আযদাহা পর্ব ৩০

আযদাহা পর্ব ৩০
সাবিলা সাবি

জ্যাসপার জীবনে কখনো এমন অনুভূতি পায়নি।এই প্রথমবার,সে এক অজানা আবেগের সম্মুখীন হলো।কাপল ডান্সের ধারণাটাই তার কাছে ছিল অচেনা,আর নাচার কোনো অভিজ্ঞতা তো দূর অস্ত।কিন্তু আজ,ফিওনার কোমরে তার হাত রেখে,মৃদু সুরের তালে তালে তাদের দুলতে দেখে, মনে হচ্ছিল যেন সময় থেমে গেছে।
ফিওনা তার গলা জড়িয়ে রেখেছে,তার উজ্জ্বল চোখ দু’টি সরল মুগ্ধতায় ঝলমল করছে।প্রতিটি মুহূর্ত যেন জাদুর মতো।জ্যাসপার বুঝতে পারল,সে তার জীবনের প্রতিটি নিয়ম,প্রতিটি বাধা,এমনকি নিজের সীমাবদ্ধতাগুলোকে উপেক্ষা করে কিছু একটার দিকে এগিয়ে চলেছে।

প্রথমে তার শরীরের প্রতিটি মুভমেন্ট যেন অদ্ভুত লাগছিল। ফিওনার প্রতিটি স্টেপ সে নিরীক্ষণ করছিল,যেন এই মুহূর্তটা তাকে ধীরে ধীরে কোনো অজানা নাচের ভাষা শিখিয়ে দিচ্ছে।
জ্যাসপার মনে মনে এক গভীর সন্তুষ্টির হাসি ফুটিয়ে তুলল।মনে মনে বলল,”যাক,একদিকে ভালোই হয়েছে।ওই ফুল খাওয়ার পর ফিওনার আবেগগুলো এমন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে,ওকে এতটা কাছে পাওয়া গেলো।নিজে থেকেই সব কিছু বলে দিলো,এমনকি এমন অনুভূতিগুলোও,যা কখনো ভাবিনি ও প্রকাশ করবে।”তার সবুজ চোখ দু’টিতে এক ঝিলিক মায়া খেলে গেল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জ্যাসপারের মন যেন আগুনে ঝলসে উঠল।ফিওনার কোমরে তার শক্ত হাতের গ্রিপ আরও শক্ত হলো,যেন ওকে নিজের থেকে একচুলও দূরে যেতে দেবে না।সে ধীরে ধীরে ফিওনার মুখের দিকে ঝুঁকল।তার আঙুলগুলো ফিওনার নরম থুতনির নিচে এসে আলতোভাবে তাকে উপরে তুলল। ফিওনার চোখ বন্ধ হয়ে গেল,যেন সে এই মুহূর্তে হারিয়ে যেতে চায়।জ্যাসপার আর অপেক্ষা করল না।তার ঠোঁট ধীরে ধীরে ফিওনার ঠোঁটের সাথে মিশে গেল,সেদিনের মতোই জ্যাসপারের ঠোঁটের স্পর্শে যেন এক স্বর্গীয় মিষ্টি স্বাদ ভেসে এলো,ঠিক যেন গ্লুকোজের মতোই নরম,মোলায়েম আর মিষ্টি।এই অনুভূতিটা ছিল এমন যেন সমস্ত ভেনাস আর পৃথিবী মিলে এই এক মুহূর্তে থেমে গেছে।

ফিওনার শ্বাস ভারী হয়ে এলো,তার হাত আপনা থেকেই উঠে গিয়ে জ্যাসপারের ঘাড়ের চারপাশে পেঁচিয়ে গেল।সে প্রথমে অবাক হয়ে গেলেও,কয়েক মুহূর্ত পরে নিজেই তাল মিলিয়ে চুম্বনে সাড়া দিল।
ফিওনা যখন অনুভব করল জ্যাসপার তাখে কোলে তুলে নিচ্ছে,তার শরীর এক ঝাঁক আবেগে কেঁপে উঠল।সে নিজের অজান্তেই তার হাতে জ্যাসপারের কাঁধের কাছে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো।যেন কখনোই তাকে ছেড়ে না দিতে পারে। জ্যাসপারের শরীরের উষ্ণতা ফিওনার ভেতর এক অদ্ভুত আগুন জ্বালিয়ে দিল।
ফিওনাকে কোলে নিয়ে,জ্যাসপার তাকে আরও কাছে টেনে এনে তার ঠোঁটে গভীরভাবে চুমু খেতে শুরু করল।এটা ছিল শুধুই এক ফ্রেন্স কিস,কিন্তু তার মধ্যে ছিল এমন এক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তীব্রতা যা কখনও টেনে নিয়ে আসছিল ফিওনাকে আরও গভীরে।জ্যাসপারের ঠোঁট থেকে গ্লুকোজের মিষ্টি স্বাদ তার জিভে ছড়িয়ে পড়ল,আর ফিওনা যেন সেই স্বাদে পুরোপুরি ডুবে গেল।

জ্যাসপার তার ঠোঁট সরিয়ে নিল,কিন্তু ফিওনার চোখে ছিল শুধু এক ধরনের পাগলামি।সে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারছিল না।চুম্বনের প্রতি তার আকাঙ্ক্ষা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে,সে অবচেতনভাবে জ্যাসপারের ঠোঁটের দিকে আবার এগিয়ে গেল,যেন মধুসুধার মতো সেই স্বাদ একটুও মিস না হয়।
জ্যাসপারের মধ্যে আবেগের বাঁধ যেন ভেঙে গেল।তার সবসময় নিয়ন্ত্রণে থাকা সেই প্রখর ব্যক্তিত্ব এই মুহূর্তে বেপরোয়া হয়ে উঠল।তার চোখে অদ্ভুত মাদকতার ঝলক,যা ভালোবাসা আর আকাঙ্ক্ষার এক গভীর মিশ্রণ।ফিওনাকে তার শক্ত বাহুতে ধরে থাকা অবস্থাতেই,জ্যাসপার তাকে ধীরে ধীরে গ্লাসের দেয়ালের কাছে নিয়ে গেল।
জ্যাসপারের চোখের মাদকতায় ফিওনা যেন পুরোপুরি হারিয়ে গেল।সে বুঝতে পারল না,কীভাবে এই নিষ্ঠুর ড্রাগনের স্পর্শে তার শরীর আর হৃদয় এতটা কাঁপতে শুরু করেছে।
জ্যাসপার ফিওনাকে শক্ত করে নিজের বাহুতে ধরে রইল, যেন কোনো শক্তি তাকে ছিনিয়ে নিতে না পারে।তার হৃদয় তখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে,আবেগের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ফিওনাকে কোলে নিয়েই ধীরে ধীরে গ্লাসের দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল।

গ্লাসের স্বচ্ছ পৃষ্ঠে চাঁদের আলো পড়ে অপূর্ব এক দৃশ্য সৃষ্টি করছিল।জ্যাসপার সেখানে ফিওনার কোমরটা ধরে তার দেহটা দেয়ালের সাথে আলতোভাবে ঠেসে ধরল।তার স্পর্শ ছিল দৃঢ় কিন্তু কোমল।ফিওনার নেশামাখা দৃষ্টি তখন জ্যাসপারের চোখের গভীরে আটকে গেল। হঠাৎ,যেন আপন সত্তার টানে,সে নিজের পা দুটো পেঁচিয়ে ধরল জ্যাসপারের কোমরে।তার স্পর্শে এক অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল জ্যাসপারের শরীরে।
জ্যাসপার নিজের হাত দিয়ে ফিওনার কোমর শক্ত করে ধরে রাখল,যেন সে পৃথিবীর আর কিছু ভুলে শুধু তাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়।গ্লাসের দেয়ালে ভেসে আসা চাঁদের আলো তাদের চারপাশকে মোহময় করে তুললো।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার মুখের কাছ থেকে সরতে শুরু করল,তার দৃষ্টি ফিওনার ঘাড়ের দিকে নিবদ্ধ।তার উষ্ণ নিঃশ্বাস ফিওনার গলায় ত্বকের উপর গিয়ে লাগতেই ফিওনা সাড়া দিয়ে চোখ বন্ধ করল।

জ্যাসপার আলতোভাবে তার ঠোঁট রাখল ফিওনার গলায়। প্রথমে এক বিন্দু স্পর্শ,তারপর গভীর আর মাদকতাময় চুম্বন।তার ঠোঁটের উষ্ণতা ফিওনার ত্বকের প্রতিটি কোষে যেন আগুন ধরিয়ে দিল।
আচমকা পুনরায় জ্যাসপার ফিওনাকে শক্ত হাতে কোলে তুলে নিলো,যেন তাকে কোনোভাবেই নিজের কাছ থেকে হারাতে দেবে না।ফিওনার শরীর তার বুকের সঙ্গে লেগে আছে,আর তার চোখে যেন এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা জ্বলছে। দেয়াল থেকে সরে আসতেই পাশের টেবিলের ল্যাম্পশেড ধাক্কা লেগে পড়ে গেল,মেঝেতে চুরমার হলো।কিন্তু তাতে জ্যাসপারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

সে ফিওনাকে নিয়ে ঘরের মাঝখানে থাকা বড় কাচের ধাতব টেবিলের কাছে এগিয়ে গেল।ফিওনাকে টেবিলের ওপর আলতো করে বসিয়ে দিলো,কিন্তু তার উত্তেজিত হাতের ধাক্কায় টেবিলের ওপর রাখা ড্রাগনদের পুরনো ইতিহাসের বই,ফ্লাওয়ার ভাস,এমনকি ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবিগুলো মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভেঙে চুরমার হলো।চারপাশে যেন এক অরাজকতা সৃষ্টি হলো,কিন্তু তাদের ভেতরের জগৎ এসব থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন।
জ্যাসপার ফিওনার সামনে দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো।তারপর ধীরে ধীরে জ্যাসপারের হাত ফিওনার গলা স্পর্শ করল,তার আঙুলের আলতো চাপ যেন এক অদ্ভুত শিহরণ বইয়ে দিলো ফিওনার ভেতর।
তারপর,কোনো দ্বিধা ছাড়াই জ্যাসপার ফিওনার ঠোঁটে গভীর চুম্বনে ডুবে গেল।সেই চুম্বনে ছিলো আবেগআকাঙ্ক্ষা,আর এক অদ্ভুত ধরনের অধিকার।ফিওনার দুই হাত নিজে থেকেই জ্যাসপারের ঘাড়ে এসে পড়লো,আর সে চোখ বন্ধ করে নিজেকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলল সেই মুহূর্তে।

সেখানে চারপাশের ভাঙা জিনিসপত্র,চূর্ণবিচূর্ণ ফ্রেম আর বইয়ের স্তুপের মাঝে একমাত্র তাদের ভালোবাসা যেন নতুনভাবে জ্বলজ্বল করছিল।
হঠাৎ করেই জ্যাসপার নিজেকে কিছুটা থামিয়ে ফেলল,তার চোখে গম্ভীরতা ফুটে উঠল।ফিওনার অসহায় দৃষ্টিটা তার অন্তরটাকে আঘাত করল।কিছু একটা ভেবে,সে এক ঝটকায় নিজের অনুভূতিগুলো নিয়ন্ত্রণে আনল।ফিওনা তার চোখে এক গভীর প্রশ্নের দৃষ্টি নিয়ে তাকালো।
“সরি হামিংবার্ড,”জ্যাসপার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“এখন আমি তোমার সাথে এসব কিছু করতে পারবোনা।তুমি নিজের মধ্যে নেই,পরে হয়তো আফসোস করবে আর ভাববে আমি তোমার এই মুহূর্তের এডভানটেজ নিয়েছি।”
জ্যাসপার পিছু হটতে গেলে,ফিওনার হাতে শক্তি ছিল যেন সে আরেকটি নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি করতে চাচ্ছিলো।এক ঝটকায়,ফিওনা জ্যাসপারের শার্টের কলার ধরে টেনে নিলো, আর জ্যাসপার অবচেতনভাবেই ফিওনার ওপর কিছুটা ঝুঁকে পড়লো।ফিওনার চোখে এক নতুন দৃঢ়তা,এক অদৃশ্য ইচ্ছা স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
তার ঠোঁটে অদৃশ্য এক তরঙ্গের মতো,জ্যাসপার নিজের বুড়ো আঙুল দিয়ে সূক্ষ্মভাবে ফিওনার অধরে চাপ দিলো,যেন সে এক ধরনের প্রলোভন অনুভব করছিলো—আকর্ষণ,দ্বন্দ্ব আর নৈরাজ্যের এক গভীরতম স্তরে।”কান্ট্রোল ইয়োরসেল্ফ হামিংবার্ড…”—তার কণ্ঠে ছিল এক অদৃশ্য শক্তি,যা ফিওনাকে এক শাসনমুখী অনুভূতির মধ্যে ঢেলে দেয়।

জ্যাসপার ফিওনার দিকে এক মুহূর্ত চুপচাপ তাকিয়ে থাকল, তারপর এক মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “চলো,তোমার এখন বিশ্রাম প্রয়োজন।তোমার কক্ষে দিয়ে আসি।”তার কথায় এমন এক যত্ন ছিল,যেন ফিওনার সব ক্লান্তি,দুশ্চিন্তা,সমস্ত কিছু দূর করে দিয়ে তাকে শান্তির এক স্থানে নিয়ে যেতে চায়।
এটা বলেই জ্যাসপার ফিওনাকে কোলে তুলে নিল।ফিওনার মাথা তার বুকের ওপর নেমে আসলো,আর তার নিঃশ্বাস যেন এক অদ্ভুত সঙ্গীত তৈরি করছিল।জ্যাসপার পা বাড়াল, করিডোরের শান্ত অন্ধকারে হেঁটে চলল।
সবে ফিওনার কক্ষের কাছাকাছি পৌঁছেছে,ফিওনার মৃদু কণ্ঠে একটা স্বপ্নের গল্প ভেসে উঠল,যা তার হৃদয়ের গহিনে লুকিয়ে ছিল।”জানেন,আমার একটা ড্রিম আছে,”ফিওনা বলল,তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত ভঙ্গিমা ছিল,যেন সে তার মনের গহীনে কিছু কিছু বলে ফেলতে চাচ্ছিল।তার চোখে এক স্বপ্নময়তা,এক প্রত্যাশা ছিল যা শুধু তাকে বোঝার জন্যই।
জ্যাসপার থেমে গিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল,”কি ড্রিম?”

ফিওনার মুখে মৃদু হাসি ছিল,আর তার চোখে আকাশে উড়ে যাওয়ার এক নীল পরিকল্পনা ছিল। “আপনারা ড্রাগন রূপে আকাশ থেকে পুরো পৃথিবী দেখতে পারেন!আমি ও যদি এভাবে করে পুরো পৃথিবীটা দেখতে পারতাম।গ্ৰান্ডপা আমাকে কোথাও ঘুরতে দিতো না,পৃথিবী না হোক শুধু পুরো চীন শহরটা দেখতে পেলেই হতো।”
ফিওনার কথায় এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা ছিল,যেন তার মনটা সেই অসীম আকাশের মতোই মুক্ত।সেই দৃশ্যপট,যেখানে ড্রাগনের মতো আকাশে উড়ে থাকা যায়,পৃথিবীটা যেন হাতের মুঠোয় এনে ধরতে পারে,এক অপার সম্ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকা।

জ্যাসপার কিছুক্ষণ নিরব থাকল,তারপর তার নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,”আমি তোমার ড্রিম পূর্ণ করবো,হামিংবার্ড।”
ফিওনা একটু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,”সত্যি কিভাবে?” তার চোখে কিছুটা অস্থিরতা ছিল,কিন্তু তার মধ্যে এক অদ্ভুত আকর্ষণও ছিল।জ্যাসপার কোনো কথা না বলে,নিঃশব্দে ফিওনাকে কোলে করেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে,গ্লাস হাউজের বাইরে নিয়ে এলো তাদের চারপাশে রাতের হাওয়া মৃদু প্রবাহিত হচ্ছিল,আর চাঁদের আলো পাহাড়ের চুড়ায় নেমে আসছিল।
পাহাড়ের চুড়ায় দাঁড়িয়ে,জ্যাসপার ফিওনার সামনে দাঁড়িয়ে। ফিওনার হাত দুটো শক্ত করে তার গলায় জড়িয়ে নিয়েছিল পেছন‌ দিকে থেকে।

অন্ধকার আকাশের নিচে,জ্যাসপার ধীরে ধীরে তার ভেতরের শক্তি অনুভব করল।সে ফিওনার হাত শক্তভাবে ধরে ঘাব ঘুরিয়ে ধরে বলল,”হামিংবার্ড,আমকে শক্ত করে ধরে রাখবে।”এরপর,এক মুহূর্তে সবকিছু বদলে গেল।জ্যাসপার তার শরীরের শক্তি আর শক্তিমান রূপে রূপান্তরিত হতে শুরু করল।সে সবুজ বিশাল ড্রাগনে পরিণত হলো।তার বিশাল পাখাগুলি আকাশে ছড়িয়ে পড়ল,আর শরীরের প্রতিটি আঁকা রেখা যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল।
ফিওনা,যা কিছু ভাবছিল তা এক মুহূর্তে ভুলে গিয়ে জ্যাসপারকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।সে তার পিঠে বসে ছিল,আর জ্যাসপার তাকে তার শক্ত পাখায় আগলে রেখেছিল।যেন তার সব শঙ্কা,ভয় একসঙ্গে মিলিয়ে গিয়েছিল।জ্যাসপারের পিঠে যখন ফিওনা বসলো তখন তার অনুভূতি হলো এক অদ্ভুত মিশ্রণ—শক্ত,কিন্তু একই সাথে মসৃণ আর কিছুটা গরম।

কারণ ড্রাগন রূপে জ্যাসপারের পিঠের স্কেলগুলো প্রায় শক্ত,কিন্তু সেগুলি খুব ধারালো না। বরং,সেগুলি শ্বেত পাথরের মতো মসৃণ আর শক্ত,যেন প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা।তার পিঠের স্কেলগুলো শক্ত হলেও, তারা খুব সূক্ষ্মভাবে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়ে একটি অদ্ভুত সুরক্ষিত অনুভূতি দিয়েছে।
ফিওনা হয়তো প্রথমে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করবে,কারণ ড্রাগনের পিঠে বসা সহজ নয়, ষকিন্তু খুব শীঘ্রই সে খুঁজে পায় যে এই শক্ত পিঠ তাকে এক ধরনের নিরাপত্তা প্রদান করেছে।আর ড্রাগন অবস্থায় জ্যাসপারের শরীরের তাপ,বিশেষত তার পিঠে,খুবই গরম ছিলো।এটাই তার ড্রাগন শক্তির একটি প্রমাণ।এই তাপ আর শক্তি ফিওনাকে এক অদ্ভুত ভাবে সম্মোহিত করেছে।

আর ঠিক তখনি,আকাশে এক বিশাল ড্রাগন উড়ে যেতে শুরু করলো।জ্যাসপার ধীরে ধীরে আকাশের রাশিতে হারিয়ে যেতে শুরু করল।তার পাখাগুলি বিশাল আর শক্তিশালী ছিল,পৃথিবীর বুকে যেন ঝড়ের আগমন।ফিওনা একটুও ভয় না পেয়ে,কেবল আকাশের বিস্তার ও নিচের পৃথিবীর অবারিত সৌন্দর্য দেখছিল।
পৃথিবীটাকে দেখতে দেখতে,সে অনুভব করলো যেন সে আর পৃথিবী একাকার হয়ে গেছে।দূর থেকে,এটি মনে হচ্ছিল—একটি বিশাল চাঁদের মাঝে,তার কেন্দ্রে কালো ছায়ার মতো উড়ছে এক ড্রাগন,আর তার পিঠে একজন মেয়ে—এই দৃশ্য যেন এক কল্পনার খোঁজ।
ফিওনা তাকিয়ে দেখলো,পৃথিবী তার পায়ের নিচে,এক বিশাল ছবির মতো ছড়িয়ে আছে।শহরগুলো,পাহাড়গুলো, নদী ও সাগর—সব কিছু যেন এক বিশাল ছবির মধ্যে আছড়ে পড়ছে।আর তার চোখের সামনে,শুধুমাত্র সে আর জ্যাসপার—এ যেন এক স্বপ্নের মতো।

ঘন্টাখানিক বাদে,ফিওনার ধীরে ধীরে নিঃশ্বাসের শব্দ জ্যাসপারের কানে আসছিল।তার হাতের মুঠো ঢিলে হয়ে গিয়েছিল,আর মাথাটা জ্যাসপারের পিঠে হেলে পড়েছিল। ব জ্যাসপার সেটা বুঝতে পেরে আর কোনো উচ্চতা বাড়াল না। তার পাখাগুলো আস্তে আস্তে গতি কমিয়ে আনল।মৃদু বাতাসে তার সবুজ ড্রাগন রূপ আলোকিত চাঁদের আলোয় মেলে ধরেছিল।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে পাহাড়ের মাটিতে নেমে এল,যেন পৃথিবী তাকে স্পর্শ করার অপেক্ষায় ছিল।পা মাটি ছুঁতেই তার বিশাল ড্রাগন রূপ মিলিয়ে গেল।তার জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল সেই অভিজাত মানব রূপের জ্যাসপার,কিন্তু কোলে তখনও নিস্তব্ধ ফিওনা।

সে ফিওনার মুখের দিকে তাকাল।শান্তির ঘুমে মগ্ন ফিওনার মুখে তখন এক অদ্ভুত প্রশান্তি।জ্যাসপারের চোখে এক মুহূর্তের জন্য মৃদু কোমলতা খেলা করল,যা তার মতো ড্রাগনের জন্য এক অজানা অনুভূতি ছিল।কিন্তু সে কিছু বলল না,বরং আরও শক্ত করে ফিওনাকে ধরে নিল।
ধীরে ধীরে পা ফেলে সে গ্লাস হাউজের দিকে এগিয়ে গেল। চারপাশ নিস্তব্ধ,যেন প্রকৃতি তার চলার শব্দ শুনতে চাইছিল না।কোলে থাকা ফিওনার ভারও তখন তার জন্য তুচ্ছ মনে হচ্ছিল।তার কাঁধে চাঁদের আলো পড়ছিল,আর তার কোলে শুয়ে থাকা ফিওনা যেন সেই আলোতেই স্বপ্নের জগতে হারিয়ে গিয়েছিল।
ফিওনার কক্ষে প্রবেশ করে।জ্যাসপার আলতো করে ফিওনাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো।ঘরের মৃদু আলোয় ফিওনার মুখে প্রশান্তির ছায়া পড়েছিল।কিছুক্ষণ তার দিকে ঝুঁকে থেকে জ্যাসপার মৃদু স্বরে বলল,
“আমি জানি,হামিংবার্ড,আগামীকাল তুমি হয়তো আজকের কিছুই মনে রাখতে পারবে না।কিন্তু আমার জন্য,আজকের দিনটা আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা দিন ছিল।”

তার কণ্ঠে মিশে ছিল গভীর আন্তরিকতা আর একধরনের দুর্বার আকর্ষণ।কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে ফিওনার কপালের ওপর আলতো করে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো, যেন এই মুহূর্তটা চিরন্তন করে রাখতে চায়।
জ্যাসপার পুনরায় ফিওনার দিকে তাকিয়ে গভীর ও দৃঢ় কণ্ঠে বললো,”আর কখনো অ্যালিসার নাম উচ্চারণ করবে ন।”হামিংবার্ড ড্রাগনের হৃদয়ে একবার যার নাম লেখা হয়ে যায়, তা সহস্র বছরেও মুছে যায় না।আমার ধ্বংসের আগ পর্যন্ত তুমি আমার হৃদয়ে থাকবে,যতদিন না এই পৃথিবী আর ভেনাস তাদের অস্তিত্ব হারায়।”ততদিন এই নাম “ফিওনা” আমার কঠিন হ্নদয়ে,এক টুকরো নক্ষত্রের মতো জলজল করবে।তার কণ্ঠে প্রতিটি শব্দ যেন অমরতার স্পর্শ পেল, আর ওই মুহূর্তে পৃথিবী,সময় আরআকাশও যেন থমকে দাঁড়াল এমন এক অঙ্গীকারের সামনে।

আযদাহা পর্ব ২৯

জ্যাসপার নিঃশব্দে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়,তার চরণগুলো যেন বাতাসের চেয়েও নীরব।কিন্তু পেছনে রেখে যায় তার অমোঘ ভালোবাসার চিহ্ন—একটা নিঃশব্দ,অথচ গভীর অঙ্গীকার।ফিওনা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন,জানে না,অনুভবও করতে পারে না যে,এক ভয়ংকর শক্তিশালী ভেনাসের ড্রাগন প্রিন্স তার প্রেমে পাগলপ্রায়।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—ফিওনা কি কখনো বুঝতে পারবে,যে হৃদয় ধ্বংস করতে পারে গ্রহ আর নক্ষত্র,তা আজ তার ভালোবাসায় বন্দী হয়ে গেছে?

আযদাহা পর্ব ৩১