আযদাহা পর্ব ২৭
সাবিলা সাবি
জ্যাসপার নিজের অবস্থার উপলব্ধি হতেই সে দ্রুত ফিওনার ওপর থেকে সরে যায়। ফিওনা বিছানা থেকে নেমে একপাশে সরে দাঁড়ায়।
জ্যাসপার তাড়াহুড়ো করে নিজের শার্টটা গায়ে জড়ায়।তার মনের ভেতর এক অস্বস্তির ঢেউ উঠতে থাকে। এক মুহূর্ত আগে সে কী করতে যাচ্ছিল,সেটা মনে করেই তার চোখে অপরাধবোধের ছাপ ফুটে ওঠে।
ফিওনা নিজের এলোমেলো চুল ঠিক করতে করতে জামার ভাঁজগুলো টেনে সোজা করে। তার হৃদপিণ্ড দ্রুত বেজে চলেছে সে বুঝতে পারছে, এই মুহূর্তটা কতটা অস্বাভাবিক আর বিপজ্জনক ছিল।
জ্যাসপার এক কোনে দাঁড়িয়ে ফিওনার দিকে তাকাল।তার ভেতরে তীব্র অপরাধবোধ মিশে গেল সেই আগ্রাসী কামনার স্মৃতির সঙ্গে।
“আম সরি,” সে নিচু গলায় ফিসফিস করল। তার কণ্ঠে লজ্জা আর নিজের প্রতি রাগের মিশ্রণ ছিল।
ফিওনা কিছু না বলে নিজের জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে রইল। দুজনের মধ্যকার নীরবতা গ্লাস হাউজের নিস্তব্ধতাকে আরও ভারী করে তুলল।
অ্যকুয়ারার কথায় থারিনিয়াস, আলবিরা আর এথিরিয়ন লিভিং রুমে চলে গিয়েছিল।সব কিছু স্তব্ধ হয়ে গেছে।ফিওনা বুঝতে পারল, সবাই চলে গেছে। দ্রুত পা বাড়িয়ে সে জ্যাসপারের কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। করিডোরে প্রবেশ করার সময়, চোখে পড়লো অ্যকুয়ারা। তাদের এক মুহূর্তের চুপচাপ সাক্ষাৎ।
অ্যকুয়ারার দৃষ্টি ফিওনার শরীরের ক্ষতগুলোতে আটকে গেল— ঠোঁট, গলা, বুকে ক্ষতচিহ্নের গভীরতা স্পষ্ট হয়ে উঠল। তার মনে এক অদ্ভুত চিন্তা চলে এলো, “এটা যদি কেউ দেখে ফেলে?” সে মুহূর্তে কিছু বললো না,শুধুই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফিওনা নিঃশব্দে নিজের কক্ষের দিকে চলে গেল,মনে হলো কিছুই ঘটেনি। তার মুখের উপর, একটি নিরব আত্মবিশ্বাস,কিন্তু গভীর ভিতরে তার মনে এক অস্বস্তি ছিল।
অন্যদিকে,জ্যাসপার বিছানায় বসে ছিল। তার মাথা নিচু,চোখে অস্থিরতার ছাপ। অদ্ভুত এক ধ্বংসাত্মক চিন্তা তার মনকে গ্রাস করছিল—ফিওনার দিকে তাকিয়ে, সে জানতো,তার ভিতরে যে ভালোবাসা উথলে উঠছে, তা একদম অপরিচিত, অজানা। কিন্তু একইসাথে,সে জানতো, ফিওনা জানে না তার এই অনুভূতির কথা। আরো ভয়াবহ ছিল,সে বুঝতেও পারছিল না, ফিওনা তাকে ভালোবাসে কি না।
তার মধ্যে এক প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেল। কি করা উচিত ছিল? ফিওনার সঙ্গে যা করলো, সেটা কি ফিওনা আদো মানতে পারবে? তার মনের গভীরে, এক গভীর দ্বিধা তাকে তাড়া করছিল, যা জ্যাসপারকে শঙ্কিত করে তুলেছিল। তার মনে গুঞ্জন হচ্ছিল।
“আমি ফিওনাকে যে ভালোবাসি, এটা তো আর ফিওনা জানেনা?সে কি আমাকে ভুল বুঝবে?”
জ্যাসপারের চোখে এক ধরনের অক্ষমতা ফুটে উঠেছিল—এমন এক অন্ধকার যেখান থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
ফিওনাকে ভালোবাসার কথা জানানোর আগেই, এক বিপথগামী মুহূর্তে, তার মধ্যে উথলে ওঠা এক অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষা জ্যাসপারকে এমন একটি পথ বেছে নিতে বাধ্য করেছিল, যেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন ছিল। ফিওনার সঙ্গে যা ঘটেছে, তা ছিল স্রেফ এক স্বপ্নের মতো—অবচেতনে এক অবর্ণনীয় অনুভূতির তাড়নায়,যা তার মাথাকে বেধে ফেলেছিল। কিন্তু যখন সেসব মুহূর্তের স্মৃতি একে একে তার মননে ভেসে উঠল, তার হৃদয়ে একটি অসহ্য ভার অনুভূত হলো।
“কী করেছি আমি?”—মাথায় এই প্রশ্নটাই শুধু ঘুরছিল।
জ্যাসপার জানতো, সে ফিওনাকে খুব ভালোবাসে—অথচ, তা জানাতে আগে এতটা এগিয়ে যাওয়ার কোনো মানে ছিল না।এখন, যখন সে নিজেই নিজের সাথে লড়াই করছে, এক অদ্ভুত অনুতাপ অনুভব করছে তার মনে হচ্ছে সে ফিওনাকে এক অজানা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে।
“আমি কি তাকে ক্ষতিগ্র*স্ত করেছি?”—এই চিন্তা তার মনকে ভেঙে ফেলছিল। ফিওনার প্রতি তার অনুভূতি সঠিক সময়ে প্রকাশ না করতে পারার দুর্বিষহ বোধ, তাকে ঘিরে ধরে ছিল।
ফিওনার সাথে এক মুহূর্তের তীব্র রোমান্স তার জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল—তখনও সে জানতো না,ফিওনা কি তার অনুভূতি বুঝতে পেরেছে, বা কখনও তাকে অনুভব করতে পারবে।
মুহুর্তেই জ্যাসপার তার চিন্তাগুলি একপাশে ঠেলে দিয়ে, একদিকে মাথা ঝাঁকিয়ে দ্রুত ল্যাবের দিকে এগিয়ে যায়। ড্রাকোনিসের সাথে তার আলোচনার জন্য মনস্থির করেছিল। বুকে অদ্ভুত চাপ অনুভব করলেও,তার কাজে মনোযোগ দিতে হবে।
ল্যাবের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে,সে স্ক্রিনে ড্রাকোনিসের চেহারা দেখতে পায়।ড্রাকোনিসের চোখের মধ্যে এক ধরণের গর্বের ঝিলিক ছিল—অথচ,জ্যাসপার জানতো,তার জন্য এখনও অনেক কিছু প্রমাণ করা বাকি।কিন্তু এখন,সেই অল্প সময়ের জন্য,তাকে অনুমতি দেওয়া হলো প্রশংসা শোনার।
“অভিনন্দন, মাই সান!”— ড্রাকোনিসের গম্ভীর,কিন্তু মধুর কণ্ঠস্বর স্ক্রিনে প্রতিধ্বনিত হলো।ৎ”তুমি তোমার প্রথম মিশন সাকসেস করেছো।আমার যে কী আনন্দ হয়েছে! আমার এথিরিয়ন ফিরে এসেছে, ওকে দেখে আমার শান্তি হচ্ছে।আর তুমি ওকে নিজের শক্তি দিয়ে বাঁচিয়েছো। এটাতে আমি তোমার প্রতি গর্বিত।
কিয়ৎক্ষন বাদেই ড্রাকোনিসের চোখে গভীর চিন্তা ঝলকাচ্ছিল, তার কণ্ঠে সেই অভিজ্ঞতা আর দায়িত্বের গাম্ভীর্য। “জ্যাসপার, এখন কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় মিশনে নামতে হবে। আর যদি তুমি সেই মিশন সফল না করতে পারো তাহলে আমাদের পুরো ভেনাস হুমকির মুখে পড়বে।”
জ্যাসপার কিছু না বলে শুধু মাথা নীচু করে শুনে গেল।সে জানতো, তার সামনে এখন খুবই কঠিন সময়।তবে ড্রাকোনিসের প্রতি তার অনুগততা আর বিশ্বাস তাকে দৃঢ় রাখছিল।
“ড্রাকোনিস আমাদের ভেনাসের পরিস্থিতি সমন্ধে জানান, ওখানের এখন কি অবস্থা?”—জ্যাসপারের প্রশ্ন ছিল একান্ত ব্যক্তিগত, তবে গভীরভাবে ভাবনার দিকে ঝুঁকেছিল।
“এখানের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে,”—ড্রাকোনিস তার কণ্ঠে হতাশা লুকিয়ে রেখে বলল। “আমি শুধু এতদিন এথিরিয়নের মুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম।এখন তুমি তোমার দ্বিতীয় মিশন শুরু করো।”
জ্যাসপার কিছু সময় চুপ করে থেকে তার আকাশচুম্বী শ্বাস ফেলল,তারপর তার কণ্ঠে আরও গভীরতা নিয়ে বলল, “জি ড্রাকোনিস।”
“তবে মাথায় রেখো,”—ড্রাকোনিস জ্যাসপারকে সতর্ক করে বলল, “এই মিশনের জন্য তোমার পৃথিবীর একজন সায়েন্টিস্ট লাগবে। তুমি যে অবস্থায় আছো, সেখানে তাকে ছাড়া আমাদের কাজ কঠিন হয়ে যাবে।”
ল্যাবের আলাপচারিতা শেষ করে,জ্যাসপার ল্যাব থেকে দ্রুত বেরিয়ে গ্লাস হাউজে ফিরে আসে। লিভিং রুমে প্রবেশ করতেই দেখলো থারিনিয়াস,আলবিরা,আর এথিরিয়ন সবাই সেখানে অপেক্ষা করছিল।আলোচনার প্রয়োজনীয়তা আর দৃশ্যমান সংকটের কারণে,সবাই বুঝতে পারছিল যে সময় খুব কম।
“থারিনিয়াস,”—জ্যাসপার গভীর কণ্ঠে শুরু করল,”আমাদের দ্বিতীয় মিশন শুরু করার সময় এসে গেছে।ভেনাসের জলবায়ু আর প্রকৃতি এখন হুমকির মুখে,আর এসব কিছু আমাদের পৃথিবী থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে হবে।”
থারিনিয়াস ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দিলো,”এটা তো সহজ কাজ, প্রিন্স।”
“না,থারিনিয়াস।” জ্যাসপার তীব্র গম্ভীরতায় তার চোখে এক আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি ফুটিয়ে তুলল। “এটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ।আমাদের সামনে যে বিপদগুলো আসবে,সেগুলো আমাদের চিন্তার বাইরে। আমরা তো জানি না কোন কোন বিপদ লুকিয়ে রয়েছে,আর সেগুলোকে কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে।”
এথিরিয়ন মাথা নিচু করে কিছুটা ভাবল,তারপর একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলল,”তাহলে,জ্যাসু ভাইয়া,আমরা এখন কীভাবে কী করব?”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ থেকে এক মুহূর্তে সোজা হয়ে বসে বলল,”আমাদের মিশনের জন্য,পৃথিবীর একজন সায়েন্টিস্ট লাগবে।তাকে ছাড়া আমরা আমাদের মিশন সফল করতে পারব না।”
আলবিরা মাথা নেড়ে বলল,”তাহলে প্রিন্স,ডঃ আর্থারকে কাজে লাগালে কেমন হয়।”
জ্যাসপার তার চোখ বন্ধ করে কিছুটা চিন্তা করল,তারপর এক মুহূর্তে মাথা তুলল। “হ্যাঁ,কাল ওনার সাথে কথা বলবো।”
তারপর সে থারিনিয়াস আর এথিরিয়নের দিকে তাকিয়ে বলল,”আমাদের অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে।পৃথিবীর সবচেয়ে বিশিষ্ট সায়েন্টিস্টের সাহায্য ছাড়া আমরা এই মিশন সফল করতে পারব না।”
আলবিরা কিছুটা নীরব থেকে বলল, “ডঃ আর্থার কী আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন,প্রিন্স? তাঁর সহায়তা কীভাবে নিশ্চিত করব?”
জ্যাসপার এক শ্বাসে উত্তর দিল,”ভুলে গেলে? সে আমার হিপনোটাইজের স্বীকার, ভেনাসকে রক্ষা করতে আমি সবকিছু করতে প্রস্তুত।”
তারা সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়,আর জ্যাসপার আবার একবার জানিয়ে দেয়,”কাল থেকেই আমাদের দ্বিতীয় মিলনের পরিকল্পনা শুরু করতে হবে।”
লিভিং রুমের মিটিং শেষ হওয়ার পর সবাই যার যার কক্ষে চলে গেল।
অ্যকুয়ারা এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে রাতে ফিওনার কক্ষে হাজির হলো। ফিওনা তখন বই পড়ছিল।অ্যকুয়ারা কিছুক্ষণ আলাপ করল হালকা স্বরে। তারপর একটা ওষুধের টিউব বিশেষ ধরনের মলম,ফিওনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।কাল সকালে দেখবে দাগগুলো পুরোপুরি চলে যাবে।”
ফিওনা অবাক হয়ে অ্যকুয়ারার দিকে তাকাল।কিন্তু অ্যকুয়ারা আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল।
ফিওনা মলমটা হাতে নিয়ে বসে রইল,কপালে ভাঁজ পড়ল তার। “কোথায় লাগাবো এটা? আর কেনই বা অ্যকুয়ারা আমাকে এই মলম দিয়ে গেলো?”
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ফিওনা মলমটা বেডসাইড টেবিলে রেখে দিল। কিছুক্ষণ ভাবল, কিন্তু ক্লান্তি তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল। মলমটা অব্যবহৃত রেখে সে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল।
মধ্যরাতের নিস্তব্ধতায় ফিওনার কক্ষের স্লাইডিং দরজাটি ধীরে ধীরে খুলে গেল।বাইরের প্রাকৃতিক আলো কাঁচের দেয়ালের মধ্য দিয়ে ঘরের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছিল। চাঁদের রূপালি আভা আর তারার মৃদু ঝিকিমিকি আলোক ছটায় ঘরজুড়ে এক স্বপ্নময় পরিবেশ তৈরি করেছিল।
ঘরের এই স্নিগ্ধ নীরবতা ভেঙে প্রবেশ করল একটি ছায়ামূর্তি—নিঃশব্দে হাওয়ার সাথেই মিলেমিশে।জ্যাসপার। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কক্ষের মাঝখানে শুয়ে থাকা ফিওনার দিকে নিবদ্ধ ছিল। ফিওনা গভীর ঘুমে মগ্ন,তার শ্বাস-প্রশ্বাসের মৃদু ওঠানামা ঘরের শান্ত পরিবেশকে আরও মোহনীয় করে তুলেছিল।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল। কাঁচের দেয়ালের বাইরে থেকে আসা আলো ফিওনার মুখে পড়ে তার কোমল সৌন্দর্যকে আরও মায়াময় করে তুলেছিল। তার এলোমেলো চুলগুলো বালিশের চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল,কোনো শিল্পীর হাতে আঁকা নিখুঁত এক চিত্র।
জ্যাসপার বিছানায় ফিওনার সামনে বসে,নিচু হয়ে ফিওনার দিকে ঝুঁকল।তার চোখে এক গভীর দৃষ্টি। এই এক মুহূর্তেই সে পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছে। ফিসফিস করে সে বলল,শব্দগুলো তার নিজের কাছেই উদ্দেশ্যহীনৎ“হামিংবার্ড!তুমি…এতটা কোমল…এতটা নাজুক।মনে হয় এই বিশ্বের সৃষ্টির বাইরের কিছু।অথচ তুমি এখন আমার কাছে,আমার পাশে।”
তার কথাগুলো মৃদু বাতাসের মতো ফিওনার মুখে এসে পড়ছিল। ঘরের কাচের দেয়ালের বাইরে রাতের আলোকচ্ছটা ফিওনার ঘুমন্ত মুখে এক অপার্থিব আভা তৈরি করছিল।
জ্যাসপারের হৃদয়ের গভীরে এক অজানা টানাপোড়েন শুরু হলো।সে জানে,তার উপস্থিতি ফিওনার জন্য এক শীতল, অচেনা অন্ধকার।কিন্তু তার আকর্ষণ এতটাই প্রবল ছিল যে সে নিজেকে থামাতে পারছিল না।তার দীর্ঘ আঙুলগুলো বিছানার কিনারায় গুটিয়ে ছিল।
জ্যাসপারের চোখ হঠাৎ পড়লো বেডসাইড টেবিলের উপর রাখা মলমটায়।কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকার পর সে মলমটা হাতে তুলে নিলো।পাশের ল্যাম্পসিডের আলো জ্বালিয়ে ঘরের আবছা অন্ধকার দূর করলো।আলো ছড়িয়ে পড়তেই ঘরটা হালকা উজ্জ্বল হয়ে উঠল,আর সেই আলোয় ফিওনার মুখটা আরও কোমল আর সুন্দর লাগছিল।
জ্যাসপার গভীরভাবে ফিওনার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ফিওনা তখন গভীর ঘুমে ডুবে ছিল,এমন ঘুম,যেখানে দুনিয়ার কোনো শব্দই তাকে ছুঁতে পারে না।ল্যাম্পসিডের আলোয় জ্যাসপার এবার তার চোখ সরালো ফিওনার শরীরের দিকে। তার চোখ গিয়ে আটকালো সেই চিহ্নগুলোতে—ফিওনার ঠোঁট,গলা,বুকের ওপর আর কাঁধজুড়ে স্পষ্ট দাগ।
জ্যাসপারের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল।তার হাতের মলমটা হালকা কাঁপছিল।প্রতিটি ক্ষত তাকে তার ভুলের দিকে নির্দেশ করছিল,প্রতিটি দাগ তার অপরাধবোধকে আরও তীক্ষ্ণ করছিল। সে বোঝে,এই ক্ষতগুলো শুধু ফিওনার শরীর নয়,তার নিজের অন্তরেও গভীর চিহ্ন রেখে গেছে।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার দিকে ঝুঁকল।তার আঙুল মলমের ঢাকনায় স্পর্শ করলো,কিন্তু সে থেমে গেল।তার ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা ফুটে উঠল। “তোমার প্রতি আমার এতো অধিকার আছে?” ফিসফিস করে নিজেকেই প্রশ্ন করলো সে।
জ্যাসপার বাঁকা হাসি হাসলো,তার চোখে এক রহস্যময় আলো।ল্যাম্পসিডের সোনালী আলো তার মুখের দিক থেকে এক অদ্ভুত আবেশ ছড়াচ্ছিল, ফিওনা গভীর ঘুমে ডুবে থাকলেও,জ্যাসপার তার প্রতি এক অদম্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতেই বদ্ধপরিকর ছিল।
সে ধীরে ধীরে ফিওনার কাছে চলে আসলো।তার শ্বাসের গরম বাতাস ফিওনার কপালে হালকা অনুভূতি সৃষ্টির মতো।চোখের কোণে সেই বাঁকা হাসি ছিল,তবে তার মুখে কোনো দয়া বা কোমলতা ছিল না।সে ফিসফিস করে বললো, “হামিং বার্ড!তোমার প্রতি আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।”এই কথাটা প্রাচীরের মতো ভাঙা,কোনো ভয় বা দ্বিধা ছাড়াই সে তার দাবি জানিয়ে গেল।
তার হাত ফিওনার কপালের কাছে চলে গেল,কপালে পড়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে দিলো। ফিওনার মুখের নিরবতা তখনও সেই শান্তির সাথে মিশে ছিল,কিন্তু তার চোখের নিঃশ্বাসে একটা গোপন বার্তা ছিল—অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।সে আবার ফিসফিস করলো, “এবার থেকে প্রস্তুতি নিতে শুরু করো,হামিংবার্ড।” তার কণ্ঠে একটি অদ্ভুত শক্তি ছিল,আগামীতে কিছু অনেক কঠিন অপেক্ষা করছে ফিওনার জন্য।
জ্যাসপার তার নরম ঠোঁটে এক প্রশান্তি রেখে বললো, “সামনে আরও বেশি ক্ষত তোমার সহ্য করতে হবে।তোমার সারা দেহে থাকবে আমার ভালোবাসা আর আদরের চিহ্ন।”
জ্যাসপার ফিওনার গভীর ঘুমের দিকে এক মুহূর্ত চেয়ে রইলো।তার ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি নিজের ভেতরের এক কঠিন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। তার লম্বা আঙুলের স্পর্শে মলমের কৌটাটা খুলে গেলো।মলমটা হাতে নিয়ে সে ধীরে ধীরে ফিওনার মুখের কাছে এগিয়ে গেল, প্রতিটি মুহূর্তে তার স্পর্শে মিশে আছে এক গভীর অধিকার।
প্রথমে সে আলতো করে মলমটা ফিওনার ঠোঁটে লাগাতে শুরু করলো।তার আঙুলের উষ্ণতায় ফিওনার ঠোঁট আরও কোমল হয়ে উঠলো।চাঁদের আলোতে ঠোঁটের সেই ক্ষতগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল,আর জ্যাসপার যত্নের সাথে প্রতিটা জায়গায় মলম মাখাতে লাগলো, সে নিজের হাতে সেই যন্ত্রণা মুছে দিচ্ছে।
এরপর তার হাত ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো। ফিওনার গলার দাগগুলোতে আলতো করে মলম লাগালো, আঙুলের প্রতিটি ছোঁয়ায় এক নিঃশব্দ ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি।গলার হালকা শিরশিরে অনুভূতি ফিওনার নিঃশ্বাসে এক অদ্ভুত স্পন্দন সৃষ্টি করছিল,যদিও সে তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
জ্যাসপার থামেনি।সে ধীরে ধীরে ফিওনার কাঁধের কাছে এগিয়ে এলো।সাদা সিল্কের নাইট ড্রেসের স্ট্র্যাপ তার আঙুলের সামান্য ধাক্কায় একপাশে সরে গেলো,আর কাঁধের ওপরে আঁচড়ের দাগগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো।সে গভীর মনোযোগ দিয়ে সেখানে মলম লাগাতে শুরু করলো,তার প্রতিটি স্পর্শেই দাগগুলো মিলিয়ে যেতে বাধ্য।
এরপর,তার দৃষ্টি সরে গেলো ফিওনার বুকের ওপরের দিকে। মলমের নরম পরশ তার আঙুলের ছোঁয়ায় বুকে ছড়িয়ে পড়ছিল।প্রতিটি জায়গায় মলম লাগানোর সময় তার চোখে ছিল একাধারে গভীর যত্ন আর এক ধরনের কঠিন দাবি।
সবশেষে,জ্যাসপার ফিওনার সাদা সিল্কের নাইট ড্রেসের নিচে নেমে থাকা ক্ষতগুলো লক্ষ্য করলো।সে ধীরে ধীরে ড্রেসটা হাঁটুর ওপর পর্যন্ত তুলে আনলো।চাঁদের আলো ফিওনার মসৃণ ত্বকের ওপরে রূপোলি আভা ছড়াচ্ছিল।জ্যাসপার থাইয়ের আঁচড়ের দাগগুলোতে মলম লাগাতে শুরু করলো,তার আঙুল প্রতিটি ক্ষত স্পর্শ করে যত্নের সাথে এগিয়ে যাচ্ছিল।তার প্রতিটি ছোঁয়ায় এক অনির্বচনীয় কোমলতা আর অধিকার মিশে ছিল।
মলম লাগানো শেষ হলে,জ্যাসপার একটু দূরে সরে বসলো। তার চোখে ছিল গভীর তৃপ্তি,আর ঠোঁটে সেই রহস্যময় বাঁকা হাসি।সে একবার ফিওনার মুখের দিকে তাকালো, নিশ্চিত করতে চাইলো যে তার প্রেয়সীর আর কোনো যন্ত্রণা অনুভব করছে না।
জ্যাসপার মলমটার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো।মলমটাকে হাতে তুলে নিয়ে একবার চাঁদের আলোয় ধরে দেখলো,সেই ছোট্ট জিনিসটাকেও নিজের ক্ষমতার কাছে নত হতে বাধ্য করেছে।
তারপর এক ধীর,গম্ভীর স্বরে ফিসফিস করে বললো,”তুই জানিস তোর কপাল কত ভালো?জ্যাসপার অরিজিনের দেয়া ভালোবাসার ওপর তুই প্রলেপ বসানোর সুযোগ পেয়েছিস। এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে?”
জ্যাসপার মলমটা ধীরে ধীরে পাশে রেখে দিলো।তার হাত এক মুহূর্ত থেমে রইলো, কিছু একটা অনুভব করছে। তারপর সে আবার ফিওনার দিকে ঝুঁকে পড়লো।
ফিওনার ঘুমন্ত মুখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে তার ঠোঁটের কোণে এক গভীর মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।চাঁদের আলোতে ফিওনার মুখটা সাদা সিল্কের মতো উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল, আর তার বাদামী চুলগুলো বালিশে ছড়িয়ে পড়ে সাগরের ঢেউয়ের মতো নরম দেখাচ্ছিল।জ্যাসপার তার মুখের এক ইঞ্চি দূরে এসে ফিসফিস করে বলল,
“হামিংবার্ড, তুমি জানো তুমি আমার কী? তুমি আমার সেই অমোঘ ভালোবাসা,যাকে আমি ভেনাসের আকাশ পাড়ি দিয়ে, ৪১ মিলিয়ন কিলোমিটার অতিক্রম করে,এই পৃথিবীর ক্ষুদ্র ভুখন্ডে এসে খুঁজে পেয়েছি।”
“তুমি আমার সবকিছু,আর আমি তোমার থেকে কিছুতেই দূরে থাকতে পারব না।”
তার কণ্ঠস্বর গভীর ছিল,কিন্তু তাতে একধরনের কোমলতা আর অধিকার মিশে ছিল।তার চোখে ভেসে উঠছিল এক প্রবল ভালোবাসা,যা সে প্রকাশ করতে ভয় পায়,কিন্তু আড়ালও করতে পারে না।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে আরও নিচু হয়ে ফিওনার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “আর তোমাকেও আমায় ভালোবাসতে হবে,হামিংবার্ড।তোমার সমস্ত পৃথিবী হতে হবে জ্যাসপার অরিজিন।”
তার কণ্ঠস্বর গভীর,ভারী আর দৃঢ় ছিল,মনে হলো এই কথাগুলো কোনো আদেশ, কোনো শর্ত নয়,বরং তার আত্মার গভীর থেকে উঠে আসা ঘোষণা।
ফিওনার নিঃশ্বাসের মৃদু ওঠানামা তার ঘুমন্ত অবস্থাকেও একধরনের রহস্যময় আবেশ এনে দিয়েছিল। জ্যাসপার তার দিকে আরও ঝুঁকে পড়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে এক মুহূর্তের জন্য তার মুখের কাছে এসে থামল।
“আর যদি সেটা না হয়…” জ্যাসপারের কণ্ঠস্বর হঠাৎ তীব্র হয়ে উঠল,ভেতরে থাকা এক দানব বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার চোখে রক্তিম আভা ফুটে উঠল।
“তবে এই জ্যাসপার অরিজিন পুরো পৃথিবী ধ্বংস করে দিবে।জ্বালিয়ে দিবে তার অগ্নি দিয়ে।”
তার শব্দগুলো শপথের মতো শোনাচ্ছিল,এক ভয়ঙ্কর শপথ যা পৃথিবীকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে দিতে পারে।
জ্যাসপার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল,ফিওনার মুখের প্রতিটি ভাঁজ গভীরভাবে লক্ষ্য করল।তারপর তার ঠোঁটের কোণে এক বাঁকা হাসি ফুটে উঠল।
“তুমি আমাকেই ভালোবাসবে,হামিংবার্ড। আমার থেকে পালানোর কোনো পথ নেই।”
তারপর সে নিজের ভেতরের আগুনকে শান্ত করে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।কক্ষ থেকে বের হওয়ার আগে সে একবার ফিওনার দিকে ফিরে তাকাল।।
জ্যাসপার মৃদু হেসে ফিসফিস করে বলল,”ইউ আর মাইন ফরেভার।”
পরের দিন সকালে ফিওনা ধীরে ধীরে ঘুম থেকে জেগে উঠল। কাঁচের দেয়াল ভেদ করে আসা সূর্যের আলো তার চোখে এসে পড়ছিল।একটু ঝিম মেরে বিছানায় বসে থাকল সে,গতকালের ঘটনাগুলো এখনো তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। নিজের চুলগুলো ঝটপট ঠিক করে,একটি হালকা রঙের জিন্সের স্কার্ট আর খয়েরি টপস পড়ে নিচে চলে এলো।
গ্লাস হাউজটা সকালের রোদে ঝলমল করছিল।প্রতিটি কোণ নীরব,শুধু কিচেন থেকে আসা হালকা ধাতব শব্দ আর সুগন্ধে বোঝা যাচ্ছিল কেউ একজন সেখানে ব্যস্ত।
ফিওনা কিচেনে ঢুকতেই দেখল অ্যকুয়ারা ইতিমধ্যে নাস্তার আয়োজন করছে।তার পরনে ছিল হালকা নীল রঙের পোশাক।রান্নার প্রতি তার দক্ষতা দেখে ফিওনার মনে একটু বিস্ময় জাগল।
“সকাল-সকাল আমকে ছাড়াই কাজ শুরু কর দিয়েছো,অ্যকু?” ফিওনা বলল, কিচেনের এক কোণে দাঁড়িয়ে।
অ্যকুয়ারা এক মুহূর্ত থেমে মৃদু হেসে বলল, “হ্যাঁ তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে,ভাবলাম তুমি ক্লান্ত তাই আর ডাকি নি ?”
ফিওনা মাথা নাড়ল “কী করতে হবে বলো।”
অ্যকুয়ারা ফিওনার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলল, “ডিমগুলো ফেটিয়ে দাও।আমি প্যানটা গরম করছি।”
ফিওনা হাতা আর কাঁসা নিয়ে ডিমগুলো দ্রুত ফেটাতে শুরু করল। কিচেনের পরিবেশটা হালকা হয়ে এল।মৃদু কথোপকথনের মাঝে অ্যকুয়ারা মাঝে মাঝে ফিওনার দিকে তাকাচ্ছিল, তার কিছু বলার ছিল,কিন্তু বলছিল না।
ডাইনিং টেবিলটি সাজানো শেষ হয়ে গেল।অ্যকুয়ারা মনোযোগ দিয়ে টেবিলের এক কোণায় থালা আর বাটিগুলো সাজাচ্ছিল,আর ফিওনা কিচেনে ব্যস্ত ছিল খাবারের বাকি কাজ করতে। সুর্যের আলোয় পুরো লিভিং রুমটা ঝলমল করে উঠছিল।ইতিমধ্যে, জ্যাসপার,এথিরিয়ন,আলবিরা আর থারিনিয়াস একে একে ডাইনিং টেবিলে এসে বসেছিল।
এথিরিয়ন, পিপড়ের মতো দ্রুত হাত বাড়িয়ে খাবারের দিকে তাকিয়ে ছিল। খাবারের উপস্থিতি দেখে তার মুখে উল্লাসের হাসি ফুটে উঠল।
“জ্যাসু ভাইয়া, এত সুন্দর সুন্দর খাবার কে তৈরি করেছে? উফ,কতদিন এই ধরনের খাবার খায়নি।সারাদিন ক্যামিকেল দিয়ে রেখেছিলো আমাকে!” – এথিরিয়ন আনন্দের সাথে বলল।
এথিরিয়ন ব্রেডটা তুলে মুখে পুরতে যাবার সময় হঠাৎ চোখে পড়ল।ফিওনা কিচেন থেকে জুসের জগ নিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে আসছে। এক সেকেন্ডের জন্য, এথিরিয়নের চোখ থেমে গেল ফিওনার দিকে।তার হাত থেকে ব্রেড পড়ে গেল,মুখ খুলে গেল অবাক দৃষ্টিতে।
ফিওনার উপস্থিতি এতটা আকর্ষণীয় ছিল যে, এথিরিয়ন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো।সে বুঝতেই পারল না কীভাবে তার চোখের সামনে এমন এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। ফিওনার বাদামী চুল,তার কোমল মুখাবয়ব,তার লাবণ্যময় চোখ—সব কিছু এক অন্য দুনিয়ার সুন্দরী।
এথিরিয়ন অবশেষে নিজেকে সামলাতে পেরে,জিজ্ঞেস করল,”জ্যাসু ভাইয়া,এই মেয়েটা কে?”
ফিওনার দিকে চেয়ে জ্যাসপার কোনো কিছু না বুঝেই বলল, “ওর নাম ফিওনা।গ্লাস হাউজের শেফ।”
এথিরিয়ন আবার তাকাল ফিওনার দিকে।তার মুখে প্রশংসার এক ঝলক ছিল, “এতো সুন্দর দেখতে শেফ কোথায় পেলে?”
অ্যাকুয়ারা,হালকা হাসি দিয়ে বলল,”ও হিউম্যান গার্ল।”
এথিরিয়ন অবাক হয়ে বললো “হিউম্যান তাও আমাদের গ্লাস হাউজে? এই জন্যই তো বলি ভেনাসের কেউ তো এমন দেখতে হয়না, এতোটা কোমলমতি সুন্দর!!
জ্যাসপার একটু রুদ্ধ মনে,একটু বিরক্তি দিয়ে বলল, “খাবারের সময় এতো কথা বলতে নেই,ভুলে গেছিস?”
ডাইনিং টেবিলের চারপাশে সবার মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়েছিল। ফিওনা জুস ঢেলে দিচ্ছিল, একে একে সবাই খাচ্ছিলো।কিন্তু এথিরিয়ন,তার চোখে এখনও ফিওনার প্রতি মুগ্ধতা স্পষ্ট, কিছু একটা বলতে চাইছিল। তবে তার কথায় ছিল এক ধরনের অস্বাভাবিক তীব্রতা।
এথিরিয়ন ফোঁস করে বলল, “হাই,আমার নাম এথিরিয়ন।” তার কথায় একটা উন্মুক্ততা ছিল, সে চায় ফিওনার সাথে বন্ধুত্ব শুরু করতে, কিন্তু সে জানতো না ,ফিওনা কি তার এই আকর্ষণকে গ্রহণ করবে না কি সে কোনো বিশেষ উত্তর দেবেনা।
ফিওনা কিছু বলল না,তবে তার চোখে দৃঢ়ভাবে কিছুটা চিন্তা ফুটে উঠল। সে জানতো,এই এথিরিয়নই সেই ড্রাগন! যাকে তার গ্ৰান্ডপা আটকে রেখেছিলো।আর যার জন্যই জ্যাসপার তাকে কিডন্যাপ করে এই গ্লাস হাউজে নিয়ে এসেছে। সেই মুহূর্তে,ফিওনার হৃদয়ে এক ধরনের টানাপোড়েন চলছিল।তার চোখের আড়ালে ছিল অনেক কষ্ট, অনেক প্রশ্ন, কিন্তু সে চুপ থাকল।
এথিরিয়ন,তার আগের উত্তেজনাকে অব্যাহত রেখে বলে উঠলো, “বাই দা ওয়ে,তোমাকে কষ্ট করে আমাকে এতো বড় নামে ডাকতে হবেনা।তুমি আমায় রিয়ন বলে ডাকবে আর আমি তোমাকে ওনা বলে ডাকবো।”
তখনই, অপ্রত্যাশিতভাবে,জ্যাসপার তীব্র এক রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল।তার চোখে একটা ঝলক ছিল—কিছু একটা ভেঙে যাওয়ার। তারপর,সে নিজের রাগ সামলাতে না পেরে,ফিওনাকে গর্জে উঠলো, “ফিওনা,গেট আউট ফ্রম হেয়ার!” তার গলা ছিল কঠিন,তার প্রত্যেকটি শব্দ খোঁচা দিচ্ছিল ফিওনাকে।
ফিওনার চোখে এক মুহূর্তের জন্য হালকা কম্পন দেখা দিলো।সে কখনোই এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি। বাকিরা অস্বস্তি নিয়ে একে একে চুপ হয়ে গেলো।অ্যকুয়ারা, আলবিরা,থারিনিয়াস—সবাই স্তব্ধ। তাদের মাঝে নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল।
ফিওনার চোখে হালকা পানি জমে উঠেছিল,সে কোনো শব্দ না করে ধীর পায়ে ডাইনিং রুম থেকে বের হয়ে গেল। তার ভেতরে এক ধরনের শূন্যতা ছড়িয়ে পড়েছিল—একটা কষ্ট,যা তাকে ভেতরে ভেতরে গ্রাস করে চলছিল।
অন্যদিকে,এথিরিয়ন হঠাৎ ফিওনার পরিত্রাণের দৃশ্য দেখে মন্তব্য করতে গিয়ে বলল, “উফ,জ্যাসু ভাইয়া,এমন ফুলের মতো সুন্দর কোমল একটা মেয়েকে কেউ এভাবে ধমক দিয়ে কাঁদায়?” তার কথা ছিল মৃদু,কিন্তু তাতেও কিছুটা মিষ্টি রূপের আভাস ছিল,সে সত্যিই ফিওনার প্রতি মুগ্ধ।
কিন্তু তার এই মন্তব্য এক মুহূর্তের জন্যও জ্যাসপারের খেয়াল থেকে পড়ে না গেল। সে এক দৃষ্টিতে এথিরিয়নের দিকে তাকালো—তীব্র এক গর্জন প্রতিটি শব্দে হুঙ্কার ছিল।তার চোখে অগ্নির মতো উত্তেজনা ছিল,প্রতিটি বর্ণ দাগ কেটে যাবে এথিরিয়নের প্রতি।
আযদাহা পর্ব ২৬ (২)
এথিরিয়ন তৎক্ষণাৎ গম্ভীর হয়ে মাথা নিচু করল, সে বুঝতে পেরেছে তার কথায় কোনো ভুল হয়ে গেছে।তার ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে সে আর কিছু বলতে চাচ্ছে না।
টেবিলের চারপাশে অস্বস্তি নেমে এলো।বাকিরা একে একে নিজেদের খাবারে মনোনিবেশ করলো,যেনো কিছুই হয়নি।কেবল তাদের মধ্যে একটা গভীর নীরবতা ভর করেছিল।
জ্যাসপার চুপচাপ বসে ছিল,তার মুখাবয়বে কিছুটা শীতল,কিছুটা কঠোর—ফিওনার এভাবে চলে যাওয়া,জ্যাসপারের ভেতরে অস্থিরতার ছাপ রেখে গেছে।