আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৭
সাবিলা সাবি
ভেনাসের আকাশ আজ স্বচ্ছ, সূর্যের আলো নীলাভ মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে।ফিওনার পা প্রথমবারের মতো স্পর্শ করল স্টেলার একাডেমির মসৃণ, ধাতব-মিশ্রিত পথ। এখানকার মাটি কাঁচের মতো স্বচ্ছ, নিচে ভেসে থাকা বিশাল সব শক্তি-কেন্দ্র দেখা যায়, যা পুরো ক্যাম্পাসের ভারসাম্য বজায় রাখছে। আশেপাশের ভবনগুলো যেন কেবল ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতার নিদর্শন নয়, বরং শিল্পকর্ম—নির্মল আকাশের নিচে ভাসমান, মাধ্যাকর্ষণের শৃঙ্খলা অস্বীকার করে দাঁড়িয়ে আছে।
ক্যাম্পাসে ঢোকার মুহূর্তেই ফিওনা টের পেল শত শত দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ। কেউ ফিসফিস করছে, কেউ মুখের কোণে চাপা হাসি, কেউ আবার বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। নতুন শিক্ষার্থী এখানে আসে প্রতি বছর, কিন্তু আজ যেন পরিস্থিতি কিছুটা অন্যরকম।
“ও কি নতুন?”
“প্রাইম ডিভিশনের ছাত্রী?”
“কোন রাজ্য থেকে এসেছে?”
ফিসফিসগুলো ফিওনার কানে আসছিল, কিন্তু সে ভান করল যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল,যদিও গলা শুকিয়ে আসছিল।
“তুমি ঠিক আছ তো?” পাশে থাকা লিয়ারা ধীরে ধীরে বলল।
ফিওনা মৃদু মাথা নাড়ল।
একাডেমির প্রবেশদ্বার স্বচ্ছ, নীলাভ স্ফটিকের তৈরি, যার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করতেই চারপাশের বাতাসে অদ্ভুত এক ভারী অথচ আরামদায়ক অনুভূতি ভেসে এলো। বিশাল গ্রাভিটেশনাল প্ল্যাটফর্ম-এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সহজেই এক ভবন থেকে অন্য ভবনে চলে যেতে পারে। কাঁচের মতো স্বচ্ছ কিন্তু কঠিন পদার্থের তৈরি ফ্লোরে মহাকাশের তারার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, যা হাঁটার সময় এক অনন্য অনুভূতি দেয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এখানে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অনুযায়ী প্রাইম ক্যাডেটস (প্রথম স্তর) →নতুন শিক্ষার্থীরা এখানে ভর্তি হয়।
ইন্টারমিডিয়েট ক্যাডেটস (দ্বিতীয় স্তর) →যারা কিছু বছর পড়েছে,কিন্তু এখনো বিশেষায়িত প্রশিক্ষণে যায়নি।
অ্যাডভান্সড ক্যাডেটস (তৃতীয় স্তর) → যারা গবেষণা ও জটিল বিষয়গুলোতে পারদর্শী হতে শুরু করেছে।
এলিট স্টেলার গার্ডস (চূড়ান্ত স্তর) →যারা শিক্ষার শেষ ধাপে এসে বাস্তব প্রশিক্ষণ ও মিশনে অংশ নিচ্ছে।
এটি একাডেমির সর্বোচ্চ স্তর,যেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু পড়াশোনাই করে না, বরং বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা, যুদ্ধ কৌশল,ও স্টেলার টেকনোলজি-তে প্রশিক্ষিত হয়।
অন্যদিকে,ফিওনা “প্রাইম ক্যাডেটস”-এ নতুন ভর্তি হয়েছে,যেখানে তাকে মূলত স্টেলার ফিজিক্স,কসমিক ইতিহাস,আর বেসিক মহাকাশ প্রযুক্তি শেখানো হবে। এই ক্যাম্পাসে পৃথিবী থেকে ফিওনাই একমাত্র সদস্য।
হঠাৎ পুরো ক্যাম্পাসে মৃদু ঝঙ্কার শোনা গেল। একাডেমির মূল ভবনের সামনে বিশাল এক হলোগ্রাফিক স্ক্রিন জ্বলে উঠল,যেখানে ধীর কণ্ঠে ঘোষণা এল,
“সম্মানিত শিক্ষার্থীরা,আজ আমরা আমাদের নতুন সহপাঠীকে স্বাগত জানাচ্ছি।”
তারপরই কণ্ঠ বদলে গিয়ে পরিচিত হয়ে উঠল।
“ফিওনা।সামনে আসো।”
গলার স্বর প্রফেসর লেক্সান্দ্রাসের।
ফিওনার বুক ধক করে উঠল। এত শিক্ষার্থীর সামনে?
ক্যাম্পাসের ওপেন-এয়ার সেমিনার হলে বিশাল এক জমায়েত, চারপাশে শূন্যে ভাসমান সিটিং এরিয়া, যেখানে শিক্ষার্থীরা বসে আছে। প্রত্যেকের চোখ এখন ফিওনার দিকে। ধীরে ধীরে সে এগিয়ে গেল, অনুভব করল অদৃশ্য এক চাপে সে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে।
প্রফেসর লেক্সান্দ্রাস তার দিকে তাকালেন। তার চোখ গভীর, প্রজ্ঞায় ভরা, তবে ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি।
“এই শিক্ষার্থী আমাদের প্রাইম ডিভিশনের নতুন সদস্য।”
সবাই নীরব। শুধু কিছু ফিসফিস শোনা যাচ্ছে,
“সে কোন রাজ্যের?”
“আগে কখনো নাম শুনিনি।”
“তার শক্তি কী?”
প্রফেসর এবার এক মুহূর্ত থেমে বললেন, “ফিওনা এসেছে পৃথিবী থেকে।”
এবার যেন এক মুহূর্তে পুরো ক্যাম্পাস নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
পৃথিবী থেকে?
যারা এই নাম কখনো শোনেনি,তারা কপাল কুঁচকে তাকাল। যারা জানত,তারা শিহরিত হলো।ভেনাসের বাইরের কেউ এখানে?একাডেমির ইতিহাসে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি।
ফিওনা টের পেল, এখন সবাই তাকে শুধু কৌতূহলের চোখে নয়, অবিশ্বাস আর শঙ্কার চোখে দেখছে।
একজন শিক্ষার্থী চাপা গলায় বলল, “এটা কি সম্ভব? একজন পৃথিবীর মেয়ে আমাদের ভেনাসের ক্যাম্পাসে?”
অন্যজন ফিসফিস করল,”তার কি বিশেষ শক্তি আছে?”
ফিওনা কেবল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।তার চারপাশের গুঞ্জন ধীরে ধীরে বাড়ছে।সে জানে,এই জায়গা তার জন্য সহজ হবে না।
কিন্তু সে জানে এটাও—এই ক্যাম্পাসে তার আসার পিছনে কোনো না কোনো কারণ আছে।হয়তো এই একাডেমি, হয়তো এই রাজ্য,হয়তো পুরো ভেনাসই তার ভাগ্যে লেখা ছিল।
সে গভীর শ্বাস নিলো।
এই যুদ্ধ তাকে একাই লড়তে হবে।
তারপর প্রফেসর বললেন, “ফিওনা, তোমার প্রথম ক্লাস হবে ‘স্টেলার ফিজিক্স’ বিষয়ে। তুমি ক্লাসরুম বি-৩ এ চলে যাও।”
ফিওনা এক মুহূর্ত দম নিলো। সে জানে, এটা শুধুই শুরু। এখন তাকে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে, এই উন্নত গ্রহের মেধাবীদের মাঝে নিজের অবস্থান তৈরি করতে হবে।
স্টেলার একাডেমির ক্লাসগুলো ছিল হোলোগ্রাফিক থিয়েটার-এর মাধ্যমে পরিচালিত, যেখানে বাস্তবের মতোই জিনিস অনুভূত হয়। প্রথম ক্লাস ছিল “কসমিক এনালিটিক্স”, যেখানে মহাবিশ্বের বিভিন্ন গ্রহ ও সভ্যতার বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয়।
পুরো কক্ষটাই যেন ভবিষ্যতের কোনো গবেষণাগার, চারদিকে স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল, যার ওপাশে মহাজাগতিক নীল আভা ভেসে বেড়াচ্ছে। শূন্যে ভাসমান স্ক্রিনে ক্লাসের বিষয়বস্তু ফুটে উঠছে, আর কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর লেক্সান্দ্রাস—ভেনাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্বান, ড্রাগন ইতিহাস ও শক্তির ওপর বিশেষজ্ঞ।
ফিওনা ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। আজ তার প্রথম ক্লাস, আর প্রথম দিনেই তাকে নিজের পরিচয়, নিজের শক্তি নিয়ে নতুন কিছু শিখতে হবে।
প্রফেসর ধীরস্থির কণ্ঠে বললেন, “ফিওনা, তুমি জানো কি, তোমার ভেতরে যে শক্তি রয়েছে, তা খুব সাধারণ কিছু নয়?”
ফিওনা কিছুটা চমকে গেল।
“আমি… আমি তো জানি না,” সে মৃদু স্বরে বলল।
প্রফেসর হালকা হাসলেন, তারপর স্ক্রিনের দিকে ইঙ্গিত করলেন। সেখানে বিভিন্ন রঙের ড্রাগনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠল—নীল, লাল, রূপালী, সবুজ… আর একদম শেষে একটি বাদামী ড্রাগনের প্রতিচ্ছবি।
“এটা হলো বাদামী ড্রাগন।খুব বিরল।
ফিওনার চোখ বড় হয়ে গেল।”আমি কি…আমি কি বাদামী ড্রাগনের উত্তরাধিকারী?”
প্রফেসর মাথা নাড়লেন। “ঠিক তাই।বাদামী ড্রাগনের বিশেষত্ব হলো—তারা শুধু শারীরিক শক্তিতেই শক্তিশালী নয়,বরং তাদের মানসিক শক্তিও অসাধারণ। তারা অনুভব করতে পারে এমন অনেক কিছু,যা সাধারণ ড্রাগনরা পারে না। তাদের কাছে অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যতের কিছু আভাসও আসে।”
ফিওনার মনে পড়ল তার স্বপ্নগুলোর কথা। কখনো অদ্ভুত আলো, কখনো অস্পষ্ট চিত্র, কখনো এক রহস্যময় কণ্ঠস্বর… তবে কি এই সব কিছুই তার ভেতরের ক্ষমতার অংশ?
“তবে মনে রেখো,” প্রফেসর এবার কঠোর কণ্ঠে বললেন, “ভেনাসে খুব কম ড্রাগন রূপ ধরবে।বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া ড্রাগন রূপ ধারণ করা বিপ*জ্জনক হতে পারে।”
ফিওনা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।
“কেন?বিপ*জ্জনক কেন?”
প্রফেসর গভীর চোখে ফিওনার দিকে তাকালেন।
“কারণ ভেনাসের নিয়ম বদলাচ্ছে,আর তোমার শক্তি যদি ভুল হাতে পড়ে,তাহলে তা এক মহাবিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।”
প্রথম ক্লাস শেষ হতে না হতেই ফিওনার মাথা ভরে আছে হাজারো নতুন তথ্য দিয়ে।বাদামী ড্রাগনের বিশেষত্ব, ভেনাসের নিয়মকানুন,আর তার নিজের অজানা শক্তি—এসব ভাবতে ভাবতেই সে হাঁটছিল স্টেলার একাডেমির বিশাল করিডোর দিয়ে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ক্যান্টিনে পৌঁছাল। ষক্যান্টিনটা যেন সাধারণ কোনো খাবারের জায়গা নয়,বরং ভবিষ্যতের এক ভোজনশালা।টেবিলগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে খাবার পরিবেশন করছে,শূন্যে ভাসমান মেন্যু স্ক্রিন থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের খাবার অর্ডার করছে।
ফিওনার পাশেই বসেছে কিছু নতুন বান্ধবী—রায়না,মেলিয়া আর সেরেনা।তারা সবাই প্রাইম ডিভিশনের শিক্ষার্থী আর ফিওনাকে দেখে খুবই আগ্রহী।
“তাহলে তুমি পৃথিবী থেকে এসেছো?মানবী থেকে ড্রাগনে পরিনত হয়েছো?এটা তো অবিশ্বাস্য!” রায়না চওড়া চোখে তাকিয়ে বলল।
মেলিয়া হাসল, “আমাদের ক্যাম্পাসে প্রথমবার কোনো মানুষ ভর্তি হলো,এটা ইতিহাস!”
ফিওনা একটু অস্বস্তি বোধ করলেও মেলিয়াদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে স্বস্তি পেল।
ঠিক তখনই,একটা ছেলেকে দেখা গেল।লম্বা,ছিপছিপে গড়ন,চোখে যেন দুষ্টুমি ঝলক দিচ্ছে।সে একদম ফিওনার সামনে এসে বসে বলল—
“শুনেছি,তুমি পৃথিবী থেকে এসেছো।একবার বলে দাও তো, পৃথিবীর খাবারের স্বাদ কেমন?কারণ এই ক্যান্টিনের খাবার তো মনে হচ্ছে এলিয়েনদের জন্য বানানো!”
ছেলেটির কথায় ফিওনা প্রথমে চমকে গেলেও পরে হেসে ফেলল।”তোমার নাম কী?”
ছেলেটি চোখ টিপে বলল,”আমি লুকাস!আর তুমি?অবশ্যই তুমি ফিওনা।কারণ এখন পর্যন্ত পুরো ক্যাম্পাস তোমার কথা বলছে!”
ফিওনা অবাক হলো,”আমার কথা?”
লুকাস কাঁধ ঝাঁকাল,”অবশ্যই!এতদিন ধরে কেউ জানতেও পারেনি যে পৃথিবী থেকে কেউ এখানে পড়তে আসতে পারে। আর এখন তুমি এখানে!আমি বাজি ধরে বলতে পারি,তুমি শুধু ক্লাসে নয়,পুরো একাডেমিতেই আলোড়ন তুলে ফেলবে!”
ফিওনা হাসল।লুকাসের মজার কথাবার্তা আর সহজাত বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ তাকে স্বস্তি দিচ্ছিল।এতদিন ধরে সে শুধু নিজের ভেতরে ভয়ের সঙ্গে লড়াই করছিল,কিন্তু এখানে এসে নতুন বন্ধু পাওয়াটা সত্যিই একটা স্বস্তির ব্যাপার।
“তাহলে?” লুকাস আবার বলল,”তুমি কি আমার সাথে বন্ধুত্ব করবে?আমি কিন্তু খুবই ভালো বন্ধু!”
ফিওনা চোখ সরু করে তাকাল,”তুমি কি সবসময় এত কথা বলো?”
লুকাস হাসল, “এটাই আমার বিশেষত্ব!”
ফিওনা হাসতে হাসতে মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে,লুকাস।উই আর ফ্রেন্ডস নাও!”
লুকাস উচ্ছ্বসিত মুখে বলল, “তাহলে বন্ধুত্বের প্রথম নিয়ম, ক্যান্টিনের সবচেয়ে ভালো খাবার খুঁজে বের করা!চল,শুরু করা যাক!”
ফিওনা বুঝতে পারল,লুকাসের সঙ্গে বন্ধুত্ব মানেই একগাদা হাসি,মজা,আর রহস্যময় সব কাণ্ডকারখানা হবে!
দুই দিন কেটে গেছে,আর ফিওনা বুঝতে পারছে স্টেলার একাডেমিতে তার জীবনটা এখন বেশ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।নতুন পরিবেশ,নতুন বন্ধুরা—সবকিছুতেই সে নিজেকে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিচ্ছে।তবে সবচেয়ে বেশি স্বস্তি দিচ্ছে লুকাস।ওর হাসিখুশি স্বভাব,ঠাট্টা-মশকরা,আর দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে ফিওনার একাকীত্ব যেন উধাও হয়ে গেছে।
লুকাসের সঙ্গে প্রতিদিন ক্লাস করা,ক্যান্টিনে খাওয়া, লাইব্রেরিতে পড়াশোনা—এসব যেন এক রুটিন হয়ে গেছে ফিওনার জন্য।কিন্তু আজকের দিনটা একটু অন্যরকম।
ক্যান্টিনে ঢুকেই ফিওনা টের পেল,কেউ একজন তাকে দেখছে।অস্বস্তি বোধ করল সে।চারপাশে তাকিয়ে দেখতে পেল,কোণের এক টেবিলে বসে থাকা একজন দীর্ঘদেহী ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে।চোখজোড়া আকাশী রঙের, মুখে এক অদ্ভুত নির্লিপ্ত ভাব।
ফিওনার মনের মধ্যে মুহূর্তেই ঝলক দিয়ে উঠল—এই ছেলেটাকে সে আগেও দেখেছে!কোথায়?
ফ্লোরাস রাজ্যের দরবারে।
ফিওনার মুখ ভ্রু কুঁচকে গেল।সে এই ছেলেটাকে ড্রাকোনিসের ছোট ছেলে হিসেবে দেখেছে, প্রিন্স জ্যাসপারের ছোট ভাই।কিন্তু সে এখানে কী করছে?
ছেলেটি ধীর পায়ে এগিয়ে এল।
“ফিওনা, তুমি এখানে?”
তার গলার স্বর গভীর,কিন্তু অবাক লাগছিল না,বরং যেন সে অনেক কিছু জানে।
ফিওনা চোখ সরু করে তাকাল,তারপর পাল্টা প্রশ্ন করল, “আপনি এখানে কেন?”
ছেলেটি একটু হাসল। “আমি এখানে পড়ি। অ্যাডভান্সড লেবেল আপাতত ফাইনাল ইয়ারে আছি,এলিট স্টেলার গার্ডসের সদস্য।”
ফিওনা বিস্ময়ে চোখ বড় করল। “তাহলে তো আপনার পড়ালেখা শেষ পর্যায়ে?”
এথিরিয়ন মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ কিন্তু তুমি?”
ফিওনা সোজা হয়ে দাঁড়াল। “আমি প্রাইম ডিভিশনের।”
এথিরিয়নের চোখে এক মুহূর্তের জন্য বিস্ময় খেলে গেল। তারপর সে মুখে রহস্যময় এক হাসি এনে বলল,”বেশ,তাহলে তুমি আর আমি এখন একই একাডেমিতে তবে আমি তোমার সিনিয়র।”
ফিওনা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,”এতো বড় ছেলে হয়ে এখনো পড়াশোনা শেষ হয়নি?”
এথিরিয়ন হেসে পাশের চেয়ার টেনে বসে বলল,”তোমার কি আমাকে বয়স্ক মনে হয়?আমি কচি একটা ছেলে,সবেমাত্র ২৪ বছর বয়স হয়েছে।জ্যাসু ভাইয়ের মতো ২৮ নয়।”
ফিওনা একটু থমকালো।কথাটা শুনে তার মনে অদ্ভুত একটা অস্বস্তি কাজ করল।সে তো শুধু একটা সাধারণ প্রশ্ন করেছিল,আর এথিরিয়ন তার উত্তরে হুট করে জ্যাসপারের প্রসঙ্গ টেনে আনল কেন?
সে কি ইচ্ছে করেই জ্যাসপারের কথা তুলল?নাকি এটা নিছকই কাকতালীয়?
ফিওনা চট করে নিজের অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলল।সে আর দাঁড়াল না। সংক্ষিপ্ত স্বরে বলল, “ঠিক আছে,দেখা হবে। বিদায়।”
কথা শেষ করেই সে দ্রুত ক্যান্টিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
তার ভেতরে অদ্ভুত এক অস্বস্তি বাসা বাঁধছিল।
ড্রাকোনিসের সাথে কোনো সম্পর্ক আছে এমন কাউকে দেখতে বা কথা বলতে কেনো যেনো ভালো লাগে না!
রাত গভীর।ফিওনার কক্ষে নরম আলো জ্বলছিল,জানালাটা হালকা খোলা,আর বাতাসে বইয়ের পাতাগুলোর ধীরে ধীরে ওলট-পালট হওয়ার শব্দ।সারা দিন ক্লাস আর বন্ধুদের সাথে সময় কাটিয়ে কখন যে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে, সেটা সে নিজেও জানে না।পাতার নিচে রাখা হাতটা ধীরে ধীরে উঠে-নামছে,গভীর ঘুমের নিঃশ্বাসে।
কিন্তু সে জানে না—এই ঘুমের পাহারায় আছে আরেকজন।
এল্ড্র রাজ্যের ল্যাব থেকে কেউ একজন মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে।
জ্যাসপার।
সে পর্দার স্ক্রিনে চোখ রাখলো।তার ছোট্ট,নিখুঁতভাবে তৈরি ড্রোনটি এখন ফিওনার কক্ষে।জানালার ফাঁক গলে নিঃশব্দে ঢুকে পড়েছে।
ড্রোনটি ধীরে ধীরে ফিওনার মুখের কাছাকাছি এলো।স্ক্রিনে ভেসে উঠলো ফিওনার প্রশান্ত মুখ,তার চোখের লম্বা পাপড়ি, নিঃশ্বাসে সামান্য কাঁপতে থাকা ঠোঁট।জ্যাসপার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
ড্রোনটি একটু নিচে নামল,একদম ঠোঁটের কাছে।
জ্যাসপার নিজের অজান্তেই স্ক্রিনের সামনে ঝুঁকে এলো। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।যেনো এই স্ক্রিন পেরিয়েই…
তার ঠোঁট স্ক্রিনের উপর ছোঁয়া লাগলো।
একটা দীর্ঘ মুহূর্ত কাটল।
সে জানে, এই চুম্বনের কোনো অস্তিত্ব নেই।
সে জানে, ফিওনা কিছুই টের পাবে না।
তবুও কেন জানি মনে হলো—সে এক মুহূর্তের জন্য সত্যিকারের স্পর্শ অনুভব করলো।
কিন্তু…
ফিওনা তখনই একটু নড়েচড়ে উঠে, যেন ঘুমের মধ্যেও কিছু অনুভব করেছে। শ্বাস একটুখানি গভীর হয়ে এলো।
জ্যাসপার দ্রুত ড্রোনটি ফিরিয়ে নেয়।
রাতের আকাশে ফ্লোরাস রাজ্যের নরম আলো ছড়িয়ে আছে, কিন্তু বাতাস আজ অস্বাভাবিক ঠান্ডা।জানালার ফাঁক দিয়ে প্রবাহিত বাতাসে ফিওনার শরীর একবার কেঁপে উঠল।ঘুমের গভীরেও তার মুখটা অস্বস্তিতে কুঁচকে গেল।
স্ক্রিনের ওপার থেকে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে জ্যাসপারের ভ্রু একসাথে কুঁচকে উঠল।
সে আর এক মুহূর্তও দেরি করল না।এল্ড্র রাজ্যের রাজকীয় মহলে বসে থাকার সময় নেই তার।
এক মুহূর্তের মধ্যে সে ড্রাগন রূপ ধারণ করল।তার বিশাল ডানা রাতের অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ল,যেন আকাশে নীরব এক আতঙ্ক।সবুজ আঁশের শরীরে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে,আর সে এক প্রবল বেগে ফ্লোরাস রাজ্যের দিকে উড়ে চলল।
শূন্যে ভেসে এসে জ্যাসপার ফিওনার বারান্দায় নামল,তার ডানা গুটিয়ে নিলো নিঃশব্দে ফিরে এলো মানব রুপে।
হালকা ঠান্ডা বাতাস তার চুল উড়িয়ে দিচ্ছে।
বারান্দার দরজায় হাত রাখতেই টের পেল,দরজাটা খোলা!
সে এক মুহূর্তও দ্বিধা না করে ভেতরে প্রবেশ করল।
ফিওনা ঘুমিয়ে আছে,ছোট্ট শিশুর মতো নিস্তব্ধ।
বালিশের পাশে খোলা বই,তার একপাশে গড়িয়ে পড়েছে নোটবুক।লম্বা বাদামী চুলগুলো বিছানার চাদরে ছড়িয়ে আছে।জানালার দিক থেকে আসা ঠান্ডা বাতাসে তার শরীর কেঁপে উঠছে বারবার।
জ্যাসপার নিঃশব্দে তার পাশে বসল।
একদম ধীর হাতে রাজকীয় কম্বলটা তুলে নিলো,তারপর সাবধানে ফিওনার গায়ে জড়িয়ে দিল।যেন সে একটুও অস্বস্তি না পায়।যেন তার ঘুমে একটুও ব্যাঘাত না ঘটে।
ফিওনার চোখের পাতাগুলো এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল, যেন কোনো স্বপ্নের ভেতর সে কিছু অনুভব করেছে।
কিন্তু জ্যাসপার জানে,মানুষ চিরকাল স্বপ্নের ভেতরেও কিছু স্মৃতি ধরে রাখে…জ্যাসপার স্থির হয়ে বসে আছে ফিওনার পাশে,একদৃষ্টিতে তাকিয়ে।
কতো মাস!
কতো মাস পেরিয়ে গেছে,অথচ আজ এই প্রথমবার আবারও সে ফিওনাকে এভাবে দেখছে।
নিঃশব্দ,নিশ্চুপ,কোমলীয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
এভাবেই তো দেখত সে ফিওনাকে মাউন্টেন গ্লাস হাউজে— যখন রাতের আকাশের নিচে,কাঁচের দেয়ালের ওপাশে, শুধুমাত্র চাঁদের আলোয় ফিওনার নিঃশ্বাসের ওঠানামা দেখতে পেতো।সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যাসপার।
তার হাত অজান্তেই একটু বাড়িয়ে দিল ফিওনার দিকে।
অস্ফুট স্বরে ফিসফিস করে বলল,“আমার হামিংবার্ড…
ঠিক আগের মতোই নাজুক,কোমল।”
তার ভিতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি খেলে গেল।
একদিকে অভিমান,অন্যদিকে গভীর এক আকর্ষণ।
ইচ্ছে করছে…
কপালে আলতো করে একটা চুম্বন দিতে।
কিন্তু পারছে না।
জ্যাসপার জানে,এটা এক মুহূর্তের দুর্বলতা।সে যদি একবার ফিওনাকে ছুঁয়ে ফেলে,তাহলে সে আর নিজেকে সামলাতে পারবে না।
সে জানে,তার মতো কারও কোনো অধিকার নেই ফিওনার এতটা কাছে আসার।
ফিওনার ঘুমের মাঝে ঠোঁট একটু নড়ল,যেন সে কোনো স্বপ্ন দেখছে।
জ্যাসপার গভীরভাবে তাকিয়ে রইল।
তারপর নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল।
সে এখনো বন্দি তার নিজের নির্মম বাস্তবতার মধ্যে।
একবারও পেছনে না তাকিয়ে জ্যাসপার আবার অন্ধকার রাতের আকাশে মিলিয়ে গেল—ফ্লোরাস রাজ্যের বাতাসে তার সবুজ আঁশের ঝলক এক মুহূর্তের জন্য খেলে গেলো,তারপর সব নিঃশব্দ হয়ে গেল।
সকাল থেকে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল।ফিওনা যথারীতি ভার্সিটিতে এসেছে,ক্লাস করছে।স্টেলার একাডেমির সুবিশাল,আধুনিক ক্লাসরুমের কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে হঠাৎ কিছু একটা দেখতে পেলো—
একটা ড্রোন।
ফিওনার ভ্রু কুঁচকে গেল।
এই ড্রোনটা কোথায় দেখেছিলাম?
তার মনে হালকা সন্দেহ জাগলো।কিন্তু সেই মুহূর্তে ড্রোনটা জানালার পাশ দিয়ে উড়ে গেল।
কেন যেন মনে হলো,সে আগেও এটা দেখেছে।
সেদিন…
সেদিন রাতে,ফ্লোরাস রাজ্যে…জানালার বাইরে দেখছিলো।
ফিওনা গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলো।
তারপর হঠাৎই লুকাসের ডাক এল—
“ফিওনা!এইদিকে মন দাও!আজকের লেকচারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ!”
ফিওনা চমকে উঠলো।ড্রোনের কথা মুহূর্তেই ভুলে গেল।
কিন্তু সে বুঝতে পারেনি,এই ছোট্ট মনোযোগের ভিন্নতায় কী যেন এড়িয়েছে তার দৃষ্টি থেকে—
ক্লাসরুমের এক কোণে,জানালার ধারে একটানা স্থির হয়ে থাকা ড্রোনটির ভেতর থেকে তাকে কেউ পর্যবেক্ষণ করছিলো…
ফিওনা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে ক্যান্টিনে গেলো। চারপাশের পরিবেশ আজ বেশ স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। সকলে হাসছে,গল্প করছে,খাবার নিচ্ছে— সবকিছু যেন একদম রুটিন মাফিক চলছে।
কিন্তু হঠাৎই ক্যাম্পাসজুড়ে একটা অদ্ভুত উন্মাদনা শুরু হলো।
সারা ইউনিভার্সিটিতে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লো—
“প্রিন্স অরিজিন এসেছে!”
এক মুহূর্তের মধ্যে পুরো ক্যাম্পাসে এক ধরনের আলোড়ন বয়ে গেলো।শিক্ষার্থীরা ক্যান্টিন ছেড়ে দৌড়ে বাইরে যেতে লাগলো,করিডোরে ভিড় জমতে লাগলো।অনেকেই জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো,কেউ বা রিসেপশনের দিকে ছুটলো।
ফিওনা থমকে গেল।
প্রিন্স অরিজিন?
তার মনে হলো এই নামটা সে আগেও শুনেছে,কিন্তু মনে পড়ছেনা।
“কে এই অরিজিন?”ফিওনা পাশের লুকাসকে জিজ্ঞেস করলো।
লুকাস শ্বাস নিলো গভীরভাবে,মুখে এক ধরনের রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে বললো, “তুমি জানো না?সে ভেনাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ড্রাগনদের একজন। কিংবদন্তি ড্রাকোনিসের ছেলে প্রিন্স জ্যাসপার অরিজিন।রাজপরিবারের প্রতীক।অনেকে বলে,তার শক্তি এতটাই ভয়ংকর যে সে যদি সত্যিই রেগে যায়, পুরো এক গ্রহ ধ্বংস করতে পারে।”
ফিওনার কপালে ভাঁজ পড়লো।প্রিন্স জ্যাসপার স্টেলার একাডেমিতে কেন এসেছে?
তারপর এক মুহূর্তের জন্য একটা চিন্তা তার মনে বিদ্যুৎের মতো খেলে গেলো—
“উনি এখানে কেনো আসলেন?”
ঠিক তখনই বাইরে বিশাল এক ছায়া পড়লো।
প্রিন্স অরিজিন এসে গেছে।
ফিওনার শ্বাস দ্রুত হয়ে উঠলো।তার হৃদস্পন্দন এতটাই জোরে ধুকপুক করছে যেন মুহূর্তের জন্য পুরো বিশ্বটাই থমকে গেছে।সে পালাতে চেয়েছিল,কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে এক টানে সে আটকে গেল কঠিন প্রাচীর আর শক্তিশালী শরীরের মাঝে।
গভীর,তীব্র শ্বাস ফেলে জ্যাসপার তার মুখের এতটা কাছে চলে এলো যে ফিওনার ত্বকে তার নিঃশ্বাসের উষ্ণতা ছুঁয়ে যাচ্ছিল। এক হাতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে,অন্য হাতে ফিওনার কব্জি শক্ত করে ধরে রেখেছে,যেন সে নিশ্চিত করতে চায় যে এইবার তাকে ফিওনা আর এড়িয়ে যেতে পারবে না।
ফিওনার বুক ধড়ফড় করছে।
সে জানে,এখান থেকে তাকে পালাতে হবে।
কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে— জ্যাসপার।
ফিওনা অনুভব করলো,তার শরীর জমে গেছে।চারপাশে সব শব্দ যেন হারিয়ে গেছে।ক্যান্টিনের কোলাহল,শিক্ষার্থীদের গুঞ্জন— সব কেমন ধোঁয়াশার মতো দূরে সরে গেছে।
শুধু টের পাচ্ছে বুকের খুব কাছে উষ্ণ এক নিঃশ্বাস।
জ্যাসপার ওকে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরেছে,শক্ত হাতে ফিওনার পথ আটকে রেখেছে।তার একটা হাত ফিওনার মাথার পাশে ঠেসে ধরে আছে,আর অন্য হাত আলতো করে ফিওনার কব্জিতে বাঁধার মতো ধরা।
ফিওনা চোখ বন্ধ করে ফেললো।
কেনো যেন মনে হচ্ছে,আরেকবার ওর চোখের দিকে তাকালে অজ্ঞান হয়ে যাবে।
কিন্তু এইবার…জ্যাসপার সতর্ক।
সে সানগ্লাস পরে এসেছে।
তবে ফিওনা জানে,ওই অন্ধকার কাচের আড়ালে যে চোখদুটো আছে,সেগুলো হয়তো নির্মম,হয়তো আগুনের মতো জ্বলছে,কিংবা হয়তো একেবারে শীতল।
জ্যাসপার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে খুব ধীর স্বরে বললো—
“আমাকে দেখে পালাচ্ছ কেন,হামিংবার্ড?”
ফিওনা গলা শুকিয়ে গেল।সে একটা শব্দও বের করতে পারলো না।
জ্যাসপার আরও ঝুঁকে এলো।এতটাই কাছে যে,তার কেশর সুবাস স্পষ্ট অনুভব করা যায়।
“আমার চোখে তাকাতে ভয় পাচ্ছ?”
ফিওনা শক্ত করে ঠোঁট কামড়ে ধরলো।
কিন্তু তখনই…
জ্যাসপার তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে গা ছমছম করা স্বরে ফিসফিস করে বললো—
“তবে আজ সানগ্লাস আছে… তাকাতে পারো,হামিংবার্ড।”
“তুমি এই ছেলেটির সাথে কেনো?”জ্যাসপারের গলা যেন ভেঙে পড়ছে।তার কণ্ঠে একটি জোরালো আবেগ,যার আঁচ ফিওনার মনে পৌঁছায়।
ফিওনা বিস্ময়ে তার দিকে তাকায়। “তাতে আপনার কি?আপনি আমার কি হন?” সে চ্যালেঞ্জিং গলায় প্রশ্ন করে।
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ থেকে, যেন তার অন্তরের ক্রোধ ও উদ্বেগের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। এরপর,গভীর গলায় বললো,“আমি তোমার জীবন থেকে হারানো রাত্রির তারা,হামিংবার্ড।আমি তোমার হৃদয়ে বসবাসকারী এক অন্ধকারের প্রহরী।তুমি যখন অন্য কারো সাথেও হাসো,তখনও আমি অনুভব করি,সেই হাসির প্রতিধ্বনি আমার হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।তুমি জানো না,এই জগতের প্রতিটি জিনিস আমাকে তোমার দিকে টেনে আনে।
ফিওনা হতবাক হয়ে যায়, তার মনে ঝড়ের মতো অনুভূতি বয়ে যায়। “আমার কিছু মনে নেই,আমি আপনাকে চিনি না!”সে কঠোর গলায় উত্তর দেয়।
জ্যাসপারের কণ্ঠস্বর গম্ভীর হয়ে যায় “কিন্তু তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো,তোমার অজান্তেই,”জ্যাসপারের চোখে একটি ক্রোধের ঝলক।”স্মৃতি মুছে গেলেও আমি তোমার হৃদয়ে সবসময় থাকবো।তুমি মহাবিশ্বের যেখানেই যাওনা কেনো হামিংবার্ড!তবুও আমি তোমার হ্নদয়ের আকাশে নক্ষত্র হয়ে থাকবো চিরকাল।”
ফিওনার হৃদয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগ্রত হয়। জ্যাসপারের কথাগুলি তাকে আঘাত করে, তার অজান্তেই।এই মুহূর্তে, সে বুঝতে পারে যে,তার স্মৃতি না থাকার পরেও, জ্যাসপারের আবেগগুলো তার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে।
ফিওনা ভ্রু কুঁচকালো,তার কণ্ঠে কৌতূহল মেশানো বিরক্তি।
“আপনি আমাকে হামিংবার্ড কেন ডাকছেন?এটা তো পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট পাখি,কিন্তু আমি এখন ড্রাগন।”
জ্যাসপার একটু হেসে এগিয়ে এলো,তার গভীর চোখজোড়া যেন এক বিশাল মহাজাগতিক রহস্য ধারণ করে আছে।
“হামিংবার্ড ছোট,কিন্তু এর রঙিন পালক,এর কোমলতা,আর এর দুরন্তপনা একে অন্যদের থেকে আলাদা করে।এটা দেখতে নাজুক,কিন্তু এর ভেতর এক অদম্য শক্তি আছে।”
তার কণ্ঠস্বর এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো, তারপর গভীরভাবে ফিওনার চোখে চোখ রেখে বললো,
“এই পাখিটা ছোট হলেও অনেক দূর যেতে পারে,তার সীমা শুধু আকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না।যেমন তুমিও একদিন পৃথিবী থেকে আমার জন্য,আমার খোঁজে স্পেসশিপে করে এই দূর ভেনাসে চলে এসেছিলে।”
ফিওনা স্তব্ধ হয়ে গেলো।তার বুকের ভেতর কেমন একটা চাপা অনুভূতি কাজ করলো।
জ্যাসপার একটু ঝুঁকে তার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,”তুমি আমার হামিংবার্ড,পৃথিবীর সেই ছোট পাখির মতো—নাজুক,কোমল কিন্তু তোমার ভেতর এক অদ্ভুত শক্তি আছে,এক দুর্দমনীয় স্পৃহা।তুমি যতই দূরে যাও,যতই পালাতে চাও,আমার মহাবিশ্বের মাধ্যাকর্ষণ তোমাকে টেনে আনবেই হামিংবার্ড।”
ফিওনা চোখ সরিয়ে নিলো,কিন্তু তার হৃদস্পন্দন যেন সত্যিই সেই হামিংবার্ডের মতো দ্রুত হয়ে উঠলো।
তার হৃদয়জুড়ে যেন একধরনের অচেনা অথচ পরিচিত আবেগের ঝড় বইতে শুরু করলো।
জ্যাসপার তখনও তাকে গভীরভাবে দেখছে,তার চোখের সেই অপরিচিত অথচ অপরিহার্য টান ফিওনার সমস্ত অস্তিত্বকে ঘিরে ধরছে।
“আপনি আমার কি হন,আমি আপাকে চিনি না?”
ফিওনার নিজের প্রশ্নটাই যেন ফিরে আসছে তার দিকে,কিন্তু এবার অন্যভাবে।
ফিওনা ভাবলো সে কি সত্যিই জানে না জ্যাসপার তার কি হয়?নাকি নিজের অনুভূতিগুলোকে অস্বীকার করার জন্যই এমন বলছে?
জ্যাসপার একধাপ এগিয়ে এলো।বাতাসে তার সুবাস ছড়িয়ে পড়লো,একধরনের অগ্নিমাখা শীতলতা,যা একসাথে ভয়ংকর এবং মায়াময়।
“তোমার কিছু মনে নেই,তাতে কিছু যায় আসে না, হামিংবার্ড,”জ্যাসপার গভীর গলায় বললো।“কিন্তু আমি জানি,আমি কী ছিলাম,এবং আমি কী আছি।তুমি যতবার আমাকে ভুলে যাবে,,আমি ঠিক ততবার তোমার সামনে এসে দাঁড়াবো— যতবার প্রয়োজন,ততবার।”
ফিওনার গলা শুকিয়ে গেল।
তার মনে হচ্ছে,সে যেন এক অতল সমুদ্রে পড়ে গেছে, যেখানে স্মৃতি নেই,অথচ অনুভূতি আছে।
লুকাস তখনো কিছু দূরে দাঁড়িয়ে,কিন্তু এখন যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে ফিওনার দৃষ্টির জন্য।
এখন মাত্র জ্যাসপার আছে চোখের সামনে।
ফিওনা কঠিন কণ্ঠে বললো, “আপনি কিছুই জানেন না।”
জ্যাসপার একটু ঝুঁকে এলো,তার চোখের গাঢ় দৃষ্টি ফিওনাকে আবদ্ধ করে ফেললো যেন।
“আমি জানি, হামিংবার্ড।তোমার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে আমি আছি।”
ফিওনার হৃদপিণ্ড তখনও অস্বীকার করছে,কিন্তু তার ভেতরের কোনো এক অংশ…সে যেন জানে, জ্যাসপার মিথ্যা বলছে না।
ফিওনা তখন বললো, “আমাকে যেতে দিন,ক্যাম্পাসের কেউ দেখে ফেলবে।”
জ্যাসপার নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,”দেখুক,আমার তাতে কিছু যায় আসে না।”
ফিওনা বিরক্ত হয়ে বললো,”আপনি এসেছেন,আর পুরো ভার্সিটি গুঞ্জন শুরু করে দিয়েছে।যদি কেউ এভাবে দেখে তাহলে কী হবে?”
জ্যাসপার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,”হ্যাঁ,আমি এই ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলাম।আমার ওপর সবাই ক্রাশ খেতো।মাঝে মাঝে প্রোগ্রামে আসি,তখনও মেয়েরা এমনটাই করে।”
ফিওনা হতভম্ব হয়ে গেল।
“আপনি… এই ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলেন?”
জ্যাসপার একটু বাঁকা হাসলো, যেন ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক।
“হ্যাঁ,আমি এই ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলাম।আমার ওপর সবাই ক্রাশ খেতো,এখনো খায়।মাঝে মাঝে প্রোগ্রামে আসলে মেয়েরা এভাবেই প্রতিক্রিয়া দেখায়।”
তার কথার ভঙ্গিতে এমন একটা আত্মবিশ্বাস ছিল,যা ফিওনাকে একধরনের রাগ আর বিরক্তির মিশ্র অনুভূতি এনে দিলো।
ফিওনা এক ঝলক তাকালো জ্যাসপারের ঠোঁটের দিকে—আসলেই অদ্ভুত!সবার থেকে আলাদা,ঠোঁটজোড়া যেন রক্তিম বেগুনি ছায়ায় মোড়ানো।অজান্তেই তার মনে এলো, “ভাগ্যিস চোখে সানগ্লাস!যদি ওই চোখ দেখতে পেতাম, তাহলে কি হতো?”
জ্যাসপার একদৃষ্টিতে ফিওনার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছিল। ফিওনা দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিলো,কিন্তু মনে মনে স্বীকার করলো, “এই প্রিন্সটা…কোয়াইট হ্যান্ডসাম।ড্যাশিং।”
জ্যাসপার ঠোঁটের কোণে একপ্রকার আত্মবিশ্বাসী হাসি ফুটিয়ে বললো,”তুমি কি কিছু ভাবছিলে হামিংবার্ড?”
ফিওনা দ্রুত বললো,”একদম না!” তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালো,কিন্তু মনে হলো,জ্যাসপারের চোখ না দেখেও সে তার নজরের ওজন অনুভব করতে পারছে।
জ্যাসপার ঠোঁটের কোণে এক দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বললো, “আজ কি একটু বেশি হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে আমাকে, হামিংবার্ড?”
ফিওনা এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো। কী জবাব দেবে বুঝতে পারলো না। তার হৃদয় যেন একটু দ্রুত চলতে লাগলো।
ফিওনা কঠিন গলায় বললো,”আপনি তো অ্যালিসা,আমার বোন,তাকে বিয়ে করছেন,তাহলে?”
জ্যাসপার এক মুহূর্ত চুপ করে ফিওনার চোখে গভীরভাবে তাকালো,তারপর ধীরে ধীরে বললো,”তুমি একবার বলো, হামিংবার্ড…একবার শুধু বলো যে তুমি আমাকে বিয়ে করবে, তাহলে সবার সামনেই অ্যালিসার সঙ্গে বিয়ের কথা আমি না করে দেবো।”
ফিওনার হৃদয় মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠলো,কিন্তু সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,”আপনি যা খুশি করুন, আমার কিছু যায় আসে না।”
জ্যাসপার ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে বললো, “তুমি কি সত্যিই তাই মনে করো?”
কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিলো, দ্রুত পেছনে ঘুরে বললো, “আমার কাছে আর আসবেন না প্লিজ।”
তারপর আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না—দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করলো, যেন পালিয়ে বাঁচলো।
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা জ্যাসপার তার প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করলো,ঠোঁটের কোণে সেই দুষ্টু হাসিটা আরও গভীর হলো। “তুমি যতই পালাও,হামিংবার্ড,আমি ঠিক তোমার কাছেই চলে আসবো,” নিজের মনে বললো সে।
জ্যাসপার দৃপ্ত পায়ে স্টেলার একাডেমির প্রিন্সিপালের চেম্বারে প্রবেশ করলো।কাচের জানালা দিয়ে দূরের গ্রহরাজি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল,আর সামনে বসে ছিলেন গম্ভীর মুখের প্রিন্সিপাল,যিনি এক নজরে জ্যাসপারকে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“আপনার আসার কারণ প্রিন্স?”
জ্যাসপার নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ার টেনে বসল।তার চোখে ছিল এক ধরনের জেদ,যা ভেনাসের কোনো যুক্তিতেই দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
“এলিসন ফিওনা,”সে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললো, “ওকে আলাদাভাবে সবার চেয়ে ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দিবেন।ও আমার গার্লফ্রেন্ড ওর যেনো কোনোকিছুতে কোনপ্রকার অসুবিধা না হয়।”
প্রিন্সিপাল ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,যেন তার সামনে বসে থাকা এল্ড্র রাজ্যের প্রিন্স যা সমগ্র ভেনাসের প্রিন্স তার মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করছেন।কিন্তু জ্যাসপার তার কোনো ব্যাখ্যার অপেক্ষা না করেই উঠে দাঁড়ালো,তার কালো কোটের প্রান্ত বাতাসে দুলে উঠলো।
“আমি যা বলেছি,সেটা মনে রাখবেন।”
তারপর কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিকতার তোয়াক্কা না করেই সে বেরিয়ে গেলো।
প্রসিদ্ধ মার্বেলের করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে জ্যাসপারের সামনে এসে দাঁড়ালো এথিরিয়ন।তার চোখে ছিল কৌতূহল, ঠোঁটে হালকা বিদ্রূপের ছাপ।
“কি ব্যাপার?”এথিরিয়ন নির্লিপ্ত গলায় বললো,”একদম রাজকীয় আদেশ দিয়ে বেরিয়ে আসলে মনে হলো?”
জ্যাসপার থমকে দাঁড়ালো,তারপর এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,”তোর ভাবির দিকে একটু নজর রাখবি।”
এথিরিয়ন চোখ গোল করলো,কিন্তু কিছু বলার আগেই জ্যাসপার কটাক্ষপূর্ণ হাসিতে যোগ করলো,”ওই লুকাসের সাথে যেন বেশি কথা না বলে।কিন্তু হ্যাঁ,নজর রাখতে বলেছি মানে এই না যে খুব বেশি নজর দিবি।আমার প্রেয়সীর দিকে তোর চোখ বেশি গেলে আমি কিন্তু একটুও পছন্দ করবো না।”
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৬
তার কথার গাম্ভীর্য আর হালকা হুমকির সুরে এথিরিয়নের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।সে জানে,জ্যাসপার কখনো নিজের জিনিসের ওপর দাবি ছাড়তে শেখেনি,আর ফিওনার ক্ষেত্রে সেটা যেন আরও প্রবল।
জ্যাসপার কোনো উত্তর না দিয়েই আবার হাঁটা ধরলো,তার লম্বা ছায়া স্টেলার একাডেমির রূপালি করিডোরে মিলিয়ে গেলো।এথিরিয়ন এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে হাসলো।