আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১০
সাবিলা সাবি
ফিওনা যথারীতি আজও ভার্সিটিতে এসেছে।কিন্তু আজকের দিনটা অন্যান্য দিনের মতো সাধারণ নয়।আজ তার জন্য বিশেষ একটি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে—তলোয়ার চালনার প্রশিক্ষণ।এর সাথে রিভলভার দিয়ে শুটিংয়ের ট্রেনিংও।
প্রথমে তলোয়ার প্রশিক্ষণ শুরু হলো।প্রশিক্ষক ধাপে ধাপে ফিওনাকে শেখাচ্ছিলেন,কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই ফিওনা তার গতির জন্য প্রশিক্ষকের নজর কাড়ল।সে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি স্বাভাবিকভাবে তলোয়ার চালাচ্ছিল।
প্রশিক্ষক কিছুক্ষণ ফিওনার হাতে ধরা তলোয়ারের গ্রিপের দিকে তাকিয়ে থাকলেন,তারপর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ফিওনা, তুমি আগে কখনও তলোয়ার চালিয়েছো?”
ফিওনা মাথা নাড়লো। “না, আজকেই প্রথম দিন।”
প্রশিক্ষক এবার আরও অবাক হলেন।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “অদ্ভুত… তোমার হাতের মুভমেন্ট এতটাই স্বাভাবিক,যেন তুমি জন্ম থেকেই জানো কিভাবে তলোয়ার চালাতে হয়!”
ফিওনা কিছু বললো না,শুধু মৃদু হাসলো।কিন্তু তার মনের ভেতর তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছিল।গত কয়দিনের স্বপ্নটা আবার তার মনে পড়ে গেলো—এক অন্ধকার যুদ্ধক্ষেত্র।তার হাতে ধরা ছিল একটি উজ্জ্বল তলোয়ার।চারপাশে ছড়িয়ে ছিল রক্ত আর আগুন…
স্বপ্ন?না না স্বপ্না না হারিয়ে যাওয়া অতীতের ছায়া।
শুটিং ট্রেনিংয়ে গিয়ে প্রথম শটেই লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি ফিওনা।কিন্তু দ্বিতীয়বারেই নিখুঁতভাবে টার্গেটে গু*লি লাগিয়েছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রশিক্ষক বিস্ময় লুকিয়ে রাখতে পারলেন না। “তুমি খুব দ্রুত শিখছো, ফিওনা!এই গতিতে চললে কয়েক দিনের মধ্যেই তুমি পারফেক্ট হয়ে যাবে!”
ফিওনা প্রশিক্ষকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।কিন্তু তার মন পড়ে ছিল অন্য কোথাও—সেই অদ্ভুত স্বপ্নের দৃশ্যগুলোতে…
ট্রেনিং শেষ করে এসে, ফিওনা ক্যান্টিনের এক কোণে বসে চুপচাপ খাবার খাচ্ছিলো।ট্রেনিং আজ একটু কঠিন ছিল, তবে সে দ্রুত শিখে নিচ্ছে।চারপাশে ট্রেনিং শেষ করা অন্যান্য শিক্ষার্থীদের কোলাহল,কেউ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে, কেউ খাবার নিচ্ছে।
এদিকে,লুকাসের এখনো আসার সময় হয়নি।ফিওনা জানে, সে অন্য ট্রেনিং সেশনে ব্যস্ত।ঠিক তখনই,এথিরিয়ন এসে তার পাশের চেয়ারে বসল।
ফিওনা অবাক হলো না,সে লক্ষ্য করেছে যে এথিরিয়ন বরাবরই বন্ধুসুলভ আচরণ করে।তাই কিছু না বলে সে শুধু নিজের খাবারে মন দিলো।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর,এথিরিয়ন হঠাৎ বললো, “আচ্ছা ফিওনা, তোমার কোনো বান্ধবী নেই?”
ফিওনা ভ্রু কুঁচকে তাকালো, “কেনো?”
এথিরিয়ন মুচকি হেসে বললো, “কেনো আবার! চোখের সামনে একটা ছেলে এভাবে সিঙ্গেল হয়ে বসে আছে, সেটা তুমি দেখো না?”
ফিওনা কিছুক্ষণ এথিরিয়নের দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর শান্ত স্বরে বললো, “তুমি কি সত্যি সিঙ্গেল?”
এথিরিয়ন নাটকীয় ভঙ্গিতে হাত বুকের ওপর রাখলো, “অবশ্যই! আমার জীবনে এখনো কোনো প্রেমিকা আসেনি।”
ফিওনা একটু হাসলো, তারপর বললো, “আচ্ছা,তুমি কি সিরিয়াসলি প্রেম করার জন্য বান্ধবী খুঁজছো?”
এথিরিয়ন কাঁধ ঝাঁকালো, “ঠিক প্রেম করার জন্য না।
ফিওনা তখন নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে বললো, “তাহলে?”
এথিরিয়ন হেসে বললো,”উফ এতো প্রশ্ন না করে একটা বান্ধবী জোগাড় করে দাও না আমার জন্য!”
ফিওনা চোখ ঘুরিয়ে বললো,”আমি কি ম্যাচমেকার নাকি?”
এথিরিয়ন কাঁধ ঝাঁকালো, “একদম না,কিন্তু তুমি তো মেয়ে, অন্য মেয়েদের চিনবে।”
ফিওনা একটু ভেবে বললো, “আমার খুব বেশি বান্ধবী নেই, আর যারা আছে,তারা তোমার ধরণের ছেলেদের পছন্দ করবে না।”
এথিরিয়ন নাটকীয়ভাবে বললো, “ওহ, আমি কী ধরনের?”
ফিওনা শান্তভাবে খাবার নিতে নিতে বললো,”একটু বেশি কথা বলা,একটু বেশি আত্মবিশ্বাসী,আর একটু বেশি ফ্লার্টি।”
এথিরিয়ন হেসে বললো, “ঠিক বলেছো,কিন্তু তাও যদি কেউ থাকে,বলো আমাকে।”
ফিওনা তখন শান্তভাবে বললো, “হ্যাঁ, আছে। তবে তারা পৃথিবীর মানবী।”
এথিরিয়ন তখনই চমকে উঠে বললো, “না না, বাবা! দরকার নেই! আমি কোনো হিউম্যান গার্লের প্রেমে পড়তে চাই না! এমনিতেই এসব নিয়ে ভেনাসে যা যা কাণ্ড ঘটেছে,আমার বাবা ড্রাকোনিস তো আগে থেকেই চিন্তিত!আমি ঠিকঠাক একটা ড্রাগন মেয়েই চাই!”
ফিওনা হেসে ফেললো, “তাহলে তুমি এত আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলে কেন?”
এথিরিয়ন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, “আরে, ফ্রেন্ডশিপ করার জন্য ভাবছিলাম!কিন্তু হিউম্যান হলে নাহ,আমি বাবা আমার ড্রাগন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবো!”
ফিওনা তখন বললো, “এক কাজ করো, সিলভা আছে তো! ওর সাথে প্রেম করলেই তো পারো। ও তোমাকে পছন্দ করে অনেক।”
এথিরিয়ন ভ্রু কুঁচকে বললো, “তুমি এটা জানলে কীভাবে?”
ফিওনা হাসলো, “আমি লক্ষ্য করছিলাম সেদিন। ও তোমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছিল, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।”
এথিরিয়ন বিরক্ত মুখে বললো, “আহ, আমার ওকে একদম পছন্দ না! গায়ে পড়া মেয়েরা আমার একদমই ভালো লাগে না! এই ধরনের মেয়ে কি আমি ডিজার্ভ করি?”
ফিওনা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, “হয়তো তুমি যা ডিজার্ভ করো, তা এখনো তোমার কাছে আসেনি।”
এথিরিয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আশা করি তাই!”
কথোপকথন চলতে থাকতেই ফিওনা জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কেমন মেয়ে পছন্দ করো?”
এথিরিয়ন হাসিমুখে উত্তর দিলো, “আমার পছন্দ কোমল, নাজুক, সুন্দরী আর বুদ্ধিমতি, যেমন তুমি। তোমার মতো কেউ হলেই হবে।”
ফিওনার মুখে এক উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠলো। সে বললো, “আমার মতো মেয়ে? আমার মনে হয়, আমার মতো মেয়ে এই ইউনিভার্সে একটাই।”
এথিরিয়ন তখন জুস খেতে খেতে হাসলো, “রাইট, তোমার মতো মেয়ে একটাই… তাও আবার সোল্ড আউট!”
ফিওনা ভ্রু কুঁচকে তাকালো, “সোল্ড আউট? এটা আবার কেমন কথা?”
এথিরিয়ন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, “মানে, তোমার ওপর তো ইতিমধ্যেই এক ড্রাগন প্রিন্সের একচেটিয়া অধিকার আছে। অন্য কেউ তোমার দিকে তাকালেও সেই প্রিন্স আগুন ছুড়ে দেবে!”
ফিওনা চোখ ঘুরিয়ে বললো, “তুমি তো এমনভাবে বলছো যেন আমি কোনো বস্তু, যার মালিকানা নির্ধারিত হয়ে গেছে।”
এথিরিয়ন হেসে বললো, “আমি কিন্তু বাস্তবতা বললাম, ফিওনা।”
ফিওনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “বাস্তবতা বদলানো যায়, এথিরিয়ন।”
এথিরিয়ন চোখ টিপে বললো, “হয়তো যায়, তবে তোমার ক্ষেত্রে অসম্ভব।কারণ,একবার যদি কোনো ড্রাগন হৃদয়ে আঁচড় কা*টে,সেটা কখনো মোছা যায় না।”
এথিরিয়ন বিদায় নিয়ে উঠে গেলো। করিডোর দিয়ে হাঁটার সময় সে হঠাৎ দেখতে পেলো লুকাস ক্যান্টিনের দিকে আসছে।
এথিরিয়ন একটু এগিয়ে গিয়ে লুকাসকে থামিয়ে দিলো। চোখে একধরনের কৌতূহল ঝিলিক দিয়ে উঠলো তার। সে সরাসরি প্রশ্ন করলো, “আমাকে চেনো?”
লুকাস ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর মাথা নেড়ে বললো, “হ্যাঁ, আপনি আমাদের ভার্সিটির সিনিয়র ব্যাচের।”
এথিরিয়নের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো, যেন সে কিছু একটা যাচাই করতে চেয়েছিলো আর তাতেই নিশ্চিত হয়েছে।
এথিরিয়ন তখন করিডোর থেকে ক্যান্টিনের কোণের দিকে ইশারা করে বললো, “ওই যে, কর্নারের মেয়েটাকে দেখছো?”
লুকাস এক নজর দেখে বললো, “হ্যাঁ, ফিওনা ও।”
এথিরিয়ন তখন গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “ওর সাথে আর কথা বলো না।”
লুকাস ভ্রু কুঁচকে বললো, “কেনো? ও তো আমার খুব ভালো বন্ধু।”
এথিরিয়ন তখন চোখ সরু করে তাকালো, যেন সে কোনো আদেশ দিচ্ছে, “আমি বলেছি, আর কথা বলবে না।”
লুকাস একটু চুপ করে রইলো, তারপর সাহস করে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “কেনো? ফিওনা কি আপনার গার্লফ্রেন্ড?”
এথিরিয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদু হেসে বললো, “আই উইশ! যদি আমার গার্লফ্রেন্ড হতো… কিন্তু প্রিন্স জ্যাসপার অরিজিনকে চিনো? ওটা তার একমাত্র সম্পদ।”
এথিরিয়নের কথা শুনে লুকাস ভয়ে ঢোক গিললো। তার মুখের রঙ একটু ফ্যাকাশে হয়ে গেলো, যেন সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
এথিরিয়ন তখন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো, “যাই হোক, ওয়ার্ন করার কাজ করালাম। না শুনলে বাকিটা পড়ে বুঝবে।”
এই কথার পর এথিরিয়ন আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না, দ্রুত করিডোর ধরে চলে গেলো।
লুকাস কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইলো, মনে হলো যেন তার গলার মধ্যে কিছু আটকে গেছে। তারপর ভয়ে ভয়ে ধীরে ধীরে ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে গেলো।
ফিওনা তখনই ওকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে হাত নেড়ে বললো, “হাই, লুকাস!”
কিন্তু লুকাস কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে ফিওনার দিকে না তাকিয়েই খাবার নিলো এবং দ্রুত ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেলো, যেন কিছু দেখতেই পায়নি।
ফিওনা ওর আচরণে পুরোপুরি অবাক হলো। “লুকাস আমাকে ইগনোর করলো কেনো? ওর কি কিছু হয়েছে?”
মনে মনে ভাবলো সে।
ব্রেক শেষে ফিওনা আবারও প্রশিক্ষণ নিলো।আজকের প্রশিক্ষণ ছিলো দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর।ছুটি হতে হতে সন্ধ্যা নেমে আসে,আকাশের একপাশে সূর্য লালচে আভা ছড়াচ্ছে, আর অন্যপাশে অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে—যেন দিন ও রাত একসঙ্গে মিশে আছে।
ফিওনা একা একা ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এলো।সে ভাবছিলো দ্রুত বাসায় ফিরবে,কিন্তু তখনই এথিরিয়ন সামনে এসে গাড়ির দরজা খুলে বললো, “এসো, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।”
এথিরিয়নের গাড়িটি একেবারে রাজকীয়।পুরো গাড়িটা পাথরের মতো শক্ত,কিন্তু তার গায়ে জ্বলজ্বল করা নকশা ছিলো,যা শুধুমাত্র ড্রাগন রাজপরিবারের জন্য তৈরি করা হয়।চাকার বদলে নিচে এক ধরনের ভাসমান শক্তি ছিলো,যা মাটির স্পর্শ ছাড়াই চলতে পারবে মনে হচ্ছে।
ফিওনা কোনো দ্বিধা না করেই উঠে পড়লো,কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ গাড়ি ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেলো।
“ধুর! মনে হচ্ছে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে,” এথিরিয়ন বিরক্ত হয়ে বললো।
ঠিক তখনই রাস্তায় প্রবল ঝড় শুরু হলো।ভেনাসের আবহাওয়া পৃথিবীর মতো সাধারণ নয়—এখানে এক মুহূর্ত আগেও আকাশ পরিষ্কার ছিলো,আর এখন চারদিকে ধুলো ও বাতাসে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে গেছে।আশেপাশের আলোগুলো একে একে নিভে আসছে,যেন রাত আরও গভীর হচ্ছে।
“বুঝতেই পারছি না,এখানে হঠাৎ ঝড় হলো,অথচ সামনের রাস্তা দেখো,একদম পরিষ্কার!ভেনাসের আবহাওয়া এতটাই অদ্ভুত।কখনো রাত শেষ হয় না,কখনো সূর্য দিনের মাঝখানে থমকে যায়।বৃষ্টি শুরু হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই উধাও হয়ে যায়,আবার কোনো কোনো জায়গায় চিরকালের জন্য রোদের আলো আটকে থাকে!”
ফিওনা জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলো,সত্যিই পাশের রাস্তা পুরোপুরি ফ্রেশ,যেন ঝড় নামার কোনো অস্তিত্বই নেই। কিন্তু তারা যেখানে আছে,সেখানে বাতাসের প্রচণ্ড গতি গাড়িটাকে কাঁপিয়ে তুলছে।
এথিরিয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”এভাবে বসে থাকলে চলবে না,আমাদের জঙ্গল দিয়ে বের হতে হবে।”
ফিওনার বুক ধক করে উঠলো।জঙ্গল?সে ভেতরে ভেতরে একটু ভয় পেয়ে গেলো,কিন্তু মুখে কিছু বললো না।সে জানে, ভেনাসের জঙ্গল সাধারণ নয়—এখানে আলো-আঁধারির খেলা চলে সারাক্ষণ,অদ্ভুত সব প্রাণীরা লুকিয়ে থাকে।
“ঠিক আছে,” ধীর কণ্ঠে বললো ফিওনা,কিন্তু তার মনের মধ্যে একটা অজানা আশঙ্কা ক্রমশ বাড়তে থাকলো।
এথিরিয়ন আর ফিওনা গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত জঙ্গলের ভেতর হাঁটতে শুরু করলো।চারপাশটা ঘন গাছে ঢাকা, কোথাও কোথাও অদ্ভুত আলো-আঁধারির খেলা, যেন এই জায়গায় রাত আর দিনের কোনো নিয়ম নেই। বাতাসে একটা কিছুর গন্ধ,কিছুটা ভেজা মাটির,আবার কিছুটা ঝড়ের পরে আসা অস্বস্তিকর শূন্যতার মতো।
কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ ঝোপের আড়াল থেকে কয়েকজন মুখোশধারী লোক ঝাঁপিয়ে পড়লো!তাদের মুখে কালো কাপড় বাঁধা,চোখের দৃষ্টিতে বিদ্বেষের ছাপ।তারা কিছু একটা ধুলো ছড়িয়ে দিলো বাতাসে।
এক মুহূর্তের মধ্যেই এথিরিয়ন আর ফিওনার শরীরে একটা বিচিত্র অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো।যেন সমস্ত শক্তি কোথাও টেনে নেওয়া হচ্ছে,শরীরের ভেতরে এক চাপা অস্বস্তি,আর ড্রাগন রূপ নেওয়ার চেষ্টা করতেই অনুভব করলো—তারা পারছে না!
“ধুর!এটা… এটা ড্রাক্সিলিয়াম ডাস্ট!” এথিরিয়ন গর্জে উঠলো, সাথে সাথে বুঝতে পারলো মুখোশধারীরা কারা।
ফিওনা অবাক হয়ে তাকালো, “ড্রাক্সিলিয়াম ডাস্ট? সেটা আবার কী?”
এথিরিয়ন দাঁত কিঞ্চিত কামড়ে বললো, “এটা এক বিশেষ ন্যানো-কেমিক্যাল,যা আমাদের ড্রাগন রূপ নেওয়ার ক্ষমতা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়।আমাদের শরীরে প্রবেশ করলেই এটা আমাদের শক্তিকে নিজ শরীরের ভেতর আটকে রাখে,কিন্তু ব্যবহার করতে দেয় না!বিতাড়িত ড্রাগনরাই সাধারণত এটা তৈরি করে…”
ফিওনা আতঙ্কিত হয়ে চারদিকে তাকালো, “এর প্রভাব কতক্ষণ থাকে?”
“কয়েক ঘণ্টা!” এথিরিয়নের চোখ চকচক করলো, “আর এই সময়ের মধ্যেই ওরা আমাদের শেষ করার চেষ্টা করবে!”
এদিকে মুখোশধারীরা ইতিমধ্যে তাদের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে! ঝনঝন শব্দে ধাতব অস্ত্রের ঝলকানিতে অন্ধকার চিরে গেল। এথিরিয়ন দ্রুত সরে গিয়ে এক আঘাত প্রতিরোধ করলো, কিন্তু তার স্বাভাবিক শক্তি নেই।
“এরা বিতাড়িত ড্রাগন!” এথিরিয়নের কণ্ঠে দৃঢ়তা, “এরা নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে আমাদের মতো শক্তিশালী ড্রাগনদের আক্রমণ করে।ভেনাসে বিতাড়িত ড্রাগনরা ড্রাগন রূপ নিলেও কোনো ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে না, তাই তারা মানব রূপেই তলোয়ার নিয়ে লড়াই করে।কিন্তু আজকের মতো শক্তি হারিয়ে আমি ওদের সামনে অসহায় হয়ে থাকবো না!”
মুখোশধারীরা একসাথে ঘিরে ফেললো ওদের। এথিরিয়ন তলোয়ার চালিয়ে একের পর এক আক্রমণ প্রতিরোধ করছিল,কিন্তু তার গতি কিছুটা ধীর হয়ে আসছিল।
“ফিওনা! এখান থেকে পালাও!” এথিরিয়ন চেঁচিয়ে উঠলো, “সামনে একটা রাস্তা আছে!এখনই দৌড়াও!”
ফিওনা পিছু হটলো, কিন্তু তার মনে হলো—সে কি সত্যিই এথিরিয়নকে এই পরিস্থিতিতে ফেলে চলে যেতে পারবে?
ফিওনা দ্রুত গাছের আড়ালে সরে গেল। তার বুক ধুকপুক করছে, কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো। আজকের প্রশিক্ষণের পর সে তলোয়ার আর রিভলভার সঙ্গে রেখেছিল, শুধুই বাসায় প্র্যাকটিস করার জন্য। তখন হয়তো গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু এখন সেটাই তার একমাত্র ভরসা।
সে দ্রুত রিভলভারের চেম্বারে কয়েকটা বুলেট ভরতে থাকলো, হাত একটু কাঁপছিল, কিন্তু দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সেটাকে উপেক্ষা করলো।
এদিকে, এথিরিয়ন নিজের শক্তি ব্যবহার করতে পারছে না বলে রীতিমতো ব্যাকফুটে চলে গেছে। শত্রুরা সংখ্যায় বেশি, প্রত্যেকের হাতে ধারালো তলোয়ার ঝলকাচ্ছে। তার পোশাকের কয়েক জায়গায় ইতিমধ্যে কাটা পড়েছে, রক্ত ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে, কিন্তু সে দমে যায়নি।
একজন মুখোশধারী তার তলোয়ার উঁচিয়ে বললো, “তোর বাবা কিং ড্রাকোনিস আমাদের বিতাড়িত করেছিলো! কতদিন ধরে এই জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলাম প্রতিশোধ নিতে,আজ সুযোগ পেয়েছি!এবার তোকে শেষ করবো!”
এথিরিয়ন তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো, “তোমাদের দুর্বলতা তো এখনো কমেনি, সুযোগ পেয়েও অত কথা বলছো?”
শত্রুর চোখ জ্বলে উঠলো রাগে, সে ছুটে এসে এথিরিয়নের দিকে আঘাত করলো। এথিরিয়ন একপাশে সরে গেলেও পুরোপুরি এড়াতে পারলো না, তার বাহুতে গভীর একটা কাট পড়লো।
ফিওনা এতক্ষণ আড়াল থেকে পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। সে জানতো, এথিরিয়ন হয়তো একা সামলাতে পারবে না। চোখ বন্ধ করে একবার নিজের প্রশিক্ষণের কথা মনে করলো, তারপর রিভলভার শক্ত করে ধরে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো।
ফিওনা দৃঢ়ভাবে রিভলভারটা ধরে শত্রুদের দিকে তাক করে বললো, “আর একটা আঘাত এথিরিয়নকে করে দেখো, গুলি করে সবকটারই বুক ঝাঁঝরা করে দেবো!”
তারা সবাই একসাথে উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো, যেন ফিওনার কথা একেবারেই গুরুত্ব দিচ্ছে না।
এথিরিয়ন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো, “ফিওনা, তুমি কি করছো? প্লিজ, এখান থেকে চলে যাও!”
কিন্তু ফিওনা নড়লো না, তার চোখে ছিল অদম্য প্রতিজ্ঞা।
ঠিক তখনই, শত্রুদের মধ্যে থেকে একজন নিখুঁত লক্ষ্যে একটা ছুরি ছুড়ে মারলো। মুহূর্তের মধ্যে সেটি সোজা গিয়ে ফিওনার রিভলভারের গায়ে লাগলো, শক্ত আঘাতে রিভলভারটা ফিওনার হাত থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলো!
ফিওনা হতবাক হয়ে নিজের খালি হাতে তাকালো, আর মুখোশধারীদের হাসির শব্দ যেন চারপাশের বাতাসে প্রতিধ্বনিত হলো…
ফিওনা হতবাক হয়ে গেল! রিভলভারটা তার হাত থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলো, কিছুটা দূরে গিয়ে গড়িয়ে গেলো ঘাসের মধ্যে। শত্রুরা হাসতে লাগলো আরও জোরে।
“ছোট্ট মেয়েটা ভাবলো, আমাদের ভয় দেখাতে পারবে!” একজন বিদ্রূপের সুরে বললো।
এথিরিয়ন ফিওনার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো, “আমি তোমাকে বলেছিলাম পালিয়ে যেতে! এখন কী করবে?”
ফিওনার মনে হলো, এথিরিয়নের চোখে একধরনের উদ্বেগ আছে, যদিও সে মুখে প্রকাশ করছে না। কিন্তু এখন পালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। রিভলভার হাতছাড়া হয়ে গেছে, আর এই দুর্ধর্ষ শত্রুদের সামনে সে একা দাঁড়িয়ে আছে।
ফিওনার চোখ চকচক করলো, তার হাত আস্তে আস্তে পেছনে গেলো—সেখানে ব্যাগের সঙ্গে বাঁধা ছিল তার প্রশিক্ষণের তলোয়ার!
শত্রুরা তখনও ব্যস্ত ছিল নিজেদের জয়ে উল্লাস করতে। এথিরিয়ন মাটিতে এক হাঁটু গেড়ে বসে, যেন রক্তক্ষরণ আটকানোর চেষ্টা করছে।
ফিওনা ধীরে ধীরে তলোয়ারটা বের করলো, ধাতব আওয়াজে বাতাস কেঁপে উঠলো। তারপর শক্ত গলায় বললো,
“আমার হাত থেকে বন্দুক পড়ে গেছে, তাতে কী? আমাকে এখনও ঠিক মতো চেনোই তো না তোমরা!”
শত্রুরা এবার কিছুটা থমকে গেলো। একজন অবাক হয়ে বললো, “ওহো, মেয়েটার সাহস তো কম নয়!”
ফিওনা তলোয়ারটা সামনের দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে রইলো, তার চোখে আগুন জ্বলছে!
ফিওনা বুঝতে পারলো, পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। ঠিক তখনই শত্রুর একজন পেছন থেকে তেড়ে এসে তার গলা পেঁচিয়ে ধরলো!
শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, কিন্তু ফিওনা হার মানার মেয়ে না। সে মুহূর্তের মধ্যে নিজের ভারসাম্য ধরে রেখে এক পা পিছিয়ে আঘাত করলো লোকটার পায়ের পাতায়! লোকটা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠতেই ফিওনা তার শক্ত হাত থেকে নিজেকে ছিটকে বের করে আনলো।
ছাড়া পেয়েই ফিওনা মুহূর্ত নষ্ট না করে এক নিখুঁত বাঁক নিয়ে তার হাতে থাকা তলোয়ারটা চালিয়ে দিলো,শত্রুটি দ্রুত সরে গিয়ে অল্পের জন্য বেঁচে গেল,কিন্তু ফিওনার চোখেমুখে যে যুদ্ধের আগুন জ্বলছিল,তা দেখে বাকিরা সতর্ক হয়ে উঠলো।
এদিকে চারপাশ থেকে আরও কয়েকজন শত্রু তাকে ঘিরে ফেলেছে।তারা ধীরে ধীরে তাকে গোল করে ঘুরছে, যেন শিকারকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলতে চায়।ফিওনা মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে, হাতে শক্ত করে ধরা তলোয়ার, চোখে ভয় নেই,বরং একরকম হিং*স্র আত্মবিশ্বাস।
অন্যদিকে এথিরিয়নও একসঙ্গে কয়েকজনের হাতে মার খাচ্ছে। সে এখনো ড্রাগন রূপ নিতে পারছে না, শত্রুরাও জানে সে দুর্বল, তাই দল বেঁধে হামলা চালাচ্ছে। এথিরিয়ন নিজেকে রক্ষা করতে পারছে, কিন্তু স্পষ্টতই সে আহত হচ্ছে।
ফিওনা দেখে, এভাবে চলতে থাকলে তারা দুজনই হেরে যাবে। কিছু একটা করতে হবে, এবং সেটা এখনই!
ফিওনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আকাশ থেকে এক বিশাল সবুজ ড্রাগন ঝাঁপিয়ে পড়লো! তার দেহজুড়ে জ্বলছিল দপদপে আগুন,চোখ দুটো লালচে সবুজ দীপ্তিময়।মুহূর্তেই সে বিশাল এক আগুনের স্রোত ছুড়ে দিলো শত্রুদের দিকে!
গনগনে আগুনের শিখা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই শত্রুরা আতঙ্কে চিৎকার করে ছিটকে গেল।যারা পালাতে পারলো না, তারা মুহূর্তেই দগ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।আগুনের তাপে জঙ্গলের বহু গাছ পুড়ে যেতে লাগলো,বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো।
এথিরিয়ন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো এই দৃশ্যের দিকে। “জ্যাসু ভাইয়া!”সে ফিসফিস করে বললো,যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
তারপর মুহূর্তেই বিশাল ড্রাগনরূপী জ্যাসপার এক লাফে ফিওনার দিকে ঝাঁপিয়ে এলো।তার শক্ত নখর দিয়ে ফিওনার কোমর আঁকড়ে ধরলো,যেন ওকে নিজের শিকার বানিয়ে নিচ্ছে।
ফিওনা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। “প্রিন্স আপনি?”
কিন্তু জ্যাসপার কিছু বললো না।সে দ্রুত ডানা মেলে আকাশে উঠে গেলো,মুহূর্তের মধ্যে বিশাল গাছপালার ঊর্ধ্বে। বাতাসের প্রচণ্ড গতি ফিওনার চুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু সে কেবল শক্ত করে জ্যাসপারের আঁকড়ে থাকা নখরের চাপটা অনুভব করছিলো।
এদিকে এথিরিয়ন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো,কিভাবে তার সামনে থেকে ফিওনাকে নিয়ে উড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে তার ভাই ড্রাগন প্রিন্স জ্যাসপার!
জ্যাসপার ফিওনাকে শক্ত হাতে ধরে তার এল্ড্র রাজ্যের প্রাসাদের এক নির্জন কক্ষে নিয়ে এলো। এটি তার ব্যক্তিগত প্রশিক্ষণ কক্ষ—যেখানে অস্ত্র, বিভিন্ন রকমের কেমিক্যাল, আর গোপন প্রযুক্তি রাখা আছে। কক্ষটি বিশাল, দেয়ালে সাজানো রয়েছে নানা ধরনের তলোয়ার, বর্শা, এবং শক্তিশালী ড্রাগনদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি কিছু যুদ্ধের সরঞ্জাম।
বারান্দা দিয়ে প্রবেশ করেই জ্যাসপার ফিওনাকে সামনে ঠেলে দিলো। তার চোখে ছিলো ক্রোধ, উদ্বেগ, আর এক অজানা আবেগ।
জ্যাসপার ফিওনাকে শক্ত করে ধরে তার চোখে চোখ রাখলো। তার মুখে বিরক্তি, রাগ, আর এক অদ্ভুত উদ্বেগের ছাপ।
“খুব সাহস হয়ে গেছে তোমার, তাই না?”—তার কণ্ঠ ছিল গভীর, তীক্ষ্ণ। “তুমি এখনো সেভাবে প্রস্তুত নও, ফিওনা! তুমি পালিয়ে না গিয়ে তাদের সঙ্গে লড়াই করছিলে কেন?”
ফিওনা বিরক্তির সঙ্গে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু জ্যাসপারের হাতের শক্তি সে নড়াতে পারলো না।
“আপনার ভাই বিপদে ছিল! আমি কি তাকে ফেলে একা পালাবো?”—ফিওনার কণ্ঠে ছিলো স্পষ্ট হতাশা।
জ্যাসপার গভীর শ্বাস নিলো, যেন নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। তারপর বললো, “হামিংবার্ড, তুমি বুঝতে পারছো না! তুমি এখনো পুরোপুরি প্রশিক্ষিন প্রাপ্ত নও। এথিরিয়ন নিজেকে রক্ষা করতে পারতো, কিংবা আমি তাকে বাঁচাতাম। কিন্তু যদি তোমার কিছু হয়ে যেত?”
ফিওনা এবার দৃঢ় কণ্ঠে বললো, “আমি এতটা স্বার্থপর নই, আর আমি দুর্বলও নই! আমি তলোয়ার চালাতে পারি।”
জ্যাসপার ফিওনার চোখের দিকে তাকালো, গভীর দৃষ্টি নিয়ে। মুহূর্তখানেক নীরব থাকার পর সে ধীরে ধীরে বললো, “তুমি হয়তো তলোয়ার চালাতে পারো, কিন্তু তুমি জানো না কখন চালাতে হবে। যুদ্ধ শুধু শক্তির নয়, বুদ্ধিরও খেলা। আর তুমি…”
সে হালকা করে ফিওনার বাহু থেকে হাত সরিয়ে নিলো, কিন্তু তার দৃষ্টিতে সেই দাবানল এখনো জ্বলছিলো।
“…তুমি আমার সবচেয়ে দুর্বল বিন্দু হয়ে যাচ্ছো, হামিংবার্ড।”
ফিওনা তখন আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বললো,”আমি দুর্বল নই,আমি ট্রেনিং নিয়েছি।”
জ্যাসপার এক মুহূর্ত ফিওনার দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর ঠোঁটের কোণে একপ্রকার বিদ্রূপাত্মক হাসি ফুটিয়ে তুললো। “তাই? তুমি একেবারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে গেছো, দেখি কতোটা শিখেছো।”
এটা বলেই সে এক লম্বা পদক্ষেপে নিজের বিশেষ আলমারির সামনে গেলো। ভারী কাঠের দরজাটা খুলতেই ভেতর থেকে উজ্জ্বল রূপালি আভা বেরিয়ে এলো।আলমারির ভেতরে সাজানো ছিলো বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র,কিন্তু জ্যাসপার একটাও চোখে পড়তে দিলো না,শুধু দুটি তলোয়ার তুলে নিলো—একটা নিজের জন্য,আরেকটা ফিওনার হাতে এগিয়ে দিলো।
ফিওনা অবাক হয়ে তার হাতের তলোয়ারটার দিকে তাকালো।নিখুঁত কারুকাজ করা,প্রায় তার হাতের দৈর্ঘ্যের সমান ভারী অস্ত্র।সে একটু ইতস্তত করলেও জ্যাসপার এক ধাপে সামনে এসে তার হাতে তলোয়ারটা শক্ত করে চেপে ধরালো।
“আমাকে হারিয়ে দেখাও,পারলে,” গভীর কণ্ঠে বললো জ্যাসপার,চোখে একরকমের চ্যালেঞ্জের ঝলক।
ফিওনার গলা শুকিয়ে গেলেও সে নিজের সংকল্প ধরে রাখলো। সে কি সত্যিই প্রস্তুত? নাকি জ্যাসপার তাকে কেবল পরীক্ষা নিচ্ছে?
ফিওনা তলোয়ারটা হাতে নিয়ে চমকে উঠলো। জ্যাসপারের তলোয়ার সাধারণ তলোয়ারের মতো নয়—এটা ভারী, তীক্ষ্ণ, আর পুরোপুরি ভারসাম্যপূর্ণ। সে তলোয়ার ধরতেই তার ওজন অনুভব করলো, বুঝতে পারলো এটা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে না।
জ্যাসপার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি টেনে বললো, “তোমার তো অনেক আত্মবিশ্বাস, তাই না? তাহলে আমাকে হারিয়ে দেখাও। যদি পারো, তাহলে মেনে নেবো তুমি সত্যিই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।”
ফিওনা গভীর শ্বাস নিলো, তার দৃষ্টিতে অটল সংকল্প। সে পা শক্ত করে মাটিতে গেঁথে ধরলো, তলোয়ারটা সোজা করে জ্যাসপারের দিকে তাকালো।
“ঠিক আছে,” সে বললো, “দেখাচ্ছি আমি কতোটা শিখেছি!”
জ্যাসপার এক মুহূর্তে তার তলোয়ার তুললো, এবং কোনো হালকা আঘাত নয়—সে সত্যিকারের একটা ভারী আক্রমণ করলো, যেনো ফিওনার দক্ষতা পরীক্ষা করাই তার উদ্দেশ্য। ফিওনা দ্রুত সরে গেলো, তলোয়ার দিয়ে আঘাত প্রতিহত করলো, কিন্তু তলোয়ারগুলোর সংঘর্ষে সে কিছুটা পেছনে সরে গেলো।
“হু… বেশ ভালো,” জ্যাসপার বললো, “কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়!”
তারপরই সে আরও দ্রুত গতিতে আক্রমণ শুরু করলো, প্রতিবারই ফিওনাকে আঘাত প্রতিহত করতে বাধ্য করলো। ফিওনা জানতো এটা শুধু পরীক্ষা নয়—জ্যাসপার সত্যি তাকে কিছু শিখাতে চাইছে।
“তুমি কেবল আঘাত প্রতিহত করছো, ফিওনা! আক্রমণ করো!”
ফিওনার চোখ জ্বলে উঠলো। সে একটা ফাঁক দেখে দ্রুত সামনে এসে আঘাত হানলো, কিন্তু জ্যাসপার অনায়াসে সেটা ঠেকিয়ে দিলো।তার গতি, তার প্রতিক্রিয়া—সবকিছু এতটাই নিখুঁত যে ফিওনা বুঝতে পারলো, জ্যাসপারকে হারানো সহজ নয়।
কিন্তু সে হার মানতে চায় না।
“আমি আপনাকে হারিয়ে দেবো!”—ফিওনা দৃঢ় কণ্ঠে বললো, তারপর তলোয়ার শক্ত করে ধরে নতুন কৌশল নিয়ে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হলো।
জ্যাসপার হাসলো।”অল দা বেস্ট ,হামিংবার্ড।”
ফিওনা দ্বিতীয় আঘাত হানলো,কিন্তু জ্যাসপার অবলীলায় সেটাও ঠেকিয়ে দিলো। তাদের অস্ত্রের সংঘর্ষে ধাতব শব্দ আবার প্রতিধ্বনিত হলো প্রশিক্ষণ কক্ষে।জ্যাসপার একের পর এক নিখুঁত আক্র*মণে ফিওনাকে প্রতিরোধে বাধ্য করলো পুনরায়।
ফিওনা এবার ও বুঝতে পারছিলো,সে সত্যিই এখনও জ্যাসপারের পর্যায়ে আসেনি।কিন্তু সে এখন ও হার মানবেনা!
“এতো সহজে হার মেনে যাবো ভেবেছেন?” ফিওনা বললো, তারপর দ্রুত বাঁদিকে সরে এক নিখুঁত গতিতে তলোয়ার চালালো।জ্যাসপার অল্পের জন্য সেটা এড়িয়ে গেলো,তার চোখে হালকা বিস্ময় ফুটে উঠলো।
“হুঁম,বেশ ভালো চেষ্টা,” সে বললো,তারপর নিমেষেই গতি বাড়িয়ে দিলো।
জ্যাসপার এবার সত্যিকারের প্রতিপক্ষের মতো আক্রমণ করলো—তাদের তলোয়ারের টকাটক শব্দ কক্ষে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো,একের পর এক শক্তিশালী আঘাতে ফিওনাকে বাধ্য করছিলো প্রতিরোধ করতে।
একসময় জ্যাসপার এক লাফে তার পেছনে এল, ফিওনার তলোয়ার নিচের দিকে নামিয়ে দিয়ে তাকে দেয়ালের দিকে ঠেলে দিলো।
তারপর এক ঝটকায় ফিওনার তলোয়ার ছিটকে গেলো দূরে।
ফিওনা শ্বাসকষ্টে হাঁপাচ্ছিলো, জ্যাসপার নিখুঁত নিয়ন্ত্রণে ছিলো। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, চোখে সেই পরিচিত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, আর এক হাতে তলোয়ার রেখে অন্য হাতে ফিওনার থুতনি তুললো।
“এখনো বাচ্চা তুমি, বুঝতে পেরেছো?” জ্যাসপার গভীর গলায় বললো, “তুমি যুদ্ধের জন্য তৈরি নও, হামিংবার্ড।”
ফিওনার রাগে শরীর গরম হয়ে উঠলো। সে হাল ছাড়ার মেয়ে নয়!
“আপনি যদি সত্যিই আমাকে পরীক্ষা করতে চান, তাহলে ঠিকঠাক লড়াই করুন!”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ তার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ, তার ঠোঁটে সেই দুষ্টু হাসি ফুটে উঠলো।
“আচ্ছা, তাহলে তোমার আরেকটা সুযোগ দিলাম, হামিংবার্ড,” সে বললো, “কিন্তু যদি হেরে যাও, তাহলে শাস্তি হিসেবে আমার কথা শুনতে হবে।”
ফিওনা চোখ সরু করলো, “কী শাস্তি?”
জ্যাসপার এগিয়ে এসে তার মুখের খুব কাছে ঝুঁকে পড়লো, ফিওনার হৃদয়প্রবাহ মুহূর্তেই দ্রুত হয়ে গেলো।
“তা পরে বলবো,” সে ফিসফিস করে বললো, “তবে হেরে গেলে তোমার জন্য সুখকর হবে না।”
ফিওনার বুক ধক করে উঠলো। কিন্তু সে পিছু হটলো না।
“দেখাই তাহলে,” সে বললো, “কেউ হারে, আর কেউ হার মানে। আমি হার মানবো না।”
জ্যাসপার মৃদু হেসে বললো, “দেখা যাক,মাই হামিংবার্ড।”
ফিওনা নিঃশ্বাস ফেললো, তলোয়ারটা শক্ত করে ধরে রাখলো, কিন্তু তার হাতের মৃদু কম্পন লুকানো যাচ্ছিল না।
জ্যাসপার তখন এগিয়ে এসে গভীর দৃষ্টিতে ফিওনার চোখে তাকালো। তার কণ্ঠ ছিল কঠিন, অথচ একধরনের অদ্ভুত মগ্নতা তাতে মিশে ছিল।
“তুমি জানো, তুমি কেন বারবার আমার কাছে হেরে যাও?” সে ধীর স্বরে বললো, যেন প্রতিটি শব্দের ওজন বোঝাতে চাইছে। “কারণ তুমি আমার কাছে আসলেই দুর্বল হয়ে যাও।”
ফিওনা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। সে নিজেই জানতো, কথাটা সত্যি। জ্যাসপারের সামনে দাঁড়ালেই তার আত্মবিশ্বাস টলে যায়, চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে যায়।
জ্যাসপার তলোয়ারটা সামান্য ওপরের দিকে তুললো, তীক্ষ্ণ ধাতব ঝলক খেললো আলোয়।
“আর তোমার এই দুর্বলতার কারণটাই হচ্ছে তোমার পরাজয়।” সে কঠিন কণ্ঠে বললো। “মনে রাখবে, তলোয়ার চালানোর সময় তোমার লক্ষ্য স্থির থাকবে। তলোয়ারের ওপাশের ব্যক্তিকে তুমি শত্রুর চোখে দেখবে—সে যেই হোক, যতই ভালোবাসার মানুষ হোক না কেনো।”
ফিওনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো, বুকের ভেতর কিছু একটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সে কি পারবে সত্যিই জ্যাসপারকে শত্রুর চোখে দেখতে?
মনের কথা মনেই রেখে ফিওনা তখন দৃঢ় কণ্ঠে বললো, “আমি মোটেও আপনার কাছে আসলে দুর্বল হয়ে যাই না।”
জ্যাসপার ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে এলো, চোখেমুখে একধরনের রহস্যময় অভিব্যক্তি।তার ঠোঁটের কোণে এক চাপা হাসি ফুটে উঠলো,যেন সে আগেই এই উত্তরটা আশা করেছিল।
“ও তাই?” সে হালকা স্বরে বললো, কিন্তু কণ্ঠে একধরনের ব্যঙ্গ লুকিয়ে ছিলো। “ঠিক আছে, তাহলে তোমার দুর্বলতার পরীক্ষা নেওয়া যাক।”
ফিওনার হৃদস্পন্দন মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো। তার আঙুলগুলো একসঙ্গে কুঁচকে এলো, সে নিজের অজান্তেই শক্ত করে মুঠো গেঁথে ফেললো।
“কি পরীক্ষা?” ফিওনা অবশেষে বললো, কিন্তু কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস থাকলেও, কোথাও যেন একধরনের অস্থিরতা লুকিয়ে ছিলো।
জ্যাসপার কোনো উত্তর দিলো না, শুধু তার চোখ দুটো গভীর, গাঢ় স্বর্ণাভ আভায় ঝলসে উঠলো।
জ্যাসপার ফিওনার হাত ধরে দৃঢ় পদক্ষেপে পাশে আরেকটি কক্ষে নিয়ে গেলো।এটি ছিলো জ্যাসপারের একান্ত ব্যক্তিগত গোসলখানা,যেখানে রাজকীয় বাথটাবটি জলভরা অবস্থায় অপেক্ষা করছিলো।আলো কম ছিলো,সামান্য মোমবাতির আলো জলের ওপরে প্রতিফলিত হচ্ছিলো,দেয়ালে ছায়া-আলো খেলছিলো রহস্যময় ছন্দে।
ফিওনা কিছুটা দ্বিধায় পড়লো, “আপনি আমাকে এখানে কেনো এনেছেন?”
জ্যাসপার ফিওনাকে সামনে দাঁড় করিয়ে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললো,”আমি এখন যা যা করবো,তুমি একদম চোখ দিয়ে দেখবে। এক নজরে,পলকহীনভাবে।তোমার দৃষ্টি আমার ওপর রাখতে হবে,হামিংবার্ড।”
সে ধীরে ধীরে নিজের শার্টের বোতাম খুলতে লাগলো, একবারে একবারে।ফিওনার বুকের ভেতর উত্তেজনায় ধক ধক করছিলো,কিন্তু সে মুখ শক্ত করে থাকলো।
“আর যদি এক ফোঁটা চোখ সরিয়ে নাও আমি বলার আগে, তাহলে তুমি হেরে যাবে,” জ্যাসপার আরও এগিয়ে এলো, তার স্বাভাবিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুটা রহস্য লুকিয়ে ছিলো।
ফিওনার শ্বাস কিছুটা দ্রুত হয়ে গেলো,কিন্তু সে তার চোখ সরালো না।
গভীর নীরবতার মধ্যে সময় ধীর গতিতে বয়ে চললো…
ফিওনা দাঁড়িয়ে আছে স্থির হয়ে, কিন্তু বুকের ভেতর যেনো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। জ্যাসপার ধীরে ধীরে নিজের শার্ট খুলে ফেললো, মসৃণ ত্বকে জলকণা ঝিলমিল করছিলো। তার শক্তপোক্ত গঠন, উজ্জ্বল অলিভ গ্রিন চোখ—সব মিলিয়ে এমন দৃশ্য যা ফিওনাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে।
জ্যাসপার নির্বিকার ভঙ্গিতে বাথটাবে বসে পড়লো,পা দুটো সামনে টান করে দিলো।বাথটাবের চারপাশে থাকা সাদা, ফিনফিনে পর্দাগুলো বাতাসে দুলছিলো,মাঝেমধ্যে আলো-ছায়ার খেলা ফিওনার চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিচ্ছিলো।
ফিওনা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো,কিন্তু ভিতরে ভিতরে অনুভূতির ঢেউ আছড়ে পড়ছিলো।অদ্ভুত একটা লজ্জা, অস্বস্তি—একসাথে সবকিছু মিশে এক অজানা উত্তেজনার স্রোত বইয়ে দিচ্ছিলো শরীরে।চোখ সরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছিলো,কিন্তু সেটাই তো হবে তার হার।
জ্যাসপার জল ছিটিয়ে হাত চালালো,তারপর ঠাণ্ডা কণ্ঠে বললো, “তুমি কি এখনো চোখ সরাবে না,হামিংবার্ড?”
ফিওনার গলা শুকিয়ে গেলো,কিন্তু সে মাথা উঁচু করে তাকিয়েই রইলো।এবার হার মানবে না।
জ্যাসপার শান্ত ভঙ্গিতে নিজের শরীরে বডি ওয়াশ মাখতে লাগলো,হাত ধীরে ধীরে গড়িয়ে চললো গলা থেকে বুক, তারপর পেটের দিকে।তার প্রতিটি নড়াচড়া যেনো খুব স্বাভাবিক,অথচ এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে ফিওনার নিঃশ্বাস আটকে আসছিলো।
ফিনফিনে সাদা পর্দাগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছিলো,গরম পানির হালকা ভাপ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিলো।জ্যাসপার এবার হ্যান্ড শাওয়ার হাতে নিয়ে নিজের গায়ে পানি ঢাললো, আর ফিওনা দেখতে পেলো পানির ধারা বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে তার পেশিবহুল শরীর বেয়ে।
ফিওনা ঠোঁট চেপে ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।তার ভেতরে যেন ঝড় বইছে, কিন্তু মুখে কোনোভাবেই সেটা প্রকাশ হতে দিচ্ছে না।সে দু’হাত দিয়ে নিজের স্কার্ট আঁকড়ে ধরলো, আঙুলগুলো কাপড়ে শক্ত হয়ে বসে গেলো।
কিন্তু তার চোখ?এক মুহূর্তের জন্যও দৃষ্টি সরালো না জ্যাসপার থেকে।
জ্যাসপার তখন চোখের কোণে তাকিয়ে একটা হাসি চাপতে চাইলেও ঠোঁটের কোণে সামান্য বাঁক খেলে গেলো।তারপর গভীর গলায় বললো, “তুমি সত্যিই হার মানবে না,তাই তো?”
ফিওনা কেবল এক মুহূর্ত শ্বাস নিলো,কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না।এখনো স্থির দাঁড়িয়ে,চোখ সরানোর কোনো ইচ্ছে নেই তার।
জ্যাসপার তখন বাথটাব থেকে উঠে এলো।টাওয়াল দিয়ে মাথার ভেজা চুল মুছতে মুছতে ফিওনার দিকে এক ঝলক তাকালো।তার ঠোঁটের কোণে সেই চিরচেনা দুষ্টু হাসি। তারপর হঠাৎ হাত বাড়িয়ে প্যান্টের বেল্টের বকলস খুলতে গেলো।
“স্টপ ইট!”
ফিওনার গলা কাঁপছিলো,কিন্তু তবুও সে জোর দিয়ে বললো। সঙ্গে সঙ্গে সে ঘুরে দাঁড়ালো,যেনো কিছুই আর দেখতে না হয়। কিন্তু তার কানের পাশ দিয়ে জ্যাসপারের চাপা হাসির শব্দ ভেসে এলো।
সে স্পষ্টই অনুভব করতে পারলো জ্যাসপার তার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,যেন সে এটা করবেই জানতো।
“তাহলে শেষমেশ হেরে গেলে,হামিংবার্ড?” জ্যাসপার ধীর স্বরে বললো,কণ্ঠে একরকম বিজয়ের সুর।
ফিওনা কিছু বললো না,শুধু চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলো।তার সমস্ত শরীর উত্তপ্ত লাগছিলো,যেনো একরকম অদৃশ্য আগুনে পুড়ছে।
জ্যাসপার তখন একদম কাছে এসে ফিসফিস করে বললো, “পরীক্ষা এখানেই শেষ।কিন্তু মনে রেখো,তোমার দুর্বলতা এখানেই।”
ফিওনা এবার মুখ তুলে তাকালো,তার চোখে ছিলো একরাশ রাগ আর জেদের ছাপ।
জ্যাসপার এক ঝটকায় ফিওনাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। ফিওনার নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে ভারী হয়ে আসছিল, যেন বুকটা আটকে গেছে।
জ্যাসপার তার মুখ নামিয়ে আনলো,ফিওনার কানের কাছে গরম শ্বাস ফেললো।তারপর ধীরে ধীরে তার ঠোঁট গলার কাছে নিয়ে এলো,একদম ছুঁয়ে ফেলার মতো,কিন্তু ছুঁলো না।
ফিওনার শরীর কেঁপে উঠলো,শ্বাস আটকে আসছিলো।সে বাধ্য হয়ে চোখ বন্ধ করলো এক মুহূর্তের জন্য,কিন্তু সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার চোখ খুললো।
জ্যাসপার এবার তার ঠোঁট নিয়ে নামলো আরো নিচে, ফিওনার ঘাড়ের কাছে এসে ছুঁই ছুঁই করতে লাগলো,যেন ইচ্ছে করেই তাকে অস্থির করে তুলছিলো।
ফিওনা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো,কিন্তু মনে হচ্ছিলো,তার সমস্ত স্নায়ু একসাথে জেগে উঠেছে।জ্যাসপার একটু হেসে ফিসফিস করে বললো,
“তুমি তো বলেছিলে দুর্বল হয়ে যাও না,হামিংবার্ড… তাহলে এখন নিঃশ্বাস নিতে এত কষ্ট হচ্ছে কেন?”
জ্যাসপার তার ঠোঁট ফিওনার কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বললো,”তুমি হেরে গেছো, হামিংবার্ড। এবার আমি যা বলবো,তাই করতে হবে তোমাকে!”
ফিওনা তার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো,যদিও তার বুক ধকধক করছিল। “কি করতে হবে আমাকে?”—তার কণ্ঠস্বর শক্ত ছিল,কিন্তু জ্যাসপার তার ভেতরের অস্থিরতা টের পাচ্ছিলো।
জ্যাসপার হালকা হাসলো, যেন সে পুরো পরিস্থিতি উপভোগ করছে।তার চোখে শিকারির মতো এক দৃষ্টি খেলা করছিলো, আর ফিওনার মনে হলো,সে জ্যাসপারের এই খেলায় পা দিয়েই ফেলেছে।
ফিওনা ধাক্কা মেরে জ্যাসপারকে সরিয়ে দিলো,চোখে কঠোর দৃষ্টি নিয়ে বললো,”কি করতে হবে সেটা বলুন।শর্ত অনুযায়ী সেটাই করবো।”
জ্যাসপার একপাশে দাঁড়িয়ে গলায় ঝোলানো তোয়ালেটা সামান্য ঠিক করলো,তারপর একদম নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, “আমিতো অন্য কিছু বলবো,কিন্তু আপাতত তুমি আমার জন্য সুমাত্রা ডার্ক রোস্ট কফি বানিয়ে দাও।তোমার হাতের সেই কফি অনেকদিন খাইনি।মাউন্টেন গ্লাস হাউজে থাকতে প্রতিদিন খেতাম।আই মিস দিজ টেস্ট।”
ফিওনা বিরক্ত হয়ে এক ধাপ পেছনে সরে গেলো।তার কণ্ঠে স্পষ্ট অস্বস্তি, “আমি এখন কফি বানাবো?আর তাছাড়া আপনার প্রাসাদে কেউ জানে না আমি এখানে আছি।
যদি কেউ দেখে ফেলে?”
জ্যাসপার ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটিয়ে বললো, “সে তোমার চিন্তার বিষয় নয়,হামিংবার্ড।ড্রাকোনিস প্রাসাদে নেই, আর বাকিরা দেখলে কোনো সমস্যা নেই।কারন তারা আমার বিষয়ে একদম নাক গলানোর সাহস করবেনা।
ফিওনা এক মুহূর্ত জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর ধীর কণ্ঠে বললো, “ঠিক আছে। কিচেন কোথায়?”
জ্যাসপার ততোধিক স্বাভাবিকভাবে বললো, “আমার পেছন পেছন আসো।”
সে সামনে এগিয়ে চললো, ফিওনা বাধ্য হয়ে অনুসরণ করলো। রঙ বেরঙের দামি হিরা আর পাথরের তৈরি সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে ফিওনার মনে হচ্ছিল, যেন সে কোনো স্বপ্নরাজ্যে পা ফেলছে। চারপাশের দেয়ালে খোদাই করা সূক্ষ্ম নকশা, ঝাড়বাতির স্বচ্ছ আলোয় চিকচিক করা সোনার কারুকাজ—সবকিছু যেন রাজকীয়তার এক অনন্য উদাহরণ।
তারা এক বিশাল ড্রইংরুমের হল পেরিয়ে গেলো,যেখানে মার্বেলের মেঝেতে প্রতিফলিত হচ্ছিলো বিশাল সব ঝাড়বাতির আলো।তার পাশেই ছিল কিচেন,যা এক কথায় অসাধারণ। দেয়ালগুলো জ্বলজ্বলে পান্না আর হীরার তৈরি, ওপরে কাঁচের ছাদ,যেখান থেকে ভেনাসের আকাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো।
ফিওনা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। তার মনে হলো, এটা কি সত্যিই একটা রান্নাঘর? নাকি কোনো জাদুর প্রাসাদের অংশ?
সে চাপা স্বরে বললো, “সত্যি, রূপকথার চেয়ে কম না এই ভেনাসের একেকটা রাজ্য…”
জ্যাসপার তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলো,এক মুহূর্ত ফিওনার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো,তারপর বললো, “তোমার কফি বানানোর জন্য যা যা দরকার, সব ওখানে আছে।এবার দেখা যাক,আমি আসলেই তোমার কফির স্বাদ মিস করাটা সার্থক হবে কিনা।”
ফিওনা তখন অসহায় ভঙ্গিতে বললো ”
আমি তো এই কফির রেসিপি জানিনা আর তাছাড়া আগে বানিয়ে থাকলেও আমার মনে নেই।
জ্যাসপার তখন সব উপকরণ গুছিয়ে রাখলো ফিওনার সামনে আর রেসিপি বলে দিলো খুব সুন্দর করে গুছিয়ে। ফিওনা মন দিয়ে শুনলো তারপর সে কাজে লেগে যায়।
ফিওনা হাতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলো,তার চুল আগে থেকে অনেকটা বড় তাই বারবার চুল তার চোখেমুখে এসে পড়ছিলো, যা তাকে বিরক্ত করছিলো।সে বিরক্তির সুরে চুল সরানোর চেষ্টা করছিলো,তখন হঠাৎই জ্যাসপার পেছন থেকে এসে চুল দুহাতে ধরে বাধতে লাগলো।
ফিওনা একটু কেঁপে উঠলো,তার শ্বাস যেন মুহূর্তের জন্য আটকে গেলো।জ্যাসপারের স্পর্শের উষ্ণতা সে অনুভব করছিলো নিজের ঘাড়ে।
জ্যাসপার ধীরে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,”তোমার চুল আগের থেকে অনেক বেশি বড় হয়ে গেছে।”
তারপর কানের সামনে ঝুঁকে এসে মৃদু স্বরে বললো,”আর তোমার গায়ের রং… যেন আরো বেশি জলজ্বল করছে।”
ফিওনা অনুভব করলো,তার হৃদস্পন্দন একটু দ্রুত হচ্ছে, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিলো।
জ্যাসপার এবার তার চুল গুছিয়ে বেঁধে দিলো,তারপর ধীর গতিতে ফিওনাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে আনলো।তার চোখ গভীরভাবে ফিওনার মুখের দিকে নিবদ্ধ হলো।
“চোখের মণিটাও যেন আরো বেশি ডার্ক ব্রাউন হয়েছে,” জ্যাসপার ফিসফিস করে বললো,”আর ঠোঁটজোড়া তো—”
ফিওনা সঙ্গে সঙ্গে তার কথার মাঝেই হাত তুললো,কঠোর কণ্ঠে বললো,”ভুলেও না!”
জ্যাসপার এক মুহূর্ত থমকে গেলো,তারপর ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি ফুটিয়ে তুললো।ফিওনার দৃঢ়তা যেন তাকে আরো বেশি আনন্দ দিচ্ছিলো।
ফিওনা চুপচাপ কফিটা বানিয়ে জ্যাসপারের দিকে বাড়িয়ে দিলো।জ্যাসপার নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কাপটা হাতে নিয়ে এক চুমুক দিলো।পরক্ষণেই তার চোখমুখ কুঁচকে গেলো।স্বাদ যেন প্রত্যাশার একদম বিপরীত!
কফিটা স্পষ্টতই খারাপ হয়েছে।কিন্তু জ্যাসপার কিছু না বলে ধীরগতিতে সেটি পান করে যেতে লাগলো।যদিও তার মুখের অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছিলো,এই কফি তার স্বাভাবিক ধৈর্যেরও পরীক্ষা নিচ্ছে।
ফিওনা এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো,তারপর বুঝতে পারলো—সে হয়তো ভুল উপকরণ দিয়ে ফেলেছে,কিংবা পরিমাণ ঠিক ছিলো না।
“আপনি কি রেসিপি ঠিকঠাক বলেছিলেন?” ফিওনা সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলো।
জ্যাসপার কাপটা নামিয়ে রেখে এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো, “হুম… আমার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না?”
ফিওনা একটু অপ্রস্তুত হলো,কিন্তু মুখ শক্ত রেখেই বললো, “তাহলে এতক্ষণ চুপ করে খাচ্ছেন কোনো? বললেই পারতেন যে খারাপ হয়েছে।”
জ্যাসপার হাসলো,”তোমার হাতের কফি তো অনেকদিন পর খেলাম,তাই ভাবলাম একটু ভিন্ন স্বাদ হলেও সহ্য করে নেই।”
ফিওনা বিরক্ত মুখে বললো, “তাহলে আরেকটা বানাবো?”
জ্যাসপার চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো, “না, না, তার চেয়ে বরং আমার জীবন রক্ষার জন্য একটু পানি এনে দাও!”
ফিওনা এবার সত্যি রেগে গেলো। “আপনার প্রাসাদে কি পানি নেই?”
জ্যাসপার মৃদু হাসলো, “আছে তো,কিন্তু তোমার হাত থেকে পানি খেলে বুঝতে পারবো তুমি কফির মতো ওটাও আলাদা টেস্ট বানিয়ে ফেলেছো কিনা!”
ফিওনা তখন জ্যাসপারের ওপর চেঁচাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো।এই ড্রাগন প্রিন্সটা কি ইচ্ছে করেই তাকে বিরক্ত করছে?
ফিওনা তখন প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, “আচ্ছা, এথিরিয়ন কোথায়? ওকে তো একা জঙ্গলে রেখে চলে এলেন?”
জ্যাসপার তখন বললো, “ও বাচ্চা ছেলে না, অলরেডি নিজের কক্ষে আছে।”
ফিওনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো,তবে চিন্তার রেখা এখনো কপালে স্পষ্ট। “ও তো অনেক আ*হত হয়েছে,আমি দেখে আসি?”
জ্যাসপার সঙ্গে সঙ্গে তার পথ আটকে দাঁড়ালো, চোখেমুখে কঠোর অভিব্যক্তি। “কোনো দরকার নেই। একটা অপরিচিত ছেলের বেডরুমে যাওয়ার কথা ভাবছো কেন?”
ফিওনা হতভম্ব হয়ে গেলো। “অপরিচিত?” তার কণ্ঠে অবিশ্বাস ঝরে পড়লো। “এথিরিয়ন তো আপনার নিজের ভাই!আমি শুধু দেখতে চাইছি ও কেমন আছে,এটাতে ভুলটা কোথায়?”
জ্যাসপার ঠান্ডা গলায় বললো,”ও আমার ভাই কিন্তু তোমার না।ও এতোক্ষণে ঠিক হয়ে গেছে।,তোমার যাওয়ার দরকার নেই।”
ফিওনার বিরক্তি এবার স্পষ্ট হলো। “আপনি এতটাই নির্দয়? আমি যদি আহত হতাম এথিরিয়ন কি আমাকে দেখতে আসতো না?”
জ্যাসপার ধীরপদক্ষেপে সামনে এগিয়ে এলো, ফিওনার খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। তার গভীর সবুজ চোখ দুটো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। “আমি বলেছি,তুমি যাবে না। মানে যাবে না।”
ফিওনা এক ধাপ পেছনে সরতে গিয়েও থেমে গেলো।তার ভিতরেও এক ধরনের একগুঁয়েমি জেগে উঠছিলো। “তাহলে আপনি ঠিক করে দিষ,আমি কোথায় যাবো,কাকে দেখবো, কাকে দেখবো না?”
জ্যাসপার এক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে রইলো, তারপর মৃদু গর্জনভরা কণ্ঠে বললো, “আমি এখন তোমাকে তোমার প্রাসাদে পৌঁছে দিচ্ছি,এই আলোচনায় এখানেই ইতি টানো।”
ফিওনার ভেতরটা রাগে ফুঁসছিলো,কিন্তু সে জানতো এখন কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।তবে একদিন সে ঠিকই জ্যাসপারের এই মালিকানাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গির জবাব দেবে!
জ্যাসপার তখন নিজের কক্ষে গেলো প্রস্তুত হতে। ফিওনা প্রাসাদের ড্রইংরুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। চারপাশের রাজকীয় সৌন্দর্য চোখে পড়লেও তার মনোযোগ ছিল অন্য কোথাও।
অল্প সময় পর সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো জ্যাসপার। সাথে সাথে বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো ভেনাসের বিখ্যাত এল্ড্র পারফিউমের ঘ্রাণ—খাঁটি চন্দন আর চন্দ্রমল্লিকার মোহময় সুগন্ধ।সেই গন্ধ যেন এক নিমেষে সমস্ত পরিবেশকে আচ্ছন্ন করে ফেললো,আর ফিওনার শ্বাস-প্রশ্বাস এলোমেলো হয়ে গেলো।
সে দ্রুত সামনে থাকা উপন্যাসের বই মুখের সামনে তুলে ধরলো,যেন নিজের প্রতিক্রিয়া লুকিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু বইয়ের পাতার ফাঁক দিয়ে চুপিচুপি তাকিয়ে দেখলো জ্যাসপারকে—সাদা শার্টের ওপর গাঢ় মেরুন রঙের ব্লেজারের রাজকীয় পোশাকে,গভীর চোখ আর নিখুঁত চেহারায় যেন এক অতিমানবিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ছে।
ফিওনা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো।সত্যিই মনে হচ্ছিল, কোনো রূপকথার রাজপুত্র প্রাসাদ থেকে নেমে আসছে। যদিও জ্যাসপার ভেনাসের রাজপুত্র,তবে পৃথিবীতে থাকলে হয়তো সব মেয়ের স্বপ্নের প্রিন্স চার্মিং হয়ে যেতো…
জ্যাসপার সোফার সামনে এসে স্থির দাঁড়িয়ে বললো,”চলো।”
ফিওনা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো,তবে এবার আর জ্যাসপারের দিকে তাকাতে সাহস পেল না।সে চুপচাপ তার পিছু নিলো।
প্রাসাদের বাইরে এসে ফিওনার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো। প্রায় এক ডজন ড্রাগন গার্ডস দাঁড়িয়ে ছিলো সারিবদ্ধভাবে। কিন্তু তাদের দেখে একদমই মনে হচ্ছিল না যে তারা কোনো ভিনগ্রহের প্রহরী। বরং তাদের পোশাক ছিল একদম পৃথিবীর মতো—কালো ব্লেজার, নিখুঁতভাবে বাঁধা টাই, শক্তপোক্ত গঠন, একেবারে কোনো অভিজাত সিকিউরিটি ফোর্সের মতো।
কিন্তু ফিওনার বিস্ময় তখন দ্বিগুণ হয়ে গেলো, যখন সে দেখলো প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি কালো মার্সিডিজ।
তার কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো।অবাক হয়ে ফিসফিস করে বললো,”ভেনাসে মার্সিডিজ!এটা এখানে এলো কীভাবে?”
জ্যাসপার একটু হাসলো,যেন সে এই প্রশ্নের জন্যই অপেক্ষা করছিলো।এরপর ধীর কণ্ঠে বললো, “এটা ভেনাসের মার্সিডিজ,তবে পৃথিবীর মতো সাধারণ গাড়ি নয়।এই গাড়ি সমুদ্রের গভীরতম তলদেশেও চলতে পারে,পানির উপরেও ভাসতে পারে,এমনকি আকাশের অসীম শূন্যতাতেও উড়তে পারে,হেলিকপ্টারের মতো।”
ফিওনার মনে হলো,সে যেন সত্যিই কোনো স্বপ্নের রাজ্যে এসে পড়েছে। এটা কি আসলেই সম্ভব?এমন প্রযুক্তি!
জ্যাসপার এবার গাঢ় কণ্ঠে বললো, “তাহলে বলো,তুমি কিভাবে সাফারি করবে?এই গাড়িতে সমুদ্রের গহীনে হারিয়ে যেতে চাও,নাকি আকাশের অসীমে উড়ে বেড়াতে?”
ফিওনা তখন কিছুক্ষণ ভেবে বললো,”আকাশে করে যাবো।”
জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য ফিওনার দিকে তাকালো,যেন তার উত্তরের মধ্যে কিছু খুঁজে দেখছে।তারপর সে কোনো কথা না বলে গাড়ির দিকে ইশারা করলো।
গার্ডরা সাথে সাথে গাড়ির দরজা খুলে দিলো। ফিওনা উঠে বসল,আর জ্যাসপার ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো।
গাড়ি স্টার্ট করার পর হঠাৎ এক ঝটকায় আকাশে উঠে গেলো।ফিওনা ভারসাম্য হারিয়ে জ্যাসপারের ব্লেজার খামচে ধরলো। বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিলো এবং বসে পড়লো ঠিক করে।আর চারদিক তাকিয়ে দেখলো—ভেনাসের সৌন্দর্য এক অন্য রকম দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
উপর থেকে পুরো রাজ্যটা যেন এক রূপকথার স্বপ্নরাজ্য মনে হচ্ছে—রঙিন অগ্নিপিণ্ডের মতো পাহাড়, ঘন সবুজ গহীন অরণ্য, আর আকাশজুড়ে লালচে সোনালি আভা।
ড্রাগন রূপে থাকলেও এত স্থিরভাবে এই সৌন্দর্য দেখা যায় না, কিন্তু এখন সে একেবারে স্বচ্ছভাবে দেখতে পাচ্ছে। ফিওনা আপন মনে, এক অদ্ভুত আনন্দ নিয়ে চারপাশ দেখতে লাগলো।
জ্যাসপার একপলক ফিওনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “Are you feeling happy?” (আর ইউ ফিলিং হ্যাপি?)
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৯
ফিওনা হালকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
জ্যাসপার তখন বাঁ হাত বাড়িয়ে ফিওনার ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে দিলো।
ফিওনা বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকালো।
জ্যাসপার মৃদু হাসলো, “If you stay with me, I will always keep you happy, Hummingbird.” (ইফ ইউ স্টে উইথ মি, আই উইল অলওয়েজ কিপ ইউ হ্যাপি,হামিংবার্ড।)
ফিওনার মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লো।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়,এবার সে চাইলেও জ্যাসপারের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে পারলো না…