আযদাহা পর্ব ৪৬

আযদাহা পর্ব ৪৬
সাবিলা সাবি

ভেনাসের লালচে আকাশ তখন থমথমে।সূর্যের আলো ম্লান হয়ে গেছে,যেন প্রকৃতিও কোনো অমঙ্গল সংবাদ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে।এল্ড্র রাজ্যের সিংহাসনে বসে থাকা জ্যাসপারের পিতা গভীর চিন্তায় নিমগ্ন।তার সাদা চুলগুলো যেন আরও সাদা হয়ে উঠেছে উদ্বেগের ভারে।সামনে রাখা স্ফটিক গোলকটি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার সন্তানের হৃদয়ের পরিবর্তন।জ্যাসপারের লাভ ফাংশনাল সক্রিয় হয়েছে,তবে সেটি কোনো ড্রাগন রাজকুমারীর জন্য নয় বরং আর সেটি ঘটেছে একটি সাধারণ মানবীর জন্য।

“এ অসম্ভব!” ড্রাকোনিস ফুঁসে উঠলেন,তার গলা ঘরজুড়ে প্রতিধ্বনিত হলো।”আমার র*ক্তধারায় এই দুর্বলতা?এমন ভুল আর কখনো ঘটতে পারে না।”
তাঁর স্মৃতিতে ফিরে আসে সেই দিনগুলো,যখন তাঁর ভাই একটি মানবীর প্রেমে পড়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছিল। মানবীর প্রেমে পড়ে প্রতিবারই ড্রাগন জাতির কেউ না কেউ নিজের শক্তি ও সম্মান হারিয়েছে।এই প্রেম,এই অনুভূতি তাঁদের জন্য কেবলই বিপদের পূর্বাভাস।
তিনি তার দৃষ্টি ফেরালেন স্ফটিক গোলকের দিকে।গোলকে দেখা যাচ্ছে অ্যালিসাকে যে কিনা সবটা জানাচ্ছে ড্রাকোনিসকে, অ্যালিসা আর সিলভা ভেধখে ফিরে এসেছে তবে অ্যালিসার শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে আর শাস্তির পুর্বেই সে সবটা জানাচ্ছে ড্রাকোনিসকে ,জ্যাসপার এবং ফিওনার কিছু মুহূর্ত—যা তুলে ধরলো অ্যালিসা ।সেই দৃশ্যগুলো কল্পনা করতেই ড্রাকোনিসের ভ্রু কুঁচকে গেল।”তুমি কী করে ভুললে,জ্যাসপার?আমি তোমাকে এই ভালোবাসার ফাংশনাল থেকে বাঁচানোর জন্য এত ব্যবস্থা নিয়েছিলাম।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অ্যালিসার শাস্তি নির্ধারণ হয়ে তা প্রস্তুতি চলছে ।ড্রাকোনিস জানতেন,তার অপরাধ ছিল ক্ষমার অযোগ্য।তবে এই মুহূর্তে তার শাস্তির বিষয়টি নয়,বরং জ্যাসপারের অবস্থা তার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে।
“এবার আমার হস্তক্ষেপ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই,” ড্রাকোনিস নিজেকে বললেন। “মানবীটির অস্তিত্বই আমাদের জাতির জন্য হু*মকি হয়ে উঠতে পারে।”
তাঁর কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে গেল।ড্রাকোনিসের সিদ্ধান্ত যেন পুরো এলড্র রাজ্যের ভার বহন করছিল।তিনি তাঁর প্রধান উপদেষ্টা অ্যালড্রিককে ডাকলেন।

“জ্যাসপারকে ফিরিয়ে আনতে হবে।তার সঙ্গে সেই মানবীর সম্পর্ক এখনই শেষ করতে হবে।যদি সে না মেনে চলে, তাহলে…” তার কথাটি অসম্পূর্ণ রয়ে গেল,কিন্তু অ্যালড্রিক বুঝতে পেরেছিলেন রাজা কী ইঙ্গিত করছেন।
ড্রাকোনিস তখন আকাশের দিকে তাকালেন।তার গভীর দৃষ্টি যেন শূন্যতায় কিছু খুঁজে ফিরছে।”ড্রাগন এবং মানবীর মিলন কখনো শুভ ফল বয়ে আনেনি।আমি আমার সন্তানকে হারাতে পারবো না।”
রাজ্যের আকাশ ভারী হয়ে উঠলো।এক নতুন ঝড়ের পূর্বাভাস যেন ভেসে আসছিল।ড্রাকোনিস জানতেন,সামনে যে লড়াই আসছে,তা কেবল জ্যাসপারের নয়,পুরো জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
এদিকে,পৃথিবীতে ফিওনা হয়তো বুঝতেই পারেনি যে তাদের নিষ্পাপ সম্পর্কের কারণে ভেনাসের শিখরে এমন ঝড় উঠেছে।কিন্তু জ্যাসপার? সে জানে,তার সামনে দুটি পথ—ফিওনার কাছে থাকা,অথবা তার নিজের জাতি এবং পরিবারের ঐতিহ্য রক্ষা করা।

ফ্লোরাস রাজ্যের রাজা জারেন অ্যালিসার পিতা,এক অত্যন্ত শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমান ড্রাগন,তার সোনালি রাজকীয় চাদর গায়ে জড়িয়ে বন্দিশালার দীর্ঘ করিডোর ধরে হাঁটছিলেন। চারপাশে শুধু নিঃস্তব্ধতা।এই বন্দিশালা ভেনাসের গভীরতম অঞ্চলে অবস্থিত,যেখানে অপরাধীদের রাখা হয়,তবে এখানে বন্দিদের অধিকাংশই ড্রাগন জাতির উচ্চ শ্রেণির সদস্য।
শেষে এসে তিনি থামলেন এক কক্ষের সামনে।কক্ষটি অন্যসব কক্ষের চেয়ে আলাদা।কক্ষের ভেতরে একটি আলোকিত স্ফটিক ল্যাম্প ঝুলছে,আর তাতে আলো ছড়াচ্ছে।কক্ষের মাঝখানে একটি চেইনে বাঁধা একজন নারী বসে আছেন—ফ্লোরাস রাজ্যের প্রাক্তন রাজকন্যা লিয়ারা,যিনি একসময় পৃথিবীর একজন মানবের প্রেমে পড়েছিলেন এবং নিজের জাতির সব নিয়ম ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন।

“তুমি এখনো সেই পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে যাচ্ছ?” জারেন ধীর কণ্ঠে বললেন,কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে।
লিয়ারা মাথা তুললেন।তার চুলগুলো কিছুটা এলোমেলো,কিন্তু তার চোখ এখনো গর্ব এবং দুঃখের মিশ্রণ। “আমি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি না,জারেন ভাইয়া।আমি দেখি আমার জীবনের একমাত্র প্রেমিকের স্বপ্ন।যে ভালোবেসেছিল আমাকে,যে আমাকে এমনভাবে আপন করেছিল,যা আমাদের জাতির কোনো ড্রাগন কখনো পারেনি।”
“তুমি জানো,তোমার এই ভালোবাসা আমাদের জাতির জন্য কী ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারত,” জারেন গম্ভীর স্বরে বললেন। “তুমি তোমার জাতি,তোমার পরিবার,এমনকি আমাদের পুরো ড্রাগন ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে গিয়েছিলে।”
লিয়ারা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন,চেইনের বাঁধন তাকে আটকে রেখেছে। “আপনারা আমাকে এখানে বন্দি করে রাখতে পারেন,কিন্তু আমার ভালোবাসা মুছে ফেলতে পারবেন না।আর আপনি জানেন না,আমি আর সেই মানব—আমাদের এক সন্তান হয়েছিলো।”

জ্যারেন চমকে উঠলেন,কিন্তু তার মুখের ভাব বজায় রাখলেন। “তোমার সন্তান?তুমি এত বছর ধরে এটি গোপন করেছিলে?সে কোথায়?”
“আমি জানি না।” লিরায়ার গলা কাঁপল। “আমি জানি না সে ছেলে ছিলো নাকি মেয়ে।আমি জানি না সে এখনো জীবিত আছে কি না।কিন্তু আমার অন্তর বলে,সে বেঁচে আছে,জারেন ভাইয়া।আর তার রক্তে ড্রাগনের শক্তি মিশে আছে।”

জ্যারেন কিছুক্ষণ নীরব রইলেন।তার চোখে ভাবলেশহীন দৃষ্টি,কিন্তু তার মনের মধ্যে প্রশ্নের ঝড় বইছিল। “তুমি জানো,এই কথা যদি এল্ড্র রাজ্যের রাজা জানতে পারে,তাহলে সে তোমার সন্তানকে পৃথিবী থেকে খুঁজে আনতে কিছুতেই দ্বিধা করবে না।ড্রাগন এবং মানবের মিলনে জন্ম নেওয়া সন্তান সবসময় বিপদের কারণ হয়েছে।”
লিরায়া কঠিন দৃষ্টিতে জারেনের দিকে তাকালেন। “আপনারা সবসময় ভালোবাসাকে ভয় করেন।আপনি আর ড্রাকোনিস একই ধরনের।কিন্তু আমি জানি,সেই সন্তান পৃথিবীতে কোথাও বেঁচে আছে।এবং তার মাধ্যমেই একদিন ড্রাগন জাতির ভাগ্য বদলাবে।”
জারেন ধীরে ধীরে পেছনে সরে গেলেন।তার ভ্রু কুঁচকে গেল।তিনি জানতেন,এই তথ্য তাকে বিপদের সামনে দাঁড় করাতে পারে।কিন্তু তিনি এটাও জানতেন,এই সন্তানের অস্তিত্ব পৃথিবীর আর ভেনাসের মধ্যে এক নতুন ইতিহাসের সূচনা করতে পারে।

“তোমার স্বপ্নে বিভোর থাকো,লিয়ারা।কিন্তু মনে রেখো, আমি কিছুতেই আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দেব না।যদি তোমার সন্তান বেঁচেও থাকে,আমি তাকে খুঁজে বের করব।এবং নিশ্চিত করব যে সে আর কখনো আমাদের জাতির বিপদ ডেকে আনতে না পারে।”
এই কথা বলে জারেন দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন।তার মনের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ চলছিল।তিনি জানতেন,এই সন্তানের অস্তিত্ব পৃথিবী এবং ভেনাসের শক্তির ভারসাম্যকে চিরদিনের জন্য বদলে দিতে পারে।

ভেনাসের আকাশে সূর্যের মতো উজ্জ্বল এক নক্ষত্র ঢলে পড়েছে।থারিনিয়াস,ড্রাগন জাতির সবচেয়ে বিশ্বস্ত দূত,ধীরে ধীরে ড্রাকোনিসের প্রাসাদে প্রবেশ করল।তার হাতে ছিল এক অনন্য ধাতব বাক্স,যার ভেতরে ছিল ভেনাসের জন্য অপরিহার্য উপাদান—উন্নত প্রযুক্তি এবং শক্তির শুদ্ধ নির্যাস।
ড্রাকোনিস,জ্যাসপারের পিতা এবং এল্ড্র রাজ্যের সর্বোচ্চ শাসক,তার ব্যক্তিগত ল্যাবে উপস্থিত ছিলেন।ল্যাবটি ছিল প্রযুক্তির এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত।স্ফটিক-আধার থেকে নিঃসৃত আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল,আর ল্যাবের কেন্দ্রস্থলে ছিল বিশাল এক পাত্র,যেখানে ভেনাসের পরিবেশের শক্তি এবং উপাদান সংমিশ্রণের জন্য প্রস্তুতি চলছিল।
থারিনিয়াস এসে মাথা নত করল। “সর্বোচ্চ রাজা,সমস্ত উপাদান সংগ্রহ করা হয়েছে।এগুলো সম্পূর্ণ প্রস্তুত।প্রিন্স যখন ফিরে আসবে,তখন এই উপাদান ভেনাসের শক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ব্যবহৃত হবে।”

ড্রাকোনিস মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি দিলেন এবং বাক্সটি গ্রহণ করে সযত্নে ল্যাবের এক নিরাপদ অংশে রেখে দিলেন। “তুমি তোমার দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করেছো থারিনিয়াস।কিন্তু এখন আমাকে অন্য একটি বিষয়ে জানতে হবে।জ্যাসপার পৃথিবীতে অনেক দিন ধরে রয়েছে,আর আমি জানতে পেরেছি যে সে একজন সাধারণ মানবীর সঙ্গে জড়িত হয়েছে।তার লাভ ফাংশনালিটি সক্রিয় হয়ে গেছে।এ বিষয়ে তুমি কী জানো?”
থারিনিয়াস এক মুহূর্ত চুপ থাকল,তারপর ধীরে ধীরে বলল, “হ্যাঁ,কিং। প্রিন্স একজন মানবীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে।তার নাম ফিওনা।আমি দেখেছি সে সেই মেয়েকে রক্ষা করতে তার নিজস্ব শক্তি ব্যবহার করেছে।আমি মনে করি,তার লাভ ফাংশনালিটি সম্পূর্ণ সক্রিয় হয়ে গেছে।এই বিষয়টি পুরো ড্রাগন জাতির জন্য একটি উদ্বেগের কারণ।”
ড্রাকোনিসের চোখে গভীর চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল।তিনি তার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ড্রাগনরা যখনই মানবদের প্রেমে পড়েছে,তখনই বিপর্যয় ডেকে এনেছে।লিরায়ার ঘটনা তোমার মনে আছে তো,থারিনিয়াস? ফ্লোরাস রাজ্যের রাজকুমারী ছিলো,যাকে আমি আর জ্যারেন মিলে নিজের হাতে বন্দি করেছি,কারণ তার প্রেম আমাদের জাতিকে ধ্বং*সের পথে ঠেলে দিয়েছিল।আর এখন আমার নিজের পুত্র!তার এই সিদ্ধান্ত ভেনাসের পরিবেশ এবং শক্তির ভারসাম্যে হু*মকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।”

থারিনিয়াস গভীর কণ্ঠে বলল, “কিং,আমি বুঝতে পারি আপনার উদ্বেগ।কিন্তু ফিওনা শুধুমাত্র একটি সাধারণ মানবী নয়।তার চরিত্র এবং সাহসিকতায় এমন কিছু আছে,যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে।তবে প্রিন্স তার প্রতি এতটাই আকৃষ্ট যে সে তার নিজের শক্তির সীমা অতিক্রম করছে।”
ড্রাকোনিস স্থির দৃষ্টিতে থারিনিয়াসের দিকে তাকালেন। “আমাকে নিশ্চিত করতে হবে,এই সম্পর্কের কারণে ভেনাসের কোনো ক্ষতি না হয়।যদি প্রয়োজন হয়,আমি নিজেই পৃথিবীতে গিয়ে এই সমস্যার সমাধান করব।কিন্তু আমি আশা করি,জ্যাসপার নিজে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবে।ফিওনার কারণে যদি ভেনাসের শক্তির ভারসাম্য বিনষ্ট হয়,তবে তার ফল অত্যন্ত ভয়াবহ হবে।”
থারিনিয়াস মাথা নিচু করে সম্মতি দিল। “আমি আপনার নির্দেশ অনুযায়ী সব ব্যবস্থা নেব, কিং।এবং আমি প্রিন্সকে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাব।”
ড্রাকোনিস তার চোখ তুলে দূরে তাকালেন। তার মুখে দৃঢ়তার ছাপ, কিন্তু ভেতরে গভীর এক দ্বিধা। তিনি জানতেন, জ্যাসপারের ভালোবাসা হয়তো তাদের জাতিকে নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। কিন্তু একজন পিতা হিসেবে, তিনি নিজের ছেলের প্রতি ভালোবাসা আর জাতির দায়িত্বের ভারের মধ্যে আটকে গিয়েছিলেন।

ভেনাসের আকাশে সোনালী সূর্য ক্রমশ অস্তমিত হতে চলেছে। ড্রাকোনিস, এল্ড্র রাজ্যের রাজা,চিন্তিত মনে দেবতা আভ্রাহারের সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।ভেনাসের রক্ষক আভ্রাহারের কাছে যাওয়া মানে ছিল একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের কাছে পৌঁছানো,যেখানে সব সমস্যার সমাধান ছিল।
আভ্রাহারের প্রাসাদটি ছিল বিশাল,অনন্য এক স্থাপত্য, যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শক্তি একত্রিত হয়েছিল। বিশালাকার ড্রাগনের আকৃতির মতো,এটি আকাশের দিকে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল,যেন এটি মহাবিশ্বের সুরক্ষক।প্রাসাদের বাইরে দাঁড়িয়ে ড্রাকোনিস অনুভব করল,ভেনাসের দেবতা সত্যিই অনেক রহস্যময়।
ড্রাকোনিস গভীর শ্বাস নিয়ে প্রাসাদের দিকে প্রবেশ করল। ভেতরে প্রবেশ করেই সে অনুভব করল,সবদিকে রহস্যময় শক্তি বিরাজমান।দেবতা আভ্রাহার সেখানে ছিল,তার সোনালী স্কেল সুর্যের আলোতে ঝলমল করছিল।সে জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ,এবং তার চোখে একটি গম্ভীর দৃষ্টি ছিল।

“রাজা ড্রাকোনিস,”আভ্রাহার তার অমলিন কণ্ঠে বললেন। “তুমি কেন এসেছ?”
“হে মহামান্য দেবতা,”ড্রাকোনিস মাথা নত করে বলল। “আমার ছেলে, ভেনাসের একমাত্র প্রিন্স জ্যাসপার অরিজিন,একটি মানবীর সঙ্গে প্রেমে জড়িত হয়েছে।আমি জানি,আপনি সব জানেন । আমি চাই,আপনি আমাকে এই সম্পর্কে কিছু বলুন।”
আভ্রাহারের চোখে একটি গভীর মৃদু হাসি ফুটে উঠল। “জ্যাসপার এবং ফিওনার সম্পর্কের খবর আমি শুনেছি। তাদের প্রেমের পথ কখনও মসৃণ হবে না।তুমি জানো, ড্রাগনরা যখন মানব প্রেমে পড়ে,তখন ইতিহাসে অনিষ্ট ঘটেছে।”
ড্রাকোনিসের কণ্ঠে উদ্বেগ ছিল। “আমি জানি,কিন্তু আমার ছেলে তার হৃদয়ের টানে বাধা দিতে পারছে না।আমি তাকে বুঝতে চাই,কিন্তু আমার পিতার দায়িত্বের চাপও রয়েছে।”

“প্রেমের চেষ্টায় অনেক কিছু জড়িত,”আভ্রাহার বললেন। “তুমি যদি চাও,আমি তাকে তার সত্যিকার দায়িত্ব বোঝানোর জন্য পাঠাতে পারি।তবে মনে রেখো,এই পথের পরিণতি তোমার জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”
ড্রাকোনিস মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। “আমি জ্যাসপারের ভালোর জন্য চাই,কিন্তু মানব-ড্রাগন সম্পর্ক ভেনাসের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।”
“তুমি যদি তোমার ছেলে আর ফিওনার জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চাও,তবে তাদের স্বাধীনতা দিতে হবে।প্রেম কখনও বাধার সামনে মাথা নত করে না।তুমি নিজেও জানো,তাদের মধ্যে এক শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে উঠছে।কিন্তু এটি তোমার ওপর নির্ভর করছে—তুমি কীভাবে তাদের পরিচালনা করবে।”
ড্রাকোনিসের চোখে দীপ্তি ছিল। “তাহলে, আমি তাদের সম্পর্কের পথে বাধা সৃষ্টি করতে চাই না। কিন্তু আমি কি তাদের এই সম্পর্ককে নিরাপত্তা দিতে পারব?”

“এটি তোমার ক্ষমতায়,” আভ্রাহার বললেন। “যদি তুমি তাদের সহায়তা করতে চাও, তাদের এই সম্পর্কের শক্তি ব্যবহার করো।এটি ভেনাসের শক্তিকে বৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে পারে,যদি তুমি সঠিকভাবে পরিচালনা করো।”
ড্রাকোনিস কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে বলল, “ধন্যবাদ, দেবতা। আমি আপনার পরামর্শ গ্রহণ করব এবং চেষ্টা করব যেন আমি আমার জাতির সুরক্ষা এবং আমার ছেলের ভালোবাসা,দুইটিকে সামঞ্জস্য রাখতে পারি।”
আভ্রাহার একটি মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, “ভালোবাসা এবং শক্তির মধ্যে একটি সুন্দর ভারসাম্য খুঁজে নাও, রাজা।এই কাজের মধ্যে সবকিছুই সম্ভব।”
ড্রাকোনিস প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন, মনে মনে একটি নতুন পরিকল্পনা নিয়ে। আভ্রাহার তার পাথরের মতো কঠিন জ্ঞানের মাধ্যমে তাকে একটি নতুন পথ দেখিয়েছেন, এবং তিনি জানতেন, তাকে তার ছেলের প্রেমের জন্য আরও দৃঢ় হতে হবে।

আভ্রাহার,ভেনাসের দেবতা,প্রাসাদের গোপন কক্ষে প্রবেশ করলেন।কক্ষটি অন্ধকারে মোড়া,যেখানে একটি পুরনো বইয়ের ওপর ধুলো জমেছে।বইটির নাম“ড্রাগনের অমর প্রেমের ইতিহাস,”এবং এটি বহু যুগ আগে রচিত হয়েছিল। দেবতা প্রতিদিনই নানান কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকলেও,আজ তার মনে হলো এই পুরনো ইতিহাসের দিকে একবার নজর দেয়া দরকার।
তিনি আস্তে আস্তে বইটির কাছে গিয়ে ধুলো ঝাড়তে লাগলেন।তখনই হঠাৎ করে বইটির পৃষ্ঠাগুলি নিজে থেকেই খুলে গেল।আভ্রাহার অবাক হয়ে গেলেন।এতোদিন পর কেন যেন একটি অজানা শক্তি বইটির পৃষ্ঠাগুলি খুলতে বাধ্য করেছে।

তিনি বইটির ওপরে নজর রাখলেন।পুরনো কালির অক্ষরগুলোর মধ্যে নতুন কিছু লেখা যোগ হয়েছে।“এটি কি সম্ভব?”দেবতা ভাবলেন,তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।সেই নতুন লেখা ছিল কিছু বিশাল কথামালা,যা বলে উঠছিল যে, ড্রাগন এবং মানবের প্রেমের এই নতুন অধ্যায়টি নাকি ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করতে পারে।
আভ্রাহারের চোখের সামনে সেই লেখাগুলি মনোযোগ সহকারে পড়তে লাগলেন।সেখানে বর্ণনা করা হচ্ছিল, একজন ড্রাগনের প্রেমে পড়ে এক মানবীর আত্মার শক্তি কতটা প্রভাব ফেলতে পারে।লেখায় বলা হয়েছিল,এই প্রেমের ফলে একটি নতুন শক্তিশালী জাতির জন্ম হতে পারে, যেখানে মানব ও ড্রাগন উভয়েই নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে পাবে।
“অদ্ভুত,”আভ্রাহার ভাবলেন।“কেন আমি এতদিন এখানে আসিনি?এই বইটির মধ্যে কত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লুকিয়ে আছে!”

তিনি আরও গভীরভাবে পড়তে লাগলেন এবং বুঝতে পারলেন,সেই ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল জ্যাসপার ও ফিওনার সম্পর্ক।তাদের প্রেমের মধ্যে ছিল এক বিশেষ শক্তি, যা ভেনাসের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করতে পারে।
দেবতা চিন্তায় পড়ে গেলেন।“তাদের প্রেম কি সত্যিই এইভাবে আমাদের ইতিহাসকে পরিবর্তন করবে?আমি কীভাবে তাদের সাহায্য করতে পারি?”

মাউন্টেন গ্লাস হাউজের নীরবতা যখন চারপাশে বিরাজ করছে,রাতের আকাশে তারাগুলি জ্বলজ্বল করছে।হাউজের উজ্জ্বল কাচের দেয়ালগুলি পুরো পরিবেশকে এক অন্যরকম রূপে সাজিয়েছে,কিন্তু ভিতরে,জ্যাসপার গভীর ঘুমে ডুবে আছে।
স্বপ্নের মধ্যে,জ্যাসপার হঠাৎ দেখতে পায় একটি সবুজ ড্রাগন আর একটি বাদামী ড্রাগন আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে।তাদের মাঝে একটি অদৃশ্য বন্ধন রয়েছে,যেন তারা একে অপরের সাথে প্রেমের বাঁধনে আবদ্ধ।সবুজ ড্রাগনটি মৃদুভাবে ঘুরে ফিরে বাদামী ড্রাগনের পাশে থাকে,আর দুজনই খুব সুন্দর আর আকাশের মধ্যে মুক্তভাবে উড়ছে।
কিন্তু হঠাৎ করে,একটি বিপদ ঘটতে শুরু করে।জ্যাসপার দেখছে,বাদামী ড্রাগনটি আচমকা নীচে পড়তে শুরু করে।সে ছটফট করতে করতে মাটিতে আছড়ে পড়ে।জ্যাসপার ভয়*ঙ্করভাবে অবাক হয়ে যায়,এবং তার হৃদয়ে এক অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করে।বাদামী ড্রাগনের মৃ*ত্যু দৃশ্য দেখে সে হতবিহ্বল হয়ে যায়।

“এলিজিয়া!”নামটি তার মুখ থেকে বের হয়ে আসে,যেন এটি কোনো পবিত্র উচ্চারণ।কেন এই নামটি সে বলল,সে তা বুঝতে পারে না।এটি যেন তার অজান্তেই বের হয়ে এসেছে।
জ্যাসপার তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে বসে।হৃদয়ের উত্তেজনা তার দেহে ছড়িয়ে পড়ে,আর সেই ভ*য়ঙ্কর দৃশ্যটির রেশ তার মনে ভাসমান থাকে।সে বুঝতে পারে যে,এটি ছিল তার জীবনের প্রথম স্বপ্ন এবং এত ভ*য়ঙ্কর কেন এটা ঘটেছে। এলিজিয়া নামটি কেন উচ্চারিত হলো,সেই প্রশ্নটি তার মনে ঘুরতে থাকে।
জ্যাসপার শান্ত হতে চেষ্টা করে,কিন্তু অস্থিরতার অনুভূতি তাকে দমিত করতে পারে না।সে জানে,এই স্বপ্নের অর্থ হয়তো গভীর,কিন্তু কিভাবে এর সাথে তার বাস্তবের সম্পর্ক আছে, তা নিয়ে তিনি চিন্তিত।এলিজিয়া কে?কেন এই নাম তার মনে এসেছে?
মাউন্টেন গ্লাস হাউজের স্বচ্ছ দেয়ালের বাইরে রাতের আকাশের তারাগুলি চকচক করছে,কিন্তু জ্যাসপারের মনে অন্য একটি জগতের ভাবনা চলছে।সে মনে মনে ভাবে, “এটি কি কেবল একটি স্বপ্ন,নাকি এর পেছনে কোনো বাস্তবতা আছে?”
সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে কক্ষের কাঁচের দেয়ালের কাছে গেলো,আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো।সেই সবুজ এবং বাদামী ড্রাগনদের প্রেমের স্বপ্ন এখনও তার মনে উজ্জ্বল ছিল,আর এলিজিয়ার নামের রহস্য এখনও তার হৃদয়ে ঝিলমিল করছে।

সকাল বেলার সূর্য হালকা আলোতে পাহাড়ের চূড়াগুলোকে আলোকিত করছে।মাউন্টেন গ্লাস হাউজের কাচের দেয়ালে সোনালী রশ্মি এসে পড়ছে,যা পুরো কক্ষটিকে মায়াবী করে তুলেছে।জ্যাসপার পাশে বসে ফিওনাকে গভীর ঘুমে দেখতে পাচ্ছে।তার মুখাবয়বে এক শান্তির অনুভূতি,নিঃশ্বাসে যেন জাদু।
জ্যাসপার মন মরা,তার চিন্তা প্রবাহিত হচ্ছে। “কেন আমি এমন স্বপ্ন দেখলাম?”সে ভাবতে থাকে। “এলিজিয়া নামটা কি কারণে এল আমার মনে?আমি তো এই নাম আগে কখনো শুনিনি।”
চোখে চোখে তাকিয়ে জ্যাসপার অনুভব করে,”আমার হৃদয়ে শুধু তুমি,হামিংবার্ড।তুমি আমার স্বপ্ন,আমার বাস্তবতা,আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোণে,আমার শিরায় শিরায় শুধু তোমার নাম জড়ানো।”
ফিওনার নিদ্রা যেন একটি স্বপ্নের রাজ্য।জ্যাসপার তার কোমল মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছে,”আমি অন্য কারো নাম কেন বললাম?তোমার কথা ভাবতে ভাবতে এলিজিয়ার নামটি কিভাবে চলে এলো?”

তবে,তার হৃদয়ের গভীরে একটিই অনুভূতি,”তুমি ছাড়া অন্য কাউকে আমি কখনো ভাবতে পারি না হামিংবার্ড”
মৃদু হাসি মুখে ফুটিয়ে সে মনে করে,”এটি কি শুধুই একটি স্বপ্ন?নাকি এর পেছনে কোনো অদৃশ্য বার্তা রয়েছে?” তবে জানে,ফিওনার প্রতি তার ভালোবাসা অটুট এবং সব কিছু ঠিক থাকবে যতক্ষণ না ফিওনা তার পাশে আছে।
সে ফিওনার কাছাকাছি গিয়ে তার কোমল হাতের ওপর হাত রাখে। “এলিজিয়া নামটি কেবল একটি স্বপ্নের অংশ,কিন্তু তুমি আমার জীবনের বাস্তবতা হামিংবার্ড।”
এমন মুহূর্তে জ্যাসপার জানে,ফিওনা তার কাছে থাকলেই সব ঠিকঠাক থাকবে।জীবনের সমস্ত অশান্তি দূর হয়ে যাবে, যতক্ষণ তার হৃদয়ে ফিওনার নাম ভাসছে।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মাউন্টেন গ্লাস হাউজের ল্যাবের চারপাশে পাহাড় আর জলের মৃদু আওয়াজ এক অদ্ভুত নীরবতা তৈরি করেছে।ল্যাবের ভেতরে জ্যাসপার একটি বিশাল স্ক্রিনের সামনে বসে আছে।স্ক্রিনে বিভিন্ন উপাদানের বিশ্লেষণ ভাসছে,কিন্তু তার মন কোথাও আটকে আছে।
ঘুমহীন রাতের সেই স্বপ্ন এখনো তার মনে জ্বলজ্বল করছে। সবুজ আর বাদামী ড্রাগনের আকাশে ওড়ার দৃশ্য,তাদের প্রেমের বন্ধন,আর সেই অদ্ভুত নাম—“এলিজিয়া।”
জ্যাসপার মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে সামলে নিল।তার কাজের মাঝে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করল,কিন্তু সেই স্বপ্নের প্রভাব যেন তাকে ছাড়ছে না।

ঠিক সেই মুহূর্তে স্ক্রিনে একটি সংকেত ভেসে উঠল। ড্রাকোনিস কল করছে।জ্যাসপার দ্রুত কলটি গ্রহণ করল। স্ক্রিনে ড্রাকোনিসের মুখ ভেসে উঠল,শান্ত ও আত্মবিশ্বাসী।
“থারিনিয়াস ঠিকঠাকভাবে উপাদানগুলো নিয়ে ভেনাসে পৌঁছেছে তো ড্রাকোনিস?”জ্যাসপার সরাসরি প্রশ্ন করল।
ড্রাকোনিস একটু থেমে বলল,“হ্যাঁ,থারিনিয়াস তার কাজ সম্পূর্ণ করেছে।সবকিছু সঠিক পথে চলছে।তবে ভেনাসের সেন্ট্রাল ল্যাবে উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।”
“তাড়াতাড়ি করতে বলুন।পরবর্তী মিশনের প্রস্তুতির জন্য আমাদের সেই তথ্যগুলো দরকার।” জ্যাসপারের গলায় দৃঢ়তা।

ড্রাকোনিস মৃদু হাসল। “তুমি তো সবসময়ই এত মনোযোগী মাই সান।তবে পরবর্তী মিশন নিয়ে ভাবার আগে নিশ্চিত হও, অন্য কোনো বিষয় তোমার মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছে না।”
ড্রাকোনিসের কথাগুলো সাধারণ শোনালেও,এর গভীরে যেন কিছু লুকিয়ে ছিল।জ্যাসপার ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকাল। তবে তার মুখে এক ফোঁটা সন্দেহ প্রকাশ করল না।
“আমার মনোযোগ সম্পূর্ণ মিশনে।অন্য কোনো ব্যাপার আমাকে প্রভাবিত করতে পারবে না ড্রাকোনিস”জ্যাসপার দৃঢ়ভাবে বলল।

ড্রাকোনিস কিছু না বলে মাথা নেড়ে হাসল।তার স্বর ছিল স্বাভাবিক,যেন কোনো গোপন ইঙ্গিত দিতে চাইছে না। “তাহলে ভালো মাই সান।আমি ভেনাসে এই বিষয়গুলো তদারকি করছি।তুমি এখানকার কাজ চালিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি মিশন শেষ করে এথিরিয়নকে নিয়ে ফিরে আসো ভেনাসে,পুরো ভেনাস তোমার অপেক্ষায়।”
কথোপকথন স্বাভাবিকভাবেই শেষ হলো।ড্রাকোনিস মিশন নিয়ে আরও কিছু কথা বলল,কিন্তু প্রতিটি বাক্যে যেন একধরনের কৌশল লুকিয়ে ছিল।
কল কেটে যাওয়ার পরও জ্যাসপার কিছুক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল।তার মনে হতে লাগল,ড্রাকোনিস কিছু জানে। তবে কি সে ফিওনার কথা জেনে গেছে?
জ্যাসপার নিজের জায়গা থেকে উঠে ল্যাবের বিশাল কাঁচের দেয়ালের দিকে এগিয়ে গেল।আকাশে একটা তারার আলো ঝলমল করছে সেটা সন্ধ্যাতারা যেটা তার বাসস্থান ভেনাস,কিন্তু তার মনের মধ্যে সেই স্বপ্ন আর ড্রাকোনিসের ইঙ্গিত যেন মেঘ হয়ে জমে আছে।

“ড্রাকোনিস কি সত্যিই কিছু জানে?নাকি এটা কেবল আমার কল্পনা?”নিজেকে প্রশ্ন করল সে।
তবে এক জিনিস পরিষ্কার,কিছু একটা বদলে যাচ্ছে। ফিওনার প্রতি তার অনুভূতি আর ড্রাকোনিসের আচরণ—সবকিছু যেন এক গভীর রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
জ্যাসপার গ্লাস হাউজে ফিরল। রাত গভীর হলেও পাহাড়ের উপর নির্মিত এই বাড়ির ভিতরটা নীরব এবং প্রশান্ত। দরজা খুলে সে সোজা লিভিং রুমে ঢুকল, আর তখনই তার চোখ গেলো সোফায় বসে থাকা ফিওনার দিকে।
ফিওনা একটি বই হাতে ধরে ছিল, কিন্তু জ্যাসপারকে দেখেই বইটি নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল। চোখে অল্প হতাশা আর দীর্ঘ অপেক্ষার ছাপ স্পষ্ট। জ্যাসপার কয়েক পা এগিয়ে এল, মুখে একধরনের অবাক হালকা হাসি।
“হামিংবার্ড, এত রাতে এখনও জেগে আছ? ঘুমাওনি কেন? রাত অনেক হয়েছে,” জ্যাসপার প্রশ্ন করল, তার গলায় একটু বকুনি মিশ্রিত মমতা।

ফিওনা ভ্রু কুঁচকে, তবে মুখে একটু দুষ্টু হাসি এনে বলল, “ঘুম আসবে কিভাবে? সারাদিন তোমার দেখা পাইনি। অপেক্ষা করছিলাম কখন ফিরবে। তোমাকে একবার না দেখলে তো আমার ভালোই লাগে না। সেটা কি তুমি বুঝতে পারো না?”
তার কণ্ঠে অভিমান মিশে ছিল, কিন্তু সেই অভিমান জ্যাসপারকে হাসতে বাধ্য করল।
“তুমি সত্যি একটা পচা ফায়ার মনস্টার,জানো?” ফিওনা হঠাৎ করেই যোগ করল, তার গলার সুর যেন একসাথে রাগ আর ভালোবাসার মিশ্রণ।
জ্যাসপার এক পা এগিয়ে ফিওনার দিকে ঝুঁকল। তার চোখে একধরনের মৃদু শ্লেষ ফুটে উঠল, কিন্তু সুরটি নরম ছিল। “তাহলে পচা ফায়ার মনস্টার হয়েও কি আমার দেখা পাওয়ার জন্য এভাবে অপেক্ষা করবে?”
ফিওনা মুখ ফিরিয়ে একটু গম্ভীর হওয়ার ভান করল। “আর কি করব?আমি তো এমনিই বোকা মানবী।”
জ্যাসপার ফিওনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,“তুমি রাতে খেয়েছো?”ফিওনা মুখ ফিরিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল,“না।খাবো না।খিদে নেই।”

জ্যাসপার ভ্রু কুঁচকে ফিওনার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। “হামিংবার্ড,খিদে না থাকলেও কিছু খেতে হবে।না খেলে অসুস্থ হয়ে যাবে।চলো,তোমাকে খাওয়াতে হবে।”
ফিওনা মাথা নেড়ে বসল,“তোমাকে আমার জন্য ঝামেলা করতে হবেনা আমার খিদে নেই।আমি ঠিক আছি।”
কিন্তু জ্যাসপার এক পা পিছু হটল না।“কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বসো।আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
জ্যাসপার সোজা কিচেনে প্রবেশ করলো।কিচেনে থাকা ফ্রিজ খুলে ভেতর থেকে হালকা ও গরম খাবার বের করল।রাতের জন্য সে স্টিমড ডাম্পলিংস(স্টাফড ভেজিটেবল ও চিকেন দিয়ে তৈরি)ও একটি বাটি মিষ্টি কর্ন স্যুপ গরম করল।
ট্রেতে খাবার সাজিয়ে নিয়ে লিভিং রুমে ফিরে এল।ফিওনা তখনও সোফায় বসে ছিল,হাতের বইটা বেখেয়ালে ধরে রেখেছে।জ্যাসপার খাবারের ট্রেটা টেবিলে রাখল আর ফিওনার পাশে বসল।
“তুমি নিজের খেয়াল রাখতে জানো না,তাই তোমার জন্য আমাকে সবসময় থাকতেই হবে।এখন চুপচাপ খাও।” জ্যাসপার বলল।

ফিওনা মুচকি হেসে বলল,“তুমি তো সবসময় ভয় দেখাও। আর আমিও তোমার হুম*কি বাধ্য।”
জ্যাসপার কোন উত্তর দিল না।সে চামচ তুলে প্রথমে একটি ডাম্পলিং ফিওনার মুখের সামনে ধরল।“মুখ খোলো।”
ফিওনা একটু ইতস্তত করলেও,জ্যাসপারের জেদের কাছে হার মানল।মুখ খুলে এক চামচ খাবার নিল।ডাম্পলিংয়ের নরম মসলাদার স্বাদ তার মুখে মিশে গেল।
“ভালো?”জিজ্ঞেস করল জ্যাসপার।
ফিওনা মৃদু হাসি দিয়ে বলল,“তুমি কি জানো,এমন কেউ আমাকে আগে খাওয়ায়নি মানে গ্ৰান্ডপা আর মিস ঝাং ছাড়া।”

জ্যাসপার হাসল।“আমি সবকিছুই প্রথমবার করি, হামিংবার্ড।আর এখন তুমি কেবল খাও।”
ফিওনা এবার জোর করে বলল,“তুমি নিজেও কিছু খাও। আমি একা খাব না।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে চামচ তুলে নিজের জন্যও এক টুকরো ডাম্পলিং নিল।“ঠিক আছে,আমিও খেলাম। এবার খুশি?”
ফিওনা মুচকি হেসে বলল,“খুশি নই,কিন্তু মেনে নিলাম।”
খাওয়ার সময়,হঠাৎ জ্যাসপার একটি মিষ্টি কর্ন স্যুপের চামচ ফিওনার মুখের সামনে ধরল।ফিওনা চামচ থেকে স্যুপ খাওয়ার পর জ্যাসপার এক মুহূর্ত থেমে তার গালে হালকা একটি চুমু খেল।
ফিওনা চমকে উঠে বলল, “তুমি!চুমু কেনো দিলে?”
জ্যাসপার শান্তভাবে বলল,“তোমার খাবার খাওয়ার পুরস্কার।”

আযদাহা পর্ব ৪৫

ফিওনা লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে বলল,“তুমি সত্যিই পচা।”
জ্যাসপার হেসে উঠল।“হ্যাঁ,তবে আমার হামিংবার্ড এই পচা মনস্টারকেই পছন্দ করে।”

আযদাহা পর্ব ৪৭