আযদাহা পর্ব ৩২

আযদাহা পর্ব ৩২
সাবিলা সাবি

পাহাড়ের উপর থেকে গড়িয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস ফিওনার চুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।গ্লাস হাউজ থেকে পালিয়ে আসার উত্তেজনায় তার হৃদস্পন্দন তীব্র।চারপাশে পাহাড়ের জঙ্গলের ঘনত্ব ক্রমেই বাড়ছে।তার পায়ের নিচে পাতা আর মাটির সোঁদা গন্ধ তাকে আরো তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ফিওনা ইচ্ছেমতো দিক বেদিক ভাবে দৌড়াচ্ছে।তার মনে একটাই চিন্তা—এই পাহাড়ের জঙ্গল পেরিয়ে তাকে একটা কাঁচা রাস্তায় পৌঁছাতে হবে।সে জানে,সময় খুব কম। জ্যাসপার হয়তো ইতিমধ্যেই এথিরিয়নের কাছ থেকে খবর পেয়ে গেছে।এখন ওদের আসা শুধু সময়ের ব্যাপার।

পাহাড়ি মাটির উঁচু-নিচু পথ তাকে দমাতে পারছে না।সে দৌড়াচ্ছে এক অদম্য সাহসে,জঙ্গল আর ছায়ার মাঝে নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।তার দৃষ্টি তখন সামনে, কিন্তু তার হৃদয় ভয় আর উত্তেজনায় কাঁপছে।
“শান্ত হ ফিওনা।কাঁচা রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেই হয়।” সে নিজেকে সাহস দিচ্ছে।
কখনো তার পা পিছলে যাচ্ছে কাদায়,কখনো ঝোপঝাড়ের কাঁটা তার কাপড় ছিঁড়ে দিচ্ছে।কিন্তু সে থামছে না।জঙ্গল যত গভীর হচ্ছে,আশপাশে পাখির ডাক,পাতার মচমচ শব্দ আর বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ তাকে যেন আরো সতর্ক করে তুলছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একসময় পাহাড়ের ঢাল কমতে শুরু করলো।ফিওনার মনে হলো সে সঠিক পথে আছে।সামনেই হয়তো সেই কাঁচা রাস্তা, যেখানে পৌঁছালে সে অন্তত কিছুটা এগিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু তার মনে একটা ভয়ও আছে।
“ফায়ার মনস্টারটারটা যদি সত্যিই আমার খোঁজ পেয়ে যায় তাহলে?”এই ভেবে তার বুক কেঁপে ওঠে।
পেছন থেকে পাতার মচমচ শব্দ ভেসে এলো।ফিওনার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল।সে পেছনে ফিরে তাকালো,কিন্তু কিছু দেখতে পেল না।
“কেউ কি আমাকে অনুসরণ করছে?” তার মনে হলো।
সে দৌড়ের গতি আরো বাড়ালো।তার পা যেন আর টানছিল না,কিন্তু সে থামার কথা ভাবছে না।
*মাউন্টেন_গ্লাস হাউজ*
গ্লাস হাউজের নিস্তব্ধতা ভেঙে এথিরিয়ন দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করলো।তার মুখে আতঙ্ক আর ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।অ্যাকুয়ারা তখনই তার দিকে তাকিয়ে বুঝে গেল কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটেছে।

“কী হয়েছে,এথিরিয়ন?তুমি এভাবে হাঁপাচ্ছ কেন?” অ্যাকুয়া জিজ্ঞেস করলো।
“ফিওনা…”এথিরিয়ন কথাটা ঠিকভাবে বলতে পারছিল না। তার চোখে অপরাধবোধ ফুটে উঠছিল।
“ফিওনা কী করেছে আর ও কোথায়?” অ্যাকুয়া ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এলো।
“ফিওনা আমাকে ধোঁকা দিয়েছে!আমি জানি না কীভাবে… সে আমাকে খরগোশ ধরার কথা বলে পাহাড়ের বাগানে নিয়ে গেল।আর আমি যখন সেই খরগোশের পেছনে ছুটছিলাম, তখন সে পালিয়ে গেছে!”
অ্যাকুয়ার চোখ বড় হয়ে গেল। “তুমি কী বলছো,এথিরিয়ন? ফিওনা পালিয়ে গেছে?তুমি কীভাবে এমন অসাবধান হতে পারলে?”

“আমি বুঝতে পারিনি!সে এতটাই শান্তভাবে আমাকে ম্যানিপুলেট করলো যে আমি কিছু বোঝার আগেই সে গায়েব হয়ে গেল।”
এমন সময়,গ্লাস হাউজের প্রবেশপথে ভারী পদক্ষেপের শব্দ শোনা গেল।কয়েক মুহূর্ত পরে জ্যাসপার প্রবেশ করলো।তার উপস্থিতি যেন পুরো ঘরটায় একটা ঠান্ডা নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে দিল।তার তীক্ষ্ণ চোখ দুটো অ্যাকুয়ারা আর এথিরিয়নের দিকে গেল।
“কী হয়েছে এখানে?” তার গভীর কণ্ঠস্বর তাদের দুজনের মধ্যে স্নায়ুচাপ তৈরি করলো।
অ্যাকুয়া চুপ ছিল,কিন্তু এথিরিয়ন সংকোচ নিয়ে বললো, “ফিওনা পালিয়ে গেছে,জ্যাসু ভাইয়া।ও আমাকে ধোঁকা দিয়েছে।আমি… আমি বুঝতে পারিনি।”
জ্যাসপারের মুখে একটা ক্ষীণ অথচ ভয়ঙ্কর হাসি ফুটে উঠলো।তার চোখে যেন আগুন জ্বলছিল।
“তুই ওকে নিয়ে বাইরে গিয়েছিলিস?।কোন সাহসে আমার অনুপস্থিতিতে তুই আমার পরামিশন ছাড়া এই গল স হাউজের মেইন দরজার লক খুললি এথিরিয়ন?”
“আমি সত্যিই…আমি বুঝতে পারিনি সে এমনটা করবে।ও আমাকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করেছিল,”এথিরিয়ন তাড়াতাড়ি বললো।

জ্যাসপার গভীর নিশ্বাস নিলো। “আমরা পৃথিবীতে কোনো খেলার জন্য আসিনি ।আমি জানতাম সে একদিন চেষ্টা করবে পালানোর।কিন্তু তার এভাবে সফল হবে ভাবতে পারনি।”
অ্যাকুয়া ততক্ষণে শান্ত হলেও গভীর চিন্তায় পড়ে গেছে। “আমরা কি এখনই তাকে খুঁজতে যাবো?”
“না,”জ্যাসপার তীক্ষ্ণ গলায় বললো। “সে পাহাড় আর জঙ্গলের ভেতর একা।বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না। আমি জানি কোথায় সে যেতে পারে।আমি একাই যাবো ওকে আনতে।এবার সে বুঝবে পালানোর ফল কী হতে পারে।”
তার চোখে রহস্যময় এক দৃঢ়তা ছিল,যেন ফিওনার প্রতিটি পদক্ষেপ তার নজরেই আছে।
অ্যাকুয়ারা হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আস্তে আস্তে বললো,“তাহলে এতদিন যে ফিওনা আমার সঙ্গে বাইরে বেরিয়েছিল,তখন তো পালানোর কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করেনি।এবার হঠাৎ কেন?”
জ্যাসপার তার দিকে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকালো।সেই চোখে রাগ, সন্দেহ,আর হতাশা স্পষ্ট। “তুমি কি ফিওনাকে কোনোভাবে ইঙ্গিত দিয়েছিলে যে এথিরিয়ন তার ড্রাগন রূপ নিতে অক্ষম?”

অ্যাকুয়ারা একটু দ্বিধায় পড়লেও সত্য লুকিয়ে রাখতে পারলো না।ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো।“আমি সরাসরি কিছু বলিনি… কিন্তু হ্যাঁ,একবার কথোপকথনের সময় সে সেটা আন্দাজ করতে পারে এমন কিছু বলেছিলাম।”
জ্যাসপারের চোখ জ্বলে উঠলো।তার ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা হাসি ফুটে উঠলো।তবে সেই হাসি একটুও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না।সে ধীরে ধীরে বললো “হুম… যতটা বোকা মানবী ভেবেছিলাম,ততটা তুমি নও,ফিওনা।তুমি ধীরে ধীরে আমার প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছো।অনেক চালাক তুমি তবে জানো না অতি চালাকেল গলা*য় দ*ড়ি।”
জ্যাসপার হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো,অ্যাকুয়ারা হতবাক হয়ে তার চলে যাওয়া দেখলো।
“ প্রিন্স আপনি কি একা যাবেন?”অ্যাকুয়ারা পিছু ডাকলো।
জ্যাসপার ফিরে তাকালো না।শুধু বললো,“যে পথ সে নিয়েছে,সেখানে তাকে খুঁজে পেতে আমার কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই।”
অ্যাকুয়ারা আর এথিরিয়ন নিজেদের মধ্যে চিন্তিত চোখে তাকালো।তাদের মনে হলো,জ্যাসপারের এই ক্রোধ কেবল ফিওনার জন্য নয় বরং তার নিজের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ও এতে জড়িত।

সন্ধ্যা ধীরে ধীরে নেমে আসছে,আকাশের রঙ কমলা আর বেগুনি মিশিয়ে এক অপার্থিব পরিবেশ তৈরি করেছে।ফিওনা দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো।তার সামনে যে দৃশ্যটা উঠে এলো,সেটা তার হৃদয় এক মুহূর্তে ধক করে উঠিয়ে দিলো।
তার সামনে আর কোনো রাস্তা নেই—শুধু বিশাল এক গভীর সমুদ্র।সমুদ্রের জল যেন দিগন্ত ছুঁয়ে গেছে,আর তার ওপর পড়ন্ত সূর্যের আলো এক রূপালি আভা ছড়াচ্ছে।কিন্তু সেই সৌন্দর্যের মাঝে ফিওনার মনে একটিই উপলব্ধি হলো—সে পুরোপুরি আটকে গেছে।
তার চোখ ভয়ে বড় হয়ে গেল।এতক্ষণ সে ভাবছিল,দৌড়ে কোনো না কোনো নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাতে পারবে।কিন্তু এখন বুঝতে পারলো,এই পাহাড় আসলে গভীর সমুদ্রের মাঝখানে অবস্থিত।এটা এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ,যার কোনো সহজপথে মুক্তি নেই।

তার শ্বাস ভারী হয়ে এলো।সে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো,কিন্তু ভয় তার মনকে গ্রাস করে ফেললো। “আমি কি এখানে চিরতরে আটকে গেলাম?” ফিওনা ফিসফিস করে বললো।
পেছনে পাতার মচমচ শব্দ শুনে ফিওনা হঠাৎ পিছনে তাকালো।মনে হলো,কেউ বা কিছু তার পিছু নিয়েছে।তার শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল।এটা কি জ্যাসপার? নাকি অন্য কেউ?
সে জানতো,জ্যাসপার যদি তাকে ধরে ফেলে,তাহলে এবার তার শাস্তি হবে ভয়ংকর।কিন্তু তার সামনে কোনো বিকল্প ছিল না।সমুদ্রের কোলাহল আর ক্রমাগত ঢেউয়ের আঘাত তার ভয়ের মাত্রা আরো বাড়িয়ে তুললো।
“এখন কী করবো?” ফিওনা নিজেকে জিজ্ঞেস করলো, চারপাশে কোনো উপায় খুঁজতে খুঁজতে।কিন্তু গভীর জঙ্গলে যেমন পালানো সম্ভব ছিল না তেমনি এখানে মহাসাগর তাকে পথ দেখানোর পরিবর্তে আরো বেশি অসহায় করে তুললো।

তার ভেতরের সাহস যেন ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছিল ফিওনা ধীরে ধীরে পেছনের গাঢ় অন্ধকারের দিকে তাকালো।
ফিওনা গভীর শ্বাস নিলো।সামনে সমুদ্রের বিশাল জলরাশি, পেছনে এক অজানা অন্ধকার।তার ভেতরে আতঙ্কের ঢেউ উঠলেও সে এবার আরেকটা সিদ্ধান্ত নিলো।
“মাউন্টেন গ্লাস হাউজে ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই,” ফিওনা মনে মনে বললো।”যতটা ভয়ংকর জ্যাসপারই হোক, এই জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার চেয়ে ভালো।হয়তো একদিন জ্যাসপার মুক্তি দেবে…”
ফিওনা এবার উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলো।পথ যতই অন্ধকার আর জটিল হোক না কেন,তার মনে একটা বিশ্বাস গড়ে উঠেছে—সে যেন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।কিন্তু তার চিন্তার মাঝেই হঠাৎ চারপাশ যেন থমকে গেল। চারিদিকে এক অদ্ভুত নিরবতা। বাতাসটা যেন হঠাৎ ভারী হয়ে এলো।

তখনই সামনে এক বিকট শব্দে মাটি কেঁপে উঠলো।একটা বিশাল প্রাণী মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালো,যেন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে। ফিওনার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।এটা একটা মনস্টার কাঁকড়া।
মনস্টার কাঁকড়াটা প্রায় ২০ ফুট লম্বা আর প্রস্থে আরো বড়। এর গা কালো ধাতব বর্মে ঢাকা,যা সূর্যের আলোতেও চকচক করে।এর পায়ের সংখ্যা বিশাল আর অদ্ভুতভাবে দ্রুত চলার জন্য তৈরি।কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো এর পিন্সার বা কাঁকড়ার বড় দুটি দাঁড়ার মতো হাত।প্রতিটি পিন্সার ৮ ফুট লম্বা আর রক্তলাল রঙের,যা যেন শিকারকে এক মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে।এর চোখ দুটি লাল আর জ্বলন্ত অগ্নির মতো।
এই কাঁকড়া মনস্টারটার নাম “ক্রাবাথন”।এটি সমুদ্র আর জঙ্গলের সীমান্তে রাজত্ব করে।এটি নিজের অঞ্চল ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ সহ্য করে না।
ফিওনা এক পা পিছিয়ে গেলো। “এটা কী!” তার মুখ দিয়ে অস্ফুটে বের হলো।
ক্রাবাথন হঠাৎ গর্জন করলো,যার শব্দ যেন মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে গেল।ফিওনা নিজের কান চেপে ধরলো।কিন্তু তারপরেই মনস্টার তার বিশাল পিন্সারগুলো সামনে নিয়ে আসলো আরফিওনার দিকে আঘাত করতে এগিয়ে এলো।

পিন্সারটা এত দ্রুততার সাথে আসছিল যে ফিওনা কোনোমতে একপাশে লাফিয়ে পড়ে আঘাত থেকে বাঁচলো। পিন্সারের আঘাতে মাটি গভীরভাবে কেঁপে উঠলো,আর বড় একটি গর্ত তৈরি হলো।
ফিওনার হৃদপিণ্ড দ্রুত লাফাতে থাকলো।সে বুঝলো,এই কাঁকড়ার সাথে সরাসরি লড়াই অসম্ভব।সে দ্রুত কিছু একটা করতে হবে।কিন্তু সমস্যা হলো,পেছনে ফেরার পথও বন্ধ।
“এই ভয়ানক কাকড়াটা হয়তো আমাকে এখানেই শেষ করে দেবে,” ফিওনা মনে মনে বললো।কিন্তু তার সাহস যেন এক মুহূর্তের জন্য হারালো না।
কাঁকড়াটা আবার পিন্সার তুলে ফিওনার দিকে আঘাত করতে এগিয়ে এলো।এবার ফিওনা চিৎকার করে বললো,”বাঁচাও!”
তখনই হঠাৎ দূর থেকে ঝড়ের মতো এক আওয়াজ ভেসে এলো।এটা যেন বাতাস কেটে আসা কিছু।ফিওনা বুঝলো, হয়তো তার কণ্ঠস্বর কেউ শুনেছে।

ফিওনা আর পা এগোতে পারছিল না।আতঙ্কে,ক্লান্তিতে,আর হতাশায় সে মাটিতে পড়ে গেল।ক্রাবাথনের বিশাল পিন্সার আকাশে উঠে ফিওনার দিকে নামতে শুরু করলো।ফিওনা বুঝতে পারলো,এটাই হয়তো তার শেষ মুহূর্ত।
চোখ বন্ধ করে ফিওনা ফিসফিস করে বললো,”শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেলাম না,এটার হাতেই মরতে হবে..”
কিন্তু ঠিক তখনই বাতাস যেন কেঁপে উঠলো।এক ভয়ঙ্কর গর্জন আকাশ ছেয়ে গেল।ফিওনা চমকে উঠলেও তার চোখ খুলতে সাহস হলো না।
আকস্মিকভাবে চারপাশ যেন আলোতে ভরে গেল।একটা বিশাল আঘাতের শব্দে মাটি কেঁপে উঠলো,যেন কোনো বিশাল কিছু ক্রাবাথনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।ফিওনা নিজের হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিল,কিন্তু চারপাশের আওয়াজ তাকে চোখ খোলার জন্য বাধ্য করলো।
চোখ খুলে ফিওনা প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না,কারণ সামনে ধুলো আর বাতাস ঘুরছিল।ধীরে ধীরে ধুলো থিতিয়ে গেলে সে যা দেখলো,তাতে তার শ্বাস আটকে গেল।

জ্যাসপার!
কিন্তু এটি সেই জ্যাসপার নয় ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল ড্রাগন জ্যাসপারে।উচ্চতা ছিল কমপক্ষে ৩০ ফুট, আর তার গা থেকে যেন অগ্নিশিখা আর শক্তির ঢেউ বের হচ্ছিল।তার চকচকে স্কেলগুলো ধাতব সবুজ রঙের,আর চোখ দুটো ঠিক আগুনের মতো জ্বলছে।বিশাল ডানাগুলো আকাশকে ছুঁয়ে ছিল,আর তার লম্বা লেজটি কাঁকড়ার চারপাশে দুলছিল।
ফিওনা জ্যাসপারের বিশাল মাথার দিকে তাকালো। জ্যাসপারের চোখ দুটো ক্রোধে জ্বলছিল,আর তার পা দুটো এত বড় যে এক ঝটকায় মাটিকে চূর্ণ করতে পারে।
কাঁকড়া ক্রাবাথন গর্জন করে পিন্সার তুলে আক্রমণ করার চেষ্টা করলো,কিন্তু জ্যাসপার তাকে এক মুহূর্তেরও সুযোগ দিল না।বিশাল এক থাবা দিয়ে সে ক্রাবাথনের একটি পিন্সার ধরে ছিঁড়ে ফেললো।তার গর্জনে চারপাশ যেন কেঁপে উঠলো।

ফিওনা তখনও মাটিতে বসে ছিল।ধীরে ধীরে সে জ্যাসপারের মুখের দিকে তাকালো।সে এতদিন জ্যাসপারকে ভয় পেয়েছে,কিন্তু এই মুহূর্তে তার মনে হলো,এই ড্রাগনটাই যেন তার রক্ষক।
জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য ফিওনার দিকে তাকালো,তার ড্রাগন রূপের আগুনমাখা চোখে অদ্ভুত কিছু ছিল।ফিওনা বুঝলো,সে নিরাপদ।
জ্যাসপার তখন ড্রাগন রূপেই কাঁকড়ার দিকে ফিরে আবার আঘাত করতে উদ্যত হলো।কাঁকড়াটি এবার পালানোর চেষ্টা করলো,কিন্তু জ্যাসপারের বিশাল ডানা এক ঝটকায় তাকে আছড়ে মাটিতে ফেলে দিল।ক্রাবাথন আর টিকতে পারলো না।
ফিওনা তখনও জ্যাসপারের বিশাল আকারের পা আর ডানা দেখে হতবাক।
“কি ভয়ংকর দৃশ্য?” ফিওনার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল।
জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য থামলো।তারপর আস্তে আস্তে তার বিশাল মুখটা ফিওনার কাছে আনলো।তার চোখে একধরনের ধৈর্য আর জ্বলন্ত ক্রোধের মিশ্রণ ছিল।

“তোমাকে বাচাতে ড্রাগন রুপ নিতে হয়েছে “তার গর্জনের মধ্যে শব্দগুলো যেন ফিওনার কানে প্রতিধ্বনিত হলো।
ফিওনা বুঝতে পারলো,সে যতবারই পালানোর চেষ্টা করুক নাকেন,জ্যাসপার তাকে ছেড়ে দেবে না।
জ্যাসপার দ্রুত তার বিশাল ড্রাগন রূপ থেকে মানব রূপে ফিরিয়ে আসলো।ফিওনার চোখের সামনে এক ঝলকেই তার বিশাল শারীরিক পরিবর্তন ঘটলো।ড্রাগনের আগুনমাখা শরীরের পরিবর্তে,এবার সে দাঁড়িয়ে ছিল একজন পুরুষ, মানুষের রূপে।কিন্তু তার চোখে তখনও একই অগ্নি,একই শক্তি ছিল।
“তোমাকে সুরক্ষিত স্থানে যেতে হবে,”সে ফিওনাকে দ্রুত এক হাতে তুলে নিয়ে একটা বড় গাছের আড়ালে নিয়ে গেল। গাছটি এত বড় যে তার ছায়া পুরো প্রান্তরকে ঢেকে ফেলেছিল।ফিওনার চমকে যাওয়া চোখগুলো রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল,তবে সে বুঝতে পারলো,জ্যাসপার তাকে রক্ষা করবে।

জ্যাসপার ফিওনাকে গাছের পিছনে রেখে দাঁড়ালো।তার চোখে তখনও অস্থিরতা ছিল,তার শরীরের প্রতিটি পেশি যেন উত্তেজনায় দুলছিল।কিন্তু সে জানতো,এখন তার সবচেয়ে বড় কাজ হলো ফিওনাকে সুরক্ষিত রাখা।
ফিওনা এক পা পিছিয়ে দাঁড়াল,তার কণ্ঠে ভয় ছিল,কিন্তু তার চোখে কৃতজ্ঞতা।তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আসলে কী বিশাল শক্তির অধিকারী,তা সে এখন স্পষ্ট বুঝতে পারলো।
ঠিক তখনই,তীব্র এক গর্জন শুনে ফিওনার বুক থেকে শ্বাস বেরিয়ে গেল।কাঁকড়াটি,যে এতক্ষণ দূরে ছিল,এখন আক্রমণ করতে আসছিল।তার বিশাল পিন্সার থেকে জ্বলন্ত তীক্ষ্ণ ধার বের হয়ে আসছিল,আর তার চোখে মিশে ছিল ক্রোধের জ্বলন্ত আগুন।

কাঁকড়া এক ঝাঁপ দিয়ে জ্যাসপারের পিঠে আঘাত করলো। একটি বিশাল পিন্সার তার পিঠের মাংসে ঢুকে গেল,সবুজ রক্তের লাইন ছড়িয়ে পড়লো।জ্যাসপার তখনও ঝাঁকুনি দেয়, কিন্তু সে ব্যথাকে এক মুহূর্তের জন্যও অনুভব করতে পারলো না।তার মন একমাত্র ফিওনার সুরক্ষা নিয়ে ছিল।
আবার এক মুহূর্তেই,জ্যাসপার তার সমস্ত শক্তি কেন্দ্রীভূত করে ড্রাগন রূপে ফিরে গেল।তার শরীরের প্রতিটি কোষ আবার আগুনে পুড়ে উঠলো।বিশাল ডানা টান করে আকাশে উঠলো,আর তার ড্রাগন চিঁৎকার গর্জনের মতো আকাশে প্রতিধ্বনিত হল।কাঁকড়া হোঁচট খেয়ে পিছিয়ে গেল,কিন্তু জ্যাসপার তাকে আর পালাতে দিল না।
তার বিশাল থাবা কাঁকড়ার দিকে ছুটে গেল।জ্যাসপার যেন এক সজোর আঘাত দিয়ে কাঁকড়াটির শরীরের এক পিন্সারকে ভেঙে ফেললো।কাঁকড়া আর প্রতিরোধ করতে পারলো না।

ফিওনা,গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে,দেখছিল জ্যাসপারের শক্তির মূর্ত রূপ।তার শরীরের প্রতিটি অংশে যেন আগুন জ্বলছিল,আর তার এক একটি আঘাতে কাঁকড়াটি তছনছ হয়ে যাচ্ছিল।
বিকট গর্জন আর তীব্র বাতাসের মাঝে,ফিওনা বুঝতে পারলো—এটা ছিল যুদ্ধ,কিন্তু জ্যাসপার তাকে বাঁচানোর জন্য সমস্ত কিছু দেবার প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
জ্যাসপার আবার মানব রূপে ফিরলো,তার বিশাল ড্রাগন গঠন মুহূর্তে বদলে গিয়ে তার পরিচিত পুরুষ রূপে ফিরে আসলো।তার শরীর থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছিল,তবে তার চোখে কেবল একটাই লক্ষ্য ছিল—ফিওনাকে নিরাপদে রাখতে হবে।সুতরাং,সে দ্রুত কাঁকড়ার দিকে এগিয়ে গেল, যেখানে সেই বিশাল সত্ত্বাটি মাটিতে পড়ে ছিল।
কাঁকড়ার শরীরের এক কোণে একটি অদ্ভুত সিগন্যাল বের হচ্ছিল।সিগন্যালটি খুবই আলোকিত ছিল,আর একের পর এক ঝলক দিয়ে আকাশে সরে যাচ্ছিল।এটা কোন সাধারণ সিগন্যাল ছিল না—এটা যেন একটি সংকেত,যা কাঁকড়ার পালকে বা গোত্রকে আহ্বান করছিল।

“শিট ,”জ্যাসপার স্বগতোক্তি করে বললো।তার মুখের অভিব্যক্তি কঠিন ছিল,কিন্তু তার চোখে দ্রুত চিন্তা চলছিল। সে ফিওনাকে দেখলো,তার মুখে উদ্বেগ আর অসহায়তার ছাপ।
“ফিওনা,তাড়াতাড়ি এখন থেকে চলো,” সে অস্থির কণ্ঠে বললো। “এখনই এই স্থান ত্যাগ করতে হবে আমাদের।”
ফিওনা কাঁপানো হাতে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,”কোথায় যাবো?মাউন্টেন গ্লাস হাউজে ফিরবো?”
জ্যাসপার মাথা নাড়লো। “না,এটা খুব বিপজ্জনক।কাঁকড়ার সিগন্যালের কারণে এখন সমস্ত কাঁকড়া আমাদের দিকে আসবে।আর তারা যদি একযোগে আক্রমণ করবে,তখন মাউন্টেন গ্লাস হাউজের সবাই বিপদে পড়বে,এতোগুলোর সাথে লড়াই করা সম্ভব না,আর তুমি মানবী তোমার বিপদ বেশি।”
ফিওনা চোখ বড় করে তাকালো, বুঝতে পারলো যে এই সিগন্যালের মাধ্যমে কিছু বড় বিপদ আসছে।কিন্তু কোথায় যাবে তারা?কী করবে তারা এখন?

“সেটা ঠিক ” ফিওনা স্বীকার করে বললো।”কিন্তু তাহলে এখন আমরা কোথায় যাব?”
“এখনই আমাদের এখান থেকে দ্রুত সরে যেতে হবে।আমাদের এমন একটা নিরাপদ স্থানে যেতে হবে যেখানে ওরা আমাদের লোকেশন ট্রাক করতে পারবে না,” জ্যাসপার উত্তেজিত গলায় বললো।
এতক্ষণে, সিগন্যালটি আরও তীব্র হয়ে উঠলো।এটি শুধু কাঁকড়াদের মধ্যে সংকেত ছড়াতে থাকেনি,বরং পুরো জঙ্গলকেও তা একেবারে টানে।জ্যাসপার জানতো তাদের সময় খুব কম।কাঁকড়ার পাল খুব শীঘ্রই তাদের চারপাশে ঘিরে ফেলবে,আর সেই সময়ে তারা যদি পালানোর চেষ্টা করে, তাহলে বিপদ আরো বাড়বে।
ফিওনাকে নিয়ে দ্রুত জ্যাসপার একপালনীয়ভাবে স্থান পরিবর্তন করতে শুরু করলো তার চোখের কোণে কেবল অদৃশ্য আশঙ্কা ছিল,কিন্তু তার মন একদম স্থির ছিল।তার উদ্দেশ্য একটাই: ফিওনাকে নিরাপদে রাখা।

ঝর্নার গুহার প্রবেশপথ ছিল অদ্ভুত,যেন কোনো প্রাচীন রহস্যের অন্ধকার সুরক্ষিত কোণ।জলপ্রপাতের গর্জন পেছনে,গুহার ভিতরে প্রবাহিত হতো বিশাল জলধারা।এই গুহাটি জ্যাসপারের বাবা,এলড্র রাজ্যের সম্রাট,প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করেছিলেন—একটি নিরাপদ আশ্রয়,যেখানে কোনও মনস্টার বা শত্রু তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে পারবে না।গুহার ভিতরে ছিল বিশেষ এক প্রযুক্তি,যা কাঁকড়াদের সিগন্যালের কার্যকারিতা বন্ধ রাখতে সক্ষম।সুতরাং তারা এখন অস্থির মুহূর্তগুলির মধ্যে কিছুটা স্বস্তি পেতে যাচ্ছিল।
যাত্রাপথে,ফিওনা দ্রুত পা চালাচ্ছিল,তবে তার দুর্বল শরীর মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল।কাঁকড়ার আক্রমণের পর তার পায়ের নিচের তল পাথরে কাটা পড়েছিল,আর রক্ত ঝরছিল।সে কিছুটা অস্থির হয়ে উঠেছিল,কিন্তু জ্যাসপার ছিল তার পাশে।

“তুমি ঠিক আছো,ফিওনা?” জ্যাসপার তার কাঁধে হাত রেখে ধীরে ধীরে প্রশ্ন করল।
ফিওনার মুখে ব্যথার ছাপ স্পষ্ট ছিল,তবে সে বলল, “হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। কিন্তু আমার পা…” তার কণ্ঠে কষ্ট ছিল।
জ্যাসপার কোনো কথা না বলেই তাকে শক্তভাবে ধরে ফিওনাকে নিজের কাঁধে তুলে নিল।তার শরীরের বিশালতা দআর শক্তি ফিওনাকে নিরাপদে রাখতে সক্ষম ছিল।এই মুহূর্তে,তার হৃদয়ে একটাই চিন্তা—ফিওনাকে কোনোভাবেই বিপদের মধ্যে পড়তে দেয়া যাবেনা।

গুহার দিকে পা বাড়িয়ে,ঝর্নার জলপ্রপাতের গর্জন একদিকে দূরে চলে যাচ্ছিল,আর অন্যদিকে,গুহার প্রবেশপথের কাছাকাছি পৌঁছানোর সাথে সাথেই ফিওনার চোখে কিছুটা স্বস্তি এল।তার শরীরের ব্যথা কিছুটা মিইয়ে আসছিল।
জ্যাসপার তাকে সাবধানে গুহার ভেতরে নিয়ে গেল।গুহার ভিতরে একটি প্রযুক্তি-নির্মিত সিস্টেম ছিল,যা জায়গাটি নিরাপদ রাখত আর তাদের অবস্থান শনাক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।সিস্টেমটি কাজ করছিল চমৎকারভাবে,আর এখান থেকে কোনো মনস্টার বা শত্রু তাদের ট্র্যাক করতে পারবে না।
ফিওনা নিঃশ্বাস ফেলল,কিছুটা শান্ত হয়ে।তার মনে শান্তি ছিল,কিন্তু যে হুমকি তারা পেছনে ফেলে এসেছে,সেই ভয় এখনও তার ভেতর রয়ে গেছে।

“আর কোনো বিপদ নেই”জ্যাসপার ফিওনাকে গুহার গভীরে একটা নিরাপদ জায়গায় বসিয়ে,তার পায়ের আঘাতটি পরীক্ষা করছিল।
ফিওনা চোখ বন্ধ করে বলল, “হ্যাঁ,কিন্তু… কাঁকড়ার সিগন্যাল তো এখনো কাজ করছে…”
“এখন আর কোনো বিপদ নেই,ফিওনা।” জ্যাসপার নিশ্চিতভাবেই বলল, “এই গুহায় কেউ আসতে পারবে না। আমরা নিরাপদ।”
ফিওনা ধীরে ধীরে তার পায়ের কাটা স্থানটা লক্ষ্য করল, তারপর তার কণ্ঠে ধীরে বলে উঠল,“তবে,আমরা এখান থেকে কিভাবে বেরোবো?যদি… অন্য কিছু আসে?”
“আমি আছি তো,” জ্যাসপার বলল, তার চোখে শক্তি আর দৃঢ়তার ঝলক। “এখন আমাদের একমাত্র কাজ হলো অপেক্ষা করা,সিগন্যাল অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত।”

ফিওনা একটু বিরতি দিয়ে মাথা নেড়ে জানাল, “তাহলে আমরা এখানে থাকবো,যতদিন না সিগন্যাল চলে যায়।”
“হ্যাঁ,ঠিক তাই,” জ্যাসপার বলল, “এখন তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন। আর এই সিগন্যাল ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত কার্যকর তারপর নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে।”
ফিওনার চোখে এক ধরনের প্রশান্তি ফুটে উঠল,তার শরীরের ক্লান্তি আর সত্ত্বা কিছুটা শান্ত হয়ে গেল।তার পাশে থাকা জ্যাসপার তার জন্য এক ধরনের আশ্রয়ের মতো—তাকে অন্ধকারের মধ্যে পথ দেখানোর জন্য।
এখন তাদের একমাত্র কাজ ছিল অপেক্ষা করা, আ্য জানত—যতক্ষন না কাঁকড়ার সিগন্যাল পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়, ততদিন তারা এখানে নিরাপদ থাকবে।
গুহার নিস্তব্ধতা যেন মুহূর্তের জন্য থমকে গেছে। বাইরে ঝর্ণার স্রোতের শব্দ দূর থেকে ভেসে আসছে, আর ভেতরে জ্যাসপার নির্জীবভাবে গুহার পাথরের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার চোখ বন্ধ, নিঃশ্বাস ভারী, আর তার শরীর থেকে সবুজ রক্তের ধারা মাটির পাথরে গড়িয়ে পড়ছে। গুহার মৃদু আলো সেই রক্তের রহস্যময় ঝলককে আরও ভয়ানক করে তুলেছে।

ফিওনা দূর থেকে তার দিকে তাকিয়ে ছিল, তার মনের ভেতর এক অজানা অনুভূতি তোলপাড় করছিল। জ্যাসপারের পেট আর পিঠের ক্ষত দেখে তার মন ভারী হয়ে উঠল। একে তো সে নিজেকে এই বিপদের জন্য দায়ী ভাবছে, অন্যদিকে তার মনে পড়ছে আগের সেই ঘটনাগুলো—যখনই জ্যাসপার আহত হয়েছে, সে ফিওনার কাছাকাছি এসেছে এবং তার থেকে কোনো অজানা শক্তি গ্রহণ করেছে।
ফিওনার মনে তখন একটি চিন্তার ঝড় বইতে লাগল। “বায়ো ক্যামিকেল,” জ্যাসপার একবার বলেছিল। তবে কী এটা তার চুম্বনের মাধ্যমেই সক্রিয় হয়? সে জানে না, কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু একটা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল।
সে ধীরে ধীরে জ্যাসপারের কাছে এগিয়ে গেল। তার পায়ের নিচে মাটির পাথর থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল, যেন গুহার প্রতিটি কণা তার চিন্তার বোঝা ভাগ করে নিচ্ছে। তার দৃষ্টি জ্যাসপারের মুখে আটকে গেল। মুখে ব্যথার ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু তবুও সেই রাজকীয় ভাব যেন ম্লান হয়নি।

ফিওনা তার ঠোঁট একটু কেঁপে উঠল। তার হাত সামনের দিকে বাড়ানোর সাহস করল। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত বেগে চলছে, যেন শরীরের রক্ত স্রোত মাথার প্রতিটি কোণায় ধাক্কা দিচ্ছে। “যদি এটা কাজ করে, তাহলে আমি তাকে বাঁচাতে পারব…” তার মনে একটাই আশা।
ঠিক যখন সে জ্যাসপারের মুখের কাছাকাছি গেল, তার ঠোঁট জ্যাসপারের ঠোঁট স্পর্শ করার মুহূর্তে, জ্যাসপারের চোখ হঠাৎ খুলে গেল। তার গাঢ়, সোনালি চোখ দুটো এমনভাবে জ্বলজ্বল করছিল যেন কোনো গভীর আগুন তার ভেতর থেকে জ্বলে উঠেছে।
“কী করছিলে তুমি?” তার কণ্ঠস্বর গভীর এবং অনুপ্রবেশকারী, যেন সেই শব্দ গুহার দেয়াল ভেদ করে ফিওনার অন্তরে গিয়ে পৌঁছাল।
ফিওনা হতচকিত হয়ে সরে গেল। তার গলা শুকিয়ে গেল, চোখে লজ্জা আর ভয়ে মিশ্রিত একটি চিহ্ন ফুটে উঠল। “আমি… আমি ভাবলাম… আপনি তো আহত… হয়তো…” তার কণ্ঠ কাঁপছিল।
জ্যাসপার তাকে একদৃষ্টিতে দেখল। তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল, তবে সেই হাসির গভীরতায় রহস্যের ছাপ ছিল। “কি হয়তো?”

ফিওনা নিশ্চুপ। তার মনের ভেতর কেবল একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—আপনি না সেদিন বললেন‌ কিসের বায়ো ক্যামিকেল ওটা কি তাহলে?
জ্যাসপার ধীরে ধীরে উঠে বসল। তার শরীর এখনও রক্তাক্ত, কিন্তু তার চোখে এক অনন্য শক্তির ঝলক। সে ফিওনার দিকে ঝুঁকে বলল, “তোমাকে যতটা বোকা মনে করেছিলাম, তুমি ততটা নও।।”
তার কথা শেষ হতে না হতেই ফিওনা আর একবার থমকে গেল।গুহার আলোয় তাদের ছায়াগুলো যেন একে অপরের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ফিওনা জানত না,এই ড্রাগনের ভেতরে কত রহস্য লুকিয়ে আছে,আর সে নিজেই তার কতটা অংশ হয়ে উঠতে চলেছে।

জ্যাসপার তখন নিজের মনের দুষ্টু পরিকল্পনা সাজাচ্ছিল। “আমার বোকা মানবীটা সত্যিই বোকা।ভেবেছে,আমি আহত হলেই তার চুম্বনের প্রয়োজন হবে।কিন্তু এই সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়?অবশ্যই না।”
মুখে সামান্য ক্লান্তির ছাপ রেখে,জ্যাসপার ধীরে ধীরে বলল,”হ্যাঁ,আমার বায়ো ক্যামিকেল দরকার,ফিওনা।”
ফিওনার চোখ বড় হয়ে গেল।সে দ্বিধায় পড়ে গেল,কিন্তু কিছু বলল না।সে জ্যাসপারের দিকে এগিয়ে গেল,তার নড়াচড়া থেমে থেমে,যেন মন একদিকে চাইছে সাহায্য করতে আর অন্যদিকে কিছুটা সাবধান।
জ্যাসপার তখন নিজের ঠোঁটজোড়া ধীরে ধীরে এগিয়ে আনতে শুরু করল।তার দৃষ্টি ফিওনার দিকে নিবদ্ধ,তীক্ষ্ণ আর গভীর।কিন্তু ঠিক যখন সে তার পরিকল্পনা সফল করার মুহূর্তে পৌঁছাল,ফিওনা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে তাকে থামিয়ে দিল।

আযদাহা পর্ব ৩১

“আপনি আমাকে বোকা বানাচ্ছেন,তাই না?” ফিওনার কণ্ঠে দৃঢ়তা।তার চোখে মিশে ছিল প্রতারণা বুঝে ফেলার ঝলক। “আজ আপনার কোনো বায়ো ক্যামিকেলের দরকার নেই। আমি বুঝতে পেরেছি।”
জ্যাসপারের মুখে এক চিলতে অপ্রস্তুত হাসি ফুটে উঠল। “আমার হামিংবার্ডটা পুরোপুরি বোকা নয়,তবে এত সহজে আমি হাল ছাড়ব না,”সে মনে মনে বলল।তার চোখের কোণে খেলা করছিল দুষ্টু হাসি। “তুমি যাই ভাবো,ফিওনা,খেলা তো এখনো শুরুই হয়নি”।জ্যাসপার মনে মনে‌ বললো।

আযদাহা পর্ব ৩৩