আযদাহা পর্ব ৭
সাবিলা সাবি
আজকের বিকেলটা অন্যরকমের সৌন্দর্যে মোড়ানো—এক বিষণ্ণ নীরবতা ঘিরে রেখেছে পুরো পরিবেশ।
লীন রুমে নেই,প্রাইভেট পড়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে,তাই ফিওনা আপাতত একা। কয়েক মুহূর্ত আগে গ্ৰান্ডপা ফোন করেছিল; বলল, বিশেষ এক দায়িত্বে কয়েকদিনের জন্য লন্ডনে যেতে হবে। কিন্তু তার কথা শেষ হতেই, ফিওনার মনে গভীরভাবে গেঁথে থাকা মিস ঝাং এর স্মৃতি অম্লান হয়ে জাগ্রত হলো। গ্ৰান্ডপার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখা করার ইচ্ছা তীব্রতর হচ্ছে তার।
কিন্তু হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায় সন্ধ্যার সেই রহস্যময় পুরুষটির সাথে সাক্ষাতের প্রতিশ্রুতি। এক অজানা আকর্ষণে টানছে যেন—মন বলছে, ‘যাও,’ কিন্তু মস্তিষ্ক শানিত যুক্তিতে পাল্টা যুক্তি তুলে ধরছে, ‘না যাওয়া উচিত হবে না।’
এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফিওনা হারিয়ে গেলো। একা একা সেই অদ্ভুত, রহস্যাবৃত পুরুষের সাথে দেখা করতে যাওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? অথচ লোকটি তো একবার তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে। তবুও, তার মধ্যে এমন কী আছে যে তাকে এতো অজানা পথে নিয়ে যেতে চাইছে? কেনই বা তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়?
ফিওনা চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে নিজের বিছানায় বসে থাকে। তার চীনা শীতকালীন পোশাক—লম্বা, প্যাডেড চীপাও— তার চোখের দৃষ্টি জানালার দিকে, কিন্তু তার মন উড়ছে প্রশ্নের অজানা গহ্বরে—সত্যিই কি সে আজ সেই রহস্যময় পুরুষের সাথে দেখা করবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফিওনা যখন প্রস্তুতি নিতে শুরু করে,সন্ধ্যার ছায়া ধীরে ধীরে নেমে আসছে বেইজিং শহরের আকাশে। লীন এখনও রুমে ফিরেনি, আর ফিওনার মনে হচ্ছে সেই রহস্যময় পুরুষ হয়তো ইতিমধ্যেই লেকের ধারে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু ফিওনা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, ঠিক কী পোশাক পড়ে যাবে আজকের এই অপ্রত্যাশিত সাক্ষাতে।
আলমারির দরজা খুলে একে একে পোশাকগুলোর দিকে তাকায়,গভীর অনুসন্ধান চালায়।
শেষমেশ আর দেরি না করে বেছে নেয় এক বড় সাইজের ব্ল্যাক স্কার্ট, হাঁটু পর্যন্ত দীর্ঘ আর খয়েরি রঙের একটি টপস, চুলগুলোকে পনিটেলের মতো করে শক্ত করে বেঁধে নিলো।
মেকআপে রয়েছে যত্নের ছাপ—হালকা হলেও নিখুঁত। কিন্তু আজকে ফিওনা ঠোঁটে গাঢ় খয়েরি রঙের লিপস্টিক লাগিয়েছে। চোখে হালকা আইলাইনারের প্রলেপ। হ্যান্ডব্যাগটি হাতে নিয়ে সে শেষমেশ বেরিয়ে পড়ে।
ফিওনা ইতিমধ্যে বাসে উঠে বসেছে, বেহাই লেকের উদ্দেশ্যে তার যাত্রা শুরু হয়েছে। জানলার বাইরে তাকিয়ে সে আকাশপানে চিন্তার জাল বুনছে, মনের আকাশে কুসুম কল্পনা উড়ে বেড়াচ্ছে। কী রকম হবে সেই পুরুষ? জীবনে এভাবেই প্রথম কোনো পুরুষ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
বাস চলতে থাকে, আর তার চিন্তারা আরও গভীরে প্রবাহিত হয়।কী অপেক্ষা করছে তার জন্য বেহাই লেকের তীরবর্তী সেই নির্জন স্থানটিতে।
অন্যদিকে, জ্যাসপার ইতিমধ্যেই বেহাই লেকের উত্তর প্রান্তে পৌঁছে গেছে। সেই বিশাল উইলো গাছের নিচে, যেখানে প্রকৃতি তার নিজস্ব ভাষায় কথা বলে,
জ্যাসপার দাঁড়িয় আছে।সন্ধ্যার আবছা আলোতে গাছের ডালগুলো নুয়ে পড়েছে, লেকের তীর বরাবর সাজানো লাইটগুলোর মৃদু আলোকচ্ছটা ,যা কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
জ্যাসপার অপেক্ষায় আছে, চুপচাপ।তার চোখের দৃষ্টি লেকের ওপরে আটকে আছে, আর মনের মধ্যে দোলা দিচ্ছে নানা ভাবনা। নীরবতা ভেঙে ওঠে হালকা হাওয়ায়, কিন্তু সেই নীরবতার মধ্যেও তার মন ফিওনার অপেক্ষায় একাগ্র।
অবশেষে ফিওনা বাস থেকে নেমে পড়ে, লেকের প্রশান্ত পরিবেশের দিকে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে শুরু করে। কিন্তু তার মনের গহীনে ভর করছে এক গভীর প্রশ্ন—এতো বিশাল লেকের কোথায় খুঁজে পাবে সেই রহস্যময় পুরুষকে? যেহেতু লোকটি নিজের পরিচয় আর সুরক্ষা নিয়ে এতটা সতর্ক, নিশ্চয়ই কোনো নির্জন স্থানে অপেক্ষা করবে সে। ফিওনার চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে, বেশ অনেকক্ষণ পর অবশেষে সে দেখতে পায় লেকের উত্তর প্রান্তে সেই উইলো গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তিকে।
লোকটি পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে, তার দীর্ঘদেহ থেকে ছড়িয়ে পড়া ছায়ায় গাছে আঁকা হয়েছে এক অনন্য ছবি। ফিওনার মনে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেয় সেই চেহারা—এটিই জ্যাসপার। তার দীর্ঘকায় দেহ, ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতা, আর সেই বিশাল ওভারকোটের আকৃতি সবকিছু মিলিয়েই নিশ্চিত করে দেয় লোকটি জ্যাসপার ছাড়া আর কেউ নয়।
এক গাঢ় বাদামী রঙের ওভারকোট তার দেহের প্রতিটি রেখায় ছায়া ফেলেছে, কোটের পকেটে তার হাত দুটি গভীরভাবে ঢোকানো।
জ্যাসপার দাঁড়িয়ে আছে নিস্তব্ধভাবে,তার দৃষ্টি সরাসরি লেকের শান্ত জলের ওপরে নিবদ্ধ। বাতাসের শীতল স্রোত এসে কোটের কাঁধে আলতোভাবে আঘাত হানে, কিন্তু সে নড়ে না।
ফিওনা ধীরে ধীরে উইলো গাছের দিকে এগিয়ে যায়, প্রতিটি পদক্ষেপে পাতা আর গাছের শাখার মাঝে অদৃশ্য সুর তৈরি হয়, কিন্তু সে সুরটি দ্রুত হারিয়ে যায়। হঠাৎ, জ্যাসপার দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়। তার মুখে এখনও সেই পরিচিত সানগ্লাস আর মাস্ক,মনে হচ্ছে তার আসল পরিচয় পুরোপুরি আড়াল করতে চায়।
ফিওনার মনোযোগ আকর্ষণ করে তার সেই রহস্যময় ভঙ্গি। কেন সে এতটা সচেতনভাবে নিজের চেহারা গোপন করছে? কি এমন কুৎসিত বা অস্বস্তিকর তার চেহারায় যা প্রকাশ্যে আসা থেকে সে এতটাই ভয় পায়?
ফিওনার মনে প্রশ্ন জাগে—লোকটি কেমন? শুধু চেহারা নয়, তার চারপাশের রহস্যময় ভাব, তার ব্যক্তিত্ব—এসব কি তার ভেতরের কিছুর প্রতিফলন? ভাবতে ভাবতে ফিওনার কৌতূহল আরও বেড়ে যায়। কিন্তু জ্যাসপারের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা তাকে অবচেতনভাবে টানে।”
“হ্যা, তো এবার বলুন, আপনি আমার সাথে বন্ধুত্ব কেনো করতে চান?” ফিওনা প্রাঞ্জল কণ্ঠে প্রশ্ন করে।
“এটা একটা রহস্য। আর ভেবে নাও, তোমাকে প্রথম দেখেই আমার অদ্ভুত রকম ভাল লাগা কাজ করেছে।”
জ্যাসপার একটু হাসে, কিন্তু তা খুব অল্প।
“আচ্ছা, আপনি নিজের চেহারা এভাবে সবসময় ঢেকে রাখেন কেন?” ফিওনা সরাসরি প্রশ্ন করলো “আজকে তো কথা দিয়েছিলেন আপনার মুখ প্রদর্শন করবেন, তাহলে করুন।”
“হ্যাঁ, করবো। চোখ তো আগেই দেখেছিলে,” জ্যাসপার রহস্যময় কন্ঠে বললো।
ধীরে ধীরে, জ্যাসপার সানগ্লাসটি খুলে ফেলে। সামনে আসে তার অলিভ গ্রিন চোখ, যা সন্ধ্যার লেকের আলোতে আরও জ্বলজ্বল করছে। ফিওনা এক দৃষ্টিতে সেই চোখজোড়াতে তাকিয়ে থাকে,সময় থমকে গেছে, আর চারপাশের জগত অদৃশ্য হয়ে গেছে।
জ্যাসপারের মতোই ওর চোখজোড়া গভীর অরণ্যের মতো—অজানা, রহস্যময়।
“মাস্ক?” ফিওনা মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করে।
জ্যাসপার এক হাত দিয়ে টেনে নিজের মাস্ক খুলে ফেলে। হঠাৎ করেই ফিওনার সামনে ভেসে ওঠে তার মুখমণ্ডল, মুখটা যেনো আকাশের একটি অশ্রুতপূর্ব রত্ন।
জ্যাসপার একজন সুঠাম যুবক, যার চেহারায় স্বাভাবিক আকর্ষণ আর গভীর রহস্যের আভাস বিরাজমান।
তার ত্বক মসৃণ আর সাদা, শীতল চাঁদের আলোতে গঠিত একটি নিখুঁত পৃষ্ঠ। চোখ দুটি অলিভ গ্রিন,যা গভীর বনভূমির রহস্যময়তা ধারণ করে।
জ্যাসপারের চোখের নিচে হালকা রেখা দৃশ্যমান ,যা তার অভিজ্ঞতার গল্প বলে। এসব রেখা তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে,ঘন কালো চুলগুলি মৃদু ঢালু আকারে পেছনে আঁচড়ানো।
তার ঠোঁট পাতলা ধনুকের মতো বাঁকা,জ্যাসপারের ঠোঁটজোড়া একেবারে ড্রাগন ফলের মধ্যাংশের মতো—যা রঙিন রণেলু দিয়ে সাজানো, গাঢ় বেগুনি আর গোলাপী রঙের মিশ্রণ এক কথায় রক্তিম বেগুনি ঠোঁটজোড়া। অতিরিক্ত ফর্সা চেহারার সাথে তার ঠোঁটজোড়া ফুটে উঠেছে।
জ্যাসপারের মুখের গঠন তীক্ষ্ণ, উঁচু গালের হাড় আর সোজা নাকের কারণে তার চেহারায় শক্তিশালী চরিত্রের পরিচয় ফুটে ওঠে।
জ্যাসপার সাধারণ পোশাক পরলেও, তার ব্যক্তিত্বের দীপ্তি চারপাশের পৃথিবীকে আলোকিত করে ফেলবে।
ফিওনার হৃদয়ে অদ্ভুত অনুভূতি উথলে উঠে। সে উপলব্ধি করে, এই সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়— এমনকি তার নিজস্ব মনের কথা বলার সক্ষমতাও হারিয়ে গেছে।
“এই পুরুষটি কি সত্যিই পৃথিবীর?” তার মনে প্রশ্ন জাগে। “সে অন্য কোনো জগতের লোক?” ফিওনা ভাবতে থাকে।
জ্যাসপারের মুখে যে আত্মবিশ্বাসের ছাপ, তা মনে হবে অন্য কোনো জীবের গুণ। তার চেহারার গঠন, প্রতিটি বৈশিষ্ট্য এমন নিখুঁত, প্রকৃতি নিজ হাতে তাকে নির্মাণ করেছে।যা শুধুমাত্র রূপকথার রাজপুত্রদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল।
ফিওনা এক ভিন্ন জগতের মায়াবী আবেশে হারিয়ে গেছে, যেখানে সৌন্দর্য তার চেতনা গ্রাস করে নিয়েছে। জ্যাসপারের অলিভ গ্রিন চোখের জাদুকরি আলোয় সে বিমোহিত।
বারবার ঢোক গিলতে গিলতে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে অস্থিরতা বাড়ছে।
হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে ফিওনার, তার দেহের প্রতিটি অঙ্গাবরণে রোমাঞ্চের শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।
এই অদ্ভুত পরিস্থিতির প্রতি নজর রেখে, জ্যাসপার দ্রুততার সাথে নিজের মুখের মাস্ক আর চোখের চশমা পুনরায় পরিধান করে।
জ্যাসপার সামান্য চুটকি বাজিয়ে ফিওনার হুঁশ ফেরাতে চেষ্টা করলো,সপ্নের পৃথিবী থেকে তাকে সজাগ করে তুলতে চাইলো।
ফিওনার মস্তিষ্কে আলোড়ন তুলে দিয়ে, এই মহৎ যুবকের সৌন্দর্য তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলো।
আর এখন সে বাস্তবের মুখোমুখি, প্রতিটি অনুভূতির পিঠে জেগে ওঠা অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে।
“এই জন্যই বুঝি আপনি সব সময় আপনার চোখমুখ ঢেকে রাখেন?” ফিওনা কিছুটা মজার সুরে বললো,
“খোলামেলা ভাবে হাঁটলে আশেপাশের সব মেয়েরা নিশ্চয়ই হুমড়ি খেয়ে পড়বে।”
জ্যাসপারের মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে এক রহস্যের ইঙ্গিতের মতো।
“তবে এবার বন্ধুত্বটা ফাইনাল করা যাক,” জ্যাসপার বললো নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ফিওনার দিকে।
ফিওনাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার সাথে হাত মেলায়, কিন্তু মুহূর্তেই হাত সরিয়ে নেয়। কারণ,জ্যাসপারের গায়ের তাপমাত্রা ছিল অবিশ্বাস্যরকম উচ্চ—প্রায় ১২০°F (প্রায় ৪৮.৮°C)
“আপনার তো জ্বর এসেছে! ডক্টর দেখাননি?” ফিওনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
জ্যাসপার কিছুটা ভিমড়ি খেয়ে যায়। আসলে,এটাই তো তার প্রকৃত তাপমাত্রা। সে যে মানব নয়, বরং ড্রাগন, তা ভুলে গেছে। ড্রাগনের শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকভাবে এতটাই বেশি হয়।
কিন্তু পৃথিবীতে আসার সময় জ্যাসপার বিশেষ ক্যামিকেল ডোজ নিয়ে এসেছিলো যার নাম “অ্যাসপিরাথ” আজকে সেই বিশেষ ক্যামিকেলি থরের ডোজ নিতে ভুলে গিয়েছিল।
এই মেডিসিনটি গ্রহণ করলে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত তার তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকে পৃথিবীর ন্যায়।
“এতোটা জ্বর নিয়ে এখানে আসাটা কি সত্যিই জরুরি ছিল?” ফিওনা কিছুটা উদ্বেগে প্রশ্ন করে।
“সমস্যা নেই,” জ্যাসপার হাসিমুখে উত্তর দেয়, “ডক্টর দেখিয়েছি মেডিসিন নিচ্ছি, বিশ্রাম করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।” জ্যাসপার মনে মনে একটু চিন্তিত হয়।
“তবে তুমি আগে এটা বলো, আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে রাজি কি না?”
ফিওনা জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে একটা প্রশান্ত হাসি দেয়। “হ্যাঁ, অবশ্যই। জানেন,এই প্রথম আমার জীবনে কোনো পুরুষ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।”
“এটা সত্যি আমার জন্য স্পেশাল মোমেন্ট,” ফিওনা উল্লসিত হয়ে বলে, “এখন থেকে আমরা বন্ধু।”
রাতের হিমেল বাতাসে ফিওনার শরীর কাঁপছিল, পাতলা টপসটি শীতের প্রকোপ থেকে তাকে কোনোভাবেই রক্ষা করতে পারছিল না। জ্যাসপার সেদিকে এক ঝলক তাকাতেই ফিওনার কম্পিত দেহ তার চোখ এড়ায় না। নির্লিপ্তভাবে নিজের ভারী, বাদামী রঙের ওভারকোটটি খুলে ফিওনার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
ফিওনা প্রথমে কিছুটা দ্বিধায় পড়লেও, কোটটির উষ্ণতা তার শীতার্ত দেহের প্রয়োজন পূরণের একমাত্র অবলম্বন মনে হয়। কোটটি কাঁধের ওপর ফেলে শরীর জড়াতেই, তার নাকে মৃদু এক অপার্থিব সুগন্ধি আঘ্রাণ লাগে। সুগন্ধিটি জ্যাসপারের মতোই অনন্য—সন্দল কাঠের (স্যান্ডেল উড) মিষ্টি গভীর গন্ধ।
কোটটি এতটা উষ্ণ ছিল যে,ফিওনার সমস্ত ঠান্ডা মুহূর্তেই গলে গেল। তার হৃদয় দ্রুত চলছিল, কিন্তু তা কি শীতের কারণে, নাকি কোটের সাথে মিশে থাকা সেই অতিজাগতিক সত্ত্বার জন্য?
“ঠিক আছে, তবে চলো, তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেই,” জ্যাসপার বললো। আর দুজনে একসাথে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।
গাড়িটি ছিল উজ্জ্বল সাদা রঙের কনভার্টিবল, যার ছাদটা খুলে দেয়া যায়। ফিওনা গাড়ির সামনের সিটে বসে আছে, আর জ্যাসপার ড্রাইভ করছে। গাড়ির জানালাগুলো খুলে দিতেই বাতাসে হালকা সুরভি ছড়িয়ে পড়ে।
ফিওনা বারবার জ্যাসপারের দিকে তাকাচ্ছে, এই প্রথমবারের মতো একজন বন্ধু পেয়ে সে অত্যন্ত আনন্দিত। যদিও জ্যাসপার তার দিকে না তাকিয়েও তা বুঝতে পারছে, কিন্তু সে কিছু বলেনা।
ভার্সিটির সামনে এসে যখন গাড়িটি থামে, ফিওনা জ্যাসপারকে বিদায় জানিয়ে নেমে পড়ে। কিন্তু মনে হয়, বিদায় বলার সময় কিছু একটি প্রায় অসমাপ্ত রয়ে গেছে। আবার কিছু মনে পড়ে যাওয়ার মতো মুখ করে জানালার কাঁচের সামনে এসে টোকা দেয়।
“আপনার সাথে যোগাযোগ করবো কিভাবে?” ফিওনা জানতে চায়।
“এটা নাও,” জ্যাসপার তার ইমেইল অ্যাকাউন্ট দিলো।
ফিওনা দ্রুত তথ্যটিকে মনে রাখে। “ঠিক আছে, আমি পরে আপনার সাথে যোগাযোগ করবো,” সে আশ্বাস দেয়।
জ্যাসপার রহস্যময় হাসি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। গাড়িটি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে।
ফিওনা গাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে, তার মন খুঁজে পায় সেই স্বপ্নের মতো মুহূর্তগুলিকে, যেখানে বন্ধুত্বের সুবাস আর অজানা আগ্রহের গন্ধ মিশে আছে।
ফিওনার মনে হঠাৎ করে ঝলক দেয়, “ও হো মিস ঝাং এর সাথে দেখা করতে হবে!” সে দ্রুত পদক্ষেপে বাড়ির দিকে বেরিয়ে পড়ে।
গ্র্যান্ডপা অনুপস্থিত থাকার কারণে ফিওনার হৃদয়ে শূন্যতা ছিল, তবে সে জানে যে মিস ঝাং-এর সাথে দেখা করা তার জন্য কতটা জরুরি। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে, সে চারপাশে তাকায়, কিন্তু মিস ঝাংকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। একটানা দৃষ্টিতে ঘরগুলো পর্যবেক্ষণ করতে করতে, সে শেষ পর্যন্ত মিস ঝাং-এর ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
অথচ, সেখানেই এক ভয়াবহ দৃশ্য তার সামনে এসে উপস্থিত হয়—মিস ঝাং অসুস্থ হয়ে গোঙাচ্ছে। ফিওনার চিত্কার করে তার দিকে ছুটে যায়। “মিস ঝাং কি হয়েছে আপনার ?” অবস্থা দেখে বোঝা যায়, মিস ঝাং- এর শারীরিক পরিস্থিতি নিতান্তই খারাপ।
“আপনাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে,” ফিওনা এক নিঃশ্বাসে বলে। সে সোজা দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে যায় আর রং দ্রুত একটা গাড়ি ডেকে হাসপাতালে পৌঁছায়।
হাসপাতালের সাদা দেয়ালগুলো, ফিওনার হৃদয়ে আরো একবার আতঙ্কের স্রোত প্রবাহিত করে। এখানে সবাই ব্যস্ত, একজন ডাক্তারকে ডাকতে থাকলেও মনে হয়, সময় থমকে গেছে।
হঠাৎ, হাসপাতালের সাদা আলোতে একটি ডাক্তারের গাঢ় পদক্ষেপ ফিওনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর মুখাবয়বটি ফিওনাকে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে যায়, তবে সঙ্গে গুরুতর রোগীর কারণে দ্রুত তিনি নার্সদের ডাক দেন, “পেশেন্টকে ভেতরে নিয়ে যেতে হবে!”
ফিওনার হৃদয়ে আতঙ্কের ঢেউ আসে; সে অশ্রুসজল চোখে ডাক্তারকে দেখে কাঁদতে শুরু করে।
“প্লিজ ডক্টর, মিস ঝাংকে সুস্থ করুন!” তার কণ্ঠস্বরে কষ্টের বিপর্যয় চলছে, সেই মুহূর্তে তার সমস্ত আশা আর মিস ঝাং এর জন্য দুশ্চিন্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
“শান্ত হন, মিস ফিওনা,” ডাক্তার মৃদু কণ্ঠে বলেন, কিন্তু তার গম্ভীর অভিব্যক্তি সব কিছু বোঝাতে সক্ষম।
ফিওনা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, মনে হয় সময় থমকে গেছে।
“এলিসন ফিওনা, রাইট?” ডাক্তারটি বলতে বলতে তার মুখমণ্ডল থেকে মাস্ক খুলে ফেলে।
ফিওনার মনের মধ্যে অস্পষ্ট চিন্তা খেলে যায়।
“আপনি আমাকে কিভাবে চেনেন, ডাক্তার?” প্রশ্নটি তার কণ্ঠে কাঁপছে।
মাস্ক খুলতেই এক শিহরণ জাগানো মুখোশের পেছনে লুকিয়ে থাকা এক রূপক যুবকের হাসি ধরা পড়ে।তার মুখাবয়ব স্বর্গীয় সৌন্দর্যের প্রতীক।
“হাই!আমি ডক্টর লিউ ঝান,” ডক্টরটি উজ্জ্বল হাসি দিয়ে জানায়, “মিস্টার ওয়াং লির একমাত্র নাতি।”
ফিওনা স্নিগ্ধ মিষ্টি স্বরে বললো, “আপনি গ্ৰ্যান্ড লির নাতী? কিন্তু আমি তো আপনাকে আগে কখনো দেখিনি?”
“আমি কিছুদিন হলো এই হসপিটালে জয়েন করেছি,” সে বলে “কিন্তু আমার গ্ৰান্ডফাদার তোমার কথা আমাকে সবসময় বলে আর তোমার ছবিও দেখিয়েছে।
তোমার সম্পর্কে তার কথা শুনে মনে হয়েছে, তুমি এক অসাধারণ রূপবতী নারী।” আর এখন আমার ধারনার থেকেও বেশি সুন্দর তুমি ।
ফিওনার মনের ভেতর সামান্য আবেগের তরঙ্গ খেলে যায় লিউ ঝানের কথায় তবে তার মন আবারও মিস ঝাংয়ের অসুস্থতা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে।
“কিন্তু… মিস ঝাং কেমন আছেন?” ফিওনা উদ্বেগের সঙ্গে প্রশ্ন করে।
“তুমি চিন্তা করো না। আমরা সব ধরনের যত্ন নিবো। আমি অবশ্যই তাকে সুস্থ করে তুলবো,” সে তাকে আশ্বস্ত করলো।
“এটা বেইজিং মেডিকেল সেন্টার,” লিউ ঝান উত্তর দিল, “এখানে আমরা সবসময় রোগীদের সুস্থ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করি।”
মিস ঝাং এখন কিছুটা সুস্থ, কিন্তু মিনি স্ট্রোকের ফলে তার শরীরের দুর্বলতা এখনও স্পষ্ট। ফিওনা বাইরে একটি চেয়ারে বসে ভাবনায় মগ্ন, সেই সময় ডক্টর লিউ ঝান সুগন্ধি কফির কাপ হাতে নিয়ে ফিওনার সামনে উপস্থিত হয়। তার চোখের কোণে মৃদু একটি হাসি।
“এই কফিটা তোমার জন্য,” সে বলে, কফির কাপটায় স্নিগ্ধতা রয়েছে। “তুমি বেটার ফিল করবে বলে আশা করি।”
ফিওনা কফির দিকে তাকিয়ে বললো “ধন্যবাদ, ডক্টর। আপনি আসার পর আমার মনে একটু স্বস্তি এসেছে।”
“তাহলে, এবার বলো কোন ভার্সিটিতে পড়ছো?” লিউ ঝান আগ্রহভরে প্রশ্ন করে।
“আমি পিকিং ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি,” ফিওনা সোজা হয়ে বসে উত্তর দেয়।
পিকিং ইউনিভার্সিটি? সেখানকার পরিবেশ কেমন?” লিউ ঝান চায়,তার প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে নতুন সম্পর্কের সূচনা করতে।
“অসাধারণ। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক আবিষ্কার করার সুযোগও রয়েছে, কিন্তু মাঝে মাঝে খুব চাপ অনুভব হয়।”
“এটা খুবই স্বাভাবিক। আমরা যখন উচ্চাকাঙ্ক্ষী হই, তখন চাপ আমাদের জীবনকে আক্রমণ করে,” লিউ ঝান বললো “তোমার মনোবল কিন্তু অবশ্যই স্ট্রং থাকতে হবে।”
ফিওনা একটু হেসে উত্তর দেয়, “আমার গ্ৰান্ডপা আমাকে সবসময় বলেছে, ‘যখন কঠিন সময় আসবে, তখন তুমিই নিজেকে স্ট্রং রাখবে।’”
আযদাহা পর্ব ৬
“তোমার গ্ৰান্ডপা মিস্টার চেন শিং তিনি খুবই বিচক্ষণ। আশা করি তুমি তার শিক্ষাগুলো মেনে চলবে,” লিউ ঝান উজ্জ্বল চোখে বললো।
কিছু সময়ের জন্য তারা দুজনেই একে অপরের সাথে আলাপ আলোচিত করে নিল।
