আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ৩০
Raiha Zubair Ripti
সন্ধ্যা, কনা,আমেনা বেগম আর রাত খাবার টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছে। সন্ধ্যা খাবার ফাঁকে আষাঢ় কে একবার ফোন করলো। কিন্তু ফোন রিসিভ হলো না। কাজে ব্যস্ত আছে ভেবে দ্বিতীয় বার আর ফোন করলো না। ব্রেকফাস্ট করে থালাবাসন সব ধুয়ে উপর করে রেখে নিজের রুমে আসলো। ওয়াইফাই টা অন করতেই ফোনের স্কিনে আষাঢ়ের ছোটো একটা মেসেজ আসলো— সন্ধ্যাবতী ইমার্জেন্সি হসপিটালে যেতে হচ্ছে এই রাতে। তোমার এই নিদারুণ ঘুম টাকে ভাঙতে ইচ্ছে করলো না। সেজন্য আর ডাকি নি। মেসেজে বলে গেলাম।
সন্ধ্যা স্মিত হেসে উঠলো। ফের আষাঢ়ের নম্বরে কল করলো। একটু খানি তার কণ্ঠ স্বর শোনার জন্য। কিন্তু এবারও ফোন রিসিভ হচ্ছে না। লোকটা সকালের খাবার খেয়েছে তো? জিজ্ঞেস ও তো করতে পারতেছে না। সন্ধ্যা ভার্সিটির জন্য প্রেজেন্টেশন করায় মনোযোগ দিলো।
রুমের এক কোনে সোফায় বসে আছে কনা। সামনেই বেডে বসে আছে রাত। কনা রাত কে পরখ করে নিলো। রাত চিন্তিত। কনা কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো।
-“ আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো।
রাত একপলক তাকালো কনার দিকে।
-“ কি কথা?
-“ আপনার না বাহিরে যাবার কথা ছিলো? তাহলে সেখানে না গিয়ে বিয়েতে আসলেন কেনো?
-“ তুমি তো চেয়েছিলে আমার জীবনে যেনো তোমাকে ঠাই দি। সেজন্য দিলাম ঠাই।
-“ বিশ্বাস হচ্ছে না কথাটা। রাহুল কেনো করলো না আমায় বিয়ে? হিসেব তো মিলছে না।
-“ এতো হিসেব ক্যান মিলাতে হবে তোমার? হতে চেয়েছিলে আমার বউ হয়ে গেছো ব্যাস। তাহলে এত কথা কেনো?
কনা ভ্রু কুঁচকালো। এটা কোন টোনে কথা বললো রাত?
-“ এভাবে কথা বলছেন কেনো? আমি জানতে পারবো না আপনি কেনো আমায় বিয়ে করলেন? যে ছেলে আমাকে তার লাইফে জড়াতে চায় নি আকস্মিক বিয়ের দিন এসে বিয়ে করে নিলো। কোনো কারন ছাড়াই?
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
-“ আমি আসছি।
রাত বাহিরে চলে গেলো। কনা সোফায় বসে ভাবলো একবার সন্ধ্যাকে জিজ্ঞেস করবে। সেজন্য রুম থেকে বেরিয়ে সোজা সন্ধ্যার রুমে আসলো। সন্ধ্যা কে ল্যাপটপে কাজ করতে দেখে কনা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো-
-“ ব্যস্ত নাকি এখন তুই?
-“ না না বস। কিছু বলবি?
-“ হু। আচ্ছা রাহুল কেনো আমায় বিয়ে করলে না। আর রাত কেনো আসলো?
-“ জানিস না এখনও?
-“ না। রাত কে জিজ্ঞেস করলাম সে বললে না।
-“ আচ্ছা বাদ দে সেসব কথা। রাতের বলা হলে সে নিজেই বলবে তোকে। এখন বিয়ে করে কি পড়াশোনা চাঙ্গে উঠিয়ে দিবি? আইইএলটিস ও তো সম্পূর্ণ করতে পারলি না বিয়ের চক্করে।
-“ অনার্স টা শেষ হলে আবার শুরু করবো।
-“ ঠিক আছে।
-“ আমি আসছি তাহলে।
কনা চলে গেলো। রুমে এসে ভাবতে লাগলো কিছু তো একটা হয়েছিলো বিয়ে তে। যার কারনে রাহুলের জায়গায় রাত এসেছিল। কনা একবার ভাবলো রাহুল কে ফোন করবে। কিন্তু শাশুড়ির ডাকে আর করতে পারলো না। ফোনটা বিছানা তে রেখেই শাশুড়ির কাছে গেলো।
বিকেল গড়াতেই আষাঢ় বাসায় আসলো। ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে আসতেই দেখতে পেলো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা ভেজা চুল মুছতেছে। কেবল গোসল করেছে বোধহয়। এপ্রন টা খুলে নিশ্চুপে সন্ধ্যাকে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ঘাড়ে মুখ গুঁজে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল-
-“ এতো দেরি করে গোসল কেনো করো? ঠান্ডা লাগবে তো।
-“ আমার অভ্যাস আছে। ঠান্ডা লাগবে না।
-“ দুপুরে খেয়েছো?
-“ হুমম। আপনাকে কত বার ফোন দিলাম রিসিভ তো করলেন না।
-“ সরি তার জন্য। আসলে ফোন টা কেবিনে রেখে অপারেশনে ছিলাম। তারপর অপারেশন থেকে বের হতেই জানলাম হসপিটালে নতুন এক ডক্টর আসতেছে। সেটা নিয়ে একটা মিটিং হলো। হয়তো আমাকে কয়েক মাসের জন্য দেশের বাহিরে যেতে হতে পারে।
-“ কয় মাসের জন্য?
-“ দু এক মাস।
-“ আমাকে ছাড়াই থাকবেন? মুখ ভার করে বলল সন্ধ্যা।
আষাঢ় সন্ধ্যাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল-
-“ তুমি যাবে সাথে?
-“ হুম।
-“ তোমার পড়াশোনার কি হবে তাহলে? সামনেই না তোমার এক্সাম আছে।
-“ আমাকে সাথে নিবেন না সেটা বলুন। পড়াশোনার বাহানা দিচ্ছেন কেনো?
আষাঢ় সন্ধ্যার মুখ ফোলানো দেখে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল-
-“ আচ্ছা নিয়ে যাব। হ্যাপি?
-“ আষাঢ় আছিস? কথাটা বলতে বলতে শ্রেয়া তাদের রুমের ভেতর ঢুকলো। সন্ধ্যা আকস্মিক শ্রেয়ার গলা শুনে ছিটকে উঠলো। দরজার পানে তাকিয়ে শ্রেয়া কে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। একটা মানুষ এতটা ম্যানারলেস কি করে হয়? কারো রুমে ঢুকতে হলে তো নক করে আগে তার উপস্থিতি জানান দিতে হয়। আর এ সোজা রুমে ঢুকে এসেছে। সন্ধ্যা সরে আসতে চাইলো আষাঢ়ের থেকে। আষাঢ় সরতে দিলো না। বরং আগের মতই জড়িয়ে ধরে শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বলল-
-“ কারো রুমে ঢুকতে হলে নক করে ঢুকতে হয় সেটা কি ভুলে গেছিস?
শ্রেয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল-
-“ আমি কিভাবে জানবো তোরা রুমের দরজা খুলেই আষ্টেপৃষ্টে থাকবি। তা যা বলার জন্য এসেছিলাম শোন…
-“ বসার ঘরে গিয়ে বস। আমি আসছি ফ্রেশ হয়ে।
-“ ঠিক আছে তাড়াতাড়ি আসিস।
সন্ধ্যা সরে আসলো এবার। আষাঢ় ওয়াশরুমে যেতে নিলে সন্ধ্যা বলে উঠে –
-“ আপনার সাথে ওর কিসের কথা আছে?
-“ গিয়ে শুনলে তো বলতে পারবো কি কথা আছে।
-“ সকালে এসেও একাই পাগলের মতো বকবক করছিলো।
-“ নিখিল চলে যাওয়ার পর বোধহয় পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে তোমার বোন।
আষাঢ় একদম গোসল সেরে বের হয় রুম থেকে। বসার রুমে শ্রেয়া কে দেখে এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসে বলল-
-“ বল কি বলবি।
আষাঢ়ের পেছন পেছন সন্ধ্যা ও এসেছে। শ্রেয়া সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ সেই কখন এসেছি। তোর বউ তো এক কাপ চা কফি কিছুই খাওয়ার কথা বললো না।
-“ বাসা থেকে খেয়ে আসিস না নাকি এ বাসায় আসার আগে?
দাঁত চেপে বলল সন্ধ্যা। শ্রেয়া হেঁসে বলল-
-“ তোর হাতের চা দারুন। এক কাপ খাওয়া।
সন্ধ্যা রেগে তাকালো। রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল-
-“ এরপর এ বাসায় আসলে বাসা থেকে চা সহ চায়ের কাপ নিয়ে আসবি খেতে খেতে।
-“ কি বলবি তাড়াতাড়ি বল শ্রেয়া।
-“ হু বলছি। তোর কি শাম্মির কথা মনে আছে?
-“ কোন শাম্মি?
-“ আরে ভুলে গেলি? কলেজ লাইফে যেই মেয়ে তোর পেছন পড়ে ছিলো আঠার মতো।
-“ হ্যাঁ মনে পড়েছে। তা হঠাৎ ওর কথা কেনো বলছিস?
-“ শুনলাম ও দেশে ফিরেছে।
-“ তো?
-“ বিশাল বড় ডক্টর।
-“ বাহ্ ডক্টর!
-“ হ্যাঁ।
-“ ভালোই।
কথাটা বলে আষাঢ় কানে এয়ারফোন গুঁজে ফোন চালাতে লাগলো।
-“ হু। আগের থেকে যা স্মার্ট হয়েছে না। সেদিন কথা হলো আমাদের। এখানেই কোন হসপিটালে যেনো জব হয়েছে..
-“ তারপর?
-“ মেয়েটা এখনও বিয়ে করে নি..
-“ তারপর?
-“ তোর কথা জিজ্ঞেস করলো..
-“ তারপর?
-“ বললাম তুই বিয়ে করেছিস আমার বোন কে।
-“ তারপর..
-“ তারপর আর কি..ও বলল তোকে এখনও ও ভুলতে পারে নি..
-“ তারপর?
শ্রেয়া ভ্রু কুঁচকালো।
-“ তারপর ও তোকে বিয়ে করতে চাইলো..
-“ তারপর?
-“ তারপর তোর মাথা।
-“ তারপর?
শ্রেয়া এবার বুঝলো আষাঢ় কোনো কথাই কানে নেয় নি।
-“ তারপর?
শ্রেয়া আষাঢ়ের কান থেকে এয়ারফোন খুলে নিলো। আষাঢ় পাশ ফিরে তাকালো।
-“ এয়ারফোন কেনো খুললি?
-“ আমি তোকে কিছু বলছিলাম।
-“ শুনেছি তো।
-“ কি বলেছি বল।
-“ শাম্মি কে নিয়েই তো বলছিলি।
-“ ও তোর সাথে দেখা করতে চায়।
-“ হ্যাঁ শুনলাম তো। আমাদের বাসায় নিয়ে আসিস। এক বেলা পেট ভরিয়ে খাইয়ে দিব। সন্ধ্যা কেও দেখা হয়ে যাবে।
শ্রেয়া আর কিছু বলার আগেই সন্ধ্যা এসে হাজির। চায়ের কাপ টা এগিয়ে দিয়ে বলল-
-“ নে খা।
শ্রেয়া চা টা খেয়ে নিলো। কনা শ্রেয়ার গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল অনেক আগেই। বাবার সাথে কথা বলছিল বেলকনিতে সেজন্য আসে নি। এখন বের হয়ে আসলো। শ্রেয়া কনা কে দেখে বলল-
-“ নতুন বউয়ের মুখ তো কিছু না দিয়েই দেখে ফেললাম। রাত কোথায়?
কনা ভ্রু কুঁচকালো। সন্ধ্যা মাঝখান থেকে বলে উঠল-
-“ তোর কাজ কি এই একটাই? বাসায় এসে জিজ্ঞেস করা একবার রাত কোথায় তো আরেকবার আষাঢ় কোথায়।
-“ তুই কেনো রেগে যাচ্ছিস এতে?
-“ রাগ হওয়াটা কি অস্বাভাবিক কিছু? দিনের বেশির ভাগ বেলা এখানে এসে টুকি মারিস। তুই বুঝতে পারিস না আমি তোকে আমার চোখের সামনে টলারেট করতে পারি না। তবুও কেনো আসিস?
-“ ইনসাল্ট করছিস আমাকে? আষাঢ় কিছু বল তোর বউ কে।
আষাঢ় সোফা ছেড়ে উঠে যেতে যেতে বলল-
-“ তোদের দু বোনের মাঝে আমি কি বলবো।
-“ তুই কথার মাঝে আবার উনাকে টানছিস কেনো?
-“ আমার ফ্রেন্ড আমি টানবো না?
-“ না টানবি না। ও আমার স্বামী।
-“ আরে থামো তোমরা। কেমন সতীনের মতো ঝগড়া করছো দু বোন ভাইয়াকে নিয়ে।
কনা বিরক্ত হয়ে বলল। শ্রেয়া কাপ টা রেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সন্ধ্যা মুখ বাকিয়ে বলল-
-“ খাওয়া শেষ এবার বিদায় হ। বাসায় চা পাতা না থাকলে বলিস দিয়ে আসবো। বাসায় বসে বানিয়ে খাস।
শ্রেয়া চলে গেলো। সন্ধ্যা দরজা আটকিয়ে রুমে এসে দেখলো আষাঢ় পানি খাচ্ছে। সন্ধ্যা এগিয়ে গিয়ে কোমরে দু হাত দিয়ে বলল-
-“ শাম্মি টা কে?
আষাঢ়ের মুখ ফস্কে পানি ফ্লোরে পড়ে গেলো। কাশি দিয়ে উঠতেই সন্ধ্যা তড়িঘড়ি করে আষাঢ়ের মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলল-
-“ দেখেশুনে পানি খাবেন তো।
আষাঢ় নিজেকে ঠিক করে নিলো। কাশি থেমে যেতেই সন্ধ্যা ফের জিজ্ঞেস করলো-
-“ শাম্মি টা কে?
-“ কে আবার একজন মেয়ে হবে।
-“ মেয়ে তো সেটা আমিও জানি। শ্রেয়া কেনো এই নাম বললো?
-“ আমাদের ক্লাসমেট ছিল।
-“ তারপর?
-“ ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে বাহিরে চলে গেছিল। দেশে নাকি ফিরেছে সেটাই বললো।
-“ ওহ্ আচ্ছা।
-“ হু। একটু শুবো আমি।
-“ তো না করেছে কে?
-“ আর কিছু জিজ্ঞেস করবা?
-“ না। তবে শ্রেয়ার সাথে বেশি কথা বলেন না।
-“ আচ্ছা।
রাত ঠিক ৭ টার দিকে রাত বাসায় ফিরে। সেই যে বের হয়েছে এখন আসলো। থমথমে মুখ করে বসে আছে। কনা কয়েকবার দেখলো।
-“ ডিনার করবেন না?
-“ হু।
-“ আসুন।
রাত ডিনার করে আসলো। কনা আজও শাড়ি পড়েছে। রাত বিছানায় এসে শুলো। কনাকে শুতে দেখে বলল-
-“ দিনে শাড়ি পড়বে ভালো কথা। রাতে একদম শাড়ি পড়ে ঘুমাবে না।
-“ কেনো?
-“ আমি বলেছি তাই। সেলোয়ার-কামিজ পড়ে ঘুমাও।
-“ কিনে দিয়েছেন? আর আমার আনা হয় নি জামাকাপড়।
-“ কাল এনে দিব সেলোয়ার-কামিজ। তারপর থেকে যেনো আর শাড়ি পড়ে ঘুমাতে না দেখি রাতে।
-“ শাড়ি পড়ে ঘুমালে সমস্যা কি আপনার?
-“ শাড়ি কি আদৌও সামলাতে পারো তুমি?
-“ মানে?
আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ২৯
-“ শাড়ির আঁচল থাকে এক জায়গায় আর তুমি থাকো আরেক জায়গায়। আমার অসুবিধা হয়।
কনা চুপ হয়ে গেলো৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আঁচলে সেফটিপিন গেঁথে বলল-
-“ আর পড়বো না রাতে শাড়ি। এই যে সেফটিপিন গেঁথে নিয়েছি।
-“ পায়ের দিক দিয়েও গাথো পাড়লে।
-“ আমি তাহলে আজকে আম্মার সাথে গিয়ে ঘুমাচ্ছি। পায়ে তো আর গাঁথতে পারবো না সেফটিপিন। তাহলে হাটবো কিভাবে। শাড়ি পড়লে সবার এমন হবেই স্বাভাবিক।
কথাটা বলে কনা চলে যেতে নিলে রাত বলে উঠে –
-“ মায়ের রুমে যাওয়া লাগবে না। ঘুমাও এ রুমেই। আমি আমার চোখ কেই সামলে নিবো।