আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ১৭

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ১৭
Raiha Zubair Ripti

পুরো ড্রয়িং রুম জুড়ে চলছে পিনপিনে নীরবতা.. আমেনা বেগম তাকিয়ে আছেন নজরুল ইসলামের মুখের দিকে। তার মুখশ্রীর ভাব দেখে বোঝা দায় আসলে তার মনোভাব টা কেমন। অনেকক্ষণ ই চললো এই গুমোট ভাব টা। আমেনা বেগম গলা ঝেড়ে দিয়ে বললেন –
-“ চুপ কেনো নজরুল ভাই? আপনি রাজি নন আষাঢ়ের সাথে সন্ধ্যার বিয়েতে?
সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকালো। কোনো মানে বুঝলো না তার বাবা নামক মানুষটার মুখ আচমকা এমন কালো করে ফেলার। সে কি রাজি নয় এই বিয়েতে? বড় মেয়ের বিয়েতে তো এমন বাংলার প্যাচের মতো মুখ করে নি তখন। তাহলে এখন কি সমস্যা তার?
আষাঢ় অবশ্য চিল মুডে আছে। কারন নজরুল ইসলাম মানুক আর না মানুক সন্ধ্যা রাজি থাকলে নজরুল ইসলামের মানা না মানার ধার সে ধারবে না। সোজা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে নিজের ঘরণী করে নিবে। তবুও এবার নিজেই বলল-

-“ আঙ্কেল চুপ কেনো? পাত্র হিসেবে কি আমাকে আপনার পছন্দ নয়?
নজরুল ইসলাম নড়েচড়ে বললেন-
-“ না না তেমন টা না।
-“ তাহলে কি?
-“ সন্ধ্যা রাজি হবে নাকি সেটাই ভাবছি।
আষাঢ় মুচকি হাসলো। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ আপনার মেয়ের অনুমতি আছে আঙ্কেল। সেজন্যই সাহস করে প্রস্তাব নিয়ে আসা।
নজরুল ইসলাম একটু চমকালো। তবে তা বুঝতে দিলো না।
-“ তোদের ভেতর কি আগে থেকেই সম্পর্ক ছিলো?
শ্রেয়া মাঝখান থেকে বলে বসলো।
সন্ধ্যার কেনো যেনো শ্রেয়া যখন তার বিষয়ে কথা বলে তখন রাগ হয়। আষাঢ় স্বাভাবিক হয়ে জবাব দিলো-

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“ না আগে কোনো সম্পর্ক ছিলো না। তবে এখন হবে।
-“ ওহ্।
-“ আরে আঙ্কেল হ্যাঁ না কিছু তো বলুন।
অধৈর্য হয়ে বলল রাত।
-“ কারো যখন আপত্তি নেই আমি আর আপত্তি জানিয়ে কি করবো। আপনারা আগাতে পারেন।
-“ বিয়ের ডেট তাহলে ফিক্সড করা যাক? আমেনা বেগম বলে উঠলেন
-“ জ্বি করুন।
-“ নেক্সট উইকে, শুক্রবার ঠিক করা যায়।
-“ এতো জলদি! আয়োজনের ও তো ব্যপার স্যপার আছে।
-“ কোনো আয়োজন করতে চাচ্ছি না ভাই। খুব ছোট্ট পরিসরে বিয়ে টা করাতে চাই। আসলে আষাঢ়ের এটাই ইচ্ছে।
-“ আচ্ছা আপনারা যা বলবেন।

আমেনা বেগম আর নজরুল ইসলাম আরো কিছুক্ষণ কথা বলে নিলো। কনা সন্ধ্যা কে নিয়ে ছাঁদে আসলো। সন্ধ্যা দোলনায় বসতেই কনা কোমরে হাত দিয়ে বলল-
-“ কি ব্যপার বাবু..কাল মনের কথা বলতে না বলতেই আজ সকালে তোর হিরো সোজা মিষ্টি নিয়ে চলে আসলো বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে! আগেই বলেছিল তোকে যে আসবে?
-“ আরে না। আমাকে জানায় নি। আমি নিজেও তো শকড
-“ বাহ্! এমন শকড লাইফে দু একটা তো আমিও পেতে চাই।
-“ প্রেম কর। তুই না আমার দেবর কে চাইলি। নে পটিয়ে দু’জনকে বেশ মানাবে।

-“ ছিঃ তোর দেবর ঐ লোক জানার পর তোর জা হবার শখ আমার মিটে গেছে। যে লোক প্রথম দিনই আমার কোমড় ভেঙে দেয় তার সাথে সংসার করলে প্রতি নিয়ত আমার শরীরের একটা একটা করে সব হাড় ভেঙে যাবে।
-“ আরেহ্ না..ও ভীষণ বাচ্চা টাইপের। আমি তো মিশেছি কিছু দিন৷ তুই উল্টা ওকে শাসন করতে পারবি।
-“ হ্যাঁ ফিটার খাওয়া বাবু তো সে যে আমি শাসন করলে সে ফিটার খেতে খেতে শুধু শুনবে। তুই ও না।
-“ এই বের হও ছাঁদ থেকে বেয়াদব মেয়ে।
কনা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো রাত আর আষাঢ় এসেছে। কনার ভ্রু কুঁচকে আসলো।

-“ ছাঁদ থেকে বের হবো মানে!
-“ কাপল দের মাঝে তুমি থেকে কি করবা? কাবাব মে হাড্ডি হবা?
-“ কিসের কাপল? কোথায় কাপল?
-“ কেনো আমার ভাই আর সন্ধ্যা কে কাপল মনে হয় না তোমার?
-“ ওহ্ তা কাপল দের মাঝে থেকে কাবাব মে হাড্ডি হলে সমস্যা কি?
আষাঢ় কিঞ্চিৎ হেসে বলল-
-“ আমাদের একটু ব্যক্তিগত কথা বলার ছিল, বুঝলে?
-“ আপনার কথাতেই যাচ্ছি ভাইয়া। অন্য কারো কথাতে না কিন্তু।
কনা রাত কে ভেঙচি কেটে চলে গেলো। রাত বিরবির করে বলল বেয়াদব।
-“ আচ্ছা ভাইয়া আমি আসছি।
রাত ও চলে গেলো। আষাঢ় এগিয়ে আসলো। সন্ধ্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুঁজে বলল-

-“ তা ম্যাডাম কি খুশি বিয়েতে?
সন্ধ্যা মাটির দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ খুশি না হওয়ার কি আছে?
-“ খুব সাধারণ ভাবে বিয়ে করতে চাচ্ছি বলে কি কোনো সমস্যা হবে তোমার? ভেবো না যে টাকা বাঁচাতে এই পথ অবলম্বন করেছি।
-“ না না এসব ভাবি। আমারও ভীষণ ইচ্ছে ছিলো সিম্পল ভাবে বিয়ে করার।
-“ যাক তাহলে আর সমস্যা ই রইলো না। তা মিস সন্ধ্যা শুনুন
-“ হু বলুন।

-“ একটু কি জড়িয়ে ধরা যাবে আমায়? না মানে খুব ইচ্ছে করছে একটু আলিঙ্গন করার।
সন্ধ্যা চোখ তুলে তাকালো। আষাঢ় ভাবলো হয়তো সন্ধ্যা রেগে গেছে। সেজন্য বলল-
-“ না না থাক এমনি বলেছি রেগে যেওনা প্লিজ। আমার লাগবে না আলিঙ্গন।
সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকালো
-“ আমার রাগ কে ভয় পান?
-“ ভীষণ।
কথাটা শুনে সন্ধ্যা মুচকি হাসলো। আষাঢ় কে অবাক করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল-
-“ নারীকে ভয় পাওয়া পুরুষ গুলো মারাত্মক হয় জানেন। আই লাইক দ্যিস ম্যান।
এই প্রথম সন্ধ্যা আষাঢ় কে জড়িয়ে ধরলো। সন্ধ্যার কথা কানে আসতেই আষাঢ় সন্ধ্যার কানের। কাছে ফিসফিস করে বলল-

-“ উষ্ণ আলিঙ্গনে কেটে যায় শতকের বিষন্নতা, ওজন কমে একাকিত্বের মিস সন্ধ্যা। আর আমি ভীষণ বউ প্রিয় একজন বউ পাগল পুরুষ হবো। তাই বউয়ের সব বিষয়ে রাখবো। আমি মোটেও চাই না কোনো এক সিম্পল ওয়ার্ডের জন্য আমার প্রিয় নারী কখনও কষ্ট পাক।
কথাটা কানে আসতেই লজ্জায় লাল নীল হয়ে গেলো সন্ধ্যা। ছিটকে সরে আসলো আষাঢ়ের বুক থেকে। আষাঢ় শব্দ করে হেসে বলল-
-“ সরে গেলে কেনো?
-“ তো কি করবো জড়িয়ে ধরেই থাকবো?
-“ থাকলে মন্দ হতো না।
-“ নিরামিষ হোন এতো আমিষ লোক আমার সহ্য হয় না।
-“ একটু কষ্ট করে মানিয়ে নাও আমিষ আমিটাকে। নিরামিষ হলে কখনই বাচ্চার মুখ দেখতে পারবো না। তখন লোকে বলবে আষাঢ় আহমেদ একজন ডক্টর হয়েও বিশেষ কাজে দূর্বল।

কোচিং সেন্টার থেকে আজ এক সাথে বের হয়েছে রাত আর কনা। দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে রিকশার জন্য রাস্তায়। রিকশাটার ও আজ দেখা নেই। মিনিট দশেক পর এক রিকশা আসলো। কনা দেখামাত্রই আগে ডেকে উঠলো। রিকশাওয়ালা আসতেই কনা রিকশায় উঠে বসলো। আশেপাশে রিকশা না দেখে রাতের দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ আপনি চাইলে উঠতে পারেন রিকশায়। আমরা তো একই বাসায় যাচ্ছি।
রাত গম্ভীর মুখে বলল-

-“ নো থ্যাংকস।
-“ ভেবে বলুন। আশেপাশে কিন্তু কোনো রিকশা নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে হবে অনেকক্ষণ। এরচেয়ে ভালো উঠে আসুন। ডোন্ট ওয়ারি আমি ভাড়া দিয়ে দিব। মেয়ে বলে ফায়দা উঠাবো না।
-“ ব্যপার কি বলো তো?
-“ কিসের ব্যাপার?
-“ সেধে সেধে উপকার করছো যে?
-“ আরে আপনি তো আমার বান্ধবীর দেবর.. তো আপনার সাথে বাজে বিহেভিয়ার করলে পরে যদি আমার বান্ধবী শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার পর অত্যাচার করেন তখন? এজন্য ভাবছি এখন থেকে আপনাকে বেয়াই এর মতো ট্রিট করবো।
একটা রিকশা আসতেই রাত রিকশা কে ডাক দিয়ে বলল-

-“ রিকশা চলে এসেছে। আর দরকার নেই তোমার উপকারের।
কনা মুখ ভেঙালো। রাত অন্য রিকশায় উঠে বসলো। কনা বিরক্তিকর মুখ নিয়ে বলল-
-“ এই মামা চলো। মানুষ জনের যেচে উপকার করতে নেই হু।
আমেনা বেগম বিকেলের দিকে সন্ধ্যা আর কনাকে নিয়ে স্বর্ণকারের দোকানে আসে। সন্ধ্যার হাতের মাপে আংটি বানাতে দিলো। কারন এ সপ্তাহে তাদের এনগেজমেন্ট। আংটির মাপ দিয়ে দোকান থেকে বের হতেই রাস্তার পাশে ফুচকার স্টল দেখে কনা বলে উঠলো-

-“ আন্টি শুনুন না। বলছি কি..
-“ হু বলো মেয়ে।
-“ ফুচকা খাই চলুন। স্টল দেখেই আমার জিভে জল চলে আসছে।
-“ তুমি আর সন্ধ্যা গিয়ে খেয়ে আসো।
-“ সে কি আপনি যাবেন না?
-“ না তোমরা যাও।
-„ তাহলে আন্টি চলুন বাসায় ফিরে যাই।
-“ কেনো? তুমি না বললা ফুচকা খাবা?
-“ আপনার ও খেতে হবে আমাদের সাথে।
-“ বাহিরের খাবার খেতে পারি না মা,,পেট খারাপ হয় আমার।
-“ একদিন খেলে কিচ্ছু হবে না। যদি রাজি থাকেন তবেই আমরা খেতে যাব। তা না হলে দরকার নেই।
-“ আচ্ছা চলো একটা খাবো।
-“ ওক্কে চলুন।

সন্ধ্যা আমেনা বেগম, আর কনা মিলে স্টলে গিয়ে তিন প্লেট ফুচকা অর্ডার দিলো। আমেনা বেগম তিনটা খেয়ে আর খেতে পারলো না। বিল মিটিয়ে তারা বাসায় চলে আসলো। সন্ধ্যা নিজের রুমে আসতেই দেখলো তার ফোনটা বেজে উঠেছে। ফোনটার দিকে তাকাতেই দেখলো আষাঢ় ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে আষাঢ় বলে উঠল-
-“ বাসায় এসেছো?

-“ হু। কেবলই আসলাম।
-“ ওহ্ আচ্ছা রাতে বের হতে পারবে?
-“ কেনো?
-“ এনগেজমেন্টের জন্য শপিং করতে।
-“ এটার জন্য কিসের শপিং করা লাগবে আর?
-“ পোষাক কিনবো না!
-“ ওহ্ আজই?
-“ হু কেনো কোনো সমস্যা?
-“ ক্লান্ত ভীষন। আপনি আপনার পছন্দ মতো কিছু কিনে আনুন।
-“ যদি তোমার পছন্দ না হয় তখন?
-“ আমি ওমন মেয়েই নই। যে জামা কাপড় পছন্দ অপছন্দ নিয়ে পড়ে থাকবো। পড়া গেলেই হলো।
-“ আচ্ছা তবুও আমি বরং মলে গিয়ে ছবি পাঠাবো। তুমি দেখে নিবে একবার। কেমন?
-“ আচ্ছা।
-“ রাখছি এখন।

সন্ধ্যা শরীর থেকে ওড়না টা খুলে ফ্যানের ফুল স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে বিছানায় বসতেই কনা দৌড়ে এসে জানালো নিখিল আবার ডিভোর্স প্যাপার পাঠিয়েছে উকিল দিয়ে। সন্ধ্যা ওড়না টা জড়িয়ে বের হলো রুম থেকে। বসার ঘরে আসতেই দেখলো শ্রেয়া প্যাপার টা ধরে বরফের মতো বসে আছে। নজরুল ইসলাম শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সই করছে না দেখে উকিল বলল-
-“ আপনি কি সই করবেন না? কি দরকার তার সাথে থাকার যে আপনাকে তার সাথে রাখতে চাইছে না।
সন্ধ্যা তপ্ত শ্বাস ফেলে শ্রেয়ার উদ্দেশ্যে বলল-
-“ মিনিমাম যদি তোর আত্মসম্মান থেকে থাকে তাহলে প্যাপারে সই করে ঐ লোকটার মুখের উপর ছুঁড়ে দে। আর যদি বেহায়া নির্লজ্জ হয়ে থাকিস তাহলে তার পা ধরে বসে থাক। আর লাত্থি উষ্টা খেতে থাক। এই একই কাহিনি আর ভালো লাগছে না।

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ১৬

শ্রেয়া সন্ধ্যার দিকে তাকালো। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। আসলেই বেহায়া হয়ে যাচ্ছে সে। সন্ধ্যা চলে গেলো। শ্রেয়া কাঁপা কাঁপা হাতে সই করে দিলো ডিভোর্স প্যাপারে৷ উকিল চলে গেলো প্যাপার টা নিয়ে। যে যার রুমে চলে গেলো শ্রেয়া গাল বেয়ে আসা জল টা মুছে বলল-
-“ অতঃপর মুক্তি দিয়ে দিলাম তোমাকে। আর বুঝলাম জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায় না।

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ১৮