আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ৩

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ৩
Raiha Zubair Ripti

আকস্মিক সন্ধ্যার দিকে আকাশের বুক চিঁড়ে আবির্ভাব হয় প্রলয়কারী ঝড়ের। ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়েই বিদ্যুৎ চলে গেছে। পাঁচ তালার ভবন টি এখন পুরোপুরি বিদ্যুৎ বিহীন। জেনারেটর ও চালু হচ্ছে না। তা দেখে বিরক্তিতে চ সূচক উচ্চারণ করলো সন্ধ্যা। ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে বসার ঘরে এসে নয়না বেগম কে ডেকে বললেন-
-“ চাচি মোমবাতি আছে কি বাসায়?
সন্ধ্যার ডাক শুনে বেরিয়ে আসলো রুম থেকে নয়না বেগম।
-“ হ্যাঁ আছে। লাগবে?
-“ হ্যাঁ লাগবে।

নয়না বেগম রান্নাঘর থেকে মোমবাতি জ্বালিয়ে সন্ধ্যার হাতে দিলো। সন্ধ্যা মোমবাতি নিয়ে রুমে আসার জন্য পা বাড়াতে নিলে হঠাৎ দরজায় খটখট শব্দ শুনতে পায়। সন্ধ্যা মোমবাতি নিয়েই দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো। মোমবাতির আলোয় আলোকিত হলো রাতের চেহারা টা। রাত সন্ধ্যার মুখের দিকে তাকালো। মোমবাতির আলোয় সন্ধ্যার মুখটা বেশ মায়াবী লাগছে। ইশ মেয়েটাকে একটু দেখার জন্য ই এই সাঝ সন্ধ্যায় আসা। সন্ধ্যা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো রাত কে ভেতরে আসতে দেওয়ার জন্য। রাত ভেতরে ঢুকলে সন্ধ্যা দরজা আঁটকে দিয়ে বলে-

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“ আমি আসার পর আপনি যতবার এসেছেন আমাদের বাসায় ততবারই ভুলভাল সময়ে চলে এসেছেন।
রাত বিরবির করে বলল- ভাগ্যিস ভুলভাল সময়ে চলে এসে আপনায় দেখেছিলাম। তা না হলে এই জীবন টা বৃথাই থেকে যেত আপনাকে না দেখার আফসোসে।
-“ কিছু বললেন?
রাত সন্ধ্যার দিকে ফিরে চিনির বাটিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
-“ না না কিছু বলি নি। এই যে এটা সুগার.. আই মিন চিনি.. চিনি দিতেই আসা।
সন্ধ্যা চিনির বাটি টা টেবিলের উপর রেখে রাত কে বসার রুমে রেখে চলে যেতে নিলে রাত পেছন থেকে ডেকে বলে উঠে –

-“ আরে মোমবাতি নিয়ে যাচ্ছেন কোথায়?আপনার বাসার গেস্ট আমি।
সন্ধ্যা পেছন ফিরে বলল-
-“ তো?
-“ তো মানে? আতিথিয়েতা করবেন না আমার?
সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকালো। চাচি কে ফের হাঁক ছেড়ে ডাকলো। নয়না বেগম ফের রুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল-
-“ আবার কিছু লাগবে?
সন্ধ্যা রুমে যেতে যেতে বলল-
-“ না আমার কিছু লাগবে না। উনার আতিথিয়েতা লাগবে। একটু আতিথিয়েতা দাও তাকে।
সন্ধ্যা চলে গেলো। নয়না বেগম রাতের দিকে এগিয়ে এসে পাশে বসে বলল-

-“ কি লাগবে তোমার রাত?
রাত এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল-
-“ কই কিছু না তো আন্টি। আসলে চিনি দিতে এসেছিলাম। নিখিল ভাইয়া কোথায়?
-“ ওর তো জ্বর এসেছে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।
-“ ওহ্। চলুন আমাদের বাসায় যাই। আপনারা তো আর সেধে আসবেন না আমার মতো। তাই বলেই নিচ্ছি।
-“ আপা কি করছে? নিয়ে আসতে সাথে করে।
-“ মা তো জানেই না আমি আপনাদের বাসায় এসেছি। সেই সকালে বলেছিল চিনি দিয়ে আসতে। আলসেমির জন্যে আসা হয় নি।

-“ ওহ্ আচ্ছা।
-“ যাবেন?
-“ এখন আর না যাই। কাল সকালে যাব নি।
-“ আচ্ছা তাহলে উঠছি।
রাত একবার ভেতর ঘরের দিকে চোখ বুলালো। একটু যদি সন্ধ্যার দেখা পেতো। কিন্তু নাহ্ পেলো না। সন্ধ্যা কে দেখতে না পেয়ে অগ্যত চলে গেলো। রাত বাসায় আসতেই দেখতে পেলো তার মা ফোনে কথা বলছে। রাত এগিয়ে মায়ের কাছে গেলো। ফিসফিস করে বলল-
-“ কে ভাইয়া?

আমেনা বেগম ইশারায় বুঝালেন হ্যাঁ। রাত সরে আসলো। তার ভাই প্রচুর রাগী,বদমেজাজি। রাত ভীষণ ভয় পায়। রাত সোফায় বসে অপেক্ষা করলো তার মায়ের কথা বলা শেষ হবার। কথা বলা শেষ হলে রাত ফের জিজ্ঞেস করে-
-“ ভাইয়া আসবে কবে?
-“ দু একের ভেতর চলে আসবে।
-“ ওহ্। ভাইয়া আসা মানেই তো মা আমার স্বাধীনতা হারানো। প্লিজ মা এবার ভাইয়ার একটা বিয়ে দিয়ে দাও। যত শাসন সব বউকে করুক। এতো বড় হয়ে গেছি তবুও ভাইয়া আমায় শাসন করে। এই দুঃখ আমি কোথায় রাখবো বলো?
আমেনা বেগম রাতের মাথায় হাত দিয়ে এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে বলে-

-“ বড় ভাই নামক মানুষ টা আছে বলেই এতো সুন্দর ইজিলি লাইফ লিড করতে পারছিস। তার সামান্য শাসন টলারেট করতে পারিস না?
রাত চোখ ছোট ছোট করে বলল-
-“ অ্যা’ম জোকিং মা।
-“ আচ্ছা আয় খেতে বস।

সন্ধ্যা রুমে এসে মোমবাতি টা টেবিলের উপর রাখে। ল্যাপটপে জরুরি কাজ করছিল ঝড় আসার আগে। এখনও ল্যাপটপ টা ওপেন দেখে সেটা বন্ধ করে বিছানায় বসলো। ফোনের লক খুলে ফেসবুকে ঢুকল আজ দুদিন পর। ফেসবুকে ঢুকতেই দেখতে পেলো রিকুয়েষ্ট অপশনে অনেক গুলো নতুন ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট এসেছে। অচেনা সবাই। সেজন্য সন্ধ্যা আর এক্সেপ্ট করলো না। নিউজ ফিড স্ক্রোল করতে লাগলো। মিনিট দশ যেতে না যেতেই আবার একটা নোটিফিকেশন আসলো। কেউ তাকে মেসেজ দেওয়ার ট্রাই করছে। সন্ধ্যা মেসেজ রিকুয়েষ্ট অপশনে গেলো। দেখলো একটা অচেনা আইডি থেকে মেসেজ দেওয়া হয়েছে। আইডিটার নাম দেখে আপনা-আপনি ভ্রু কুঁচকে আসলো সন্ধ্যার। আইডিটার নাম “ আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা ” দেওয়া। আর মেসেজ দিয়েছে— অপ্রিয়তার এক সন্ধ্যায় তোমায় জানাচ্ছি এক কাপ চায়ের নিমন্ত্রণ।
সন্ধ্যা পাল্টা মেসেজ দিলো-

-“ কে আপনি?
সময় নিলো না মেসেজের ওপাশে থাকা ব্যক্তি সিন করতে। সাথে সাথে জবাব পাঠালো-
-“ মানুষ।
-“ সেটা আমি ও জানি। মানুষ ছাড়া তো আর কোনো প্রাণী পশু ফোন চালায় না।
-“ বাহ্ বেশ ব্রিলিয়ান্ট আপনি।
-“ পরিচয় টা দিন। তা না হলে ব্লক করতে বাধ্য হব।
-“ পরিচয়?
-“ জ্বি।
-“ অপরিচিত থাকি। কখনও সুযোগ হলে পরিচয় দিব।
-“ তার মানে কি আপনি বা আমি পরিচিত?

মেসেজ টা সেন্ট হলো। কিন্তু ডেলিভারি হলো না। সন্ধ্যা বুঝলো মেসেজের ওপাশে থাকা মানুষটা লাইনে নেই। সন্ধ্যা ফোনের ডাটা বন্ধ করে বিদ্যুৎ আসার অপেক্ষা করতে লাগলো। ঘন্টাখানেক পর ঝড় থামলে বিদ্যুৎ চলে আসে। রাতের খাবার খাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হয় সন্ধ্যা। খাবার টেবিলে সবাই আছে শুধু শ্রেয়া নিখিল নেই। নজরুল ইসলাম নয়না বেগম কে জিজ্ঞেস করলেন-

-“ ভাবি নিখিল শ্রেয়া আসলো না যে খেতে?
-“ নিখিলের তো শরীর অসুস্থ রুমেই আছে। শ্রেয়া খাবার নিয়ে গেছে।
সন্ধ্যা চুপচাপ খাবার খেয়ে হাত ধোয়ার জন্য বেসিনে আসলো। হাতটা ধুয়ে রুমের দিকে যেতে নিলে চোখে পড়লো শ্রেয়া দের রুমের দরজা খোলা। নিখিল আধশোয়া হয়ে আছে। শ্রেয়া সযত্নে খাইয়ে দিচ্ছে। আর নিখিল খাচ্ছে। কি যেনো হলো সন্ধ্যার বুকটায়। ভীষণ ব্যথা অনুভব হলো। আর এক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে নিজের রুমে চলে আসলো। দরজা আঁটকে বিছানায় বসলো। মাথায় দু হাত দিয়ে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চেষ্টা করতে লাগলো। বুকে জ্বালা হচ্ছে। সন্ধ্যা বুকে হাত ঘষতে ঘষতে বলল-

-“ কন্ট্রোল সন্ধ্যা কন্ট্রোল। কিচ্ছু হয় নি তোর। তুই স্ট্রং। এসব অহরহ ঘটবে তোর চোখের সামনে। তুই আবেগ নিয়ন্ত্রণ কর। এতো বছর ধরে পোষা রাগ ঘৃণা টাকে সামান্য কিছু দৃশ্য দেখে হারিয়ে ফেলিস না। মনে করার চেষ্টা কর ওরা কিভাবে তোকে ঠকিয়েছিল। ওরা প্রতারক। ওদের তুই সারাজীবন ঘৃণা করবি।
এদিকে,, ডক্টর আরাফাত বসে আছে বেলকনিতে। হাতে জ্বল জ্বল করছে মুঠোফোন। দৃষ্টি তার ফোনের দিকেই। থেকে থেকে মুচকি হাসছে আরাফাত। হঠাৎ আকস্মিক দরজা খোলার শব্দ পেতেই তড়িঘড়ি করে ফোনটা পকেটে ঢুকালো। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলো তার মা চলে এসেছে। আরাফাত এগিয়ে গেলো। আরাফাতের মা বিরক্ত হয়ে বলল-

-“ হসপিটাল থেকে এসেছিস সেই কখন? এখনও রুমের মধ্যেই আছিস। বলছি রাতের খাবার কি মুখে নিবি না?
আরাফাত মায়ের কাধে দু হাত দিয়ে রুম থেকে বের হতে হতে বলল-
-“ হু খাবো তো। তুমি খেয়েছো?
আরাফাতের মা আরিফা বেগম খাবার বাড়তে বাড়তে বলল-
-“ তোকে ছাড়া আমি কখনও খেয়েছি?
আরাফাত খাবার খেতে লাগলো। আরিফা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-
-“ একটু কি মায়ের দিক টা বুঝবি না তুই?
আরাফাত খাবার খেতে খেতে বলল-

-“ কি বুঝবো মা?
-“ এই যে সারাটা দিন একা একা বাসায় কাটাতে হয়। আমার ও বয়স হয়েছে। তোর ও হচ্ছে।
-“ হু।
-“ হু কি? বিয়ে সাদি করবি না?
আরাফাত বিরক্তিকর চাহনি নিয়ে বলল-
-“ কি মা খাওয়ার সময় বিয়ে বিয়ে করছো। ওসব বিয়ে টিয়ে এখন করবো না। বিয়ে করা মানেই নিজের স্বাধীনতা হারানো। এতো তাড়াতাড়ি হারাতে চাই না স্বাধীনতা।
-“ ফাজলামো বন্ধ কর। বিয়ে মানেই স্বাধীনতা হারানো তোরে কে বলছে?
-“ তোমার অতি প্রিয় গুনধর সেই মানুষ টা।
-“ তোদের দুটোর মাথায় এই ভুলভাল তথ্য কে ঢুকাইছে সেটা বল।
-“ ওর মাথায় কে ঢুকাইছে সেটা জানি না। তবে আমার মাথায় ও ঢুকাইছে। ইউ নো উই আর বেস্ট ফ্রেন্ড। ও যে পথে হাঁটবে আমি ও সে পথেই হাঁটবো।

-“ ও যদি সারাজীবন বিয়েই না করে তাহলে কি তুই ও করবি না নাকি?
-“ হ্যাঁ আমিও করবো না।
-“ নাতিনাতনির মুখ দেখবো না আমি?
-“ যেখানে বউমার মুখ দেখাই অনিশ্চিত হিসাব সেখানে নাতিনাতনি অব্দি যাচ্ছ কেনো?
-“ আজকাল কার জেনারেশনের ছেলে তোরা। তোরা থাকবি বিয়ে পাগল। তা না তোরা এমন কেনো?
-“ সবাই যদি বিয়ে পাগল হয় তাহলে সিঙ্গেল পদের সভাপতি থাকবে কে বলো? আর প্যারা নিও না। কপালে বিয়ে থাকলে হয়ে যাবে কোনো একদিন।

-“ ততদিন যেনো আল্লাহ আমায় বাঁচিয়ে রাখে।
আরাফাত আর কিছু বললো না। চুপচাপ খেতে থাকলো। মনে মনে ভাবছে অন্য কিছু। সে কি তার বেস্ট ফ্রেন্ডের অপেক্ষায় থাকবে নাকি? সে তো বিয়ে করেই ফেলবে চটজলদি। মেয়েও ঠিক। এখন সময় বুঝে সব ফটাফট করে ফেলবে।
আরিফা বেগম লম্বা করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো। ছেলে দুটোর বয়স ৩০ হতে চলল। অথচ তাদের বিবাহ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। আদোও এদের কপালে বউ থাকবে তো?
অথচ আরিফা বেগম জানলোই না তার ছেলে মনে মনে সব ভেবে রেখেছে।

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ২

সাত তালার একটি দালানের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে একটি ২৯ এর কোঠায় পা দেওয়া এক সুদর্শন পুরুষ। পড়নে তার সাদা শার্ট। একটু আগেই ঝড় থেমে গিয়ে এখন শীতল বাতাস বইছে। আজ বেশ ফুরফুরে লাগছে তার। হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে সে তার প্রাপ্তির খুব কাছাকাছি। এতোদিন ধরে যেই প্রাপ্তির অপেক্ষায় ছিলো সেটা এখন তার আশেপাশেই আছে। যে কোনো সময় নিজের শক্তপোক্ত খোলস ছাড়িয়ে তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে দু বারও ভাববে না এই জেদি বদমেজাজী রাগী পুরুষ টি।

আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ৪