আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা শেষ পর্ব
Raiha Zubair Ripti
ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় আষাঢ় বাসা চেঞ্জ করে একটা ছয়তলা ভবনের তিন তলার ফ্ল্যাটে তিন রুমের সহ একটা স্টোর রুমের ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। এখান থেকে ভার্সিটি টা একটু দূরে। সন্ধ্যা কনাকে আষাঢ় দিয়ে আসে তো কখনও রাত৷ হাসিখুশিতেই দিন পার হয়ে যাচ্ছে তাদের। সন্ধ্যার প্রেগন্যান্সির যখন সাড়ে সাত মাস তখন কনা কিছুটা অসুস্থ হয়ে গেলো৷ ভার্সিটিতেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো কনা। ডেলিভারির দিন ঘনিয়ে আসছিলো বলে সাত মাস থেকেই একটু অনিয়ম করে ভার্সিটি যেত সন্ধ্যা। তো ভার্সিটির লোকজন পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলে জ্ঞান ফিরেনা বিধায় পাশেই থাকা হসপিটালে নিয়ে যায়। তখন ডক্টর চেক-আপ করে দেখে কনা প্রেগন্যান্ট। জ্ঞান ফেরার পর কনা কথাটা শুনতেই চমকে উঠে৷ কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলো। পেটে হাত দিয়ে থম মেরে কিছুক্ষণ বসে ছিলো। তারপর ডক্টরের থেকে রিপোর্ট গুলো নিয়ে বাসায় এসে সর্বপ্রথম রাত কে ফোন করে খবর টা জানালে। তার ঠিক ঘন্টাখানেক পরই রাত হাত ভর্তি মিষ্টি নিয়ে বাসায় ফিরে। সন্ধ্যা তখন বসার ঘরে বসে ছিলো৷ রাতের হাত ভর্তি মিষ্টি দেখে সন্ধ্যা একটু অবাক হয়ে বলল-
-“ মিষ্টি! কোনো সুখবর নাকি?
রাত মিষ্টির প্যাকেট গুলো টেবিলে রেখে হাসি মুখ নিয়ে এগিয়ে এসে বলল-
-“ আপনি জানেন না?
-“ কি জানবো?
-“ কনা কোথায়?
-“ রুমে হয়তো।
রাত সোজা রুমে চলে গেলো। রুমে ঢুকতেই চোখ গেলো বিছানায় । কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে কনা৷ রাত কনার কাছে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে কনার কপাল থেকে হাত সরিয়ে গালে হাত রেখে বলল-
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
-“ খারাপ লাগছে জান?
কনা আকস্মিক রাত কে দেখে অবাক হয়ে বলল-
-“ আপনি এখানে?
-“ হু অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে এসেছি। সত্যি বাবা হচ্ছি আমি?
কনা পাশ থেকে রিপোর্ট গুলো রাতের দিকে এগিয়ে দেয়। রাত রিপোর্ট গুলো দেখে কনাকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে৷ সে বাবা হবে! কি আনন্দ। কনার সারা মুখে অসংখ্য চুমু দিলো রাত৷ কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল-
-“ ধন্যবাদ জান। আজ আমি ভীষণ খুশি৷ আমার ছোট্ট দুনিয়া টা শুধু তোমাদের কেই ঘিরে। ভালোবাসি তোমাদের।
-“ সেম।
-“ আচ্ছা তুমি রেস্ট নাও আমি ভাবি,মা কে সুসংবাদ টা দিয়ে আসি।
রাত রুম থেকে বের হতেই দেখলো সন্ধ্যা মিষ্টির বক্স থেকে অলরেডি মিষ্টি খাওয়া শুরু করে দিছে৷ প্রেগন্যান্সির পাঁচ মাসের পর থেকেই সন্ধ্যা প্রচুর খায়৷ সন্ধ্যা রাত কে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেকি হেঁসে বলল-
-“ দেখে লোভ সামলাতে পারি নি তাই আর কি..
-“ আপনাদের জন্য ই এনেছি।
-“ কোন খুশিতে বললেন না তো।
-“ আমি বাবা হতে চলছি যে সেজন্য।
-“ বাবা না তো চাচা হতে যাচ্ছেন আপনি। মিষ্টি খেতে খেতে বলল সন্ধ্যা।
রাত হেসে বলল-
-“ চাচার সাথে বাবাও। কনা প্রেগন্যান্ট।
-“ ওও কংগ্রে… কিহ! কনা প্রেগন্যান্ট!
শেষের কথাটা অবাক হয়ে বলল।
-“ হ্যাঁ।
-“ কবে হলো। আমাদের তো বললো না কনা।
-“ আজই জানতে পেরেছে। সেজন্য ই তো শোনা মাত্রই ছুটে আসলাম।
সন্ধ্যা ছুটে আসলো কনার রুমে। কনাকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানালো৷ রাত মায়ের রুমে গেলো। মাকে মিষ্টি খাইয়ে সুখবর টা দিলো। আমেনা বেগম ফের দাদি হবার সুখবর শুনে খুশি হলেন। কনা কে গিয়ে দেখে আসলেন।
রাতে আষাঢ় ফিরলে সন্ধ্যা আষাঢ় কে এই সুখবর টা জানায়। আষাঢ় চাচ্চু হবে শুনে খুশি হলো। রাতের সাথে দেখা করে আসলো।
রাত সেদিনের পর থেকে কনার বেশি খেয়াল রাখা শুরু করলো। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করে। কনার যা খেতে ইচ্ছে করে মূহুর্তে সামনে হাজির করার চেষ্টা করে। মাঝেমধ্যে কনার মুড সুয়িং হলে দুজনে হাঁটতে বের হয়। সেসব দেখে সন্ধ্যা প্রতি মূহুর্তে আষাঢ় কে খোঁটা দিয়ে বলে-
-“ দেখেন রাত কনার যখন যা খেতে ইচ্ছে করে মুখের সামনে এনে হাজির করে। আর আপনি আমাকে বাহিরের খাবার খেতেই দেন না।
আষাঢ় কথার বিপরীতে সন্ধ্যার গালে চুমু খেয়ে বলে-
-“ কারন কনা তোমার মতো ওসব আনহেলদি ফুচকা চটপটি খেতে চায় না। ও হেলদি ফুড ফ্রুটস খেতে চায়। আর রাত কে আমিই বলেছি এসব চাইলে দিতে।
-“ তাই বলে আমাকে ওসব খেতে দিবেন না? এমনও তো হতে পারে বাবু হতে গিয়ে আমি ম’রে আসলাম। তখন তো খেতে না পারার আফসোস নিয়ে চলে যেতে হবে।
আষাঢ় শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সন্ধ্যা কে। কপালে চুমু খেয়ে বলল-
-“ এসব বলো না সোনা। কিছু হবে না তোমার। ফুচকা খাবে তো আমি বাসায়ই বানিয়ে দিব। তুমি আমাদের পুচকু সবাই সুস্থ থাকবে।
-“ আমি তো এমনি বলেছি। সিরিয়াসলি নিচ্ছেন কেনো? আমি এত সহজে ওপারে চলে যাচ্ছি না হু। আমি বাচ্চা মানুষ করবো। আপনাকে ভালোবাসবো,বাচ্চা কে বিয়ে দিব। ওর পুলাপানের সাথে ফুটবল খেলবো। কত কিছু করা বাকি এখনও জানেন?
আষাঢ় স্মিত হাসলো। তারপর কাজের বুয়াকে বাসায় কয়েকটা ফুচকা বানিয়ে দিতে বলল। বুয়া বানিয়ে দিলে আষাঢ় কনাকে ডেকে দুজন কে খেতে বলল।
এভাবেই কেটে গেলো আরো এক মাস। সন্ধ্যার পেট টা আগের তুলনায় আরো বড় হয়েছে। আলট্রা করে জেনেছি তাদের বাচ্চা আসার ডেট আরো এক মাস পর। তো নিত্য দিনের মতো আজ রাত নয়টার দিকে ডিনার করে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছিলো সন্ধ্যা। ঘরের লাইট নিভিয়ে বিছানায় শুতেই হাল্কা পেটে ব্যথা অনুভব করলো। প্রায়ই করতো ব্যথা। তো গুরুত্ব দিলো না। বাবু আসার ডেট তো এক মাস পর। আজ আষাঢ় বাসায় নেই। নাইট ডিউটি থাকায় হসপিটালে আছে। মৃদু ব্যথা নিয়েই সন্ধ্যা ঘুমানোর চেষ্টা করলো। রাত যখন এগারো টা বাজে তখন প্রচন্ড ব্যথা শুরু হলো পেটে। ব্যথার জন্য ঘুম ভেঙে গেলো। এমন ব্যথা শুরু হলো যে আর শুয়ে থাকতে পারলো না। আধশোয়া হয়ে মা মা বলে আমেনা বেগম কে ডাকতে শুরু করলো। আমেনা বেগম সন্ধ্যার গলার আওয়াজ শুনে ধড়ফড়িয়ে রুম থেকে আের হয়ে সন্ধ্যার রুমে আসলো। দরজা খোলাই ছিলো। আষাঢ় যেদিন নাইট ডিউটি করে সেদিন সন্ধ্যা দরজা আর ভেতর থেকে আটকায় না। আষাঢ় মানা করে রেখেছিল কারন কখন কোন দূর্ঘটনা ঘটে তা তো বলা যায় না। আমেনা বেগম ভেতরে এসে সন্ধ্যা কে আধশোয়া হয়ে কান্না করতে দেখে আত্মা বেরিয়ে আসার উপক্রম। তড়িঘড়ি করে পাশে বসে বলল-
-“ কি হইছে সন্ধ্যা? মা আমাকে বলো।
সন্ধ্যা ব্যথাযুক্ত পেটের উপর হাত রেখে বলল-
-“ আম্মা আপনার ছেলেকে খবর দেন। আমার পেটে প্রচন্ড ব্যথা করতেছে। আমি সহ্য করতে পারতেছি না আম্মা। আমার কষ্ট হচ্ছে খুব।
আমেনা বেগম রাত কে ডাকতে লাগলো। রাত কনা ধড়ফড়িয়ে উঠে আসলো। সন্ধ্যার রুমে এসে সন্ধ্যা কে ব্যথায় কান্না করতে দেখে রাত বুঝে গেলো পেইন উঠেছে। পকেট থেকে ফোন টা বের করে আষাঢ় কে ফোন দিলো। কিন্তু ফোন রিসিভ হচ্ছে না। কয়েকবার চেষ্টা করলো রিসিভ হলো না।
-“ মা ভাই হয়তো ওটিতে আছে ফোন রিসিভ হচ্ছে। ভাবি কে হসপিটালে নিতে হবে।
-“ হ্যাঁ তাড়াতাড়ি কর রাত সন্ধ্যার অবস্থা আরো অবনতি হচ্ছে তো।
রাত আর কোনো কিছু চিন্তা না করে সন্ধ্যা কে পাঁজা কোলে নিয়ে গাড়িতে বসালো। দু’পাশে কনা আর আমেনা বেগম বসলেন। রাত ড্রাইভ করে হসপিটালে আসলো। হসপিটালে ঢুকে ডক্টর কে ডেকে আনলো। ডক্টর সন্ধ্যার অবস্থা দেখে নার্স ডেকে সন্ধ্যা কে ভেতরে নিয়ে যেতে বলল। নার্সরা সন্ধ্যা কে নিয়ে গেলো। ডক্টর প্রথমে নর্মালে চেষ্টা করাবে। যদি না হয় তখন সিজার করাবে। রাতরা করিডরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। আষাঢ় সবেই অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে করিডর ক্রস করতেই বেখালিতে ঘাড় ঘুরাতেই রাত কে দেখতে পেয়ে চমকে উঠলো। এতো রাতে রাত হসপিটালে কেনো? সব ঠিক আছে তো? আষাঢ় হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসলো। সামনে দাঁড়িয়ে বলল-
-“ এতো রাতে হসপিটালে তোরা? সব ঠিক আছে তো? সন্ধ্যা.. ওকে দেখছি না কেনো?
আমেনা বেগম কান্না করতে করতে আষাঢ় কে জড়িয়ে ধরে বলল-
-“ সন্ধ্যা ব্যথা উঠছে। তোরে কত ফোন দিলাম তুই ধরলি না।
চমকে উঠলো কথাটা শুনে আষাঢ়।
-“ কোন কেবিনে আছে সন্ধ্যা?
কনা হাতের ইশারায় দেখালো। আষাঢ় সময় ব্যয় না করে কেবিনে ঢুকে গেলো। ডক্টর হঠাৎ আষাঢ় কে কেবিনে দেখে বলল-
-“ আপনি এখানে?
আষাঢ় সন্ধ্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সন্ধ্যা ব্যথায় চিৎকার করছে। আষাঢ় সন্ধ্যার হাত চেপে কপালে চুমু খেয়ে বলল-
-“ শি ইজ মাই ওয়াইফ। আমি থাকতে চাই এখানে প্লিজ ডক্টর। আমি থাকলে ও ভরসা পাবে।
ডক্টর কিছুক্ষণ চুপ থেকে সম্মতি দিলো। নার্স পাশ থেকে টুল এনে দিলো। আষাঢ় টুল টাতে বসে সন্ধ্যা কে সাহস দিতে লাগলো। সন্ধ্যা শক্ত করে চেপে ধরলো আষাঢ়ের হাত। ডক্টর বারবার জোরে পুশ দিতে বলছে সন্ধ্যা কে। সন্ধ্যা চেষ্টা করছে। আষাঢ়ের বুক ফেটে যাচ্ছে সন্ধ্যার এমন অবস্থা দেখে। ইশ কি কষ্ট টাই না পাচ্ছে। প্রায় ঘন্টাখানেক মৃ’ত্যুর সমান যন্ত্রণা সহ্য করে সন্ধ্যা এক বাচ্চার জন্ম দিলো। কানে ভেসে আসলো বাচ্চাটার কান্নার আওয়াজ। সন্ধ্যা চেয়ে দেখলো র’ক্তে মাখা তার বাচ্চা টাকে ডক্টর পরিষ্কার করাতে নিয়ে যাচ্ছে। পাশেই সন্ধ্যার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আষাঢ়ের দিকে তাকালো সন্ধ্যা। আষাঢ়ের মুখের হাসি বলে দিচ্ছে সে কতটা খুশি। সন্ধ্যা কোনো রকমে উচ্চারণ করে বলল-
-“ ছ..ছেলে হয়েছে নাকি মেয়ে ডাক্তার?
আষাঢ় সন্ধ্যার কপালো চুমু খেয়ে বলল-
-“ ছোট্ট আষাঢ় এসেছে।
-“ একটু আনবেন? আমি ওর মুখটা দেখতে পারি নি। একটু দেখবো।
আষাঢ় নার্স কে ইশারা করলো বাচ্চা টাকে আনার জন্য। নার্স সাদা টাওয়ালে মুড়িয়ে বাচ্চাটাকে এনে সন্ধ্যার সামনে ধরতেই সন্ধ্যা চেয়ে দেখলো তার নারি কাটা মানিক টাকে। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মাতৃত্বের সাধ বুঝি এটাকেই বলে? সন্ধ্যা চুমু খাওয়ার জন্য নার্স কে বলল বাচ্চা টাকে এগিয়ে দিতে। নার্স সন্ধ্যার কথা মতো বাচ্চাটাকে এগিয়ে আনলো। সন্ধ্যা বাচ্চাটার মুখশ্রী তে কয়েকটা চুমু খেলো। তারপর বিরবির করে বলল-
-“ আমার ঘরের আলো, সোনা মানিক । সবসময় আলোকিত করে রেখো আমার ঘরটাকে। ভিষণ ভালোবাসে মা তোমাকে।
কথাটা শেষ হতেই চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসলো। আষাঢ় চমকে উঠলো। সন্ধ্যার গালে হাত দিয়ে ডক্টর কে বলল-
-“ ও চোখ বন্ধ করে ফেললো কেনো ডক্টর? কি হলো হঠাৎ ওর? এই সন্ধ্যা কি হলো তোমার? ডক্টর কিছু বলছেন না কেনো?
ডক্টর সন্ধ্যা কে পরীক্ষা করে বলল-
-“ হাইপার হবেন না ডক্টর আষাঢ়। আপনার ওয়াইফ সেন্সলেস হয়ে গেছে। জ্ঞান ফিরে আসবে। আপনি আপনার ছেলেকে কোলে নিন।
নার্স শিশুটাকে আষাঢ়ের কোলে দেওয়ার জন্য বাড়িয়ে দিলো। আষাঢ় কাঁপা কাঁপা হাত নিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিলো। ছেলের মুখের দিকে তাকালো৷ হঠাৎ কেমন এক অনুভূতি হলো যা প্রকাশ করার মতন না। ডক্টর আষাঢ় কে বাহিরে যেতে বলল। আষাঢ় সন্ধ্যার দিকে একবার তাকিয়ে বাহিরে চলে আসলো। এতক্ষণ চাতকের মতো অপেক্ষা করতে থাকা তিন সদস্য হঠাৎ আষাঢ়ে কোলে বাচ্চা দেখে প্রাণ ফিরে ফেলো। এগিয়ে এসে বাচ্চা কে কোলে নিলো কনা। রাত বাচ্চার দিকে একবার তাকিয়ে বলল-
-“ ভাবি কেমন আছে?
-“ সেন্সলেস হয়ে গেছে। জ্ঞান ফিরে আসবে।
প্রায় আড়াই ঘন্টা পর সন্ধ্যার জ্ঞান ফিরে। জ্ঞান ফিরতেই কেবিন রুম ফাঁকা দেখে আঁতকে উঠলো। তার মনে পড়লো সে তার ছেলেকে এক নজর দেখেছিলো। তারপর আর কিছু মনে নেই। সন্ধ্যা আষাঢ় কে ডেকে উঠলো ডাক্তার ডাক্তার বলে।
আষাঢ় কেবিনের বাহিরেই ছিলো সন্ধ্যার গলার স্বর শুনেই কনার কাছ থেকে বাচ্চা কে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। কারন আষাঢ় জানে সন্ধ্যা ওকেই দেখতে চাইবে।
সন্ধ্যা দরজা দিয়ে আষাঢ় কে তার বাবু হাতে নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে আধশোয়া হয়ে বসলো। দু হাত বাড়িয়ে দিতেই আষাঢ় বাবুকে সন্ধ্যার কোলে দিলো। সন্ধ্যা বাবু কে জড়িয়ে আদর করলো চুমু খেলো হিসাববিহীন। আষাঢ় পাশে বসে মা ছেলের আবেগঘন মূহুর্ত টা চোখ জুড়ে দেখলো।
-“ ওকে বুকের দুধ খাওয়াও সন্ধ্যা।
সন্ধ্যা তাই করলো। এক এক করে কিছুক্ষণ পর সবাই সন্ধ্যা কে দেখে গেলো। বিকেলের দিকে সন্ধ্যার বাবা মা চাচা চাচি আসে সন্ধ্যা কে দেখতে। নিখিল আর তিতলি ও আসে৷ সন্ধ্যা কে দেখে বাচ্চা টাকে আদর করে কিছুক্ষণ থেকে চলে যায়। ঠিক তিনদিন পর সন্ধ্যা কে বাসায় আনা হয়।
সন্ধ্যার বাবা মা এক সপ্তাহের মতন থেকে চলে যায়। এই এক সপ্তাহে সন্ধ্যা তার বাবার সাথে তেমন কথা না বললেও ঠেস মেরে কথা একটাও বলে নি। তবপ ভালো মতো কথাও বলতে পারে নি।
একদিন দুপুরে সন্ধ্যা বাচ্চার কাপড় ভাজ করছিলো। তখন আষাঢ় বলল-
-“ আচ্ছা সন্ধ্যা বাবু আমার মত দেখতে হয়েছে তাই না?
সন্ধ্যা পাশে তাকালো। আষাঢ়ের কোলে থাকা আরাধ্যর দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ মোটেই না। আমার বাপ জান আমার মতো হয়েছে।
-“ যেমন?
-“ দেখুন ওর ঠোঁট দুটো আমার ঠৌঁটের মতো গোলাপি। হাসি টাও আমার মতো।
-“ এ্যহ বললেই হলো নাকি? আরাধ্য তার বাবার মতো হয়েছে। প্রুফ চাও?
-“ হ্যাঁ দিন।
-“ আরাধ্য যে পুরুষ ওর বাবার মতো এর চেয়ে বড় আর কোনো প্রুফ হয় নাকি?
-“ মেনে নিলাম মহাশয় আপনার কথা। এবার কি আপনি যাবেন একটু ওয়াশরুমে বাবুর ভেজা কাপড় গুলো ধুয়ে রোদে শুকাতে দিতে?
আষাঢ় মুখ বেঁকিয়ে বাবুকে বিছানায় শুইয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলল-
-“ সুযোগ বুঝে আমাকে দিয়ে সব করিয়ে নিচ্ছ। বাচ্চা বড় হলে বলবো তো তার বাবার উপর অনেক অত্যাচার চালিয়েছে তার মা। তার পটির না না পটির না হিশুর ত্যানা আমাকে দিয়ে ধুয়াইছে।
-“ বাচ্চা আমার তখন গর্বে গর্ভবতী হয়ে যাবে।
আষাঢ় ত্যানা গুলো ধুয়ে বেলকনিতে মেলে দিলো। বাচ্চাটার অভ্যাস ভীষণ বাজে প্রতি রাতে ঘুম থেকে উঠে কান্না করবে। আর তাকে কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে কান্না থামাতে হবে। এই কাজটার দায়িত্ব আষাঢ় নিয়েছে। সন্ধ্যার যাতে ঘুমের সমস্যা না হয় সেজন্য বাচ্চা কে কোলে নিয়ে সে নিজেই হেঁটে হেঁটে কান্না থামায়।
এভাবে বাচ্চা নিয়ে হাসিখুশি তে কাটলো আরো কয়েক মাস। হসপিটালের করিডরে বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছে রাত৷ মেয়ে বাচ্চা হয়েছে তার। কনার নর্মালে বাচ্চা হয়নি যার জন্য সিজার করতে হয়েছে। কনাও সুস্থ আছে। রাত মেয়েকে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকলো। একদম কনার মতো দেখতে হয়েছে। কনাকে কেবিনে শিফট করালে রাত চলে যায় কনাকে দেখতে। সন্ধ্যা মুচকি হাসলো ছেলের দিকে তাকিয়ে। এখন বসতে শিখেছে তার ছেলে। ড্যাপড্যাপ করে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা গালে চুমু খেয়ে বলল-
-“ তোমার ছোট্ট একটা বোন এসেছে বাবা। বোনের সাথে খেলা করবে?
কথাটা শোনামাত্রই কি হলে কে জানে আরাধ্য কেঁদে দিলো।
-“ কি হলো বাবা কাঁদছো কেনো? বোনের সাথে খেলবে না?
আরাধ্য সন্ধ্যার বুকে মাথা দিয়ে মুখ লুকিয়ে ফেললো।
তিনদিন হসপিটালে থাকবে কনা। সেজন্য বিকেলের দিকে আষাঢ় সন্ধ্যা কে নিয়ে বাসায় চলে আসে। হসপিটালে রাত আর মা আছে। পরিবার টা এখন কত পরিপূর্ণ। আরাধ্য ঘুমিয়েছে সেজন্য সন্ধ্যা আরাধ্য কে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো। ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে দিলো সারা অঙ্গ। আজ পুরোনো দিনের কথা গুলো ভেসে উঠছে স্মৃতি তে। পাশে এসে দাঁড়ালো আষাঢ়। সন্ধ্যা মাথা এলিয়ে দিলো আষাঢ়ের কাঁধে। আষাঢ় এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। সন্ধ্যা চোখ বুজে বলল-
আমি সুন্দর একটা সংসারের স্বপ্ন দেখতাম খুব ছোট থেকে। তখন উড়তি বয়স ছিলো। ভালোবেসে ফেলেছিলাম নিখিল ভাইকে। তার ব্যক্তিত্ব সুঠাম দেহ, কথা বলার ধরন দেখে প্রেমে পড়েছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতির শিকার হয়ে সে আমায় ছেড়ে দিলো। আমি ভেঙেচুরে গেলাম। আমার সংসার করার স্বপ্ন সেদিনই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো। এরপর আর দেখা হয় নি সংসার নিয়ে স্বপ্ন। সাহসই পাই নি। ভালোবাসা থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছিলো। তারপর হঠাৎ অনেক গুলো বছর পর আপনি আসলেন আমার জীবনে। আপনার সংস্পর্শে এসে আপনাকে চিনতে পেরে আবার দেখলাম সংসার করার স্বপ্ন। এবার আর প্রথমবারের মতো পরিস্থিতির শিকার হলাম না। আপনাকে পেলাম একান্তই নিজের করে। সে কি আনন্দের দিন। ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখলেন আমায়। ভালোবাসায় বাঁচিয়ে রাখলেন এই ভেঙে চুড়া আমিকে। আমি রোজ স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। ভেঙেচুরে ফেলা সন্ধ্যা এবার আর ভাঙলো না। আপনি ভালোবাসতে থাকলেন আর আমি গ্রহণ করতে লাগলাম। সুখ দুঃখে গড়া আমাদের সংসারের বছর গড়ালো। মা হলাম। আমাদের ঘর আলো করে ছোট্ট আষাঢ় আসলো। একদম আপনার মতো দেখতে। আমাদের পরিবারে আজ নতুন আরেক সদস্যর আগমন ঘটলো। এক ছোট্ট রাজকুমারীর। কি আনন্দের দিন তাই না বলুন? আর আজই কেমন সব পুরোনো দিনের কথা ভেসে উঠছে।
আষাঢ় চুমু খেলো সন্ধ্যার মাথায়।
-“ অতীত আছে বলেই বর্তমান আর ভবিষ্যত এত সুন্দর। মাঝেমধ্যে অতীত মনে করা উচিত। অতীত কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলা উচিত — তুমি এসেছিলে বলেই আমার জীবন এত সুন্দর।
-“ কিন্তু আমি পারি না ডাক্তার। আমি কখনই নরক সমান যন্ত্রণা পেয়ে বর্তমানে খুশি হয়ে অতীত কে নিয়ে বলতে পারি না। আমার বুকটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মনে পড়ে সেদিনের কিশোরীর পরিবারের থেকে পাওয়া ধোঁকা পরিবার ছেড়ে খালার বাড়ি থাকা। একদম নিঃসঙ্গতা আপন করে৷ সেসব কি ভুলে যাওয়া যায় বলুন?
-“ আচ্ছা ভুলো না। ভালোবাসি এটা তো বলতেই পারি বলো?
সন্ধ্যা মুচকি হেঁসে জাপ্টে জড়িয়ে ধরলো।
আষাঢ় রাতের সন্ধ্যা পর্ব ৩৯
-“ ভালোবাসি আপনাকে ডাক্তার।
-“ আমিও ভালোবাসি আষাঢ় রাতের সিঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে সরি না বলা সেই সন্ধ্যা কে।
সন্ধ্যার মনে পড়লো সেদিনের কথা। সিড়িতে ধাক্কা লেগে হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল ল্যাগেজ টা। সন্ধ্যা বিরক্ত হয়ে বেয়াদব বলেছি।
আহ্ পৃথিবী তোমাকে দারুন এক ধন্যবাদ এমন এক সঙ্গীর সঙ্গিনী বানানোর জন্য। আর কোনো কষ্ট পেতে দিও না এই আমাদের। ভালোবাসায় ভালোবেসে রাখিও আমাদের। বড্ড ভালোবাসি আমার এই মানুষদের কে।