আয়ুর প্রহর পর্ব ২১

আয়ুর প্রহর পর্ব ২১
তুশিতা নুর তৃষ্ণা

“ নিজের বাবাকে এভাবে রেখে কষ্ট হবে না তোমার আয়ুশ বাবা?”
শামসুজ্জামানের উক্ত কথা শুনে আয়ুশ দাঁড়িয়ে পড়লো।কতোদিন পর তার বাবা তাকে বাবা বলে ডাক দিয়েছে।রক্তের টান আয়ুশের শিরায় শিরায় বয়ে গেল।সে পিছনে তাকালো। শামসুজ্জামানের মুখের হাসি প্রসারিত হলো। আয়ুশ শামসুজ্জামানের কাছে যাবে কী না তা ভাবতে লাগলো। মুহুর্তেই মত চুড়ান্ত করে সে শামসুজ্জামানের লকাবের দিকে দ্রুত পায়ে এগুতে লাগলো!

শামসুজ্জামান লকাবের গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।আয়ুশ শামসুজ্জামানের ঠিক কাছটায় গিয়ে শক্ত গলায় বলে,
“ আপনার মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতেও আমার ঘৃণা করে মিস্টার শামসুজ্জামান।আপনি আমার বাবা নন। সম্পর্কের দিক দিয়ে আমার বাবা হলেও আমি আপনাকে আমার বাবা বলে স্বীকার করতেও লজ্জা হয় আমার!
বিশ্বাস করুন,যে হাত দিয়ে আপনি আমার মায়ের গলা চে’পে ধরেছিলেন,ওই হাতটা আমার জাস্ট কে’টে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু করবো না শুধুমাত্র সম্পর্কের জন্য।আমি অস্বীকার করলেও আপনি আমার জন্মদাতা এ কথা পাল্টে যাবে না। শুধুমাত্র ওইজন্য আমি আপনাকে কিছু করিনি।আমার নিজের প্রতি ঘৃণা হয় এই ভেবে যে আমার শরীরে আপনার রক্ত বইছে।আপনাকে আমি শুধু ধিক্কার জানাই।ধিক্কার আপনাকে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিন্তু সেইসাথে আপনাকে ধন্যবাদ ও।কেননা,আপনি আমাকে আপনার থেকে দূরে দূরে রাখলেও মা চলে যাওয়ার পর আপনি আমার খরচ বহন করতেন।যদিও মা হারা সন্তানের যত্ন রাখার বিষয়টা আপনার মাথায় কখনো আসেনি। তবুও আমাকে দেওয়া খরচের জন্য আপনাকে আবারো অসংখ্য ধন্যবাদ।
আর একটা কথা।এইবার আপনার ক্ষমতা আর টাকা দিয়ে কিচ্ছু করতে পারবেন না।আমি আইনের লোক। সমস্ত নিউজ চ্যানেলে আপনার শ্যুট করা,আপনার স্ত্রীর সবকিছু স্বীকার করার ক্লিপ সমস্ত বড় বড় নিউজ চ্যানেলে পাঠিয়ে দিয়েছি। ইতিমধ্যেই প্রায় সবগুলো নিউজ চ্যানেলেই সম্প্রচার করা হয়ে গিয়েছে।এবার আর পাবেন না আপনি।
আর কখনো আমাকে ডাকবেন না।দরকার হলে আমিই আসবো।চলি।”
আয়ুশ চলে যেতে লাগলো।পুনরায় শামসুজ্জামান পিছন থেকে ডাকলেন,

“ আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাও প্লিজ।”
আয়ু্শ ঈষৎ হেসে পিছু ফিরে গাইতে লাগলো,
“ তুমি হাকিম হইয়া হুকুম করো,
পুলিশ হইয়া ধরো!
স্বর্প হইয়া দংশন করো,
ওঝা হইয়া ঝাড়ো!”

থানা থেকে বাড়ি ফিরলো আয়ুশ।কলিংবেল বাজালো।প্রহর যেন আয়ুশের অপেক্ষায় ছিল।সে দৌড়ে এসে দরজা খুললো।
আয়ুশ বাসার ভিতরে ঢুকে সোফায় বসে পড়লো।প্রহর সাথে সাথে জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে আয়ু্শের সামনে দিলো।আয়ুশকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে।
সত্যিই আয়ুশ খুব ক্লান্ত ছিল।ঢকঢক করে পুরো এক গ্লাস পানি শেষ করে প্রহরকে জিজ্ঞেস করলো,

-—“ প্রণয় আর প্রেমা কোথায়?”
-—“ ভাইয়া বাইরে গিয়েছে। কিছু বাজার নিয়ে আসবে বললো।আর প্রেমা একটু আগেই গোসল করতে গেলো।”
-—“ আচ্ছা!” বলে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে রইলো আয়ুশ।
-—“ কিছু হয়েছে আপনার?শরীর খারাপ লাগছে?” আয়ুশের চোখ বুজে আছে দেখে জিজ্ঞেস করলো প্রহর।
চোখ খুলে ঈষৎ হেসে আয়ুশ উত্তর দিলো-—“ কিছু হয়নি।”
-—“ যে কাজ করতে গিয়েছিলেন,তা সম্পূর্ণ হয়েছে?”
আয়ুশের পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো প্রহর।
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে খানিকক্ষণ প্রহরের দিকে তাকিয়ে রইলো আয়ুশ।
হঠাৎই বাচ্চাদের মতো দুহাত মুখে চেপে কেঁদে উঠলো আয়ুশ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।
আকস্মিকভাবে এমন ঘটনার দরুন প্রহর অবাক না হয়ে পারলো না।আয়ুশের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,

“ কি হয়েছে আপনার?এভাবে কাঁদছেন কেন?এভাবে কাঁদবেন না প্লিজ।”
আচমকাই আয়ুশ প্রহরের কাঁধে নিজের মাথা রাখলো।কান্না করতে করতেই বলতে লাগলো,
“ আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে প্রহর খুব।যে মা আমার ছোট ছোট হাত নিয়ে খেলা করতো।আমায় খাইয়ে দিতো।আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিতো।আমার আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।
জানো প্রহর,আমার মাকে যখন মা’রা হয়েছিল তখন আমার কতো কষ্ট হয়েছিল।ছয় বছরের ছিলাম আমি। তবুও কাউকে কিচ্ছুটি বলতে পারিনি।তবে ওইসময় মনে মনে শপথ করেছিলাম,যখন বড় হবো আমার মায়ের মৃত্যু’র প্রতিশোধ আমি নিবো।আজকে আমার মাকে আমার খুব মনে পড়ছে প্রহর।খুব।”
আয়ুশের কথা শুনে প্রহর চমকে উঠলো।তবে এতটুকু বুঝলো,আয়ুশের মাকে খু’ন করা হয়েছিল।তবে এখন আয়ুশ কে ঘাটতে গেলো না আয়ুশ।এ বিষয়ে সে পরেও শুনতে পারবে।আপাতত আয়ুশকে শান্ত করতে হবে।
তাই সে আয়ুশকে বললো,

“ তো আপনি এভাবে কাঁদছেন কেন?এভাবে কাঁদলে মায়ের আত্না কষ্ট পাবে।মৃত ব্যাক্তিদের জন্য কাঁদতে হয়,তবে নিঃশব্দে।এভাবে জোরে জোরে কাঁদবেন না হুম?তবে আমি আপনাকে কাঁদতে মানা করবো না।আপনি যত ইচ্ছে কাঁদুন।নিঃশব্দে কেঁদে মনকে হালকা করুন। কাঁদুন!”
প্রহরের প্রশ্রয় পেয়ে আয়ুশ প্রহরের কাঁধে মাথা রেখে আবারো কাঁদতে লাগলো। প্রহর আয়ুশের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আয়ুশের চোখ থেকে প্রতিটি অশ্রুকণা নির্গত হওয়ার পর সে যেমন ফুঁপিয়ে উঠছে,তার সে নিঃশ্বাসের প্রতিটি শ্বাস যেন প্রহরকেও কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
এভাবে অনেক সময় যাওয়ার পর প্রহর খেয়াল করলো, আয়ু্শের নিঃশ্বাস সে আগের মতো শুনতে পারছে না।তখনি সে আয়ুশ কে দেখতে নিজের মাথা একটু নোয়ালো।মাথা নুয়িয়ে দেখতে পেলো ,আয়ুশ ঘুমিয়ে পড়েছে।
প্রহর নিজেও কান্না করলে ঘুমিয়ে পড়ে।আজকে আয়ুশ ঘুমিয়ে পড়েছে।এটা দেখে একটা নিঃশ্বাস ফেলে প্রহর মুচকি হাসলো।তার আয়ুর সাথে তার কতো মিল!হিহি
আয়ুশের মাথা তার কাঁধে,আয়ুশ তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে! বিষয়টা প্রহরের বেশ লাগছে।খুব উপভোগ করছে সে পরিবেশটাকে।

কিন্তু একটু পরই খেয়াল হলো,এভাবে এক সাইডে মাথা কাত করে রেখে ঘুমোলে পরবর্তীতে আয়ুশের মাথার এই সাইডে ব্যাথা হতে পারে। কিন্তু এখন তো আয়ুশ কে কোলে করে বেডরুমেও নিয়ে যেতে পারবে না সে।আয়ুশের বলিষ্ঠ দেহের তুলনায় প্রহর চুনোপুঁটি।আবার আয়ুশ কে এখন জাগিয়ে দিতেও খারাপ লাগবে তার।তাই একটু চিন্তা করে সে সিদ্ধান্ত নিল,আয়ুশের মাথা আলতো করে নুয়িয়ে তার কোলে তার আয়ুর মাথা রাখবে।সে অনুযায়ীই প্রহর আয়ুশের মাথা নিজের কোলে রাখলো।তারপর আয়ুশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
আয়ুশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই সে খেয়াল করলো,আয়ুশের কপালে কিছু একটা লেগে আছে।একটু নিচু হয়ে যখনই সে সেটা মুছে দিলো,তখনি আয়ুশের চোখ খুলে গেল।প্রহর ভয় পেয়ে নিজের বুকে থু থু দিলো।প্রহরের এমন কান্ডে আয়ুশ হু হু করে হেসে ফেললো।প্রহর আয়ুশের দিকে তাকিয়ে রইলো।কি প্রশান্ত লাগছে লোকটাকে!
আয়ুশ প্রহরকে জিজ্ঞেস করলো,

-—“ এমনভাবে আমার দিকে ঝুঁকে কি করছিলে প্রহর?”
-—“ এ…আপনার কপালে কি একটা লেগে…
-— “ থামো,থামো।আমি বুঝেছি তুমি কি করতে গিয়েছিলে!”
-—“ কি করতে গিয়েছিলাম?” বোকার মতো প্রশ্ন করলো প্রহর!
-—“ তুমি আমার কপালে পাপ্পি দিতে গিয়েছিলে!” দুষ্টু হেসে বললো আয়ুশ!
আয়ুশের কথা শুনে প্রহরের কপালে ভাঁজ পড়লো।পরক্ষণেই পাপ্পি শব্দটার মানে বুঝে তার দু গালে লাল আভা ছড়িয়ে পড়লো।সে আমতা আমতা করে বললো,
-—“ না।এমন কিছু করার উদ্দেশ্যে ছিল না। সত্যিই আপনার কপালে কি একটা লেগে ছিল..তাই..
-—“ থামুন ম্যাডাম!আর কিছু বলতে হবে না আপনাকে।আমি বুঝেছি…” এবারও প্রহরের কথার মাঝখানেই তাকে থামিয়ে দিলো আয়ুশ।

-—“ কি বুঝেছেন?” জিজ্ঞাসু চোখে আয়ুশকে জিজ্ঞেস করলো প্রহর।”
প্রহরের কোলে মাথা রেখেই আয়ুশ প্রহরের নাকের ডগা আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
-— এইটাই যে…….আমার ম্যাডাম মানে আপনি অনেক বোকা!”
-—“ আমি বোকা?” বলেই আয়ুশের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো প্রহর।পরক্ষণেই নিজের বোকা প্রশ্ন বুঝতে পেরে লজ্জা পেল সে।
বারবার প্রহরের লাজরাঙা মুখ দেখে আয়ুশের মনেও ভালোলাগার পরশ বয়ে গেল।তাহলে কী সত্যিই প্রেমে পড়েছে সে?
“এই মেয়েটা আমায় সত্যিই তার মায়ায় ফেলে দিয়েছে।এখান থেকে নিস্তার পাবো কি করে?”
আনমনে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করলো আয়ুশ।
পরক্ষণেই নিজের মনকে ধমকি দিয়ে নিজেই প্রত্যুত্তর করলো সে,
“ একবার যখন তার মায়ায় পড়েছি,তখন আর এখান থেকে কোথাও যেতে চাই না।এখানেই থাকতে চাই আজীবন,চির জনম।”

আয়ুর প্রহর পর্ব ২০

মনে মনে এতটুকু কথা বলে একা একাই হেসে ফেললো আয়ুশ।
প্রহর অবাক দৃষ্টে আয়ুশের দিকে তাকালো।লোকটা আবার হাসছে!কি মনোমুগ্ধকর সেই হাসি!
গোসল থেকে বের হয়ে দূর থেকে প্রেমা তার প্রহু ও দুলাব্রোর মিষ্টি কথোপকথনের খানিকটা শুনতে পেলো।শুনে দূর থেকেই মুচকি হাসলো।তার বোনজামাইটা খুব ভালো মানুষ।তার প্রহুকে খুব ভালো রাখবে।খুশিতে রাখবে।আর তার প্রহুর খুশিই তো তার খুশি।মনে মনে স্রষ্টার কাছে নিজের বোনের সুখময় জীবনের প্রার্থনা করলো সে।ভালো থাকুক তার বোন!কখনো নজর না লাগুক তার বোনের সংসারে।এরপরই নিজের রুমে চলে গেলো সে।তাদের ব্যাক্তিগত সময়ে কাবাব মে হাড্ডি হতে চায় না প্রেমা!

আয়ুর প্রহর পর্ব ২২