আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১১
সাবিলা সাবি
জ্যাসপার নিজের কক্ষে বসে আছে।চারপাশে আধো-আলো, সামনে একটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিন ভাসছে,যেখানে কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করছে সে।হাতে ধরা কফির কাপে ধোঁয়া উঠছে, কিন্তু তার মন অন্য কোথাও।কফির স্বাদ বুঝতে পারছে না, কারণ তার ভাবনা একটাই— তার হামিংবার্ড ফিওনা।
সে নিজেও বুঝতে পারছে না,কেন প্রতিটা মুহূর্ত তার মনের কোণে ফিওনার মুখ খোদাই হয়ে যাচ্ছে।এক মুহূর্তের জন্য নিজের উপর বিরক্ত হলো।
ঠিক তখনই দরজা খুলে গেলো।
“জ্যাসপার মাই সান।”
গভীর,ভারী কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝতে পারলো— ড্রাকোনিস প্রবেশ করেছে।
জ্যাসপার মুখ তুলে তাকালো।তার বাবা ধীর পায়ে এসে একটি ডিজিটাল ফাইল তার সামনে রাখলেন।
“তোমাকে ল্যাবে যেতে হবে। নতুন মিশন আছে।”
জ্যাসপার ভ্রু কুঁচকে বললো, “কিসের মিশন?”
ড্রাকোনিস সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,”সূর্যপাথরকে অন্য গ্রহে সুরক্ষিত রাখতে হবে।এটি নিয়ে শনি গ্রহের উপগ্রহ ‘টাইটান’-এ কিছু অদ্ভুত প্রাণীর গতিবিধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা হয়তো এটি চুরি করার পরিকল্পনা করছে।যদি পাথর তাদের হাতে পড়ে,তবে ভেনাস চিরতরে রাত হারিয়ে ফেলবে।”
জ্যাসপার ফাইলের দিকে তাকালো,তারপর ধীরে ধীরে কফির কাপে চুমুক দিলো।
“এই মিশন অন্য কাউকে দিন,” সে কঠিন স্বরে বললো। “আমি ফিওনাকে ছাড়া এক মুহূর্তও কোথাও যাব না।”
ড্রাকোনিস গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন।তারপর ধীর কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “ভেনাসের অন্য কোনো ড্রাগনের কি সেই ক্ষমতা আছে,যা তোমার আছে?কেউ কি পারবে অন্য গ্রহে গিয়ে এই মিশন সম্পন্ন করতে?”
জ্যাসপার চুপ।
“তুমি ভেনাসের প্রিন্স,এটা ভুলে যেও না,” ড্রাকোনিস আবার বললেন। “এই দায়িত্ব তোমারই।যদি তুমি ব্যর্থ হও,তবে শুধু ভেনাস নয়,পুরো সৌরজগৎ ঝুঁকির মুখে পড়বে।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ নীরব রইলো। তারপর গভীর নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। “ঠিক আছে, আমি যাব,” সে ধীর স্বরে বললো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জ্যাসপার দ্রুত ল্যাবে প্রবেশ করলো।বিশাল গ্লাসের দেয়াল ঘেরা কন্ট্রোল রুম,চারপাশে নানা রঙের হোলোগ্রাফিক স্ক্রিন ভাসছে,কিছুতে তার আগের মিশনগুলোর তথ্য,কিছুতে বর্তমান গবেষণা।তার সামনে স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে গেল, ভিতরে ঢুকতেই স্ক্যানার তার পরিচয় শনাক্ত করলো।
“সিস্টেম,মিশন স্যাটার্ন-২৯ খুলে দাও,” জ্যাসপার বললো।
একটা ব্লু-হোলোস্ক্রিন ভেসে উঠলো,যেখানে বিশদ তথ্য ছিল:
লক্ষ্য: সূর্যপাথরকে নিরাপদ স্থানে সরানো।
গন্তব্য: স্যাটার্নের (শনি) উপগ্রহ টাইটান।
সম্ভাব্য বিপদ: অজানা প্রাণীর গোপন চলাফেরা
সময়কাল: আনুমানিক ২০ দিন (ভেনাসের সময় অনুযায়ী)
সূর্যপাথর: এক মহাজাগতিক শক্তি….
জ্যাসপার চোখ সরিয়ে স্ক্রিনের আরেক অংশে তাকালো— যেখানে সূর্যপাথরের ৩ডি মডেল ভাসছিল।
এটি দেখতে অনেকটা হেক্সাগোনাল স্ফটিকের মতো, কিন্তু একেবারে স্বচ্ছ নয়— এর ভিতরে নিরবিচারে আগুনের মতো দ্যুতি খেলা করে। কখনও এটি লালচে হয়,কখনও স্বর্ণাভ হয়ে ওঠে।
কাজ: সূর্যপাথর ভেনাসের রাত-দিনের ভারসাম্য রক্ষা করে।
এটি সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিকে নিয়ন্ত্রণ করে,যাতে ভেনাস চিরকাল আলোকিত না থাকে।কারন ভেনাসের আবহাওয়া সবসময় দিন থাকে।খুব কমদিন রাত হয় তাই এই পাথরের কারনে ভেনাস পৃথিবীর মতোই রাত দিন হয়।
পাথরটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শক্তি শোষণ ও নির্গমন করতে পারে,যা ভেনাসের পরিবেশকে জীবন ধারণের উপযোগী রাখে।
কিন্তু যদি এটি নষ্ট হয় বা অন্য গ্রহের হাতে চলে যায়,তাহলে—
ভেনাসে রাত আর কখনও আসবে না— মাসের পর মাস শুধু দিন থাকবে।
অতি তাপের কারণে বাতাসের ঘনত্ব বদলে যাবে, যা হয়তো প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন করবে।
অন্য কোনো শক্তিশালী সভ্যতা যদি এটি কাজে লাগায়, তবে তারা সৌরজগতের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
প্রস্তুতি: মিশনের জন্য কী কী লাগবে?
জ্যাসপার দ্রুত তার হাই-টেক কম্পিউটারে হিসাব কষতে লাগলো:
প্রটেকশন শিল্ড: সূর্যপাথরের বিকিরণ খুব শক্তিশালী,বিশেষ ধাতব বর্ম লাগবে।
শূন্য মহাকর্ষের জন্য ম্যানুভারিং সিস্টেম: টাইটান গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ কম,তাই ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ওয়েপন ডিফেন্স:যদি অন্য গ্রহের শত্রুরা ওত পেতে থাকে, তাহলে লেজার ব্লেড আর আয়নিক শক ওয়েভের দরকার হবে।
নতুন পরিবেশের জন্য অ্যান্টি-টক্সিন ইউনিট: টাইটানের বাতাসে বিষাক্ত গ্যাস আছে, এজন্য ফিল্টার প্রয়োজন।
সবকিছু লিস্ট করে নিলো।
তারপর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।এবার তার যাওয়ার পালা।কিন্তু মনে একটাই প্রশ্ন— ফিওনাকে ছাড়া সে কি এই মিশনে মন দিতে পারবে?
জ্যাসপার আর ভাবলো না।কালকের মধ্যেই তাকে রওনা দিতে হবে, আর এখনো ফিওনার সাথে দেখা হয়নি।শেষবার দেখা হয়েছিল তিন দিন আগে,তখনও সে জানতো না,এত দীর্ঘ একটা মিশনে যেতে হবে।
সে সরাসরি ফ্লোরাস রাজ্যে যেতে চায়নি,কারণ সেখানে গেলেই অ্যালিসা বিরক্ত করবে।অ্যালিসার সন্দেহপ্রবণ চোখ, অহেতুক প্রশ্ন আর চাপিয়ে দেওয়া দায়িত্বগুলো সে এখন এড়িয়ে যেতে চায়।
তাই সে সহজ পথ বেছে নিল— ড্রাগন রূপে রওনা দিলো, ফিওনার বারান্দার দিকে।
রাতের আকাশ নীলচে-সোনালি আলোয় ভাসছিল।ভেনাসের আকাশ এমনই— চাঁদ নেই,কিন্তু সূর্যপাথরের বিচ্ছুরণে রাতের অন্ধকার গভীর হয় না।
জ্যাসপার নিজের ড্রাগন রূপ ধারণ করলো।বিশাল ডানা মেলে সে বাতাসে উঠলো,হাওয়ার গতি তার শরীর ছুঁয়ে গেল, সবুজ সোনালী আঁশের গায়ে রাতের আলো প্রতিফলিত হলো।
ফ্লোরাস রাজ্য এখনো দূরে,কিন্তু ওর বারান্দার অবস্থান সে ভালোই জানে।ওর গন্ধ,ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্ষীণ ছোঁয়া পর্যন্ত অনুভব করতে পারে।
“… ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি,হামিংবার্ড?” জ্যাসপার নিজের মনে হাসলো।
সে ধীরে ধীরে ওর জানালার কাছে নামতে লাগলো,যাতে কেউ টের না পায়।কিন্তু সে জানে,ফিওনা এত সহজে টের না পেয়ে থাকলে সেটা বিস্ময়ের ব্যাপার হবে।
জ্যাসপার নরমভাবে বারান্দায় নামলো,বাতাসে তার গায়ের
ব্ল্যাক শার্টের ওপরে বাদামী রঙের ওভারকোটের ছায়া দুলে উঠলো।ঠিক তখনই পাশের একটা ফুলদানি টলে গিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো—
ঠাস!
শব্দটা নিস্তব্ধ রাতের মধ্যে কাঁপিয়ে তুললো পরিবেশ। জ্যাসপার দ্রুত পেছন ফিরে তাকালো,কিন্তু তখনই বারান্দার কাচের দরজা সরিয়ে কেউ একজন ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো।
জ্যাসপার নিশ্চিন্ত ছিল,ফিওনাই আসবে।
কিন্তু সামনে এসে দাঁড়ালো অ্যালিসা।
জ্যাসপার চোখ সরু করলো,অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করলো না।
অ্যালিসা হাতে একটা ওয়াইনের গ্লাস ধরে রেখেছে,চোখ দুটো কিছুটা বিদ্রুপে ভরা।
— “তুমি এত রাতে এখানে?” অ্যালিসা ধীরে ধীরে বললো, গ্লাসটা হাতের আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে।
জ্যাসপার ঠোঁট বাঁকিয়ে তাকালো,বুঝতে পারছে না ফিওনার কক্ষে অ্যালিসা কী করছে।
— “প্রশ্নটা আসলে তোমার করা উচিত নয়,” জ্যাসপার নির্লিপ্ত স্বরে বললো।
অ্যালিসা এবার সামান্য হাসলো,কিন্তু চোখে ঈর্ষা লুকোনো নেই।
— “ফিওনা এখানে নেই।”
জ্যাসপার এবার ভ্রু কুঁচকালো।
— “সে কোথায়?”
অ্যালিসা এবার মৃদু হেসে বললো,”আমি কীভাবে জানবো? তবে,তবে আপনি এসে ভালোই করেছেঞ প্রিন্স।আজকে আমরা সারারাত গল্প করবো একসাথে।”
জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য কিছু বললো না।তারপর, একধরনের শীতল অভিব্যক্তি নিয়ে বারান্দা থেকে পা সরিয়ে নিলো।
— “তুমি বোধহয় ড্রাঙ্ক,আমি এখন যাই।”
এটা বলেই সে দ্রুত সরে যেতে চাইল,কিন্তু অ্যালিসা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো।
— “আমি ড্রাঙ্ক নই।আপনার এত তাড়া কিসের?
নাকি আপনি ভয় পাচ্ছন?”
জ্যাসপার এবার এক ঝলক হেসে ফেললো।
— “ভয়? আমি?”
সে এবার ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, অ্যালিসার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো—
— “ফিওনাকে আমার দরকার,অ্যালিসা।ওর সাথে কিছু জরুরী কথা বলতে এসেছিলাম।”
অ্যালিসার মুখ এবার কালো হয়ে গেলো।
জ্যাসপার অ্যালিসার চোখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই বুঝে গেল— ড্রাকোনিস এখনো কিছু জানায়নি।
অ্যালিসার চোখে এখনো আশা আছে,এখনো সে ভেবে বসে আছে তারা বিয়ে করতে চলেছে।
জ্যাসপার মুখে কোনো ভাব প্রকাশ করলো না,কিন্তু মনে মনে বিরক্ত হলো।সে কিছু বলতে যাবার আগেই অ্যালিসা তার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললো ড্রইং রুমের দিকে।
— “চলুন,বাবা আপনাকে দেখতে চাইবে।”
জ্যাসপার একটু চমকালো,তবে নিজেকে দ্রুত সামলে নিলো।
ড্রইং রুমের দরজা খুলতেই,সামনে বসে থাকা রাজা জারেন আর ফিওনার মা লিয়ারা অবাক হয়ে তাকালেন।
কেউই মেইন দরজা দিয়ে কাউকে আসতে দেখেনি,তাহলে জ্যাসপার কখন এল?
জারেন কপালে ভাঁজ ফেললেন,গম্ভীর স্বরে বললেন—
— “জ্যাসপার,তুমি কখন এলে?”
জ্যাসপার কিছু বলার আগেই অ্যালিসা উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে উঠলো—
— “বাবা,উনি আমার সঙ্গে দেখা করতে বারান্দা দিয়ে এসেছেন।”
লিয়ারার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো।
জারেন এবার একদৃষ্টিতে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে রইলেন,যেন কিছু অনুমান করার চেষ্টা করছেন।
জ্যাসপার জানতো অ্যালিসা তার আগের মতোই দাবি করছে,তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক আছে।কিন্তু এখনো তার বাবা ড্রাকোনিস ঘোষণা না করায়,রাজা জারেনও কোনো সন্দেহ করেননি।
সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো,পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো।
লিয়ারা হাসিমুখে জ্যাসপারকে বসতে বললো।
— “বসো জ্যাসপার,অনেকদিন পর এলে! তুমি নিশ্চয়ই অনেক ক্লান্ত,আমি তোমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসছি। হবু জামাই বলে কথা!”
জ্যাসপার কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো।সে বুঝতে পারছিলো,ফিওনার মা ও এখনো জানেন না যে তাদের বিয়ে বাতিল করা হয়েছে।
অ্যালিসা খুশি মনে তার পাশে বসলো,যেন কিছুই হয়নি।
রাজা জারেন খানিকক্ষণ জ্যাসপারের সঙ্গে মিশন নিয়ে কথা বললেন।
— “তোমার বাবা ড্রাকোনিসের পাঠানো বার্তা আমি পেয়েছি। এই মিশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। তুমি একা যাচ্ছো তো?”
জ্যাসপার মাথা নেড়ে বললো—
— “হ্যাঁ, একাই যাবো।”
জারেন ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, তারপর একটু হাসলেন।
— “তাই বুঝি? আমার মনে হয়েছিলো, তুমি যাওয়ার আগে অ্যালিসার সঙ্গে দেখা করতে এসেছো!”
জ্যাসপার এবার পুরো বোঝা গেলো, জারেন ধরে নিয়েছেন সে বিদায়ের আগে অ্যালিসার সঙ্গে সময় কাটাতে এসেছে।
অ্যালিসা লাজুক মুখে হাসলো।
জ্যাসপার মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে কিছু প্রকাশ করলো না।
— “হুম,যেতে হবে তো…”
এভাবেই ভুল বোঝাবুঝি আরও গাঢ় হলো,আর জ্যাসপার বুঝতে পারলো,এখনো তার জন্য একটা নাটক অপেক্ষা করছে।
কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা শেষ করে রাজা জারেন উঠে চলে গেলেন আর লিয়ারা প্রচুর খাবার নিয়ে এলেন।
— “এই নাও,জ্যাসপার!খেয়ে নাও।”
জ্যাসপার কিছু বললো না,শুধু চারপাশে তাকিয়ে কারও সন্ধান করছিলো।অ্যালিসা খুশিমনে তার পাশে বসলো,কিন্তু জ্যাসপার শুধু একটাই প্রশ্ন ভাবছিলো— ফিওনা কোথায়?
তার চোখ বারবার দরজার দিকে যাচ্ছিলো,যেন এখনই কেউ এসে পড়বে।
ঠিক তখনই,সিলভা ভেতরে ঢুকলো।তার হাতে কিছু কাগজপত্র ছিলো,যেন কোনো কাজে ব্যস্ত।
— “ফুপি,ফিওনা কোথায়?” সিলভা জানতে চাইলো।
লিয়ারা হেসে বললেন, “ও কালকের জন্য এসাইনমেন্ট তৈরি করছে,তাই স্টাডি রুমে আছে।”
জ্যাসপার মুখ গম্ভীর করে ফেললো।ওর যাওয়ার আগেই ফিওনার সঙ্গে দেখা করতেই হবে!কিন্তু সরাসরি এখন উঠে যাওয়া ঠিক হবে না।অ্যালিসা কাছে বসে থাকায়,পরিস্থিতি আরও জটিল লাগছিলো জ্যাসপারের কাছে।
সবার চলে যেতে অনেকক্ষণ সময় লাগলো।ধীরে ধীরে ড্রয়িংরুম ফাঁকা হয়ে গেলো,এখন শুধু অ্যালিসা আর জ্যাসপার বসে ছিলো।
জ্যাসপার তার কপালে হাত রাখলো,যেন মাথা ধরেছে।
— “অ্যালিসা,আমার জন্য এক কাপ সুমাত্রা ডার্ক রোস্ট কফি বানিয়ে আনবে?মাথাটা ধরেছে।”
অ্যালিসা একদম খুশিতে লাফ দিয়ে উঠে গেলো।
— “অবশ্যই!আপনি অপেক্ষা করুন,আমি একদম পারফেক্ট কফি বানিয়ে আনছি।”
অ্যালিসা রান্নাঘরের দিকে চলে যেতেই,জ্যাসপার দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। ওর সময় নেই, ওকে এখনই বের হতে হবে।
ফিওনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলো,কিন্তু সেটা এত সহজ না।তাই কাগজের একটা টুকরো টেবিলের ওপর রাখলো। কফির গ্লাস আসার পর সেটা যাতে উড়ে না যায়,তাই কাগজের ওপরই একটা খালি গ্লাস চাপা দিয়ে রাখলো।
কিছুক্ষণ পর অ্যালিসা ফিরে এলো।হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ।
— “প্রিন্স, দেখেন তো ঠিক হয়েছে কিনা…”
কিন্তু ড্রয়িংরুম একদম ফাঁকা!
চারপাশে তাকিয়ে দেখলো,কিন্তু কোথাও জ্যাসপারের কোনো চিহ্ন নেই।
হঠাৎই চোখ গেলো টেবিলের ওপর রাখা কাগজের দিকে। অ্যালিসা ধীরে কাগজটা তুলে নিলো,চোখ বোলাতেই মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো।
“মিশনের জন্য কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে,তাই চলে গেলাম। সরি।”
অ্যালিসা কিছুক্ষণ কাগজটা শক্ত করে ধরে রইলো।কফির কাপটা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হতে থাকলো।
বিশাল স্টাডি রুম,চারদিকে নীরবতা।স্টাডি রুমের নরম আলোয় ফিওনা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঝূকে মনোযোগ দিয়ে এসাইনমেন্ট লিখছিল।চারদিকে বই আর নোটের স্তূপ, যেন সে পুরো ভেনাস ভুলে গিয়ে নিজের পড়াশোনায় ডুবে আছে।একদম তন্ময় হয়ে কাজ করছিলো,তাই প্রথমে বুঝতেই পারেনি কেউ একজন ওর একদম পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।কিন্তু হঠাৎ তার গায়ে একটা উষ্ণ স্পর্শ লাগলো। একটা শক্তিশালী উপস্থিতি ঠিক পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এরপরই গায়ে লাগলো পরিচিত পারফিউমের ঘ্রান।
তারপর একটা শীতল নিঃশ্বাস ওর ঘাড় ছুঁয়ে গেলো।
ফিওনা হঠাৎ থমকে গেলো।
শরীরের লোমগুলো কাঁটা দিয়ে উঠলো।
এই পরিচিত সুগন্ধ…
এই পারফিউমের ঘ্রাণ…
ফিওনার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।কিন্তু পেছনে ঘুরে দেখার সাহস পেলো না।
তারপরই দুইটা শক্ত হাত ওর কোমর জড়িয়ে ধরলো।
— “আমি না থাকলে তুমি খুব একা হয়ে যাবে,তাই না, হামিংবার্ড?”
প্রিন্স।
ওর গলার গভীর স্বর কান ছুঁয়ে গেলো।
এরপর একটা ভারী স্পর্শ,জ্যাসপারের থুতনি ওর কাঁধে ঠেকলো।ফিওনা শরীর কাঁপিয়ে উঠলো,বুকের ভেতর হৃদস্পন্দন যেন দ্বিগুণ গতিতে চলতে লাগলো।
— “আমি দীর্ঘদিনের একটা মিশনে যাবো।তো,আমি চলে যাওয়ার আগে একটু তোমার কাছে সময় চাই। দেবে?”
জ্যাসপার ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,আর ফিওনা কেবল চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে লাগলো সেই স্পর্শ…এক মুহূর্তে সমস্ত রক্ত যেন জমে গেলো ফিওনার শরীরে।
তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল।ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস জোগাড় করলো,আর তাকিয়ে দেখলো—জ্যাসপার!
ফিওনার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো।
— “আপনি কখন এলেন প্রাসাদে?আর এখানে,
আমার স্টাডি রুমে?”
জ্যাসপার এক পা এগিয়ে এলো,তার গভীর দৃষ্টিতে ছিল এক অদ্ভুত আকর্ষণ।
— “তোমার কক্ষের বারান্দায় এসেছিলাম,কিন্তু অ্যালিসা ছিলো সেখানে।পরে ও আমাকে নিচে নিয়ে গেলো,আর আমি সুযোগ বুঝে এখানে চলে এলাম।কেউ জানেনা,সবাই জানে আমি চলে গেছি।”
ফিওনার হৃদস্পন্দন একটু বেড়ে গেলো।সে চারপাশে তাকালো,যদি কেউ এসে পড়ে,কিন্তু জ্যাসপার রুমের দরজা বন্ধ করেই এসছে!
— “কেউ যদি চলে আসে তখন?”
জ্যাসপার নির্লিপ্ত হাসলো,যেন এসব তুচ্ছ।
— “আসলে আসুক।এমনিতেই আমি অ্যালিসার সাথে বিয়েটা ক্যান্সেল করে দিয়েছি।বাবাকে জানিয়েছি,কিন্তু রাজা জারেন আর বাকিরা এখনো জানেন না।আমি চাইনি মিশনের আগে এসব নিয়ে কথা বাড়ুক।ফিরে এসে সবাইকে জানাবো।”
ফিওনা কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
— “আপনি বিয়ে ক্যান্সেল করেছেন?”
জ্যাসপার তার চোখের দিকে তাকিয়েই বললো,
— “হ্যাঁ,এবং আমি একটুও অনুতপ্ত নই।”
ফিওনা কিছু বলতেই গিয়েছিল,কিন্তু তার আগেই জ্যাসপার এক ঝটকায় হাত তুলে তার ঠোঁটে আঙুল রাখলো।
— “হুঁশ…”—জ্যাসপার ফিসফিস করে বললো,গলার স্বরে ছিল এক অদ্ভুত কোমলতা,অথচ শাসনের সুরও স্পষ্ট।
তারপর ধীর কণ্ঠে যোগ করলো, “মিশন শেষ করে এসে তোমার মায়ের কাছে তোমাকে চাইবো সারাজীবনের জন্য।”
ফিওনার বুক ধুকপুক করে উঠলো।এত কিছু এত দ্রুত!সে বিস্মিত হয়ে বললো, “একটু বেশি এগিয়ে গেলেন না?এখনো আপনাকে পুরোপুরি জানলাম না,আর আপনি সোজা বিয়ের কথা বলছেন?”
জ্যাসপার একটু হেসে তাকালো, তার চোখের গভীরে ছিল এক ধরনের দাবির অনুভূতি।
— “তুমি আমাকে অনেক গভীরভাবে জানো,ফিওনা।আর আমিও তোমার সবটা জানি।তোমার কিছু হয়তো মনে নেই, কিন্তু তা বলে আমার স্পর্শ মিথ্যে হয়ে যাবে?”
তার কণ্ঠ আরও গভীর হলো, তার মুখ ফিওনার মুখের আরও কাছে এগিয়ে এলো।
— “তোমার দেহের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আমার স্পর্শ পড়েনি।”
ফিওনার শ্বাস গলা আটকে গেলো। মাথাটা হালকা চক্কর দিলো, মনে হলো সে যেন মাটির ভেতর গলে যেতে চাইছে। তার হাত টেবিলের ওপর শক্ত হয়ে আঁকড়ে ধরলো, যেন নিজেকে স্থির রাখতে পারবে।
কিন্তু জ্যাসপার তখনো তাকে এক দৃষ্টিতে দেখছিল, যেন তার সমস্ত আত্মার ভেতর ঢুকে পড়তে চাইছে…
ফিওনা কিছু বলার সুযোগ পেল না।জ্যাসপার আরেক ধাপ এগিয়ে এলো,তার দু’হাত ফিওনার কোমরের চারপাশে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো।এক মুহূর্তের জন্য ফিওনা ভারসাম্য হারালো,পেছনে হেলে পড়ল ডেস্কের ওপর।তার আঙুলগুলি শক্ত করে কাঠের ওপর আঁকড়ে ধরলো,যেন নিজেকে স্থির রাখতে চাইছে।
জ্যাসপার তাকে আরও কাছে টেনে নিলো,এমনভাবে জড়িয়ে ধরলো যেন তার শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরায় গরম স্রোত বইয়ে দিচ্ছে।
ফিওনার শ্বাস আটকে গেলো।
— “প্রিন্স…”—তার কণ্ঠ যেন হারিয়ে গেলো এক অজানা উত্তাপে।
জ্যাসপার তার গালে মুখ ঘষে নিয়ে ধীরে ফিসফিস করে বললো,
— “তোমার হাতের শক্তি এত কম কেন,হামিংবার্ড?এত দুর্বল হয়ে পড়েছো কেন?”
ফিওনার হাতের শক্তি আসলেই কমে যাচ্ছিল,কিন্তু সে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করলো।জ্যাসপারের শরীরের তাপ,তার শ্বাসের গতি তার শক্ত আলিঙ্গন—সব মিলিয়ে ফিওনার মনে হলো যেন চারপাশের ভেনাস হঠাৎ করেই আবছা হয়ে আসছে…
ফিওনার স্টাডি রুমের নিস্তব্ধতা হঠাৎ করেই চূর্ণ হয়ে গেলো দরজায় জোরে নক পড়তেই।সে কেঁপে উঠলো,কিন্তু জ্যাসপার যেন একটুও নড়লো না,বরং আগের মতোই শক্ত করে তাকে ধরে রাখলো।
ফিওনা ব্যাকুল হয়ে জ্যাসপারকে ঝাঁকাতে লাগলো,”প্রিন্স, ছাড়ুন!মনে হচ্ছে কেউ এসেছে!”
কিন্তু জ্যাসপার নির্বিকার।তার চোখে এক অদ্ভুত তীব্রতা, যেন সে এক মুহূর্তের জন্যও ফিওনাকে ছেড়ে দিতে রাজি নয়।
ঠিক তখনই দরজার ওপাশ থেকে পরিচিত এক কণ্ঠ শোনা গেলো।
“ফিওনা মামণি,দরজা খোলো!”
মা!
ফিওনার গলা শুকিয়ে গেলো। আতঙ্কে সে আবারও জ্যাসপারকে সরানোর চেষ্টা করলো,কিন্তু এবার সে আরও একটা অবিশ্বাস্য কাজ করে বসলো।
জ্যাসপার হঠাৎ ফিওনার কোমর ধরে তাকে ডেস্কের ওপরে বসিয়ে দিলো!
“প্রিন্স!” ফিওনা ফিসফিস করে ফোঁস করে উঠলো,কিন্তু তার প্রতিবাদ ধোপে টিকলো না।
জ্যাসপার যেন তার কথা শুনছেই না।তার নিঃশ্বাস গরম হয়ে উঠেছে,চোখের দৃষ্টি গভীর আর বুনো।
কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই সে হঠাৎ ঝুঁকে পড়লো,ফিওনার গলা থেকে ঘাড়ের দিকে নরম কিন্তু দাবিদার চুম্বনের ছোঁয়া দিলো।
ফিওনার শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বয়ে গেলো।
“প্লিজ… কি করছেন! ছাড়ুন!”
সে ছাড়াতে চাইলো, কিন্তু জ্যাসপারের শক্ত বাহু তাকে আটকে রেখেছে, যেন সে এত সহজে ফিওনাকে মুক্তি দেবে না।
হাত দিয়ে ধাক্কা দিতে গিয়েই তার কনুইয়ের ধাক্কায় পাশে থাকা নোটবুক আর কিছু কাঁচের জিনিস পড়ে গেলো ফ্লোরে,এক তীব্র শব্দে!
“ঠাস!”
দরজার ওপাশ থেকে লিয়ারা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “ফিওনা! কি হয়েছে? তুমি ঠিক আছো তো?”
ফিওনার বুক ধুকপুক করছে। সে কিছু বলার আগেই জ্যাসপার আবারও কিছু অপ্রত্যাশিত করে বসলো।ফিওনা পুরোপুরি জমে গেলো। শরীর কাঁপতে শুরু করলো, কিন্তু জ্যাসপার তাকে শক্ত করে ধরে রাখলো, যেন এই মুহূর্তে তাকে এক ইঞ্চিও সরে যেতে দেবে না।
দরজার ওপাশ থেকে লিয়ারার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শোনা গেলো, “ফিওনা, কি হয়েছে? তুমি ঠিক আছো তো?”
ফিওনার মনে হলো, হার্টবিট যেন দ্বিগুণ গতিতে চলছে। একদিকে লিয়ারা, অন্যদিকে জ্যাসপার—এ যেন এক দুঃস্বপ্ন আর বাস্তবতার মিশ্রণ!
তার মুখ হঠাৎই ফিওনার মুখের এতটা কাছে চলে এলো যে, ফিওনার নিঃশ্বাস আটকে গেলো।
একের পর এক মুহূর্ত যেন স্থির হয়ে গেলো।
জ্যাসপার ঠোঁট চেপে ধরলো ফিওনার ঠোঁটে।
ফিওনার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেলো।
সে ধাক্কা দিতে গিয়েও যেন শক্তিহীন হয়ে পড়লো।
জ্যাসপারের শক্ত হাত তাকে ধরে রেখেছে, তার উত্তপ্ত ঠোঁট দাবী জানাচ্ছে, আর দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে তার মা কিছুই টের পাচ্ছেন না।
ফিওনার মনে হলো, এই মুহূর্তে পুরো ভেনাস যেন এক ঝড়ের মধ্যে পড়ে গেছে—আর সেই ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে প্রিন্স জ্যাসপার অরিজিন!
সে দু’হাতে জ্যাসপারকে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু জ্যাসপার আরও গভীরভাবে তাকে নিজের মধ্যে টেনে নিলো।
লিয়ারা আবারও ডাক দিলেন, “ফিওনা? দরজা খুলবে না?”
ফিওনা মরিয়া হয়ে জ্যাসপারকে ধাক্কা দিলো,চোখে পানি এসে গেছে রাগে,আতঙ্কে,লজ্জায়।
প্রায় পাঁচ মিনিট পর,জ্যাসপার ধীরে ধীরে চুম্বন থামালো। কিন্তু তার চোখে এখনো সেই দাবিদার আগুন জ্বলছিল।সে এক মুহূর্তও ফিওনার থেকে দূরে থাকতে চাইল না। তাই আবারও ঝুঁকে পড়লো,যেন নতুন করে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে।
ফিওনা দ্রুত হাত বাড়িয়ে তার বুকে ঠেকিয়ে দিলো, “প্লিজ ছাড়ুন! মা এসেছে!”
জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য ফিওনাকে দেখলো,যেন তার মনে হচ্ছে ফিওনা তাকে আবার ধোঁকা দিচ্ছে।কিন্তু দরজার ওপাশ থেকে লিয়ারার উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “ফিওনা?আমার কথা শুনতে পাচ্ছো না!”
তখনই ফিওনা ব্যাকুল হয়ে জ্যাসপারকে ঠেলে দিলো, “আপনাকে লুকাতে হবে!আলমারির পেছনে যান!”
জ্যাসপারের ভ্রু কুঁচকে গেলো।সে বিরক্ত মুখে ফিসফিস করে বললো, “হোয়াট? আমি লুকাবো? সিরিয়াসলি? ফিওনা, আমি এটা পারবো না! এসব একেবারেই আমার ধারা সম্ভব না।”
কিন্তু ফিওনা এখন সময় নষ্ট করতে চায় না।সে দ্রুত জ্যাসপারের হাত ধরলো,অনুরোধের সুরে বললো, “প্লিজ, প্রিন্স!আপনি যদি এখন আমার কথা শোনেন,তাহলে আমি নিজে আপনাকে কিস করবো।প্রমিজ!”
জ্যাসপারের চোখ চকচক করে উঠলো।ঠোঁটের কোণে এক চতুর হাসি ফুটে উঠলো।সে ধীরে ধীরে ফিওনার মুখের সামনে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, “সত্যি? প্রমিজ করছো?”
ফিওনা দ্রুত মাথা নাড়লো, “হ্যাঁ, প্রমিজ!”
জ্যাসপার একটু সময় নিলো,যেন বুঝে নিতে চাইছে ফিওনা মিথ্যা বলছে কিনা।তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে আলমারির পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।হাত ভাঁজ করে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকলো ফিওনার দিকে,যেন এটা তার জন্য সবচেয়ে অসম্ভব একটা কাজ যা সে জীবনে কখনোই করতে চায়নি।
তার মুখে বিরক্তির ছাপ,কিন্তু চোখে একরকম কৌতুকের ঝিলিক। “আজকে কি না আমাকে লুকাতে হলো!প্রিন্স হয়ে এসব করবো,তা কখনো ভাবিনি!” ফিসফিস করে নিজেকেই বললো সে।
আর ফিওনা ততক্ষণে দ্রুত নিজের চেহারা আর জামাকাপড় ঠিকঠাক করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো,যেন কিছুই ঘটেনি!
দরজা খুলতেই লিয়ারা হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকলেন।তাঁর চোখ সরাসরি ডেস্কের নিচে পড়লো,যেখানে কাঁচের কিছু জিনিস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে,সঙ্গে নোটবুকও মেঝেতে উল্টে আছে।
লিয়ারার ভ্রু কুঁচকে গেলো। সন্দেহভরা কণ্ঠে বললেন, “ফিওনা, এটা কী হলো? তোমার স্টাডি রুম এভাবে তছনছ কেন?”
ফিওনার হৃদস্পন্দন মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো। সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করলো।এক সেকেন্ডের মধ্যেই মুখে স্বাভাবিক ভাব এনে বললো, “মা, একটা বিড়াল এসেছিলো জানালা দিয়ে!এত বড় বিড়াল, বিশ্বাস করতে পারবেন না!ডেস্কে লাফ দিয়ে উঠে সব ফেলে দিয়েছে!”
লিয়ারা চোখ সরু করলেন। “বিড়াল?এই ভরা সন্ধায়?”
ফিওনা দ্রুত মাথা নাড়লো, “হ্যাঁ মা! এত বড় আর কালো রঙের! আমি তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছি,তাই জিনিসগুলো পড়ে গেছে।”
লিয়ারা কিছুক্ষণ ফিওনার দিকে তাকিয়ে রইলেন, যেন মেয়ের চোখের ভেতর সত্যতা খুঁজে দেখছেন। ফিওনার শ্বাস এখনো অনিয়মিত,কিন্তু সে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে।
লিয়ারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “হুম, ঠিক আছে। জানালাগুলো ভালো করে বন্ধ করে দিও।
লিয়ারা এক গ্লাস দুধ আর হালকা স্ন্যাকস রেখে ফিওনার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “এগুলো খেয়ে নিও,তারপর ভালো করে পড়াশোনা করো।”
এ কথা বলে তিনি ঘুরে বেরিয়ে গেলেন।
ফিওনা দরজা বন্ধ করে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর ধীরে ধীরে আলমারির পেছনে তাকালো,যেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক বিরক্ত প্রিন্স—হাত ভাঁজ করে,ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি।
“বিড়াল, তাই তো?”
ফিওনা কিছু বলার আগেই জ্যাসপার এক ধাক্কায় তাকে ডেস্কের সামনে চেয়ারে বসিয়ে দিলো।তারপর সে টেবিলের ওপর রাখা দুধের গ্লাস হাতে তুলে নিলো,ফিওনার সামনে নিয়ে এসে বললো, “এখন চুপচাপ এটা খাও।”
ফিওনা চোখ বড় বড় করে তাকালো, “আমি দুধ খাইনা!”
জ্যাসপার একটুও পাত্তা না দিয়ে গ্লাসটা ফিওনার ঠোঁটের কাছে ধরলো, চোখে এমন শাসন ছিলো যেন ফিওনা এক মুহূর্ত দেরি করলেই আরও কঠিন কিছু ঘটবে।
“তুমি একটু আগে যে কাঁপাকাপি করলে অনেকটাই দুর্বল তুমি।খাবে নাকি আমি নিজে খাওয়াবো?”
ফিওনা মুখ ভার করে একটু চুমুক দিলো। কিন্তু জ্যাসপার এত সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। সে ধীরে ধীরে ফিওনার চিবুক ধরে মুখটা আরও কাছে টেনে আনলো, চোখে গভীর দৃষ্টি রেখে বললো, “পুরোটা শেষ করো,নাহলে…”
ফিওনা আতঙ্কে চোখ বড় করে বললো, “নাহলে কী?”
জ্যাসপার মৃদু হেসে গ্লাসটা আরেকটু সামনে ধরলো,”নাহলে আমি এমন কিছু করবো যার জন্য তুমি প্রস্তুত থাকবে না।”
ফিওনার গাল রক্তিম হয়ে উঠলো, আর কোনো উপায় না দেখে সে দ্রুত গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে বাকি দুধটা শেষ করলো।
জ্যাসপার তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললো, “গুড গার্ল।”
তারপর সে একপাশে হেলে গিয়ে বললো, “এখন বলো, আমি কি সত্যি বিড়াল? নাকি একটু বেশি বিপজ্জনক কিছু?”
ফিওনা ভীষণ লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিলো, কিন্তু তার ধুকপুক করা হৃদয় যেন তাকে অন্য কিছু বলছিলো…
জ্যাসপার চেয়ারের দিকে একটু ঝুঁকে এসে গভীর গলায় বললো, “কি প্রমিজ করেছিলে একটু আগে, মনে আছে?”
ফিওনা মাথা নিচু করে ফেললো, যেন নিজের ভেতরের দ্বিধা লুকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু জ্যাসপার এত সহজে ছাড়ার মানুষ নয়। সে আরেকটু সামনে এগিয়ে এল, ফিওনার নিঃশ্বাস তার গরম নিঃশ্বাসের সাথে মিশে গেলো।
আর উপায় না দেখে ফিওনা দ্রুত জ্যাসপারের গালে একটা আলতো চুমু দিলো।
জ্যাসপার এক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকলো, চোখের গভীরে খেলা করছিল এক অদ্ভুত আগুন।
“আমি বলেছি চুমু দেবো,” ফিওনা ফিসফিস করে বললো, “কিন্তু কোথায় দেবো, সেটা তো বলিনি।”
জ্যাসপারের ঠোঁট বাঁকা হলো, চোখ ধীরে ধীরে সংকীর্ণ হয়ে উঠলো।
ফিওনা কিছু বলার আগেই জ্যাসপার ওর চোয়াল শক্ত করে ধরে মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো।
“আই হেইট চিটিং, হামিংবার্ড,” ওর কণ্ঠে ছিল একটা তীব্র শাসন, যেন কোনো ভুল ক্ষমার যোগ্য নয়।
পরক্ষণেই কোনো সতর্কতা ছাড়াই ওর ঠোঁটে ঝাঁপিয়ে পড়লো জ্যাসপার।
এটা কোনো সাধারণ চুমু ছিল না।
ফিওনার ঠোঁট পুরোপুরি আটকে গেলো ওর মুখের ভেতর। জ্যাসপার এমনভাবে শুষে নিলো, যেন এক মুহূর্তের জন্যও ফিওনাকে নিঃশ্বাস নিতে দেবে না।
ওর মুখের উষ্ণতা,জিভের দাবিদার স্পর্শ, ঠোঁটের গভীর চাপে ফিওনা নিজেকে পুরোপুরি অসহায় অনুভব করলো।
ফিওনার আঙুলগুলো মুঠো হয়ে গেলো, শরীর শিউরে উঠলো।
ও ঠেলে সরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু জ্যাসপার শক্ত হাতে ওর কোমর ধরে রেখেছিলো।
তখনই ফিওনা অনুভব করলো একটা হালকা কামড়, ঠোঁটের নরম ত্বকের ওপর।
“আহ্!” ও ব্যথায় শিহরিত হয়ে উঠলো।
কিন্তু জ্যাসপার থামলো না। ও ফিওনার নিচের ঠোঁট টেনে নিয়ে আরও গভীরভাবে মুখের ভেতরে পুরে নিলো, যেন এই স্বাদ চিরদিন নিজের মধ্যে ধরে রাখতে চায়।
শুধু ঠোঁট নয়, ওর জিভ ও ধীরে ধীরে ফিওনার মুখের প্রতিটি কোণ স্পর্শ করছিলো, তীব্রভাবে নিজের অস্তিত্বের ছাপ রেখে যাচ্ছিলো।
ফিওনার বুক ধড়ফড় করছিলো, চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছিলো আবেগে, অনুভূতির অতলে ডুবে যাচ্ছিলো ও।
এই চুমু কোনো সাধারণ চাহিদার ছিল না—এটা ছিল একধরনের দাবি, এক গভীর শাস্তি।
জ্যাসপার যেন বলে দিচ্ছিলো—
“তুমি প্রতারণা করেছো, হামিংবার্ড। তাই তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে!”
ফিওনা তখনো জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। ঠোঁট জ্বলে যাচ্ছিল যেন, স্পর্শের জায়গাগুলো এখনও শিহরণ তুলছিল ওর শরীরে। জ্যাসপার ওকে এতক্ষণ শক্ত করে চেপে ধরেছিল যে ওর হৃদস্পন্দন এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
জ্যাসপার ধীর গতিতে চেয়ারটা এক ঝটকায় ঘুরিয়ে দিলো, ফিওনা হালকা চমকে উঠলো। ওর চোখের সামনে এখন শুধুই জ্যাসপার, যার চোখে গভীর কিছু খেলা করছিল।
“আমি এখন চলছি,” ওর কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা, কিন্তু তার নিচে একটা শীতল হুমকিও লুকিয়ে ছিল। “তবে হ্যাঁ, এটা ভেবো না যে আমি চলে গেলেই তুমি আমার নজর থেকে বেরিয়ে যাবে।”
ফিওনা তখনো ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল, বুঝতে পারছিলো না সে রেগে আছে নাকি কিছু অন্যরকম ভাবছে।
জ্যাসপার আরও ঝুঁকে এলো, ওর মুখটা একদম ফিওনার কানের কাছে। “এমন কিছু করো না, হামিংবার্ড, যাতে আমি রেগে যাই। তোমার ওপর রুষ্ট হয়ে যাই।” ওর কণ্ঠে ছিল একধরনের সুর যা ফিওনার মেরুদণ্ড বেয়ে কাঁপন তুললো। “আমি ছাড়া আর কিছুতে মন দেবে না, শুধুমাত্র পড়াশোনায় ফোকাস করবে। আর হ্যাঁ, আমার থেকে বেশি আমার পড়ালেখা নিয়ে ভেবো না!”
ফিওনা চোখ সরিয়ে নিলো, তবুও মৃদু বিরক্তির সুরে বললো, “কেন? যদি আপনার চেয়েও পড়াশোনায় বেশি মন দিই, তাহলে কি আমার পড়ালেখা বন্ধ করে দেবেন?”
জ্যাসপার হেসে উঠলো, একদম নির্লিপ্ত কন্ঠে
বলল, “না, শুধু তোমার নয়—পুরো ভেনাসেরই পড়ালেখা বন্ধ করে দেবো!”
ফিওনা হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। “আপনি পাগল নাকি?” ওর মুখ ফস করে বেরিয়ে গেল।
জ্যাসপার ওর চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো,তারপর এক চোখ টিপে বললো, “তোমার জন্য পাগল হামিংবার্ড?”
কথাটা বলেই সে এক ঝটকায় জানালার দিকে এগিয়ে গেল। পরের মুহূর্তে, ফিওনার চোখের সামনেই জ্যাসপারের শরীর রূপান্তরিত হতে লাগলো—মানুষের গড়ন মিলিয়ে গিয়ে বিশাল সবুজ ড্রাগনের রূপ নিলো সে।জানালা দিয়ে এক তীব্র ঝাপটা হাওয়া এল, আর সেই সাথে জ্যাসপার ডানা মেলে আকাশে উড়ে গেল।
ফিওনা স্থির হয়ে বসে রইলো,মাথার মধ্যে এখনো জ্যাসপারের শেষ কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।ওর গাল তখনো জ্বলছিল,ঠোঁট এখনো অস্বাভাবিক রকম সংবেদনশীল লাগছিল।নিজের ঠোঁটে হাত রাখল ও,তারপর ফিসফিস করে বলল, “এই ড্রাগন প্রিন্স কি সত্যিই পাগল, নাকি আমিই ধীরে ধীরে ওর পাগলামিতে জড়িয়ে যাচ্ছি?”
তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও নিজের টেবিলে বসে পড়লো। কিন্তু এবার আর পড়াশোনায় মন বসছিল না।
দূর মহাকাশের অন্ধকারে ছোট্ট স্পেসশিপটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল।জানালার ওপাশে অসংখ্য তারার আলো জ্বলজ্বল করছিল,কিন্তু লিউ ঝানের চোখে আলো ছিল আরেকজনের প্রতিচ্ছবি। সে গভীরভাবে নিজের হাতে থাকা আঙটিটার দিকে তাকিয়ে রইলো,আঙুলের আঙটাকেৎআলতোভাবে ছুঁয়ে বলল,
“আর মাত্র কয়েকটা দিন… তারপর আমি তোমাকে দেখতে পাবো,তোমাকে কাছে পাবো আমার ‘ক্যামেলিয়া’।”
তার কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা, একরাশ প্রতিজ্ঞা। এরপর সে আঙটিতে এক নিঃশব্দ চুমু খেলো,যেন সেটার মাঝেই কোনো অনুভূতি বন্দী করে রাখতে চাইলো। এরপর একধরনের প্রশান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তুমি যত দূরেই যাও না কেন তোমার ভালোবাসার মানুষ ঠিক তোমার কাছে পৌঁছে যাবে।এবার আর আমি তোমাকে হারাতে দেবো না,ফিওনা।”
লিউ ঝান চোখ বন্ধ করলো,যেন মনের ভেতর কোনো দৃশ্য স্পষ্ট করে আঁকতে চাইছে।তার ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো।
এই মহাকাশযাত্রা শুধু একটা মিশন নয়,এটা তার ভালোবাসার জন্য যুদ্ধ।এবার সে নিজের ভাগ্য নিজেই লিখবে,আর সেই ভাগ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে শুধুই তার ক্যামেলিয়া।
একদিকে ফিওনা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।রাতের আকাশে বিশাল চাঁদ ঝলমল করছে, আর তার পাশে উজ্জ্বল সন্ধ্যাতারা। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
“এই কয়দিনেই এমন কী করলো ও? আমার মন যেন আমার নিয়ন্ত্রণেই নেই…”
সে নিজের বুকের উপর হাত রাখলো,যেন অস্থির হৃদস্পন্দন থামাতে পারে।জ্যাসপারের ছোঁয়া,তার গাঢ় সবুজ চোখের দৃষ্টি,সেই দাবিদার কণ্ঠস্বর—সব মিলিয়ে যেন একটা অদৃশ্য শৃঙ্খল পরিয়ে দিয়েছে তাকে।
এদিকে,দূর মহাকাশে ছোট্ট স্পেসশিপে বসে লিউ ঝান কাচের জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে।
“খুব শিঘ্রই তার প্রথম ভালোবাসা।তার ডাক্তার ক্যারিয়ারে প্রথম প্রেমে পড়া।তার একমাত্র প্রেমের প্রতিক ফুল ক্যামেলিয়া।যাকে হসপিটালে প্রথম দেখেই প্রেমে পড়ে।লাভ এটা ফার্স্ট সাইট যাকে বলে।তার কাছে পৌঁছাতে পাড়ি দিচ্ছে কয়েক আলোকবর্ষ।”
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১০
অন্যদিকে,এল্ড্র রাজ্যের ড্রাকোনিস শিখরের উপর,ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে আছে জ্যাসপার।তার রক্তিম ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি,কিন্তু চোখে এক অজানা আগুন।
“তুমি আমার কন্ট্রোলে আসতে শুরু করেছো,হামিংবার্ড। তোমার মন কী চায়,সেটা তুমি নিজেও জানো না।কিন্তু আমি জানি।”
সে ভেনাসের আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করলো—
“তুমি আমার,শুধুই আমার।আমি তোমাকে কারও হতে দেবো না।”