আলোর ভীড়ে পর্ব ১৫
ইশরাত জাহান অধরা
“কিরে এখানে কি করছিস?চল! আম্মুর অপারেশন শুরু হয়ে যাবে।”
ইরার কথা শুনে হকচকিয়ে উঠলো প্রিয়তা।নিজেকে সামলিয়ে বলল,
“হুম চল।”
প্রিয়তা চেয়ারে বসে আছে।পাশেই ইরা বসে আছে।প্রিয়তার মাথায় শুধু ইনামের বিষয়টাই ঘুরঘুর করছে।উনি কি অসুস্থ? নইলে হাসপাতালে কেন আসবে?কিন্তু উনাকে দেখে তো আমার অসুস্থ মনে হয় নি!নাহ আর বসে থাকতে পারছেনা সে।যতক্ষন না ওর মনের কনফিউশান দুর হবে ততক্ষন ও স্থির হয়ে শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারবে না।ভাবতে ভাবতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো প্রিয়তা।প্রিয়তাকে এভাবে হঠাত উঠতে দেখে ইরা অবাক হয়ে বলল,
“কোন সমস্যা?এভাবে উঠে পরলি যে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রিয়তা আমতা আমতা করতে বলল,
“আমার না একটু কাজ আছে।আমি একটা জিনিস আমাকে জানতে হবে। আমি গেলাম।”
“কিন্তু….”
ইরাকে বাধা দিয়ে যেতে যেতে বলল,
“পরে আমি ফোন করে আন্টির খবর জেনে নিব।আমি গেলাম।কিছু মনে করিস না প্লিজ!”
কে জানে এখনো ইনাম আছে কিনা!যদি না পায়?এটা ভাবতেই প্রিয়তা দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামলো চারতলায়।রুমের দিকে যেতেই যাবে হঠাত থেমে গেলো।ও কি ইনামকে দেখলো এইমাত্র?ভালো করে পাশাপাশি তাকাতেই দেখলো সত্যিই ইনাম বসে আছে চেয়ারে!প্রিয়তা সাথে সাথে পাশে থাকা দেয়ালের পিছনে লুকিয়ে পরলো।ইনাম এখনো ওকে দেখতে পায় নি।মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক ইনান তাহলে এখনো চলে যায়নি। এসব ভাবতে ভাবতেই দেখলো সাদা এপ্রোন পরা একটা ছেলে এসে ইনামের পাশে বসেছে।কতগুলো কাগজ ইনামের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে ছেলেটা।কিসের কাগজ এগুলা?আর ছেলেটা কে?ডাক্তার?
কিছুক্ষন চুপ থেকে আরাফ বলল,
“তোর ধারনাই ঠিক।টিউমারটা আস্তে আস্তে বড় হয়ে যাচ্ছে যার কারনে তোর এমন হুট করে মাথা ব্যথা,ঝাপসা দেখা,নিজের উপর কনট্রোল হারানো এসব বেরে যাচ্ছে।”
ইনাম ঠান্ডা গলায় বলল,
“আমার হাতে আর কতদিন সময় আছে?”
“চার থেকে পাঁচ মাস!”
আরাফ কিছুক্ষন থেমে বলল,
“আমি বলি কি তুই অপারেশনটা করেই নে।”
ইনাম আরাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অপারেশন করলে আমার রোগ সেরে যাবে?তুই ই বলেছিস অপারেশন করেও ব্রেন টিউমারটাকে সরানো যাবে না।অপারেশন করলে রোগ সারার সম্ভবনা ৫০% এর থেকেও কম।”
আরাফ থতমত খেয়ে বলল,
“আমি তো বলিনি যে একদমই সম্ভব না!মিরাকেল তো হলেও হতে পারে!তুই নেগেটিভ কেন ভাবছিস?অপারেশনের মাধ্যমে তো তুই ভালো ও হয়ে যেতে পারিস!”
ইনাম হেসে বলল,
“মিরাকেল সবসময় সবার ক্ষেত্রে হয় না!আমি যে হাতে চার পাঁচ মাস সময় পাচ্ছি এটাই আমার জন্য অনেক।অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে আমি আমার বাঁচার আয়ু ফুরাতে চাই না।তুই গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারছিস না যে অপারেশন করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে!আমার হাতে যা সময় পাচ্ছি, যতটুকুই পাচ্ছি সেটা আমি কাজে লাগাতে চাই।আমাকে আর অপারেশনের সাজেশন দিবি না।”
“তাহলে আমি কয়েকটা মিডিসিন লিখে দিচ্ছি। এগুলা তোর মাথা ব্যথা কমাবে কিছু সময়ের জন্য!কেবিনে আয়।”
ইনাম আর আরাফ যেতেই প্রিয়তা আড়াল থেকে বেরিয়ে আসলো।ওর হাত পা কাঁপছে।কি শুনলো সে?ইনাম এতদিন ওকে কিচ্ছু বলেনি!তারমানে আজকে কিএই কথাগুলাই বলতো ইনাম?প্রিয়তা মুখে হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পরল।ওর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে ও!দুঃস্বপ্ন!
ইনাম বারান্দায় বসে আছে। সামনের দিকে তাকিয়ে আনমনে কি একটা ভাবছে ও!প্রিয়তা ঘরে এসে ইনামকে দেখতে না পেয়ে সারা রুম খুঁজলো।হঠাত বারান্দায় কাওকে বসে থাকতে দেখে প্রিয়তা পা বাড়ালো বারান্দার দিকে। বারান্দায় আসতেই দেখল ইনাম বসে আছে একটা চেয়ারে।প্রিয়তা যে এসেছে সেটা এখনো টের পায়নি ইনাম।প্রিয়তা আস্তে আস্তে কয়েক পা এগিয়ে গেলো ইনামের দিকে।ইনামের ঠিক পিছনে এসে দাঁড়ালো।ও কি বলবে যে সবটা জানে ও?কি করবে বুঝতে না পেরে নিজের ডান হাত ইনামের কাধে রাখল প্রিয়তা।ইনাম একবার পাশ ফিরে প্রিয়তার দিকে তাকালো।মুখ ঘুরিয়ে আবার সামনে তাকিয়ে থেকে বলল,
“তোমাকে কিছু বলার ছিলো আমার!সকালে বলেছিলাম!”
“হুম।”
“পাশের চেয়ারটায় বসো!”
প্রিয়তা চুপচাপ এসে চেয়ারে বসলো।
“আসলে কথাগুলো তোমাকে আমার অনেক আগেই বলা উচিত ছিলো।কিন্তু বলতে পারি নি আব্বু আম্মুর জন্য। আব্বু আম্মু জানলে কষ্ট পাবে এই ভেবে।কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি।তোমাকে তোমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছি।তাই ভেবেছি কথাগুলা তোমাকে বলে দেওয়া উচিত।এরপর তুমি যদি নিজ থেকে আমাকে ডিভোর্স দিতে চাও তাহলে আমার কোন আপত্তি থাকবে না।বরং মন থেকে খুশি হবো আমি।মনকে স্বান্তনা দিতে পারব এই ভেবে যে আমি কোন মেয়ের জীবন নষ্ট করিনি।”
প্রিয়তা সবগুলা কথা শুনে বলল,
“কিন্তু আমি শুনতে চাচ্ছি না!”
প্রিয়তার এমন কথা শুনে চমকে ইনাম প্রিয়তার দিকে তাকালো।প্রিয়তা ইনামের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি যেকারনেই অদ্ভুদ আচরন করুন না কেন আমি শুনতে চাচ্ছি না। ”
‘কিন্তু কেন?”
“দেখুন আপনি যদি আমাকে এখন সবকিছু বলে দেন তাহলে আপনাকে আমার ডিভোর্স দিতে ইচ্ছা হবে।আপনার মুখ দেখতে ইচ্ছা করবে না।ঘৃণা করতে শুরু করব আপনাকে।”
“এটাই তো স্বাভাবিক!”
“আমাদের বিয়ের ১ মাসও হয়নি।এখন আমি আপনাকে যতোই মন থেকে ডিভোর্স দিতে চাই না কেন দিতে পারব না।ডিভোর্স হতে সময় লাগে।অনেক সময়!সেই সময়টুকুতে আপনাকে সহ্য করার মতো ধৈর্য্য আমার থাকবে না।দাঁতে দাঁত চেপে থাকা লাগবে আপনার সাথে!তাই আমাকে কথাগুলো পরে বলিয়েন।বিয়ের কয়েকদিন পর।আর কয়দিন গেলেই আপনাকে আমি ডিভোর্স দিতে পারব।”
ইনাম হা করে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আছে।সব কথা ওর মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে।
“মানে তুমি বলছো আর কয়টা দিন গেলে তারপর তোমাকে বলতে?”
“হুম।”
“তোমার কৌতুহল হবে না জানার?”
“মোটেও না!আমি নিজেকে বুঝাবো!সরি আপনার রুমে পারমিশন ছাড়া আসার জন্য। আমি আসলে ভেবেছিলাম…..”
ইনামকে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রিয়তা বলল,
“আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তবা বাসায় আসেন নি।সিউরিটির জন্য এসেছি।আর দরজায় অনেকবার নক করেছি। কিন্তু আপনি কোন এন্সার দেন নি।তাই…. ”
“থাক!আর বলতে হবে না।আমি বুঝতে পেরেছি।”
প্রিয়তা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।যেতে যেতে বলল,
“কষ্টগুলো নিজের মাঝে চেপে রাখবেন না।আপনার যদি কান্না পায় তাহলে কান্না করুন।মন হালকা হবে।এভাবে নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছেন?আপনার ভেতরের সত্ত্বাটা কাঁদতে চাইছে কিন্তু আপনি তাকে কাঁদতে দিচ্ছেন না।কান্নাগুলাকে নিকের মধ্যে আটকে রেখেছেন।এতে আপনি নিজেকে নিজে কষ্ট দিচ্ছেন।তাই বলছি কাঁদার ইচ্ছা হলে কাঁদুন।কেও আপনাকে আটকাবে না,দেখবেও না।”
বলেই বারান্দা থেকে রুমে এসে একটা শ্বাস ফেলল।যাক কথাগুলাতে কোন প্যাচ ধরেনি ইনাম!ইনাম প্রিয়তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবলো প্রিয়তা হঠাত এসব কথা কেন বলল?প্রিয়তা ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে বসে রইলো।ইনামকে জানতে দেওয়া যাবে না যে সে সব জেনে গেছে।এমন ভাব করতে হবে যেন কিছুই জানে না।সবকিছু আগের মতোই সিম্পল!
আজকে শুক্রবার।ছুটির দিন।ইনাম বিছানায় ঘুমাচ্ছিলো। হঠাত ফোনের তীব্র আওয়াজে ঘুম ভেংগে গেলো।বিরক্ত হয়ে পাশের টেবিল থেকে ফোন নিয়ে রিসিভ কলে কানে ধরতেই শুয়া থেক্র লাফ দিয়ে উঠে বসলো সে।তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে নেমে সোজা প্রিয়তার রুমের সামনে গেলো।প্রিয়তা তো মনে হয় ঘুমাচ্ছে।এ অবস্তায় রুমে কি করে যাবে?দরজার সামনে থেকেই ডাকতে লাগলো প্রিয়তাকে।প্রায় কয়েকবার ডাকার পরও প্রিয়তার সাড়া শব্দ না পেয়ে আর কোন উপায় না পেয়ে সোজা ড্রয়িং রুমে গিয়ে টিভি চালিয়ে দিলো।টিভির ভলিউম ফুল দিয়ে রাখলো যাতে প্রিয়তার ঘুম ভাংগে।
কানের কাছে জোরালো শব্দ প্রবেশ করতেই বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে ফেলল প্রিয়তা।এত সকালে এমন অভদ্রের মতো টিভি চালিয়েছে কে?বিরক্ত হয়ে পাশে থেকে একটা বালিশ নিয়ে কানে চেপে রাখলো।কিন্তু কোন লাভ হলো না।অবশেষে কোন উপায় না পেয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো।চেয়ার থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে পেচিয়ে রুম থেকে বের হতেই দেখলো ইনাম দাঁড়িয়ে আছে সামনে।পাশে টিভি চলছে।প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে বলল,
“এভাবে জোরে সাউন্ড দিয়ে টিভি চালিয়ে রেখেছেন কেন?”
ইনাম টিভি অফ করে বলল,
“তোমার ভাংগানোর জন্য। ”
” বুঝলাম না।”
ইনাম কথাটা বলতেই প্রিয়তা অবাক হয়ে বলল,
আলোর ভীড়ে পর্ব ১৪
“এখন?এখন কি করব?আপনি আগে বলেন নি কেন?”
“আরে আমিই তো এইমাত্র জানলাম।”
ইনাম একটা শ্বাস নিয়ে প্রিয়তার কাছে গেলো।প্রিয়তার দুই কাধ ধরে বলল,
“চিন্তা করো না।আমি সবকিছুর ব্যবস্তা করছি।কাজে লেগে পরো!”