আযদাহা পর্ব ৫৮

আযদাহা পর্ব ৫৮
সাবিলা সাবি

ল্যাবের আলো নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে।বিশাল স্ক্রিনে লুনার দ্বীপের স্যাটেলাইট ইমেজ ফুটে উঠেছে।মিস্টার চেন শিং গভীর মনোযোগে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন।তার পাশে হুয়াং ঝি একটি ট্যাবলেটে দ্রুত নোট নিচ্ছে।পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে।
“এই দ্বীপে পৌঁছানো সহজ নয়।এখানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় এবং অনবরত ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ বিচ্ছুরিত হচ্ছে,”হুয়াং ঝি তার নোট দেখে বলল।
চেন শিং দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,”আমাদের এমন একটা হেলিকপ্টার দরকার যা এই বৈরী পরিবেশে টিকে থাকতে পারে।কিন্তু আমরা যদি এখনই তৈরি করতে বসি,তাহলে অন্তত ১৫ দিন সময় লাগবে। আমাদের হাতে এতো সময় নেই।”

হুয়াং ঝি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।হঠাৎ তার মুখে একরকম উত্তেজনার ঝিলিক দেখা গেল।”লি ওয়েন!”
“লি ওয়েন?”চেন শিং ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
“হ্যাঁ,আমার এক বন্ধু।সে একসময় আমার সঙ্গে গবেষণায় ছিল।তার কাছে এমন একটি হেলিকপ্টার রয়েছে যা দুর্গম অঞ্চলে যাওয়ার জন্য তৈরি।এটা তার প্রোটোটাইপ,নাম’সাইলেন্ট স্টর্ম’।এই হেলিকপ্টারটি স্টেলথ মোডে কাজ করতে পারে,দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় উড়তে সক্ষম,এবং বৈদ্যুতিক তরঙ্গ এড়াতে এর একটি শক্তিশালী শিল্ড রয়েছে।তবে…”
চেন শিং ধৈর্যহীনভাবে জিজ্ঞেস করলেন,”তবে কী?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“লি ওয়েন সহজে তার প্রযুক্তি অন্যের হাতে তুলে দেয় না।ওর কাছে এই প্রোটোটাইপ তার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার।আমি নিশ্চিত,শুধু কথার জাদুতে ওকে রাজি করানো যাবে না।”
চেন শিং মুহূর্তের জন্য চুপ থেকে বললেন,”আমাদের তাকে বোঝাতে হবে।তাকে বলতে হবে,এই মিশন শুধু আমাদের জন্য নয়,মানবজাতির জন্য।লুনার দ্বীপের রহস্য তার গবেষণারও এক বিশাল সাফল্য এনে দিতে পারে।”
হুয়াং ঝি হেলিকপ্টারেএর বর্ননা দিতে লাগলেন।
‘সাইলেন্ট স্টর্ম’একটি হাইব্রিড হেলিকপ্টার।

এটি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক শিল্ডিং প্রযুক্তি দ্বারা সুরক্ষিত,যা বৈদ্যুতিক ঝড় এবং চৌম্বকীয় তরঙ্গ থেকে সুরক্ষা দেয়।এতে স্টেলথ মোড রয়েছে,যা রাডার এবং অন্যান্য ট্র্যাকিং ডিভাইস থেকে অদৃশ্য থাকতে সাহায্য করে।এর অটো-ব্যালেন্সিং সিস্টেম রয়েছে, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও স্থিতিশীলভাবে উড়তে পারে।হেলিকপ্টারটি ৪০০ নটিক্যাল মাইল/ঘণ্টা গতিতে চলতে পারে এবং একটানা ১৮ ঘণ্টা উড্ডয়ন সক্ষম।ভিতরে রয়েছে একটি ছোট গবেষণা ল্যাব এবং উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জাম।
মিস্টার চেন শিং অবাক হয়ে শুনলেন,আর বিবরন শুনে বুঝতে পারলেন হেলিকপ্টারটা কোনো সাধারণ হেলিকপ্টার না।
হুয়াং ঝি বলল,”আমি লি ওয়েনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করব,তবে সহজ হবে না।সে খুবই গোপনীয় স্বভাবের মানুষ।”
চেন শিং দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,”আমাদের চেষ্টা করতে হবে। এখানে শুধুমাত্র ফিওনার জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন।

দিনের শুরুতেই জ্যাসপার ফিওনাকে বলেছিল, “আজকে তোমাকে দেখাবো এই দ্বীপের এমন সব জায়গা,যা তুমি স্বপ্নেও ভাবতে পারো না।”
ফিওনা একটু অবাক হয়ে বলেছিল,”তাহলে চলো,আমাকে অবাক করাও!”
জ্যাসপার প্রথমেই ফিওনাকে নিয়ে গেলো এক মিষ্টি পানির ঝর্ণার কাছে।ঝর্ণার পানির স্ফটিক স্বচ্ছ ধারা সূর্যের আলোয় রঙিন হয়ে উঠছিল।ফিওনা হাঁটুগেড়ে বসে ঝর্ণার পানিতে হাত ডুবিয়ে বললো,”এত ঠাণ্ডা,এত মিষ্টি পানি আমি কখনো ছুঁয়েও দেখিনি।”
পাশেই জ্যাসপার হাসছিলো,”এটা শুধু এই দ্বীপেই পাওয়া যায়।এখানে কোনো কিছুই সাধারণ নয়,হামিংবার্ড।”
পরবর্তী ধাপ ছিল দ্বীপের এক ফলের বাগান।জ্যাসপার ফিওনাকে পরিচয় করিয়ে দিলো গোলাপি রঙের ছোট্ট একটা ফলের সঙ্গে।ফিওনা ফলটি হাতে নিয়ে বললো,

“এটা দেখতে একেবারে ক্যান্ডির মতো।খেতে কেমন?”
জ্যাসপার মুচকি হেসে বললো,”তুমি খেয়ে দেখো,তারপর বলো কেমন।”
ফিওনা ফলটা মুখে দেয়ার পর বিস্মিত হয়ে বললো,”এটা তো মধুর মতো মিষ্টি!কিন্তু সাথে একটা হালকা ফুলের গন্ধও আছে।”
জ্যাসপার হেসে বললো,”এটা আমাদের প্রিয় ‘অ্যাম্ব্রোসি ফ্রুট’।কিন্তু আরেকটা মজার ব্যাপার আছে।”
এরপর জ্যাসপার আরেকটা ছোট ফল তুলে ফিওনার দিকে বাড়িয়ে দিলো।ফিওনা মজা করে ফলটা মুখে পুরে অর্ধেক ঠোঁটের বাইরে রাখলো।জ্যাসপার তার মুখ থেকে বাকি অর্ধেক ফলটা খেয়ে নিলো।ফিওনা লজ্জায় বললো,
“তুমি সবসময় এমন অদ্ভুত কাজ করো কেনো?”

জ্যাসপার একটু চুপ করে মুচকি হেসে বললো,”তোমার সাথে থাকলে আমার অদ্ভুত হতে ইচ্ছা করে।”
দ্বীপের গভীরে নিয়ে যাওয়ার পর জ্যাসপার ফিওনাকে দাঁড় করালো এক দৃষ্টিনন্দন ফুলের গাছের সামনে।গাছটা যেন হাজার হাজার রঙিন ফুলে ভরে ছিলো।ফিওনা মুগ্ধ হয়ে বললো,”এটা তো স্বপ্নের মতো সুন্দর।”
জ্যাসপার কিছু না বলেই গাছটা ঝাঁকিয়ে দিলো।
মুহূর্তেই সেই ফুলগুলো ঝরে পড়ে ফিওনার ওপর।তার চুল, হাত,আর জামা ফুলে ভরে গেলো।ফিওনা কিছুটা চমকে উঠলেও হাসতে হাসতে বললো,”তুমি এটা ইচ্ছে করেই করলে,তাই না?”
জ্যাসপার হেসে বললো,”তোমার তো ফুলের রানী হওয়া উচিত।তাই তোমাকে সাজিয়ে দিলাম।”
দিনশেষে,সূর্যটা যখন আকাশের গাঢ় লাল রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছিলো, জ্যাসপার ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ফিওনা,এই দ্বীপে তুমি এসেছো বলেই এর সৌন্দর্য যেন আরও বেড়ে গেছে।”
ফিওনা একটু লজ্জা পেয়ে বললো,”তুমি সবসময় এমন কথা বলো কেন?আমি তো শুধু একজন সাধারণ মেয়ে।”
জ্যাসপার মৃদু গলায় বললো,”তুমি সাধারণ নও।তুমি আমার মহাবিশ্বের সবচেয়ে অসাধারণ জিনিস।”

সারাদিনের ক্লান্তি সত্ত্বেও ফিওনার মন যেন শান্তি খুঁজে পাচ্ছিলো না।দ্বীপের ছোট পাহাড়ের চূড়া থেকে দূরের প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউগুলো দেখে তার মনের অস্থিরতা আরও বেড়ে যাচ্ছিলো।পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা জ্যাসপারের নিঃশব্দ উপস্থিতি তাকে আরও বেশি প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করলো।
হঠাৎ ফিওনা ঘুরে দাঁড়ালো।তার চোখে ছিলো গভীর এক প্রশ্ন,আর গলায় একধরনের দৃঢ়তা।”তুমি আমাকে ভেনাসে অস্বীকার করেছিলে কেনো?” ফিওনার কণ্ঠ ভারী ছিলো।”আমি কিন্তু এখনো সব মনে রেখেছি।তুমি বলেছিলে,তুমি আমাকে ভালোবাসো না।যদিও আমি কখনোই সেটা বিশ্বাস করিনি।”

জ্যাসপার প্রথমে কিছু বললো না।সে গভীরভাবে ফিওনার দিকে তাকিয়ে রইলো।তার মুখের মধ্যে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। এক গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে সে বললো,”হামিংবার্ড,আমি যা করেছিলাম,সবটাই তোমার সুরক্ষার জন্য।আমার ভালোবাসার চেয়েও তোমার নিরাপত্তা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।”
ফিওনা একটু অবাক হয়ে বললো,”তুমি ভাবলে কি করে আমি তোমার কাছ থেকে দূরে গেলে নিরাপদ থাকবো?
আমি সবচেয়ে নিরাপদ তোমার কাছেই থাকবো।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।তারপর সে বললো,”না হামিংবার্ড,আমার কাছে থাকাই তোমার সবচেয়ে বড় বিপদ।আমি চেয়েছিলাম তুমি আমাকে ঘৃণা করো,আমাকে ভুলে যাও।কারণ আমি জানতাম,আমার ভালোবাসা তোমার জীবনে অন্ধকার নিয়ে আসতে পারে,তার প্রমান ইতিমধ্যে পেয়েছো দুবার।”

ফিওনার চোখে তখন অশ্রু চিকচিক করছিলো।তার কণ্ঠ কেঁপে উঠলো,”তুমি কি সত্যিই ভেবেছিলে,আমি তোমাকে ঘৃণা করতে পারতাম?যাকে একবার ভালোবাসা যায়,সে শত আঘাত দিলেও ঘৃণা করা যায় না।আর আমি জানতাম,তুমি কোনো না কোনো কারনেই এমনটা করেছো আর তার পেছনে তোমার নিজের কষ্ট লুকিয়ে আছে।আমার বিশ্বাস ছিলো, তুমি আমাকে কখনোই সত্যিকারের কষ্ট দেবে না।”
জ্যাসপার গভীরভাবে ফিওনার চোখে তাকালো।সে অনুভব করলো,এই মেয়েটি তার জীবনে সেই আলো যা তার অন্ধকার মহাবিশ্ব আলোকিত করতে পারে।
সন্ধ্যার আলো তখন ম্লান হয়ে আসছে,মহাসাগরের ঢেউগুলো একঘেয়ে শব্দে দ্বীপের পাড়ে আছড়ে পড়ছিল।বাতাসে ছিলো একধরনের অদ্ভুত প্রশান্তি।জ্যাসপার আর ফিওনা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে।
হঠাৎই জ্যাসপার গভীর কণ্ঠে বললো,”তুমি আমাকে কতটুকু বিশ্বাস করো?”
ফিওনা কিছু বললো না।শুধু মৃদু হেসে তার হালকা বাদামি চোখে এক অদ্ভুত রহস্যময়তা ফুটে উঠলো।কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে হঠাৎই পাহাড়ের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালো। জ্যাসপারের দিকে এক পলক তাকিয়ে,চোখ বন্ধ করলো, আর পরের মুহূর্তে নিজেকে শূন্যে ছেড়ে দিলো।

জ্যাসপারের হৃদপিণ্ড যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো। সময় যেন স্থির হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু সে এক মুহূর্তও দেরি না করে নিজেকে মানব রূপে রেখেই নিচে ঝাঁপ দিলো।তীব্র বাতাসকে চিরে,সে দ্রুতগতিতে ফিওনার দিকে পৌঁছালো। ফিওনার কোমর আঁকড়ে ধরে,সে তাকে শক্ত করে নিজের বুকে টেনে নিলো।
ফিওনা চোখ খুলে তাকালো।তার সামনে জ্যাসপারের উদ্বিগ্ন মুখ,চোখে যেন এক ধরণের অস্থিরতা।কিছু না বলে, জ্যাসপার মুহূর্তের মধ্যে ড্রাগন রূপে রূপান্তরিত হলো।তার বিশাল ডানাগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো।শক্তিশালী ডানার ঝাপটায় বাতাস চিরে সে ধীরে ধীরে ফিওনাকে নিরাপদে পাহাড়ের চূড়ার মিটিয়ে নামলো।
জ্যাসপার ফিওনার দিকে তাকিয়ে রাগ মেশানো কণ্ঠে বললো,”তুমি কি পাগল?নিজের জীবন নিয়ে এমন খেলা করো কেন?”

ফিওনা শান্তভাবে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমিই তো জানতে চেয়েছিলে,আমি তোমাকে কতটা বিশ্বাস করি। ঠিক এতটাই যে নিজের জীবন তোমার হাতে তুলে দিতে পারি।কারণ আমি জানি,তুমি কখনো আমাকে হারাতে দেবে না।”
জ্যাসপার তার দিকে তাকিয়ে রইলো।তার সবুজ চোখে যেন এক অজানা অনুভূতির ঢেউ খেলে গেলো।এই মেয়েটির ভালোবাসা আর বিশ্বাস যেন তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
“তুমি আমাকে বোঝা বন্ধ করো,হামিংবার্ড।” তার কণ্ঠ এবার অনেকটা কোমল।
ফিওনা হেসে বললো,”তুমি কি সত্যিই তাই চাও প্রিন্স?”
জ্যাসপার কোনো উত্তর দিলো না।শুধু নিঃশব্দে ফিওনার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো,যেখানে তারা আর মেঘের আড়ালে নতুন এক গল্প লিখতে শুরু করেছে।

রাতের আকাশে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে,আর মহাসাগরের ঢেউগুলো যেন সেই আলোর প্রতিফলনে মৃদু সুর তুলেছে।ফিওনা চুপচাপ জ্যাসপারের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলো। হঠাৎই,সে পেছন থেকে জ্যাসপারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।তার গলায় আবেগ ঝরে পড়লো।
“প্রিন্স,”ফিওনা বললো,”তুমি আমাকে কথা দাও।তুমি আর কোনোদিন আমাকে কষ্ট দেবে না,তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দেবে না?”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো।তার সবুজ চোখে গভীর ভালোবাসা ফুটে উঠেছে।ফিওনার গাল দু’টো ধরে,মৃদু কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বললো,”এই তোমাকে ছুঁয়ে প্রমিস করছি, হামিংবার্ড।আর কখনো তুমি আমার জন্য কষ্ট পাবে না।আর কখনো আমাকে ভেবে তুমি কাঁদবে না।আর কখনো আমার কারণে তোমার হৃদয়ে কোনো আঘাত আসবে না।আমি শত কষ্ট বা আঘাত পেলেও,তোমাকে সুখে রাখব।তোমার হাসি আমার কাছে সবচেয়ে দামি।এই প্রমিস রাখার জন্য আমি যেকোনো কিছু করতে পারি।”
ফিওনার চোখ ভিজে গেলো।সে খুশিতে জ্যাসপারকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।তার হৃদয় যেন আনন্দে ভরে গেলো।

জ্যাসপারও ফিওনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,”তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ, হামিংবার্ড।তোমার হাসিই আমার সবকিছু।আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি,তোমার কোনো ক্ষতি হতে দেবো না।”
চাঁদের আলোয় তারা দুজন যেন একে অপরের মাঝে নিজেদের পুরো পৃথিবী খুঁজে পেয়েছিল।ওই মুহূর্তে তাদের ভালোবাসা আরও গভীর হয়ে উঠলো,যা কোনো কষ্ট বা দুর্যোগ কখনো ভাঙতে পারবে না।
ফিওনা একপলক জ্যাসপারের দিকে তাকালো।তার চোখে মিশে ছিলো কৌতূহল আর খুনসুটি।সে ধীরে ধীরে নিজের পা দুটো আলগা করলো,জ্যাসপারের দিকে ঝুঁকে তার ঠোঁটে চুমু দিতে উদ্যত হলো।কিন্তু জ্যাসপার,যেন সবটা আঁচ করে, ইচ্ছে করেই নিজের মাথা আরো উঁচু করে ফেললো।
ফিওনা ভ্রু কুঁচকে হালকা বিরক্তি নিয়ে বললো,”তুমি কি জানো,তুমি খুবই বেয়াদপ?”

জ্যাসপার হাসলো,তার চোখে দুষ্টুমি ঝিলিক দিলো।”তোমার কাছে এত সহজেই হারবো,এমনটা ভেবেছিলে?”তার কণ্ঠে ছিলো এক অদ্ভুত তাচ্ছিল্যের মিশেল,কিন্তু তাতে ভালোবাসার আভাস ছিল স্পষ্ট।
ফিওনা কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর নিজের হাত দুটো বাড়িয়ে জ্যাসপারের গলায় ঝুলে পড়লো।এবার একেবারে তার চোখের সামনে মুখ নিয়ে বললো,”তোমার অহংকার ভাঙা আমার কাজ।”
জ্যাসপার এবার আর পালানোর সুযোগ পেলো না।ফিওনা তার ঠোঁট ছুঁয়েই চুমু খেয়ে নিলো মুহূর্তটা যেন থেমে গেলো। জ্যাসপার আর কোনো প্রতিরোধ করলো না।বরং সে ধীরে ধীরে তার হাত তুলে ফিওনাকে আরো কাছে টেনে নিলো। গভীর ভালোবাসা আর কোমল স্পর্শে তার বাহুতে ফিওনাকে আবদ্ধ করলো।
ফিওনা নিজের চোখ বন্ধ করে জ্যাসপারের সঙ্গ উপভোগ করছিলো।সেই মুহূর্ত যেন শুধু তাদের জন্য তৈরি হয়েছিল—কোনো শব্দ,কোনো বাধা তাদের স্পর্শ করতে পারছিল না।

একসময় জ্যাসপার ফিসফিস করে বললো,”হামিংবার্ড!
তুমি জানো,এই মুহূর্তগুলো আমাকে কেমন করে বদলে দিচ্ছে,যে আমি হৃদয়হীন ছিলাম,তুমিই তাকে ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করেছো।”
ফিওনা তার কাঁধে মাথা রেখে মৃদু হেসে বললো,”তুমি কখনোই হৃদয়হীন ছিলে না,প্রিন্স।শুধু তোমার হৃদয়কে ভালোবাসার পথ দেখানোর জন্য কাউকে দরকার ছিল। আমি তো তাই,তাই না?”
জ্যাসপার তার চিবুক তুলে ধরে গভীর চোখে তাকিয়ে বললো,”তুমি শুধু আমার হৃদয় দেখাওনি,তুমি আমার জীবনের মানে।তুমি আমার সবকিছু।”
ফিওনা হাসলো।তার হাসি যেন পুরো দ্বীপে আলো ছড়িয়ে দিলো।সে আলতো করে বললো,”তাহলে কথা দাও,আর কখনো আমাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেবে না।আমি তোমার কাছে আসতেই জন্মেছি,আমাদের ডেসটিনিতেই আছে কাছে থাকা।”

জ্যাসপার স্নিগ্ধ গলায় বললো,”মাই মুন,মাই নাইট,মাই ভেনাস,মাই ওয়ার্ল্ড,মাই ইউনিভার্স—আই প্রমিস ইউ,আই উইল নেভার লেট ইউ ক্রাই অর সাফার বিকজ অফ মি এগেইন।
জ্যাসপার ফিওনাকে ধীরে ধীরে কোলে তুলে নিলো, যেন তার পৃথিবীটা এখন এই মেয়েটির মাঝে সীমাবদ্ধ। ফিওনা প্রথমে কিছুটা বিস্মিত হলেও, তার মুখে এক মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।
জ্যাসপার তার গভীর সবুজ চোখে ফিওনার দিকে তাকালো,যেন হাজার কথাও এই দৃষ্টির গভীরতা প্রকাশ করতে অক্ষম। এরপর কোনো কিছু না বলে,সে ধীরে ধীরে ফিওনার মুখের দিকে ঝুঁকল।
ফিওনার নিঃশ্বাস তখন থমকে গিয়েছিল।জ্যাসপার তার ঠোঁটকে ফিওনার ঠোঁটে আলতো করে রাখলো।সেই চুম্বনটা ছিল আবেগে পূর্ণ,গভীর আর নির্ভেজাল।
ফিওনার হাত ধীরে ধীরে উঠে এসে জ্যাসপারের ঘাড়ের চারপাশে জড়িয়ে ধরলো।তাদের মাঝে যেন সময় থমকে গিয়েছিল।চাঁদের আলো তাদের ঘিরে যেন এক অলৌকিক আবেশ তৈরি করেছিল।

হুয়াং ঝি পরদিন সকালে লি ওয়েনের কাছে একটি গোপন মেসেজ পাঠাল।কয়েক ঘণ্টা পর একটি এনক্রিপ্টেড ভিডিও কল এল।লি ওয়েনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর দৃঢ় মুখাবয়ব স্ক্রিনে ফুটে উঠল।
“হুয়াং,এতোদিন পর!কী ব্যাপারে যোগাযোগ করছ?”
লি ওয়েন সরাসরি জিজ্ঞাসা করল।
হুয়াং ঝি একটু সংকোচ নিয়ে শুরু করল,”লি,তোমার ‘সাইলেন্ট স্টর্ম’ দরকার।আমাদের একটি বিপজ্জনক মিশন আছে।”

“সাইলেন্ট স্টর্ম?”লি ওয়েনের চোখে সন্দেহের ছাপ ফুটে উঠল।”তুমি জানো এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ আমার জন্য। এরকম একটা প্রযুক্তি আমি কারো হাতে তুলে দেব না।”
হুয়াং ঝি চাপা হাসি দিয়ে বলল,”আমি জানি।তবে ভাবো, যদি তুমি আমাদের সাহায্য করো,লুনার দ্বীপের রহস্য প্রথম তোমার নামের সাথেই জড়িয়ে যাবে।তুমি শুধু একজন বিজ্ঞানীই নও,তুমি হয়ে উঠবে ইতিহাসের অংশ।”
লি ওয়েন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,”তুমি জানো,আমি এই ধরনের আবেগী কথায় সহজে প্রভাবিত হই না।তবে ঠিক আছে,আমি এটা ভাড়া দিচ্ছি না।তুমি কী দিতে পারো আমাকে বিনিময়ে?”

হুয়াং ঝি আর চেন শিং একে অপরের দিকে তাকাল।চেন শিং বললেন,”মিস্টার লি,আমরা যা চাইছি,সেটা শুধু আমাদের জন্য নয়।তোমার সাইলেন্ট স্টর্ম লুনার দ্বীপের সত্যিকারের রহস্য উদ্ঘাটনের চাবিকাঠি হতে পারে।সেখানে কিছু এমন তথ্য আছে যা হয়তো মানবজাতির ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে পারবে।
হুয়াং ঝি শেষমেশ লি ওয়েনকে রাজি করাতে সক্ষম হলো।ফোনের অপরপ্রান্তে কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর লি ওয়েন বলল,”ঠিক আছে, আমি তোমাকে ‘সাইলেন্ট স্টর্ম’ দিতে রাজি আছি।তবে মনে রেখো, 1ষএটা এক বিশেষ ধরনের প্রোটোটাইপ।এই হেলিকপ্টার ব্যবহার করার জন্য তোমাদের কিছু নির্দেশ মেনে চলতে হবে।আর যদি এতে কোনো ক্ষতি হয়,তার জন্য আমি দায়ী নই।”

চেন শিং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,”ধন্যবাদ,মিস্টার লি।আমরা তোমার হেলিকপ্টারের যত্নে ব্যাবহার করবো।
লি ওয়েন বললেন,”তোমাদের হেলিকপ্টারটা অত্যন্ত যত্নের সাথে ব্যবহার করতে হবে।এটি আমার সবচেয়ে গোপন প্রোজেক্টগুলোর একটি।আরেকটি কথা,হেলিকপ্টারটি লুনার দ্বীপ থেকে ফেরত না আসা পর্যন্ত এটি নিয়ে কী করছ, সে বিষয়ে আমাকে নিয়মিত আপডেট দিতে হবে।”
চেন শিং নিশ্চিত করলেন,”তোমার হেলিকপ্টারের কোনো ক্ষতি হবে না।আমরা যত্ন নেব।আর দ্বীপ থেকে ফিরে এর প্রতিটি ডাটা তোমাকে জানাব।”

সকাল ছিল স্নিগ্ধ আর শান্ত।জ্যাসপার ফিওনাকে ডাকলো,”হামিংবার্ড,ওঠো।”
ফিওনা ঘুম ঘুম চোখে জবাব দিলো,”কি হলো প্রিন্স ?এত সকালে ডাকছো কেন?”
জ্যাসপার তার দিকে ঝুঁকে এসে ফিওনার এক গালে আলতো করে চুমু খেয়ে বললো,”গুড মর্নিং,সকাল হয়ে গেছে।এখন উঠো তো।”
ফিওনা ধীরে ধীরে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো।তার এক চোখ বন্ধ আর অন্যটা আধখোলা।
জ্যাসপার ফিওনার সেই অবস্থা দেখে হেসে জিজ্ঞেস করলো,”তোমার এমন চোখ বন্ধ-খোলা কেন?”
ফিওনা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,”এক গালে চুমু দিয়েছো তো, তাই একটা চোখ খুলেছে।”এটা বলেই সে জ্যাসপারের পায়ের ওপর শুয়ে গালটা সামনে এগিয়ে দিলো।
জ্যাসপার মৃদু হেসে বললো,”ওহ,আমার হামিংবার্ড।” তারপর সে একদম একসাথে পাঁচটা চুমু দিয়ে দিলো।
ফিওনা নড়েচড়ে উঠে বসে অবাক হয়ে বললো,”এটা আবার কি হলো প্রিন্স?”
জ্যাসপার চটপট উত্তর দিলো,”যাতে আমার হামিংবার্ড একবারেই পুরোপুরি উঠে যায়,তাই একসাথে এতগুলো চুমু দিলাম।”

ফিওনা তখন হেসে বললো,”তাহলে বলতে হয়,তুমি চুমু দিয়ে মানুষ জাগানোর নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছো!”
ফিওনা তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”সকালে উঠে দেখি তুমি একেবারে সকালের খাবার রেডি করে ফেলেছো?এটা কি করে সম্ভব?”
জ্যাসপার মৃদু হেসে বললো,”হ্যাঁ,আমি রেডি করে ফেলেছি।তোমাকে ভালো করে খাওয়াতে হবে তো!”
ফিওনা ভ্রু কুঁচকে বললো,”এক সেকেন্ড,তোমার চোখদুটো দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি সারারাত ঘুমাওনি। কেন?”
জ্যাসপার হাসি চাপা দিয়ে বললো,”সারারাত তোমাকে দেখেছি,তাই।”
ফিওনার মুখে বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠলো।
“তোমাকে দেখেছি?মানে?”
জ্যাসপার গভীর দৃষ্টিতে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি যখন ঘুমিয়ে ছিলে,তোমার মুখের প্রশান্তি দেখে আমার চোখ সরাতে পারিনি।তোমার প্রশ্বাসের ছন্দ,তোমার মিষ্টি মুখ—সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছিল।তাই ঘুমানোর কথা মনেই আসেনি।”

ফিওনা একটু লজ্জায় গালে হাত দিয়ে বললো,”আচ্ছা, ঠিক আছে।কিন্তু একটা কথা বলি?”
জ্যাসপার তার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বললো, “বলো,হামিংবার্ড।”
ফিওনা একটু দ্বিধা করে বললো,”তুমি সারারাত আমাকে দেখেছো,তাই না?কিন্তু…আমিও তো সেদিন ঘুমাইনি।আমিও তোমাকে দেখছিলাম।”
জ্যাসপার অবাক হয়ে হাসলো।”তুমি আমাকে দেখছিলে?কেন?”
ফিওনা একদম লজ্জায় মাথা নিচু করে বললো,”কারণ আমি ভাবছিলাম…তুমি যখন ঘুমাও,তখন তুমি কীভাবে এতটা শান্ত আর সুন্দর দেখতে হও।তাই চোখ বন্ধ করতে পারিনি।”
জ্যাসপার হাসতে হাসতে ফিওনার দিকে ঝুঁকে বললো, “তাহলে আমরা দুজনেই সারারাত ঘুমাইনি,শুধু একে অপরকে দেখেছি?কী অদ্ভুত প্রেমিক-প্রেমিকা আমরা!”
ফিওনা মৃদু হেসে বললো,”অদ্ভুত হোক বা না হোক,আমার মনে হয় এর চেয়ে সুন্দর কিছু আর হতে পারে না।”
জ্যাসপার ফিওনার কপালে আলতো চুমু দিয়ে বললো,”তুমি ঠিকই বলেছো।আমাদের এই মুহূর্তগুলোই আমার কাছে সবচেয়ে দামি।”

পরদিন ভোরে সাইলেন্ট স্টর্ম লি ওয়েনের গোপন হ্যাঙ্গার থেকে বের করা হলো। মসৃণ ধাতব বডি, তীক্ষ্ণ ব্লেড, আর মেশিনের গর্জনে যেন শক্তি আর আত্মবিশ্বাস মিশে ছিল। ভিতরে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সাজানো।লি ওয়েন হেলিকপ্টার চালানোর জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও ডকুমেন্টেশন দিয়ে দেয়। সাইলেন্ট স্টর্ম প্রস্তুত ছিল যাত্রার জন্য।

আযদাহা পর্ব ৫৭ (২)

এবার,হুয়াং ঝি ও চেন শিং সঠিক লোকেশন ট্র্যাক করে লুনার দ্বীপে যাওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করল। তাদের হাতে সময় অল্প, আর ঝুঁকি ছিল বিশাল। কিন্তু সাইলেন্ট স্টর্মের প্রটেকশন তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলল।
হেলিকপ্টারে চেপে চেন শিং, হুয়াং ঝি,লুনার দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।তাদের মিশন শুরু হলো।সাইলেন্ট স্টর্ম শব্দহীনভাবে আকাশে উঠে পড়ল,যেন এক অদৃশ্য ছায়া। তাদের সেখানে পৌছতে মাত্র তিন ঘন্টা সময় লাগবে।
পথে হুয়াং ঝি গম্ভীর কণ্ঠে বলল,”এখানে কোনো ভুলের জায়গা নেই।আমরা লুনার দ্বীপে যাচ্ছি,কিন্তু কী অপেক্ষা করছে,তা জানি না।এটা শুধুমাত্র বিজ্ঞান নয়,এটা টিকে থাকার লড়াই।”

আযদাহা শেষ পর্ব