ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৭

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৭
Arishan Nur

চোখের সামনে নিজের এক্সকে দেখে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে সমুদ্র। কিংকর্তব্যবিমুঢ় সে। ইউশার উপস্থিতি এ’আসরে কখনোই আশা করেনি। চোখ জুড়ে আঁধার দেখে। স্মৃতির মানসপটে কিছু আবছা সুন্দর-বিশ্রী স্মৃতি ভেসে উঠতেই চোয়াল শক্ত হয়। কপালের রগ স্পষ্ট দেখা যায়৷ সে ইউশার বলা কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আসো রুমে।”
আয়না নিজেও সামান্য চকিত উঠে ওনার আজব ব্যবহারে। একজন ফ্রেন্ড সৌজন্যবশত কৌশল বিনিময় করছে অথচ উনি জবাব তো দিলোও না তাকালাও না একবারও। এতো আনকালচার’ড ব্যবহার কেন? উপরন্তু গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে রেগে আছে।

সে নরম গলায় বলে, ” আচ্ছা, আপনি যান, আমি চা নিয়ে আসছি।”
ইউশা এবারে দ্বিতীয়দফায় বলে উঠে, ” সমুদ্র কথা বললে না যে?”
সমুদ্র সে প্রশ্নেরও উত্তর না দিয়ে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করে। আয়না ওর হয়ে সাফাই গেয়ে ইউশাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” উনার মনে হয় মাথাব্যথা করছে। এজন্য চলে গেলো।”
ইউশা ব্রেডে জেলি লাগাতে গিয়ে থেমে গিয়ে বললো, ” ওর তো মাথাব্যথার সমস্যা নাই।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কথাটা বলেই কেমন চুপসে গেলো। এরপর একদম চুপ মেরে যায় যেন বোমা মারলেও মুখ দিয়ে কথা বের হবে না৷ আয়না ভ্রু কুচকে তাকায়। মেয়েটাকে দেখলে মনে হবে বাঙ্গালী কিন্তু কাছ থেকে মিশলে বোঝা যায় ও কেবল দেখতেই বাঙ্গালী বাকি সবকিছুই ভীনদেশীর মত। তবে বাংলা জানে। নামটাও সুন্দর। ইউশা। দেখতেও অনেক সুন্দর। একটু বেশিই মনে হয় সুন্দর। কিন্তু উনি কী সমুদ্রকে খুব ভালোমতো চেনেন? কীভাবে জানলো সমুদ্রের মাইগ্রেন বা মাথাব্যথার ইস্যু নেই? আয়না প্রশ্ন করত কিন্তু সমুদ্রের জন্য চা আর ব্রেকফাস্ট এসে যাওয়ায় সে উঠে চলে যায়৷

হোটেল রুমে ঢুকতেই সিগারেটের গন্ধ নাকে আসে। আয়না নিজে ব্যক্তিগতভাবে সিগারেটের স্মেল নিতে পারে না। সিগারেটের স্মেল নাকে গেলেই নিশ্বাস নিতে সমস্যা হয় তার। কিন্তু উনি তো এভাবে সম্মুখীনে কোনোদিন সিগারেট ধরায় না৷ আজ তবে নিয়ম ভঙ্গ হলো কেনো?
আয়না ডাক দেয়, ” শুনেন।”
সমুদ্র বারান্দা থেকে একবার ওকে দেখে নিয়ে সিগারেট ফেলে, সরিয়ে দিয়ে, ভেতরের দিকে এসেই বলে উঠে, ” আয়না, চলো পরের বাসে ঢাকা ব্যাক করি।”
এটা শোনামাত্র সে বিষ্ময়ে হা হয়ে যায়। চোখ কপালে উঠে যায়। বলে কী এই ছেলে? আসার তিনঘণ্টাই পেরুলো না এরমধ্যেই নাকি ব্যাক করবে৷

সে বলে, ” মোটেও না। মাত্র আসলাম। কিছু ই তো দেখলাম না। না ঘুরেই যাবো নাকি?”
–” দেখার তেমন কিছু নাই। ওই সবুজ পাতা ছাড়া আর কিছু নাই দেখার মতো।”
আয়না তার হাতে খাবারের প্লেট তুলে দিয়ে বলে, ” খেয়ে আমাকে উদ্ধার করুন।”
— “সর‍্যি উদ্ধার করতে পারলাম না তোমাকে। খাচ্ছি না।”
–” হুট করে কী হলো আপনার? কেমন আজব ব্যবহার করছেন। ওই আপুর সঙ্গেও রুড বিহেভিয়ার করলেন। কি হয়েছে বলুন তো‌!”
–” জার্নি করার জন্য খারাপ লাগছে। এখন খারাপ লাগা শরীর নিয়ে মানুষের সঙ্গে গপ্পো করতে হবে? এটাই চাইছো?”
–” এটা একবারও চাই নি।”

সমুদ্র বিরক্তি নিয়ে বিছানায় শু’য়ে পড়ে। এরপর চার্জে থাকা ফোন অন করতেই দেখে গতকাল রাতেই নীলা তাকে ম্যাসেজ দিয়েছিলো যে ইউশাও আসবে। ওর কমন ফ্রেন্ড শ্রেয়শীর মাধ্যমে এ ট্যুরে ইনভাইটেশন পেয়েছে। সমুদ্র ফোন জোরে ফেলে দেয়। আয়না সামান্য চমকে উঠে। সমুদ্র শরীর খারাপ লাগছে বাহানা দিয়ে দুপুর অব্দি বিছানায় গড়াগড়ি খায়।খাবার অব্দি খায় না সে।
দুপুরের দিকে নীলা আসে সঙ্গে নুহাকে কোলে নিয়ে। আয়না আজও নুহাকে কোলে নিয়ে খেলতে ব্যস্ত থাকে। এই ফাঁকে দুই বন্ধু বারান্দায় যায়৷ আয়নার আড়ালে দু-একটা কথা বলতে চায়।
নীলা ধমকের সুরে বলে,” ফোন অফ রাখোস কেন?”

সমুদ্র বলে, ” চার্জ ছিলো না বা-?ল। ও এখানে কেন এসেছে?”
–” আমি কিভাবে বলব? জানার পর আমি নিজেই শকড। ও তোদের মধ্যে কোনো ঝামেলা করবে না তো? আয়নাকে সব বলে দেয় যদি?”
–” এই-বার ও কোনো ঝামেলা করলে আই ইউল কি–ল হার। আর কি বলবে ও? কোন মুখে বলবে সে? শুনো তোমার হাসবেন্ডকে আমি চিট করেছি?”

–” নট ফানি এট ওল ভাই। আমার ভয় হচ্ছে। তুই নিজ থেকে কেন সত্যটা বলিস না?”
তখনই আয়নার হাসির শব্দ কানে আসে। নিশ্চয়ই নুহাকে নিয়ে খেলার ছলে হাসছে।
সমুদ্র ঢোক গিলে অসহায় মুখ করে ছোট করে বলে, ” কী বলবো বল? আমি সাহস পাইনা। শুধু প্রাক্তন হলেও কথা ছিলো। কিন্তু ও যে ইহু–দি। মাতৃসূত্রে ই–সরা–য়েলী। ওকে ভালোবেসে আমি নিজের দেশ, জাতী, পরিবার একপ্রকার ত্যাগ করতে ধরেছিলাম। পিতার কাছে ত্যাজ্যপুত্র। মায়ের অবাধ্য ছেলে। এসব বললে আমাদের রিলেশনে ভয়ংকর প্রভাব পড়বে। আপাতত আমি মানসিকভাবে এতো স্ট্রং নাই। এমনও হতে পারে এসব শুনে আয়না আমার থেকে দূরে সরে পড়লো। পারবো না ওইসব কালো অতীতের ব্যাখা দিতে। নিজেরই ভয় লাগে।”
–“একদিন না একদিন তো বলতেই হবে।”
–” বলবো খুব শীঘ্রই।”

দুপুরের পর সমুদ্র আয়নাকে নিয়ে রিসোর্ট ঘুরতে বের হয়। সব মিলিয়ে ওর ক্লান্ত লাগে। সে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে। কিন্তু আয়না ছু’টে, ঘুরে বেড়ায়, ছবি তুলে। কোনদিকে যাচ্ছে-আসছে ও-ই ভালো জানে। সমুদ্র বসে থেকেই ওকে দেখছে। বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হয়। ও আনমনে আয়নার অনেক গুলো ছবি তুলে নিজের ফোনে।
এমন সময় ইউশার আগামন ঘটে। আজ গুনে গুনে একবছর পর দেখা৷ ও আগের মতোই আছে। একদম চেঞ্জ হয়নি। সমুদ্র সরে যেতে ধরলে ইউশা পথ আটকায়। বলে উঠে, ” চলে যাচ্ছো কেন?”
সমুদ্র থামে। কিন্তু কিছু বলে না৷
ইউশা-ই বললো, ” কেমন আছো? ”

–” ভালো। একচুয়ালি খুব ভালো আছি। আলহামদুলিল্লাহ। ”
–” তোমার ওয়াইফের সঙ্গে দেখা হলো। লেকের ধারে বসে ছিলো। আমিও ওদিকেই ছিলাম।”
–” ও আচ্ছা।”
–” বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো।”
সমুদ্র একটু সরে ওর থেকে দূরে পাশাপাশি দাঁড়ায় যেন একে অপরের চেহারা না দেখতে পায়। তবে আয়নার নাম শুনে ও নিজ থেকে বলে,” আমার ওয়াইফ অনেক সুইট না?”

–ইয়েস সি ইজ এ ভেরি সুইট গার্ল আই হাভ এভার সীন বাট ডু ইউ লাভ হার?”
সমুদ্র চকিতে উঠে ওর এই প্রশ্নে। তবে খুব সাবধানে বলে উঠে, ” তোমার মুখে ভালোবাসা ওয়ার্ডটা মানায় না।”
–“তাহলে কার মুখে মানায়? তোমার? তুমি নিজেও বিয়ের আগ মুহুর্তে আমায় কল করেছিলে। কেন ফিরতে চাচ্ছিলে যদি এতোই লয়্যাল হও।”

সমুদ্র সবটা শুনলো। ওইদিনের করা সেই একটা ভুল তাকে এভাবে ইউশার সামনে অপমানিত করে ছাড়লো।
সে শান্ত স্বরে মাথা ঠান্ডা রেখে শক্তপোক্ত ভাবে বললো, ” তখনো আমি ওর মায়ায় বাঁধা পড়িনি এজন্য আবার গন্ধযুক্ত ডোবায় ঝাপাতে চাইছিলাম। জানো তো পোকারা ভুল করে বারবার জলন্ত আগুনে ঝাপ দিয়ে মরে। আমারও ওই অবস্থা হচ্ছিলো। জিজ্ঞেস করলে না যে ওকে ভালোবাসি কিনা। দেন দ্যা আন্সার ইজ ইয়েস, আই লাভ মাই ওয়াইফ। ইউ নো, একটা টক্সিক জীবন থেকে ও আমাকে উদ্ধার করেছে। সুন্দর একটা গোছালো লাইফ উপহার পেয়েছি ওর থেকে। ”

–” আমার প্রশ্নের উত্তর এটা না।”
সমুদ্র হেসে বলে, ” কি উত্তর চাও? তুমি ভাবছো আমি এখনো তোমার প্রতি উইক? নাহ! বিয়ের দিন থেকে আমি তোমাকে সম্পূর্ণ ভাবে ভুলে গেছি। সেদিনের করা ভুলের জন্য আমি গিল্ট। বাট এম টোটালি ডান উইথ ইউ। ইটস ওল ওভার টুইংকেল কারোল।”
ইউশা একটু ভ্যাবাচেকা খায়। এই নামে সমুদ্র ওকে ডাকেনি কোনোদিন। এছাড়াও এর আগে সমুদ্রকে এতো শক্তভাবে ওর সাথে কথা বলতে দেখেনি। সবসময়ই নরমভাবে বলতো কথা। ওর এই পরিবর্তনে অবাক না হয়ে পারে না। তবুও দমে না সে।

বলে উঠে, ” এতোই যখন প্রেম তাহলে তোমাদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই কেনো?”
সমুদ্র ভ্রু কুচকে বলে, ” মানে কি?”
ইউশা আত্নবিশ্বাসী কণ্ঠে বলে, ” তোমাদের মধ্যে ফিজি–৷ ক্যাল কিছু হয়নি কেন?”
প্রাক্তনের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে ও বেশ রেগে যায়। মন চাচ্ছিলো থা–প্পড় মারতে কিন্তু ভীনদেশী কালচারে এসব খুব খোলামেলা আলাপ হয়।
সে শান্ত থাকলো। কিন্তু নিশ্চুপ।
ইউশা-ই বলে উঠে, ” তোমার ওয়াইফ নিজেই বলেছে।”

–” এসবও জিজ্ঞেস করো? রাবিশ ম্যান! কারো পার্সোনাল লাইফ নিয়ে কেউ এভাবে জানতে চায়। এতো লাইফলেস কেন? আমার মনে হচ্ছে, আমার ওয়াইফ, আমার সংসার দেখে তুমি ঈর্ষাবোধ করছো। নতুন বয়ফ্রেন্ড তৃপ্তি দিতে পারছে না?”
ইউশা একটু সংকোচবোধ করে। সমুদ্র ভুল বলেনি। ওর আসলেই আয়নাকে দেখে জেলাসি ফিল হচ্ছে। যদিও সে নিজেই সমুদ্রের উপর চিট করেছিলো। তাও মনে হচ্ছে আরেকবার সমুদ্রের ভালোবাসা পেলে ধন্য হত। কেমন পাগলার মতো ওকে ভালোবাসত সমুদ্র? অথচ সে অবহেলা দিয়েছে শুধুই। এখন সমুদ্রের এমন ড্যাম কেয়ার ভাব তার সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। সমুদ্র যেভাবে তার জন্য পাগল ছিলো ইউশা ভেবেছিলো ওকে দেখামাত্র সমুদ্র সব ফেলে চলে আসবে কিন্তু ও হাই অব্দি বলে নি। উপরন্তু যার জন্য সমুদ্রের সঙ্গে সে চিট করে, ওই ব্যক্তির সঙ্গেও আর সম্পর্ক নেই তার।

ইউশা কনফিডেন্সর সাথে বলে, ” তুমি এখনো ভালোবাসো আমাকে তাই না?”
সমুদ্র এই কথায় হাসলো খুব। এতে অপমানিত বোধ করে সে৷
সমুদ্র বলে উঠে, ” শোনো, পারলে আমি অতীত মুছে দিতাম। আমার আফসোস হয় কেনো আমাদের সাক্ষাৎ হলো। এরচেয়ে একদম প্রথমেই আয়নার সঙ্গে দেখা হলে মন্দ হতো না।”

সন্ধ্যায় বারবিকিউ এর আয়োজন করা হয়। অন্ধকার নামলেই রিসোর্টের দোতলা বিল্ডিংয়ের ছাদে সবাই একত্রিত হয়ে বারবিকিউ তৈরিতে ব্যস্ত। সমুদ্র নিজে কয়লা জ্বালিয়ে বারবিকিউয়ের মুরগীর পিজ নাড়াচাড়া করছে।
বারবিকিউ পার্টতে আয়না লাল শাড়িটি পড়েছে। ও সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা কথা বলছে৷ সমুদ্র বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছে। আজকে ওকে দেখতে এতো সুন্দর কেন লাগছে? চোখ ফেরাতে পারছে না সে।
এমন সময় নিয়াজ বলে উঠে, ” সমুদ্রের কণ্ঠে অনেকদিন হলো গান শুনি না। সমুদ্র একটা গান গা৷ আমাদের এই বারবিকিউ পার্টি পরিপূর্ণ করে দে।”

আয়না তখন জুস খাচ্ছিলো। সে প্রশ্ন করে, ” উনি গান গেতে পারেন?”
আয়নার এহেন প্রশ্নে সমুদ্রের সব ফ্রেন্ডরা হেসে ফেলে।ইউশাও উপস্থিত ছিল।
ও এতোক্ষণে মুখ খুললো , ছাদে আসার পর একটা কথাও বলেনি। ও বলে উঠে, ” আয়না, তুমি জানোই না সমুদ্র গায়?কেমন ওয়াইফ তুমি? ”
আয়নাকে সামান্য দমতে দেখা গেলো। তবে সমুদ্র ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে, ” আমি গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছি সেজন্য জানে না। পরিস্থিতির সাথে অনেক অভ্যাস বাদ দিতে হয়। আমি গান গাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছি আরোও আগে থেকেই। ও আমার লাইফে নতুন এসেছে তাই জানে না।”
সবাই চুপ হয়ে গেলো সমুদ্র-ইউশার বাকবিতন্ডায়।

তবে আয়নার শখ জাগলো ওনার কণ্ঠে গান শুনবে। ও অনুরোধ করে বলে, “প্লিজ আজকে আবার গান গেয়ে শুনান। আমার খুব আপনার গলায় গান শুনতে মন চাচ্ছে।”
সমুদ্র তৎক্ষনাৎ প্রস্তাব নাকচ করে দিলো। সে একবার ইউশার দিকে তাকালো। ওর চোখে কেমন জিতে যাওয়ার আনন্দ। অপরদিকে আয়না মুখ গোমড়া করে আছে।
এরপর দু’দণ্ড সময় নিয়ে কি যেন ভেবে নিয়ে বলে, ” আমার বউয়ের ইচ্ছা পূরণ করা-ই আমার দায়িত্ব।ওর কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখতে চাই না। ওর জন্য হলেও তাহলে দু’লাইন গাই।”
মুহুর্তেই সব বন্ধুরা হাত তালি দিয়ে হৈচৈ শুরু করলো। সিটি বাজালো দু’জন বন্ধু। সবাই ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সমুদ্র গলার কণ্ঠ আসলেই সুন্দর। কেমন মায়া জড়ানো গানের কণ্ঠ ওর। ছায়ানটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ছিলো। আয়না ওইসময় একগাল হাসি হাসে।

গিটার হাতে নিয়েই গলার স্বর একটু উঁচু করে বলে, ” দিজ সং ইজ ফর মাই বিলাভটেড ওয়াইফ। আয়না, শুধু তোমার জন্য!”
গিটারে সুর তুলে মাথা নিচু করে গাওয়া শুরু করে,
“ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু
তোমায় যতনে”
সে মাথা উঁচু করে একটু হেঁটে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওর হাত নিজের হাতে নিয়ে বাকি লাইনগুলো গাইলো।
” দুধে আলতা গায়ের বোরন
রুপ যে কাঁচা সোনা
আঁচল দিয়া ঢাইকা রাখো
চোখ যেন পরে না।
আমি প্রথম দেখে পাগল হইলাম
মন তো আর মানে না।”

আয়নার ওই মুহূর্ত গুলো কেমন রুপকথার মতো লাগছিলো। একটা ঘোর কাজ করছিলো। মোহময় চোখে সমুদ্রের দিকে তাকায় থাকে সর্বক্ষণ। পলক ফেলতে মন চায় না তার। পয়েন্ট ওয়ান ন্যানো সেকেন্ডও এই দৃশ্য মিস দিতে ইচ্ছুক না মন৷
সমুদ্র ওকে একবার ঘুরিয়ে এনে নিজের কাছাকাছি দাঁড় করিয়ে গাইতে থাকে,” তোমায় মন দিলাম, সোহাগ দিলাম, নিলাম আপন করে।”

এরপর কোমড়ে হাত রেখে একটু কাপল ডান্স দেওয়ার ভঙ্গিমায় অনেকটা নিকটে অবস্থান করে দু’জনে। ওনার পারফিউমের সুঘ্রাণে মাতোয়ারা হতে থাকে আয়না।
আয়না ওর হাত আকড়ে ধরে। মৃদ্যু আলো-ছায়ায় ওর কেমন লাগতে থাকে। ওনার শার্ট অপর হাত দিয়ে ধরে ফেলে যেন ছেঁড়ে দিলেই উনি চলে যাবে কোথাও।
সমুদ্র গান গাওয়া থামিয়ে আস্তে করে বলে, ” ম্যাডাম, এটা আপনার বেডরুম না। আমি কোনো হানিমুন করতে আসিনি। ছাড়ুন। লোকে দেখলে বলবে মেয়েটার খুব ইয়ে তো!”
আয়না সঙ্গে সঙ্গে সরে যায়, ভীষণ লজ্জা পায় ও। সমুদ্র আলতো হেসে শেষ দু’লাইন গায়,
“ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু
তোমায় যতনে।”

গান শেষ হওয়ার পর আয়নার ধ্যান ভাঙ্গে সমুদ্রের ‘ইউশা’ বলে ভীষণ জোড়ে চিৎকারের শব্দে। তবে সমুদ্র থেমে নেই। শব্দ করে নাম উচ্চারণ করেই থেমেই নেই, গিটারটা জোরে করে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে ছু’টে যায় ছাদের কর্ণারে।
আয়না সহ সবার দৃষ্টি সে’দিকেই গেলো। ইউশা ছাদের কর্ণারে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর স্কার্ফে বারবিকিউয়ের জলন্ত আগুন লেগে গেছে কিন্তু ও খেয়াল করেনি৷ সমুদ্র নাম ধরে ডাকায় তাকাতেই খেয়াল হতেই প্যানিক হয়৷ বলতে গেলে উপস্থিত সবার মধ্যে ভয়ের আভাস ঢুকে যায়। তবে ভাগ্য সহায় ছিলো, সমুদ্র সময় মতো ওর কাছে গিয়ে স্কার্ফ টান মেরে ফেলে দেয়, নিয়াজ কোথা থেকে পানি এনে আগুনে পানি ঢালে। বড় কোনো দুর্ঘটনা হতে বেঁচে যায় ও। পরবর্তীতে পার্টির আমেজে ভাটা পড়লো। সমুদ্র বারবিকিউ স্ট্যান্ডের সামনে আয়নাকে আসতেই দেয় নি। নীলার সঙ্গে ওইদিকে বসায় রাখে। বারবিকিউ বানানোর পর ওয়ান টাইম প্লেটে সার্ভ করা হয়।

সে প্লেট নিয়ে আয়নার কাছে যায়৷ ওইসময় আবহাওয়া কিঞ্চিৎ খারাপ হয়। বাতাস বইতে শুরু করে। হুহু বাতাসে গরম প্লেট নিয়ে শাড়ি-চুলের উড়াউড়িতে বেশ বিরক্ত হয় আয়না। সমুদ্র তা খেয়াল করে। সে খাবারের প্লেট নিজের হাতে তুলে নিয়ে বললো, ” খাও এখন আরাম করে।”
আয়না খাচ্ছিলো কিন্তু ওর জেদি, অবাধ্য চুল উড়ছে। সমুদ্র একটু পরপর চুল সরিয়ে কানের পিছে রাখছিল। ওমন সময় ইউশা একবার এদিকটায় এসে ওদেদ দেখে ফিরে চলে যায়।
খাওয়ার পর্ব চুকে যেতেই মেয়েরা ক্লান্ত হয়ে সবাই রুমে ফিরে যায়। কিন্তু ছেলেরা বোতল খুলে। আজ অনেকদিন পর সমুদ্র ও খেলো। ফ্যামিলির সাথে থাকে জন্য ও খায় না এসব ছাইপাঁশ। কিন্তু আজ ফ্রেন্ডরা ফোর্স করে।
সকলেই হাল্কা টুকটাক পান করে।

নিয়াজ বলে উঠে, ” কিরে ব্যাটা। আমি তো ভাবছিলাম তুই ভাবীর সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকবি। তুই এখনো এখানে কী করস? রাত পাড় হলে আফসোস করবি তো।”
ফ্রেন্ডদের এমন লাগামহীন কথায় সমুদ্র ধমক দিয়ে বলে, ” চুপ কর।”
তাদের আরেক রিয়াদ ফ্রেন্ড ও একটু বেশি করে ফেলেছে। ও বলে উঠে, ” আমার হানিমুনে আমরা রুম ছেড়ে বেরই হতাম না। আর তুই দেখি গ্রহ আর পৃথিবীর মতো দূরত্ব মেইনটেইন করিস।”
নিয়াজ বলে, ” সায়ন হারা—মি আগেই কইসে তোর ভাই চিকিৎসা দরকার।”
রিয়াদ ফের বলে উঠে, ” দোস্ত ভাদ্র মাস আর হানিমুন সিজন দুইটাই বছরে একবার আসে। জিলে আপনি জিন্দেগি ভাই।”

নিয়াজ বলে, ” ভাগ্না-ভাগ্নি দেখেই অস্ট্রেলিয়া যাই।”
ওরা সমুদ্রের হানিমুন উপলক্ষে আরেকটা খুলে। এগুলো সব বাহানা। ওতোক্ষণ সমুদ্র জাস্ট অল্প একটু এক ঢোক গিলেছিলো। এবারে ওরা কেউ শুনেনি। অনেক গুলো খাওয়ায় দেয় যার অর্ধেক ও মুখ থেকে ফেলে দেয়। তাতেই মাথা টলকাতে থাকে। সবটা খেলে নির্ঘাত মাতা–ল হত।
হোটেল রুমে আসতেই ক্যান্ডেল লাইট জ্বালানো দেখলো সে। ফুলের গন্ধে মাত–লামি আরোও এক স্কেল যেকারো বেড়ে যাবে। তার চোখ একজনকে দেখার জন্য তৃষাতুর। চোখ ঠিকই তার প্রয়োজন কে খুঁজে নেয়।
আয়না তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আছড়াচ্ছে। শাড়ি খুলেনি, ড্রেস চেঞ্জ করেনি এখনো। ওর আঁচল ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চুল সামনের দিকে থাকায় ওর অনাবৃত ফর্সা পিঠ দৃশ্যমান। আজকে সমুদ্রের নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। স্টেবেল থাকাকালীন খুব পার্ফেক্টলি নিজেকে সামলে চলে৷ কিন্তু আজকে ও যেন নিজেই জলোচ্ছ্বাস। সবকিছু ভে–ঙে দিতে মন চাচ্ছে।

দুজনার হৃদয় ভেঙেচুড়ে একসঙ্গে কুমোড়ের মাটির পাতিলের মতো নতুন করে দু’টো হৃদয় গড়তে মন চাচ্ছে। নিজের হৃদয়ের কিছু অংশে ওর হৃদয়ের খণ্ডাংশ রাখতে চায়।
সমুদ্র এগিয়ে এসে ওর কাঁধে থুতনি রেখে পরপর গালে চু– মু খেতে থাকে। আয়নার টনক নড়ে। সে অস্থির হয়ে উঠে যেতে চাইলে সমুদ্র আটকে রেখে বললো, ” বারন আছে নাকি কোনো?”
–” হুম”
–” তাহলে মিসেস রহমান, আজকে আপনার কোনো বাঁধা মানছি না কেমন? আর যদি বেশি কই মাছের মতো লাফাও, তাহলে আজকে বেঁধে ফেলবো।”
–” ছিঃ! কেমন অসভ্য আপনি! এসব কী বলেন? আর গা দিয়ে এমন স্মেল কেনো আসছে?”
সমুদ্র মুখ গোমড়া করে বলে, ” আমার গায়ের গন্ধ তোমার ভালো লাগেনা বুঝি। ব্রান্ড নিউ তাতেই এই দশা। পুরাতন হলে ফেলেই দিবা আমাকে।”

সমুদ্রর হাত ওর কোমড় থেকে আস্তে করে সামনে অগ্রসর হয়। অবাধ্য হাত দু’টো অস্থিরতা বাড়ায়৷ সমুদ্র ওর মুখ আয়নার কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলে, ” তোমার মুখেও গ–ন্ধ তাও তো আমি থেমে থাকিনি। কতো লম্বা সময় ধরে ফিল দিলাম কেবল ভালোবাসা-বাসি আছে বলে।”
ওনার এমন পিত্তি জ্বলা মার্কা কথায় আয়না দাঁড়িয়ে সামনের দিকে ঘুরলেই সমুদ্র ওকে টেনে একদম নিজের কোলে তুলে নেয়। কোনো কথা নেই, সিগনাল ছাড়াই। আয়না হতভম্ব হয় কিন্তু সমুদ্র মিচকা শয়তানের মতো হাসে যেন ওই কথাটা মাছের টোপ ছিলো। মাছ টোপ মুখে দিতেই জাল দিয়ে আটকে ফেললো। ওকে পাজকোলে তুলে বেডের দিকে পা বাড়ায়৷

দুজনেই ফুলের পাপড়ি যুক্ত বিছানায় বসে। মোমবাতির আলোয় সমুদ্র একবার নিজের বউকে দেখে নেয়। লাল শাড়িতে ওকে এতো বেশি অপরুপ লাগছে। ইচ্ছা করেই ওর মাথা খারাপ করার জন্য এই মেয়ে বোধকরি লাল শাড়ি পড়েছে কারণ ও খুব জানে সমুদ্রের লাল শাড়ির প্রতি দুর্বলতা আছে। লাইট নিভিয়ে কেবল ঝাড়বাতি জ্বালিয়ে রাখলো। ঘরময় লো-লাইটে, টিপটিপ মোমবাতি, বারান্দা থেকে আসা হিমেল বাতাসে, ফুলের গন্ধে কেবল ভালোবাসাময় সুবাস। সমুদ্র ফুলের কিছু পাপড়ি আয়নার মুখে আস্তে করে ছিটিয়ে দিয়ে বলে, ” গরম লাগছে অনেক।”

–” এসি অন করেন।”
–” না। শার্ট খুলবো।”
ঘর্মাক্ত শরীর থেকে নেশায় বুদ থাকা সমুদ্র শার্টের বোতাম খুলতে পারছিলো না। ভুলভাবে বোতাম টান মারছে। আয়নার মায়া হলো। সে নিজ থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বোতাম খুলে দেয়। সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে সাদা শার্টটা ফ্লোরে ছু’ড়ে মারে। এরপর আয়নার চোখে, মুখে, ঠোঁটে, কপালে, ঘাড়ে আলতো হাত ছু’য়ে আদর করতে থাকে। ওনার নীলচে চোখের দিকে তাকিয়ে আয়নার মায়া হয়। ও গিয়ে ওনার কপালের ঘাম মুছে দিয়ে চোখে আলতো চুমু বসায়। এতেই যেন কাল হলো। শান্ত ছেলেটা কেমন অশান্ত হয়ে গেলো ঠিক যেমন শান্ত সমুদ্র আচানক ফুলে-ফেঁপে, ফুঁসে কেমন ক্ষ্যাপাটে, দুর্বার হয়। আয়নাকে নিয়ে বেডে শু’য়ে পরে। আয়নার উপর শুয়ে সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দিয়ে বলে,

“তোমার জ্বর আসার কারণ হতে চাই, পাখি।”
আয়না কেঁপে উঠে ওনার কথায়। বরফের মতো জমে আসে ওর শরীরের রক্ত। কেমন অস্থির লাগে৷ নিশ্বাস ভারী হতে থাকে তার৷ লজ্জায় লাল হয়ে আসে মুখ। ওনার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেনা সে।
আজ সত্যি সমুদ্র ভীষণ অশান্ত ছিলো। অধৈর্যও বটে যেন এখনি, এই মুহূর্তে আয়নাকে হাসিল করতে তৎপর। ও বেডসাইডে থাকা মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয়। এরপর এলোপাথাড়ি ভাবে আয়নার কপালে, গালে ঠোঁট ছু’য়ালো। নিজের দু’হাতের আঙ্গুলগুলো আয়নার হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে গুঁজে দেয়। ওর অমান্য মন আজ সবটা অমান্য করে বসে। গলায় আলতো করে ঠোঁট ছো’য়ায়। আয়না তিরতির করে কেঁপে উঠে। সমুদ্র ওই তিরতির কচি পাতার মতো কম্পিত ঠোঁটের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কেমন মোহ কাজ করে তার মধ্যে।

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘড়ির কাঁটা ও হৃদস্পন্দনের গতি পর্যায়বৃত্ত গতিতে ঘুরতে থাকে। দু’জনের হৃদপিণ্ড ভীষণ তীব্রভাবে ধুকপুক করে একে-অপরকে খুব কাছ থেকে পেতে চায়। একসময় কাছাকাছিও আসে তারা। হয়তো এতো টা কাছাকাছি আসাই ভালোবাসার শেষ প্রান্ত, শেষ পর্যায়।

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৬

বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে হিমেল বাতাসে মোমবাতির আলো নিভতে থাকে, নিভতে থাকে সমুদ্র-আয়নার ভেতরকার দাউদাউ মনন-আগুন। বাতাসে সাদা পর্দা উড়তে থাকে। রাত গভীর হয়। আকাশে চাঁদের লুকোচুরি খেলা চলে। দূরে কোথাও মেঘ ডাকে। বিদ্যুৎ চমকায় থেকে থেকে।

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৮