আযদাহা পর্ব ৫৬

আযদাহা পর্ব ৫৬
সাবিলা সাবি

সূর্যের আলো ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ফিওনা তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে বারবার চারপাশে তাকাচ্ছে। একঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও জ্যাসপারের কোনো দেখা নেই। তার উদ্বেগ বাড়ছে। “খাবারের খোঁজে গেলো, এতক্ষণ ধরে কী করছে?” ফিওনা নিজের মনেই প্রশ্ন করলো।
তাঁবু থেকে বেশ দূরে, দ্বীপের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে জ্যাসপার। তার চেহারায় দৃঢ়তার ছাপ, হাতের স্মার্ট ঘড়িটাতে দ্রুত আঙুল চালাচ্ছে। বাতাসের শীতল হাওয়ায় তার চুল উড়ছে, কিন্তু সে তাতে কর্ণপাত করছে না। তার চোখ স্ক্রিনে আটকে আছে।

চূড়ার ওপরে একটি সমতল পাথরের উপর দাঁড়িয়ে, জ্যাসপার মিস্টার চেন শিং-এর সঙ্গে সংযুক্ত ডিভাইসে সিগন্যাল পাঠানোর চেষ্টা করছে। স্মার্ট ঘড়িটির বিশেষ ফাংশন “রেসোন্যান্স পিং” ব্যবহার করে সে বারবার একটি সংকেত পাঠাচ্ছে। যদিও মিস্টার চেন শিং বর্তমানে অসুস্থ এবং তার মোবাইল হুয়াং ঝির ল্যাবে পড়ে আছে, জ্যাসপার জানে না এই তথ্য।
ঘড়ির স্ক্রিনে একটি ক্ষুদ্র অ্যানিমেশন ঘুরছে। “লোকেশন পাঠানো হচ্ছে,” স্ক্রিনে এই বার্তা ভেসে উঠেছে। কিন্তু প্রতিবারই সিস্টেম জানিয়ে দিচ্ছে, “সিগন্যাল পৌঁছাতে পারছে না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জ্যাসপারের হাতের স্মার্ট ঘড়ি কেবল সময় দেখানোর যন্ত্র নয়। মিস্টার চেন শিংকে পাহাড় থেকে নামানোর সময়, জ্যাসপার তার স্মার্ট ঘড়ির একটি বিশেষ ফাংশন অ্যাক্টিভেট করেছিল। চেন শিংয়ের মোবাইল ফোনের সাথে জ্যাসপারের এই ঘড়ি ব্লুটুথের মতো এক ধরনের হাইব্রিড তরঙ্গ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংযুক্ত। তবে এটি সাধারণ ব্লুটুথ নয়। এটি ‘ড্রাগন কোডেড ওয়েভলেংথ’ নামে পরিচিত, যা জ্যাসপার তার নিজস্ব গবেষণা থেকে তৈরি করেছে।
এই প্রযুক্তি পৃথিবীর সাধারণ যোগাযোগের সিগন্যাল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এটি এমন এক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, যা কেবলমাত্র ড্রাকোনিসের বুদ্ধিমত্তা এবং জ্যাসপারের মস্তিষ্কের ডিজাইন করা। যেকোনো ডিভাইসের সাথে এই কোডেড সিস্টেম যুক্ত করার জন্য জ্যাসপার কেবল সেই ডিভাইসটির ইলেকট্রনিক কোড স্ক্যান করেছিল। একবার যুক্ত হয়ে গেলে, এটি পৃথিবীর স্যাটেলাইট বা টাওয়ারের প্রয়োজন ছাড়াই সরাসরি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারে।
এটি কাজ করে স্থানীয় ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফ্রিকোয়েন্সি এবং ড্রাকোনিসীয় তরঙ্গ একত্রিত করে। সহজ কথায়, চেন শিংয়ের মোবাইলে একটি অদৃশ্য সিগন্যাল যায়, যা তার কাছে উপস্থিত হয় একটি সাদামাটা টেক্সটের মতো—কিন্তু আসলে এটি একটি সিক্রেট কোডেড বার্তা।

জ্যাসপারের কপালের ভাঁজ গভীর হলো। “এটা কীভাবে সম্ভব? মিস্টার চেন শিং তো এমন ডিভাইস ফেলে রাখার মানুষ নন।তবে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”
সিগন্যালটি পাঠানোর পর জ্যাসপার বুঝতে পারছে যে মিস্টার চেন শিংয়ের মোবাইল থেকে কোনো সাড়া আসছে না। সে বারবার সিগন্যাল পাঠিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কোনো জবাব নেই। তার মাথার ভেতর প্রশ্ন ঘুরছে, “কোথায় গেলো এই মোবাইল?”
প্রকৃতপক্ষে, মিস্টার চেন শিং মিনি স্ট্রোক করার পর তিনি এখন বেড রেস্টে আছেন।তার মোবাইলটি তার বন্ধু হুয়াং ঝির ল্যাবে পড়ে আছে।ফলে সিগন্যাল সেখানে পৌঁছালেও,সেটি এখন কার্যকর কোনো কাজ করতে পারছে না।এইদেকে জ্যাসপারের হাতে সময় খুবই কম।ফিওনাকে নিরাপদে চীনে ফিরিয়ে দেয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।কিন্তু মনের গভীরে চাপা এক অস্বস্তি কাজ করছে। সে জানে,এই সিগন্যালের সফলতা নির্ভর করছে সঠিক অবস্থানে ডিভাইসটির উপস্থিতির উপর।

দ্বীপের চূড়ায় বাতাসের শো শো শব্দ।জ্যাসপারের চারপাশে গাছের পাতাগুলো নড়ছে।তার শক্ত হাত স্মার্ট ঘড়িটা চেপে ধরে আছে।পাথরের চূড়া থেকে নিচে তাকালে দ্বীপের সবুজ আচ্ছাদিত সৌন্দর্য দেখা যায়,কিন্তু সে তা দেখতে পাচ্ছে না। তার মন অন্য জগতে আটকে আছে।
ফিওনা তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে,তার চোখে চিন্তার ছাপ। সে জানে না জ্যাসপার আসলে কী করছে এতক্ষন।তার কেবল একটাই প্রশ্ন, “এত দেরি করছে কেনো?”

জ্যাসপারের সামনে হঠাৎই একটা উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠলো।আলোটা দ্রুতই একটা ছোট্ট পরির আকার নিলো। তার পরিপাটি সাদা ডানা সূর্যের আলোয় চকচক করছে। মাথার চারপাশে মৃদু সোনালি আভা।ছোট্ট গাঢ় নীল পোশাক পরা পরি একধরনের স্বর্গীয় সৌন্দর্য বহন করছে।তার পায়ের নূপুরের ঝংকার বাতাসের সঙ্গেও যেন সুর মিলিয়ে বাজছে।
পরি উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে বললো,”প্রিন্স অরিজিন!!আমার সুদর্শন রাজকুমার আপনি আবার এসেছেন!এত বছর পর আপনার দর্শন পেয়ে আমি ধন্য।”

জ্যাসপারের মুখে বিস্ময়ের হাসি ফুটে উঠলো।”আরে,লিটল অ্যাঞ্জেল!তুমি?”
পরি উড়ে জ্যাসপারের সামনে এসে মিষ্টি হেসে বললো, “আমাকে চিনতে পেরেছেন তাহলে?”
জ্যাসপার এক পলক তাকিয়ে বললো, “কেন চিনবো না!দশ বছর আগে যখন এই দ্বীপে এসেছিলাম,তোমার সাথেই তো প্রথম পরিচয় হয়েছিল।তুমি তখন এতটাই ছোট্ট ছিলে যে আমার আঙুল ধরেই উড়তে চেষ্টা করছিলে।”
পরি মিষ্টি স্বরে বললো, “আপনার সেই কথা এখনো মনে আছে!আমি আপনাকে আবার ও দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। এই দ্বীপের রক্ষক আমার বাবা আমাকে বলেছিলেন, একদিন আপনি আবার ফিরবেন।
সিলভেরা এই দ্বীপের রক্ষক পরিদের রাজকন্যা।তার ডানাগুলো মুক্তোর মতো উজ্জ্বল এবং নীলাভ আভায় মোড়ানো।তার গলায় একটি ক্ষুদ্র রূপার লকেট ঝুলছে,যেটা তাকে তার শক্তি সংরক্ষণে সাহায্য করে।সিলভেরা খুব চঞ্চল, কিন্তু একইসঙ্গে বুদ্ধিমতী এবং সহায়ক।দ্বীপের প্রতিটি গোপন পথ তার জানা,আর তার মিষ্টি হাসি যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিকেও আনন্দময় করে তোলে।

সিলভেরা কিছুক্ষণ উড়ে জ্যাসপারের চারপাশে চক্কর দিলো। তার উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন,”তা আমার সুন্দরের দেবতা, আপনি কি এবারও দ্বীপে একাই এসেছেন?আগেরবারের মতো?”
জ্যাসপার সামান্য থমকে গেলো।কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে গভীর চোখে সিলভেরার দিকে তাকালো। তারপর গভীর, ভারী কণ্ঠে উত্তর দিলো,”না,আসলে আমি এবার ফিওনার সাথে এসেছি।আর এসেছি বললে ভুল হবে।আমরা দুজনে আপাতত এখানে আটকা পড়ে গেছি।”
সিলভেরার চোখে কৌতূহলের ঝিলিক ফুটে উঠলো। “ফিওনা?”সে তার মাথা একটু কাত করে চিন্তায় পড়লো। তারপর হালকা হাসি দিয়ে বললো,”মনে হচ্ছে কোনো নারী। সে কি হয় আপনার?”
জ্যাসপারের মুখে সামান্য বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো।তার চোয়াল শক্ত হলো।সে মৃদু গলায় বললো, “সে আমার… সে আমার একজন ‘জরুরি’সঙ্গী।”
সিলভেরা হেসে বললো,”জরুরি সঙ্গী?হাহ!সুন্দরের দেবতা, আপনার মতো কারো জরুরি সঙ্গীর প্রয়োজন পড়ে?”
জ্যাসপার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”সবকিছু তোমার মতো সহজ নয়,সিলভেরা।আর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।”

পরি একটু রাগী ভঙ্গিতে বললো, “ওহ,আপনি আবার আপনার প্রিন্স মেজাজে চলে গেলেন!তবে আমি ফিওনাকে দেখতে চাই।শুনুন,কোনো নারী যদি আপনাকে আটকা পড়তে বাধ্য করে,তবে তার অবশ্যই বিশেষ কিছু আছে।”
জ্যাসপার মৃদু হেসে বললো,”বিশেষ কিছু?হয়তো বা।”
জ্যাসপার সামনে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে, আপাতত আমাকে কিছু খাবার জোগাড় করে দাও। ফিওনার জন্য কিছু দরকার।”
পরি সিলভেরা তার ছোট্ট ডানা ঝাপটিয়ে একটু এগিয়ে এল। তার মুখে চঞ্চল হাসি। “ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমার সুদর্শন রাজকুমার! তা আপনার ফিওনা কি ড্রাগন?”
জ্যাসপার শান্ত গলায় বলল, “না, সে মানবী।”
শুনে সিলভেরা এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। তার চোখে বিস্ময়ের ঝিলিক ফুটে উঠল। “মানবী?” সে এত ধীরে বলল যেন নিজেকেই প্রশ্ন করছে। তারপর একটু হাসল, “একজন মানবী! আপনি সত্যিই একজন মানবী নিয়ে এসেছেন এই দ্বীপে? অসম্ভব সুন্দর রাজকুমার আর একজন মানবী… কী অদ্ভুত জুটি!”
জ্যাসপার তার গম্ভীর মুখে একটুও পরিবর্তন না এনে বলল, “খুব বেশি কথা বলো না, সিলভেরা। আমি যা বলেছি, সেটা করো।”

সিলভেরা হেসে বলল, “ঠিক আছে, প্রিয় রাজকুমার। তবে মানবী হলেও নিশ্চয়ই সে বিশেষ কেউ। তা না হলে আপনি তাকে এখানে আনতেন না।”
জ্যাসপার আর কিছু বলল না। শুধু তার চোখে এক ঝলক দৃঢ়তা দেখা দিল। সিলভেরা সেটা লক্ষ করল কিন্তু আর কিছু বলেনি। তার ছোট্ট ডানাগুলো মৃদু আওয়াজ তুলে সে গাছের ভেতর দিকে উড়ে গেল, খাবার সংগ্রহের জন্য।
ফিরে আসার সময় তার হাতে একটি ছোট্ট ঝুড়ি। ঝুড়িতে ছিলো কয়েকটা বিচিত্র রঙের ফল, মধু আর কয়েকটা এমন ফুল যা পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না। ঝুড়ি বাড়িয়ে সিলভেরা বলল, “এই নিন, রাজকুমার। মানবীর জন্য আমি আমার সেরা ফল আর মধু নিয়ে এসেছি।”

জ্যাসপার কিছু না বলে ঝুড়ি হাতে নিল। সিলভেরা এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “রাজকুমার, আপনার এই মানবীকে একবার দেখে যেতে হবে। যে আপনাকে এই দ্বীপে ফিরিয়ে আনতে পারে, সে তো অবশ্যই বিশেষ কেউ.”
অবশেষে জ্যাসপার ফলের ঝুড়ি হাতে নিয়ে ধীর পায়ে তাঁবুর দিকে হাঁটা ধরল।তার পাশেই উড়ে উড়ে এগোচ্ছিল সিলভেরা।তার ছোট্ট ডানা থেকে মৃদু আলো ঠিকরে পড়ছিল।
“তোমার এই মানবীটা কে,রাজকুমার?”সিলভেরা বলল, কৌতূহল ঝরে পড়ছিল তার কণ্ঠে।“তাকে তো দেখতে হবে! এমন কী জাদু আছে তার মধ্যে,যার জন্য স্বয়ং ড্রাগন প্রিন্স—যার হৃদয়ে কোনোদিন আবেগ কাজ করেনি—তাকে এখানে নিয়ে এসেছে?”
জ্যাসপার কোনো জবাব দিল না।তার গম্ভীর মুখের রেখা একটুও নড়ল না।সে একদৃষ্টিতে তাঁবুর দিকে তাকিয়ে রইল।

“ওহ,রাজকুমার,তুমি কিছু বলছো না মানে এটা আরো বেশি রহস্যময়!” সিলভেরা ফিসফিস করে বলল। “তোমার এই মানবীকে দেখতে আমার খুব ইচ্ছে করছে।সে নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী কেউ।”
“সিলভেরা,” জ্যাসপার অবশেষে বিরক্তির সুরে বলল, “আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না।সে কে,কেন এখানে,তা জানার তোমার কোনো প্রয়োজন নেই।তোমার কাজ ছিল খাবার আনা,সেটা তুমি করেছো তার জন্য তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।এখন ফেরত যাও সাবধানে।”
সিলভেরা হাসল। “আমি বুঝতে পারছি,রাজকুমার।কিন্তু এতদিন পর তোমাকে এমনভাবে দেখছি—যেন তুমি সত্যিই কিছু অনুভব করছো।আর এটা আমি মিস করতে চাই না। তোমার মানবীকে একবার দেখা দরকার।”
জ্যাসপার থামল না।“তোমার এই কৌতূহল একদিন তোমাকে সমস্যায় ফেলবে,সিলভেরা।”
সিলভেরা তার ডানায় ভর দিয়ে একটুখানি উপরে উঠে বলল, “সমস্যায় তো তুমিই পড়েছো,প্রিয় রাজকুমার।আর তা-ও একজন মানবীর কারণে।আমি শুধু দেখতে চাই,তার মধ্যে এমন কী আছে,যা এত শক্তিশালী ড্রাগনকেও দুর্বল করতে পারে।”

জ্যাসপার আর কিছু না বলে তাঁবুর পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকল। সিলভেরা এক পলকের জন্য দ্বিধায় দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, “মানবীটা কে, তা দেখতেই হবে।” এবং সে উড়তে উড়তে তাঁবুর ভেতরে ঢুকে পড়ল।
তাঁবুর ভেতরে ঢুকতেই ফিওনা দ্রুত উঠে দাঁড়াল। “তুমি এতো দেরি করলে কেনো, জ্যাসপার? কোথায় ছিলে এতক্ষণ?” তার গলায় অভিযোগের সুর।
জ্যাসপার কোনো কথা বলার আগেই সিলভেরা ভেসে এল। ছোট্ট ডানাগুলো আলতো ঝাপটা দিয়ে সে ফিওনার সামনে এসে দাঁড়াল। ফিওনা বিস্ময়ে থমকে গেল। এমন ছোট, জীবন্ত, উজ্জ্বল আলোয় মোড়া পরি সে আগে কখনো দেখেনি। তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
“তুমি… তুমি কি একটা পরি?” ফিওনা ফিসফিস করে বলল।

সিলভেরা হেসে উঠল। “হ্যাঁ, সুন্দরী মানবী, আমি একেবারে সত্যিকারের পরি। আমার নাম সিলভেরা, কিন্তু প্রিন্স আমাকে আদর করে ‘লিটল এনজেল’ বলে ডাকে। আমি এখানকার রক্ষকের মেয়ে।”
“অবিশ্বাস্য!” ফিওনা মুগ্ধ দৃষ্টিতে সিলভেরার দিকে তাকিয়ে রইল। “আমি কখনো ভাবিনি যে এমন কিছু দেখতে পাবো। তুমি… তুমি সত্যিই অসাধারণ।”
জ্যাসপার কিছু না বলে খাবারের ঝুড়ি রেখে এক পাশে দাঁড়াল। সিলভেরা মিষ্টি হেসে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি খুব মজার, ফিওনা। তা, বলো তো, এই ড্রাগন প্রিন্স তোমার কী হয়?”
ফিওনা এক মুহূর্ত থেমে গেল। তারপর আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল, “আমার বয়ফ্রেন্ড।”
“বয়ফ্রেন্ড?” সিলভেরা একেবারে বিভ্রান্ত হয়ে গেল। “বয়ফ্রেন্ড মানে কী?”
ফিওনা একটু হাসল। “মানে আমার প্রেমিক। আমার ভালোবাসার মানুষ।”

সিলভেরার মুখে বিস্ময়ের ছাপ। সে জ্যাসপারের দিকে তাকাল। “আমি জানতাম এটা হবে! অথচ প্রিন্স, আপনি আমাকে বললেন আপনি কখনো কাউকে ভালোবাসবেন না। আমাকে বললেন আপনার মধ্যে আবেগ কাজ করে না। কিন্তু এখন? এই মানবীকে তো আপনি ভালোবেসেছেন, তাই না?”
জ্যাসপার কোনো উত্তর দিল না। তার চেহারা কঠিন ও অপ্রকাশ্য রইল।
সিলভেরা আবার বলল, “আপনি আমাকে মিথ্যে বললেন কেনো? আমি তো কখনো কষ্ট পেতাম না। বরং আমি খুশিই হতাম। হ্যাঁ, প্রিন্স, আমি আপনাকে পছন্দ করি। এখনও করি। আপনার মতো সুদর্শন রাজকুমারকে কে না পছন্দ করবে?”

ফিওনা এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তার ভেতরে যেন হঠাৎই একটা অজানা ঈর্ষার বোধ জেগে উঠল। কিন্তু মুখে কিছু না বলার চেষ্টা করল। সিলভেরা তখনো হাসছিল, আর তার চোখে দুষ্টু উজ্জ্বলতা খেলে যাচ্ছিল।
সিলভেরা ফিওনার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বলল, “তবে শোনো, সুন্দরী মানবী কন্যা। তুমি যতই তার প্রেমিকা হও না কেন, তোমার এই প্রেমিকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে সবার আগে। তুমি তো এই দ্বীপে এসেছো জীবনে প্রথমবার, আর আমি? আমি এবং প্রিন্স এই দ্বীপে অনেক স্মৃতি কাটিয়েছি, জানো? এমন কিছু সময় যা তোমার কল্পনারও বাইরে।”
ফিওনার ভেতরে যেন আগুন জ্বলে উঠল। কিন্তু মুখে সে কিছু প্রকাশ করল না। কেবল ঠোঁট শক্ত করে চেপে রইল। তার মনের ভেতর একটাই কথা বাজছিল, “এই ছোট্ট পরি নিজেকে কী ভাবে? আর জ্যাসপার, সে কেনো এমন সব কথা সহ্য করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে?”

সিলভেরা এবার জ্যাসপারের দিকে ঘুরে তাকাল। “প্রিয় প্রিন্স, আপনার সঙ্গে আড্ডা দেওয়াটা সবসময়ই আনন্দের। আপনার এই মানবী প্রেমিকা বেশ আকর্ষণীয়। তাকে ভালো করে দেখার সুযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু এখন আমাকে যেতে হবে। দ্বীপের অন্য দিকেও আমার দায়িত্ব আছে, জানেন তো।”
জ্যাসপার ঠান্ডা গলায় বলল, “যাও তাহলে, লিটল এনজেল। তোমার কাজগুলো সেরে নাও।”
সিলভেরা বিদায় জানিয়ে উড়ে চলে গেল। ফিওনা এক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জ্যাসপারের দিকে তাকাল। কিন্তু সে কিছু বলল না। শুধু মাথা ঘুরিয়ে তাঁবুর অন্য কোণে গিয়ে বসে পড়ল, যেন কিছুই ঘটেনি।
জ্যাসপার বুঝতে পারল, ফিওনার মনের ভেতর ঝড় উঠেছে। কিন্তু তার অভিব্যক্তি একেবারে অটল রইল। সে শুধু চুপচাপ তাঁবুর এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকল, যেন সবকিছু স্বাভাবিক।

ফ্লোরাজ রাজ্যের বন্দিশালার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তখনো নিস্তব্ধতা। লিয়ারার চিৎকার বন্দিশালার প্রাচীরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। এক ভৃত্য তার জন্য খাবার নিয়ে গেলে, লিয়ারা সেটি হাতের আঘাতে ফেলে দিলো মেঝেতে। তার চোখ দুটো ক্রোধ আর বেদনার অশ্রুতে লাল। খবরটি দ্রুত রাজা জারেনের কানে পৌঁছালো। রাজা জারেন শীঘ্রই বন্দিশালায় প্রবেশ করলেন। তার উপস্থিতি যেনো শীতল বাতাসের মতো লিয়ারার উন্মত্ততা খানিকটা শান্ত করলো।
“ভাই!” লিয়ারা আবেগঘন কণ্ঠে ডাকলো। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছিল। “আপনি আমাকে বন্দি করে রেখেছেন ১৮ বজ্রকাল ধরে। আমি সেই অপরাধের শাস্তি পাচ্ছি, যার কারণ পৃথিবীতে আর নেই। কেনো এমন করছেন? আমাকে মুক্তি দিন। আমাকে আমার সন্তানকে খুঁজে পেতে দিন। আমি তাকে একবার দেখতে চাই। সে ছেলে না মেয়ে? কেমন দেখতে? একবার শুধু জানার সুযোগ দিন।”

জারেন গভীর দৃষ্টিতে লিয়ারার দিকে তাকালেন। তার চোখে কঠোরতা আর একধরনের অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব। “লিয়ারা, তুমি একজন ড্রাগন। অথচ তুমি মানুষের গর্ভধারণ করেছো। সেই সন্তানের জন্ম প্রকৃতির নিয়মের বাইরে। তুমি কি বুঝতে পারছো, এ ঘটনা ভেনাসের নীতিকে অপমানিত করেছে?”
“আমি কোনো নিয়ম মানতে চাই না, ভাই। আমি শুধু জানতে চাই আমার সন্তান বেঁচে আছে কিনা। তাকে একবার দেখতে চাই।” লিয়ারার কণ্ঠে মায়ের আকুতি ফুটে উঠলো।
“তুমি কি করে চিনবে তাকে, লিয়ারা? সে কি বেঁচে আছে, সে কি এখনো তোমারই সন্তান, নাকি কিছু অজানা দুর্বিপাকের শিকার?”

“আমি তাকে চিনবো। আমার মাতৃসত্তা তাকে চিনে নেবে, তার অস্তিত্ব অনুভব করবে। আমি তাকে খুঁজে বের করবো,” লিয়ারা দৃঢ়তার সাথে বললো।
জারেন এক মুহূর্তের জন্য নীরব রইলেন। তারপর বললেন, “আমাকে কিছু সময় দাও, লিয়ারা। আমি রাজা ড্রাকোনিসের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।”
তিনি আরও কিছু না বলে হনহন করে প্রকোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে গেলেন। লিয়ারা তখন মেঝেতে বসে পড়লো,তার চোখে ছিলো অনন্ত অপেক্ষার ছবি।

বিকেল থেকে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। আকাশের লালচে আভা ম্লান হয়ে চারপাশে একটা অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছে। ফিওনা পাথরের ওপর বসে আছে, গোধূলির শেষ আলো তার মুখে পড়েছে। সে আনমনে দূরে তাকিয়ে, মুখে অভিমানের ছাপ।
জ্যাসপার তাঁবুর ভেতর থেকে বেরিয়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। “ফিওনা, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এবার তাঁবুর ভেতরে চল। এখানে দ্বীপে যেকোনো সময় প্রকৃতি বদলে যেতে পারে। এটা নিরাপদ নয়।”
ফিওনা কোনো দিকে না তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল, “তুমি যাও, আমি এখানে থাকব।”

জ্যাসপার কিছুটা বিরক্ত হলো। “ফিওনা, এতো জেদ করছো কেন? কী হয়েছে? তুমি এমন আচরণ করছো কেন?”
ফিওনা এবার তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে বলল, “তুমি জানতে চাও? সিলভেরা। ওই পরিটাকে নিয়ে তুমি কীভাবে এতো সময় কাটিয়েছো? নিশ্চয়ই গভীর কিছু ছিলো না?”
জ্যাসপারের ভ্রু কুঁচকে গেল। “তুমি কী বলতে চাইছো? ও একটা ছোট পরি, ফিওনা। তুমি এই অদ্ভুত ধারণা কোথা থেকে আনছো?”
ফিওনা রাগ চেপে বলল, “তোমার তো লাভ ফাংশনাল ডিলিট ছিলো, আবেগ ছিলোনা, নারীদের প্রতি আকর্ষণ ছিলোনা। তবে সিলভেরার সঙ্গে কী ছিলো?এতো গল্প,এতো স্মৃতি! আমি কি ভুল বলছি?নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে খুব ‘বিশেষ’ কিছু সময় কাটিয়েছো,তাই না?”

জ্যাসপার হালকা হেসে মাথা নাড়ল। “তুমি সত্যিই এটা বিশ্বাস করো?একটা ছোট পরি,যে আমার হাতের আঙুলের সমান,তাকে নিয়ে আমি কি…”
ফিওনা তৎক্ষণাৎ তাকে থামিয়ে বলল, “থাক! আমি কিছু শুনতে চাই না। তুমি যাও। আমি এখানেই থাকব।”
জ্যাসপার এবার আর কিছু বলল না। তার দৃষ্টি একটু কঠিন হয়ে উঠল।”তবে থাকো বসে,যদি পড়ে বিপদে পড়ো,দোষ কিন্তু আমার না।আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি।”
এটা বলেই জ্যাসপার তাঁবুর দিকে ফিরে চলে গেল।ফিওনা তার অভিমানের আগুনে আরও জ্বলে উঠল।কিন্তু সে স্থির বসে রইল,যেন তার সিদ্ধান্ত অপরিবর্তনীয়।

বাইরে রাত নেমে এসেছে।তাবুর ভেতরে বসে জ্যাসপার খানিকটা অস্থির। ফিওনা এখনো ফিরে আসেনি। অপেক্ষার প্রহর যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।হঠাৎই তাবুর ভেতর অস্বাভাবিক ঠান্ডা অনুভূত হলো।জ্যাসপার দ্রুত তাবুর চেইন খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখল চারপাশে তুষারপাত শুরু হয়েছে, প্রকৃতি যেন হঠাৎ করেই তার রূপ বদলে ফেলেছে।
ফিওনা তখনো সেই পাথরের ওপর বসে আছে।তার অভিমান এতটাই প্রবল যে সে নিজের দিকে আসা বিপদের তোয়াক্কা করছে না।জ্যাসপারের ভেতর এক অদ্ভুত আতঙ্ক জাগল। তুষারের নিচে তাকে এমন একা বসে থাকতে দেখে সে আর অপেক্ষা করতে পারল না।

“ফিওনা!” চিৎকার করে কাছে গিয়ে দেখল,ফিওনা একদম শক্ত হয়ে গেছে।তার হাত বরফের মতো ঠান্ডা।জ্যাসপার ফিওনার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল,ঠোঁটজোড়া কালসেটে হয়ে গেছে,শরীরের রক্তপ্রবাহ যেন থমকে গেছে।
“তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?এখনো এভাবে বসে আছো কেন?” জ্যাসপার আর কথা না বাড়িয়ে ফিওনাকে কোলে তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি তাবুর ভেতরে ঢুকে পড়ল।
তাবুর মেঝেতে ফিওনাকে শুইয়ে দিলো।তুষারের ঠান্ডা তার শরীরের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছে।ফিওনার নিস্তেজ মুখ দেখে তার নিজের ভেতর একটা অদ্ভুত ব্যথা জেগে উঠল।
“তুমি এত জেদ করছো কেন,ফিওনা?এভাবে নিজের ক্ষতি করছো কেন?”জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার ঠান্ডা হাতগুলো নিজের হাতে মুঠো করে চেপে ধরল,যেন তার শরীরের তাপ দিয়ে ফিওনাকে উষ্ণ করতে পারে।
বাইরের প্রকৃতি যেন ক্রমেই আরো নির্মম হয়ে উঠছে। তুষারপাত এতটাই অস্বাভাবিক যে দ্বীপের শীতল পরিবেশ এক অন্যরকম শ্বেতশুভ্র আচ্ছাদনে ঢাকা পড়েছে। জ্যাসপার নিজেও ঠান্ডায় কাঁপছে। পাতলা, ফিনফিনে শার্ট তার শরীরের কোনো রক্ষাকবচ হতে পারছে না। ব্লেজারটা কখন যেন হারিয়ে ফেলেছে, তার খেয়াল নেই। তবে তার মনোযোগ পুরোপুরি কেন্দ্রীভূত ফিওনার দিকে।

জ্যাসপার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে দেখল ভেতরে একটি মাত্র পাতলা কম্বল পড়ে আছে। কম্বলটা বের করে ধীরে ধীরে ফিওনার গায়ে জড়িয়ে দিল। কিন্তু ফিওনার কাঁপুনি থামার কোনো লক্ষণ নেই। তার হাত-পা একদম বরফের মতো ঠান্ডা, ঠোঁটের রঙ কালচে হয়ে গেছে।
“আর দেরি করা যাবে না,” জ্যাসপার মনে মনে ভাবল।
সে তৎক্ষণাৎ ফিওনাকে নিজের বুকের মাঝে টেনে নিল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কম্বলটা দুজনের উপর মুড়ে দিল, যেন তাদের শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা হলেও বাড়ে।
জ্যাসপার অনুভব করল ফিওনার ঠান্ডা শরীর তার নিজের ত্বকের সাথে লেগে আছে। তার ভেতরে এক অদ্ভুত সঙ্কল্প জেগে উঠল—কিছুতেই ফিওনাকে এইভাবে হারাতে দেবে না।

“তুমি বোকা মেয়ে,”জ্যাসপার ফিসফিস করে বলল।”এভাবে নিজের জীবন নিয়ে খেলতে আসো কেন?”
ফিওনার মুখের দিকে তাকিয়ে তার ভেতর যেন এক নতুন ধরনের অনুভূতি তৈরি হলো।নিজের শরীরের তাপ দিয়ে ফিওনার কাঁপুনিকে থামানোর চেষ্টা করতে করতে জ্যাসপার যেন নিজের মনের ভেতর এক অদ্ভুত অস্থিরতা টের পেল।
কম্বল মোড়া অবস্থায় জ্যাসপার ফিওনার মাথায় আলতো করে হাত রাখল। “তোমার জন্য কিছুই কি করতে পারছিনা?” তার কণ্ঠস্বর গাঢ় কিন্তু আবেগময়।
বাইরের তুষারপাত আরো জোরালো হচ্ছে।তাঁবুর ভেতর অন্ধকার নেমে এসেছে।কিন্তু জ্যাসপার ফিওনার জন্য জেগে আছে,তাকে উষ্ণতা দিয়ে সুরক্ষিত রাখার প্রতিজ্ঞা করে।

তাঁবুর ভেতর অন্ধকার আর ঠান্ডা যেন আরো বেড়ে গেছে। ফিওনার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে, তার ঠোঁট আরও কালচে হয়ে উঠছে। জ্যাসপার বুঝতে পারল, আর সময় নষ্ট করা যাবে না।
সে তৎক্ষণাৎ লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে আলো করল। আলো ছড়াতেই ফিওনার মুখ স্পষ্ট দেখা গেল—একদম ফ্যাকাসে, যেন প্রাণশক্তি হারাতে বসেছে। তার এই অবস্থা দেখে জ্যাসপারের ভেতর একটা তীব্র দায়িত্ববোধ আর উদ্বেগ কাজ করল।
“এখন আর কোনো উপায় নেই,” জ্যাসপার নিজেকে বলল।
সে দ্রুত নিজের গায়ের পাতলা শার্ট খুলে ফেলল। ফিওনার গায়ের ভারী সোয়েটারটাও খুলে রাখল। ফিওনা তখন কেবলমাত্র ইনার পরে আছে। জ্যাসপার তার শক্ত, উষ্ণ শরীর দিয়ে ফিওনাকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরল। কম্বলের নিচে দুজনকে সম্পূর্ণ মোড়া অবস্থায় শক্ত করে চেপে রাখল।

ফিওনার শরীর এতটাই ঠান্ডা হয়ে গেছে যে তার কাঁপুনি থামছেই না। জ্যাসপার অনুভব করল, তার নিজের শরীরের উষ্ণতাই এখন একমাত্র ভরসা। ফিওনার মাথার কাছে মুখ এনে সে ফিসফিস করে বলল, “তোমার এই অবুঝ জেদের জন্য নিজেকে আর কতবার বিপদে ফেলবে?আমি তো তোমাকে এইভাবে শেষ হতে দিতে পারি না হামিংবার্ড।”
ফিওনার কাঁধে হাত রেখে নিজের শরীরের উষ্ণতা দিতে দিতে জ্যাসপার একপ্রকার চুপ করে থাকল। বাইরের তুষারপাতের শব্দ তাঁবুর উপর আঘাত করছে, আর ভেতরে তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ মিশে এক অদ্ভুত নীরব পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
“হামিংবার্ড,তুমি আমাকে আরো বেশি উন্মাদ বানিয়ে দিচ্ছ,” মনে মনে বলল জ্যাসপার।তার ভেতরের কঠিন,আবেগহীন ড্রাগন হৃদয় যেন মুহূর্তে গলে যেতে চাইছে।

তাঁবুর ভেতরে অদ্ভুত এক শান্তি। বাইরের তুষারপাত মুহূর্তেই থেমে গেছে, আর ভেতরে জ্যাসপারের উষ্ণ শরীরের সান্নিধ্যে ফিওনার সব ঠান্ডা গায়েব হয়ে গেছে। ফিওনা ধীরে ধীরে চোখ মেলল। প্রথমে তার দৃষ্টি ঝাপসা ছিল, কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই স্পষ্ট হলো।
তার সামনে জ্যাসপারের গভীর সবুজ চোখজোড়া। দুজনের চোখের মিলন হলো, যেন পৃথিবীর সব শব্দ হারিয়ে গেছে, শুধু তাদের হৃদস্পন্দন শোনা যাচ্ছে। জ্যাসপারের চোখে চিন্তা, অপরাধবোধ আর একরকম স্নেহ মিশে আছে। ফিওনার চোখে ধীরে ধীরে ফিরে আসা প্রাণের আভা।
জ্যাসপার নিচু গলায় বলল, “এখন কেমন লাগছে?”
ফিওনা প্রথমে কিছু বলল না, কেবল তাকে দেখেই যাচ্ছিল। তার ঠোঁট শুকনো, গলায় কোনো শব্দ আসছে না। অবশেষে হালকা কাঁপা গলায় বলল, “আমি… আমি ঠিক আছি।”
জ্যাসপার একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। “তোমার অবুঝ জেদ তো আমাকে বিপদে ফেলে দিয়েছিলো। যদি তোমার কিছু হয়ে যেত…”

ফিওনা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “তোমার কথা শোনার মতো মন ছিল না তখন।”
জ্যাসপার তার চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, “আমি তো তোমার ভালো চাই। এই জায়গাটা সহজ নয়, ফিওনা। কখনো কখনো প্রকৃতি হুট করে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।”
ফিওনা কোনো উত্তর দিলো না। কেবল তার চোখজোড়া আবারও মুগ্ধ হয়ে আটকে রইল জ্যাসপারের চোখে।
জ্যাসপার ফিওনাকে কম্বলের মধ্যে যত্ন করে শুইয়ে দিয়ে উঠে যেতে চাইলো। কিন্তু ফিওনার শীতল হাতটা তার হাত ধরল, শক্ত করে। চমকে গেল জ্যাসপার। সে পেছন ফিরতেই ফিওনার চোখের দৃষ্টি তার হৃদয়ে ঝড় তুলল—গভীর ভালোবাসায় ভরা, আর কোনো এক অজানা আকাঙ্ক্ষায় জ্বলজ্বল করা।
“থামো না,” ফিসফিস করে বলল ফিওনা, যেন তার কণ্ঠে ছিল আবেগের এক নীরব আহ্বান।
জ্যাসপার সরে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু ফিওনা তাকে যেতে দিল না। হঠাৎ করেই সে তার কোমল, কাঁপা ঠোঁট দিয়ে জ্যাসপারের ঠোঁট আঁকড়ে ধরল। মুহূর্তটা যেন স্থির হয়ে গেল।

জ্যাসপার প্রথমে চমকে উঠে থামাতে চাইল। তার মনের ভেতরে যেন একদিক থেকে যুদ্ধ চলছিল—প্রেম আর দায়িত্বের দ্বন্দ্ব। কিন্তু ফিওনার এই নির্ভীক স্পর্শ, তার গভীর আবেগ, সবকিছু তার আত্মনিয়ন্ত্রণ ভেঙে দিল।
এক সময় জ্যাসপার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। তার হাত ধীরে ধীরে ফিওনার কোমর জড়িয়ে ধরল, আর সে ফিওনার চুম্বনে সাড়া দিল। গভীরতা বাড়তে থাকল, যেন এই মুহূর্তে বাইরের পৃথিবীর অস্তিত্ব পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে।

জ্যাসপার এখন আর নিজের মধ্যে নেই। ফিওনার সাহসী চুম্বন তার ভেতরের সমস্ত বাঁধভাঙা আবেগকে মুক্ত করে দিয়েছে। এতোদিন ধরে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখা আকাঙ্ক্ষা যেন ফুঁসে উঠেছে।
তৃষ্ণার্তভাবে সে ফিওনার নিচের ঠোঁট একবার, ওপরের ঠোঁট একবার শুষে নিচ্ছে। তার চুম্বনের তীব্রতায় যেন ফিওনা শীতের সমস্ত শীতলতাকে ভুলে যাচ্ছে। জ্যাসপার মাঝে মাঝে ঠোঁট কামড়ে, মাঝে মাঝে আদর দিয়ে ফিওনার ঠোঁটজোড়াকে ভরিয়ে তুলছে।
ফিওনা হালকা শীৎকার করে তার গলা জড়িয়ে ধরল। জ্যাসপারের হাত ধীরে ধীরে ফিওনার পিঠে উঠে গেল, তাকে আরো কাছে টেনে নিল।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ঠোঁটজোড়া ছেড়ে দিয়ে হালকা উঠে বসলো।শীতল তুষারপাতে নীলাভ হয়ে থাকা ফিওনার শরীর এখন তার উষ্ণতার ছোঁয়ায় ফিরে পেয়েছে একটি মোহময় আভা।সে ফিওনার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

লণ্ঠনের হালকা আলো ফিওনার ত্বকের উপর পড়ে যেন এক রহস্যময় ছটায় মেলে ধরেছে তাকে। ফিওনার পোশাকের ওপরের আবরন না থাকার ফলে তার পেট, না*ভি, আর বু*কের সৌন্দর্য এখন পুরোপুরি জ্যাসপারের সামনে উন্মুক্ত। তার মসৃণ ত্বক লণ্ঠনের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, আর তা যেন জ্যাসপারের জন্য এক অদম্য আকর্ষণের সৃষ্টি করেছে।
ফিওনার শরীরের প্রতিটি বাঁক,তার কোমল ত্বকের প্রতিটি ছোঁয়া,সবকিছুই জ্যাসপারকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে।তার চোখ নেশার মতো গভীর হয়ে উঠেছে।সে যেন আর চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছে না।
ফিওনার নরম হাত দুটো যখন জ্যাসপারের দিকে বাড়ানো হলো, জ্যাসপার এক মুহূর্ত দেরি না করে তার হাত দুটো শক্তভাবে ধরে টেনে তুলল। ফিওনার কোমল ত্বকের উষ্ণতা জ্যাসপারের হাতের শক্ত মুঠিতে মিশে গেল।
জ্যাসপার তখন দুই হাঁটু গেড়ে বসে ছিল, ফিওনার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে। তার চোখে এক অদ্ভুত মায়া, অথচ ভেতরে যেন লুকিয়ে থাকা উত্তাল ঢেউ খুঁজে পাওয়া যায়।

ফিওনার কোমল, উষ্ণ ঠোঁট জ্যাসপারের শক্তপোক্ত গলার কাছে স্পর্শ করতেই তার সারা শরীরে যেন এক অদ্ভুত ঝড় বয়ে গেল। ফিওনা ধীরে ধীরে জ্যাসপারের গলা থেকে উন্মুক্ত বুকে চুমু দিতে লাগল। তার নরম ঠোঁটের উষ্ণতা আর নিঃশ্বাসের ছোঁয়া জ্যাসপারের স্নায়ুকে উত্তেজিত করছিল।
জ্যাসপার নিজের জায়গা থেকে নড়তে পারছিল না।
তার দুই হাত শক্তভাবে ফিওনার কোমরে গিয়ে থেমে গেল।সে ফিওনাকে নিজের শরীরের আরো কাছে টেনে আনলো,যেন তাদের মাঝে কোনো দূরত্ব না থাকে।তার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠলো,আর তার সবুজ চোখে এক ধরনের গভীর, আদিম আগুন জ্বলতে লাগলো।ফিওনার চোখে দেখা যাচ্ছিল একধরনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা,যা জ্যাসপারের ভেতরের পশু*ত্বকে আরো প্রজ্জ্বলিত করছিল।

“হামিংবার্ড,” জ্যাসপারের গলা থেকে এক গভীর, রুদ্ধস্বর বের হলো। তার হাত এবার ফিওনার পিঠ বেয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করলো, আর তার নখের হালকা চাপ ফিওনার ত্বকে দাগ কাটছিল, কিন্তু তাতে ফিওনা কেবল আরো বেশি তার কাছে চলে এলো।
জ্যাসপার নিজেকে সামলানোর জন্য শেষ চেষ্টা করল,কিন্তু ফিওনার প্রতিটি স্পর্শ তাকে আরো বেশি হিং*স্র করে তুলছিল।

হঠাৎ, জ্যাসপার ফিওনার দু’টি হাত শক্ত করে ধরে তার মাথার ওপরে চেপে ধরলো, যেন তাকে সম্পূর্ণ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে চায়। তার চোখে ঝড়ের মতো কিছু ভাসছিল—একটি মিশ্রণ, ভালোবাসা, কামনা আর গভীর আকাঙ্ক্ষার। ফিওনা চমকে উঠল, কিন্তু সেই বিস্ময় মুহূর্তের মধ্যেই মিলিয়ে গেল।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার দিকে আরও ঝুঁকল। তার এক হাত দিয়ে আলতো করে ফিওনার ইনারের হুক খুলে ফেলল, যেন এই মুহূর্তটি একান্তই তাদের হয়ে উঠছে। লণ্ঠনের মৃদু আলোতে ফিওনার ত্বক যেন আরো উজ্জ্বল লাগছিল। ফিওনার হৃদয় দ্রুত বেজে উঠল, আর জ্যাসপারের গভীর দৃষ্টি যেন তাকে পৃথিবীর সব বাস্তবতা ভুলিয়ে দিল।

জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো। তার ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শে ফিওনার ত্বকে যেন আগুন লেগে গেলো। প্রতিটি চুম্বনে ফিওনার গলা, ঘাড়, আর বুকের ওপরিভাগ লাল হয়ে উঠছিল।জ্যাসপার তৃষ্ণার্তের মতো তার ঘাড় আর ত্বক শু*ষে নিচ্ছিল,যেন প্রতিটি মুহূর্তে ফিওনার অস্তিত্বকে নিজের ভেতরে ধারণ করছে।
ফিওনার নিঃশ্বাস ভারী হতে শুরু করল। তার প্রতিটি শ্বাসের শব্দ তাঁবুর ভেতরে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছিল, যেন পুরো পরিবেশ তাদের আবেগের ভারে নীরব হয়ে গেছে। জ্যাসপার তার হাত অবাধ্যভাবে ফিওনার শরীরজুড়ে চালিয়ে দিতে লাগল। প্রতিটি স্পর্শ যেন তাকে আরো গভীরে নিয়ে যাচ্ছিল, ফিওনাকে এক অচেনা আবেশে আচ্ছন্ন করে তুলছিল।

ফিওনার শরীর জ্যাসপারের প্রতিটি স্পর্শের কাছে সাড়া দিচ্ছিল।তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে এলো,আর তার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এলো অস্ফুট শব্দ,যা জ্যাসপারকে আরও বেশি পাগল করে তুলল।
জ্যাসপার ফিওনাকে আরো গভীরভাবে সুখ দিতে চাইছিল। সে ধীরে ধীরে ফিওনার ব*ক্ষের নরম জায়গায় মৃদু চাপ প্রয়োগ করল।ফিওনার বক্ষে*র ছোট বৃন্তে নিজর জি*ভ দিয়ে লেহন করতে করতে,জ্যাসপার তা কামড়ে ধরল।ফিওনা যেন পাগল হয়ে যাচ্ছিল।এমন সময় তার মুখ থেকে একপ্রকার মৃদু শিৎকার বেরিয়ে এলো।
জ্যাসপার দ্রুত তার হাত ফিওনার মুখের কাছে ধরল। ফিওনা অবচেতনভাবে সেই হাত কা*মড়ে ধরল,যেন তার আওয়াজ যেন বাইরে না যায়।
জ্যাসপার হঠাৎ বলল,”তোমার এগুলো পুরাই ফ্ল্যাট।” ফিওনা বুঝতে পারল,জ্যাসপার আসলে কী বোঝাতে চাইছে—সে বোঝাতে চায় যে ফিওনার বক্ষ একদমই সমান।ফিওনা হালকা রাগ দেখাতে চাইলে,জ্যাসপার সাথে সাথে বলল, “বাট আই লাভ ইট!।”

তারপর জ্যাসপার ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগল। ফিওনার নাভী*র কাছে এসে সেখানে ঘ্রাণ নিলো। তারপর একটি হালকা চুমু দিয়ে ফিওনার দিকে তাকাল। ফিওনার চোখজোড়া বন্ধ,ঠোঁট হালকা ফাক হয়ে আছে।জ্যাসপার গাঢ় চুম্বন দিলো নাভী*তে এবং তার চারপাশে লেহন করতে লাগলো। ফিওনা জ্যাসপারের পেছনের চুল নিজের মুঠোয় নিয়ে নিলো,যেন সবকিছু নিজের হাতে নিতে চাইছে।
জ্যাসপার আর দেরি করল না।সে আরো একটু নিচে নেমে ফিওনাকে চুমুতে ভরিয়ে দিল।তার মধ্যে যেন এক নতুন অনুভূতির স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল।কিন্তু ফিওনা এবার ভয় পেতে লাগলো—আগেরবার জ্যাসপার এক ঘণ্টা ধরে ছিল। এই অনুভূতি আবারও তার মনের গভীরে আলোড়ন সৃষ্টি করছিল।

ফিওনা এবার একপ্রকার পালাতে চাইছিল।কিন্তু জ্যাসপার তা হতে দিতে চায়নি। তার মধ্যে এক অদ্ভুত হিংস্রতা প্রবাহিত হচ্ছিল, যা থামবে না। ফিওনার হাত দুটির আঙুলের ভাঁজে নিজের আঙুল ডুবিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। তারপর তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল যেন ফিওনা চিৎকার করতে না পারে।
অবশেষে সেই চরম মুহূর্ত উপস্থিত হলো। ফিওনা চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু কিছুতেই পারল না। জ্যাসপার এত শক্তভাবে তার ঠোঁট চেপে রেখেছে যে, তার শব্দ বের হতে পারছিল না। ফিওনার মনে এক অজানা আতঙ্কের ছায়া জেগে উঠলো;জ্যাসপারের কাছে সে যেন সম্পূর্ণ ব*ন্দী হয়ে পড়েছিল।পরিস্থিতির আকস্মিকতায় তার শরীরে ঝরঝরে শিরশিরে অনুভূতি বয়ে যাচ্ছিল,যা তাকে একদিকে ভীতির মধ্যে ঢেলে দিচ্ছিল,অন্যদিকে এক অদ্ভুত আকর্ষণও তৈরি হচ্ছিল।

আযদাহা পর্ব ৫৫

অবশেষে,দুটো শরীর,দুটো আত্মা পুনরায় মিলিত হলো। কিন্তু এবার জ্যাসপার থামলো না;সে অনেকটা সময় নিয়েছিল। রাত পার হয়ে গেছে,যখন ভোরের আলো ধীরে ধীরে ফুটতে শুরু করল।
জ্যাসপার ফিওনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো। উষ্ণতায় ঘেরা সেই মুহূর্তে, যেন সময় থমকে দাঁড়িয়েছিল। বাইরে সুর্যোদয়ের সোনালী রশ্মি ধীরে ধীরে ঘরটিতে ঢুকে পড়ছিল
আর তাদের চারপাশে একটি মধুর নীরবতা সৃষ্টি করছিল।

আযদাহা পর্ব ৫৭