আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪২
সাবিলা সাবি
বাষ্পময় বাতাস ভেদ করে শাওয়ার থেকে ভেজা চুলে বেরিয়ে এল জ্যাসপার। মিস্টার চেন শিং-এর রাজকীয় ভিলা হলেও এই বাথরুমটা তার এল্ড্র প্রাসাদের মতো বিশাল নয়। তবে কাঁচের দেয়াল, উষ্ণ আলো আর সাদা টাওয়েলজোড়া ওকে বেশ খানিকটা শান্ত করেছে।
পায়ে নরম স্লিপার, গায়ে হালকা একটা সাদা টি-শার্ট চড়িয়ে ধীরে ধীরে জ্যাসপার পা বাড়ায় ঘরের দিকে। বেইজিংয়ের শীতল হাওয়াটা জানালা গলে ঘরের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছে, সঙ্গে একটা ধূপকাঠির মৃদু সুগন্ধ—ফিওনার ঘুমের জন্য রাখা হয়েছিল।
চোখ পড়তেই গেল বিছানার দিকে। নরম আলোয় স্পষ্ট ফিওনার ঘুমন্ত মুখ। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে বালিশে, চোখদুটো শান্ত, নিঃশ্বাস গুলো দীর্ঘ আর সুশৃঙ্খল। চাঁদের নরম আলো জানালা ছুঁয়ে এসে পড়েছে তার গাল বেয়ে, যেন আকাশ নিজ হাতে আঁকছে এক অর্ধ মানবীর সৌন্দর্য। জ্যাসপার নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে ফিওনার পাশে বসে। এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে।
পৃথিবীতে এসে,এই চীনের শহরে, এতো বিশৃঙ্খলা আর অনিশ্চয়তার মধ্যেও—এই মেয়ে যেন ওর একমাত্র অবসর। সে ধীরে বিছানায় শুয়ে ফিওনাকে নিজের দিকে টেনে নেয়। ফিওনার মাথা ওর বুকে এসে পড়ে। জ্যাসপার এক নিঃশ্বাসে ওর গায়ের ঘ্রান গিলতে গিলতে,চোখ বুজে ফেললো তারপর মনে মনে বললো, “এই নারীই আমার পৃথিবী আর ভেনাস।তার পাশে ঘুমিয়ে পড়াটাই এখন আমার চূড়ান্ত আরাম।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চীনের বেইজিং-এ হালকা কুয়াশার চাদর তখনও জানালার কাচে ঝুলে আছে। চেন শিংয়ের রাজপ্রাসাদসদৃশ বাড়ির ঐতিহ্যবাহী ঘরটায় ঢুকে পড়ে এক তীব্র প্রশান্তির আলো।
ফিওনার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে প্রথমেই তার দৃষ্টি পড়ে—জ্যাসপার।ঘুমিয়ে আছে। নিঃশ্বাস ভারী নয়, বরং ঠিক যেন মহাকাশ থেকে নেমে আসা কোনো দেবদূত বিশ্রামে গেছে।
জেগে থাকলে যতটা ভয়ংকর-সুদর্শন, ঘুমন্ত জ্যাসপার ঠিক ততটাই মায়াবী। ওর মুখে এক শিশুসম প্রশান্তি, চিবুকে সূর্যরশ্মির নরম ছায়া। চোখের পাতা এমনভাবে নেমে এসেছে, যেন এক বিশাল রাজ্য ঘুমিয়ে আছে তার পলকে।
ফিওনার মন ঠাণ্ডা হয়ে আসে। সে মৃদু হাসে। এতটা কাছ থেকে ড্রাগন প্রিন্সকে দেখার অনুভবটা ঠিক গলায় দলা পাকানো আবেগের মতো। কিন্তু হঠাৎ…ফিওনার চোখ আটকে যায়।
জ্যাসপারের বাম হাতে… কিছু একটা অস্বাভাবিক।
সে ধীরে ধীরে একটু উঠে বসে। হাতটা দেখে ফিওনার নিঃশ্বাস আটকে আসে।
গভীর কাটা দাগ। চারপাশে জমাট বাঁধা সবুজ রক্ত। অদ্ভুত ঘন,জ্বলন্ত রঙ। যেন সাধারণ কোনো রক্ত নয়, এই রক্তে লুকানো রয়েছে কোনো ভয়াবহ শক্তি।
ফিওনার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। “এটা কখন হলো, প্রিন্সের হাত কাটলো কিভাবে?” তার মনে পড়ে—গতকাল রাতে জ্যাসপার বাথরুমে গিয়েছিল তারপর তো সে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো।
ফিওনা ধীরে ধীরে জ্যাসপারের হাতের কাটা জায়গায় ছুঁয়ে দিল।আঙ্গুলের ছোঁয়ায় এক অদ্ভুত উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে, আর ঠিক তখনই—জ্যাসপার নড়েচড়ে উঠে চোখ মেলে তাকায়।
চোখেমুখে এখনও ঘুমের ছায়া, তবুও একপলকে ফিওনার অস্থিরতা অনুভব করে ফেলে সে। “তোমার হাত…!” ফিওনার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে “এটা কিভাবে কাটলো, প্রিন্স? এতো গভীর ক্ষত… এটা তো সাধারণ কাটা নয়!”
জ্যাসপার হালকা হাসে। একটা হাতে ফিওনার চুলগুলো পেছনে সরিয়ে নিয়ে গভীর চোখে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বলে— “শান্ত হও হামিংবার্ড… এটা তেমন কিছু না। সামান্য কেটেছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” সে ধীরে ফিওনার হাতে নিজের হাত চেপে ধরে। “তোমার ছোঁয়াই যথেষ্ট চিকিৎসা।”
ফিওনা বিশ্বাস করতে পারছিল না, তবু তার কণ্ঠে অস্ফুট প্রশ্ন ঝরে— “তবুও বলো, কেটেছে কিভাবে?”
জ্যাসপার তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হালকা হাসে। তারপর উঠে বসে। “এতো প্রশ্ন না করে তুমি বরং উঠে ফ্রেশ হও।”সে ফিওনার কপালে এক চুমু এঁকে দেয়। “তোমাকে ঠিক সময় মতো ব্রেকফাস্ট করতে হবে।” একটু থেমে, চোখ নামিয়ে ফিওনার পেটে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে মৃদু গলায় বলে— “এতক্ষণে হয়তো আমাদের বেবিটাও খিদের জন্য নড়েচড়ে উঠছে।”
ফিওনার বুকটা একদম গলে যায়। তার চোখে জল চিকচিক করে ওঠে—এই ভিনগ্রহের কঠিন ড্রাগন প্রিন্স, যার হৃদয়ে ভালোবাসা ছিল না, এখন শুধু তাকে নয়… তার গর্ভে বেড়ে ওঠা প্রাণটাকেও ভালবাসছে নিরবে।
সকালের আলো জানালা বেয়ে ডাইনিং রুমে ছড়িয়ে পড়েছে।টেবিলে চেন শিং ইতিমধ্যেই বসে পড়েছেন। থারিনিয়াস সংবাদপত্রের পাতা উল্টাচ্ছে আর আলবিরা ফিওনার পাশে বসে কাঁটাচামচে খুচিয়ে খাচ্ছে স্টিমড বান। ফিওনা আজ তুলনামূলক শান্ত—কিন্তু চোখে অপেক্ষার ছায়া।
জ্যাসপার তখনো আসেনি টেবিলে।হঠাৎ করেই ঘরের দিকের সিঁড়ি বেয়ে জ্যাসপার নিচে নামে। সে একেবারে প্রস্তুত—স্মার্ট কালো শার্ট, গাঢ় ধূসর প্যান্ট, চুল আঁচড়ানো, চোখে সেই আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি।
ফিওনা ভ্রু কুঁচকে তাকায়, হালকা হাসি দিয়ে বলে,
“তুমি তো একেবারে অফিসের মতো করে রেডি! আজ কিছু বিশেষ আছে নাকি নাকি কোথাও যাচ্ছো?”
জ্যাসপার চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে, “হ্যাঁ, একটা কোম্পানিতে যেতে হবে। আজই শেষ প্রজেক্টের কাজটা শেষ করবো। তারপর… তোমাকে নিয়ে ভেনাসে ফিরবো।”
“ভেনাসে এতো তাড়াতাড়ি?” ফিওনার গলায় বিস্ময়। মুখটা থমকে যায় এক মুহূর্তে। “হুম,” জ্যাসপার হালকা মাথা নাড়ে, “সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার সময় এসে গেছে, ফিওনা।”
মিস্টার চেন শিং ও তখন বলে উঠলেন “এতো তাড়া চলে যাবে কেনো? ফিওনা আর কিছুদিন থাকুক।
জ্যাসপার তখন বললো ” নো গ্ৰন্ডপা! ফিওনা এখন প্রেগনেন্ট আর ওর বেবি কোনো সাধারন বেবি না ড্রাগন বেবি ও্য প্রতিদিন ট্রিটমেন্ট নিতে হবে আর সেটা ভেনাস ছাড়া সম্ভব না।মিস্টার চেন শিং পরিস্থিতি বুঝে চুপ করে গেলেন।
ফিওনা এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ বলেই ফেলে, “তাহলে আমিও চলি তোমার সাথে অফিসে!”
জ্যাসপার চমকে যায়। “না,, ফিওনা। তুমি বরং বিশ্রাম নাও কারন এখন তোমার বিশ্রামের সময়। পরে তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবো।”
ফিওনা হালকা গম্ভীর হয়ে বলে, “তাহলে অন্তত আমায় ভার্সিটিতে নামিয়ে দিও। আমি লিন আর লিয়ার সাথে দেখা করবো।” জ্যাসপার একটু ভাবল, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে রাজি হয়ে যায়,“ঠিক আছে।”
চেন শিং তখন আড়চোখে সব দেখছেন।
আলবিরা ফিওনার কানে ফিসফিস করে বলল, “প্রিন্সের কড়া রুলস বেড়ে গেছে অলরেডি।” ফিওনা মুচকি হেসে বলে,“হ্যা আমকে জ্বালিয়ে মারবে”।
ব্রেকফাস্ট শেষ হওয়ার পর, বাড়ির সামনের উঠোনে গাড়িটা অপেক্ষা করছিলো।ড্রাইভারের আসনে আজ থারিনিয়াস বসেছে।আলবিরা তার পাশের সিটে বসেছে, চোখে সানগ্লাস, মাথা হেলানো সিটে। ফিওনা আর জ্যাসপার ধীরে পেছনের সিটে উঠে বসল।
গাড়ি চলতে শুরু করলো। বেইজিং শহরের ব্যস্ত সকাল—রাস্তায় মানুষ, গাড়ি, ভাপ ওঠা দোকানের নুডলসের গন্ধ, ট্রাফিক সিগন্যালে পথচলতি গল্পের মতো ভেসে আসা শব্দ।
জ্যাসপার চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে, মুখটা গম্ভীর। ফিওনা ধীরে ওর হাত চেপে ধরে বলল, “আর ইউ ওকে?”
জ্যাসপার তার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে, “তোমার স্মেলটা এখন আমার শান্তি…কয়েকটা ঘন্টা তোমাকে ছাড়া থাকতে হবে। আজকের দিনটা কোনোরকম শেষ করলেই আমরা একসাথে ফিরে যাবো আমাদের ভেনাসে।”
ফিওনা মাথা হেলিয়ে দিলো জ্যাসপারের কাঁধে।
একটুকরো নীরব ভালোবাসা যেন গাড়ির ভেতর ঘুরে বেড়ালো।কিয়ৎক্ষন বাদেই পিকিং ইউনিভার্সিটির গেট এসে পড়ে।গাড়ি ধীরে ধীরে থামলো।
পিকিং ইউনিভার্সিটির গেটের সামনে গাড়ি থামতেই।
ফিওনা জানালা খুলে বাইরে তাকালো সেই পুরনো স্মৃতি সেই চিরচেনা ক্যাম্পাস।ফিওনা আর জ্যাসপার একসাথে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো আর তখনি লিন আর লিয়া গেইট দিয়ে বেরিয়ে আসছিলো হঠাৎ ওরা দু’জনেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলোএক মুহূর্ত, যেন কারো ওপর বিশ্বাস হচ্ছিল না। তারপর পরক্ষণেই চিৎকার করে ওঠে “ফিওনা!”
দুই বন্ধু ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিওনার গলায়।
চোখের কোনে জল, মুখে অগাধ বিস্ময়। “তুই কোথায় ছিলি রে? আমরা তো ভেবেছিলাম… তুই…”
ফিওনা হেসে ওদের জড়িয়ে ধরে। “আমি ঠিক আছি। অনেক কিছু হয়েছে… কিন্তু এখন আমি তোদের সামনে আছি, এটাই আসল।”
জ্যাসপার তখনো গাড়ির পাশে দাঁড়ানো—মুখে মাস্ক, চোখে গাঢ় সানগ্লাস, গায়ে কালো ট্রেঞ্চ কোট। ওর অবস্থানেই একটা নির্জন ক্যারিশমা ছিলো—যা সহজে নজর কাড়ার মতো।
হঠাৎ লিন চোখ তুলে তাকিয়ে বলে, “ওয়েট… আমি এই ওনাকে আগে কোথাও দেখেছিলাম মেবি…!”
ফিওনা আঁতকে উঠে বলে, “প্রিন্স তুমি এখন যাও।”
জ্যাসপার এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সামনে এগিয়ে আসে।ওর চোখ দুটো সানগ্লাসের আড়ালেও যেন আগুন ছুঁয়ে যায় ফিওনার চোখে। “আমি বিকেলের মধ্যেই কাজ শেষ করে ফেলবো আর তোমাকে নিতে আসবো,”—জ্যাসপার বলে নিঃসাড় কণ্ঠে। “কোথাও দূরে যাওয়ার দরকার নেই।আশেপাশে থাকবে।নিজেকে আর আমাদের… বেবিকে সাবধানে রাখবে।” এটা বলেই জ্যাসপার পকেট থেকে একটা চকচকে ব্ল্যাক কার্ড বের করে ফিওনার হাতে দিয়ে দেয়।
“নাও, তোমার বন্ধুদের সাথে দেখা হয়েছে—তাদের নিয়ে যা খুশি করো, যত খুশি খরচ করো। কিন্তু…”
ওর ঠোঁটের কোণে এক ফোঁটা দুষ্টু হাসি খেলে যায়, “…তুমি সেইফ থাকবে,আমাদের বেবির কথা যেনো মনে থাকে, হুম?”
লিন আর লিয়া চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকে—
“বে-বেবি?!” দুজনেই একসাথে বলে ওঠে, মুখে অবিশ্বাস, চোখে বিস্ময়ের ঝলক।
ফিওনার গাল রাঙা হয়ে ওঠে, সে তাড়াতাড়ি ওদের হাত ধরে বলে— “চলো, ভেতরে গিয়ে সব বলবো… অনেক লম্বা গল্প!”
জ্যাসপার গাড়িতে ওঠার আগে হঠাৎ পেছন ফিরে এলো।সবাই তখন ফিওনার সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত, কিন্তু জ্যাসপারের চোখে যেন কেবল একজনই — ফিওনা।
সে এক পা এগিয়ে এসে ফিওনাকে নিজের বুকে টেনে নিল। সবাই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল মুহূর্তেই।তারপর জ্যাসপার ফিওনার কপালে এক নরম চুমু দিল।আলতো করে, গভীর ভালোবাসায়। “নিজের খেয়াল রেখো, হ্যাঁ?” — তার কণ্ঠে ছিল একধরনের কোমল জোর। তারপর মুখ ঘুরিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। ফিওনা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়াতে নাড়াতে বলে উঠল, “বাই প্রিন্স সাবধানে যেও…!”
গাড়ি চলতে শুরু করল। আর গাড়ির ভেতরে বসে থাকা জ্যাসপার তাকিয়ে রইল সেই লুকিং গ্লাসে—
যতক্ষণ ফিওনাকে দেখা যাচ্ছে, ততক্ষণ তার চোখ একটুও সরে না। এক পলকের জন্যেও নয়।
জ্যাসপারের গাড়ি চলে যাওয়ার পরেই লিন আর লিয়া দুজনেই ফিওনাকে দুই পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমরা তোকে ভীষণ মিস করছিলাম!”
ফিওনা হেসে ফেলে, সেই পুরনো দিনের মতো।তিনজন একসাথে হাঁটতে হাঁটতে পিকিং ইউনিভার্সিটির গেট পেরিয়ে বেরিয়ে পড়ে শহরের দিকে। সেই পরিচিত রাস্তাগুলো, সেই পুরনো দিনগুলো যেন ফিরে এলো।
তারা আগে গেল চীনের বিখ্যাত স্ট্রিট ফুড মার্কেটে।
হাতঘড়ি দেখে বেলা প্রায় এগারোটা। তীব্র রোদের মধ্যে ফুটপাথে গরম ধোঁয়া ওঠা ফুড কার্টগুলোর সামনে লাইন।
“তোর জন্য আমরা হটপট রেডি রেখেছি!” — লিন হাসে। “আর আমার জন্য স্টিমড বান!” — বলে লিয়া।
ফিওনা হাসে, আর বলে, “তোরা দু’জনে একটুও বদলাস নি।”
তারা তিনজন একসাথে ধোঁয়া ওঠা তাওকিয়াও খায়, চপস্টিকে নুডলস টেনে নেয়, কোল্ড সোয়েটেড মিল্ক চায় পান করে।লোকজন তাকাচ্ছে, কিন্তু ওরা নিজেদের পৃথিবীতে মগ্ন। তারপর গেল কাছের একটা গেম জোনে। সেখানে ঢুকে প্রথমেই খেলল ড্যান্সিং মেশিনে।লিয়া ফার্স্ট রাউন্ডেই হারে লিনের কাছে, আর ফিওনা সেই হাসতে থাকে।
“তুমি তো একদম আগের মতোই আছো ফিওনা!” — লিয়া বললো। “হয়তো তাই, কিন্তু এখন আমি একজনের হামিংবার্ড তার সবকিছু তাঁর ইউনিভার্স!” — ফিওনা হাসতে হাসতে বলে। তারা এরপর আরও কিছু গেম খেলে—বক্সিং পাঞ্চ, কার রেসিং, তারপর টেডি বেয়ার ক্লো মেশিন। ফিওনা একটা নীল টেডি পায়, আর বলে, “এইটা আমি আমার বেবির জন্য রাখবো।” লিন আর লিয়া আবার থমকে যায়।”তুই আসলেই… মা হতে চলেছিস?”ফিওনা মুচকি হেসে হ্যাঁ বলে মাথা ঝাঁকায়। তিনজন আবার গলা জড়িয়ে ধরে হাসে, আনন্দে ভরে ওঠে সেই পুরনো দিনের বন্ধুত্ব।
এদিকে জ্যাসপারের দিনের কাজ শেষ।
এটাই ছিলো তার আপাতত পৃথিবীর শেষ প্রজেক্ট—একটি বিরল আর অমূল্য পাথর নিয়ে গবেষণা, যার মাধ্যমে শক্তির নতুন প্রবাহ তৈরি করা সম্ভব হবে। হালকা ঘামভেজা কপালে সোনালি আলো পড়ে জ্বলজ্বল করছে। তার চোখে প্রশান্তি, ঠোঁটে একটুখানি আত্মবিশ্বাসের হাসি।
কোম্পানির ল্যাবের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে সে। পেছনে দাঁড়িয়ে থারিনিয়াস আর আলবিরা। দুজনেই অপেক্ষা করছিলো তার কথা শোনার জন্য।
জ্যাসপার হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল ওদের সামনে।
তার কণ্ঠ গভীর, ভারী কিন্তু শান্ত। “আজকের প্রজেক্ট শুধু আমার না। থারিনিয়াস, আলবিরা… এটা তোমাদের জন্যও সাফল্য।” তারা নীরবে তাকিয়ে থাকে জ্যাসপারের চোখে। সে আবার বলে— “তোমরা দুজন আমার সঙ্গ দিয়েছো শুরু থেকে। তাই ভেনাসে ফিরে যাওয়ার পর এই সাফল্যের জন্য রিওয়ার্ড পাবে—আমার পক্ষ থেকে।”
থারিনিয়াস বিস্মিত হয়ে বলে, “প্রিন্স… সত্যি?”
“ইয়েস,” জ্যাসপার মাথা হেলিয়ে বলে। “এটাই ছিলো আপাতত শেষ প্রজেক্ট পৃথিবীতে। আমরা কালকে রাতেই ভেনাসে ফিরবো ”
আলবিরা একটু হেসে বলে, “প্রিন্স আমার কি গিফট পাবো একটু বলুন না আমি খুব এক্সাইটেড। ?”
জ্যাসপার তাকিয়ে থাকে দূরের আকাশের দিকে।তারপর বলে “তোমাদের লাইফের বেস্ট গিফট হবে ভরসা রাখো আমার ওপর ।”
বিকেলের নরম রোদ ছুঁয়ে যাচ্ছে পিকিং ইউনিভার্সিটির লোহার গেটটায়।রাস্তার পাশে কালো বিলাসবহুল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে—একটা ধাতব ঘোড়া যেন শিকারির অপেক্ষায়।পেছনের সিটে বসে আছে জ্যাসপার। মুখে মাস্ক, চোখে সানগ্লাস, কিন্তু তার চোখ—যা ধরা পড়ে কেবল ফিওনার চোখেই—তাতে এক অস্থির প্রতীক্ষা।
ঠিক তখনই রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে ফিওনা, লিন আর লিয়া।হেসে-খেলে আসছে তিনজনেই, কিন্তু ফিওনার চোখ বারবার রাস্তার পাশে তাকিয়ে থাকছে। জ্যাসপারকে দেখেই তার মুখে এক ঝলক হাসি ছড়িয়ে পড়ে।
“তোদের সঙ্গে দারুণ সময় কাটলো,” ফিওনা বলে লিন আর লিয়াকে। লিন ঠাট্টা করে বলে, “তবে যে বলছিলে ‘একটু দেখা করতে এসেছো’, সেটাতো পুরো দিন পার হয়ে গেলো!”
“তোদের জন্যই তো দিনটা এত সুন্দর হলো,” ফিওনা মিষ্টি করে বলে।তারা দুজনেই ফিওনাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানায়। ফিওনা ধীরে ধীরে এগিয়ে গাড়ির দরজার দিকে। জ্যাসপার নিজে নেমে দরজা খুলে দেয়।
“তোমার অপেক্ষায় ছিলাম,” নিচু কণ্ঠে বলে সে।
ফিওনা তার চোখে এক ঝলক তাকায়।তাকে কিছু না বলেই ধীরে ধীরে গাড়িতে উঠে বসে।ভালো করে নড়েচড়ে বসার আগেই জ্যাসপার তার দিকে একটু ঝুঁকে বলে—”সবকিছু ঠিক ছিলো তো?” “তুমি ছিলে না, তাই পুরোপুরি ঠিক ছিলো না,” ফিওনা শান্ত স্বরে বলে।
জ্যাসপার হালকা হেসে গাড়িতে উঠে ফিওনার পাশে বসে পড়ে। গাড়ির কাচ দিয়ে দেখা যায়, লিন আর লিয়া এখনও দাঁড়িয়ে আছে, আর হাওয়ায় হাত নাড়ছে।
ফিওনা জানালার কাচে হেলান দিয়ে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে বাইরে। আর জ্যাসপার তার পাশ থেকে নিঃশব্দে বলে— “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমার হামিংবার্ডটা আজ অনেক বেশি খুশি।”
গাড়ি চলতে চলতে হঠাৎই ফিওনা নিজের ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে বললো, “প্রিন্স, দেখো আমি কী পেয়েছি!”
সে একটা ছোট নীল টেডি তুলে ধরে নিজের গালের পাশে রাখলো।টেডিটার চোখ দুটো বড় বড়, পাউটা গোল আর নরম—দেখলেই মন গলে যাওয়ার মতো।ফিওনা নিজের গালের সাথে টেডিটার গাল লাগিয়ে হেসে বললো, “দেখো তো কেমন লাগছে টেডিটাকে?”
জ্যাসপার এক ঝলকে তাকালো।তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি।তার চোখে পড়লো টেডিটার পাশে থাকা ফিওনার উজ্জ্বল মুখ, আর সেই মায়াময় চোখের দৃষ্টি।
সে ধীরে বলে উঠলো— “কিউট টেডি.. বাট নট মোর দ্যান ইউ” তারপর একটু ঝুঁকে ফিওনার চোখে চোখ রেখে বললো— “ইউ আর টু মাচ কিউট …মোর দ্যান এভরিথিং।”
ফিওনার মুখে তখন একফোঁটা শিশির হাসি, চোখে একরাশ ভালোবাসার আভা ফুটে উঠলো।
জ্যাসপারের কথায় ফিওনা হেসে ফেললো।
সে আবারও টেডিটার দিকে তাকালো, তারপর গালে ঠেকিয়ে বললো, “এই টেডিটা আমার বেবির জন্য রাখলাম!”
জ্যাসপার একটু হালকা চোখে তাকিয়ে বললো, “তুমি এখনো নিজেই একটা বাচ্চা, ফিওনা। আমি ভাবছি, তুমি আরেকটা বাচ্চা কিভাবে সামলাবে?” সে একটু থেমে কপালে ভাঁজ ফেলে জোস করে বললো— “এখন আমাকে একসাথে দুইটা বাচ্চা সামলাতে হবে—একটা ছোট আর একটা একটু বড়!”
ফিওনা মুখ ফুলিয়ে বললো, “আমি বাচ্চা নই প্রিন্স!”
জ্যাসপার মুচকি হেসে তার কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বললো— “ঠিক আছে, তুমি প্রিন্সেস বেবি!” গাড়ির ভেতরে মুহূর্তটা যেন আরও নরম, আরও কাছের হয়ে উঠলো।
গাড়ির জানালা দিয়ে রোদের হালকা ছায়া পড়ছে জ্যাসপারের মুখে। ফিওনার টেডির কথা, তার চঞ্চল চোখ আর কপালের কোলে চুলের আলতো ঝাঁকুনিতে জ্যাসপার যেন একরকম শান্তির আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে।হঠাৎ সে একটু এগিয়ে এসে ফিওনার কাঁধে মাথা রাখে— ধীরে ধীরে যেন পুরোটা বুকের মধ্যে ঢুকে যেতে চায়।
ফিওনা প্রথমে অবাক হয়, তারপর এক মুহূর্তের চুপচাপ ভালোবাসায় আঙুল চালাতে থাকে জ্যাসপারের নরম চুলে। আলতোভাবে চুল সরিয়ে চুমু খায়—জ্যাসপারের মাথায়।
জ্যাসপারের গলায় হালকা কাঁপুনি, যেন এত কাছে থেকেও তার ভালোবাসা ফিওনার ছোঁয়াতে নতুন করে জেগে উঠছে।
ফিওনা কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,”তুমি না থাকলে আমার পৃথিবী একদম খালি খালি লাগে…”
জ্যাসপার চোখ বন্ধ করে থাকা অবস্থায় বললো—”আর তোমার থেকে কয়েক ঘন্টা দূরে থেকেই আমার অবস্থা কেমন হয়েছে বুঝো? এক সেকেন্ডের জন্য ও চোখের আড়াল হলে আমার পাগল পাগল লাগে। এই মুহূর্তে তোমার বুকের মধ্যেই আমার জীবন পূর্ণ।”
এদিকে ভেনাসে, ফ্লোরাস রাজ্যের আকাশে আজ অন্যরকম সুর বাজছে। রাজপ্রাসাদের সভাকক্ষে বসেছে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। রাজা জারেন আর বড় রাজকুমারী লিয়ারা আজ এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন। যাদেথ থেকে সমন্ধ এসেছে তাদের পুত্র সুশিক্ষিত, রুচিশীল, এবং রাজনৈতিক দিক থেকেও শক্তিশালী—পরিপূর্ণ এক যুবরাজ। প্রস্তাবটি এসেছে সরাসরি রাজা জারেনের ঘনিষ্ঠ এক মিত্র রাজ্য থেকে।
এই সম্বন্ধটি ঠিক হয়েছে ফ্লোরাসের রাজকুমারী সিলভার জন্য। সারা রাজপ্রাসাদে তখন খুশির হাওয়া, কিন্তু…
সিলভারের কানে যখন খবরটি পৌঁছায়, তখন যেন ওর পায়ের নিচের জমি সরে যায়। চোখে জল আটকে রাখা কঠিন হয়ে যায়। বুকের ভেতরটা হু হু করে কেঁদে ওঠে।
“না… এই সম্বন্ধ আমি চাই না,” সিলভার ফিসফিস করে বলে,”আমি তো রিয়নকে ভালোবাসি… আমি তো ওর অপেক্ষায় আছি…” কিন্তু কেউ জানে না, এই মুহূর্তে এথিরিয়ন কোথায়। নেই সে ভেনাসে, নেই কোনো যোগাযোগ।হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর থেকে কেউ ওর খোঁজ পায়নি।
আর ঠিক এই শূন্যতার মুহূর্তেই জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তের সামনে এসে দাঁড়ায় সিলভা।
ফ্লোরাস রাজপ্রাসাদের গোলাপ বাগানে সিলভা একা বসে ছিলো হাওয়ায় চুল উড়ছিল, মন যেনো উন্মাদের মতো কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছিলো।অবশেষে… আর সহ্য করতে না পেরে সিলভা উঠে দাঁড়াল।এই চুপচাপ থাকা আর নয়। আজ সত্যিটা বলতেই হবে।
সে সোজা চলে গেল রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে, লিয়ারার কক্ষে।ফিওনার মা, তার নিজের ফুপি—সবচেয়ে কাছের অথচ সবচেয়ে কঠিন মানুষ। “ফুপি…” কণ্ঠটা কাঁপছিল, তবুও সিলভা বলল, “আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। আমি এথিরিয়নকে ভালোবাসি…”
এক মুহূর্তে বাতাস যেন থেমে গেল।
লিয়ারার চোখ বড় হয়ে গেল, চেহারা কালো মেঘে ভরে উঠল। হঠাৎ এক বজ্রপাতের মতো একটা চড় এসে পড়ল সিলভার গালে। “তোমার এত সাহস!” গর্জে উঠলেন লিয়ারা, “ওই ছেলেকে ভালোবাসো? যার ভাই আমার মেয়ের জীবনটাকে নরকে নামিয়ে এনেছে?”
সিলভার চোখ ছলছল করে ওঠে, কিন্তু সে চুপ। “জ্যাসপার—তাও তো যোগ্য। সম্মান আছে, শক্তি আছে, রাজপুত্রদের মধ্যে রাজপুত্র। কিন্তু এথিরিয়ন?” “ওর কী আছে? নিজের কোনো পরিচয় নেই, ভাই আর বাবার প্রাসাদে পড়ে থাকে, নিজের কোনো অবস্থান নেই!”
একটু থেমে লিয়ারা কঠিন স্বরে বলেন, “ভার্সিটি থেকেও তো ও সাসপেন্ড হয়েছে। ওর সঙ্গে তোমার কী ভবিষ্যৎ?”
সিলভা তখন মাথা নিচু করে শুধু এতটুকু বলে, “ভবিষ্যৎ জানি না… কিন্তু আমি আমার হৃদয় জানি। আমি ভালোবাসি। সত্যিকারের ভালোবাসি ওকে…”
লিয়ারার গলা তখন প্রচণ্ড রাগে আর অভিমানে কাঁপছে। তিনি সিলভার চোখে চোখ রেখে বললেন— “জেনেশুনে, একপাক অন্ধকারে ঠেলে দিবো তোমাকে? যে ভবিষ্যৎ আজ অবধি তৈরিই হয়নি, সেখানে ঠেলে দিতে বলছো আমাকে?”
“তুমি এখন আবেগে ডুবে আছো, সিলভা। এখন তাকে চাও। কিন্তু কয়েকদিন পর?”“যখন অভাব আসবে, অপমান আসবে, তখন তুমি নিজেই চলে আসবে। তখন? তখন আমাদের সম্মান কোথায় থাকবে?”
“আমি শুধু মা বা ফুপি নই,আমি এই রাজপরিবারের একজন বড় রাজকুমারী। আমি সেই পথ চলতে দিতে পারি না—যেখানে পদে পদে আছে লজ্জা, ব্যর্থতা আর অনিশ্চয়তা।আমি তা হতে দেবো না, সিলভা। আমি তোমাকে সেই ছেলের হাতে সঁপে দিতে পারি না, যার নিজের দাঁড়াবার শক্তি নেই।”
সিলভা কাঁপা গলায় ফুপির দিকে তাকিয়ে বলল,”তাহলে আমাকে সময় দাও, ফুপিই। আমি ওর সঙ্গে কথা বলব। আগে ও নিজের একটা ক্যারিয়ার দাঁড় করাক, তারপর…”
কিন্তু লিয়ারা মাঝপথেই কথাটা কেটে দিয়ে রাগে গর্জে উঠলেন, “ওই ছেলে? ওই এথিরিয়ন? ওর বয়স কতো জানো তুমি? সবেমাত্র ২৪! এই বয়সে কি গড়বে?””ক্যারিয়ার করতে করতে ১০ বছর পার হয়ে যাবে, ততদিনে তোমার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাবে!রাজপরিবারে এসব ধৈর্য চলে না, সিলভা।আর জানো কতো ভালো সম্বন্ধ এসেছে তোমার জন্য? যারা এখনই তোমার পাশে একটা শক্ত সিংহাসন দাঁড় করিয়ে দিতে পারবে, তাদের হাত ছাড়া করবো কেন?স্রেফ একটা আবেগের কারণে?”
সিলভা চোখের জল ফেলে চিৎকার করে উঠে বলল,
“অ্যালিসা আপু তো আমার চেয়েও বড়! তার তো এখনো বিয়ে হয়নি! তাহলে আমাকে আগে কেনো ঠেলে দিচ্ছো, ফুপিই?”
লিয়ারা এবার একটু শান্ত গলায় বললেন, কিন্তু গলার রেশে কঠোরতা স্পষ্ট,”অ্যালিসার মানসিক অবস্থা ভালো নেই। ও এখনো কোনো একটা ট্রমা থেকে পুরোপুরি বের হতে পারেনি। ওকে সময় দিতে হচ্ছে। আর এই সম্বন্ধটা? এই ছেলে তোমার বাবার পরিচিত একজনের ছেলে। রাজনীতি, শক্তি, সম্মান—সব আছে ওর ঘরে। তোমার ভবিষ্যৎ নিরাপদ হবে, সিলভা।”
এখন না বুঝলেও একদিন বোঝাবে, কেন আমি এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।”
লিয়ারা আরো কঠিন গলায় বললেন, “হতে পারে জ্যাসপার ভেনাসের প্রিন্স। ওর বাবা কিং, আর এল্ড্র রাজ্য ভেনাসের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য। কিন্তু এথিরিয়ন? সে তো শুধু তার বাবা ভাইয়ের নামেই পরিচিত। ওর নিজের কিছু নেই, নিজের কোনও অবস্থান, কোনও লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রমাণ নেই।ও তো এখনও ওর ভাই আর বাবার ছায়ায় বেঁচে আছে। শুন্য, একেবারে শুন্য!আমি কি তোমাকে এমন একজনের হাতে তুলে দিতে পারি, যার ভবিষ্যৎ পর্যন্ত ধোঁয়াশায় ঢাকা?”
তখন লিয়ারা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না।গায়ে জড়ানো রেশমের সালটা সামান্য সামলে নিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে ওঠেন, “যখন বুঝবে মনের চেয়ে ভবিষ্যৎ অনেক বড় ব্যাপার, তখন আমার দরজাটা খোলা থাকবে—তবে হয়তো দেরি হয়ে যাবে।” তার পেছনে দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। ঘরে শুধু পড়ে থাকে নিঃশব্দ কান্না চেপে রাখা এক সিলভা, আর জানালার ধারে হালকা বাতাসে দুলতে থাকা ফ্লোরাস পতাকা।
অ্যাকুয়ারা এল্ড্রে রাজপ্রাসাদের একটি নিরিবিলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে, গায়ে রুপোর গাউন, একা একা নিজের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে ব্যথা প্রশমনের চেষ্টা করছিল।
হালকা শীতল বাতাস তার খোলা চুলে খেলছিল, আর ক্লান্তি যেন ঘাড়ে কাঁধে ভর করে বসে আছে। ঠিক তখনই, নরম পদক্ষেপে পেছন থেকে লিউ জান এসে দাঁড়ায়।
কোনো কথা না বলে সে আলতো করে অ্যাকুয়ারার ঘাড়ে হাত রাখে। “কি হয়েছে এখানে ?” — লিউ জানের গলা নরম, স্নিগ্ধ। তার আঙুলের স্পর্শে যেন এক মায়াময় শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে অ্যাকুয়ারার সারা ঘাড়ে। সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। লিউ জান একহাত দিয়ে তার ঘাড় ম্যাসাজ করতে করতে আরেক হাতে মাথায় চাপ দিতে থাকে।
অ্যাকুয়ারা হালকা হেসে বলে, — “যাক, লাইফে একটা ডক্টর পেয়ে ভালোই হলো। অলটাইম ট্রিটমেন্ট নিবো এখন থেকে!”
লিউ জান একটু হেসে তার কানে কানে বলে,
— “আমি শুধু ট্রিটমেন্টের জন্য না, প্রিসক্রিপশন দিতেও পারি—ব্লুড্রিম!! যদি নিয়ম মেনে চলো!”
অ্যাকুয়ারা তখন হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে, — “প্রিসক্রিপশন রাখো তোমার কাছে মিস্টার পালস্! আগে ম্যাসাজ ঠিকমতো করো!”
লিউ ঝান অ্যাকুয়ারার ঘাড়ে ধীরে ধীরে আঙুল চালাতে চালাতে অভিমান মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, — ব্লুড্রিম তোমার ওই চাইল্ডিশ প্রিন্স এখনো ফিরছে না কেন? কতোদিন হয়ে গেলো…তোমাকে নিয়ে পৃথিবীতে যেতে হবে তো।”
অ্যাকুয়ারা একটু চুপ থেকে হেসে বলল, — “তোমার মনে কি খুশির একটা আলাদা রং লেগে গেছে, ডক্টর সাহেব? তুমি এতো তাড়াহুড়ো কেনো করছো?”
লিউ ঝান এবার ম্যাসাজ করতে করতেই ওর কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, — “আমি চাই, এই ঘাড়ে হাত রাখার অধিকার শুধু আমার থাকুক। এই চুলে হাত
চালানোর ছুঁতো শুধু আমিই পাই। আর এই চোখ… শুধু আমাকেই দেখুক।”
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪১
অ্যাকুয়ারা চমকে ওর দিকে তাকাল। কিছু বলার আগেই লিউ ঝান আস্তে করে ওর গাল ছুঁয়ে বলল, — “চাইল্ডিশ প্রিন্স তো ফিরবেই, কিন্তু ততদিন অপেক্ষা করতে করতে বয়স পার হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।”
তারপর দুজনের মাঝে মুহূর্তের নীরবতা। বাইরের আকাশটা তখন গোধূলি ছুঁয়ে গেছে, যেন সেই মৃদু আলোতেই তাদের ভালোবাসার প্রথম ছায়া গেঁথে গেলো।