আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ১৪

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ১৪
Raiha Zubair Ripti

রাতের অন্ধকারে চারপাশ এক ভিন্ন রূপ ধারণ করে। নক্ষত্রমণ্ডিত আকাশ যেন অসীমতার দিকে ডাকে, প্রতিটি তারা মনে করিয়ে দেয় মানুষের ক্ষুদ্রতা এবং জীবনের অনিশ্চয়তা। চাঁদের আলো একটি রহস্যময় দোলনায় পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করে। এ যেন এক স্নিগ্ধ স্বপ্ন, যেখানে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে রহস্য ও কৌতূহল লুকিয়ে রয়েছে। কিছু দূরে, একটি নিশাচর পাখির গানের সুর বাতাসে ভাসছে, যা মনে করিয়ে দেয় যে জীবন প্রতিটি ক্ষণে চলমান।
ছাঁদেরই দোলনায় বসে আছে কনা আর সন্ধ্যা। কনা আপেলে কামড় বসাচ্ছে আর আড়চোখে সন্ধ্যা কে দেখে চলছে। বাসায় এসে থেকেই মেয়েটাকে অস্থির দেখে চলছে। কি হয়েছে বলছেও না। এবার অধৈর্য হয়ে বলল-

-“ আরে বোইন হইছে টা কি সেটা তো বলবি? কি এমন হলো ক্যাফেতে যে অস্থির হয়ে চলে আসলি। কিছু দেখছিস তুই?
-“ হ্যাঁ।
-“ কি দেখছিস?
-“ তুই শুনলে বিলিভ করতে চাইবি না।
-“ কি এমন দেখছিস বোইন?
সন্ধ্যা বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল-
-“ আমি আষাঢ় কে দেখছি ক্যাফের বাহিরে।
কনার খাওয়া থেমে গেলো। অবাক হয়ে বলল-
-“ মাথাটা কি একদম গেছে? ঐ বেডা এখানে আসবে কি করে? উনিতো আমেরিকা।
-“ মনে হচ্ছে উনি যায় নি।
-“ কিহ! তুই না বললি গতকাল কথা বললি তার সাথে। সে নম্বর চেঞ্জ করছে। তাহলে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সন্ধ্যার কিছু একটা মনে হতেই দোলনা থেকে ফোন টা নিতে নিতে বলে-“ ওয়েট।
ফোনটা নিয়ে সোজা হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে আষাঢ়ের নম্বর টা চেক করলো। নম্বর টা কোনো আমেরিকার না। বরং নম্বর টা বাংলাদেশেরই। সন্ধ্যা কনার দিকে তাকালো। কনা ফোনে নম্বর টা দেখলো। দু’জন একে ওপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। কতবড় বেক্কল সন্ধ্যা। নম্বর তোলার সময় খেয়ালই করে নি সে যে এটা একটা বাংলাদেশী নম্বর। কনা ফোনটা কেঁড়ে নিয়ে বলল-

-“ কিরে এটা তো বাংলাদেশী নম্বর।
-“ হু সেটাই তো দেখছি।
-“ তারমানে উনি আমেরিকা যান নি।
সন্ধ্যা ফোনটা নিয়ে আষাঢ়ের নম্বরে কল লাগালো। দুবার রিং হয়ে কে’টে যেতেই তৃতীয় বার ফোনটা রিসিভ হলো। শুরুতেই আষাঢ় বলে উঠল-
-“ সরি বিজি ছিলাম সেজন্য ফোনটা ধরতে পারি নি।
লাউডস্পিকারে থাকা ফোনটার সাউন্ড কমালো সন্ধ্যা। কনা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা সাইডে সরে গিয়ে বলল-
-“ সমস্যা কি আপনার?
আষাঢ় কিছু বুঝলো না।
-“ কি সমস্যা?
-“ আপনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন কেনো?
আষাঢ়ের ভ্রু কুঁচকে আসলো।

-“ কি মিথ্যা বলেছি তোমায়?
-“ এই যে আপনি আমেরিকা চলে গেছেন।
-“ আমি একবার ও বলেছি আমি আমেরিকা চলে এসেছি?
-“ গতকাল যে বললেন।
-“ ভেবে দেখো একবার ও বলিনি আমেরিকা এসেছি আমি।
-“ যান নি কেনো তাহলে আমেরিকা?
-“ চলে গেলে কি খুশি হতে?
সন্ধ্যা থতমত খেয়ে গেলো।
-“ ন..না মানে যান নি কেনো?
-“ ফ্লাইটের ডেট আকস্মিক পিছিয়ে গেছে।
-“ ওহ্ তো বাসায় আসছেন না কেনো?
-“ এমনি।
-“ আজ আপনাকে আমি দেখেছি।
-“ কোথায়?

-“ ক্যাফের সামনে। না দেখলে তো ভেবে বসে থাকতাম আপনি আমেরিকা তে।
-“ কেনো তুমি আমার নম্বর চেক করো নি যখন নিয়েছো? নম্বর টা তো বাংলাদেশী।
-“ খেয়ালই ছিলো না যে আমি বাংলাদেশী নম্বর তুলেছি ফোনে।
-“ আচ্ছা।
-“ কি আচ্ছা?
-“ না কিছু না। আর কিছু বলবে?
-“ কেনো বিরক্ত করতেছি?
-“ না। আমি হসপিটালে।
-“ তাতে কি?
-“ না তাতে কিছু না। তুমি বলো আমি শুনছি।
-“ কি বলবো আমি?
আষাঢ় এক গাল হেঁসে বলল-
-“ তুমি কি বলবে সেটা আমি কিভাবে জানবে!
-“ কেনো জানবেন না? খুব তো বলতেন আমাকে ভালোবাসেন।
-“ আমি কি সবজান্তা নাকি।
-“ বাসায় ফিরবেন কবে? আপনার ভাই রাত সে তো আরেক বাটপার।
-“ কেনো রাত কি করেছে?
-“ ও আপনি চলে যাওয়ার দুদিন পর বললো আপনার নাকি কেনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আমি কত ভয় পেয়েছিলাম জানেন?.

-“ ভয় কেনো পাবে তুমি?
-“ একটা মানুষের খোঁজ পাচ্ছে না কেউ৷ তো ভয় লাগবে না?
-“ না লাগবে না।
-“ ধরুন আমি হারিয়ে গেলাম। কেউ খোঁজ পাচ্ছে না। তাহলে খারাপ লাগবে না আপনার?
-“ শাট-আপ। অন্য কথা বলো।
-“ বাসায় ফিরবেন কবে?
-“ নেক্সট সপ্তাহে ফ্লাইট। তো একদিন আগে বাসায় গিয়ে দেখা করে আসবো মা আর রাতের সাথে।।
-“ ওহ্ আচ্ছা। এর আগে আসবেন না আর?
-“ দরকার কি।
-“ না মা..মানে।
-“ না মানে কি?
-“ একটু আসতেন৷
-“ কেনো?
-“ আপনাকে সন্ধ্যার খুব দেখতে ইচ্ছে করতেছে ভাই। তাড়াতাড়ি আসুন। বান্ধবী আমার শুকিয়ে গেছে।
সন্ধ্যা কটমট চাহনি নিয়ে তাকালো কনার দিকে৷ আষাঢ় নৈঃশব্দ্যে হেসে ফেললো।

-“ কে পাশে?
-“ কনা। আমার বান্ধবী এসেছে।
-“ তুমি কোথায় এখন?
-“ বাসাতেই। ও এসেছে ঢাকা।
-“ ওহ্ তোমার ফ্রেন্ড যা বললো তা সত্যি নাকি?
-“ না।
-“ ওকে। তাহলে আর গিয়ে কি করবো।
-“ মা ভাইকে দেখবেন আবার কি করবেন?
-“ তাদের প্রতিনিয়ত ই দেখি মিস সন্ধ্যা। তুমি রিকোয়েস্ট করলে যেতে পারি তোমায় দেখতে।
-“ আমি কি বলেছি আমাকে দেখতে আসুন?
-“ তাহলে আর যাওয়ার কথা বলিও না।
-“ আচ্ছা রাখছি। পরে কথা বলবো।
-“ আচ্ছা শুভরাত্রি।
-“ হু।
সন্ধ্যা কেটে দিলো ফোন। কনা বিরক্তিকর চাহনি নিয়ে বলল-

-“ এতো ঢংগী কেনো তুই? বারবার বলছিস আসতে কিন্তু স্বীকার করছিস না তোর তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
-“ দু লাইন বেশি বুঝিস তুই।
-“ জ্বি না। আমি ঠিকই বুঝি। তুই দু লাইন কম বুঝিস। আমি গেলাম ঘুমাতে তুই আয়।
কনা ছাঁদ থেমে চলে আসলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনের সুখে গান গায় –
-“ ওরেএএএএ প্রেম যে কাঁঠালের আঠা
লাগলে পরে আর ছাড়ে না,,
এ কেমন পিরিত বন্ধু
দিলে তো মানে নাআআআআআআআআআআআওমাআরে
গানটা নিজের মতো গাইতে গাইতে নামতে গিয়ে আচমকা এক পুরুষের সাথে ধাক্কা খেয়ে পা পিছলে দুই সিঁড়ির নিচে গিয়ে পড়ে যায় কনা। সন্ধ্যা তড়িঘড়ি করে সিঁড়ির কাছে আসে। দেখে কনা নিচে পড়ে আছে আর রাত দু হাত বুকে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে।

সন্ধ্যা কনার কাছে দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে কনাকে তুলে উঠায়। কনা কোমরে হাত দিয়ে বলল-
-“ ওরে সন্ধ্যা আমার কোমর গেলো রে। কোন রাতকানার ঘরে রাতকানা আমার কোমর ভেঙে দিলো রে।
কথাটা বলে পেছম তাকায় কনা। ব্লাক টিশার্ট পড়া রাত কে দেখে রাগ গুলো বেরিয়ে আসলো।
-“ এই রাতকানা নাকি আপনি? দেখেন নি আমার মতো জলজ্যান্ত একটা মেয়েকে? দিলেন তো ফেলে দিয়ে আমার কোমর টা ভেঙে।
রাত ভ্রু কুঁচকে বলল-

-“ রাতকানা কি হ্যাঁ? আমার নাম ভেঙাচ্ছেন কেনো? আপনার হুঁশ নেই? গান গাইতে গাইতে হেলেদুলে দিক্বিদিক না তাকিয়ে নামার জায়গা এটা?
-“ এখন আমি কিভাবে নামবো সিঁড়ি দিয়ে সেটাও আপনার থেকে শিখতে হবে?
-“ আমার এতো আজাইরা সময় নেই আপনাকে হাঁটা শেখানোর।
-“ আমারও শখ নেই রাতকানা লোকের কাছে হাঁটা শেখার। আপনি নিজেই তো হাঁটতে জানেন না। কানা লোক একটা।এই সন্ধ্যা আমাকে ধরে নিয়ে যা তো। ফালতু লোক একটা।
-“ মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ।
-” ইই মাইন্ড ইউর হাঁটাচলা।
সন্ধ্যা রাত কে কিছু বলতে চেয়েও আর বললো না। কনাকে ধরে রুমে নিয়ে গিলো। কনা বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে বলল-

-“ সন্ধ্যারে একটু দেখ তো বোন ছুলে টুলে গেছে নাকি। জ্বলতেছে খুব।
সন্ধ্যা কনার জামা একটু উঠিয়ে দেখলো কিছুটা ছুলে গিয়েছে।
-“ কি রে ছুলে গেছে?
-“ হু কিছুটা।
-“ ইশ অনেক জ্বলতেছে রে।
-“ ওয়েট মলম লাগায় দিতেছি।
-“ আরো জ্বলবে তো।
-“ তারপর ঠান্ডা হয়ে যাবে।
-“ আচ্ছা ফু দিয়ে দিবি ইয়ার।
সন্ধ্যা কনার কোমরে মলম দিয়ে ফু দিলো। দরজার ওপাশ থেকে শ্রেয়া দেখলো দৃশ্য টা। সন্ধ্যা কনাকে কত মানে কত বিশ্বাস করে। আপন বোনের মতো দেখা যায়। অথচ কনার জায়গায় তার থাকার কথা ছিলো। কিন্তু নিজের দোষে সব হারালো।

রাত ছাঁদে এসে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে লাইটার আর সিগারেট বের করে জ্বালাতে শুরু করে। ইদানিং সিগারেটের নেশা হয়ে গেছে। সিগারেট টা ধরিয়ে মুখে নিয়ে টান দিলো।তারপর ধোঁয়া গুলো আকাশের দিকে উড়িয়ে দিয়ে বিরবির করে বলল-
-❝ ধোঁয়ার মতো আকাশে মিলে যাক সব গ্লানি,,
মরিচীকার মায়া যেনো ভুলে থাকতে পারি আমি❞
সকালে ঘুম থেকে উঠে হাই তুলতে তুলতে সন্ধ্যা বেলকনিতে আসে।চারিদিকের স্নিগ্ধ ঠান্ডা বাতাস সন্ধ্যার শরীর কে অমায়িক সুখ দেয়। পরপর কয়েকবার চোখ ঝাপ্টানি দিয়ে তাকায়। তারপর নিচের দিকে দৃষ্টি পাত করতেই দেখে ব্লাক কালারের প্রাইভেট কার থেকে আষাঢ় এক হাতে এপ্রন নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে নামছে। সন্ধ্যা চোখ ঢললো। কিছুটা এগিয়ে আসতেই সন্ধ্যা গলা উঁচু করে বলল-

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ১৩

-“ এসেছেন কেনো?
আকস্মিক সন্ধ্যার গলা শুনতে পেয়ে আষাঢ় চমকে যায়। মাথা উঁচু করে বেলকনির দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যা তাকিয়ে আছে তার দিকে। আষাঢ় বাঁকা হেঁসে বিরবির করে বলল –
-“ তোমাকে দেখতেই চলে আসা প্রিয়তমা।

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ১৫