আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩৯
সাবিলা সাবি
এক মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে।….
সময় তার নিজস্ব গতিপথেই ছুটে চলেছে, যেমনটি সে চলে যুগে যুগে। ভেনাসের রক্তিম আকাশ, এল্ড্র রাজ্যের বেগুনি পাহাড় আর স্ফটিক নদী—সবকিছুই নিখুঁত ছন্দে চলছে। যেন কোনো অলিখিত নিয়মে আবদ্ধ এক পরিপূর্ণ গীতিকবিতা। তবে সেই কবিতার ভিতর হঠাৎই যেন কোথাও একটা চিহ্নহীন যতি চিহ্ন পড়ে গেছে।
আর সেই যতির নাম—ফিওনা।
গত দুই দিন ধরে ফিওনার আচরণ যেন একটু একটু করে সরে গেছে চেনা ছকে বাঁধা জীবন থেকে।তার আচরনে অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। তার ক্ষুধা বেড়েছে অস্বাভাবিক রকমে। সকাল-দুপুর-রাত—যেন সব সময়ই সে খেতে চাইছে। এমনকি এক বসায় তিনজনের খাবার সাবাড় করে দিচ্ছে , আর তা দেখে রান্নাঘরের ড্রাগন সহকারীরাও থমকে যায়। রাজপ্রাসাদের কর্মচারীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফিসফিস করতে শুরু করে—“এই মেয়েটি তো কিছুদিন আগেও এক কাপ চা আর সামান্য ফলেই সারাদিন পার করে দিত… এখন এতটা ক্ষুধা কিসের?”
জ্যাসপারের চোখেও পড়ে যায় বিষয়টি। সন্ধ্যা বেলা কক্ষের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফিওনাকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি ঠিক আছ তো, হামিংবার্ড? এত খিদে পাচ্ছে কেন হঠাৎ করে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফিওনা কিছু বলার চেষ্টা করে, আবার থেমে যায়। তার চোখে-মুখে এক ধরনের অব্যক্ত সংশয় ধরা পড়লো। কিন্তু জ্যাসপার তখন এল্ড্র ল্যাবের নতুন প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত। তাই অতটা গুরুত্ব না দিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “আচ্ছা, তোমার যা খেতে ইচ্ছে করে যতোটা খেতে ইচ্ছে করে তুমি খাবে, আমি এখন ল্যাবে যাই ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে” এটা বলেই ফিওনাকে আলতো করে নরম একটা চুমু দিয়ে জ্যাসপার নিজের গবেষণাগারে চলে যায়।
তবে ফ্লোরাস রাজ্যে বসে সবকিছুই খবর পেয়ে গেলেন ফিওনার মা—লিয়ারা! তার মনটা ও দুদিন ধরে অস্থির অনুভুত হয় যেনো অদ্ভুত এক মা-মেয়ের টেলিপ্যাথি কানে কানে কিছু বলে গিয়েছিলো তাকে। তাই আর দেরি না করে, তিনি সিলভাকে সঙ্গে নিয়ে এল্ড্র রাজ্যে ছুটে আসেন। চোখের সামনে ফিওনাকে দেখে মুহূর্তেই বুঝে ফেলেন—এই মেয়েটার শরীরে কিছু একটা পরিবর্তন ঘটছে। শুধু ক্ষুধা নয়, ওর চোখে জমে আছে অভ্যন্তরীণ এক উত্তাপ। ঠোঁটে ক্লান্তির রেখা, আর আচরণে অজানা টানাপোড়েন।
“আমার মেয়েটাকে এমন কেন লাগছে সিলভা?”—কাঁপা গলায় ফিসফিস করেন লিয়ারা।
লিয়ারাকে সামনে দেখেই ফিওনা যেন এক অদ্ভুত আশ্বাস ফিরে পেল। বহুদিনের চেনা সেই বুক, যেটা সবসময় সব দুঃখ গিলে নিত, সেই বুক আবারও ফিওনার আশ্রয় হয়ে উঠলো। কোনো কথা না বলে, সে চুপচাপ মায়ের কোলে গুটিয়ে গেল। চোখ বন্ধ করে কেবল নিশ্বাসে মায়ের চেনা গন্ধটুকু টেনে নিচ্ছিল—যেন এ গন্ধই তার একমাত্র মুক্তি।
লিয়ারার চোখে-মুখে শঙ্কা। মেয়েটার শরীরে অস্থিরতা স্পষ্ট। বুকের ভেতর মায়ের টান বলছে—এ কেবল ক্লান্তি নয়, কিছু একটা গভীর অসাম্য চলছে ওর শরীরে।
আর এক মুহূর্তও দেরি না করে, লিয়ারা সরাসরি রাজা ড্রাকোনিসের কাছে যান। তাঁর কণ্ঠে অনুরোধ নয়, বরং ছিল আদেশের স্পষ্টতা। “আমি ডক্টর আগ্নিসকে এখুনি চাই। এখনই। দয়া করে তাঁকে আনান আমার মেয়ের শরীর ভালো নেই।” রাজা ড্রাকোনিস বিষয়টার গুরুত্ব বুঝে সঙ্গে সঙ্গেই সম্মতি দেন। আগ্নিসকে অবহিত করা হয় এল্ড্র ক্যাসলের গোপন চ্যানেলের মাধ্যমে।
এই সেই ডক্টর আগ্নিস—তিনিই সেই প্রাচীন ড্রাগন চিকিৎসক, যিনি একদিন পুস্পরাজ পাহাড়ের “মাউন্টেন গ্লাস হাউজ”-এ এসে ফিওনার শারীরিক বিপর্যয় সামলে দিয়েছিলেন। তার হাতে ছিলো প্রজন্মের জ্ঞান, চোখে ছিলো ভবিষ্যতের হিসাব।
ডক্টর আগ্নিসের উপস্থিতি মানেই কিছু গুরুতর ঘটছে—এই বার্তা যেন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে এল্ড্র প্রাসাদের নিঃশব্দ বাতাসে।
এদিকে ফিওনা তখনো মা’র বুকে গুটিসুটি মেরে বসে। তার দেহে অদ্ভুত এক উত্তাপ, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মনে হচ্ছে, তার শরীরে এক নতুন প্রাণের আবির্ভাব হতে চলেছে—যার ভার ও উত্তেজনা, সে নিজেও এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি।
ডক্টর আগ্নিস এলেন। তাঁর উপস্থিতি মানেই যেন পুরো এল্ড্র রাজ্যে এক নতুন শ্বাস-প্রশ্বাসের শুরু। ধবধবে সাদা গায়ের রং তার চোখজোড়া দীপ্ত আগুনের মতো অর্ধ বয়স্ক একজন সুদর্শন ড্রাগন ডক্টর,আর তার তখন হাতে চিকিৎসার মুদ্রিত চেম্বারস্কোপ।কথা না বাড়িয়ে, এক মুহূর্ত দেরি না করে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন।
কক্ষে তখন নিঃশব্দতা। ফিওনা চুপ করে বসে আছে, কিছুটা শঙ্কিত, কিছুটা অবাক। লিয়ারা দাঁড়িয়ে আছেন এক কোণে আর সাথে সিলভাও, লিয়ারার চোখে মমতা আর অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে।
ডক্টর আগ্নিস তার হাতঘড়ির স্ক্রিনে দ্রুত কিছু কোড টাইপ করলেন। মুহূর্তেই ঘরের এক কোণ থেকে ভেসে উঠল একটি স্বচ্ছ ভাসমান হোলোগ্রাফিক স্ক্যানার। সেটি ধীরে ধীরে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় ফিওনার চারপাশে আসতে লাগল।
ফিওনাকে বলা হলো একটি নির্দিষ্ট, গোলাকার সিলভার প্যাডে দাঁড়াতে। সেটির নিচ থেকে সূক্ষ্ম একধরনের আলোকরশ্মি বের হলো—না তা উত্তাপ দেয়, না ব্যথা, কেবল শরীরের গভীর থেকে তথ্য আহরণ করে।
ড্রাগনের আধা-ম্যাজিকাল ও আধা-সায়েন্টিফিক প্রযুক্তিতে তৈরি এই স্ক্যানার শুধু শরীর নয়, র/ক্ত, স্নায়ু ও ডিএনএর ভেতরের স্তর পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। হালকা গ্লো করা হোলোগ্রাফিক স্ক্রিনে একের পর এক ফিওনার শারীরিক স্তর ফুটে উঠছিল।
ডক্টর আগ্নিস চোখ নামালেন তার স্পর্শ-সংবেদী হাই-ডেটা ট্যাবলেটে। একাধিক কিউব ফর্মুলা, ম্যাট্রিক্স কোড ও নানান রঙের গ্রাফ ঘোরাঘুরি করছে সেখানে। তিনি কপালে ভাঁজ ফেললেন। লিয়ারা উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “ডক্টর… কি দেখছেন?”ডক্টর আগ্নিস গম্ভীর গলায় বললেন, “একটু সময় দিন… ড্রাগনের জিনোম যখন কোনো মানব দেহে থাকে, সেটা বিশ্লেষণ করতে আমাদের সাবধান হতে হয়।”
কিছুক্ষণ পর এক হালকা শব্দের সাথে স্ক্যানার থেমে গেল। তখনই একটি ছোট নীল-সবুজ আলোক বিন্দু ফিওনার পেটের উপরের দিকে স্থির হয়ে জ্বলে উঠল। সেটাই ছিল একটা জীবন—একটি নতুন প্রাণের অস্তিত্ব। ডক্টরের চোখে একরাশ গভীরতা, ঠোঁটে মৃদু বিস্ময়। “অবিশ্বাস্য…” – তিনি ফিসফিস করে বললেন। লিয়ারা এগিয়ে এলেন, গলা শুকনো, “কি হলো কি ডক্টর আগ্নিস, আমার মেয়ে ঠিক আছে তো?” আগ্নিস উঠে দাঁড়ালেন, কণ্ঠে স্থিরতা রেখে বললেন “ফিওনা… প্রেগন্যান্ট। ওর পেটে ড্রাগন সন্তান বেড়ে উঠছে।”
কক্ষের ভেতর যেন হঠাৎ হিমেল বাতাস বয়ে গেল। ফিওনা চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো ডক্টরের মুখে—একদম নিঃশব্দ ভাবে।যেন শব্দ হারিয়ে ফেলেছে সে। “কি… বলছেন… আপনি ডক্টর,এটা কি সত্যি?”— তার কণ্ঠ কেঁপে উঠলো।
ডক্টর আগ্নিস মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ। ড্রাগনদের গর্ভধারণ খুব দ্রুত হয়। সাধারণত ড্রাগন সন্তান এক মাসের মধ্যেই পেটে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়… আর তোমার শরীরে সেটাই ঘটেছে। যদিও তুমি অর্ধেক মানবী, তবুও—ড্রাগনের র*ক্ত তোমার মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। এটাই সম্ভব করেছে এই দ্রুত বিকাশ।”
লিয়ারা অবাক হয়ে ফিওনার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তবে স্তব্ধ হয়ে গেলেন ঠিক তখনই, যখন ডক্টর আগ্নিস শান্ত গলায় বললেন,“এই সন্তান… সাধারণ ড্রাগন সন্তান নয়। এই সন্তান প্রিন্সের —ওর মধ্যে অস্বাভাবিক শক্তি আছে। তার উপস্থিতি ইতিমধ্যেই ফিওনার শক্তি শু*ষে নিচ্ছে, যার ফলে ফিওনা এতো খাবার খাচ্ছে।”
ফিওনার চোখ বিস্ময়ে ছলছল করে উঠলো। সে ভাবতেই পারেনি… তার ভেতরে কোনো প্রাণ জন্ম নিতে পারে—এতো তাড়াতাড়ি! এই সত্য গ্রহণ করা যেন তার জন্য পাহাড় ভেঙে পড়ার মতো।
সবার আগেই সিলভা নড়ে উঠল। তার চোখ বিস্ময়ে আর আনন্দে চিকচিক করছে। সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। তীব্র আবেগে ফিওনার দিকে এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। “ফিওনা!” — সিলভার কণ্ঠ কাঁপছে — “তুমি মা হতে যাচ্ছো! আমাদের রাজকুমারীর মধ্যে আরেকটি প্রাণ!”
ফিওনার চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। সে সিলভার কাঁধে মাথা রাখে। লিয়ারার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠছিল অজানা এক আতঙ্কে। তিনি এগিয়ে এলেন ডক্টর আগ্নিসের দিকে, কণ্ঠস্বর কাঁপা কিন্তু দৃঢ়—
“ডক্টর… আমার মেয়ের কোনো অসুবিধা হবে না তো? ওর তো মাত্র উনিশ বছর বয়স… আর… এটা কোনো সাধারণ মানব সন্তান নয়, এ তো ড্রাগনের সন্তান।”
ডক্টর আগ্নিস দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর চোখে দয়া, কিন্তু অভিজ্ঞতার কঠিন ছাপও ফুটে উঠল। তিনি ধীরে বলে উঠলেন, “মিস লিয়ারা… সেটা এখনই বলা সম্ভব না। ফিওনার দেহে অর্ধেক মানব আর অর্ধেক ড্রাগনের র*ক্ত বইছে। এই ভ্রূণ কিভাবে তার শরীরের সঙ্গে মিশে থাকবে, সেটি আমরা এখন বুঝতে পারছি না। সবকিছু নির্ভর করছে আগামী দুই মাসের ওপর। তখনই বোঝা যাবে—এই গর্ভধারণ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ আর কতোটা নিরাপদ।”
ঘরের ভেতর হঠাৎ ভারী নীরবতা নেমে এলো।ফিওনা এক কোণে চুপ করে বসে ছিল, হাতদুটো নিজের পেটের ওপর রাখলো। তার চোখে জল, কিন্তু সে কাঁদছে না—শুধু শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দূর আকাশের দিকে। তার চোখে যেন একটাই প্রশ্ন— “আমি কি সত্যি মা হতে চলেছি?
ডক্টর আগ্নিস ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর লিয়ারা কাঁপা হাতে ফিওনার পাশে এসে বসেন। তাঁর চোখে উদ্বেগ, ঠোঁটে কেবল একটাই কথা—”ফিওনা… তুমি এখন কেমন অনুভব করছো মা?” কিন্তু লিয়ারার প্রত্যাশা ভেঙে দিয়ে, ফিওনা মুখ তুলে তাকাল, চোখজোড়া চকচক করছিল অনির্বচনীয় আনন্দে। পরক্ষণেই সে মায়ের বুকের দিকে ঝুঁকে পড়ল, কণ্ঠে উত্তাল আবেগ— “মা… আমি খুশিতে আত্মহারা! তুমি জানো, এটা প্রিন্সের সবচেয়ে দামি জিনিস… ওর একটুকরো অস্তিত্ব আমার ভেতরে! আমার ভালোবাসার প্রিন্সের র*ক্ত, তার শক্তি, তার জীবন আমার মধ্যে বেড়ে উঠছে… আমি কতোটা ভাগ্যবতী!”
লিয়ারা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। ফিওনার চোখে কোনো ভয় নেই, কেবল ভালোবাসা। যেন মৃত্যু*র আশঙ্কাও হার মানে সেই গভীর মুগ্ধতার কাছে।
ফিওনা আবার বলল—”মা… এটা শুধু একটা সন্তান না… এটা আমার আর জ্যাসপারের ভালোবাসার চিহ্ন। আমি ওকে আগলে রাখব… নিজের জীবন দিয়ে হলেও।”
লিয়ারা ফিওনার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন নিঃশব্দে। মেয়েটির চোখে যে আলো, তা কোনো ব্যথা নয়—সেই চোখে ছিল এক নতুন জীবনের উন্মেষ, এক নিঃশর্ত ভালোবাসার দীপ্তি। ফিওনার কথাগুলো শুনে লিয়ারা যেন হঠাৎ করেই বাস্তবতা বুঝলেন। তিনি ঠোঁটে এক নরম হাসি এনে বললেন, “তুমি মা হচ্ছো, আর আমি… আমি হতে চলেছি একজন নানীমা।”য়শব্দটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার হৃদয় কেঁপে উঠল। সেও তখন খুশিতে ফিওনাকে বুকে টেনে নিলেন।
একজন মায়ের কাছে নিজের মেয়ের মা হয়ে ওঠার এই সংবাদ—জীবনের এক পরিপূর্ণ চক্র যেন!
এদিকে সেই মুহূর্তে এল্ড্র রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে সংবাদটি। প্রাসাদ থেকে দূর দুর্দান্ত, পাহাড়ি উপত্যকা থেকে রাজসভা—সবাই একটাই কথা বলছে, “প্রিন্স জ্যাসপার বাবা হতে চলেছেন!”
ড্রাকোনিস রাজা, যিনি বহু যুদ্ধে র*ক্ত ঝরিয়েছেন, যিনি কূটনীতিতে চিরোজ্জ্বল, তিনি আজ যেন এক শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়লেন। সিংহাসনের পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে সে বললেন, “আমার জ্যাসপার… আমার উত্তরসূরী এখন শুধু এল্ড্রের ভবিষ্যৎ নয়, এক প্রাণের জন্মদাতা হতে যাচ্ছে।”
তার গর্জনে ভেসে উঠল কেবল আনন্দের রেশ, সেদিন বোধহয় এল্ড্রের আকাশেও তারা আরও উজ্জ্বলভাবে ঝলমল করছিল।
সেই রাতটা ছিল নিঃস্তব্ধ, এল্ড্র রাজ্যের আকাশে যেনো কৃত্রিম চাঁদও আজ একটু বেশি উজ্জ্বল। প্রাসাদের এক অংশে তখন নিভৃতে রয়ে গেছে জোনাকি আলো, আর তারই মধ্যে ফিরে এসেছে জ্যাসপার।
ল্যাবের দরজা বন্ধ করে ক্লান্ত, ধুলোমলিন মুখে সে পা রাখল প্রাসাদের অভ্যন্তরে। একজন দাসী নিচু গলায় জানালেন, “ডক্টর আগ্নিস এসেছিলেন, প্রিন্সেস ফিওনার শরীর দেখে গেছেন।”
শুধু এতটুকুই কানে এসেছিল জ্যাসপারের। বাকিটা? কেউ বলেনি। কিন্তু শুধু এই খবরেই যেনো তার হৃদয়ে ঝড় বয়ে যায়।
ছুটে গেল সে নিজের ঘরের দিকে। ফিওনা তখন শুয়ে ছিল নিঃশব্দে, চোখে এক আশ্চর্য প্রশান্তি। দরজা খুলতেই জ্যাসপার ছুটে যায় তার দিকে। হাঁটু গেড়ে বসে ফিওনার সামনে তারপর ফিওনার গালের দু’পাশে হাত রেখে শঙ্কিত কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে, “ফিওনা! তুমি ঠিক আছো তো? হ্যাঁ? প্লিজ বলো, তুমি ঠিক আছো?”
ফিওনা চোখ মেলে তাকাল জ্যাসপারের দুশ্চিন্তায় মোড়া মুখের দিকে। হাসি ফুটিয়ে বলল, “রিল্যাক্স, প্রিন্স… আমি ঠিক আছি।” কিন্তু জ্যাসপার তখনও থামেনি। পাগলের মতো বারবার বলছে, “না, না! তোমাকে ভালো দেখাচ্ছো না ফিওনা! তোমার শরীর একেবারেই দুর্বল লাগছে। আমি খুব বড় ভুল করেছি, আমাকে তোমার কাছে থাকা উচিত ছিল, ওই ল্যাবের কাজে যাওয়া উচিত হয়নি। আম সরি!!… আমি প্লিজ… আমি—” তার চোখে জল টলটল করছে। সে যেন নিজেকেই ক্ষমা করতে পারছে না।
জ্যাসপারের দুশ্চিন্তার স্রোত যেন থামছেই না। তার কণ্ঠ কাঁপছে, চোখে আতঙ্ক—প্রিয়তমার একটু অস্বস্তিও যেনো তার সমস্ত স্নায়ুকে জাগিয়ে তুলছে। “ফিওনা, প্লিজ বলো, কোথায় অসুবিধা হচ্ছে? মাথা ঘুরছে? বুক ব্যথা? শ্বাস নিচ্ছো ঠিকমতো?” তার প্রশ্নগুলো একটার পর একটা ছুটে আসছে, যেনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই প্রশ্নই দিয়ে ভালোবাসা ঢেলে দিচ্ছে সে। ফিওনা ধীরে ধীরে উঠে বসে। জ্যাসপারের কাঁধে হাত রেখে একবার হালকা ঝাঁকায় তাকে— “প্রিন্স, রিল্যাক্স… একটু শান্ত হও। আমি ঠিক আছি।”
কিন্তু না, জ্যাসপার যেন থামতেই পারছে না।“না, তুমি ঠিক নেই। আমি বুঝতে পারছি—দেখো, ফিওনা, আমাকে বলো… প্লিজ, আমি ভয় পাচ্ছি আমার চিন্তা হচেছ।”
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে ফিওনা। তারপর এক গভীর নিশ্বাস নিয়ে নিঃশব্দে বলে ওঠে, “প্রিন্স… তুমি বাবা হতে যাচ্ছো।” মুহূর্তটি যেনো থেমে যায়। সময় নিঃশব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।জ্যাসপারের কানে কথা গিয়েও যেনো পৌঁছায় না। সে থমকে গিয়ে বলে, “কি বললে?”
ফিওনার চোখে তখন এক অদ্ভুত দীপ্তি। এক হাত রাখে নিজের পেটের ওপর, আরেক হাত জ্যাসপারের হাতটা ধরে নিজের পেটের উপরে রাখে। “তোমার আর আমার—একটা নতুন জীবন আসছে প্রিন্স। আমাদের সন্তান। তুমি বাবা হবে… আর আমি হবো মা।”
জ্যাসপার একেবারে চুপ। চোখে-মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। যেনো হঠাৎ কেউ সমস্ত অনুভবক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে তার ভেতর থেকে।ফিওনার বলা শেষ হতেই ঘরজুড়ে নেমে আসে নিস্তব্ধতা।তাকে না ছুঁয়ে, না জিজ্ঞেস করে, জ্যাসপার তাকিয়ে থাকে শুধু—ফিওনার চোখে, তার পেটের দিকে, আবার নিজের হাতের দিকে।
সময় যেন থমকে গেছে। পাঁচ সেকেন্ড… দশ সেকেন্ড… এক মিনিট… তারপর আর গোনা যায় না। সে একেবারে রোবটের মতো নিথর হয়ে আছে, চোখ পিটপিট করা পর্যন্ত ভুলে গেছে।
ফিওনা তখন অস্থির হয়ে যায়, “প্রিন্স…? তুমি ঠিক আছো?”
জ্যাসপারের কোনো সাড়া নেই। তারপর ধীরে ধীরে—অতি ধীরে—জ্যাসপারের চোখজোড়ায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে এক চিলতে জল। সে ফিসফিস করে বলে, “আমি… আমি বাবা হবো?” তার ঠোঁট কাঁপে। শব্দটা যেন নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে তার কণ্ঠে। “আমার ভেতরের যতটা কঠিনতা ছিলো, তুমি সব ভেঙে ফেললে, ফিওনা… এ যে কোনো সাধারণ খবর না। আমার হৃদয়টা… এটা ধারণ করতে পারছে না।”
জ্যাসপার যেন হঠাৎই নিজের জগতে ফিরে এল। চোখের কোণে আবেগের ছায়া, কিন্তু মুখে একরাশ বিস্ময় আর শিশুর মতো উচ্ছ্বাস। সে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো, যেন কিছু খুঁজছে। ফিওনা বিস্মিত, “তুমি কোথায় যাচ্ছো প্রিন্স?”
জ্যাসপার হেসে বললো,“একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি”। তারপর দ্রুত চলে গেলো পাশের একটা কক্ষে।
মাত্র এক মিনিট পর, সে ফিরে এলো হাতে ছোট্ট এক ডিভাইস নিয়ে—সিলভার কালারের ডিভাইস,পাথরের মতো চকচকে।ফিওনার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“এইটা একটা ভয়েস রেকর্ডিং ডিভাইস। আমি… আমি চিরকাল তোমার বলা সেই কথাগুলো শুনতে চাই। বারবার শুনতে চাই, যতবার ইচ্ছে হবে… আমি যেন ভুলে না যাই কখনো, কী বলেছিলে তুমি আজ রাতে।”
তার চোখে শিশুর মতো অনুরোধ। “ফিওনা, আবার বলো… প্লিজ। ঠিক যেমনটা কিছুক্ষণ আগে বলেছিলে, তেমন করে বলো।” ফিওনা প্রথমে একটু লজ্জা পেলেও, জ্যাসপারের সেই উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে, নিজের হাত তার বুকে রাখলো। গভীর আবেগভরা গলায় বললো, “আমাদের বেবি আসবে, প্রিন্স। তুমি বাবা হতে যাচ্ছো… আর আমি, আমি হবো তোমার সন্তানের মা… তোমার ভালোবাসার একমাত্র চিহ্ন এখন আমার মধ্যে বেড়ে উঠছে।”
ডিভাইসটা টুং করে একটা শব্দ করে—রেকর্ডিং সেভ হয়ে যায়। জ্যাসপার ডিভাইসটা বুকের কাছে ধরে রাখে, চোখ বুজে ফিসফিস করে বলে,“এই শব্দ… এই বাক্য… আমি আগলে রাখবো, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত।আর এটা আমি যখন ইচ্ছে হবে তখনি শুনবো ।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ করে ফিওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখে প্রশান্তির ঝিলিক, ঠোঁটে মৃদু হাসি। হঠাৎ গভীর কণ্ঠে বললো, “আজকের এই আনন্দের দিনে… এই ঐশ্বরিক মুহূর্তে তুমি আমার কাছে কি চাও, ফিওনা?”
ফিওনা হালকা হেসে বললো, “আমি কিছু চাই না প্রিন্স। আমার জীবনের সবচেয়ে দামি উপহার আমি আগেই পেয়ে গেছি… সেটা হচ্ছো তুমি।”
জ্যাসপারের চোখ চিকচিক করে উঠলো। সে ফিওনার হাত ধরে বললো,য”এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে দামি গিফট তুমি আমাকে দিতে যাচ্ছো, ফিওনা। আমি তোমাকে যাই উপহার দেই না কেন, তা কখনোই এর সমান হবে না… আমাদের ঘরে… আরেকটা ছোট পাখি আসবে।” তারপর সে আস্তে আস্তে ফিওনার পেটে হাত রাখলো, যেন অনুভব করতে চাইলো ভবিষ্যতের সেই ছোট প্রাণের উপস্থিতি। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে আবার স্বপ্নে ডুবে বললো, “এই যে, এই জায়গায় ও একদিন হাঁটবে তাই না, ফিওনা? এখানেই দৌড়াবে, পড়ে যাবে, আবার উঠবে… আমি ওকে কোলে তুলে নেবো, ঠিক এইখানে।”ফিওনা হেসে মাথা হেলিয়ে দিলো জ্যাসপারের কাঁধে।জ্যাসপার ফিওনার হাত ধরে বিছানায় বসে পড়লো। দুজনের চোখে স্বপ্নের আলো, মনে যেন এক নতুন ভোরের আভাস।
ফিওনা হঠাৎ একটু চুপ থেকে চোখ ছোট করে বললো,
“আচ্ছা প্রিন্স… একটা প্রশ্ন করি?”
জ্যাসপার একটু অবাক হয়ে বললো, “একটা না হাজারটা করো, হামিংবার্ড।” ফিওনা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললো, “এর আগে তো আমরা কখনোই… প্রোটেকশন ব্যবহার করিনি, তাই না? তাহলে তখন বেবি হয়নি কেনো?এখন কেনো হলো? আর আমি যখন সম্পুর্ন মানবী ছিলাম তখন তোমার ডি.এন.এ-এর জন্য আমি দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম, এমনকি মর*তেও বসেছিলাম.. তাহলে তখন ফিজিক্যালের সময় তুমি কেনো প্রোটেকশন ব্যবহার করলে না?”
জ্যাসপার হালকা হেসে ফিওনার কপালে চুমু দিলো। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “প্রথমত, ড্রাগনদের ক্ষেত্রে সন্তান জন্ম একেবারেই ইচ্ছানির্ভর, ফিওনা। তুমি এখনো মানুষিকভাবে বুঝতে পারোনি আমরা কতটা আলাদা,হামিংবার্ড।
ফিওনা একটু অবাক হয়ে বললো, “তুমি বলতে চাচ্ছো, ড্রাগনরা যখন নিজেরা চায়, তখনই তাদের সন্তান আসে? এটা কীভাবে সম্ভব?” জ্যাসপার একটু হাসলো, তারপর ধীরে ও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে লাগলো, “ড্রাগনদের শরীর মানুষদের মতো নয়, হিউম্যান রিপ্রোডাকশনের মতো দৈব ঘটনাও নয়। আমাদের প্রজাতির জেনেটিক কোডে এমন এক ধরনের ‘সেলফ-কন্ট্রোলড রিপ্রোডাকটিভ সুইচ’ থাকে, যেটা শুধুমাত্র ড্রাগনের মস্তিষ্ক থেকে নির্দিষ্ট নিউরোসিগন্যাল পেলেই সক্রিয় হয়।”
ফিওনা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। জ্যাসপার চালিয়ে গেলো, “এই নিউরোসিগন্যাল আমাদের হৃদয়ের অবস্থা, মানসিক প্রস্তুতি এবং শারীরিক সম্মতির উপর ভিত্তি করে কাজ করে। মানে আমি যদি তোমাকে ভালোবাসি, তোমার সঙ্গে একাত্ম হই, এবং আমার মস্তিষ্ক যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে আমি একটি প্রাণ চাই, তখন আমার বায়োলজিক্যাল সিস্টেম নিজে থেকেই ডিএনএ-র এমন এক ‘রিপ্রোডাকটিভ সিকোয়েন্স’ এক্টিভ করে যা সন্তানের বীজ তৈরি করে।”
সে একটু থেমে ফিওনার চোখে তাকিয়ে বললো, “যদি আমি না চাইতাম, আমাদের মাঝে যতই সম্পর্ক হতো—কখনো কোনো সন্তান হতো না। কারণ আমার ডিএনএ তখন সেই তথ্যই দিত না।”
ফিওনা আস্তে বললো,”মানে বেবিটা এসেছে… কারণ তুমি তোমার হৃদয় দিয়ে এটা চেয়েছো?”
জ্যাসপার মৃদু হেসে বললো “আমি চেয়েছিলাম, যেদিন আমাদের ভেনাসের নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে হবে, তারপরই আমরা আমাদের সন্তান আনবো। তারপর সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” আর আমাদের বিয়ের পরে প্রথম বাসর রাত,সেদিনই আমি হৃদয়ের গভীরে পেয়েছিলাম… তোমার মধ্যে আমার অস্তিত্ব দেখতে।
ফিওনা আরো কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বললো, ” আচ্ছা প্রিন্স তাহলে প্রোটেকশনের ব্যাপারটা?
জ্যাসপার একটু থেমে গভীরভাবে ফিওনার চোখের দিকে তাকালো। তারপর ধীরে ধীরে বললো,”ড্রাগনদের ডিএনএ– এটা একধরনের ‘বায়ো-এনার্জি ড্রাইভেন স্ট্রেন্ড’… যার তাপমাত্রা গড়ে ৪৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, বিশেষ মুহূর্তে।য়এমনকি বিশেষ প্রটেকশন ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করলেও সেটা গলে যায়।”
ফিওনা চমকে উঠে বললো, “৪৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট? প্রিন্স… সেটা তো আগুনের থেকেও বেশি!”
জ্যাসপার মৃদু হাসলো, “ঠিক তাই। আর এই কারণেই… আমি সবসময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম মাউন্টেন গ্লাস হাউজে।কারণ আমি জানতাম, তোমার শরীর সেই তাপ সহ্য করার জন্য প্রস্তুত নয়…আর চাইলেও প্রটেকশন ম্যাটারিয়াল ইউজ করতে পারতাম না।
রাত গভীর। এল্ড্র রাজ্যের আকাশজুড়ে নক্ষত্রেরা যেন আজ একটু বেশি জ্বলজ্বল করছে। এথিরিয়ন ক্লান্ত পায়ে প্রাসাদে ফিরে এলো। দরজায় পা রেখেই সে দেখতে পেলো, চারপাশে একধরনের উচ্ছ্বাস। প্রাসাদের একান্ত দাসীরা মুখে মুখে বলছে, “প্রিন্স জ্যাসপার… বাবা হতে যাচ্ছেন!”
এথিরিয়নের মুখে চওড়া হাসি ছড়িয়ে পড়লো। সে হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে এলো ফিওনা আর জ্যাসপারের কক্ষে।
রাজকীয় কাঠের দরজাটা খোলা,য়ভেতরে ঢুকেই সে দেখলো—ফিওনা বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে, জ্যাসপার পাশে। ঘরজুড়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তি।য়এথিরিয়ন হেসে বললো,
“তোমরা দুজনই রাজ্যকে নতুন আলো উপহার দিতে যাচ্ছো! অভিনন্দন,জ্যাসু ভাইয়া। আর ফিওনা, তোমাকে শ্রদ্ধা জানাই। তুমি এখন আমাদের রাজপরিবারের সবচেয়ে মূল্যবান অস্তিত্ব ধারণ করছো।”
ফিওনা লাজুক হেসে মাথা নিচু করলো। জ্যাসপার গম্ভীর মুখে হলেও চোখে ছিল একরাশ কৃতজ্ঞতা।”ধন্যবাদ চাচ্চু সাহেব” বললো সে। কিছুক্ষণ কাটানোর পর, এথিরিয়ন কক্ষ থেকে বের হলো। গম্ভীর আর শান্ত মনের সে, কিন্তু আজ তার চোখেও যেন কিছুটা আনন্দ ঝিকিয়ে উঠছে। ঠিক তখনই করিডোরে মুখোমুখি হয়ে গেলো সিলভার সাথে।
সিলভা তার চিরচেনা ভঙ্গিতে বললো, “রিয়ন তুমি শুনেছো খবরটা?” এথিরিয়নের ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি খেলে গেলো।”হ্যাঁ, শুনেছি। আজকের রাতটা সত্যি আনন্দের।”সিলভা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, তারপর বললো,য়”তুমি চাচ্চু হবে… কেমন লাগছে শুনে?”
এথিরিয়ন করিডোরের জানালার দিকে তাকিয়ে বললো, “ভালো লাগছে… যেন এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো। এই রাজপ্রাসাদে আরেকটা ছোট পায়ের শব্দ শোনা যাবে—এটা ভাবতেই আশ্চর্য লাগছে।”
দুজনের মাঝে অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো। করিডোরে চাঁদের আলো পড়ে সিলভার সাদা পোশাক উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। এক ঝলক চোখাচোখি হলো দু’জনের। সিলভা কিছু বলবে বলবে করেও থেমে গেলো।
এথিরিয়ন ধীরে বললো,”ভবিষ্যত যেন ফিওনার শিশুকে রক্ষা করে। তাকে যেন এমন রাজত্ব উপহার দিতে পারি, যেখানে কেউ তাকে কষ্ট দিতে পারবে না।”
সিলভা তখন মৃদু স্বরে বললো, “তুমি শুধু চাচ্চু নও, তুমি হবে তার গার্ডিয়ান।”
এথিরিয়নের চোখে তখন অন্যমাত্রার প্রতিশ্রুতি। করিডোরের ছায়ায় তারা দুজন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। অদৃশ্য কোনো বাঁধন যেন ধীরে ধীরে বোনা হতে লাগলো নিঃশব্দে।
এথিরিয়ন করিডোরের জানালায় চোখ রেখে কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ বললো,”চলো ছাদে যাই। আজ আকাশটাও যেন অন্যরকম কথা বলছে।” সিলভা একটু অবাক হয়ে বললো, “এখন? এই রাতে?” “হ্যাঁ,” এথিরিয়ন মৃদু হেসে বললো, “আজকের রাতটা শুধু ফিওনা আর জ্যাসপারের জন্য নয়, আমাদের সবার জন্যই বিশেষ।”
সিলভা প্রথমে একটু ইতস্তত করলো, কিন্তু তার চোখে ঝলকে উঠলো কৌতূহল—এথিরিয়নের ডাক উপেক্ষা করতে পারলো না। “ঠিক আছে চলো,” সিলভা মৃদু হেসে সম্মতি জানালো।
দুজন একসাথে হেঁটে এল্ড্র প্রাসাদের সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এলো। ছাদে উঠতেই চোখে পড়লো—সমস্ত এল্ড্র রাজ্য চাঁদের আলোয় ভেসে আছে। দূরে আকাশে ভেনাসের আলো আর তারার মেলা।
সিলভা ছাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল। তার চুল উড়ছে হাওয়ায়, চোখে প্রশান্তি। সে নিঃশব্দে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইলো।এথিরিয়ন কিছুক্ষণ তাকে দেখে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে সিলভার পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলো।
সিলভা হঠাৎ গা ছমছম করে অনুভব করলো তার চারপাশে উষ্ণতা। এথিরিয়নের শক্ত দুটো বাহু তাকে আগলে রেখেছে। হৃদস্পন্দন যেন হঠাৎ একটু থমকে গেলো তার।
“তুমি জানো?” এথিরিয়নের কণ্ঠটা গভীর ও স্নিগ্ধ, “এই হাওয়া, এই রাত… সব কিছু আজ অন্যরকম বিশেষ রকম অনুভব হচ্ছে, শুধু তোমার পাশে থাকার কারণে।”
সিলভা কিছু বললো না। শুধু চোখ বন্ধ করে অনুভব করলো সেই মুহূর্তকে। এতদিন এথিরিয়নের চোখে সে রাজ্যের এক নারী হিসেবে ছিলো, আজ যেন সে কোনো এক নারী হিসেবে ছিলো, আজ যেন সে কোনো এক ভিন্ন রূপে দেখা দিচ্ছে—একটা অনুভবের স্পর্শে।
এথিরিয়ন তার কানের কাছে মুখ এনে বললো, “আজ যদি কিছু চাও… আমি দিতে প্রস্তুত, সিলভা। শুধু বলো, তুমি কি এখন আমাকে সেই আগেরমতো একইভাবে অনুভব করো?” সিলভার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। ছাদের ওপরে এল্ড্র রাজ্য নিঃশব্দে সাক্ষী হয়ে রইলো দুই হৃদয়ের এক অচেনা শুরুতে।
জকের সকালটা অন্যরকম। সূর্যের আলো জানালার পর্দা ভেদ করে ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকছে। ফিওনা চোখ ডলতে ডলতে বিছানায় উঠে বসলো। চুল এলোমেলো, চোখ আধখোলা। হঠাৎ তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল!
ঘরের একপাশে বিশাল এক ব্যানার টানানো—লাল আর সোনালি রঙে লেখা,
“প্রেগন্যান্ট কুইনের স্পেশাল কেয়ার গাইডলাইন—by Prince Jasper”
ফিওনা বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে ব্যানার জুড়ে লেখা— ঘুমাতে হবে অন্তত ৮ ঘণ্টা! স্ট্রেস একদম নয়, রাজকীয় আদরে থাকবে! খাবারের সময়: সকাল ৯টা, দুপুর ১টা, সন্ধ্যা ৭টা (মেনু ফিক্সড) কোনো গবেষণা কাগজ পড়া যাবে না!
চিন্তা করলে প্রিন্সের মন খারাপ হবে!
দিনে অন্তত একবার ইয়োগা করতে হবে!
প্রতিদিন ফিওনা হাসবে কমপক্ষে ৫ বার (জ্যাসপার গণনা করবে)
ফিওনা হাসতে হাসতে মুখে হাত চাপা দিলো। তখনই জ্যাসপার এক হাতে একটা ফলের ঝুড়ি, আরেক হাতে একটা কুশন নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
“গুড মর্নিং, মাই ড্রাগন কুইন,” জ্যাসপার মুচকি হেসে বললো, “এই ব্যানারটা হলো তোমার নতুন জীবনবিধি। আর আমি তোমার নতুন ব্যক্তিগত বডিগার্ড, নার্স,শেফ, এবং প্রেমিক, হাজবেন্ড—সব একসাথে!”
ফিওনা হেসে বললো, “তুমি একেবারে পাগল!”
“হ্যাঁ, তোমার জন্য পাগল,” জ্যাসপার গম্ভীর মুখে বললো, “এই রাজ্যের ভবিষ্যৎ আমার মধ্যে নয়, এখন তোমার মধ্যে বেড়ে উঠছে।” ফিওনা ব্যানারের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে বললো, “এই ব্যানারটা এনে ভালোই করেছো। প্রতিদিন মনে থাকবে—আমি এখন শুধু একজন মেয়ে না, আমি এখন একজন মা… আর আমার প্রিন্স আমার পাশে আছে।”
জ্যাসপার হেসে বললো, “আর প্রতিদিন ব্যানারে নতুন নিয়ম যোগ হবে, কারণ তুমি তো একমাত্র ‘প্রেগন্যান্ট হিউম্যান কুইন অফ ড্রাগন কিংডম’!”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফলের ঝুড়ি থেকে একটা টকটকে লাল স্ট্রবেরি তুলে নিলো। “এটা তোমার জন্য, আমার কুইন,” সে বললো মিষ্টি করে। ফিওনা একটু মুখ ঘুরিয়ে বললো,
“না, এখন খেতে ইচ্ছে করছে না…”
জ্যাসপার ভ্রু কুঁচকে একদম নাটকীয়ভাবে বললো,
“কি? প্রিন্সের খাওয়ানো খাবারও ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে এখন?” ফিওনা হাসি চাপতে গিয়ে মুখে হাত চাপা দিলো।
জ্যাসপার তখন ঠোঁটে এক টুকরো দুষ্টুমি নিয়ে বললো,
“ওকে… তাহলে অন্য নিয়মে খাওয়াতে হবে।”
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩৮
বলেই জ্যাসপার স্ট্রবেরির অর্ধেকটা নিজের মুখে নিলো। তার চোখে তখন একরকম শয়তানি ঝিলিক। “এবার তুমি খাবে,” সে গম্ভীর মুখে বললো, মুখের মধ্যে থাকা অর্ধেক স্ট্রবেরি দেখিয়ে।
ফিওনার চোখ বিস্ফোরিত, গাল লাল, “ প্রিন্স!” সে ফিসফিস করে বললো, “তুমি একেবারে পাগল!” “তোমার প্রিন্স তো পাগল হবেই তোমার জন্য,” জ্যাসপার হাসলো, আর ধীরে ধীরে ফিওনার দিকে ঝুঁকে এলো।য়ফিওনা শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে এগিয়ে এলো। মুহূর্তের মধ্যেই সেই স্ট্রবেরির অর্ধেক তাদের দু’জনের মাঝখানে ভাগ হয়ে গেলো। তারপর জ্যাসপার ফিসফিস করে বললো “দেখলে, প্রেগন্যান্সি ডায়েট শুরু হলো রাজকীয়ভাবে।”
ফিওনা হেসে বললো, “তুমি না, ভয়ানক রোমান্টিক…”
জ্যাসপার চোখ টিপে বললো, “আমি তোমার ‘ভয়ানক’ ভালোবাসা।”