাসের ছোট্ট ইয়াশ ইউভান জেনেটিক্যালি অবিকল তার বাবার বৈশিষ্ট্যের। দু’জনার চোখ, শূন্য নির্জীব দৃষ্টি, এদিক ওদিক তাকানোর ভঙ্গিমা সবকিছুই অদ্ভুত ভাবে এক।
দেখলে যে কারোরই মনে হতে পারে, স্বয়ং কার্বন কপি কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মাফিয়া বস ।
হেলিপ্যাড ছাড়িয়ে সামনে এগুলো এরীশ। গার্ডদের মুখোমুখি হতেই বাম হাতের করতল বাড়িয়ে ইশারায় দিতে বললো কিছু একটা। সঙ্গে সঙ্গে একজন কালো পোশাকধারী এগিয়ে এসে চকচকে একটা ভারী রিভলবার ধরিয়ে দিলো তার হাতে, সহসা দৃষ্টি ঘোরালো মাফিয়া বস। রিভলবারটার দিকে বিতৃষ্ণ চোখে চেয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার, তৎক্ষনাৎ ধ্বনিত হলো চাপা হুংকার,

— গান নয় ফিডার দিতে বলেছি, ইডিয়ট!
অন্য একজন গার্ড তড়িৎ পায়ে এগিয়ে এসে ভুল শুধরালো তক্ষুণি, রিভলবারের বদলে তার হাতে ধরিয়ে দিলো তরল দুগ্ধ মিশ্রিত ফিডার। এক হাতে ছোট্ট ইয়াশ আর অন্যহাতে তার ফিডিং বোতল সমেত ভেতরে ভেন্যুর দিকে এগিয়ে গেলো এরীশ।
কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের মতোই শান্ত, নির্মল আবহ। ওয়াইল্ড ল্যাভেন্ডারের মিষ্টি একটা সুঘ্রাণ হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। একটুকরো স্বর্গরাজ্য যেন আজ হামেশাই নেমে এসেছে লোকালয়হীন নিস্তব্ধ এই ছেঁড়া দ্বীপে। মাথার উপর হরেক রকম ঝুলন্ত আলো আর টাটকা ফুলের সৌরভে মুখরিত হয়ে আছে সমগ্র দ্বীপ।
আউটডোর ডেকোরেশন, অথচ প্রতিটি ধাপে ধাপেই রয়েছে চমকপ্রদ সব রাজকীয় সম্ভাষণ।
পায়ের নিচে মখমলি আবরণের নরম সবুজ কার্পেট, মাঝখানের ওয়াকওয়ে জুড়ে স্টেইনলেস কাচের চকচকে হাঁটার রাস্তা। যার দু’ধারে ঝাঁকে ঝাঁকে ফুটে আছে হরেক রকম ঝুলন্ত সাদা ফুল। এখান থেকেই অহং পদধূলিতে হেঁটে হেঁটে স্টেজে গিয়ে দাঁড়াবে স্বয়ং ব্রাইড।

স্টেজ তো নয়, যেন শিল্পীর নিঁপুন হাতে বানানো কোনো রাজকীয় প্রদর্শনী। যা কেবল দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়। ফুল আর আলোয় সজ্জিত এই স্টেজটা এতোটাই মনোহর আর নজরকাড়া বলে বুঝানোর নয়। মন্থর, সহনীয় নীল আলোয় একপ্রকার স্বর্গীয় ঝলক দিচ্ছে পুরো মঞ্চটা, তার ঠিক পেছনে ত্রিভুজাকৃতির সাদা সোনালু কারুকাজের ব্যাকড্রপ। সিলিং এর দিকের জায়গাটা সবচেয়ে আকর্ষনীয়। সেখানে নানান ভঙ্গিতে ঝুলে আছে চকচকে সাদা ক্রিস্ট্যালের তৈরি একাধিক চ্যান্ডেলিয়র।সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে একযোগে দ্যুতি ছড়াচ্ছে সাদা আর সোনালীর মিশেলে লতানো ফুলের ডেকোর। স্টেজের ঠিক মুখোমুখি দু’পাশের জায়গাটা অতিথিদের জন্য। যার পুরোটা জুড়ে রয়েছে রাজকীয় ধাঁচের অভিজাত সব আরামদায়ক গদি।

ট্রান্সপারেন্ট ঘোস্ট চেয়ার গুলো রাত বাতির ম্লান আলোতে ভীষণ লাক্সারিয়াস দেখাচ্ছে। একেকটি গোলাকৃতির টেবিলকে কেন্দ্র করে বসানো হয়েছে এই চেয়ারগুলো। প্রতিটি টেবিলই যেন ডেকোরেটরের উন্নত রুচির বহিঃপ্রকাশ। ব্ল্যাকসিল্ক টেবিলক্লথে আবৃত টেবিলের চারিপাশ দখল করে নিয়েছে দারুণ ভাঁজের অফ হোয়াইট ক্ল্যাসি ন্যাপকিন, পাশেই ক্রিস্ট্যাল ওয়াইনের নান্দনিক গ্লাস, তার ঠিক মাঝখানের যায়গাজুড়ে একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু লম্বা এক ক্যান্ডেল হোল্ডার। যার চারপাশে রয়েছে নানান রকম শোভাবর্ধক ফুল আর স্বচ্ছ সাদা মোমবাতি। মোমবাতির এই হালকা নরম আলোয় যেন আরও বেশি অভিজাত্যপূর্ন আর সুশোভিত হয়ে উঠেছে ভেন্যুর পরিবেশ।

এবার শুধু একটা জিনিস বাকি,আর তা হলো স্নোফল। এরীশ চায় ওর ওয়েডিং এর সময় স্নোফল হোক। বরফের শুভ্রতায় মুড়িয়ে যাক সমগ্র শহর। কারণ এই সাজসজ্জা, এই ফুল কোনোকিছুই অভিভূত করতে পারেনা ওকে। সবকিছুই কেমন নিস্তেজ অহেতুক মনে হয়। তুষারই একমাত্র জিনিস যা ওর কড়াপড়া নির্জীব হৃদয়ে তৃপ্তির ঢেউ তুলে দেয়। বরফ দেখলেই চক্ষু শীতল হয় । মৃতদের মতো শীতল। যেই শীতল চোখের অন্তরায় নিমেষেই ধ্বংস হয়ে যায় সমগ্র মহাকাল।

ত্রুটিহীন নিঁখাদ আয়োজনের কোনো কমতি নেই, নেই কোনো নিরাপত্তার ঘাটতি। তুষারের একান্ত তদারকি বলে কথা। তবুও চারিদিকের ডেকোরশনে একপল চোখ বোলালো মাফিয়া বস। চোখ বোলাতে গিয়েই নির্দিষ্ট একটা জায়গায় লক্ষ্য স্থীর হয়েছে তার। পরবর্তী কয়েকমূহুর্ত আর চোখ সরালো না। বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ শিকারী দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো অনিমেষ। অতঃপর কিয়ৎক্ষনবাদে চোখ সরালো ধীরে ধীরে। যেন কিছুই হয়নি, সবকিছু শান্ত স্বাভাবিক তেমন করেই ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তুষারের নিকট।
তুষার তখন ভাবনায় নিমজ্জিত। অকারণ একটা দুশ্চিন্তা পদ্মাসন হয়ে গেড়ে বসেছে তার ভ্রুদ্বয়ের মাঝখানে। বেখেয়ালে জিভ তালুর সন্ধিতে চ উচ্চারণ করে কানের মধ্যে হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করছে সেই তখন থেকে। হঠাৎ করেই এয়ারবাডসটা ডিস্টার্ব করছে ভীষণ। কানেকশন লুজ হয়ে যাচ্ছে বারবার। এমন হলে তো চারিদিকে নজর রাখা মুশকিল।নেটওয়ার্কের সামান্য জটিলতায় তুষার যখন দ্বিধাগ্রস্থ, ঠিক তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো মাফিয়া বসের রাশভারি কণ্ঠস্বর,

— ইজ এ্যানিথিং রং?
চকিতে ঘাড় ঘোরালো তুষার। তেমন কিছু ঘটেনি ব্যাপারটা বোঝাতে ঠোঁট বাঁকিয়ে স্ফীত হাসলো সে । অতঃপর সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— কি করে বুঝলেন?
এরীশ নিজ হাতের ঘড়িটা ওর মুখের সামনে তুলে ধরলো। দ্বিধাহীন কণ্ঠে আওড়ালো,
— ব্লাডপ্রেশার হাই।
— ওহ, ওটা অন্য কারণে।

কিছু একটা ভেবে দাঁতের ডগায় অধর কামড়ে ধরলো তুষার। সম্ভবত ভাবনার বিষয়টা ফ্লোরা। এরীশ সেসব প্রসঙ্গ এরিয়ে, স্পষ্ট গম্ভীর একটা অভিব্যক্তি টেনে আনলো চেহারায়। অতঃপর তুষারের কোলে ইয়াশ আর হাতে ইয়াশের ফিডার ধরিয়ে দিয়ে ওর কান থেকে এয়ারবাডস গুলো খুলে নিলো স্বাভাবিক ভঙ্গিমায়। সেগুলো নিজের কানে ঢোকাতে ঢোকাতে নিস্পৃহ ভাবেই বলে উঠলো ,

— বিয়ে করতে এসেছো তুমি এখানে, কোনো মিশন সাকসেসফুল করতে নয়। সো ট্রাই টু বি নরমাল।
বাক্যটুকু শেষ করে তুষারের কোমরের খাঁজে আবদ্ধ রিভলবারটা একটানে মুঠোয়পুরে নিলো এরীশ। জবাবে তুষার কিছু বলবে তার আগেই রিভলবার লোড করতে করতে ঝোড়ো হাওয়ার গতিতে কন্ট্রোল রুমের দিকে এগিয়ে গেলো সে ।
ওদিকে মাফিয়া বসের গমন পথের দিকে কয়েকমূহুর্ত নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে থেকে স্বগোতক্তি করে বিড়বিড়ালো তুষার,
— কে কাকে নরমাল থাকতে বলছে আশ্চর্য!

একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘুটঘুটে বেজমেন্ট। নেই কোনো জানালা, নেই কোনো ভেন্টিলেটর। অথচ সমগ্র রুম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস। কোথাও মনিটর, কোথায় পিসি, কোথাও বা যান্ত্রিক ওয়াকিটকি। চারিদিকে তারের ছড়াছড়ি, ঠিক তার মধ্যবর্তী স্থানে একটা ছোট্ট আধভাঙা একহারা ডেস্ক। যার একপাশে সিগারেট ভর্তি এ্যাশট্রে, আর অন্যপাশে চকচকে হুইস্কির বোতল। একটা ধাতব ক্রীস ডেস্কের সঙ্গে এলিয়ে রাখা। তার পাশেই রিভলভিং চেয়ারে পৃষ্ঠদেশ ভাজ করে ঝিমিয়ে পড়া প্যাঁচার মতো বসে আছে একজন।প্রবল দুশ্চিন্তায় তার একটি পা অহেতুক নড়ছে, আর অন্যটি মৃতের ন্যায় নির্জীব। ঠিক যেন ডেথনোট সিনেমার ডিটেকটিভ এল। তার খামখেয়ালি উদাসীন দৃষ্টি সামনে থাকা মনিটরে নিবদ্ধ। যার প্রতিটি খন্ডাকৃতির স্ক্রীনে ভেসে আছে মাফিয়া বসের রাজকীয় বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানের একেকটি দৃশ্য।

লোকটা হুডির আস্তিন মাথায় টেনে নিলো। অতঃপর কন্ট্রোল রুমে দাঁড়িয়ে সিকিউরিটি ক্যামেরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা এরীশকে পর্যবেক্ষন করতে থাকলো নীরবে । একধ্যানে, একমনে। যেন এরীশের প্রতিটি পদক্ষেপে জড়িয়ে আছে তার অপার আগ্রাসন। এরীশ ক্যামেরা গুলোর দিকে এগুতেই লোকটা মাউস চেপে স্ক্রিন বড় করলো। মাফিয়া বসের উদগ্রীব সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে নজর পড়তেই জ্বালাময়ী এক পৈশাচিক হাসি ফুটলো তার ওষ্ঠকোণে। ফের ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো তা রহস্যের আড়ালে। অহেতুক দাঁতে দাঁত পিষলো সে মানব, ফনা তোলা সাপের মতোই ফুঁসে উঠলো অতর্কিতে । তার গভীর কালো নেত্রে দাউদাউ করে জ্বলছে প্রতিশোধের তীব্র স্পৃহা। সেই অগ্নিদৃষ্টি নিয়েই মনিটরের দিকে আরেকটু ঝুঁকলো সে । বিগস্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা এরীশের চোখে চোখ রেখে হিসহিস করে আওড়ালো,

— ইউ আর ইন ডেঞ্জার মাফিয়া বস! তোমার শত্রু, তোমার দূর্বলতা ধরে ফেলেছে। সো স্টার্ট দ্যা কাউন্টডাউন। একটামাত্র ভুল পদক্ষেপ, এ্যান্ড ইউওর বেবিগার্ল ইজ ইন মাই গ্র্যাস্প। তোমাকে আর আমাকে দু’জনকেই ধ্বংসস্তূপ বানানোর একমাত্র হাতিয়ার ওই মেয়েটা। ওর জন্য হয় তোমার হাতে আমি ধ্বংস হবো, নয়তো আমার হাতে তুুমি। তাইতো সবার আগে খু’ন’টা আমি ওকেই করবো। লেটস সি, হাউ লং ইউ ক্যান প্রটেক্ট হার!
বাক্যটুকু শেষ হতেই অদ্ভুতভাবে নড়েচড়ে উঠে চোখের পলকে ঠাস করে বন্ধ হয়ে গেলো মনিটরটা। ঘটনার আকস্মিকতায় ক্রুদ্ধ হয়ে সেটিকে জোড়ালো মুষ্টাঘাতে ছুড়ে ফেলে দিলো রহস্যমন্দ্রিত সেই মানব , তমশাচ্ছন্ন স্যাতেসেতে মেঝের কোনো এক কোণে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ে রইলো যন্ত্রটা। অদ্ভুত মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টে সেই ভাঙাচোরা অংশগুলো পরখ করতে করতেই আচানক ধরিত্রী কাঁপিয়ে গর্জে উঠলো লোকটা,
— এরীশ ইউভাননননন! ইউ ফাকিং এ্যাসহোল!

কন্ট্রোল রুমের সবচেয়ে কর্ণারের সিকিউরিটি ক্যামেরাটাকে সেই তখন থেকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পরখ করছিল এরীশ। যেটা কিনা ওর কোম্পানির কোনো ব্র্যান্ড নয়। লাগানোর কৌশলটাও ভীষণ অদ্ভুত, এক কথায় অপরিকল্পিত। যদিও খুব কৌশলে আড়ালে সেট করা হয়েছে, তবে মাফিয়া বসের সিক্সসেন্স বলছে এই ক্যামেরার পেছনে তো একজন নিশ্চিত বসে আছে। যে এই মূহুর্তে বাজপাখির দৃষ্টিতে এরীশকে দেখছে। পুরো ব্যাপারটা মস্তিষ্কে ক্যাচ করতে সময় নিলো কয়েক সেকেন্ড পরমূহুর্তেই ফটাফট রিভলবারের ট্রিগ্যার টেনে উড়িয়ে দিলো সেটিকে। ছয়ছয়টা গু’লির প্রভাবে নিমেষেই বিলীন হয়ে গেলো ডিভাইসটা। এরীশ সেই ধ্বংসস্তূপের দিকে চেয়ে চোয়াল শক্ত করলো। ভেতরের ছাইচাপা জিদের একটুখানি প্রস্ফুটন ঘটিয়ে তীব্র আক্রোশ নিয়ে বেজে উঠলো তার ব্যঘ্র কণ্ঠস্বর,

—- আ’ম নট ইন আ ডেঞ্জার। আই এ্যাম দ্যা ডেঞ্জার!
বজ্রধ্বনিতে স্বগোতক্তি করা মাত্রই কক্ষ থেকে ছুটে পালালো কেউ। কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে চকিতে ঘাড় ঘোরালো এরীশ। ততক্ষণে দরজা গলিয়ে করিডোরের প্রান্ত ধরে ছুট লাগিয়েছে অবয়বটি।
— সন অব আ বিচ!

এরীশ সময় নিলোনা আর, দাঁতে দাঁত পিষে কয়েক দফা অস্রাব্য গালি ছুড়ে ঝড়ের বেগে ধাওয়া করলো লোকটিকে। কয়েকমূর্হুতের ব্যাবধান মাত্র, তন্মধ্যে কালো মাস্ক আর বেসবল ক্যাপে আবৃত স্পাই গোছের লোকটার গতিরোধ করলো মাফিয়া বস। পেছন থেকেই কোমর বরাবর শক্ত এক পদাঘাতে উল্টে ফেললো মার্বেল পাথরের মসৃণ মেঝেতে। গতি জড়তায় পর্যুদস্ত হয়ে কয়েক দফা হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো সেই গুপ্তচর । অতঃপর নাক টেনে শ্বাস তোলার আর সময় দিলোনা এরীশ, তার আগেই হাঁটুর সবটুকু ভর ছেড়ে দিয়ে ঋজু হয়ে বসে পড়লো লোকটার পিঠের উপর। সঙ্গে সঙ্গে গলাকাটা মুরগীর মতো ধড়ফড় করে উঠলো তার প্রাণ ,র’ক্তা’ক্ত মুখ থেকে আপনাআপনি নিসৃত হলো তীব্র ব্যথাতুর আর্তনাদ। সেদিকে দৃষ্টিপাত না করেই কঠোর থাবায় লোকটার চুলের গোছা আঁকড়ে ধরে অকস্মাৎ টান মে’রে মাথাটা মুখের কাছে নিয়ে এলো এরীশ। ক্রোধান্ধ হয়ে হাতের মুঠোয় আরও খানিকটা শক্তি প্রয়োগ করে হিমশীতল কণ্ঠে নিসৃত করলো ভয়াবহ এক বাক্য,

— ম’র’তে এসেছিলি?
আহত শরীরটা ছটফট করে ওঠে । মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ,
—- উমমম, না৷ উমমম!
নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে সময় নিয়ে জবাব দেয় এরীশ,
— আজ খু’ন করার ইচ্ছে ছিল না। জীবনে একটা মাত্র আবদার করেছিল আমার বউ। সকাল থেকে একফোঁটাও র”ক্ত লাগাইনি হাতে।ড্রাগের তাড়নায় মাথাটা কিলবিল করছে তবুও নিজেকে দমিয়ে বসে আছি। যদি নিজেকে একবার সামলাতে পারি তবে ড্রাগের চেয়েও ভয়ংকর নেশায় ডুব দেওয়ার অঙ্গিকার পেয়ে যাবো। কিন্তু তুই আমাকে বাধাগ্রস্থ করেছিস। তোর জীবনটা যে আমার হাতেই যাওয়ার ছিল ।সো আই হ্যাভ নাথিং টু ডু।

হাতের কাছে ধারালো কোনো অ’স্ত্র নেই, রিভিলবারটাও রেখে এসেছে কন্ট্রোল রুমে। কিন্তু এরীশ তো কাউকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না। সহসা পরবর্তী কাজটা জানোয়ারের মতোই ঘটিয়ে ফেললো সে । নিজের পরিধেয় ব্লেজারের সঙ্গে লাগোয়া যে ব্রোঞ্জপিনটা ছিল, সেটাকেই খুলে আনলো একটানে। পরপরই সেকেন্ডের ব্যবধানে ওই ধারালো অংশ দিয়ে অকস্মাৎ মূমুর্ষ লোকটার কণ্ঠনালিতে জোরে জোরে আ’ঘাত করতে শুরু করলো এরীশ। যেন কোনো শিকারকে ধরাশায়ী করায় মগ্ন হয়ে আছে কোনো হিংস্র দানব । একবার দু’বার নয়, অগণিত অজস্রবার।
প্রবল আক্রোশে লোকটাকে মারতে মারতে যখন কণ্ঠনালিটা থেঁতলে ফেললো, ঠিক তখনই মাফিয়া বসটার র’ক্ত রঞ্জিত চেহারায় প্রজ্জ্বলিত হলো অকৃত্রিম এক তৃপ্তির ঢেউ ।

শুভ্ররঙা ধবধবে এক আকর্ষনীয় ট্রেইল গাউন গায়ে চড়াতেই বিয়ের সাজসজ্জা সম্পূর্ণ হলো ঈশানীর।কয়েকহাত লম্বা ট্রেইলের এই ভলিউম গাউনটা ভীষণ ভারী। তাইতো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেটিকে সামলাতে গিয়ে বড্ড বেগ পোহাতে হচ্ছে তাকে। সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকতেই হঠাৎ মনে হলো পেছনের চেইনটা খুলে গিয়েছে, অগত্যা পেছনে না ঘুরেই ডাকলো ও মেয়েদের।
— কেউ আছো? আমার পেছনের জিপারটা বোধ হয় খুলে গিয়েছে, একটু ঠিক করে দাওনা।
ঈশানী যেহেতু ব্যাসিক রাশিয়ান শব্দগুলো শিখে গিয়েছে, তাই টুকটাক কথোপকথনে সমস্যা হয়না খুব একটা। কিন্তু ঈশানীর ডাকে সারা দিলো না কেউ, যার দরুন আবারও ডেকে উঠলো রমণী,

— কেউ নেই এখানে?
আবারও নিস্তব্ধতা। হতে পারে মেয়েগুলো সব ফ্লোরাকে তৈরি করাতে ব্যস্ত, কিন্তু ঈশানীর কেন এমন লাগছে? কেন বারংবার মস্তিষ্ক জানান দিয়ে যাচ্ছে কারোর তীক্ষ্ণ উপস্থিতির? মনে হচ্ছে যেন একজোড়া চোখ মোহাচ্ছন্ন হয়ে নিগূঢ় দৃষ্টিতে পরখ করে চলেছে অবিরাম। বুকের ভেতর অনিশ্চিত একটা শঙ্কা জেঁকে বসতেই তড়িৎ খেলে গেলো সর্বাঙ্গে। অস্থির চিত্তকে প্রশ্রয় দিয়ে চট করেই ঘুরে তাকালো রমণী। বিস্মিত কণ্ঠে ডেকে উঠলো,
— রীশ!
ঈশানীর থেকে কয়েকহাত দূরে লেদারে মোড়ানো কাউচ চেয়ারটায় উরুর উপর পা তুলে বসে আছে এরীশ। হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর এক ঠান্ডা র”ক্তের খু’নি। অথচ ঈশানীর চোখে সে এক ভয়ংকর প্রেমিক।
এরীশের পুরন্ত হাতের মুঠোয় আবদ্ধ হয়ে আছে একগুচ্ছ গাঢ় নীল গোলাপ। ঈশানী অবশ্য খেয়াল করেনি সেসব। বিস্ময় ভাবটা কেটে যেতেই, দ্বিধাহীন কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো ,

— সারা দিচ্ছিলে না যে?
এতোক্ষণে চোখের পাতায় পলক ফেললো এরীশ। তুলে রাখা পা টা অবলীলায় দোলাতে দোলাতে নিস্পৃহ কণ্ঠে জবাব দিলো সে,
— দেখতে ভালো লাগছিল তাই।
স্বামীর এই একটুখানি মিষ্টতায়, রমণীর নিখাঁদ প্রতিমার মতো মুখটা আরক্ত হলো লাজে। নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়ে রিনরিনে গলায় শুধালো ,

— সুন্দর লাগছে আমায়?
এরীশ জবাব দিলো না, চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এসে ঈশানীর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো, গ্রীবাটা বাঁকিয়ে অনেকখানি ঝুঁকে উষ্ণ শ্বাস ফেললো ওর পরিপাটি মুখের ওপর। আকস্মিক উষ্ণতায় দুলে উঠল রমণীর ভীত সন্ত্রস্ত অন্তরঃকরণ। চোখ বুঁজে বিপন্ন ভঙ্গিমায় জানতে চাইলো,
— কি চাইছো?
— স্রেফ তোমাকে। আর কিচ্ছু না।
মাফিয়া বসের হিমশীতল নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর। ধীরে ধীরে চোখ তুললো ঈশানী, আচ্ছন্ন গলায় শুধালো,
— একবারও তো ভালোবাসি বললে না?
এরীশ সে কথার প্রত্যুত্তর করলো না। প্রসঙ্গ এরিয়ে হাতের নীল গোলাপ গুলো এগিয়ে দিলো ওর নিকট। রমণীর নীলাভ চোখে আমাবস্যার আধার। থৈথৈ করছে অভিমানী অশ্রু। তবুও ফুল গুলো দেখামাত্র একটু অবাকই হলো সে। কৌতুহলী হয়ে বললো,

— এগুলো তো নীল গোলাপ! নীল রঙের যে গোলাপ হয় সেটা তো জানাই ছিলনা আমার। কি ভীষণ সুন্দর!
নীল গোলাপের সৌন্দর্যে বিভোরিত হয়ে সেগুলোকে আলতো স্পর্শে গালে ছোঁয়ালো রমণী। তৎক্ষনাৎ ভেসে এলো মাফিয়া বসের বিমুগ্ধ পুরুষালি কণ্ঠস্বর,
— ভেরী বোল্ড, যাস্ট লাইক ইউওর আইস।
ঈশানী চোখে হাসে। সেই মাদকীয় হাসিতে মোহাচ্ছন্ন হয়ে ওর ভেজা নরম ওষ্ঠপুটে আঙুল বোলায় মাফিয়া বস। ঠোঁট নাঁড়িয়ে কিছু বলতে যাবে, তন্মধ্যে ওর গতিরোধ করলো রমণী। অকস্মাৎ ধ্বনিত হলো শঙ্কিত কণ্ঠস্বর,
— তোমার হাতে র”ক্ত এরীশ!
ঈশানীর রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখের দিকে চেয়ে তৎক্ষনাৎ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলো এরীশ। প্রথমে তাড়াহুড়ো করে জিভের সাহায্যে আঙুলে ডগার রক্তটুকু চুষে পরিস্কার করলো। অতঃপর আলতো হাতে জামার চেইনটা লাগিয়ে দিতে দিতে ধাতস্থ করলো ঈশানীকে। যেন কোনো নীরব স্বান্তনা। তেমন করেই ভেসে এলো তার গভীর মন্ত্রমুগ্ধ কণ্ঠস্বর,

—- জিজ্ঞেস করেছিলে না কেমন লাগছে? উত্তরটা আজ রাতেই পাবে,খুব গভীর রাতে।
বাক্যটুকু শেষ হতেই ঈশানীকে অসমাপ্ত ধোঁয়াসার মাঝে রেখেই মেকআপ রুম ত্যাগ করলো এরীশ। ঈশানীর মাঝে ভোঁতা, অস্ফুট এক উৎপীড়ন। পুতুলের মতো সাজানো চোখ দু’টোতে অজানা অভিমানের ঢেউ। অথচ নারী মনটা গলে তরল হয়ে গিয়েছে সেই কবেই। হৃদয়কুঠুরে এখনো হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো লেগে আছে এরীশ । তার পুরুষালি শরীরের ক্লোনমিশ্রিত সুঘ্রাণটাও নাকের ডগায় সুরুসুরি খাচ্ছে ক্রমাগত। মাঝেমধ্যে ঈশানীর মনে হয় এই সুঘ্রাণটা পৃথিবীর সকল মাদকতার উর্ধ্বে। মানুষটা কাছে এলেই কেমন উন্মাদ লাগে ওর। তার গভীরকণ্ঠে যেন আফিমের আভাস। কানে এসে বাজলেই কেমন লজ্জায় গুটিয়ে যায় রমণী। যেন এক স্বঘোষিত কলঙ্ক হয়ে ঈশানীর সর্বাঙ্গে মিশে আছে তার অস্তিত্ব।

এই মন পড়েছে আমার বড় দোটানায়,
প্রেম বয়ে আনলো হঠাৎ,
দমকা হাওয়ায়………
এই আশিকি, আশিকি,
করলো কি জাদু হায়…
সাকুরা, আমার জীবনের একটুখানি পবিত্রতার উপমা তুমি। কঠোর নিষ্ঠুরতার আড়ালে আমার অব্যক্ত অভিমানের সাক্ষী, আমার অনিশ্চিত ভবিতব্যের পরিণিতা। কয়লার মতো কলুষিত জীবনের একটুখানি প্রশান্তি তুমি। অদমনীয় নৃ”শংসতায় ডুবে থাকা এই পাথুরে হৃদয়ের অগ্নিদাহ, সেটাও তুমিই। হ্যা ঠিকই বলেছি, তোমার আগমনে আমার অন্তরে যে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটেছিল, তা এখন দাবানলের মতো আগ্রাসী। হৃদয়টাকে পোড়াও তুমি সর্বক্ষন, স্টিল ফিল অ্যা ফায়ার বার্নিং ইনসাইড মি। ইয়েস, ইট’স ট্রু। কিন্তু তবুও আমি তোমাকে চাই।
প্রেম আমার, উঁহু তুমিতো আত্মার অংশ আমার । আমি এমন ভাবে তোমাকে চাই, যেমনভাবে পৃথিবীর কেউ কাউকে কখনো চায়নি। তুমি আমার কাছে রক্তহীরকের চেয়ে অধিক মূল্যবান।

আমার পবিত্র সরলতা, শুধুমাত্র আমিই একমাত্র পাপ, যা তোমাকে স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখে। এর বাইরে কোনো পাপাচারের ছাঁয়াও কখনো পড়বে না তোমার শরীরে। তোমার পবিত্র সত্তা, সবসময় পবিত্রই থাকবে। যদি কখনো প্রকাণ্ড ঝড় আসে আমি ঢাল হয়ে রুখবো,যদি ব্যর্থ হই, তবে প্রাণটাই দিয়ে দিবো। তবুও তোমাকে নয়। তুমি বরং আমাকে পোড়াও। নিজের সংস্পর্শে শাস্তি দাও। আমি শান্তি ভেবে পুরোটা গ্রহন করে নেবো। তবুও এই মরিচীকার সঙ্গী হয়ে আঁধার দুনিয়ায় থেকে যাও, যেমন করে থাকে অমোচনীয় কালোদাগ। আমি শুধু তোমাকে চাই!

কাঁচের তৈরি স্বচ্ছ ওয়াকওয়ে ধরে দৃপ্ত পায়ে হেটে আসা এক ভূবনমোহিনী নীলাক্ষী রমণীর পানে আচ্ছন্ন দৃষ্টে চেয়ে আছে এরীশ ইউভান। মনে মনে গেঁথে চলেছে একের পর এক অব্যক্ত পঙক্তি । কেবল মাত্র দৃষ্টির দৃঢ়তায় দিয়ে যাচ্ছে হাজারো দ্বিধাহীন অঙ্গীকার । নিজের নামে দলিল করে নেওয়া স্ত্রীকে আজ এই বধূবেশী সজ্জায় দেখে, ওই বুলেটবিদ্ধ হৃদয়টাতে কি ভয়ংকর ঝড়টাই না বয়ে যাচ্ছে, সেসব তার কঠোর চিবুক আর শূন্য চোখ দেখে বুঝে ওঠা দায়। ওদিকে তুষার ছিল সাবলীল। তার ঠোঁটের কোণে সৌজন্যের নিস্তেজ হাসি। কেবল অপলক চেয়ে আছে ওয়াকওয়ে ধরে হেটে আসা ঈষৎ সোনালু চুলের রুশ মেয়েটার দিকে। ওর হবু স্ত্রী।
তামাটে বর্ণের তুষারের পাশে এহেন গোলাপি চেহারার টুলটুলে রমণী। মানাবে তো? একমুহূর্তের জন্য আশ্চর্য এই প্রশ্নটা খেলে গেলো তুষারের মস্তিষ্কে।
ওদিকে দুপাশের অতিথিদের পূর্ণদৃষ্টি স্টেজের অভিমুখে হেটেচলা ব্রাইডদ্বয়ের গমনপথের দিকে।

I’ve daed everyday
waiting for you,
Darling Don’t be afraid
i’ve loved you,
For a thousand year’s,
I waiting for a thousand year’s…….
ক্রিস্টিয়ান পেরির সুমধুর কণ্ঠের তালে তালে পা মিলিয়ে শুভ্ররঙা লং-ট্রেইল ফ্লোরটাচ্ গাউনটাকে অবলীলায় জমিনে ছড়িয়ে রাজকীয় বেশে হাঁটছে তারা। হাঁটার তালে ভলিউম গাউনের ঝালরগুলো প্রস্ফুটিত ফুলের মতোই ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে । মাথার হেট পিসের সঙ্গে লাগোয়া স্বচ্ছ সাদা ভেইলটাও তার সামিল।
দু’জনার একই সাজ, একই সৌন্দর্য। একজন যেন শুভ্রতায় মোড়ানো প্রশান্তির ছোঁয়া, আর অন্যজন দীর্ঘ রাতের শেষে নেমে আসা সদ্য ভোরের নরম উষ্ণতা। একই ছন্দে একই তালে নিজেদের ভালোবাসার মানুষকে নিশানা করে এগিয়ে চলেছে দু’জন। পার্থক্য শুধু এটুকুই, ঈশানীর হাতে আবদ্ধ একগুচ্ছ স্বচ্ছ নীল গোলাপ। শরতের মেঘমুক্ত আকাশের মতোই গাঢ় সেই রঙ। আর ফ্লোরার হাতে একগুচ্ছ শুভ্র স্নিগ্ধ ফুলের বাকেট, যার নাম বেবিস ব্রেথ।

স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন সুদর্শন গ্রুমের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছেন ডক্টর মাতভেই। বিচক্ষণ পরিপক্ব, শক্ত তার মুখের গাঁথুনি। তিনি আজ ডক্টর নয় প্রিয়েস্ট হয়ে এসেছেন। এরীশ আর তুষারকে বিয়ের শপথ পড়ানোর দ্বায়িত্ব তার।
অবশেষে ওরা যখন হেটে এসে যে যার গ্রুমের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো, ঠিক সেসময় অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন মাতভেই।
ঈশানী স্টেজে এসে দাড়িয়ে সবার আগে দৃষ্টিপাত করলো ইয়াশের পানে। ছোট্ট স্ট্রোলারের মাঝে প্রথম সারির অতিথিদের সঙ্গে বাবু হয়ে বসে আছে সে। জাঁকজমকপূর্ণ এই অনুষ্ঠানের মর্মার্থটা ঠিক বোধগম্য না হলেও, বাবা মায়ের একত্র দর্শনে তার কচি কোমল ঠোঁটে লেগে রয়েছে বিস্তীর্ণ হাসির ঢেউ। কোনো এক অজানা খুশিতে হাত-পা ছুড়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করছে সে। ছেলের হুটোপুটি অবলোকন করে চোখে হাসলো ঈশানী, তারপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে চোখ রাখলো একজোড়া প্রাণশূন্য নির্জীব চোখে। ফলস্বরূপ অচিরেই অনুভব হলো চোখের মালিকের নিরবধি ব্যকুলতা।

বিয়ের সূচনা হতে না হতেই ঝিরিঝিরি স্নোফল হতে লাগলো। হিম হিম হাওয়ায় ভর করে সূদুর আকাশ থেকে গায়ে এসে ঠায় জমাচ্ছে শুভ্র তুষারের কুঁচি।আবার পলক ছাড়ার আগেই হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো গলে যাচ্ছে সেগুলো। এ যেন বিয়ে নামক শুভক্ষণে স্বয়ং প্রকৃতির আর্শিবাদ। চারিপাশে হাড়হিম কনকনে ঠান্ডা বাতাস। অথচ ফ্লোরা আর ঈশানী,বিমূঢ় নির্লিপ্ত। দু’জনকেই অদৃশ্য বলয়ের মতো ঘিরে রেখে আছে সুখ সুখ অদ্ভুত এক উষ্ণতা। যার দরুন স্নোফলের মাঝেও তাদের কপোলে ফুটেছে আরক্ত উষ্ণ আভা।
বিয়েটা যেহেতু মাফিয়াদের মধ্যে, তাই কারোরই বিয়ের শপথ হলো না ওদের । যদিও মাফিয়া বস ইতিমধ্যে হাজারো অব্যক্ত শপথ করে বসে আছে ওই একহারা বাঙালি রমণীর নামে। আর তুষার? তার অভিব্যক্তি বোধগম্য নয়। সে কি দ্বায়িত্বে জড়াতে চাইছে ? নাকি ভালোবাসায়? ফ্লোরা এখনো অনিশ্চিত। তার এলোমেলো ভাবনাগুলো মস্তিষ্কে হুলের মতো বিঁধছে? শুঁয়োপোকার মতো নীরবে ক্ষয়ে যাচ্ছে রমণীর অন্তর। এই লোকটাকে আর কবে বুঝতে পারবে সে? বিয়েটা আদৌও সংসার অবধি গড়াবে? নাকি সর্বহারা কলুষিত বলে কেবল নামেমাত্র স্ত্রী হয়ে থেকে যাবে ফ্লোরা? আর যাই হোক এতোকিছুর পরে তুষারের অবহেলা অন্তত সহ্য করতে পারবে না মেয়েটা।

ফ্লোরার ভাবনার মাঝেই ডক্টর মাতভেই সাধারণ আনুষ্ঠানিকতা পালনের উদ্দেশ্য তাদের দু’জনার সামনে এসে দাঁড়ালেন। দু’জনকে ইশারা করে খুব সাবলীল ভাবেই বললেন,
— দুজন দু’জনার হাত ধরুন।
প্রথম হাতটা তুষারই বাড়ালো ফ্লোরার দিকে। একবুক সংশয় নিয়ে ফ্লোরাও সেই হাতেহাত রাখলো। ভীষণ যত্ন সহকারে রমণীর শীর্ণ হাতটাকে আঙুলের মধ্যে ঠায় দিলো মানব। এতোটুকুতেই ঘাম ধরে গেলো ফ্লোরার। পরিস্থিতিটাকে স্বপ্ন বলে মনে হলো।
ঠিক তক্ষুণি ভেসে এলো মাতভেই এর গম্ভীর কণ্ঠস্বর। তিনি এবার একহাতে মাইক্রোফোন আর অন্য হাতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে তুষারের উদ্দেশ্য বললো,

— প্লিজ আমার সঙ্গে বলুন।
অতঃপর প্রিয়েস্টের সঙ্গে সঙ্গে বলতে আরম্ভ করলো তুষার। সেই বাক্যগুলো, যা পাঠ করার সঙ্গেই স্নোফ্লেক্স নামটি সুক্ষ্মভাবে জুড়ে যাবে তার জীবনের সঙ্গে, তার দ্বায়িত্বে, তার অধিকারে তার একনিষ্ঠতায়।
—- আমি, তুষার জাওয়াদ মিকাইল, ফ্লোরা পেট্রোভাকে আমার আইনসম্মত স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করছি। আজ থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে সুখে-দুঃখে, হাসি-কান্নায়,এমনকি সমস্ত জটিলতায় পাশে থাকব। অসুস্থতায় ও সুস্থতায়, সমৃদ্ধি ও অভাবে সব অবস্থায় তোমাকে ভালোবাসব ও মর্যাদা দেব।
তুষারের পরে ফ্লোরাকে একই নিয়মে জিজ্ঞেস করা হলো,
— মিস ফ্লোরা পেট্রোভা, আপনি কি তুষার জাওয়াদকে আপনার আইনগত ও বৈধ স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি আছেন?তার সুস্থতা – অসুস্থতায়, ধনী বা দরিদ্র অবস্থায়, কিংবা জীবনের জটিলতম পর্যায়ে আপনি কি ভালোবাসা দিয়ে জীবনভর একসাথে থাকতে চান?

ফ্লোরা নির্লিপ্তে শুনে গেলো। ধীরে ধীরে মানস্পটে ভেসে উঠলো একের পর এক কলুষিত স্মৃতির অধ্যায়। মনে পরে গেলো সম্ভ্রমহানীর সেই বিভীষিকাময় রাতের কথা। সেই রাতে চেতনা থাকলে বোধহয় জীবনটা আর রাখা হতোনা । সর্বহারা নরকীয় জীবন, রেখে কিইবা লাভ? পরবর্তী দিনগুলোতেও একই ভাবনায় বুদ হয়েছিল ফ্লোরা। সর্বদা হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল রমণীর মস্তিষ্কে গোলোকের মতো ঘুরপাক খেতো আত্মঘাতীর নানাবিধ কৌশল।
তখনও কি জানতো, জীবন ওকে আরও একবার সুযোগ দিবে? এই তো সেই মানুষটা, ওর সামনেই দাঁড়িয়ে। যার দু’ফোঁটা অশ্রুজলের বিনিময়ে নিজের কলুষিত অধ্যায়কে চিরতরে মাটিচাপা দিয়েছে রমণী। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে নির্জীব পেন্ট হাউজের সেই চঞ্চতা হরিণী। শুধুমাত্র তার একটুখানি হাসিমাখা মুখ দেখার জন্যই তো আজ এখানে কনের সাজে দাঁড়িয়ে আছে ফ্লোরা। জীবন তাকে সুখ দিক কিংবা না দিক, তুষারকে তো দিয়েছে। এই বা কম কিসে? হুট করেই স্রোতস্বীনি নদীর মতো কুলকুলিয়ে সাহস সঞ্চারিত হলো রশকন্যার নাজুক বুকে। ভয়, দ্বিধা সংশয় সবকিছুকে দূরে ঠেলে দিয়ে, আস্তে আস্তে মুখ খুললো সে। জীবনটাকে তুষারের নামে বাজি ধরে দৃপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,

— ইয়েস, আই ডু!
ওদের দু’জনার সম্মতি গ্রহন শেষে এরীশ ঈশানীর দিকে এগিয়ে গেলো মাতভেই। একইভাবে তাদেরও বিয়ের শপথ সম্পন্ন হলো।
কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, কোনো বাক্য নেই, কেবল দৃষ্টির মিলনে আদান-প্রদান হয়েছিল এক পৃথিবী সমান অঙ্গীকার। ঈশানীকে যখন শপথ পড়ানো হলো, তখন তার দু’চোখে ছিল প্রাপ্তির ঢেউ। অধরা এক মরিচীকার উপস্থিতিও যে মনের আঙিনায় আলোকরশ্মির প্রস্ফুটন ঘটায় তা বোধ হয় আজকের আগে জানা ছিলনা রমণীর। চারিদিকে সুখ সুখ হাওয়া বয়। বুকের ভেতর টিপটিপ করে ঝড়ে পড়ে অনুভূতির বৃষ্টি। মন গহীনের এহেন অযাচিত উচ্ছ্বাস দেখে, ঈশানীর প্রেয়সী মনটা হুট করেই আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। হৃদয়ের সমগ্র সংশয় ভুলে সে স্বগোতক্তি করে আওড়ায়,

— কে বলেছে তুমি মরিচীকা? তুমি তো অধরা নও। তুমি বাস্তবে রয়েছো। এই যে আমার সর্বাঙ্গে কলঙ্ক হয়ে মিশে গেছো। আমার উদরে জন্ম নেওয়া ওই ছোট্ট প্রাণের মাঝে অস্তিত্ব হয়ে তাকিয়ে আছো। রীশ, তুমি আমার জীবনের সেই অমোচনীয় কলঙ্ক, যা আমি নিজ ইচ্ছেতে গায়ে মেখেছি। এর বিনিময়ে যদি তোমাকে পাওয়া যায়, তবে তাই হোক। একটুআধটু কলঙ্ক তো চাঁদের ও থাকে বলো? সেখানে আমি তো এক তুচ্ছ রমণী। সংসার হোক কিংবা না হোক, তুমি সর্বদাই আমার নাজুক হৃদয়ের প্রেম প্রেম বিষন্নতা। আর আমি তোমার আঁধার জীবনের একমাত্র পরিণিতা।

এরকম হাজারো না-বলা প্রতিশ্রুতি আর জলে ভেজা চোখ নিয়ে, ঈশানী নিজেও গ্রহন করলো তার স্বামীকে। অতঃপর নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে মাইক্রোফোন হাতে তুলে নিলেন ডক্টর মাতভেই। ব্রাইড এবং গ্রুমকে ইশারা করে বললেন,
—- এবার আংটি বদলের পালা। আপনারা নিজেদের সঙ্গিকে আংটি পড়িয়ে নতুন জীবনে আমন্ত্রণ করুন।
প্রিয়েস্ট এর অনুমতি সাপেক্ষে এরীশ হাত বাড়িয়ে ঈশানীর শীর্ণ হাতটাকে মুঠোয়পুরে নিলো। তারপর মখমলে মোড়ানো আকর্ষনীয় বক্সটা খুলে সাবধানে আংটি পড়ালো তার অনামিকায় । সেই আংটি, যেটা বছর খানিক আগে ব্ল্যাকহোলের একটা জীর্ণ কফি টেবিলে রেখে এসেছিল ঈশানী। এরীশের দেওয়া সবচেয়ে দামি উপহার “ব্লাড ডায়মন্ড”। রক্তিম এই হীরের দ্যুতি চোখে এসে লাগা মাত্রই ধড়ফড়িয়ে উঠলো ঈশানী। র’,ক্তশূণ্য মুখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিপাত করলো এরীশের পানে। অস্থির হয়ে বললো,

— এটাতো ব্লাড ডায়মন্ড এরীশ! এটা ভীষণ অদ্ভুত, আমার ভয় করে।
— ঠিকই ধরেছো এটা অদ্ভুত। আর অদ্ভুত বলেই তা শুধু তোমার জন্য। মাফিয়া বস রীসক্সার ওয়াইফ, কুইন অব পাইথন প্যারাডাইস হাতে একটা ব্লাড ডায়মন্ড নিয়ে ঘুরবে না তা কি করে হয়?
— কিন্তু এটা অনেক রিস্কি এরীশ। আমি পারবোনা এটা সামলাতে।
ঈশানীর বাক্য শেষ হতেই ধ্বনিত হলো মাফিয়া বসের গমগমে আওয়াজ,
— আমি আরও বেশি রিস্কি, আমাকে যেহেতু সামলাতে পারো এটাকেও পারবে।
কথায় না পেরে তপ্তশ্বাস ছাড়লো ঈশানী। সেটুকুও বৃথা যেতে দিলোনা হিংসুটে মাফিয়া বস। আংটি পড়ানো হতে না হতেই তার খরখরে রুক্ষ ঠোঁটজোড়া এসে অকস্মাৎ নোঙর ফেললো রমণীর ভেজা নরম তুলতুলে ঠোঁটের ভাঁজে। ঠোঁট গলিয়ে নিসৃত হওয়া তপ্তশ্বাস টুকু গিলে নিতেই প্রগাঢ় হলো স্পর্শ। এরীশের বন্য দংশনে দিশেহারা রমণী, সেই সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে আছে পুরো ওয়েডিং ভেন্যু।
সবার গোল গোল চাহনি দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো ঈশানী । সহসা এরীশের শক্ত কব্জার মধ্যে থেকেই বিব্রত অথচ অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলো,

— রীশ, পাগল হয়ে গেলে? দেখছে সবাই!
— হু কেয়ার’স?
ঠোঁটের প্রগাঢ়তায় লাগাম টেনে সংক্ষিপ্ত বাক্যে জবাবটা দিলো এরীশ। তারপর আবারও সেই বন্য উন্মাদনা । ঈশানী অসহায় বোধ করলো। অনুনয়ের কণ্ঠে বললো,
— এরীশ প্লিইইজ!
— তুমি বলেছিলে নেশা বাদ দিতে, আমি বাদ দিয়েছি। এখন কেন না করছো?
— তাই বলে এভাবে? প্রিয়েস্ট এখনো কিস করার অনুমতি দেয়নিতো।
এরীশ যেন বেপরোয়া উন্মাদ। ফলস্বরূপ লাগামহীন উন্মত্ত স্বরেই প্রত্যুত্তর করলো সে,
—- তুমি আমার। পুরোটাই আমার।
বিব্রতকর ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য দ্রুত হাততালি দিলো মাতভেই। সঙ্গে সঙ্গে অজস্র করতালির সয়লাব ভেসে এলো ওপাশের অতিথি ভেন্যু থেকে। এরপর তুষার কে ইশারা করে তিনি বললেন,
— ইউ্য মে নাও কিস ইউওর ব্রাইড।

তুষার তখনো ফ্লোরাকেই দেখছিল। এই মূহুর্তে তার দু’চোখে ঝাপসা হয়ে আছে দুনিয়ার সমগ্র অনিশ্চয়তা। কেবল এই মুখটা ছাড়া সবকিছুই যেন অর্থহীন, অপ্রোয়জনীয়। মাতভেই এর প্রত্যক্ষ আদেশটুকু কর্ণগোচর হতেই একটু নড়চড়ে উঠলো ফ্লোরা। চোখ নামিয়ে দৃষ্টি রাখলো পায়ের পাতায়। তবে বেশিক্ষণ এই লজ্জামিশ্রিত মুখটাকে লুকিয়ে রাখার সুযোগ পেলোনা রমণী। তার আগেই চমকপ্রদ পন্থায় কাজটা করে বসলো তুষার। নাহ, ঠোঁটে নয়। ফ্লোরার কোমল হাতদুটো মুঠোয় পুরে ধীরে ধীরে ঠোঁট নামালো তুষার। তারপর অতি সংবেদনশীল ভাবে পরপর দু’টো চুমু খেলো রুশ রমণীর শীর্ণ হাতের পৃষ্ঠে।
স্বামীর প্রথম স্পর্শে থরথর করে কেঁপে উঠল ফ্লোরা। প্রবল আড়ষ্টতায় জমে গেলো তার অন্তর। ফ্লোরার শরীরের সেই মৃদু কম্পন দৃষ্টি এড়ায়নি তুষারের, সহসা খানিকটা দূরত্ব বাড়ালো সে। রমণীর পানে পূর্ণ দৃষ্টিপাত করে পুরো দ্বীপকে সাক্ষী রেখে গভীর স্বরে ডাকলো,

— হেই ওয়াইফি!
স্বামীর এই আহ্লাদী সম্মোধনে অকস্মাৎ থমকে গেলো ফ্লোরা। তার দিশেহারা অস্থির দৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে রইলো যন্ত্রমানবের নির্লিপ্ত চোখের পাতায়। মেয়েটা দম ফেলতে ভুলে গিয়েছে যেন , কেবল আকুল নয়নে দেখছে সেই মানুষটাকে, যে ওকে কড়া কণ্ঠে শাসিয়ে বলেছিল,

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৬০

—- বিয়ে, সংসার, স্বাভাবিক জীবন, এসব মাফিয়াদের জন্য নয়। আমিও কখনো বিয়ে করবো না ফ্লোরা ।
তবে কেন করলো এ বিয়ে? কেনইবা এতোটা ব্যকুলতা নিয়ে ডাকলো ফ্লোরাকে? হৃদয়টা দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, এবার তাহলে কিই হবে! শপথ বাক্যে “ভালোবাসি” শব্দটা ছিল। তুষারের মুখে ওই শব্দটা শোনার পরেও কেন যেন কিছুই অনুভব হয়নি ফ্লোরার। দমকা হওয়ায় দুলে ওঠেনি অন্তর। কিন্তু মাত্রই যেন অনুভূতির জোয়ারে ভেসে গেলো সব। হৃদয় জুড়ে অনুভূতির ঢেউ। একের পর এক পর্যুদস্ত হয়ে ধসে পড়েছে অভিমানের দেওয়াল। তুষারের মুখের সামান্য এই সম্মোধনে, পাহাড় সমান কষ্ট নিয়েও, সে রাতে অনুভূতির সাম্পান খেয়ায় দুলতে দুলতে ফ্লোরা স্বাদ পেয়েছিল পূর্ণতার।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৬২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here