আযদাহা পর্ব ৪৪

আযদাহা পর্ব ৪৪
সাবিলা সাবি

ফিওনা ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পায়।চারপাশ অন্ধকার, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ অন্ধকারের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।গুহার দেয়াল থেকে এক রকম ঠান্ডা আর্দ্রতা তার ত্বকে অনুভূত হচ্ছে।এক বিরাট শূন্যতার মধ্যে সে নিজেকে খুঁজে পায়—গুহার প্রশস্ততা তার অস্তিত্বকে ক্ষুদ্রতর মনে করায়।
তার হাত পিছনে শক্ত বাঁধা।প্রতিটি চেষ্টা তার কব্জিতে ব্যথা বাড়াচ্ছে,কিন্তু সে থামছে না।”জ্যাসপার!”সে চিৎকার করে।তার কণ্ঠস্বর গুহার দেয়ালগুলোয় প্রতিধ্বনিত হয়,আবার তার নিজের দিকে ফিরে আসে। যেন এই অন্ধকার গুহা তার চিৎকারকে চেপে ধরছে।
হঠাৎ,গুহার দূর থেকে এক সুতীব্র গর্জনের শব্দ তার মনোযোগ কেড়ে নেয়।শব্দটি যেন পাথরের দেয়াল কাঁপিয়ে দিচ্ছে।ফিওনার হৃদয় দ্রুত গতিতে ধড়ফড় করতে থাকে।”এটা কি?সে নিজেকে প্রশ্ন করে।
সে টের পায়,তার আশেপাশে কারো উপস্থিতি আছে। অন্ধকারের ভেতর,এক জোড়া উজ্জ্বল চোখ ঝিকিমিকি করছে।বিশাল লম্বা ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে।এটি সেই ড্রাগন,যে তাকে ব*ন্দী করেছে।তার সোনালী আঁশগুলো অন্ধকারেও জ্বলজ।

গভীর গুহার নীরবতা যেন এক শূন্যতার গল্প বলে। কালো অন্ধকারে মিশে থাকা প্রতিটি ছায়া যেন ফিওনার ক্ষীণ সাহসকে তীক্ষ্ণ ছুরির মতো চিরে ফেলতে চায়।তার হাতদুটি পেছনে শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা, আর পাথুরে মেঝের শীতলতা তার দেহে বয়ে আনে অবর্ণনীয় ক্লান্তি।তবুও,তার চোখে এক অদম্য আলো জ্বলজ্বল করছে—প্রত্যাশার আলো।
“জ্যাসপার কোথায় আপনি ?…”সে ফিসফিস করে,তার কণ্ঠ যেন বাতাসে হারিয়ে যায়।গুহার দেয়ালগুলো প্রতিধ্বনিতে ভরে ওঠে, যেন অন্ধকারই তার কণ্ঠকে গ্রাস করতে চায়।তবু তার বিশ্বাস অটুট।
চারপাশ থেকে গভীর,রহস্যময় শব্দ ভেসে আসে—মাঝে মাঝে পাথরের চাঙড় খসে পড়ে,কখনো হাওয়ার গর্জন, আর কখনো …দূর থেকে শোনা যায় থমথমে গর্জন, যেন কোনো অজানা শক্তি সতর্ক করে দিচ্ছে তার উপস্থিতি।ফিওনার মন বারবার প্রশ্নে ঘুরপাক খায়—“কোথায় আমি?কেন আমাকে এখানে আনা হল?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তবু তার মনের গভীরে এক দৃঢ় বিশ্বাস, এক অবিচল প্রত্যাশা জেগে থাকে।“ প্রিন্স,”সে আবার ফিসফিস করে,কিন্তু এবার তার স্বরে দৃঢ়তা।”আপনি আমায় খুঁজে পাবেন।আমি জানি আপনি আসবেন।”
আচমকা গুহার মেঘলা নীরবতায় এক চঞ্চলতা দেখা দিল।গুহার দেওয়াল যেন কেঁপে উঠল,পাথরের ফাটলগুলো থেকে হালকা আলো ছড়িয়ে পড়ল।দড়ি বাঁধা অবস্থায় ফিওনা কেবল অনুভব করতে পারল, কিছু একটার আগমন।বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, আশপাশের পরিবেশে যেন অদৃশ্য কোনো শক্তির ছোঁয়া।
এবং ঠিক সেই মুহূর্তে,এক তীক্ষ্ণ গর্জন গুহার নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে দিল।গর্জনের ধ্বনি তার হৃদয়কে একধরনের সাহস এনে দিল।ফিওনার চোখ বন্ধ হয়ে গেল,কিন্তু তার মনে ভেসে উঠল জ্যাসপারের দৃঢ় মুখ।
আলো ক্রমেই বাড়ছে।হঠাৎ,একটি ছায়ামূর্তি গুহার প্রবেশমুখে দৃশ্যমান হলো।ফিওনার হৃদয় দ্রুত ধুকপুক করতে লাগল।পাথরের স্তূপ ভেঙে ফেলে,আগুনে ঝলসে ওঠা চেহারা নিয়ে জ্যাসপার গুহায় প্রবেশ করল।তার ড্রাগন আকৃতি যেন গুহার সমস্ত অন্ধকারকে গ্রাস করে নিল।

“আমি জানতাম আপনি আসবেন,” ফিওনার কণ্ঠ এবার শান্ত,কিন্তু তাতে সাহসের ঝলক।
জ্যাসপার তার দিকে এগিয়ে এলো,তার চোখে আগুনের শিখা আর চোয়ালে দৃঢ়তা।”তুমি কি ভেবেছিলে হামিংবার্ড,আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারি? তার কণ্ঠ গভীর,কিন্তু তাতে এক ধরনের মমতা মিশে আছে।
তারপরে শুরু হলো লড়াই।গুহার অন্ধকার থেকে একটি মনস্টার বেরিয়ে এলো,বিশালকায় আকৃতি আর ধারালো দাঁত নিয়ে।তার চোখগুলো যেন আগুনের মতো জ্বলছে।জ্যাসপার তার ড্রাগন শক্তি নিয়ে লড়াই শুরু করল।পাথর ভাঙার শব্দ,আগুনের শিখা,আর মনস্টারের গর্জনে গুহাটি যেন কাঁপছে।
ফিওনা দড়ি থেকে মুক্ত হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে দেখল,তার রক্ষাকর্তা কীভাবে জীবনের জন্য লড়াই করছে।তার মনে তখন একটাই কথা,“জ্যাসপার আমার জন্য আসবেই,সে কখনো পিছু হটবে না।”
লড়াই শেষ হলো।জ্যাসপার বিজয়ী হলো।তার ড্রাগন আকৃতি আবার মানুষের রূপ নিল।ফিওনার দিকে তাকিয়ে বলল,”তুমি আমার পৃথিবী,হামিংবার্ড।আমি তোমার জন্য শেষ র*ক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ব।”
এই মুহূর্তে ফিওনা জানল,সে কেবল নিরাপদ নয়,বরং সে এমন একজন যোদ্ধার ভালোবাসায় আবদ্ধ।যে তার জন্য দুনিয়ার যেকোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে প্রস্তুত।

ফিওনা ধীরে ধীরে চোখ খুলল।চারপাশে নীরবতা। পাথরের গন্ধে ভারী বাতাস।গুহার দেওয়ালের শীতলতা যেন তার ত্বকে অনুভূত হচ্ছে।সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারল,যা কিছু সে এতক্ষণ দেখছিল—জ্যাসপারের প্রবেশ,তার সাহসী লড়াই,তার কথা—সবই ছিল একটি স্বপ্ন।
“এটা কি শুধুই কল্পনা ছিল?”তার গলা ভেঙে এল, আর হৃদয়ে এক অদ্ভুত শূন্যতা গ্রাস করল।
চারপাশে তাকিয়ে ফিওনা অনুভব করল,সে একেবারেই একা।সেই জ্বলন্ত চোখের মনস্টার বা জ্যাসপারের আগমন,কোনো কিছুরই আর চিহ্ন নেই।তার হাত এখনও দড়ি দিয়ে বাঁধা।বাতাসে ভেসে বেড়ানো গুহার ভুতুড়ে নীরবতা যেন তার একাকিত্বকে আরও প্রকট করে তুলছে।
সে তার মনে বারবার নিজের সান্ত্বনা দিতে চাইল,”না, এটা শুধু কল্পনা হতে পারে না।জ্যাসপার আমাকে খুঁজে পাবে।সে নিশ্চয়ই আসবে।”

কিন্তু সময় যেন থমকে গেছে।যতক্ষণে তার প্রতীক্ষা দীর্ঘ হচ্ছে,ততই সন্দেহ দানা বাঁধছে মনে।“যদি সে না আসে?যদি সে জানতেই না পারে আমি কোথায়?”
ফিওনার মনে একদিকে ভয়,আরেকদিকে আশা।একা গুহার গভীরে ব*ন্দি,তার মনে হচ্ছিল যেন সময় আর বাস্তবতা তার বিরুদ্ধে কাজ করছে।
তবু,সে নিজের মনকে শক্ত করল।“আমি নিজেকে হারাতে পারি না।যদি সে আমাকে খুঁজে না পায়,তবে আমাকেই বেরিয়ে আসতে হবে।”
তার চোখ দুটি গুহার চারপাশে ঘুরে বেড়াল।দেয়ালের কোথাও কোনো ফাটল বা আলোর চিহ্ন খুঁজতে লাগল। তার হাতের দাঁড়িগুলো ধীরে ধীরে টানতে শুরু করল, জানত এটা সহজ হবে না।
গুহার নীরবতার মধ্যে হঠাৎ এক তীক্ষ্ণ আওয়াজ শুনতে পেল।দূরে কোথাও যেন পাথর গড়িয়ে পড়ছে। তার হৃদয় আবার জেগে উঠল।“এটা কি… জ্যাসপার?”

অথবা,হতে পারে,এই আওয়াজ কোনো নতুন বিপদের আগমনী বার্তা।
ফিওনার মনে আশা আর আতঙ্কের মিশ্রণ।এই অন্ধকার তাকে গ্রাস করার আগে,তাকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে।আর যদি কেউ তার দিকে আসেও,সে জানত না,সেটা জ্যাসপার নাকি আরেকটি দুঃস্বপ্ন।
ফিওনা হাতের বাঁধন মুক্ত করার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিল।দড়ি শক্ত হলেও কোথাও যেন আলগা ছিল, যেন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে শক্ত করে বাঁধেনি।তার হাতগুলো ধীরে ধীরে ঘামছিল,কিন্তু সে চেষ্টা থামালো না।অবশেষে,এক পর্যায়ে দড়ির গিঁট আলগা হয়ে গেল।

সে দ্রুত হাত দুটো মুক্ত করে নিল এবং কাঁধ মচকালো। মুক্তির স্বাদে তার মনে সামান্য স্বস্তি এলেও,এই গুহার গভীর অন্ধকার তাকে মনে করিয়ে দিল যে আসল চ্যালেঞ্জ এখনো শেষ হয়নি।
“সোনালী ড্রাগন…”ফিওনার মনে হঠাৎ সেই ড্রাগনের কথা ভেসে উঠল।সে কীভাবে তাকে এখানে ধরে এনেছিল,তার চোখের সেই রহস্যময় দৃষ্টি,যেন সে জানত ফিওনা এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে না। ফিওনা বুঝতে পারল,তাকে আলগা করে বেঁধে রাখা হয়েছিল একটাই কারণে—এই গুহা তার কাছে আরেকটি অদৃশ্য কারাগার।
সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।পাথরের মেঝে তার পায়ের নিচে শীতল অনুভব হচ্ছিল।তার মন বারবার প্রশ্ন করতে লাগল,”এই গুহা থেকে বের হওয়ার পথ কোথায়?এখানে কতটা বিপদ লুকিয়ে আছে?”
গুহার দেয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে হাঁটতে শুরু করল। চারপাশে নীরবতা,শুধু দূরের কোথাও থেকে পানির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।পাথরের দেয়ালগুলো শীতল আর ভেজা।গুহার প্রতিটি কোণ যেন তাকে আরেকটি ধাঁধার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছিল।

ফিওনার মনে বারবার প্রশ্ন জাগল,”ড্রাগন কেন আমাকে মুক্তির সুযোগ দিল?সে কি চায় আমি কিছু খুঁজে পাই?নাকি এটা শুধু একটা পরীক্ষা?”
সে হঠাৎ এক স্থানে থমকে দাঁড়াল।দেওয়ালের ফাঁকে একটি ছোট আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে।তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।”আলো মানে তো বাইরের দুনিয়া, হয়তো এখান থেকেই আমি বের হতে পারি!”
কিন্তু ঠিক তখনই,গুহার গভীর থেকে এক হিমশীতল শব্দ ভেসে এল।শব্দটা ভারী আর গভীর,যেন কারও শ্বাসের শব্দ।ফিওনা স্থির হয়ে দাঁড়াল।তার মনে হল, গুহায় সে একা নয়।

ফিওনা চারপাশে কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। অন্ধকার গুহার দেওয়ালগুলো যেন তাকে ঘিরে ধরেছিল,তার মুক্তির সম্ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। হতাশার ভারে ক্লান্ত হয়ে সে মাটিতে ধপাস করে বসে পড়ল।তার চোখ ভিজে উঠল,আর মনটা যেন কেঁদে উঠল।নিঃসঙ্গতা আর অনিশ্চয়তা তাকে গ্রাস করছিল।
হঠাৎ,ফিওনার মনে পড়ল তার গলায় থাকা লকেটের কথা।দ্রুত জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে লকেটটা বের করল।লকেটটা তার হাতের স্পর্শে ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল,মৃদু সবুজ আলো ছড়িয়ে পড়ল অন্ধকার গুহায়।আলো এতটাই মায়াময় ছিল যে,মুহূর্তের জন্য গুহার চারপাশটা যেন রহস্যময় জগতে পরিণত হলো।
ফিওনা লকেটের উজ্জ্বল পাথরে হাত রেখে বুকে চেপে ধরল।তার কণ্ঠ ভেঙে গেল,”আমি কি আর আপনার কাছে ফিরতে পারব না?আপনাকে আর দেখতে পারব না জ্যাসপার?”

এদিকে,বহু দূরে জ্যাসপার তার ল্যাবে বসে ছিল।তার চারপাশে ল্যাবের আধুনিক ডিভাইসগুলোর অবশিষ্টাংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল—সবই ভাঙা। সেগুলো নিজের হাতেই ধ্বং*স করেছিল সে,কারণ ফিওনাকে হারানোর পর থেকে সেগুলোকে অর্থহীন মনে হচ্ছিল।
কিন্তু হঠাৎ তার স্মার্ট ঘড়িটা কম্পন দিতে শুরু করল। ঘড়ির পর্দায় ছোট্ট একটি নীলচে-সবুজ সিগন্যাল জ্বলজ্বল করে উঠল।জ্যাসপার দ্রুত ঘড়ির দিকে তাকাল।”এটা… এটা তো ফিওনার লকেটের সিগন্যাল!”
সে সঙ্গে সঙ্গেই স্মরণ করল,ফিওনার লকেট তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি করা।লকেটের পাথরের ভেতরে একটি অত্যাধুনিক কম্পিউটার চিপ বসানো ছিল,যা শুধুমাত্র ফিওনার স্পর্শে সক্রিয় হবে।ফিওনা যখনই লকেট স্পর্শ করবে সেটা সংকেত পাঠাবে জ্যাসপারের স্মার্ট ঘড়িতে।
জ্যাসপার তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়াল।তার চোখে এক ঝলক আশা জ্বলে উঠল।”ফিওনা…তুমি বেঁচে আছ! আমি আসছি।”
সে দ্রুত তার ল্যাবের কোণায় রাখা ছোট জেটপ্যাকটি তুলে নিল, এটি ছিল তার নিজস্ব ডিজাইন করা একটি দ্রুতগামী ফ্লাইট ডিভাইস,যা সংকেত অনুসরণ করে সঠিক স্থানে পৌঁছতে পারে।সে তার স্মার্ট ঘড়ি থেকে সিগন্যাল ট্র্যাক করে লকেটের অবস্থান নির্ধারণ করল।

জ্যাসপারের স্মার্ট ঘড়ির পর্দায় হঠাৎই একটি তিন-মাত্রিক মানচিত্র ভেসে উঠল।নীলচে-সবুজ আলোয় আঁকা মানচিত্রটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।একটি পাহাড়ের নাম জ্বলজ্বল করে দেখা গেল— “শিলা ক্লিফ”।
শিলা ক্লিফ ছিল পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় এবং দুর্গম স্থান।পাহাড়টি ছিল আকাশছোঁয়া,শিখরের চারপাশে সবসময়ই মেঘ জমে থাকত।এর পাদদেশে গভীর অরণ্য এবং প্রবল নদীর গর্জন শোনা যেত।পাহাড়ের ঢালগুলো ছিল খাড়া এবং বিপজ্জনক,যেখানে মানুষের পা রাখা প্রায় অসম্ভব।
পাহাড়ের শিখরে ছিল একটি প্রাচীন গুহা,যা স্থানীয় কিংবদন্তিতে পরিচিত ছিল”আঁধার আশ্রয়”নামে। কথিত ছিল,এই গুহায় একসময় ড্রাগনরা বসবাস করত।কেউ কখনো গুহার ভেতরের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি,কারণ এর পথ সবসময় রহস্যময়ভাবে অদৃশ্য হয়ে যেত।

জ্যাসপার দ্রুত ঘড়ির মানচিত্র দেখে নিশ্চিত হলো। ফিওনার সংকেত সেই আঁধার আশ্রয় গুহা থেকেই আসছে।
“শিলা ক্লিফ,”জ্যাসপার নিজের মনে নামটা উচ্চারণ করল।তার ভ্রু কুঁচকে উঠল।”তোমাকে এরকম বিপজ্জনক জায়গায় নিয়ে গেছে কে,ফিওনা?যা-ই হোক,আমি আসছি।”
জ্যাসপার জেটপ্যাকটি প্রস্তুত করল এবং নিজের স্মার্ট ঘড়ির নির্দেশনায় শিলা ক্লিফের দিকে যাত্রা শুরু করল। গন্তব্যে পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগবে,কারণ শিলা ক্লিফ এমন একটি জায়গা, যেখানে সাধারণ ডিভাইস কাজ করত না।
এদিকে,ফিওনা গুহার মেঝেতে বসে ছিল,লকেট থেকে নির্গত আলো তার চারপাশের অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল।গুহার বাইরে শিলা ক্লিফের বাতাস শোনা যাচ্ছিল—প্রবল এবং শীতল,যেন গুহাটির রহস্যকে আরও ঘনীভূত করছিল।
জ্যাসপার জানত,শিলা ক্লিফে পৌঁছানো মানেই শুধু বিপজ্জনক এলাকায় প্রবেশ করা নয়,বরং তাকে এমন এক শত্রুর মুখোমুখি হতে হবে, যে এই গুহাকে তার নিজের সাম্রাজ্য বলে মনে করে।

শিলা ক্লিফের পাথুরে শিখরে পৌঁছানোর সাথে সাথেই জ্যাসপার দূর থেকে একজনকে দেখতে পেলো।সোনালী ড্রাগনটি মানব রুপেই গুহার প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে ছিল,জ্যাসপার যতই কাছে আসছিল, ড্রাগনের চোখ দুটি লাল আগুনের মতো ঝলকাচ্ছিল।
ড্রাগনটি এক মুহূর্ত দেরি না করেই ফিওনাকে গুহার ভেতর থেকে টেনে বের করল।ফিওনা হঠাৎ করে এভাবে বের হওয়ায় ধাক্কা খেয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ড্রাগনটি তাকে শক্ত করে ধরে রাখল।
“এবার তুমি আমার হাত থেকে বাঁচতে পারবে না,” সোনালী ড্রাগন গর্জে উঠল।তারপর সে ফিওনার হাত দুটো তুলে জোর করে নিজের গলার কাছাকাছি চেপে ধরল।যেন এটিই তার পরবর্তী পরিকল্পনার সূচনা।
ড্রাগনটি ধীরে ধীরে তার আসল রূপ ধারণ করল—এক বিশাল,প্রাচীন সোনালী ড্রাগন।তার দেহ ঝলমল করছিল সূর্যালোকে,যেন সে এক জীবন্ত সোনার মূর্তি। ফিওনা নিজেকে ড্রাগনের পিঠে আবিষ্কার করল,আর মুহূর্তের মধ্যেই ড্রাগনটি আকাশে উড়াল দিল।

পেছনে থাকা জ্যাসপার এই দৃশ্য দেখে মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।কিন্তু এক সেকেন্ডও নষ্ট না করে সে তার বিশাল ডানা বিস্তার করে সে এক লাফে আকাশে উঠল।
ফিওনা বাতাসের শীতলতা আর উচ্চতার ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল।হঠাৎই তার কানে ভেসে এল ডানা ঝাপটানোর শব্দ।ভয় পেয়ে পেছনে তাকিয়ে সে দেখল—এক সবুজ ড্রাগন তাদের পেছনে আসছে।
ড্রাগনটির চেহারা,গতি,আর ভঙ্গিমা তার জন্য অত্যন্ত পরিচিত।সে চিনতে ভুল করল না।
“প্রিন্স!আপনি এসেছেন!আপনি আমাকে বাঁচাতে এসেছেন!”ফিওনা চিৎকার করে উঠল।
সোনালী ড্রাগন ফিওনার চিৎকার শুনে ক্ষেপে গেল।সে তার গতি আরও বাড়িয়ে দিল,যেন তার শিকারকে আরও দূরে সরিয়ে নিতে পারে।
জ্যাসপার পেছন থেকে এক কঠিন গর্জন ছাড়ল,যা পুরো আকাশে প্রতিধ্বনিত হলো।তার সবুজ ডানা শক্তিশালী বাতাস কেটে এগিয়ে চলছিল,আর তার চোখ দুটি আগুনের মতো জ্বলছিল।“তোমাকে থামতেই হবে,সোনালী ড্রাগন।ওকে ছেড়ে দাও!”

ফিওনা এক মুহূর্তের জন্য সাহস ফিরে পেল। জ্যাসপারের উপস্থিতি যেন তাকে নতুন করে বাঁচার আশা দিল।এখন তার ভরসা শুধুই তার ড্রাগন প্রিন্স, যে কোনোভাবেই তাকে এই বিপদ থেকে মুক্ত করবে।
সোনালী ড্রাগনটি হঠাৎ করে উজ্জ্বল সোনার আলোতে জ্বলে উঠল,যেনো আকাশ নিজেই তার রাগের প্রতিফলন দেখাচ্ছে।তার বিশাল মুখ থেকে এক বিশাল আগুনের গোলা বেরিয়ে জ্যাসপারের দিকে ছুটে এলো।
জ্যাসপার এক চমৎকার দক্ষতায় বাতাসে দ্রুত বাঁক নিল,গোলাটি তার পাশ দিয়ে চলে গেল।কিন্তু সে পাল্টা আ*ক্রমণ করতে পারল না—তার চোখ ফিওনার দিকে আটকে ছিল।সোনালী ড্রাগনের পিঠে বসা ফিওনার চোখে আ*তঙ্ক আর আকুল আবেদন স্পষ্ট ছিল।
“আমি যদি আ*ক্রমণ করি,ফিওনার কিছু হয়ে যেতে পারে,” জ্যাসপারের মনে এক দ্বন্দ্ব জেগে উঠল।তার মস্তিষ্কে কেবল একটাই চিন্তা:ফিওনাকে সুরক্ষিত রাখা।
সোনালী ড্রাগন এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে আবার আক্রমণ চালাল।এবার সে তার ডানা দিয়ে বাতাসের প্রবল ঝাপটা তৈরি করল,যা জ্যাসপারের ভারসাম্য নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।জ্যাসপার দ্রুত নিজেকে সামলে নিল,কিন্তু তার চোখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট ছিল।
ফিওনা এই মুহূর্তে চিৎকার করে উঠল,“প্রিন্স!নিজেকে রক্ষা করুন!আপনি আমার জন্য কষ্ট সহ্য করতে পারবেন না!”

জ্যাসপার ফিওনার কণ্ঠে ব্যথার ছোঁয়া শুনে তার মন স্থির করল।সে ড্রাগন রূপে থাকা সত্ত্বেও যেনো তার হৃদয়টা আরও বেশি মানবিক হয়ে উঠল।
এদিকে ফিওনা সোনালী ড্রাগনের দিকে ফিরে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, “প্লিজ,ওনাকে আঘাত করবেন না। আপনি যেখানে বলবেন আমি সেখানেই যাবো।কিন্তু জ্যাসপারকে কষ্ট দেবেন না।প্লিজ,তার কিছু করবেন না।”সোনালী ড্রাগনের চোখে এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধার ছায়া ফুটে উঠল।তার শক্ত ডানা স্থির হয়ে গেল। ফিওনার আকুল আবেদন হয়তো তার হৃদয়ের কোনো এক কোণ ছুঁয়ে গেল।
জ্যাসপার এই সময়ে ফিওনাকে আরও দৃঢ়ভাবে দেখতে থাকল,তার মনে একটাই প্রতিজ্ঞা—কোনো ভাবেই সে ফিওনাকে বিপদে পড়তে দেবে না।এখন তার অপেক্ষা কেবল এক সুযোগের,যেটা তাকে তার ভালোবাসার মানুষকে বাঁচানোর পথ দেখাবে।

সোনালী ড্রাগনটি হঠাৎ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল কিছু একটা মনে করে।তার আ*ক্রমণ যেন আকাশ কাঁপিয়ে তুলছিল,এবং প্রতিবারের ঝাপটায় জ্যাসপারকে অস্থির করে তুলছিল।বাতাসে দুলতে থাকা ফিওনা অনুভব করছিল ড্রাগনের পিঠ ক্রমেই তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
হঠাৎ,একটি প্রবল আ*ঘাতের ধাক্কায় ফিওনা পিছলে গেল।ড্রাগনের পিঠ থেকে সে মাটির দিকে তীব্র গতিতে পড়তে শুরু করল।চারপাশের বাতাস যেন তার চিৎকারকে গিলে ফেলছিল।ফিওনার মনে হলো,এই পড়ে যাওয়া তার জীবনের শেষ অধ্যায়।

“আজ হয়তো সব শেষ।জ্যাসপার,আমি আর কখনো আপনাকে দেখতে পাব না…”ফিওনা চোখ বন্ধ করে ফেলল,এক অনিবার্য পরিণতির জন্য প্রস্তুত।
কিন্তু সেই মুহূর্তে,এক শক্তিশালী বাহু তাকে ধরে ফেলল।একটি পরিচিত উষ্ণতা তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল।ফিওনা ধীরে ধীরে চোখ খুলল এবং দেখে সে জ্যাসপারের পিঠে বসে আছে।তার সবুজ ড্রাগন রূপে থাকা জ্যাসপার শক্ত ডানা মেলে ফিওনাকে নিরাপদে ধরে রেখেছে।
এক মুহূর্তের জন্য ফিওনা কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না।তার হৃদয় যেন ধুকপুক করতে করতে থেমে গেল। সে ধীরে ধীরে জ্যাসপারের পিঠে গাল ঠেকাল, নিজের হাত দিয়ে তাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।
“আপনি এলেন,প্রিন্স… আমি জানতাম,আপনি আমাকে বাঁচাবেন।” ফিওনার কণ্ঠ আবেগে ভরা,এবং তার চোখে কৃতজ্ঞতার অশ্রু টলমল করছে।

জ্যাসপার তার ডানা শক্ত করে মেলে উড়তে থাকল। তার দৃষ্টি সোনালী ড্রাগনের দিকে নিবদ্ধ ছিল,কিন্তু তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত কোমলতা ফুটে উঠল।
“আমি থাকতে তোমাকে কখনোই পড়ে যেতে দেব না, হামিংবার্ড।তুমি আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান।”
সেই মুহূর্তে ফিওনার মনে হলো,আকাশে তাদের এই উড়াল যেন কেবল যুদ্ধের এক টুকরো নয়,বরং তাদের সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়।
সোনালী ড্রাগনের আচরণ যেন আরও হিং*স্র হয়ে উঠল।এবার তার মুখে এক ধরনের বি*কৃত আনন্দ ফুটে উঠল,কারণ তার কাছে সুযোগ এসেছে একসাথে জ্যাসপার এবং ফিওনাকে ধ্বং*স করার।সে হিং*স্রভাবে জ্যাসপারের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল,তার শক্তিশালী ডানা বাতাসকে কাঁপিয়ে তুলল।

তবে এবার জ্যাসপার তার প্রিন্স শক্তি ব্যবহার করল। তার হাত থেকে এক তীব্র আ*গুনের গোলা বেরিয়ে সোজা সোনালী ড্রাগনের দিকে ছুটে গেল। সেই আগুনের গোলাটি ড্রাগনের চোখে ঝলকানি তৈরি করল এবং মুহূর্তের জন্য ড্রাগনটি দিশেহারা হয়ে পড়ল। সে আকাশে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ছটফট করতে থাকল।
জ্যাসপার আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে একটি নিরাপদ স্থানের সন্ধান করল।পাহাড়ের নিচে একটি শান্ত গাছের ছায়ায় সে ফিওনাকে পিঠ থেকে নামিয়ে রেখে নরম কণ্ঠে বলল,”এখানে থেকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। আমি ওকে শেষ করে আসছি।”ফিওনা আতঙ্কিতভাবে বলল,”আপনি সাবধানে থাকবেন,প্রিন্স।”

জ্যাসপার এক মৃদু হাসি দিয়ে বলল,”তুমি জানো, আমি তোমার জন্য সব করতে পারি।”
তারপর সে দ্রুত আকাশে উড়ে গেল।এবার তার আ*ক্রমণ আরও তীব্র হয়ে উঠল।একের পর এক আগুনের ঝলক দিয়ে সে সোনালী ড্রাগনটিকে পরাস্ত করার চেষ্টা করতে থাকল।ড্রাগনটি ততক্ষণে পাহাড়ের নিচে নেমে আসার চেষ্টা করছিল,তার শক্তি ক্রমেই কমে আসছিল।
শেষমেশ,যখন সোনালী ড্রাগন বুঝতে পারল তার আর পালাবার পথ নেই,সে তার ড্রাগন রূপ ত্যাগ করে মানব রূপ ধারণ করল।তবে তার এই কৌশলও কাজে এল না।জ্যাসপারও ততক্ষণে মাটিতে নেমে এসেছে এবং মানব রূপ ধারণ করেছে।
সোনালী ড্রাগন পালানোর চেষ্টা করতেই জ্যাসপার তার হাত শক্তভাবে চেপে ধরে বলল,”এবার আর তোমার পালানোর কোনো পথ নেই।তুমি যা করার চেষ্টা করেছ, তার মাশুল দিতে হবে।”
ড্রাগনটি তার চোখে ভয় নিয়ে জ্যাসপারের দিকে তাকাল।তার শক্তি এবং জ্যাসপারের দৃঢ় সংকল্প এক মুহূর্তে তার ভয়কে বহুগুণ বাড়িয়ে দিল।

জ্যাসপার যখন সেই সোনালী ড্রাগনটির মুখোমুখি হলো এবং তার মানব রূপটি স্পষ্ট দেখতে পেল,তার চোখে বিস্ময় ও ক্রোধের ছাপ ফুটে উঠল।সে অবিলম্বে বুঝতে পারল,এই ড্রাগনটি ভেনাসের ফ্লোরাজ রাজ্যের একজন সদস্য,এবং তার নাম থেরাসিলিয়ান।
জ্যাসপারের গলার স্বর দৃঢ় ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, “থেরাসিলিয়ান!তুমি আমার রাজ্যের ড্রাগন হয়েও আমার বি*রুদ্ধে যেতে সাহস করেছ?কী সাহস তোমার, ফিওনাকে ব*ন্দি করার!”
থেরাসিলিয়ান তখনই জ্যাসপারের পায়ে পড়ে যায়। তার মুখে আতঙ্ক ও লজ্জার ছাপ,সে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠল,”প্রিন্স,আমি দোষী।আমাকে ক্ষমা করুন। আমি শুধুমাত্র আদেশ পালন করছিলাম।”
জ্যাসপার আরও ক্ষি*প্ত হয়ে ওঠে।তার হাতের মুষ্টি শক্ত হয়,এবং তার কণ্ঠ তীব্র হয়ে ওঠে,”কার আদেশে? কে তোমাকে পাঠিয়েছে?বলো,নইলে আমি তোমাকে এখানেই শেষ করে দেব!”

থেরাসিলিয়ান কাঁপতে কাঁপতে বলে,”এটা… এটা প্রিন্সেস অ্যালিসার আদেশ ছিল।তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন।তিনি ফিওনাকে বন্দি রাখতে বলেছেন, যাতে আপনি তার কাছে ফিরে আসতে বাধ্য হন।”
জ্যাসপারের মুখে ঘৃণার ছাপ ফুটে উঠল।”অ্যালিসা… আমি জানতাম তার মধ্যে এই ধরনের কূটকৌশল আছে।কিন্তু সে এতটা নিচে নামবে,এটা কল্পনাও করিনি।”
থেরাসিলিয়ান তখনও জ্যাসপারের পায়ে পড়ে কাঁদতে থাকে “আমাকে দয়া করুন,প্রিন্স।আমি শুধু আদেশ পালন করেছি।আমি বুঝতে পারিনি,এটা আপনাকে এতটা কষ্ট দেবে।আমাকে মেরে ফেলবেন না।আমি আর কখনো আপনার পথে আসব না।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ থেরাসিলিয়ানের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।তার মনে ক্রোধের আগুন জ্বলতে থাকলেও,তার ভেতরের ন্যায়বোধ তাকে থামিয়ে দেয়। সে কঠিন কণ্ঠে বলে,”তোমার জীবন এবার আমি ছেড়ে দিলাম,কিন্তু মনে রেখো,যদি আবারও আমার বা ফিওনার বিরুদ্ধে কিছু করো,তখন তোমার শেষ নিশ্চিত।

জ্যাসপার ফিওনাকে হাত ধরে মাউন্টেন গ্লাস হাউজে প্রবেশ করতেই গৃহের আবহাওয়া এক ভিন্নরূপ নেয়।গ্লাসের প্রাচীরগুলি বাইরে থেকে আসা রৌদ্রের আলোকে প্রতিফলিত করে এক অসাধারণ দীপ্তি তৈরি করেছে,কিন্তু তার মন শান্ত ছিল না।তার মনে শুধুই থেরাসিলিয়ানের শাস্তির চিন্তা।
ফিওনার চোখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট ছিল,সে মনে মনে চিন্তা করছিল,”এটা ঠিক কি করছে জ্যাসপার?”কিন্তু তার মনের চিন্তা স্পষ্ট করতে পারেনি।
গ্লাস হাউজের লিভিং রুমে এসে জ্যাসপার জোরে জোরে অ্যালিসার নাম ডাকতে থাকে,”অ্যালিসা!অ্যালিসা!”কিন্তু সেখানে কোনো সাড়া মেলে না।ফিওনা দেখল,জ্যাসপারের মুখে এক ধরনের গম্ভীরতা,এবং সে বুঝতে পারল যে কিছু বড় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।

হঠাৎ,অ্যাকুয়ারা প্রবেশ করে।সে ফিওনাকে দেখতে পেয়ে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে এবং তাকে আলিঙ্গন করে বলে, “ফিওনা!তুমি ফিরে এসেছ!আমি তোমাকে এত মিস করেছি!”
ফিওনা হাসিমুখে সাড়া দেয়,”আমিও তোমাকে মিস করেছি,অ্যাকুয়ারা।কিন্তু আমি কিছু ভয়াবহ ঘটনা পার করেছি।”
জ্যাসপার তখন অ্যাকুয়ারা কে নির্দেশ দেয়,”অ্যাকুয়ারা, এখনি অ্যালিসাকে ডেকে আনো।আমি ওর সাথে জরুরি কথা বলতে চাই।”
অ্যাকুয়ারা নীরবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় এবং দ্রুত অ্যালিসার সন্ধানে বেরিয়ে যায়।
অ্যাকুয়ারা কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে, তার পেছনে অ্যালিসা উপস্থিত হয়।অ্যালিসার মুখে অস্বস্তির ছাপ দেখা যায়।সে বোঝে,কিছু গুরুতর সমস্যা ঘটেছে।আর ফিওনাকে দেখে আরো বেশি অবাক হয়ে যায়।
জ্যাসপার মুখ শক্ত করে বলে,”অ্যালিসা,আমি তোমার কাছে একটি বিষয় জানতে চাই। থেরাসিলিয়ান এখন টর্চার সেলে রাখা হয়েছে।তার প্রতি তোমার আদেশ ছিল ফিওনাকে আটকানোর?”
অ্যালিসা জ্যাসপারের দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”আমি থেরাসিলিয়ানকে পাঠাইনি।আমি এমন কোনো আদেশও দিইনি।”তার গলার স্বরে তে হতাশা স্পষ্ট ছিল।
জ্যাসপার তার কথা শুনে বিরক্ত হয়ে ওঠে। “কিন্তু সে তো স্বীকার করেছে যে তোমার আদেশ ছিলো।তুমি কি আমার সাথে সত্যি কথা বলছ?”

অ্যালিসা নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে চেষ্টা করে। “আমি জানি না হয়তো কেউ আপনাকে ভুল বোঝাতে পারে।আমি থেরাসিলিয়ানকে ফিওনাকে আটকাতে আদেশ দেইনি।সে কি কারণে এমন করেছে,সে জানে।”
জ্যাসপারের চোখ ক্রোধে জ্বলে উঠল।তার গলার স্বর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল,”অ্যালিসা,একদম মিথ্যা কথা বলবে না!তুমি খুব ভালো করেই জানো,ড্রাগন সদস্য কখনো মিথ্যা বলে না।আর থেরাসিলিয়ানকে পৃথিবীতে আনবার অধিকার তোমার ছাড়া আর কারো নেই।
তুমি নিজেও জানো ফিওনার প্রতি তোমার ঈর্ষা কতটা তীব্র।”
অ্যালিসা কিছুক্ষণ চুপ থেকে,মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখে দ্বিধার ছাপ। অবশেষে সে মৃদু কণ্ঠে বলল,”হ্যাঁ প্রিন্স,আপনি ঠিকই বলেছেন।আমি সবকিছু বুঝে গেছি।আমি জানি আপনি ফিওনার প্রতি কতটা ভালোবাসা অনুভব করেন।আর আমি… আমি এটা সহ্য করতে পারিনি।”

জ্যাসপার তার দিকে এগিয়ে গেল, তার চোখে তীব্র প্রশ্ন।”তাহলে কেন?কেন এমন করেছ?শুধু ঈর্ষার কারণে?”
অ্যালিসা তার মাথা তুলল,চোখে অশ্রু নিয়ে বলল, “আমি ওকে মেরে ফেলতে চাইনি,প্রিন্স।আমার শুধু মনে হয়েছিল…যদি ফিওনা আপনার থেকে দূরে থাকে, তাহলে হয়তো আপনি আবার আমার দিকে ফিরে তাকাবেন।আমি শুধু ওকে আটকাতে চেয়েছিলাম।আমি জানতাম থেরাসিলিয়ান ওকে আ*ঘাত করবে না।”
জ্যাসপার একটি দীর্ঘ শ্বাস নিল।তার কণ্ঠে ক্ষোভ এবং হতাশা মিশ্রিত হয়ে উঠল।”তুমি জানো আমি কখনোই অন্যায়ের পাশে দাঁড়াই না।ফিওনার জীবনের ঝুঁকি নেয়ার অধিকার তোমার ছিল না।তুমি যে কাজ করেছো,তার শা*স্তি ভোগ করতে হবে।”

অ্যালিসা কাঁপতে কাঁপতে বললো।”প্রিন্স,আমি দোষ স্বীকার করছি।কিন্তু দয়া করে আমাকে ক্ষমা করুন। আমি শুধু…শুধু আপনাকে হারানোর ভয়ে এমন করেছি।”
জ্যাসপার কঠোর কণ্ঠে বলল,”ক্ষমার প্রাপ্যতা তোমার কাজে নির্ধারিত হবে।থেরাসিলিয়ানের ভুল এবং তোমার ষড়যন্ত্রের কথা আমি ভেনাসে জানাবো। রাজ্যের বিধি অনুযায়ী তোমার শাস্তি নির্ধারণ করা হবে।”ফিওনা পাশ থেকে সবকিছু চুপচাপ দেখছিল।তার চোখে মিশ্রিত ছিল দুঃখ ও হতাশা।সে ভেবে পেল না,কীভাবে একজন মেয়ে ভালোবাসার কারণে এত নিচুতে নেমে যেতে পারে।
অ্যালিসা ফিসফিস করে বলল,”আপনার প্রতি আমার ভালোবাসাই আমাকে অন্ধ করে দিয়েছে,প্রিন্স।”
জ্যাসপার তার দিকে পেছন ফিরে বলে দিল, “ভালোবাসা যদি অন্যের জীবন নষ্ট করে,তাহলে সেটা ভালোবাসা নয়,সেটা শুদ্ধতায় কালিমা।”
অ্যালিসা এবার রেগে যায় ও জানে এমনিতে এখন প্রিন্স ওকে শা*স্তি দিবে,তাই তেড়ে এসে ফিওনার দুই বাহু ধরে ঝাঁকাতে থাকে আর বলে,”তোর জন্য সাধারণ মানবী হয়ে তুই কিভাবে আমার প্রিন্সকে বশ করেছিস বল!তোরা মানবীরা একটা জাদুকরী,তোরা ছলনাময়ী।”

তখনই ফিওনা ব্যথায় কুকিয়ে উঠে,তার মুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অ্যালিসার আচরণ দেখে জ্যাসপারের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়।সে ফিওনার আ*র্তনাদ শুনে দ্রুত এগিয়ে এসে ফিওনার বাহু থেকে অ্যালিসার হাত সরিয়ে দেয়। অ্যালিসাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে রেখে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বলে,”ফিওনা,তুমি ঠিক আছো?”
ফিওনা যন্ত্রণায় ম্লান কণ্ঠে বলল,”আমার কাঁধটা খুব ব্যথা করছে,প্রিন্স।”
জ্যাসপার তখন ফিওনার কাঁধের দিকে নজর দেয় এবং জামার ভেতরে কাঁধের গভীর ক্ষত দেখে তার চোখে ক্রোধ ঝলসে ওঠে।তার কণ্ঠ কঠিন হয়ে যায়,”এটা সহ্য করার মতো নয়।”

ওই ড্রাগন যখন ছাদ থেকে ফিওনার কাঁধে খামচে নিয়ে গেছিলো,তখনি তার নখে ফিওনার কাঁধে একটি গভীর দাগ রেখে গিয়েছিল।জ্যাসপার তার জামাটা হালকা নামিয়ে দেখলো সেই দাগ;র*ক্তের দাগগুলো যেনো বেদনার চিহ্ন হয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল।মুহূর্তের মধ্যে জ্যাসপারের মাথা রাগে গজগজ করতে লাগলো,আর তার প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত তীব্র।
সে অ্যালিসার গলা চেপে ধরলো সবার সামনে,যেনো তার কঠোর সিদ্ধান্তের কথা স্পষ্ট করে দিতে চায়।
ঠিক তখনই থারিনিয়াস,আলবিরা,এবং সিলভা একত্রে উপস্থিত হলো।তাদের চোখে ছিল বিস্ময় ও চিন্তা,যেন তারা বোঝার চেষ্টা করছে এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির পরিণতি কি হতে পারে।
জ্যাসপারের চোখে রাগের আগুন যেন আরও দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।তার গলার স্বর কঠিন হয়ে গেল, “অ্যালিসা!তুমি কীভাবে সাহস করলে ফিওনাকে আঘাত করার?”

ফিওনার কাঁধ থেকে রক্ত ধীরে ধীরে মেঝেতে পড়ছিল। সে যন্ত্রণায় ম্লান হয়ে জ্যাসপারের দিকে তাকাল।
অ্যালিসা ধকধক করে কাঁপতে লাগল,তবুও তার মুখে ঔদ্ধত্যের ছাপ।সে গলায় শ্বাসের অভাবে কষ্ট পাচ্ছিল, তবুও বলল,”আপনার জন্য আমি সব করতে পারি, প্রিন্স!কিন্তু এই সাধারণ মানবী আপনার ভালোবাসা পাবে এটা আমি মেনে নিতে পারি না!”
জ্যাসপারের চোখ রক্তিম হয়ে উঠল।তার কণ্ঠ বজ্রধ্বনির মতো গর্জে উঠল,”কে সাধারণ,আর কে অসাধারণ,সেটা নির্ধারণ করার অধিকার তুমি পেয়েছ কোথায়?ফিওনাকে আঘাত করার সাহস তুমি কীভাবে পেলে?তোমার কাজের জন্য আমি তোমাকে আজই শাস্তি দেব কারন শুনে রাখো একটা কথা স্পষ্টভাবে ফিওনা আমার ভালোবাসা আর আমার ভালোবাসা কখনোই সাধারণ হতে পারেনা।”
থারিনিয়াস দ্রুত এগিয়ে এসে বলল, “প্রিন্স,দয়া করে নিজেকে সংযত করুন।শাস্তি দিতে হলে রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী দিন।এভাবে রাগে সিদ্ধান্ত নেবেন না।”

অ্যালবিরা, অ্যাকুয়ারা,এবং সিলভাও এই দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেল।অ্যাকুয়ারা ধীরে ধীরে জ্যাসপারের পাশে এসে বলল,”প্রিন্স,ফিওনার কাঁধের অবস্থা খুব খারাপ।তাকে আগে চিকিৎসা দিতে হবে।দয়া করে শান্ত হোন।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।তার চোখে ক্রোধ আর দুঃখের ঝড় বইছিল।শেষে সে ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে নিল,কিন্তু তার কণ্ঠ কঠোর রয়ে গেল। “থারিনিয়াস,অ্যালিসাকে তৎক্ষণাৎ টর্চার সেলে নিয়ে যাও।আর তার অপরাধের কথা ভেনাসে জানানো হোক।রাজ্য তার জন্য কী শাস্তি নির্ধারণ করে,তা দেখা হবে।”
অ্যালিসা মাটিতে বসে পড়ল,শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার।তবে তার চোখে এখনও হিং*স্রতার ছাপ ছিল। ফিওনার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,”তুই জিততে পারবি না।প্রিন্সের ভালোবাসা একদিন তোকে ধ্বংস করবে।”
ফিওনা কিছু বলল না।সে কেবল জ্যাসপারের দিকে তাকাল।জ্যাসপার ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এসে মৃদু কণ্ঠে বলল,”তুমি ঠিক আছো,ফিওনা?”

ফিওনা ম্লান গলায় বলল,”আমি ঠিক আছি,প্রিন্স।
জ্যাসপার কিছু না বলে তার হাতে ফিওনাকে তুলে নিল।গ্লাস হাউজের চিকিৎসাকক্ষে নিয়ে যাওয়ার আগে তার চোখে কঠোর প্রতিজ্ঞার ছাপ ছিল।”যে আমার ভালোবাসাকে আঘাত করবে,তার জন্য আমি কোনও দয়া দেখাব না।”
অ্যালিসা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে বলে,”আপনি আমাকে শাস্তি দিতে চান,তাই না?দিন শাস্তি।কিন্তু মনে রাখবেন, এই মানবী আপনার ধ্বংসের কারণ হবে।”

জ্যাসপার ফিওনার দিকে এগিয়ে যায়।তারপর সবার সামনে ঘোষণা দেয়,”অ্যালিসা,তোমার এই অন্যায়ের শাস্তি হবে।থারিনিয়াস,এই মুহূর্তে অ্যালিসাকে টর্চার সেলে নিয়ে যাও।আমি ভেনাসে তার আসল বিচারের ব্যবস্থা করব।”
থারিনিয়াস আদেশ অনুযায়ী অ্যালিসাকে ধরে টর্চার সেলের দিকে নিয়ে যায়।অ্যালিসা যেতে যেতে শেষবারের মতো ফিওনার দিকে তাকিয়ে বলে,”তুই আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছিস।একদিন তোর সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে,মানবী!”
ফিওনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে,তার চোখে অশ্রু। জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার কাছে এসে তার হাত ধরে বলে,”তুমি ভয় পেয়ো না,ফিওনা।আমি তোমার পাশে আছি।”

অ্যালিসার চলে যাওয়ার পর পুরো গ্লাস হাউজে নীরবতা নেমে আসে।কিন্তু জ্যাসপারের মনে আগুনের শিখা জ্বলতে থাকে।সে প্রতিজ্ঞা করে,যে কেউ ফিওনাকে আঘাত করবে,তাকে তার শক্তির মূল্য দিতে হবে।
আলবিরা আর সিলভা অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল। আজকের ঘটনাগুলি তাদের জন্য অবিশ্বাস্য ছিল;তারা জানতে পারলো জ্যাসপার আর ফিওনার সম্পর্কের কথা।আলবিরার চোখে সন্দেহের ছাপ দেখা যাচ্ছিল।সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে,তাদের প্রিন্স,যিনি এতদিন ধরে গর্বের সাথে ড্রাগন রাজ্যকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন,এখন ভালোবাসায় উন্মাদ হয়ে পড়েছেন একজন মানবীর জন্য।

আযদাহা পর্ব ৪৩

“এটা কিভাবে সম্ভব? আলবিরা ভাবতে লাগলো, “আমাদের রাজ্যের একজন প্রিন্স,যার মধ্যে লাভ ফাংশনাল ডিলিট সে কিভাবে প্রেমে পড়তে পারে তাও একজন মানবীর প্রেমে পড়েছেন!সে তো আমাদের জন্য বড়ই অশুভ!”

আযদাহা পর্ব ৪৫