আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩৪
সাবিলা সাবি
রাতের ঘন আঁধার কেটে গিয়ে আকাশে নতুন সুর্য উদিত হয়। সুর্যরশ্মির স্নেহালতা ছড়িয়ে পড়ে প্রাসাদের ভেতরে। প্রাসাদের বড় বড় জানালা দিয়ে সুর্যের কিরন ছড়িয়ে পড়ে মার্বেলের মেঝেতে। এল্ড্র রাজ্যের রাজকীয় প্রাসাদটা ধীরে ধীরে ঘুম থেকে জাগ্রত হচ্ছে। বাতাসে ভেসে বেরাচ্ছে ভেনাসিয়ান রক্তজবা আর রজনীগন্ধার সুবাস। বারান্দার পাশ দিয়ে ভেসে আসছে পাখিদের কলকল ধ্বনি। রাজপ্রাসাদের রান্নাঘরে তখন তুমুল ব্যাস্ততা,সার্ভেন্টরা ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে, কেউ চা বানাচ্ছে কেউ বা রুটির খামির তৈরি করছে।
ফিওনা তখনও পুরোপুরি জেগে ওঠেনি,চোখজোড়া আধবোজা কিন্তু ঘুমের ঘোরেও মুখে এক টুকরো হাসি লেগে আছে। আজকের দিনটা বিশেষ একটা দিন আজকে জ্যাসপার ফিওনার রিসিপশনের দিন।ৎতবে গতকালের কথাগুলো এখনও ফিওনার মস্তিষ্কে ভাসছে,অ্যাকুয়ারা, লিউ ঝান আর নিজের ভবিষ্যতে জীবনের চিন্তা।
এদিকে জ্যাসপার এখনও ছাদের কক্ষের নরম সোফায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। পাশেই ফ্লোরে পড়ে রয়েছে এক গ্লাস অর্ধেকে ওয়াইন।মুখে হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠেছে যা দেখে মনে হচ্ছে কোনো এক সুখস্মৃতির স্বপ্নে ডুবে ছিলো কিয়ৎক্ষন আগেই।
আর এথিরিয়ন ভোরবেলা চুপচাপ নিজের কক্ষে ফিরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলো।মাথাটা ভার হয়েছিলো তবুও মনে হালকা প্রশান্তিও বিদ্যমান ছিলো।
আর থারিনিয়াস এখনও আলবিরার কক্ষে আলবিরার পাশে কমফোর্টের নিচে মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে আছে।
লম্বা রাজকীয় ডাইনিং টেবিলটায় আস্তে আস্তে জড়ো হচ্ছে প্রাসাদের সকলে। সুন্দর সুন্দর রুপালী সোনালী থালায় সাজানো হচ্ছে এল্ড্র রাজ্যর ঐতিহাসিক সবরকম সুস্বাদু খাবার। খাবারের আইটেমে রাখা হয়েছে, মধুতে ভাজা রুটি, ভেনাসিয়ান ফল দিয়ে তৈরি হালকা ঝাল সালাদ,আর একধরনের নীলচে চা, যার গন্ধেই ঘুম কেটে যাওয়ার উপক্রম।
ফিওনা টেবিলের এক কোনে বসে আছে, সফেদ রঙের ঢিলেঢালা একটা পোশাক পড়ে।চোখে চোখে খুঁজে বেরাচ্ছে জ্যাসপারকে।ঠিক তখনই জ্যাসপার উপস্থিত হয় ডাইনিং কক্ষে। জ্যাসপারের মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে আর চোখে রয়েছে এক রাশ ক্লান্তি। হাঁটার পদক্ষেপ কিছুটা ঢুলুঢুলু বসার সময় চেয়ার টানতে গিয়ে হোঁচট খায় একবার।
ফিওনা চোখ সুরু করে তাকায়। জ্যাসপার ফিওনার বরাবর উল্টোপাশের চেয়ারে বসেছে।
ফিওনা সাথে সাথে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে,প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,”প্রিন্স তোমার চোখজোড়া লাল কেনো? জ্যাসপার আবছা হাসি দিয়ে বললো, “রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি তাই।”
কিয়ৎক্ষন বাদেই ডাইনিং এ প্রবেশ করে এথিরিয়ন। ওর ও এলোমেলো চুল আর শার্টে লেগে আছে ওয়াইনের হালকা দাগ।চেয়ার টেনে বসেই গলা কিছুটা খাকরিয়ে বললো
“গুড মর্নিং এভরিওয়ান”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাজা ড্রাকোনিস তার দুই পুত্রের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো,গতকাল রাতে এরা কিছু একটা কান্ড করেছে। ফিওনার পাশে বসা অ্যাকুয়ারা তখন কিছুটা কপাল কুঁচকে ভাবলো “এরা দুজনেই এমন দুলছে কেনো?”
ঠিক তখনই থারিনিয়াস আর আলবিরা একত্রে প্রবেশ করে ডাইনিং এ। থারিনিয়াসের হাঁটাও কিছুটা এলোমেলো। মাথার পেছনে ঝুঁটি বেঁধে চোখে সাদা চশমা পড়ে ডাইনিং বসেই প্রথমে হাতে চা নিয়ে নিলো তারপর চা খেতে খেতে বললো “গতকাল রাতটা ভালোই কেটেছে, কিযে একটা শান্তি লাগছে।”
হঠাৎ করেই ডাইনিং টেবিলে খানিকটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করলো। সকালের খাবার চলতে থাকলেও সবার মধ্যেই রয়েছে কিছুটা চাপা উত্তেজনা। রাজা ড্রাকোনিস ধীরে ধীরে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর একে একে চোখ তুলে পরখ করে যাচ্ছেন তিনজনের দিকে।জ্যাসপার,থারিনিয়াস, আর এথিরিয়ন, তিনজনের চোখেই ঘুম ঘুম ভাব স্পষ্ট, এলোমেলো হাসি আর শরীরে স্পষ্ট রাত জাগার ক্লান্তি।
রাজা ড্রাকোনিস চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে গম্ভীর স্বরে বললেন “আমরা সবাই জানি রাজ প্রাসাদে এই মুহূর্তে উৎসবের আমেজ চলছে, আমার বড় ছেলের বিবাহ হয়েছে কাল,কিন্তু তোমরা কি ভুলে গিয়েছো? তোমরা শুধুমাত্র আমার সন্তান না এই এল্ড্র রাজ্যর ভবিষ্যতে।”
জ্যাসপার তখনও নির্বিকার ভঙ্গিতে মধুতে ভাজা রুটি ধীরে ধীরে চিবিয়ে খাচ্ছিলো। এথিরিয়ন চুপচাপ বসে আছে। থারিনিয়াস মৃদু গম্ভীর ভঙ্গিতে চা পান করে যাচ্ছিলো।
রাজা ড্রাকোনিস পুনরায় তাদের উদ্দেশ্য বলে উঠলেন, “তোমাদের রাত জাগা, মাতাল হওয়া এসব নিয়ে আমি কিছুই বলতাম না, কিন্তু আজকে তোমদের মুখের অবস্থা দেখে বুঝতে পারলাম, তোমরা নিজেদের সিমারেখা ভুলতে শুরু করেছো। রাজপরিবারের নামডাকের সাথে দায়িত্ব কর্তব্যও মিশে থাকে। সেটা যদি এখন থেকেই না বোঝো তোমরা তাহলে এল্ড্র রাজ্য সামলাবে কি করে? আমি সত্যি আমার ছেলে জ্যাসপারের থেকে এমন আচরণ আশা করিনি কারন সে সমগ্র ভেনাসের একমাত্র প্রিন্স! সবসময়ই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে এসেছে তার হঠাৎ এমন আচরন আমাকে সত্যি হতাশ করেছে।”
ফিওনা এবার একটু অবাক হয়ে রাজা ড্রাকোনিসর দিকে তাকালো। সাধারণত তিনি এমন রূঢ় গলায় কথা কখনো বলেন না।
জ্যাসপার মাথা উঁচু করে, মৃদু শান্ত স্বরে বললো “ড্রাকোনিস আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।এরপর থেকে আর কখনো এরকমটা হবেনা আমি কখনোই আর আপনাকে আশাহত করবো না এটা আমার প্রতিজ্ঞা।”
এথিরিয়ন তখন তাল মিলিয়ে বললো ” বাবা আমাদের ক্ষমা করুন, বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা এতো বড় পর্যায় চলে যাবে।”
ড্রাকোনিসের চোখ তখন কিছুটা নরম হয়ে আসে। তিনি ছেলদের উদ্দেশ্য শান্ত কন্ঠে বললেন “আমার রাগ তোমাদের ওপর নয়, আমার রাগ এই বিষয়ে যে তোমরা রাজপুত্র হয়ে এরকম একটা ভুল করছো। আজ রিসিপশন ভেনাসের দূরদুরান্ত থেকে অতিথি আসবেন সবাই তাকিয়ে থাকবেন তোমাদের দিকে। তাই আমি আর কোনো অপ্রিয় পরিস্থিতি চাইনা। তোমাদের সাবধান করে দেয়া হলো।”
তারপর তিনি রাজকীয় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন “সকালের সভা শেষ এবার যার যার নিজ জায়গায় ফিরে যাও। একটু পরেই রাজপ্রাসাদের ডেকোরেশনের কাছ শুরু হয়ে যাবে তাই যার যে দায়িত্ব সেই দায়িত্বে লেগে পড়ো।”
সকলে যখনে ডাইনিং টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো। ফিওনা তখন জ্যাসপারের হাত ধরে টেনে বারান্দার একপাশে নিয়ে গেলো। জ্যাসপার একপ্রকার অপরাধী চোখে ফিওনার দিকে দৃষ্টি মেললো। বারান্দায় হালকা রোদের সোনালী আভা ছড়িয়ে আছে। সকালের একটা স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে যাচ্ছে বারান্দা দিয়ে। ফিওনা কপট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো “কাল রাতে এলকোহল পান করেছো কেনো? জ্যাসপার হালকা হেসে ফিওনার দুই বাহু ধরে বললো ” কালকে শেষ ব্যাচেলর পার্টি করলাম তাই।”
ফিওনা চিন্তিত চোখে বললো “রাজা ড্রাকোনিস কি বলেছেন শুনেছো তো?”
জ্যাসপার ফিওনারা দুগালে হাত রেখে কোমল স্বরে বললো
“হ্যাঁ শুনেছি আমার মহারানী! আর তুমি একদম চিন্তা করোনা আজকের রিসিপশন সুন্দর ভাবেই কাটবে কথা দিচ্ছি। আর রাতে তো আমাদের বাসর তাইনা?”
ফিওনা তখন দুহাতে জ্যাসপারের গলা জড়িয়ে মিষ্টি কন্ঠে বললো ” তা আজকে আবার কি দিয়ে বাসর করবে ফায়ার মনস্টার?”
জ্যাসপার তখন ফিওনার দিকে খানিকটা ঝুকে মৃদু ফিসফিস কন্ঠে বললো “এলকোহল হামিংবার্ড”।
দুপুর গড়িয়ে সন্ধা নামার উপক্রম।সূর্য তখন ধীরেগতিতে অস্ত যাচ্ছে।আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ল্যাভেন্ডা নীল ও হালকা গোলাপি রঙের কুয়াশার মতো এক মায়াবী আভা। ঠিক যেমনটা দেখা যায় রূপকথার শেষ পৃষ্ঠায় আঁকা রাজকীয় সন্ধ্যায়। দূরে পাহাড়ের গায়ে পড়ছে কমলা রঙের আলো, আর মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে ড্রাগনরূপী রক্ষীদের আকাশচারি টহল।
আকাশে উড়ছে সাদা-ল্যাভেন্ডার পতাকা, আর প্রতিটি কোণে বাতাসে বেজে চলেছে সুরেলা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ। রিসেপশনের জন্য এল্ড্র প্রাসাদ আজ যেন হয়ে উঠেছে এক রাজকীয় স্বপ্নের প্রতিরূপ। সাদা ও ল্যাভেন্ডার এই দুই রঙে গোটা রাজ্য রাঙিয়ে তোলা হয়েছে।
প্রাসাদের চারপাশ আজ যেন হয়ে উঠেছে স্বর্গের কোনো এক খোলা দরজা। এল্ড্র রাজ্যের প্রধান চত্বরে বসানো হয়েছে সুদৃশ্য রঙিন প্যান্ডেল, যার ছাউনি সাদা রেশমে মোড়ানো, আর তার প্রত্যেকটা কিনারায় লাগানো হয়েছে ল্যাভেন্ডার আর রুপালি ফ্রিঞ্জ। মাটিতে বিছানো একদম দুধসাদা রঙের গালিচা।আর গালিচার মাঝে মাঝে আবার ফুটে রয়েছে জ্যামিতিক বেগুনি ফুলের নকশা।
প্রাসাদের চারপাশ ঘিরে লাগানো হয়েছে শত শত সাদা মোমবাতি, তাদের ওপর লেগে আছে ছোট ছোট হীরা-দানার মতো ঝকমকে পুঁতি। রাতের হালকা বাতাসে যখন এসব মোমবাতির শিখা দুলে ওঠবে,তখন মনে হবে আকাশের তারা যেন মাটিতে নেমে এসেছে।
প্রাসাদের মূল হলরুমটিকে সাজানো হয়েছে মুক্তার মতো ঝিলমিলে আলো ধারা।ছাদের উপর ঝুলছে স্ফটিকের বিশাল ঝাড়বাতি, যার প্রতিফলিত আলো নেমে এসেছে মেঝেতে।ঠিক যেনো স্নিগ্ধ ভোরের রোদের মতো।
হলরুমের প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে সিংহাসন পর্যন্ত ল্যাভেন্ডার ফুলের পাপড়ি দিয়ে বিছানো পথ তৈরি করা হয়েছে। প্রবেশদ্বারের দুইপাশে দাঁড় করানো হয়েছে সাদা মার্বেলের ড্রাগনের ভাস্কর্য, সেই ভাস্কর্যের চোখ থেকে নির্গত হচ্ছে ক্ষীণ বেগুনি আলো।
প্রতিটি সারির আসনের পেছনে বাঁধানো হয়েছে রুপালি ফিতেয় মোড়ানো ছোট্ট ফুলের তোড়া। দেয়ালের চারপাশে টাঙানো হয়েছে পাতলা সাদা পর্দা, আর মাঝে মাঝে তার মাঝে ল্যাভেন্ডার রঙের পুষ্পমালর মতো সূক্ষ্ম সোনালী কারুকাজ করা হয়েছে ।
মধ্যমঞ্চের ওপর রাখা হয়েছে দুটি সিংহাসন—একটি সাদা মুক্তার মতো ঝকঝকে, আরেকটি হালকা সোনালি রঙের। আর তাদের পেছনে বিশাল একটি পর্দা, তাতে সূর্য আর নক্ষত্রের নিখুঁত ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। দেখেই মনে হচ্ছে ভেনাস আর পৃথিবীর মিলনরেখা আঁকা হয়েছে সেই ক্যালিগ্রাফিতে।
বাতাসে মৃদু সুগন্ধি ছড়িয়ে যাচ্ছে লুনেরা ফুলের এটি এল্ড্র রাজ্যের বিশেষ সুগন্ধি ফুল।। হলরুমের প্রতিটি কোণ থেকে বয়ে আসছে ছোট ছোট জলরাশির ফোয়ারা থেকে নিরবধি নীলাভ জলের ধারা, আর সেই জলে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা পাপড়ির ফুল।
চারদিকে রাজ্যের সেনারা, প্রজারা, এবং অতিথিরা পরেছে ল্যাভেন্ডার রঙের সাজসজ্জা— আজকে নব দম্পতি বাদে সবাই ল্যাভেন্ডারে সেজেছে।
আঁধার যত ঘনিয়ে আসবে, আলোতে ঝলমল হয়ে উঠবে পুরো রাজপ্রাসাদ। রিসেপশন পরিণত হবে এক রাজকীয় উৎসবে, যার কথা বছরের পর বছর মনে রাখবে এল্ড্র রাজ্য।
আচমকাই পুরো এল্ড্র প্রাসাদ নিস্তব্ধ হয়ে যায়—শুধু কানে এলো এক অভিজাত ঘোড়ার খুরের শব্দ। সেই শব্দ ধীরে ধীরে প্রবেশ কররো রাজচত্বরে। সকলের চোখ তখন একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো মহা প্রাচীন পঙ্খিরাজ ঘোড়ার দিকে, যার ডানাগুলো রুপালি আভায় চকচক করছে আর লেজে জড়ানো রয়েছে বেগুনি ঝালর।
পঙ্খিরাজের পিঠে বসে আছে জ্যাসপার অরজিন—এল্ড্র রাজ্যের প্রিন্স,আজকের রিসিপশনের বর। তার পদক্ষেপ রাজকীয় মাধুর্যে ভরে উঠেছে—এমন দৃশ্য যা এর আগে কখনো কেউ দেখেনি।
জ্যাসপারের পরনে আজ সাদা ও রুপালি রঙে মেশানো দীর্ঘ চুড়িদার কুর্তা-ধরণের রাজপোশাক,পষ পোশাকের বুকে সূক্ষ্মভাবে নকশা করা হয়েছে ড্রাগনের চিত্র যেটা রূপার সুতোয় বোনা হয়েছে। পোশাকের কাঁধে পড়ে আছে হালকা নীলাভ ছায়ার এক রাজচাদর,চাদরটা ঝুলে আছে পেছনে রেশমি ধারার মতোই। কোমরে বাঁধা আছে পাতলা একটি রুপার বেল্ট, বেল্টের মধ্যখানে বসানো একটি সাদা জ্যোতিষ্ক আকৃতির পাথর—যা শুধু রাজপরিবারের উত্তরাধিকারীদেরই পরিধান করার অনুমতি হয়ে থাকে।
চুলগুলো সুন্দর করে সেট করা আর তার সবুজ নেতৃদ্বয় দুটি গভীর হয়ে আছে —নদীর ঠান্ডা ঢেউয়ের মতোই তবুও দুরন্ত—আর রক্তিম বেগুনি ঠোঁটজোড়ায় একটুখানি সংযত হাসি ফূটে আছে।
পঙ্খিরাজ ঘোড়াটা থেমে গেলো সিংহাসনের ঠিক সামনে আয় ঘোড় হতে জ্যাসপার ধীরে ধীরে নেমে পড়লো, মাটিতে জ্যাসপারের পা রাখার সময় চারপাশে হালকা রুপালি ধোঁয়ার মতো এক আভা ফুটে উঠল, ঠিক যেন ড্রাগনরক্তের উত্তরাধিকারীর পা স্পর্শ করলো রাজভূমিকে। সবাই নিঃশব্দে দেখল,সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সিংহাসনের দিকে। তারপর এক চমৎকার ভঙ্গিতে বসে পড়ল তার নিজ আসনে— যা দেখে মনে হলো শতাব্দীর জন্য বানানো এক অটুট সম্মানচিহ্নেতে নিজেকে স্থাপন করলো আজ।
আজ এল্ড্র রাজ্যের আকাশের নিচে জ্যাসপার একমাত্র আলো হয়ে উঠলো আজকে —যা বলে দিচ্ছে নির্বিঘ্ন, নির্ভুল এবং অতুলনীয়।
কিয়ৎক্ষন বাদেই প্রাসাদে সোনালি ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠল, ফুল ছড়ানো সিঁড়ি বেয়ে প্রবেশ করলো একটি রাজকীয় পালকি—পালকিটি ছিলো রাজকীয় কাঠের তৈরি, যার গায়ে খোদাই করা হয়েছে ফুলের নকশা,পালকির চারপাশে ঝুলছে বেগুনি আর সাদা রঙের রেশমি মালা। পালকিটি টেনে আনছে এল্ড্র রাজ্যের অভিজাত রক্ষীরা—তাদের কাঁধে পালকি, আর তিলের প্রতিটি পদক্ষেপে ছন্দময় ধ্বনি ছড়াচ্ছে।
পালকির পর্দা একটু সরতেই হালকা দেখা মিললো ফিওনার—আজকের প্রসাদের নববধূ। তার পরনে বিশাল সাদা রঙের রাজকীয় গাউন, সিল্ক ও লেইসের সূক্ষ্ম কারুকাজে বোনা গাউনটা। গাউনের পিছনে টানা লম্বা ট্রেইন যেন মেঘের ধারা টেনে আনছে সাথে করে। মাথায় হালকা হীরকখচিত মুকুট, কানে ঝুলছে ভেনাসিয়ান হিরের দুল। ফিওনার গলার হারটি এল্ড্র রাজপরিবারের উত্তরাধিকারীদের জন্য বরাদ্দ—যেটা চন্দ্রপাথরের একটি ছোট্ট টুকরোর মতোই।
পালকি থেমে গেলো সিংহাসনের কয়েক কদম দূরে। রক্ষীরা ধীরে ধীরে পর্দা সরালো, আর ঠিক তখনই কৃত্রিম চন্দ্রের আলো এসে পড়লো ফিওনার মুখশ্রীতে। সাদা গাউনের ঝলক আর রুপালি অলঙ্কার আর মাথার হীরক মুকুট—সব মিলিয়ে তৈরি হলো এক অপার্থিব দৃশ্য। ফিওনা ধীরে ধীরে পালকি থেকে নেমে পড়লো,হালকা ভাবে গাউন সামলে নেয়।
এই দৃশ্যেই থমকে যায় দূরে সিংহাসনে বসে থাকা জ্যাসপার।
তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়, ঠোঁট অল্প ফাঁক হয়ে থাকে। যেন কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে সে। চারপাশের সুর, মানুষের কোলাহল, বাদ্যযন্ত্র—সব মুছে যায় তার মস্তিষ্ক থেকে ।
ওর মনে হতে থাকে, যেন স্বর্গের কোনো পরী নেমে এসেছে মাটিতে—শুধু ওর জন্যই জন্ম এই পরির।
ফিওনার প্রতিটি পদক্ষেপে জ্যাসপারের হ্নদয় ছুটে চলে বুনোঘোড়ার মতোই, এখনি হ্নদয় বেরিয়ে আসবে তার পাঁজর ছেড়ে।তার সবুজ দৃষ্টিতে তখন ধরা পড়ে একরাশ বিস্ময় আর উপচে পড়া ভালোবাসা।
ফিওনা ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো সিংহাসনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পায়ে হিল জুতা, আর ভারী রুপালি গাউন—তাতে ওর হাঁটা কষ্টকর হয়ে যায়। প্রতিটি কদমে ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠে। আর চুলের ভাঁজে ঘাম জমে, ঠোঁট শুকিয়ে আসে।
হঠাৎই জ্যাসপার বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
কারও তোয়াক্কা না করে এগিয়ে যায় ফিওনার দিকে। উপস্থিত অতিথিদের মাঝে গুঞ্জন শুরু হয়, কিন্তু জ্যাসপার নির্লিপ্ত। ওর চোখে তখন শুধুমাত্র ফিওনা।
“থেমে যাও ওখানেই,” জ্যাসপার মৃদু স্বরে বলে। তারপর ফিওনার কাছে এসেই এক ঝটকায় ফিওনাকে কোলে তুলে নেয়।গাউনের পেছনের টানাও জ্যাসপার সামলে নেয় নিপুণভাবে। তার চোখে তখন একটাই ভাষা ফুটে ওঠে
—“তুমি আমার একমাত্র রাণী, তোমাকে এক ফোঁটা কষ্ট ও পেতে দিবো না আমি।”
সারা প্রাসাদ তখন স্তব্ধ, অতিথিদের মুখে একটুখানি বিস্ময়ের হাসি,কিন্তু ফিওনার গাল হয়ে উঠে হালকা লালিমা।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে কোলে করেই ফিওনাকে নিয়ে আসে সিংহাসনের সামনে, কোমল ভাবে বসিয়ে দেয় সিংহাসনে, এক রানীর আসনে।এরপর নিজেও গিয়ে বসে পড়ে পুনরায় নিজের আসনে।ফিওনার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। হাতে রাখ হাত যেনো বলে দেয়, তুমি ভয় পেলে আমি হবো তোমার একমাত্র ভরসা।
নব দম্পতির সিংহাসনের পাশেই রাজকীয় আসনে বসে আছেন রাজা ড্রাকোনিস,আর তাঁর ঠিক পাশেই রাজা জারেন,আর তাঁদের মাঝখানে মাথা উঁচু করে বসে আছেন লিয়ারা।তিনজনেই গর্ব আর আনন্দমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন জ্যাসপার ফিওনার পানে।
হলরুম ধীরে ধীরে ভরে উঠছে উজ্জ্বল ল্যাভেন্ডার পোশাক পরিহিত অতিথিদের পদচারণে। চারপাশে গানের সুর বাজছে, আর আতিথেয়তার ব্যস্ততা চলছে পূর্ণমাত্রায়।
এদিকে…
সিলভা আর অ্যালিসা রাজপরিবারের প্রিন্সেসের মতো করে রূপসজ্জায় ব্যস্ত,সাজঘরে রঙে আর অলঙ্কারের ছায়াপটে আলো ছড়িয়ে পড়ছে।
এথিরিয়ন আর থারিনিয়াস সামনের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা করছে। একজন একজন করে পরিচিত মুখ আসছে—ড্রাগনদের সম্মানিত সদস্য, দূর রাজ্য থেকে আগত দূতেরা, আর রাজা ড্রাকোনিসের আর রাজা জারেনের পুরনো বন্ধুজনেরা।
অ্যাকুয়ারা ল্যাভেন্ডার গাউন পরিহিত হালকা সাজে হয়ে উঠেছে অতুলনীয় এক সৌন্দর্যর প্রতীক,তার হাতে ধারা কয়েকটা দামি শপিং ব্যাগ। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কিছুক্ষণ ধরেই মুখে একরাশ দ্বিধা থাকা সত্বেও চোখে ফুটে উঠেছে আত্মবিশ্বাস।
অভ্যর্থনার ব্যস্ততা থেকে সরে এসেই সে ছুটে এলো লিউ ঝানের কক্ষে। অ্যাকুয়ারা নরম গলায় বললো “আপনি কি আজ প্রিন্স আর ফিওনার রিসেপশনে আসবেন না লিউ ঝান?” লিউ ঝান অতিথি কক্ষের জানালার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো উল্টো ঘুরে বাইরের দিকে তাকিয়ে,লিউ ঝান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।
অ্যাকুয়ারা ধীরে ধীরে কক্ষের ভেতরেএগিয়ে এসে বললো
“আপনি জানেন না, আজ ফিওনার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন, আর ফিওনাই চেয়েছে আপনি যেনো আজকের এই দিনটায় ওর পাশে থাকেন।আপনি তো ফিওনাকে মন থেকে প্রিন্সের জন্য সেক্রিফাইস করেছেন তাহলে এখন যদি না যান… তারমানে কি বোঝায়? আপনি এখনো ওকে সেক্রিফাইস করেননি মন থেকে।”
লিউ ঝান এবার চোখ নামিয়ে ঘুরে তাকায় অ্যাকুয়ারার দিকে। চুপ করে থাকলো কয়েক পল।
অ্যাকুয়ারা হালকা হাসলো। কিন্তু গলায় কষ্ট মিশে থাকলো।
“আমি জোর করবো না আপনাকে। কারন জোর করে কখনো কারো সম্মতি আদায় করা যায়না।শুধু বলবো,আমি অনেক বেশি খুশি হবো যদি আপনি সেখানে উপস্থিত থাকেন।আমি কখনো কিছু চাইনি শুধু এটুকুই চাই।”
অ্যাকুয়ারা শপিং ব্যাগ গুলো থেকে পোশাক বের করলো ব্যাগের ভেতরে সুশ্রী ল্যাভেন্ডার প্রিন্সলি পোশাক।
অ্যাকুয়ারা পুনরায় বললো
“আপনার জন্য এই পোশাকটা আমি রেখেছি।এগুরো বিছানায় রেখে গেলাম। যদি ইচ্ছে হয় পরে হলরুমে চলে আসবেন।”
এই কথা বলেই অ্যাকুয়ারা ধীরে ধীরে পেছন ঘুরলো তারপর সোজা বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।অ্যাকুয়ারা বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই লিউ ঝান চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। বাকি দৃশ্য রয়ে গেলো নিঃশব্দে, নিভৃতে এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
বাঁশির সুর বদলে যায়। এবার ঘোষিত হয় রাজপরিবারের বাকী নারীদের আগমনের বার্তা। প্রথমে মৃদু পায়ে প্রবেশ করে সিলভা। আজ তার পরনে রূপালি চিকচিকে জরি-করা হালকা ল্যাভেন্ডার গাউন,উরন্ত খোলা চুল,গলায় একটিমাত্র মুক্তার হার।সিলভার প্রতিটি পদক্ষেপই নিঃশব্দ সংগীত ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশটায়।
এথিরিয়ন, প্রধান দরজায় দাঁড়িয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা করতে করতে,হঠাৎ দৃষ্টি চলে যায় সিলভার দিকে আর তখনি সিলভাকে দেখে থমকে যায় হ্নদস্পন্দন। এথিরিয়নের চোখে ফুটে উঠে বিস্ময়,তবুও মুখে এক অসমাপ্ত হাসির রেখা।
এথিরিয়নের মন তখন বলে উঠে এক মুহুর্তে
“এতদিনের পরিচয়…এতবার কাছ থেকে দেখেছে সিলভাকে অথচ আজ মনে হচ্ছে আবার প্রথমবার দেখছে। চাঁদের উজ্জল কিরন নেমে এসেছে মর্ত্যেতে…”
সিলভা মুখে হালকা হাসির রেখা টেনে, লিয়ারার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো আর এথিরিয়ন দুর থেকেছি নিচু গলায় ফিসফিস করে বললো “আজ প্রাসাদের বাকি সব আলোকে তুমি এক নিমিষেই ম্লান করে দিয়েছো, হাজার নক্ষত্রের মাঝে এক টুকরো চাঁদ হয়ে আমার চোখের সামনে ধরা দিয়েছো।”
এরপর প্রবেশ করে অ্যালিসা। রাজকন্যা হয়েও তার সাজে ফুটে উঠেছে কোমলতা।সে পড়েছে ল্যাভেন্ডার রঙের ভেলভেট কেপ সহ গাউন,আর কানের দুলজুড়া ছোট ছোট জ্যোতিষ্কের নকশার মতো।
এরপরেই মুহূর্তে আলো থেমে যায় একবার।আলবিরা প্রবেশ করে হলরুমে।
আলবিরার পোশাকে আজ অন্যরকম এক দীপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে—ল্যাভেন্ডার রঙের পোশাকে সোনালি এমব্রয়ডারির ঝলক রয়েছে।কোমরে বাঁধা রুপার বেল্ট, আর মাথায় ছোটো টিকির মতো সাজ। চোখে সাহস আর ঠোঁটে ফূটে উঠেছে সামান্য হাসি।
থারিনিয়াস এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ তার দৃষ্টি আলবিরার দৃষ্টির সাথে আটকে যায়। মুহূর্তেই মিলন ঘটে দুজোড়া চোখের। থারিনিয়াসের চোখ কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়।
থারিনিয়াসের মনোলগ তখন বলে উঠে “হাহ্ কার সঙ্গে যুদ্ধ করেছি এতদিন? ওই চোখের দখল নিতে, নাকি ওই হৃদয়ের দখল নিতে?”
আলবিরা হেসে তাকায় থারিনিয়াসের দিকে। মাথা একটু কাত করে।আর থারিনিয়াস তখন না পেরে নিজের বুকের বাম পাশে হাত রাখে আর নিজের হ্নদস্পন্দনের শব্দ অনুভব করে।
আলবিরা ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে আসলো। হালকা পায়ে হেঁটে এসে যখন থারিনিয়াসের কাছাকাছি দাড়ালো, থারিনিয়াস তখন গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকলেও তার চোখ আলবিরার প্রতি আটকে গেলো।
আলবিরা থেমে দাঁড়িয়ে বললো,
“কি ব্যাপার, চোখ দিয়ে গিলে খাওয়ার আগে একটা কথা মনে রেখো আমি তোমার খাবারের মেনু না।”
থারিনিয়াস ঠোঁটের কোণে হাসি চেপে বললো,
“তোমাকে দেখলেই মনে হয় বিরা —যে বিশ্বজয় নয়, বরং এই একজনকেই পেতেই …আমাকে যুদ্ধ করে যেতে হবে সবার বিরুদ্ধে ।”
আলবিরা হেসে তার গাউন সামান্য সরিয়ে সামনে এক পা এগিয়ে বললো, “তোমার কবিতা শুনেই মনে হচ্ছে পালিয়ে যাই এল্ড্র রাজ্য থেকে।”
থারিনিয়াস হালকা কণ্ঠে বলে, “তুমি পালানোর চেষ্টা করেই দেখো,ভাগ্য তোমাকে আবার টেনে আনবে আমার সামনে। আর তখন কিন্তু আর ছাড়বো না তোমাকে যদিও এখনো আমি তোমাকে পালাইতে দিবো না।”
আলবিরার মুখে হাসি জমে ওঠে, কিন্তু চোখে এক রহস্যময় মায়া ছড়িয়ে পড়ে।সে ধীরে ধীরে বলে উঠে “দেখা রাখা কিভাবে আমাকে আটকে রাখো।খেলাটা এবার জমবে মনে হচ্ছে।”
থারিনিয়াস একটু ঝুঁকে বললো,”তোমার কাছে আমি হারতেও রাজি।”
আলবিরা থারিনিয়াসকে হালকা ধাক্কা মেরে বললো,
“বেশি কথা বললে কিন্তু সবাই সন্দেহ করবে। আর তুমিতো দেখছি অনেক বেশি প্রেমে পড়ে গেছো।”
থারিনিয়াসের চোখ তখন আগুনের মতো উজ্জ্ব হয়ে উঠলো আর ফিসফিস করে বললো , “সে তো বহু আগেই পড়েছি, এখন শুধু স্বীকার করছি।”
রিসেপশন হলটা তখন অতিথিদের আড্ডায় জমে উঠেছে। হঠাৎ চারপাশের আলো যেন খানিক নরম হয়ে আসলো।
সোনালী ল্যাভেন্ডার রঙের সমন্বয়ে তৈরি রেশমি পোশাকে পরিহিত। যার আকাশী রঙের চুলে ছোট্ট মুকুটটা জলজল করে উঠছে। হালকা সাজে অ্যাকুয়ারা ধীরে ধীরে হলরুমে প্রবেশ করলো।তার চলাফেরায় ফুটে উঠলো এক রাজকীয় মাধুর্যতা।আর চোখে আত্মবিশ্বাসের ছায়া আর মুখে হালকা হাসি। গায়ের ওপরের গাউনের পাতলা জর্জেটের অংশটা বাতাসে দুলে উঠছে বারবার। আর সেই দুলে উঠা গানটা যেনো এক জাদুর আস্তরণ ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে।
প্রবেশমুহূর্তেই কিছু অতিথির দৃষ্টি তার দিকে ঘুরে যায়। কাচের ঝাড়বাতির নিচে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই তার পোশাকের পাথরের কাজগুলো ঝিলমিলিয়ে ওঠলো।
অ্যাকুয়ারা চোখ ঘুরিয়ে অতিথিদের দিকে তাকায়, তারপর সোজা সামনে এগিয়ে যায়। পাশ দিয়ে হেঁটে যায় লিউ ঝান না থাকলেও—তার মনটা নিঃশব্দে বলে ওঠে নিজের মনে,”এই আনন্দে আপনি থাকলে ভালোই হতো…”
তারপর ধীরে ধীরে হেটে এসে দাঁড়ায় আলবিরার পাশে।অ্যাকুয়ারা অন্য সবার মতো চুপচাপ নয়—অ্যাকুয়ারা যেন এক আলাদা জগত থেকে আসা অতিথি, যার চোখে এখনো লিউ ঝানের অপেক্ষার ছায়া ফুটে আছে।
হলরুমের সিংহাসনে বসে আছে জ্যাসপার ও ফিওনা। একে অপরের পাশে,জ্যাসপারের চোখে রাজকীয় গাম্ভীর্য আর ফিওনার চোখে-মুখে লাজুক হাসি। জ্যাসপারের চোখ তখন ও ফিওনার দিকেই নিবদ্ধ, একবারের জন্যও চোখ সরায়নি।হলরুমের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সুগন্ধি ফুলের ঘ্রাণ,ধীরে ধীরে অতিথিরা একে একে এগিয়ে আসে সিংহাসনের দিকে।
প্রথমেই এগিয়ে আসেন জ্যাসপারের বাবা রাজা জেনথ ড্রাকোনিস। তিনি জ্যাসপারের মাথায় সস্নেহে হাত রাখেন, তারপর ফিওনার দিকে তাকিয়ে কোমল কণ্ঠে বলেন,”আজ এল্ড্র রাজ্যের হৃদয় জিতে নিয়েছো তোমরা,আমি আমার পুত্র আর পুত্রবধূকে নিয়ে গর্বিত।” তারপর এক তোড়া শুভ্র গোলাপ তাদের হাতে দিয়ে ফিরে যান নিজের জায়গায়।
তারপর রাজা জারেন ও রাজরানী লিয়ারা এসে ফিওনার কপালে চুম্বন করে আশীর্বাদ দেন।
লিয়ারা ফিসফিস করে বলে ওঠেন, “তোমার পৃথিবীর মা আজ বেঁচে থাকলে অত্যন্ত খুশি হতেন আমি তোমার আসল মা কিন্তু তোমার জীবনে তোমার আসল মা তিনি যে তোমাকে লালন পালক করেছিলেন তার স্মৃতি কোনদিন ও তোমার মন থেকে মুছে যাবেনা।।” ফিওনার চোখে এক মুহূর্তের জন্য জল টলমল করে ওঠে মনে পড়ে যায় সেই স্মৃতি তার বাবা মায়ের কথা আর তার একমাত্র গ্ৰান্ডপা।
ফিওনার জীবনে হয়তো এখন অনেককিছুই আছে তবে অনেককিছুই হারিয়ে গেছে। তার জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষদের থেকে আজ কতো দূরে। দুটো গ্রহের দুরত্ব যা কোনো সাময়িক দুরত্ব না। ফিওনার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। লিয়ারা বুজতে পেরে ফিওনার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলেন ” একদম কাঁদবে না, আমি তো আছি তোমার মা আমি এখন ও আছি আমি থাকতে তোমাকে কোনো কষ্ট আমি পেতে দিবো না।” ফিওনা এক মুহুর্তে আশ্বাস পায়।
এরপর আসে থারিনিয়াস আর আলবিরা একসঙ্গে ।
আলবিরা হালকা হাসি দিয়ে ফিওনার কানে ফিসফিস করে বললো “অভিনন্দন এল্ড্র রাজ্যের একমাত্র রানী!”
আর থারিনিয়াস জ্যাসপারের সামনে হালকা মাথা ঝুকে সম্মান প্রদর্শন করে বললো ” কনগ্ৰেচুলেশন! প্রিন্স অরিজিন, সারাজীবন একসাথে এভাবেই হাসিখুশি থাকুন।আমি থারিনিয়াস যতদিন বেঁচে থাকবো আপনার আর ফিওনাল মধ্যে কোনো বাধা আসতে দিবোনা আমি সবসময় আপনার পাশে থাকবো প্রিন্স যেকোনো পরিস্থিতিতে।”
এরপর আলবিরা আর থারিনিয়াস দুজনে মিলে একটা ল্যাভেন্ডার রঙের ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে পুনরায় নিজেদের জায়গায় ফিরে যায়।
এরপরেই সিলভা এগিয়ে যায় স্টেজের দিকে আর সেটা দেখা মাত্রই এথিরিয়নও চলে আসে আসে। সিলভা একটু ভয় পেয়ে থাকলেও ফিওনার পাশে দাঁড়িয়ে এক তোড়া মিষ্টি বেগুনি ফুল বাড়িয়ে দিয়ে বললো “তোমাকে স্বর্গের পরির মতো লাগছে আজকে।”
এদিকে এথিরিয়ন জ্যাসপারের পাশে দাঁড়িয়ে বললো”
“শুভ কামনা জ্যাসু ভাইয়া আশা করি আজকের বাসরটা ভালোই হবে, এটা শুনেই জ্যাসপার কিছুটা রাগি চোখে তাকালো এথিরিয়নের দিকে আর ফিওনা লজ্জায় ঠোঁট চেপে রাখলো। এথিরিয়ন পুনরায় ফিসফিস করে বললো
“আর হ্যাঁ এবার আমার দিকটাও ভেবো!” এটা শুনতেই সিলভা তখন বুঝে গেলো এথিরিয়ন তাকে উদ্দেশ্য করেই বলছে। এটা শোনামাত্র সিলভা সেখান থেকে প্রস্থান করে ফেললো।
সবশেষে ধীরপদক্ষেপে সিংহাসনের কাছে আসলো অ্যাকুয়ারা। তার হাতে রয়েছে একটা নীল-সাদা ফুলে সাজানো তোড়া।ফিওনার দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠলো ,
“তোমাকে সত্যিই স্বর্গের রানির মতো লাগছে আজকে ফিওনা।” এটা বলে সরাসরি তাকালো জ্যাসপারের দিকে আর বললো ” প্রিন্স অরিজিন আপনার নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর আমার এই প্রিয় বন্ধু এই এল্ড্র রাজ্যের একমাত্র রানিকে সবসময় আগলে রাখবেন।”
সবার কণ্ঠে শুভকামনা, মুখে হাসি, আর হাতে ভালোবাসা। ফুলের সৌরভে, শব্দের উষ্ণতায় আর চোখের ভাষায়—রিসেপশনটা হয়ে ওঠলো এক স্বপ্নময় মুহূর্ত।
রিসেপশন হল তখনো গুঞ্জনে ভরপুর। অতিথিরা হাসছে, ছবি তুলছে, সুর বাজছে নরম তালে তালে। অ্যাকুয়ারা ধীরে ধীরে স্টেজের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকে, আজকে তার রূপে আভিজাত্য আর প্রশান্তি মিলেমিলে একাকার।অথচ ঠিক তখনই,যেন সময় থেমে যায় চারপাশে— সিঁড়ির বিপরীত দিক থেকে নেমে আসে এক নিঃশব্দ চমক।
লিউ ঝান।
সেই মুহূর্তে যেন চাঁদের আলো এসে পড়ে তার গায়ে।আজ তার পরনে অ্যাকুয়ারার পছন্দ করে রাখা ঐতিহ্যবাহী এল্ড্র স্টাইলের পোশাক। মাথার চুল হালকা পেছনে আঁচড়ানো, চোখে সেই চেনা গাম্ভীর্য। ল্যাভেন্ডার রঙের পোশাকে সে যেন হয়ে উঠেছে কোনো এক রুপকথার রাজপুত্র। কাঁধে হালকা রাজকীয় কারুকাজ করা সুটে বেশ মানিয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে নিজেও এই এল্ড্র রাজ্যের আরেক প্রিন্স।চোখে লেগে নির্লিপ্ত কিন্তু গভীর দৃষ্টি।আর গা থেকে এক ধরনের অদৃশ্য মাধুর্য ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।
সবার চোখ ঘুরে যায় লিউ ঝানের দিকে।
কোনো কোলাহল নেই, শুধু এক মুহূর্তের স্তব্ধতা।
অ্যাকুয়ারা থেমে যায়। সিঁড়ির এক ধাপে দাঁড়িয়ে, নীচের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ তুলে ফেলে মুহুর্তেই।
অ্যাকুয়ারার দৃষ্টিতে বিস্ময় আর মুগ্ধতা মিশে যায়— অ্যাকুয়ারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে আর মনে মনে বলে
“আজ সত্যি তাকে … রাজপুত্রের মতো লাগছে।”
কিন্তু সেই মুহূর্তেই, লিউ ঝানের চোখ সোজা চলে যায় স্টেজে বসে থাকা ফিওনার দিকে।
ফিওনা ঠিক তখনই তার দিকে তাকিয়ে ছিল।ফিওনা হালকা অভিভূত, তবে চমকে যায় না। দৃষ্টিতে হালকা কাঁপন ছিলো ফিওনার। সে জানে না কী বলবে, দৃষ্টিতে কিছুটা অপ্রস্তুততা চলে আসে।
জ্যাসপারও চুপ হয়ে আছে। সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসে থাকা অবস্থায় সে সোজা হয়ে বসে পড়ে,একটুখানি কপাল ভাঁজ করে আর তিক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় লিউ ঝানের দিকে।
লিউ ঝানের মুখ শক্ত হয়ে আসে।
তার বুকের ভেতর হালকা মোচড় দিয়ে উঠে—
এই মঞ্চে আজ জ্যাসপার আর ফিওনা পাশাপাশি বসে থাকা দৃশ্যটা যেন এক ছুরির মতো বুক চিরে বেরিয়ে যাচ্ছে তার।
তবুও সে মাথা উঁচু করে হাঁটলো।স্টেজের সামনে এসে দাঁড়ালো। তার হাতে ছিলো ফুলের তোড়া—সাদা, বেগুনি আর সোনালি রঙের ফুলে মোড়া।
সে তোড়াটা বাড়িয়ে দেয় ফিওনার দিকে, গলা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে, “শুভেচ্ছা রইলো তোমাদের জন্য। সুখে থেকো সারাজীবন একসাথে।”
ফিওনার দিকে বাড়ানো ফুলের তোড়া টা জ্যাসপার নিয়ে নেয়। মুখে অভিজাত এক হালকা হাসি ফুটিয়ে জ্যসপার বলে উঠে — “ধন্যবাদ।”
ফিওনা কিছু বলতে পারে না। শুধু হালকা মাথা নাড়ে।
তবে চোখের ভাষা বলে দেয়—এটা ছিল অপ্রত্যাশিত, অদ্ভুতভাবে হৃদয় বিদারক দৃশ্য।
তারপর লিউ ঝান এক পা পেছনে সরে দাঁড়ায়,
নীরবে, গাম্ভীর্য নিয়ে—কিন্তু এবার আর একা নয়।
কারণ, অ্যাকুয়ারা এক পা সামনে এসে তার পাশে দাঁড়ায়।দুজনে একসাথে নেমে যায় স্টেজ থেকে।
কিছু সময় বাদে হলরুমের এক কোণে লিউ ঝান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতের ধরা কাঁচের গ্লাসে হালকা কমলা রঙের জুস,ছাদের ওপরের ঝাড়বাতির আলো এসে পড়ছে তার গায়ে। সে ধীরে ধীরে চুমুক দেয় জুসের গ্লাসে।
সবার মাঝখানে আলোয় ঝলমল করছে জ্যাসপার আর ফিওনা—সিংহাসনে বসে থাকা নবদম্পতি। তাদের চারপাশে অভিনন্দনের ভিড়,হালকা হাসিতে আর সোনালি রঙের ঝলকানিতে মুখোর হয়ে আছে পরিবেশ।
তবে লিউ ঝানের দৃষ্টি আটকে আছে শুধু একজনের মধ্যে—ফিওনা। লিউ ঝান এক ঝলক তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার তাকায়।এভাবেই দেখে যাচ্ছে ফিওনাকে।
চোখের তলে অতীতের ছায়া খেলে গেলো এক মুহুর্তে লিউ ঝানের। ফিওনার মুখে এখন হাসি,কিন্তু লিউ ঝানের মনে পড়ে যাচ্ছে।
শত বছর আগে একটা শীতের ভেনাসের দুপুরে,
ফিওনা গাউনের ওপর রাজকীয় সাদা সোয়েটার পরে তার পাশে বসে বলেছিল, “জাইরন আমি সবসময় এমন শীতের দুপুর তোমার সাথে কাটাতে চাই,আমার মনে হয় এখন সময় এসে গেছে আরডন ভাইয়াকে জানানোর আমাদের বিয়ের বিষয়টি নিয়ে কথা বলা দরকার।।”
আরেকটা গ্রীষ্মের ভেনাসের সন্ধ্যায়। প্রাসাদের কর্নারে দুজনে একসাথে আইসক্রিম খাচ্ছিল,ফিওনা তখন বলেছিল, “জাইরন আইসক্রিম গলে শেষে হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের এই মুহূর্তটা কখনোই শেষ না হোক।”
জুসের গ্লাসটা পুনরায় লিউ ঝান ঠোঁটে তোলে, চুমুক দিলো।হঠাৎ মুখ শক্ত হয়ে যায়। তার চোখে ফূটে উঠে একটুখানি দহন, বুকের ভেতর কেমন যেন একটা শূন্যতা বয়ে যাচ্ছে।
ফিওনার দিকে তাকিয়ে সে বুঝে ফেলে—তাকে আজ শুধু বাহারি গাউনে দেখা যাচ্ছে না, ও এখন অন্য কারো চিরদিনের সঙ্গীর রুপে বসে আছে।
হলরুমের ব্যস্ততা, আলো, শব্দ, গানের ছন্দ—সবকিছুর মাঝেও লিউ ঝানের ভেতরে কেবল নিঃশব্দতা বিরাজমান।
সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েই আছে,জুসের গ্লাসটা তখন ও হাতে, দৃষ্টি দূরে…ঠিক তখনই একটা কোমল স্পর্শ অনুভব করলো।
লিউ ঝান অনুভব করলো কেউ তার হাত ধরেছে।
সে ঘুরে তাকাতেই দেখে অ্যাকুয়ারা—গম্ভীর মুখে সামনে তাকিয়ে আছে অ্যাকুয়ারা কিন্তু চোখে কেমন এক নিঃশব্দ দৃঢ়তা।লিউ ঝান একটু চমকে ওঠে প্রথমে।
অ্যাকুয়ারা মাথা নিচু না করে শান্ত কণ্ঠে ধীরে ধীরে বললো
“আমি জানি আপনি এই মুহূর্তে কি ভাবছেন। কিন্তু লিউ ঝান, কিছু জিনিস চাইলেও পাল্টানো যায় না।নিয়তির কাছে কখনও কখনও আমাদের মাথা নত করতে হয়।
তবে ভুলে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া নয়—এটা নিজেকে আবার নতুন করে ভালোবাসার সুযোগ দেয়া।
আর আমি চাই,আপনি সেই সুযোগটা নেন আপনি সমস্ত কিছু ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে বাঁচুন। কারন কেউ না কেউ আছে যে আপনাকে ভালোবাসে আপনার সব দহন সব কষ্ট শেষ করে দিতে পারবে।”
লিউ ঝান ধীরে ধীরে বলে, “কিন্তু কে আছে এমন… যে আমায় বুঝবে? এটা জানা সত্বেও যে আমি ফিওনাকে কতোটা ভালোবাসি তারপরেও কে আমাকে মেনে নিবে?”
অ্যাকুয়ারা এবার নিঃশব্দে একবার চোখ বন্ধ করলো, তারপর সরাসরি তাকালো লিউ ঝানের চোখে।
তার ঠোঁট কাঁপে না,কণ্ঠ গলা কাঁপে না, চোখেও কোনো দ্বিধা নেই।সরাসরি বললো “আমি।”
শুধু একটুকরো শব্দ,একটা সহজ সিকারোক্তি অথচ যেন এক মহাকাশ ছুঁয়ে গেল।লিউ ঝানের সবকিছু মুহূর্তে থেমে যায়।গায়ে আলোর ঝলকানি পড়ে, হলরুমের কোলাহল আর কানে আসে না।সে তাকিয়ে থাকে অ্যাকুয়ারার চোখে কোনো শব্দ বেরোয় না মুখ থেকে।
অ্যাকুয়ারা এবার লিউ ঝনের হাতটা আরো শক্ত করে ধরলো। সেই অদ্ভুত সাহসী স্পর্শ বলে দিলো…ভাঙা মনেও নতুন করে ভালোবাসার অঙ্কুর ফোটানো যায়।পুনরায় জীবিত করা যায় প্রেমের ফুল।
রিসেপশনের হলরুমে জমে উঠেছে অতিথিদের খাওয়া-দাওয়া আর গল্পের আসরের মধ্যে।
বর্ণিল খাবার সাজানো টেবিলের পাশে বসে আছে লিউ ঝান—চোখে হালকা ক্লান্তি আর ঠোঁটে এক পরিণত হাসি লেগে আছে।ঠিক তার পাশে এসে বসেছে সিলভা, হাস্যোজ্জ্বল আর প্রাণবন্ত হয়ে।
সিলভা আর লিউজান দুজনেই হেসে হেসে কিছূ একটা বলছিলো। মাঝে মাঝে লিউ ঝানের কানে ঝুঁকে কিছু বলতে লাগলো সিলভা—সব মিলে ওদের রসায়ন হয়ে উঠলো এক বন্ধুত্বপূর্ণ।
কিন্তু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এথিরিয়ন সবটাই লক্ষ্য করে যাচ্ছে।তার চোখের দৃষ্টিতে চাপা আগুন জ্বলে উঠলো।
ঠোঁট দৃঢ়ভাবে চেপে ধরলো এথিরিয়ন আর বুকের ভেতর কেমন অস্থিরতা শুরু হলো।
হঠাৎ এথিরিয়ন এগিয়ে এল সিলভার সামনে।
টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে সিলভার হাত একঝটকায় টেনে ধরলো। সিলভা চমকে উঠলো,
“রিয়ন! কি হচ্ছে—”
এথিরিয়ন কোনো জবাব না দিয়ে,একবার লিউ ঝানের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তারপর সিলভার হাত ধরে টেনে নেয়া অবস্থায় সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে যেতে লাগলো।
সিলভা কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু তখন এথিরিয়নের চোখে কেমন এক অপরিচিত জেদ দেখা গেলো।সিলভা নিজেকে ছাড়াতে চাইলো, কিন্তু তার কবজি দুটো এথিরিয়নের লোহার মত হাতের মুঠোয়।সিলভা ফুঁসে উঠলো, “ছাড়ো আমাকে, তুমি পাগল হয়ে গেছো?”
এথিরিয়নের চোখে রক্তাভ ঝলক, ঠোঁটের কোণে একটুখানি হিং*স্র হাসি— “আমি পাগল নই, সিলভা… আমি শুধু আমার জিনিস আমার কাছে নিয়ে এসেছি।”
এথিরিয়ন সিলভাকে সোজা নিয়ে গেল নিজের কক্ষে, দরজা ঠাস করে বন্ধ করে দিল।সিলভাকে নিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল নরম কালো সোফার ওপর।সিলভার চোখ বড় হয়ে গেল,”তুমি পাগল হয়েছো?”
এথিরিয়নের কণ্ঠ গম্ভীর, ধীর কিন্তু ভেতরে দহনের আগুন—”তুমি জানো না, তোমাকে অন্য কারো সঙ্গে হাসতে দেখলে কেমন লাগে আমার। তুমি জানো না, তোমার প্রতিটা হাসির ভাগীদার শুধু আমি হতে চাই, শুধুমাত্র আমি।”
সিলভা নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে এথিরিয়নের চোখে…
আজকে তীব্র দহন আর ভালোবাসা একসাথে ঢেউ খেলছে এথিরিয়নের দৃষ্টিতে।
সিলভার নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে ওঠে। সে উঠে দাঁড়ানোর আগেই এথিরিয়ন ঝুঁকে পড়ে তার খুব কাছাকাছি।সিলভার চিবুক টেনে তোলে, চোখে চোখ রেখে গর্জে ওঠে।
সিলভা এথিরিয়নের চোখে তাকিয়ে বুঝে গেলো—আজ ওর ভেতরের সবকিছু ভেঙে পড়েছে। এথিরিয়নের কথাগুলো যেন ছুরি হয়ে এসে বিঁধছে সিলভার হ্নদয়ে।
“আর কতো! আর কতো আমাকে জালাবে তুমি?”
“একবার ক্যালিক্স.. এখন আবার লিউ ঝান? তুমি আসলে কি চাও, সিলভা?” সিলভা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো কিছু বলতে চেয়েও পারছেনা। এথিরিয়ন পুনরায় গর্জে উঠলো “আজ আমি তোমাকে আমার করেই ছাড়বো।” এই কথা বলেই, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে সিলভার ওপর। সোফার গায়ে চেপে ধরে তাকে, গলায় একের পর এক গাঢ় চুম্বন দিতে থাকে — তীব্র, দাবিদার, রক্তশোষ চুম্বন!
একটির পর একটি গভীর চুম্বন… সিলভার গলা লালচে হয়ে ওঠে, রক্তজমাট বেঁধে যায় ঘাড়ে।
সিলভা কাঁপতে কাঁপতে বলে, “রিয়ন… থামো…”
এথিরিয়ন সিলভার কোনো কথায় কর্ণপাত করেনা।
সিলভা ধস্তাধস্তি করছিল,তার শ্বাস অস্থির হয়ে উঠেছে, চোখে ভয় আর রাগ মিশে গেছে।
কিন্তু এথিরিয়ন হঠাৎ তার চোয়াল ধরে ঠোঁটে কামড় বসায় প্রেমে নয় ,দাবির ভাষায়।গাঢ় চুম্বনে ঠোঁটজোড়া রক্তিম হয়ে উঠে সিলভার। সিলভার ঘাড়ের পাশে দাঁত ছুঁইয়ে দেয় এমনভাবে আরেকটু চাপ দিলেই রক্ত ফেটে বের হবে।
সিলভার বুকের ওপরে জ্বলছিল আগুন,
কিন্তু এথিরিয়নের চোখে ছিল—একটা যুদ্ধ, এক নিঃশ্বাসে তাকে দখল করে নেবার পণ।
এক হাতে সে সিলভার গাউনের চেইন খুলে ফেলে, গাউনের হাতা নামিয়ে আনে কাঁধের নিচে।—গভীর চুম্বন নেমে আসে গলা থেকে বুকের মাঝ বরাবর, আর অন্য হাতে ছুঁয়ে যায় সিলভার পিঠ, কাঁধ, বাহু— সিলভার দেহের প্রতিটি কোণে নিজের ছাপ রেখে যেতে চাইছে এথিরিয়ন।
সিলভার মুখে কেবল ফুটে উঠেছে অসহায়তা।তার সাথে রাগ ক্ষোভ একসাথে। তার চোখ দুটো ভিজে গেছে, কিন্তু এবার আর সে চোখের জল চেপে রাখে না। হঠাৎই সে জোরে জোরে কেঁদে ফেলে—একটা চাপা কষ্ট আর অভিমানের বিস্ফোরণ তার কণ্ঠ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে।
এথিরিয়ন মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায়। তার হাত জমে যায় মাঝপথে, চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠে। “সিলভা…” সে ফিসফিস করে।
কিন্তু সিলভা সেদিকে কর্ণপাত না করে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় নিজের কাছ থেকে। “তুমি কী ভাবো নিজেকে?”—সিলভার কণ্ঠে কাঁপুনি আর রাগ একসাথে। আর ঠিক তখনই তার হাত উঠে আসে—একটা সপাটে চড় বসে এথিরিয়নের গালে।
চড় খেয়ে এথিরিয়নের মুখ হেলে যায় একপাশে।চোখে বিস্ময়, অপমান, আর এক চিলতে লজ্জা ভেসে উঠে তার।
এথিরিয়ন কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকলো, তারপরে নিঃশ্বাস নিয়ে সোজা হনহন করে বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে। কোনো কথা না বলে, কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে।
সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে বেরিয়ে গেলো প্রাসাদের বাইরের দিকে—কেউ তাকে দেখলোনা বেরিয়ে যেতে। তার পদক্ষেপে ছিলো অভিমানের ঝড়, ছিলো গ্লানির বিষ।
সিলভা তখন কক্ষে একা বসে কাঁপতে থাকা শরীরে সোফায় গুটিসুটি মেরে আছে। কান্নার শব্দে কক্ষ জুড়ে নেমে আসে নিস্তব্ধ এক চাপা আর্তনাদ।
রিসেপশনের হলরুমে আনন্দের জোয়ার বইছিলো। খাবার পর্ব শুরু হতেই বাহারি সব পদ সাজিয়ে রাখা হয়েছিলো লম্বা টেবিল জুড়ে। সুগন্ধে মাতোয়ারা চারপাশ। তবে ফিওনার সমস্যা হচ্ছিলো—তার গাউনটা এতটাই ভারি আর লম্বা যে তার জন্য স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটাচলা করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জ্যাসপার একটু হেসে বলেলো, “তুমি গাউনটা চেঞ্জ করে আসো, হামিংবার্ড।আর তাড়াতাড়ি আসবে আমি কিন্তু তোমার জন্য অপেক্ষা করবো,একসাথে খাবার খাবো।”
ফিওনা সামান্য মাথা নাড়ে। সে উঠে যায় হলরুম সংলগ্ন রাজপরিবারের অতিথি চেঞ্জিং রুমে। গাউন পাল্টে সে পরে নেয় হালকা সাদা রঙের সিল্কের ফ্রক বিশিষ্ট আরামদায়ক পোশাক।
আলাইরা আজ সারাদিন ব্যস্ত ছিলো রিসেপশনের সাজসজ্জায়, একেকটা কোণ নিজের হাতে সাজিয়েছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে আজ আলাইরা একবারের জন্যও জ্যাসপার বা ফিওনার সামনে আসেনি।সারাদিন কাজেই ব্যাস্ত ছিলো।
ফিওনা প্রায় এক ঘণ্টা পর নীচে নেমে আসে।প্রথমে প্রাসাদের স্তব্ধতা দেখে সে ভাবে সবাই হয়তো ডান্স ফ্লোরে বা বাগানে গিয়েছে, কিন্তু আস্তে আস্তে তার পায়ের গতি থেমে যায়।
হলরুমে ঢুকতেই চমকে ওঠে ফিওনা। ঝাড়বাতির আলোয় সে দেখলো—চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সকলে। কেউ চেয়ারে, কেউ মেঝেতে, কেউ টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। খাবার-দাবার এলোমেলো পড়ে আছে টেবিলে। মনে হচ্ছে সবাই যেন একসাথে মদের ঘোরে অচেতন হয়ে পড়েছে।
ফিওনার মুখে উদ্বেগ জমে ওঠলো। সবার চোখ বুজে থাকা দেখে তার ভয় হলো। কিন্তু তার হৃদয় হঠাৎ আরো জোরে ধুকপুক করতে শুরু করলো—কারণ সিংহাসন ফাঁকা।
“প্রিন্স?” ফিওনা নিচু গলায় ডাকলো।কিন্তু কোনো সাড়া নেই।সে চারদিক চোখ বুলিয়ে খুজতে লাগলো —কিন্তু কোথাও জ্যাসপার নেই। সিংহাসনের পাশে, বাগানে, করিডোরে—সে কোথাও নেই।
ফিওনার কণ্ঠে উদ্বেগ আর চাপা আতঙ্ক মিলেমিশে একাকার। “কোথায় গেলে তুমি, প্রিন্স? আরা সবার এই অবস্থা কিভাবে হলো?”
তার চোখে তখন একটাই প্রশ্ন—এই ঘুমে ঢলে পড়া রাজপ্রাসাদে, জ্বলজ্বলে সাজসজ্জার মধ্যেও কোথায় হারিয়ে গেলো তার প্রিয়তম প্রিন্স?
প্রসাদের এক কোণে অবস্থিত, অতিথি কক্ষের ঝলমলে ঝাড়বাতির নিচে ধীরে ধীরে আলো-আঁধারির খেলা চলছিলো। ঘরের ভেতর বাতাসটা এতোটাই ভারী আর নীরবতা এতটাই ঘন যে নিঃশ্বাসের শব্দও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।মশারির মতো পর্দা সরিয়ে ভেতরে তাকালে দেখা যায়—
জ্যাসপার, একপাশে মুখ ঘুরিয়ে অর্ধ অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে রাজকীয় বিছানায়। তার কপালে এক ফোঁটা ঘাম জমে আছে, আর নিঃশ্বাস হয়ে আছে ভারী অনিয়মিত। শরীরের পোশাক কিছুটা এলোমেলো।
আর তার ঠিক পাশে, বিছানার ধারে বসে আছে আলাইরা। শরীরটা একটু ঝুঁকে আছে জ্যাসপারের দিকে, চুপচাপ তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে,আলাইরার মুখে অদ্ভুত এক শান্তি বিরাজমান, কিন্তু চোখে একধরনের দাহ—যেটা চেয়েছিলো তা যেন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।
আলাইরার হাতে ধরা একটা সাদা রুমাল, যেটা দিয়ে সে জ্যাসপারের কপালের ঘাম মুছে দিচ্ছে।
বাইরে থেকে হালকা বাতাসে পর্দা নড়ছে। একটা রাত… যা বদলে দিতে পারে সব কিছু।
গতকাল…ফিওনা আর জ্যাসপারের বিবাহ উপরে সবাই তখন দেবতা আভ্রাহারের প্রাসাদে আর অ্যালিসা অসুস্থতার ভান করে থেকে যায় ফ্লোরাস রাজ্যেতে।
বিয়ের ঠিক আগের মুহূর্তে, অ্যালিসা তার ঘরের দরজা বন্ধ করে আলাইরাকে চুপিসারে ডেকে পাঠায়।
“এই সুযোগটা আমাদের বারবার আসবে না, আলাইরা,” অ্যালিসা ধীরে ধীরে বলে। তার ঠোঁটে এক ধরনের নির্মম শীতল হাসি খেলে যায়। “তুমি প্রিন্সকে অনেকবছর ধরে চাও, তাই না?
আলাইরা একটু লজ্জা পেয়ে যায়, চোখ নামিয়ে বললো,”হ্যাঁ, আমি তাকে পছন্দ করি অনেক আগে থেকেই।” অ্যালিসা সামনে এগিয়ে এসে তার হাতে একটা ছোট কাঁচের শিশি ধরিয়ে দেয়। “এইটা শুধু গতকাল রিসিপশনে খাবারে মিশিয়ে দিতে হবে।আধ ঘণ্টার মধ্যে সবাই ঘুমিয়ে পড়বে। এরপর তুমি শুধু প্রিন্সকে সামলাবে। আর আমি বাকিটা সামলাবো।”
আলাইরা প্রথমে একটু দ্বিধা করে।কারন তার মনে একটা ভয় ঝেকে বসে কাজটা অনেকটাই রিস্কি।কিন্তু অ্যালিসা তখন পাথরের একটা বাক্স খুলে দেখায়—ভেনাসের দামি, ঝলমলে,রঙিন সব রত্নপাথর।
“তুমি শুধু প্রিন্সের সাথে এক রাত চাও। আর আমি তোমাকে সে সুযোগের সঙ্গে এসব পাথরও দিবো।”
আলাইরার চোখ মুহুর্তেই চকচকে করে ওঠে।
একদিকে বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা—জ্যাসপার। অন্যদিকে, লোভনীয় রত্নপাথর। আর অ্যালিসার মূল উদ্দেশ্য?
ফিওনার চোখে এমন কিছু তুলে ধরা, যাতে সে আর কোনোদিন জ্যাসপারকে ক্ষমা না করে।
অ্যালিসা জানে, জ্যাসপার ফিওনাকে ভালোবাসে।
আর ঠিক সেই কারণেই, সে চায় তাদের মাঝে চিরদিনের জন্য একটা বিষাক্ত বিভেদ তৈরি করতে ।
তারা দুজনেই বুঝে গেছে—এই এক রাতই যথেষ্ট ফিওনা আর জ্যাসপারের মধ্যে সারাজীবনের ফাটল ধরাতে।
প্রাসাদের এক কোনে নির্জন অতিথিকক্ষে নরম আলোয় মোড়ানো এক বিছানায় অর্ধ অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে জ্যাসপার।ঝিমঝিম করা চোখ, ভারী হয়ে ওঠা নিঃশ্বাস, আর সমস্ত শরীর জুড়ে এক অস্বস্তিকর শূন্যতা বয়ে চলেছে। তার মাথার ভেতর যেন কেউ ধোঁয়া ছড়িয়ে দিয়েছে—সব কিছু আবছা,অস্পষ্ট, অথচ কোথাও যেন একটা বাস্তবতার খোঁচা তাকে চেতনায় ফিরিয়ে আনছিল বারবার।
তার পাশেই বসে ছিল আলাইরা—সাদা-সোনালি গাউনের ঝলকে রূপকথার পরী সেজে।সেদিনকার রাজকীয় উৎসবের আড়ালে সে ছিল এক নীরব ছায়া, অ্যালিসার ছায়াসঙ্গিনী। আজ,সেই ছায়া নিজেই হয়ে উঠেছে জ্বলন্ত আগুনের লাভা।
জ্যাসপারের চোখ খুলে যায় ধীরে ধীরে। দৃষ্টিটা তখনও ঝাপসা, কিন্তু অনুভূতিগুলো তাকে স্পষ্ট করে বলছে—এই স্পর্শ,এই গন্ধ, এই নিঃশ্বাস—এটা ফিওনার নয়।সে ওঠার চেষ্টা করে,কুঁচকে যায় তার ভ্রুযুগল।তবু শরীর সাড়া দেয় না।
আলাইরার নরম হাত তখন উঠে আসে জ্যাসপারের গালের ওপর। “আরও একটু বিশ্রাম নিন প্রিন্স,” মিষ্টি স্বরে ফিসফিস করে বলে সে, জ্যাসপারের কাঁধে মাথা রেখে। তার আঙুলগুলি ধীরে ধীরে জ্যাসপারের গলা বেয়ে বুকে নেমে আসে, যেন প্রতিটি স্পর্শে তাকে বন্দী করতে চায়। এরপর সে এগিয়ে আসে আরও কাছে, ঠোঁট ছুঁই ছুঁই করছে জ্যাসপারের ঠোঁটে—আরও এক ইঞ্চি মাত্র দূরত্ব।
ঠিক তখনই—
“ঠাস!”
একটানা নীরবতা চিরে দরজা খুলে যায় প্রচণ্ড শব্দে।
আলোকছায়ায় ঢেকে যাওয়া কক্ষের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছায়া। কে এসেছে? সেই প্রশ্ন তখন স্থির বাতাসে কাঁপছে, আর জ্যাসপারের ঝাপসা চোখে সেই ছায়াটিই যেন এখন একমাত্র বাস্তব।
দরজার শব্দটা যেন বজ্রপাতের মতো ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিলো।আচমকা সেই শব্দে আলাইরা কেঁপে উঠে পিছনে তাকালো—
আর ঠিক সেই মুহূর্তে—
রাত অনেকটা গড়িয়ে গেছে। প্রাসাদের ঘড়ির কাঁটা তখন মধ্যরাত পেরিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। অতিথিকক্ষের জানালায় চাঁদের আলো ঝরে পড়ছে জ্যাসপারের মুখে। হঠাৎ সে তীব্রভাবে চোখ মেলে তাকালো। ঝাপসা দৃষ্টি এখন অনেকটাই স্বচ্ছ—মস্তিষ্কে ধীরে ধীরে ফিরে আসছে চেতনার স্পষ্টতা।
জ্যাসপার এক ঝটকায় উঠে বসল। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো—পুরো কক্ষে নিস্তব্ধতা, নীরবতা আর শূন্যতা। আলাইরা নেই, কেউ নেই। ঘরের পরিবেশ, ছায়া, বাতাস—সব কিছুতেই একটা অদ্ভুত ভার।
জ্যাসপার উঠে দাঁড়ায়। তার মনের মধ্যে তখন একটাই নাম বারবার ধ্বনিত হচ্ছে—ফিওনা।
সে দৌড়ে যায় বাইরে। প্রাসাদের হলরুমে প্রবেশ করে সে দেখে—সবাই ঘুমিয়ে আছে। যেন কোনো মায়াবী ঘুম সবাইকে ঘিরে ফেলেছে। কেউ মেঝেতে, কেউ সোফায়, কেউ এক কোণে পড়ে—যেমন যেমন ভাবে পেরেছে ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। কিন্তু—ফিওনা নেই।
পাগলের মতো হয়ে যায় জ্যাসপার। তার চোখ যেন আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে। একে একে প্রতিটি কক্ষ, করিডোর, বাগান, ছাদ—সব তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ায়। প্রতিটি জানালা খোলে, প্রতিটি দরজা ঠেলে দেয়। ফিওনার নাম চিৎকার করে ডাকে, কিন্তু নিজের কন্ঠের প্রতিধ্বনি ছাড়া কোনো উত্তর পায়না জ্যাসপার।
শেষে, সে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়ে। ঠাণ্ডা রাতের হাওয়া তার পাজরে শ্বাস কেটে যায়, কিন্তু তার ভ্রু নড়ে না। সে ছুটতে থাকে—অনুভূতিতে ভর করে, ভালোবাসার আঁচে দগ্ধ হয়ে।
দূরে, বহু দূরে—একটি ছোট্ট পাহাড়। আর পাহাড়ের ঢালে একটি বড় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ের অবয়ব—উল্টো মুখ করে, নিঃশব্দে।
জ্যাসপার থেমে যায়। এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা।
তারপর নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে যায় সে—চিনে ফেলে স্পষ্টভাবে সেই অবয়বটিকে।
ফিওনা।
চাঁদের আলোয় ফিওনার বাদমী চুল ঝিলমিল করছে। হাওয়ায় ওড়ে যাচ্ছে তার গাউনের পাড়, আর গাছের ছায়া তার মুখ ঢেকে রেখেছে। জ্যাসপার ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, বুকের ভেতর তীব্রভাবে ধুকপুক করতে থাকা হৃদয় নিয়ে।
সে একদম কাছাকাছি পৌঁছায়, কিন্তু মুখে শব্দ ফুটে না।চাঁদের আলোয় পাহাড়ের ঢালে দাঁড়ানো সেই অবয়বটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। জ্যাসপার কাছে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসা কণ্ঠে ডাকে—
“ফিওনা…”
সে নামটা উচ্চারণ করতেই যেন বাতাস থেমে যায়।
মেয়েটি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায়।
জ্যাসপার চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে—ফিওনার মুখ, গলা, হাত—রক্ত মাখা ছিটানো রক্তের মতো।
“ফিওনা!” জ্যাসপার ছুটে গিয়ে তাকে জাপ্টে ধরে। চোখে-মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। “এই র*ক্ত কেনো তোমার শরীরে?কোথায় কেটেছে তোমার? ফিওনা, বলো! তুমি ঠিক আছো তো?তুমি কি কাঁদছো?”
কিন্তু ফিওনার চোখে কোনো জল নেই। বরং সেই চিরচেনা কোমল চোখে আজ কিছু অজানা, কিছু গভীর, রহস্যময় ছায়া খেলে আছে।
সে কোনো কথা না বলে, চুপচাপ নিজের পা জোড়া উঁচু করে জ্যাসপারের ঠোঁটে আলতো করে একটি আঙুল রাখে।”শান্ত হও প্রিন্স” তার ঠোঁটে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু চোখ বলে দিচ্ছে সব।
তারপর কোমরের ছোট পাউচ থেকে একটি ছোট্ট বোতল বের করলো ফিওনা।বোতলের গায়ে লেখা—NTC-7।
জ্যাসপার হতভম্ব! সে কিছু বলার আগেই ফিওনা বোতল থেকে সামান্য তরল রুমালে ঢালে। তারপর সেই রুমাল দিয়ে জ্যাসপারের গালে, গলায় আলতো করে মুছে দিতে থাকে। যেন কোওনো চিহ্ন মুছে দিচ্ছে, কোথাও চেতনার পর্দা নামিয়ে দিচ্ছে । তারপর জ্যাসপারের পোশাকের সামান্য অংশ সরিয়ে,জ্যাসপারের বুকে কিছুটা তরল মেখে দেয়। প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি নড়াচড়া গভীর, মৃদু, অথচ পরিকল্পিত।
জ্যাসপার অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে।
“ফিওনা… তুমি কী করছো?” কিন্তু ফিওনা তখনও নিরুত্তর। তার চোখে এক অন্য জগতের ছায়া।
জ্যাসপারের চোখে বিস্ময়, মনে হাজার প্রশ্ন নিয়ে ফিওনার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার শরীরে একে একে ছোঁয়া লাগছিল সেই তরল—NTC-7।
ফিওনার হাত যত জ্যাসপারের গাল, গলা, আর বুক ছুঁয়ে যাচ্ছিল, ততই তীব্র হয়ে উঠছিল একধরনের জ্বালা। আগুনে পোড়ার মতো নয়, বরং অদ্ভুত এক রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া—মনে হচ্ছিল গায়ের চামড়া কেঁপে উঠছে, যেন ভেতর থেকে কিছু একটাকে পরিষ্কার করে দিচ্ছে।
জ্যাসপার দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে। তার বুকের মধ্যে হঠাৎই কিছুটা খচখচ করতে শুরু করে।
আর তখনই তার মনে পড়ে—আজকে রাতে অতিথি কক্ষে…
সে তো জ্ঞান হারিয়েছিল! কিন্তু পুরোপুরি নয়—শেষবারের সেই জুসে দুই চুমুকই তার চেতনা কেড়ে নিতে পারেনি।
তবু…সেই মুহূর্তে কেউ তার গায়ে স্পর্শ করেছিলো কি?
জ্যাসপারের দৃষ্টি এক ঝটকায় ফিরে আসে ফিওনার চোখে।
জ্যাসপার ফিওনার রক্তমাখা চেহারা দেখে নিশ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছিলো, তার বুক ধড়ফড় করে উঠছে এখনও। ক্যামিকেলের জ্বালাও তার কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছে ফিওনার এমন অবস্থা দেখে। হাতে-পায়ে, গলার কাছে লেগে আছে শুকনো আর ভেজা রক্তের ছোপ। ফিওনার চোখে তখন অদ্ভুত এক উষ্ণতা… না যেন কষ্ট, না যেন রাগ, বরং একটা অনির্বচনীয় অনুভূতি।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে জ্যাসপারের দিকে।
জ্যাসপার হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে— সে নড়তে পারে না, বলতে পারে না কিছু।
ফিওনার ডান হাতটা, যেখানে রক্ত লেগে আছে, সেটা বাড়িয়ে দেয় জ্যাসপারের গালে।র*ক্ত জ্যাসপারের গালের সাদা চামড়ায় ছড়িয়ে পড়ে—গরম, ভেজা, আর সেই সঙ্গে ফিওনার কাঁপা কাঁপা হাতের ছোয়া।
তারপর সে হাতটা নামিয়ে আনে জ্যাসপারের গলার দিকে চোখ বন্ধ করে গলার বাঁদিকে আলতো করে স্পর্শ করে…আর তারপর—
একটা দীর্ঘ চুমু। রক্তমাখা ঠোঁট দিয়ে সে জ্যাসপারের গলায় এক গভীর চুমু এঁকে দেয়।জ্যাসপারের শরীর শিউরে ওঠে।তার দেহে জমে থাকা সব অভিমান, সন্দেহ, প্রশ্ন যেন হঠাৎ করেই বিলীন হয়ে যায়।
ফিওনার শরীর থেকে গলে পড়া রক্তে জ্যাসপারের বুকেও ছড়িয়ে পড়ে লাল দাগ।
দুজনের দেহে, দুজনের নিঃশ্বাসে মিশে যায় আতঙ্ক আর আকাঙ্ক্ষা। জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিসফিস করে, “ফিওনা… তুমি ঠিক আছো তো?”
কিন্তু ফিওনা কিছু বলে না।সে শুধু র*ক্তমাখা আঙুলগুলো জ্যাসপারের ঠোঁটে ছুঁয়ে দিয়ে বলে—
“শশশশশ।”
হঠাৎ করেই ভেনাসের আকাশ কালো হয়ে আসে। এক মুহূর্তে যেন ভেনাস থমকে দাঁড়ায়, আর পরক্ষণেই—
ঝরঝরঝর—
প্রবল বৃষ্টি নামে। বিদ্যুৎ চমকে ওঠে দূর পাহাড়ের কোণে।
ফিওনার সাদা পোশাকে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে যায়, একে একে গলে পড়ে যায় বৃষ্টির জলে।সাথে জ্যাসপারের গায়ে লেগে থাকা রক্তের তরল ও ধুয়ে যায়। ফিওনার চুল ভিজে গিয়ে ঘাড় বেয়ে ঝুলে পড়ছে,ঠোঁট কাঁপছে ঠান্ডায়, কিন্তু চোখ… চোখে এক ধরনের অদ্ভুত শীতলতা।
জ্যাসপার চমকে উঠে ফিওনার হাত ধরে।
“চলো, ফিওনা। এত বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ হবে… প্রাসাদে ফিরে চলো। প্লিজ।”
কিন্তু ফিওনা ধীরে মাথা নাড়ে।তার কণ্ঠে একটা রহস্যময় শীতলতা মিশে যায়—“না, প্রিন্স… আজ আমাদের বাসর রাত।আর বাসর হবে এখানেই। আমি সব কিছু গুছিয়ে রেখেছি।”
জ্যাসপারের চোখ বিস্ময়ে ছেয়ে যায়।
সে তাকায় ফিওনার চোখের দিকে—
কিন্তু সেখান থেকে কিছুই পড়তে পারে না।
“ওই দেখো…” ফিওনা হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে গাছের তলায় ইশারা করে। জ্যাসপারও তাকায়।
একটা ছায়াময় কোণে, ঝোপের পাশে রাখা একটা বোতল—
কালো রঙের, লেবেল ছেঁড়া, কিন্তু তীব্র গন্ধ ঠিকই ছড়াচ্ছে বাতাসে।
এলকোহল।
আর তার পাশেই রাখা দুটি মাটির চেরামিক গ্লাস।
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩৩
একটা উল্টে পড়ে আছে,অন্যটায় জমেছে বৃষ্টির পানি।
জ্যাসপারের গলা শুকিয়ে আসে।
“তুমি কি… এটা…” তার প্রশ্ন শেষ হয় না।
ফিওনা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় বোতলের দিকে, তারপর থেমে বলে—“আজকের রাতটা শুধু আমাদের। সত্যিটা জানার আগে, একটা রাত শুধু ভালোবাসায় ডুবে থাকুক না প্রিন্স?”