আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ৩২
Raiha Zubair Ripti
নতুন সকাল..বয়ে আনে সুখবর। রাতের জন্য আজকের দিনটা একটু বেশিই স্পেশাল। কারন আজ তাকে জবের জন্য ডাকা হয়েছে। আজ সকাল ১০ টার দিকে ইন্টারভিউ। রাত নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছে। কনা রান্না ঘরে রান্না করতেছে। রাত রেডি হয়ে ডাইনিং টেবিলে আসলো। গলা ছেড়ে কনাকে ডেকে বলল-
-“ খাবার কি হলো?
কনা প্লেটে খাবার সাজিয়ে আনতে আনতে বলল-
-“ হ্যাঁ হয়েছে।
প্লেট টা টেবিলে রাখলো। রাত খেতে শুরু করলো। খাওয়া শেষে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কনার দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ আসছি।
কনা দরজার কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। রাত বের হতেই কনা পেছন থেকে বলে উঠল-
-“ অল দ্যা বেস্ট।
রাত পেছন ফিরলো। স্মিত হেঁসে চলে গেলো।
সন্ধ্যার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল ভোরের দিকে। আষাঢ় হসপিটালে আসার আগে সন্ধ্যার জ্বর চেক করে তাকে মেডিসিন খাইয়ে এসেছে। এখন সন্ধ্যার ফোনে ফোন দিলো সন্ধ্যার অবস্থা জানার জন্য। কিন্তু সন্ধ্যার ফোন সুইচ অফ। আষাঢ় কনা কে ফোন দিলো। কনা নিজের রুমে বসেছিল। আষাঢ়ের ফোন পেয়ে ফোন রিসিভ করতে ওপাশ থেকে আষাঢ় অস্থির কণ্ঠে বলে উঠল-
-“ কনা সন্ধ্যা কেমন আছে এখন?
-“ জ্বর কিছুটা কমে গেছে ভাইয়া। এখন শুয়ে আছে।
-“ খাইয়ে ছিলে কিছু?
-“ হ্যাঁ অল্প করে খেয়েছিল। আপনি চিন্তা করবেন না।
-“ আচ্ছা রাত বাসায়?
-“ না। উনি তো ইন্টারভিউ দিতে গেছে।
-“ ওহৃ আজ ছিলো ইন্টারভিউ?
-“ হ্যাঁ।
-“ আচ্ছা রাখছি তাহলে।
আষাঢ় ফোন কেটে দিলো। আকস্মিক দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতেই দরজার পানে তাকিয়ে দেখলো নার্স এসে দাঁড়িয়ে আছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
-“ সব রেডি করা হয়েছে?
নার্স মাথা ঝাঁকিয়ে হুমম বললো। আষাঢ় কেবিন থেকে বের হয়ে রেডি হয়ে নিলো অপারেশনের জন্য। অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতেই দেখলো শাম্মিও এসেছে। আষাঢ় শাম্মি কে এভয়ড করে অপারেশন শুরু করলো।
অপারেশনের পুরো টা সময় শাম্মি আষাঢ় কে হেল্প করেছে। সাকসেসফুলি তারা অপারেশন টা শেষ করে। অপারেশন শেষ করে আষাঢ় নিজের কেবিনে চলে আসে। নার্স কে ডেকে জেনে নেয় আজ আর কোনো অপারেশনের সিডিউল আছে কি না। নার্স জেনে জানালো আজ আর নেই। আষাঢ় হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসলো সন্ধ্যার দিকে। বাসায় আসার পথে শপিংমলে ঢুকলো। আজকাল শীত পড়ে খুব। সন্ধ্যা সহ বাসার সকলের জন্য শীতের পোশাক কিনে নিলো। মল থেকে বের হতেই ফুলের দোকানে চোখ গেলো। সন্ধ্যার ভীষণ পছন্দ ফুল। আষাঢ় সাদা গোলাপ সহ বেলি ফুলের মালা নিলো একটা। আজ সন্ধ্যা কে নিজ হাতে পড়িয়ে একটু বের হবে রাতে।
বাসায় ফিরতে আষাঢ়ের সাড়ে সাত টা বেজে গেলো৷ রুমে ঢুকে সন্ধ্যা কে মাথা চেপে সোফায় বসপ থাকতে দেখে আষাঢ় এগিয়ে গিয়ে পাশে বসলো৷ কাঁধে হাত রেখে বলল-
-“ খুব বেশি খারাপ লাগছে?
সন্ধ্যা মাথা তুলে তাকালো। পাশে আষাঢ় কে দেখে মুচকি হাসার চেষ্টা করলো৷
-“ ঠিক আছি।
আষাঢ় বসা থেকে উঠে ড্রয়ার থেকে জ্বর মাপার যন্ত্র টা বের করে সন্ধ্যার মুখে দিয়ে জ্বর চেক করে নিলো। না জ্বর বেশি নেই।
-“ জ্বর কমে গেছে। জাস্ট মাথা ব্যথা করছে। এক কাপ কড়া রং চা হলে ভালো হত। একটু কনা কে বলবেন বানিয়ে দিতে?
-“ হাঁটতে পারবে?
সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকালো।
-“ হাঁটতে পারবো না কেন?
-“ তাহলে চাদর টা পেঁচিয়ে নাও। তোমাকে নিয়ে আজ টঙের দোকানে গিয়ে চা খাওয়াবো। খাবে?
সন্ধ্যার চোখ মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো।
-“ সত্যি?
-“ হু।
সন্ধ্যা চাদর টা জড়িয়ে নিলো শরীরে। আষাঢ় গায়ের এপ্রন টা খুলে পোশাক বদলে একটা টাউজার আর শার্ট পড়ে তার উপর কালো হুডি পড়ে নিলো। সন্ধ্যা সোফায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। আষাঢ় ওয়ারড্রবের উপর রাখা ফুল গুলো হাতে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল-
-“ হাত দাও তো সন্ধ্যাবতী
সন্ধ্যা হাত বাড়িয়ে দিলো বিনা বাক্যে। আষাঢ় বেলি ফুলের মালা টা হাতে পড়িয়ে দিলো। সন্ধ্যা আষাঢ়ের দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ ফুল এনেছেন! আই লাভ ফ্লোয়ার।
-“ জানি তো সেজন্য আনা। উঠে দাঁড়াও তো।
-“ কেনো? আরো কিছু দিবেন নাকি?
-“ হুম।
সন্ধ্যা উঠে দাঁড়াতেই আষাঢ় সন্ধ্যার লম্বা কেশ খুলে দিয়ে কানের পাশে সাদা গোলাপ টা গুঁজে দিয়ে বলল-
-“ নাও পারফেক্ট।
সন্ধ্যা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আয়নায় নিজেকে দেখে বলল-
-“ কেমন দেখাচ্ছে আমায়?
আষাঢ় সন্ধ্যার পাশে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজে বলল-
-“ স্নিগ্ধ।
সন্ধ্যা হেঁসে ফেললো। আষাঢ় সন্ধ্যার হাত ধরে বেড়িয়ে গেলো।
রাত এসেছে অনেকক্ষণ হয়েছে। ইন্টারভিউ টা দারুন হয়েছে। আশা করছে জব টাও হয়ে যাবে। কনা কে এক মগ কফি আনতে বলে রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে জানালার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আকস্মিক চোখ গেলো রাস্তায়। বাড়ির সামনের রাস্তাতেই আষাঢ় সন্ধ্যা চাদর জড়িয়ে হাতে হাত রেখে হাঁটছে। দৃশ্য টা দূর থেকে দেখলো রাত কনা। কনা কেবলই এসেছে রাতের কফির মগ নিয়ে। সন্ধ্যা আষাঢ় কে দেখে মুচকি হেঁসে বলল-
-“খারাপ লাগছে?
রাত হকচকিয়ে গেলো পাশে কনা কে দেখে। মনে হলো চুরি করে ধরা পড়ার মতো অবস্থা। তড়িঘড়ি করে কনার হাত থেকে কফির মগ টা নিয়ে বলল-
-“ খারাপ লাগবে কেনো?
-“ প্রথম ভালোবাসা ছিলো কি না। সেজন্য।
-“ সেটা একান্তই আমার পৃথিবীতে ছিলো। একান্ত অনুভূতি একান্ত ভালোবাসা,সব একান্তই।
-“ আমি জানার পর তা আর একান্ত থাকে না।
-“ একটা ভুল দিনে জেনেগেছো।
-“ হয়তো। তবে আমি কখনই বলবো না প্রথম ভালোবাসা ভুলে যান।
-“ কেনো? তোমার হাসবেন্ড আরেকজন কে ভালোবাসবে আর তুমি না করবে না?
-“ না। আমি হিংসুটে মেয়ে নই। যে সামান্য এটা নিয়ে জেলাশ ফিল করবো। আমি জানি আপনি ভালোবেসে গেলেও তাকে পাবেন না। এখন আমিই আপনার বর্তমান ভবিষ্যৎ।
-“ মাঝেমধ্যে হিংসুটে হওয়া ভালো।
-“ এটা আমার দ্বারা হবে না।
-“ যদি ধরো আমার তোমার প্রতি ভালোবাসা আসলো না তখন?
কনা হাসলো।
-“ আমি সময়ে বিশ্বাসী। জানি উপরওয়ালা এতোটা নির্দয় আমার উপর হবেন না। যদি ধরুন আপনি আপনার প্রথম ভালোবাসা কে পান নি। তাহলে ধরে নিবেন আপনার ভালোবাসা টা ভুল ছিলো না৷ ভুল ছিলো ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবাসা। সেজন্য মানুষের জীবনে প্রথম ভালোবাসা খুব গভীর হয়! এজন্য দ্বিতীয়বার প্রেমের অনুভুতিটা চট করে আসে না, কিন্তু যখন আসে,তখন সেটা হয় প্রথম বারের চেয়েও আরো গভীর। আরো বিশুদ্ধ।
-“ খুব জানো দেখছি?
-“ আগে না জানলেও এই কয়েকদিনে উপন্যাস,বই পড়তে পড়তে জেনে গেছি।
-“ তোমাকে অখুশি আমি কখনই রাখবো না কনা।
-“ খুশিও তো রাখতে পারছেন না রাত।
-“ কি করলে খুশি হবে?
-“ আমি তেমন আহামরি কোনো কিছু চাই না রাত। আমাকে শুধু একটু সময় উপহার দিবেন। একটু ভালো করে হাসিমুখে কথা বলবেন। মাঝরাতে হঠাৎ করে রাতের শহরে ঘুরতে বের হবেন আমার সাথে। মাঝেমধ্যে বাসায় আসার পথে আমার জন্য ৩০ টাকা দিয়ে একটা ফুল কিনে আনবেন৷ ব্যস আর কিছু না। আমরা কি খুব ভালো ফ্রেন্ড হতে পারি না? ভালোবাসা তো চাইছি না। আপনার যখন ইচ্ছে হবে তখন না হয় বাসবেন জোর তো নেই এতে।
রাত চুপচাপ শুনলো কথা গুলো। কফির মগে চুমুক দিয়ে বাকি কফির মগ টা কনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল-
-“ খেয়ে নাও। শুনেছি স্বামীর এঁটো খাবার খেলে নাকি ভালোবাসা বাড়ে।
আষাঢ় সন্ধ্যা কে নিয়ে রাস্তার মোড়ে থাকা চায়ের দোকানে নিয়ে আসলো। দোকান টায় কেবল দু তিনজন বৃদ্ধ বসে চা খাচ্ছে আর গল্প করছে। আষাঢ় সন্ধ্যাকে একটি বেঞ্চে বসিয়ে দোকানদারকে ডেকে বলল,
– “দুই কাপ কড়া রঙ চা দিন।”
সন্ধ্যা চারপাশটা তাকিয়ে দেখল। ছোট্ট দোকানটা খুব সাধারণ, কিন্তু জায়গাটায় যেন এক ধরণের স্নিগ্ধতা আছে। হালকা শীতের সন্ধ্যায় গায়ে চাদর জড়িয়ে, মাথায় ফুল গুঁজে সে যেন আরও আলাদা লাগছে।
আষাঢ় তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
– “এখানে কি এত দেখার আছে?”
সন্ধ্যা হাসল।
– ” ভীষণ ভালো লাগছে।
চা এসে গেল। আষাঢ় একটা কাপ তুলে সন্ধ্যার হাতে দিল।
– “এই নিয়ে আজকে আমাদের প্রথম বাইরে বের হয়ে চা খাওয়া। বিশেষ মনে হচ্ছে না?”
সন্ধ্যা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হেসে বলল,
– “বিশেষ অবশ্যই। তবে চায়ের সঙ্গে যদি একটা চানাচুর থাকত!”
আষাঢ় হেসে দোকানদারকে ডেকে এক প্যাকেট চানাচুর নিয়ে নিল।
– “তোমার চাওয়া পূরণ হলো। আর কিছু লাগবে?”
সন্ধ্যা গম্ভীর মুখ করে বলল,
– “হ্যাঁ। গল্প চাই।”
– “গল্প?”
– “হুম। কিছু একটা বলো।”
আষাঢ় হেসে বলল,
– “ঠিক আছে, বলছি শুনো তাহলে।
সন্ধ্যা মুচকি হেসে বলল,
– “বলুন শুনি”
আষাঢ় শুরু করল:
– “একবার এক লোক বাজার থেকে একটা মোরগ কিনে আনল। মোরগটা খুব দুষ্টু! সারাক্ষণ বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করে, কাউকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। একদিন লোকটা রেগে গিয়ে মোরগকে বলল, ‘শুন! যদি শান্ত হয়ে না থাকিস, তোকে রান্না করে ফেলব।’
মোরগ কিছুক্ষণ শান্ত থাকল, কিন্তু পরদিন সকালে আবার পুরো উঠানে তাণ্ডব চালিয়ে দিল। লোকটা রেগে গিয়ে সত্যিই মোরগকে কেটে ফেলল আর রান্না করতে বসলো।
যেই রান্না শুরু হয়েছে, মোরগের ভূত লোকটার সামনে এসে দাঁড়ালো!
মোরগ বলল, ‘তোমার সাহস কীভাবে হলো আমাকে কাটার?’
লোকটা ভয় পেয়ে বলল, ‘ভাই, তুমি খুব দুষ্টু ছিলে, তাই বাধ্য হয়ে কেটেছি।’
মোরগ বলল, ‘শাস্তি হিসেবে তোমার পুরো জীবন আমাকে কক্কো ডাকতে হবে!’
লোকটা বলল, ‘ভাই, আমি মানুষ, কক্কো ডাকতে পারি না!’
মোরগ বলল, ‘আজ থেকে পারবা।’
পরের দিন থেকে লোকটা যেই মুখ খুলত, শুধু “কক্কো” বের হতো। দোকানে গিয়ে চা চাইতে গেলেও বলত, ‘কক্কো এক কাপ চা!’
লোকজন হাসতে হাসতে বলত, ‘ভাই, তুমি মানুষ, না মোরগ?’
এরপর লোকটা ডাক্তার দেখানোর জন্য গেল। ডাক্তার তাকে দেখে বলল, ‘আপনার এই রোগের জন্য একটা পোলাও রান্না করে খেতে হবে।’
লোকটা বলল, ‘কক্কো পোলাও!’
ডাক্তার বলল, ‘না, মুরগি পোলাও।’
শেষে লোকটা মোরগের ভূতের কাছে গিয়ে বলল, ‘ভাই, আমায় ক্ষমা করে দাও, আর কক্কো ডাকব না। এবার শান্তি দাও।’
মোরগ বলল, ‘এক শর্তে ছাড়ব, আমাকে রান্না করে খেয়েছ, এবার প্রতিদিন আমাকে পোলাও বানিয়ে দিবি!’
লোকটা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ভাই, তুমি ভূত হয়ে খাবার দাবি করছো?’
মোরগ বলল, ‘তাই তো! ভূত হলেও আমার স্টাইল আছে।’
, লোকটা প্রতিদিন কক্কো ডাক দিতে দিতে গ্রামের মানুষদের বিনোদনের কেন্দ্র হয়ে গেল।”
সন্ধ্যা হেসে কুটিকুটি হয়ে বলল,
– ” এটা গল্প ছিলো?
আষাঢ় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
– ” অবশ্যই।
সন্ধ্যা চায়ের কাপ নামিয়ে বলল,
– ” এসব গল্প কীভাবে বানান?”
আষাঢ় একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
– ” ওভাবেই।
আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ৩১
চায়ের দোকানে বসে তারা আরও কিছুক্ষণ গল্প করল। আষাঢ় মাঝে মাঝে সন্ধ্যার দিকে তাকাচ্ছিল। তার মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি, যা তার সমস্ত ক্লান্তি মুছে দেয়। দোকানে চায়ের টাকা টা দিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে তারা হাঁটতে হাঁটতে বাসার দিকে রওনা দিল। সন্ধ্যা গায়ে চাদরটা ঠিক করে বলল,
– ” আপনি সবসময় এমন থাকলে আমি কখনো অসুস্থ হব না।”
আষাঢ় হেসে বলল,
– “তুমি শুধু সুস্থ থাকো, আমি বাকিটা সামলে নেব।”