আলোর ভীড়ে পর্ব ১১
ইশরাত জাহান অধরা
প্রায় কয়েকবার নক করলেও কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা টর্চ লাইট বের করে বাড়ির দিকে আলো ফেলতেই দেখল চারদিকে ময়লা।এই বাসায় কেও কি থাকে?থাকলে এমন ময়লা কেন?বাড়ির ভেতর ঢুকে কিছু পা এগিয়ে যেতেই দেখল সামনের রুমে আলো জ্বলছে।খুশি হলো ও।তারমানে অই রুমেই মানুষ আছে।ভেবেই অই রুমের সামনে এগিয়ে গেলো।রুমের দরজার সামনে গিয়ে রুমের ভেতর তাকাতেই দেখল ঘরের ভেতর কয়েকটা ছেলে মিলে কার্ড(জুয়া) খেলছে।
একটু ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝল ছেলেগুলা আর কেও না অইদিনের বাস স্ট্যান্ডের ছেলেগুলা।প্রিয়তার পিঠের মেরুদন্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেলো।পরল তো পরল এই ছেলেগুলার সামনেই পরা লাগলো ওর?নাহ এখানে বেশিক্ষন থাকা যাবে না।থাকলেই ওরা যদি দেখে ফেলে তাহলে সব শেষ। নিজেকে কিছুতেই বাঁচাতে পারবে না ওদের হাত থেকে।একটা শ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে পা ফেলে বাইরে যেতে লাগল।হঠাত একটা কুকুর এসে ওকে দেখেই জোরে ঘেউ ঘেউ করা শুরু করলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রিয়তার কলিজা কেঁপে উঠলো।ও কুকুরটাকে ইশারায় হাত দিয়ে থামতে বলল।কিন্তু ঘরের ভেতরে এমন অচেনা একটা মেয়েকে দেখে কুকুরটা যেন আরও চিৎকার করতে লাগলো। ও যখনই কোন কাজ সাবধানে করতে যায় তখনই কোন কোন ঝামেলা করে বসে।যেমন আজকেরটাই।আসার সময় কিছু হলো না।অথচ যখনই সে সাবধানে ধীরে ঘর থেকে বেরুতে চাইছিলো তখনই এই ঘটনা ঘটলো?আর কোন উপায় না পেয়ে হাতে থাকা টর্চ লাইটা প্রিয়তা সামনেে ডানপাশে ছুড়ে মারল।
কুকুরটাও সেই টর্চলাইটের কাছে গিয়ে মুখে নিয়ে কাঁমড়াতে লাগল।প্রিয়তা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।কুকুরটা যেভাবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল এটাকে কোনমতেই সরানো যেতো না।সুযোগ বুঝে সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসলো সে।
ভেতরে থাকা ছেলেগুলা মাঝখানে টেবিল পেতে তার মধ্যে জুয়া খেলছিলো।হঠাত রুমের বাইরে থেকে হঠাত কুকুরের চিল্লানো শুনতে পেয়ে সবাই দরজার দিকে তাকালো।
“কিরে কুকুরটা এমনে চিল্লাতাছে কেন?”
“ও তো এমনে এমনে চিল্লায় না।চলতো গিয়ে দেখি!”
রুম থেকে বের হয়ে চোখ বুলাতেই ওদের নজরে পরল কুকুরটার দিকে।
“এই টর্চ লাইট আসলো কোথা থেকে?”
“কেও নিশ্চয়ই এসেছিলো।”
প্রিয়তা দৌড়ে একটা গলির ভেতর লুকিয়ে পরলো।জোরে জোরে কিছুক্ষন শ্বাস নিয়ে ভাবল যাক বেঁচে গেছে সে।এখন ওরা আর ওকে ধরতে পারবে না।কিন্তু ও বাসায় যাবে কি করে?কি করে ও এখান থেকে বের হবে?হাতে থাকা ঘড়িতে টাইম দেখল।দেখল ১২ টা ১০ মিনিট!এমনেই এই রাস্তায় কেও নেই৷ এই টাইমে তো আরও থাকবে না।ইশ কি ভুলটাই না করে ফেলল সে!আফসোস হচ্ছে এখন।পেটের ভিতর ইদুরেরা দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে অলরেডি। দুপুরে লাঞ্চের সময় যে খেয়েছিলো এরপর পেটে একটা দানাও পরে নাই।কিন্তু কি করার?এভাবেই থাকা লাগবে।বসা থেকে উঠে উঁকি দিয়ে দেখল ছেলেগুলা আছে নাকি।পুরো রাস্তা খালি দেখে উঠে দাঁড়ালো।এখানে তো আর বসে থাকা যায় না।গলি থেকে বের হয়ে কিছুদুর হাঁটতেই পিছন থেকে কেও একজন বলে উঠল,
“আমাদের আস্তানায় এসে লুকিয়ে চলে যাওয়া হচ্ছে?ভেবেছো তোমাকে ধরতে পারব না?”
আচমকা এমন কথা শুনে কলিজা কেঁপে উঠলো প্রিয়তার।ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকাতেই ছেলেগুলাকে দেখতে পেলো।ওর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।এখন ও কি করা উচিত সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না।কোনমতে ঠোটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“ভালো আছেন ভাইয়া!আসলে আমি এখানে একটা কাজে এসেছিলাম।ভুলবশত আপনাদের বাড়িতে ঢুকে গিয়েছি।কিছু মনে করবেন না।আমি কাওকে কিছু বলব না যে আপনারা জুয়া খেলছিলেন।আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন।তাহলে আসি কেমন?ভালো থাকবেন!”
বলে চলে নিতেই একজন এসে সামনে দাঁড়ালো প্রিয়তার।ছেলেটা কিছুক্ষন প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই মেয়েটাকে আমার কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।তোদের লাগছে না?”
এরমধ্যে একটা ছেলে বলল,
“হ্যা আমার তো ফাস্ট থেকেই চেনা চেনা লাগছিলো।কোথায় যেন দেখেছি একে বারবার এই কথা মনে হচ্ছে মেয়েটাকে দেখার পর!”
“আরে এই মেয়ে অইদিনের বাসস্ট্যান্ডের মেয়েটা না যে আমাদের থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো।”
কথাটা শুনতেই প্রিয়তা শুকনো ঢোক গিলল।ছেলেগুলা ওকে শেষপর্যন্ত চিনে ফেলল!নিজেকে নিজের কাছে এই প্রথম অসহায় মনে হচ্ছে!মনে হচ্ছে ও নিজেকে কিছুুতেই বাঁচাতে পারবে না!আজকে সব শেষ!নিজেকে নিজে থাঁপড়াতে মন চাচ্ছে।কি করে এত বড় ভুল করে বসল সে?এখন কেও ওকে সাহায্য করতে আসবেনা।মানুষ থাকলেই না সাহায্য করবে!কেওই তো নেই!ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।সামনে তাকাতেই দেখল ছেলেগুলা হেসে ওর দিকে এগিয়ে আসছে।প্রিয়তা পিছাতে লাগল।একটা ছেলে এসে সরাসরি ওর হাত ধরে ফেলল। হাত ধরে বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে বলল,
“চলো মামনি আমাদের আস্তানায় চলো।এত রাতে মেয়ে হয়ে বাইরে থাকা ঠিক না!”
প্রিয়তার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পরেছে।ছেলেটা ওর হাত ধরে টান দিতেই প্রিয়তা আরেক হাতে থাকা ব্যাগ দিয়ে সজোরে ছেলেটার মুখের উপর বারি মারলো।ছেলেটা প্রিয়তার হাত ছেড়ে ব্যথা পেয়ে মুখ চেপে ধরলো।এই সুযোগেই প্রিয়তা দৌড়াতে লাগলো।নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে দৌড়াতে লাগলো।ছেলেগুলাও প্রিয়তার পিছে দৌড়াতে শুরু করলো।
ইনাম গাড়ি চালিয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছিলো।আর দোয়া করছিলো যেন প্রিয়তার কিছু না হয়।
হঠাত ওর নজরে আসল রাস্তার অপর পাশে। একটা মেয়ে দৌড়াছে।একটু ভালো করে খেয়াল করতেই দেখল মেয়েটা আর কেও নয় প্রিয়তা।কিন্তু ও এভাবে দৌড়াচ্ছে কেন?ওর পিছনে দৌড়াতে থাকা ছেলেগুলাকে দেখে বুঝার বাকি রইল না প্রিয়তার দৌড়ানোর কারন।তাড়াতাড়ি গাড়ি এক পাশে সাইড করে গাড়ি থেকে নেমে পরলো ইনাম।প্রিয়তার দিকে যেতে লাগলো।প্রিয়তা এখন দৌড়াতে দৌড়াতে একটা নদীর কাছে এসে পরেছে।এখন ওর আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।ছেলেগুলা এর মধ্যেই প্রিয়তার কাছে এসে পরেছে প্রায়।প্রিয়তার অবস্তা দেখে একটা ছেলে বলল,
“অনেক নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছিস!এখন চুপচাপ আমাদের সাথে চল নইলে খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম।”
প্রিয়তা পিছাতে লাগলো।আর ছেলেগুলা এক পা এক পা করে এগুতে লাগলো।এরমধ্যে একটা ছেলে এসে আবার প্রিয়তার হাত ধরে টানতে লাগলো।প্রিয়তাও হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।এভাবে টানাটানির মধ্যেই পুলিশের গাড়ির শব্দ পেয়ে ছেলেটা প্রিয়তার হাত ছেড়ে দিলো।ফলস্বরূপ প্রিয়তার নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রন না থাকায় সোজা নদীতে গিয়ে পরলো।পুলিশ এসে ছেলেগুলাকে এরেস্ট করতেই ইনাম দৌড়িয়ে আসলো।ও শুনেছে পানিতে কিছু পরার শব্দ!কি পরল?প্রিয়তা?
প্রিয়তা পানিতে কিছু পরার শব্দে মনে করল অই ছেলেগুলা বুঝি পানিতেও ঝাঁপ দিয়েছে ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলো প্রায়।চোখ একটু আধা খুলতেই পরিচিত মানুষের মুখ ভেসে উঠল।কে? ইনাম?ইনাম ওর জন্য পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে!উনি এখানে কি করে আসল?জানলই বা কিভাবে সে যে এখানে?আর কিছু ভাবার আগেই ইনাম প্রিয়তার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসল।এক হাতে জড়িয়ে সাতরিয়ে নদীর কিনারায় এসে পৌছালো।প্রিয়তা বসে আছে।সামনেই ইনাম তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে।
“ঠিক আছো তুমি?কিছু হয় নি তো?ব্যাথা পেয়েছো?”
প্রিয়তার কান্না আসছে।ইনাম না আসলে কি হতো?ও কি মারা যেতো?নাকি অই ছেলেগুলা ওর ক্ষতি করে ফেলতো?ভাবতেই আরও কান্না পাচ্ছে।প্রিয়তাকে কোন কথা বলতে দেখে ইনাম বলল,
“কি হলো কিছু বলছোনা কেন?”
প্রিয়তা নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না।ঝাপটে ধরল ইনামকে।প্রথমে ইনাম অবাক হলেও পরে নিজেকে সামলে নিলো।নিশ্চয়ই মেয়েটা ভয়ে পেয়েছে অনেক!ইনাম কাঁপা কাঁপা হাতে প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কোন ভয় নেই।সব ঠিক হয়ে গেছে।আমি এসে পরেছি।”
প্রিয়তা কেঁদে দিলো।প্রিয়তাকে হঠাত এভাবে কাঁদতে দেখে ভ্রু কুচকালো ইনাম।প্রিয়তা এই ফাস্ট কাঁদছে!ওকে এর আগে কাঁদতে দেখেনি ইনাম।
“আরে বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন?”
“আপনি ঠিক সময় না এলে কি হতো?”
“এসে পরেছি তো!মাথা থেকে সবকিছু বের করে দাও।কিচ্ছু মনে রাখার দরকার নেই।আর আমি দুঃখিত আমার কারনে তোমাকে এই সিচুয়েশনে পরতে হয়েছে।”
প্রিয়তা কান্না থেমে গেল ইনানের কথা শুনে।ইনামের থেকে সরে এসে বলল,
“আপনি সরি বলছেন কেন?”
ইনাম মাথা নিচু করে বলল,
“আমি যদি অইসময় তোমাকে আটকাতাম তাহলে এমনটা হতো না!এত বড় বিপদের মধ্যে তুমি পরতে না!”
‘এতে আপনার কোন দোষ নেই।সব আমার দোষ।নিজেকে অপরাধী ভাববেন না।উল্টো আপনি এসে আমাকে বাঁচিয়েছেন!আমার আপনাকে উচিত ধন্যবাদ দেওয়া।”
“গাড়ি একটু দুরে রাখা আছে।হাঁটতে পারবে?”
“হুম!”
আলোর ভীড়ে পর্ব ১০
“তাহলে চলো!”
ইনাম উঠে ডান হাত বারিয়ে দিয়ে বলল,
“হাত ধরে উঠো!”
প্রিয়তা থমকে গেলো ইনামের কথা শুনে।ইনাম যে নিজ থেকে ওর হাত ধরতে বলবে সেটা কল্পনাও করে নাই প্রিয়তাকে উঠতে না দেখে ইনাম নিজেই প্রিয়তার হাত ধরে টেনে উঠালো।
“যত দ্রুত সম্ভব বাসায় যেতে হবে।এই ভেজা কাপড়ে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার!তাড়াতাড়ি চলো!”