আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ১৩

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ১৩
Raiha Zubair Ripti

জীবনের নানান ধরনের বাঁধা বিপদ কে পিছু ঠেলে মানুষ সামনের দিকে আগায়। মানুষের জীবন গতিপথ এমনিই। তাদের লক্ষ্য সামনের দিকে আগানো। অতীত ধরে কখনই বসে থাকা যায় না। তাহলে জীবনের গতিপথ ও মাঝ রাস্তায় এসে আঁটকে থাকবে।

সন্ধ্যা আষাঢ়ের নম্বরের দিকে তাকিয়ে আছে। ফোন করবে কি করবে না এই দ্বিধায়। একবার ভাবছে ফোন করবে পরক্ষণে আবার ভাবছে ফোন করা টা কি আদোও ঠিক হবে? ফোনের আলো নিভে যেতেই মনে র আশাও নিভে গেলো। ফোন টা ছুঁড়ে বিছানায় ফেললো। বিছানায় এসে বসে টেবিল ল্যাম্পের দিকে তাকালো। ফোনে টিংটং মেসেজ আসার শব্দ আসতেই তাকিয়ে দেখলো সিম কোম্পানির মেসেজ। বিরক্তিতে চ সূচক উচ্চারণ করলো। এদের কি খেয়েদেয়ে কাজ নেই সব সময় শুধু মেসেজ পাঠানো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফোন টা তুলে সব মেসেজ ডিলেট করলো। তারপর ফের হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে কল লাগালো। প্রথম বার রিসিভ হলো না। সন্ধ্যা ফের দ্বিতীয় বার দিলো। এবার ও রিসিভ হলো না। সন্ধ্যা কেটে দিলো। আর দিলো না ফোন। ফোন টা বিছানায় রেখে রুম থেকে বের হলো। মায়ের রুমে এসে দেখলো নজরুল ইসলাম শেফালী বেগমের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। সন্ধ্যা না চাইতেও মুগ্ধ হয়ে দেখলো। বাবার আদরের মেয়ে ছিলো সন্ধ্যা। এখনও কি আছে সেই আদরের? সন্ধ্যা একটা সময় বাবা বলতে পাগল ছিলো। হঠাৎ করেই লোকটার একটা ডিসিশন তাদের দুজনের বাবা মেয়ের সম্পর্ক টাকে দু’দিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যার আর মন থেকে সেই বাবার জন্য মায়া আসে না। কেমন যেনো শক্ত হয়ে গেছে হৃদয় টা। এতোটাই শক্ত যে কোনো পুরুষের আকুতি ভরা আর্তনাদ ও নরম করতে পারে নি।

মানুষের হৃদয় কি এমন হওয়া উচিত? বিশেষ করে মেয়েদের? তাদের হৃদয় তো হবে ফুলের মতো। যেখানে ভ্রমর এসে বসবে। সন্ধ্যা কেমন যেনো পুরোনো অতীত ভুলেই মুগ্ধ হলো বাবার মায়ের প্রতি এমন কার্যকলাপ গুলো দেখে। দু’জনের এখন ছোট্ট সংসার তাই না? একটা বয়সের শেষে এসে তো তখন স্বামী স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক হয়ে যায় । বাহিরের জীবনের আর কোনো যানজট থাকে না। সন্ধ্যা তপ্ত শ্বাস ফেলে সরে আসলো। রুমে আসতেই দেখলো ফোন বাজছে। সন্ধ্যা ফোনটা উঠিয়ে দেখলো আষাঢ় ফোন করেছে। কেমন যেনো শরীরের রক্ত চলাচল বন্ধ করে দিলো। ফোনটা রিসিভ করে কানে নিলো।
কোনো শব্দ ভেসে আসলো না ফোনের ওপাশ থেকে। নীরবতা চলতে লাগলো। সন্ধ্যা অপেক্ষায় আছে ওপাশ থেকে আষাঢ় কিছু জিজ্ঞেস করবে আর সে উত্তর দিবে।
কিছু সময় অতিবাহিত হবার আষাঢ় বলে উঠল-

-“ ফোন দিয়েছিলে?
সন্ধ্যা ছোট্ট করে জবাব দিলো-
-“ হু।
-“ কেনো ফোন দিছো? যন্ত্রণা টা আরো বাড়াতে?
-“ না।
-“ তাহলে কেনো ফোন দিছো?
-“ কন্ঠে রাগের বহিঃপ্রকাশ পাচ্ছি কেনো?
-“ এটা রাগ কেনো মনে হলো তোমার?
-“ তাহলে কি?
-“ বোঝার বয়স হয় নি। কোনো দরকার ছিলো আমাকে?
-“ হু।
-“ কি দরকার বলো।
সন্ধ্যা ফট করে জিজ্ঞেস করলো-

-“ কেমন আছেন?
আষাঢ় জবাব দিলো-
-“ যেমনটা রেখেছো তেমন টাই আছি। তুমি নিশ্চয়ই ভালো আছো?
-“ সত্যি বলবো?
-“ ইচ্ছে হলে বলো।
-“ ভালো নেই।
-“ কেনো? শরীর খারাপ?
-“ না।
-“ তাহলে?
-“ মন খারাপ।
-“ কেনো?
-“ জানা নেই।

-“ মন তো খারাপ থাকার কথা না৷ আমি তো ছেড়েই চলে এসেছি৷ এখন তো ডাবল ভালো থাকার কথা।
-“ নম্বর চেঞ্জ করেছেন কেনো? আগের নম্বর কি হয়েছে?
-“ বন্ধ করে রেখেছি। আমার নম্বর কোথায় পেলে?
-“ চু… না আন্টির থেকে নিয়েছি।
-“ ওহ আচ্ছা।
-“ ফিরবেন কবে?
-“ ফিরবো না তো আর।
-“ কেনো?
-“ এমনি।
-“ আপনার কি সামনে বিয়ে?
-“ কে বললো?
-“ আন্টি যে তার ছেলের বউদের জন্য গয়না বানাতে দিলো আজ।

-“ তোমার আন্টিকেই জিজ্ঞেস করো তাহলে৷ রাখছি এখন অপারেশনে যেতে হবে।
আষাঢ় কে’টে দিলো ফোন। সন্ধ্যা তাকিয়ে রইলো কেটে দেওয়া ফোনের দিকে। ইগনোর করলো নাকি?
রাত আজকাল ভীষণ ব্যস্ত থাকে পড়াশোনা নিয়ে। কিছু একটার পেছন ভীষণ শ্রম দিচ্ছে। যখন সফলতা টা আসবে তখন মা ভাইদের জানাবে। আমেনা বেগম সন্ধ্যা দের বাসায় গেছে। শুনেছে নিখিল চলে গেছে। শ্রেয়া মেয়েটার উপর দিয়ে কি ঝড় টাই না যাচ্ছে ভেবে। সন্ধ্যা দের বাসায় এসেই দেখলো সন্ধ্যা বাসায় নেই বেরিয়েছে কোথাও একটা। শ্রেয়া চুপচাপ বসে আছে সোফায় পা গুটিয়ে চোখ বন্ধ করে। আমেনা বেগম এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল-

-“ শ্রেয়া।
শ্রেয়া চমকে তাকালো। ভালো হয়ে বসে বলল-
-“ আন্টি আপনি! বসুন না।
আমেনা বেগম বসলেন। শ্রেয়া হাসার চেষ্টা করলো। অথচ তার ভেতর থেকে হাসি আসতে চাইলো না। কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়েই জিজ্ঞেস করলো-
-“ কিছু বলবেন আন্টি?
-“ না কিছু বলবো না। তোমাকে দেখতে আসলাম। একটা কথা বলবো?
-“ হু বলুন না।
-“ নিখিল কে খুব ভালোবাসো তাই না?
-“ হু।

-“ আত্মসম্মান এর থেকেও বেশি? শুনো কখনই নিজের থেকে কাউকে ভালোবাসবে না। তাহলে ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করার মতো না। আমি সব শুনেছি। যে পুরুষ একটা অপূর্ণতা মেনে নিতে পারেনি। তোমাকে রাখতে পারে নি সেই দোষ তোমার না। দোষ টা সেই পুরুষের। নিজেকে কখনও নিখিলের সামনে ছোট করবে না।
-“ কিন্তু আন্টি হৃদয় সে তো মানে না। ওটা তো চরম বেহায়া।
-“ তার লাগাম এখনই টেনে ধরো। দেখবে কয়েক দিন। এই কয়েক দিনে যদি নিখিল একবারও তোমার খোঁজ খবর না নেয় তাহলে ভাববে সে তোমার জীবনের মরীচিকা কেবল। আর ছুটবে না তার পেছন। নিজের মতো বাঁচবে নিজেকে ভালোবেসে। আর সময় পেলে একটা জায়গায় যাবে।

-“ কোথায়?
-“ বাসার পাশে যে এতিমখানা আছে না? ওখানে গিয়ে বাচ্চাদের সাথে মিশবে দেখবে সকল যন্ত্রণা ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে।
-“ একটু জড়িয়ে ধরবো আপনাকে আন্টি?
-“ কেনো নয় আসো?
শ্রেয়া জড়িয়ে ধরলো আমেনা বেগম কে।

-“ জানেন আন্টি জীবনে একটা ভুল.. না ভুল না ওটা। ওটা ছিলো অন্যায়। অন্যায় করেছিলাম। তারপর থেকে কেউ আমাকে এতো সুন্দর করে কখনই বুঝায় নি। বুঝাবে কি ঠিক মতো বসে কথাই বলে নি কেউ। আমি না নিজের ভালোবাসায় এতটাই অন্ধ হয়ে গেছিলাম যে শুধু নিজের ভালো থাকাকেই সবার আগে দেখতাম।
-“ গিল্টি ফিল হচ্ছে অনেক?
-“ প্রচুর।
-“ ক্ষমা চেয়ে নিও যাদের সাথে অন্যায় করেছো।
সন্ধ্যা বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে আজ কনা আসছে তার বাসায়। কয়েক দিন থাকবে। কারন ঢাকাতেই আইইএলটিএস কোর্স করছে সে। কিছু সময় অপেক্ষা করার পরই একটা বাস থেকে কনা কে নামতে দেখে এগিয়ে গেলো। কনা জড়িয়ে ধরলো৷

-“ আসতে অসুবিধা হয় নি তো?
-“ উঁহু।
-“ আচ্ছা চল।
-“ হু।
কনা আর সন্ধ্যা হাঁটা ধরলো বাসার দিকে। বাসায় আসতেই দেখা হয় শ্রেয়ার সাথে। শ্রেয়া ভ্রু কুঁচকালো কনা কে দেখে।
-“ কে ও?
-“ আমার ফ্রেন্ড।
কনা সালাম দিলো। শ্রেয়া সালামের জবাব দিলো। কনা মুচকি হেঁসে জিজ্ঞেস করলো-

-“ কেমন আছেন আপু?
-“ জ্বি.. আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি?
-“ আলহামদুলিল্লাহ।
সন্ধ্যা রুমের দিকে যেতে যেতে বলল-
-“ রুমে আয়। ফ্রেশ হ আগে।
কনা সন্ধ্যার পেছন পেছন আসলো। শ্রেয়া রান্না ঘরে গেলো খাবার বানাতে। কনা ফ্রেশ হতেই শ্রেয়া দরজায় টোকা দিয়ে সন্ধ্যা কে বলল-
-“ কনার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।
সন্ধ্যা এগিয়ে এসে খাবার টা নিলো। শ্রেয়া চলে গেলো।
কনা খাবার টা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো-
-“ কিরে তোর সেই পাগলা প্রেমিক কোন তালায় থাকে?
-“ নেই সে।
-“ হসপিটালে নাকি?
-“ না।
-“ তাহলে?
-“ আমেরিকার চলে গেছে।

কনার খাবার আঁটকে গেলো গলায়। কাশি উঠলে সন্ধ্যা পানি এগিয়ে দেয়। কনা পানি টা খেয়ে বলে-
-“ তুই তাকে যেতে দিলি আমেরিকা! হাউ বোইন হাউ?
-“ যেতে না দেওয়ার কি আছে? কত বড় অপরচুনিটি এটা তার জন্য জানিস?
-“ তোর থেকে কোনো কিছুই বড় ছিলো না তা কাছে।
-“ হয়েছে তার হয়ে ওকালতি৷ এখন খেয়ে নে। বিকেলে বের হতে হবে তো।

বিকেল তিনটার দিকে বের হলো বাসা থেকে কনা আর সন্ধ্যা। মূলত তারা শপিংমল যাবে। একটু কেনাকাটা করবে সাথে বাসার আশেপাশ টাও কনাকে দেখাবে। শপিংমলে শপিং করে হাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে মল থেকে বের হতেই একটা ক্যাফে দেখতে পেলো। কিছু খাওয়ার জন্য সেই ক্যাফে তে ঢুকলো। দুটো স্যান্ডউইচ আর দুটো কফি অর্ডার দিলো। ওয়েটার দিয়ে গেলো। সন্ধ্যা স্যান্ডউইচ টা মুখে দিতেই আকস্মিক দেখতে পেলো রাস্তার ওপর পাশে আষাঢ় কে। হাতের স্যান্ডউইচ টা পড়ে গেলো প্লেটে। সে না আমেরিকা গেছে? তাহলে এখানে কি করে? সন্ধ্যা দৌড়ে বেরিয়ে আসলো ক্যাফে থেকে। ডাক্তার বলে ডাক দেওয়ার জন্য উদ্যত হওয়ার আগেই আষাঢ় গাড়িতে উঠে চলে গেলো। সন্ধ্যা ক্যাফেতে ঢুকে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে আষাঢ় কে কল লাগালো। ফোন ঢুকছে না৷ নেট অফ বোধহয়।
কনা হঠাৎ সন্ধ্যা কে বাহিরে দৌড় দিতে দেখে অবাক হয়। আবার ভেতরে এসে অস্থির হয়ে কাউকে ফোন করতে দেখে বলল-

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ১২

-“ কি হয়েছে?
সন্ধ্যা কথার উত্তর না দিয়ে তড়িঘড়ি করে ব্যাগ গুলো হাতে নিয়ে বলল-
-“ বাসায় চল। আমি বাসায় যাব।
-“ খেয়ে নেই তো আগে।
-“ পার্সেল করে নিয়ে আয়। বাসায় খাইছ। আমি বিল দিয়ে আসছি।
কনা কিছুই বুঝলো না। নিজের স্যান্ডউইচ টা খেয়ে পার্সেলের অপেক্ষা করলো না৷ হাতে ট্যিসু নিয়ে সেটা দিয়ে সন্ধ্যার স্যান্ডউইচ উঠিয়ে খেতে খেতে বের হলো।

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ১৪