ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৯

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৯
Arishan Nur

বাস ঢাকায় যখন ঢুকলো, তখন দুইটার বেশি বাজে। তারা কয়েক দফা বাস থামিয়ে হোটেলে নেমেছিল এজন্য সময় বেশি লাগে। সমুদ্র আগে থেকেই পিউকে ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছে। মেয়েটা রাত জেগে ফেসবুক চালায়, জেগেই থাকে অনেক রাত অব্দি। অযথা আব্বু-আম্মুকে পেরেশানি দেওয়ার দরকার নেই। বাস যেখানে থামিয়েছে তার ড্রাইভারও সেখানেই গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো৷

ঢুলতে থাকা আয়নাকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে সে। গাড়িতেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যায় আয়না। বাসে নীলার কাছে চেয়ে একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দিয়েছে। গাড়ি বাসায় থামতেই ও আয়নাকে কোলে তুলে নেয়৷ শুধু শুধু ঘুম থেকে তুলার দরকার নেই। বাসার সদর দরজা খুলে পিউ দাঁড়িয়েই ছিলো। নিজের বড় ভাইকে এভাবে ভাবীকে কোলে তুলে নিয়ে আসতে দেখে তার মুখ হা হয়ে যায়। সে চোখ বড় করে তাকায়। একবার ভাবলো ভুল দেখছে। রাতের বেলা ভাইয়ার রুপ ধারণ করে কোনো ভূত চলে এলো নাতো?
সমুদ্র ছোট বোনের সামনে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে একটু নাজুক হয় তবে দ্রুত সামলে উঠে বলে, ” এমন তাকায় আছোস কেন? প্রথম দেখছিস আমাকে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পিউ বলে উঠে, ” তোমায় প্রথম দেখছি না কিন্তু এমন ভাবীকে কোলে নিয়ে নায়কের মতো আসতে প্রথম দেখলাম।”
-” মুখ বন্ধ কর, নাহলে মশা ঢুকে যাবে মুখে।”
পিউ মুখ বন্ধ করলেও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে জিজ্ঞেস করলো, ” তোমাদের ট্যুর কেমন কাটলো?”
সমুদ্র লাজুক হেসে বলে, ” ওটা আসলে এক প্রকার হানিমুনই ছিলো, বুঝলি? মাত্র একরাতের জন্য যাওয়া বোকামি হলো। আগামী হানিমুনে পাক্কা একমাসের লং প্যাকেজে যাবো।”

পিউয়ের মুখ ফের হয়ে যায়। এটা আসলেই তার ভাই?নাকি শ্রীমঙ্গলে ভাই এক্সচেঞ্জ হয়ে গেছে।
সমুদ্র ওর বোনের মাথায় চাটি মেরে বলে, ” ওর জ্বর। ঘুমাচ্ছে জন্য আর ঘুম থেকে তুলিনি।”
সমুদ্র আয়নাকে নিজের রুমে নিয়ে আসে। এই প্রথম আয়না তার বাসায়, তার রুমে! সে পুলকিত হলো। বড় সাইজের বেডটায় ঘুমন্ত আয়নাকে শু’ইয়ে কম্ফোর্টার গায়ে জড়িয়ে দেয়। এরপর দু’দণ্ড সে নিজেই বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার বিছানা এই প্রথম কোনো নারীর ছোঁ’য়া পেলো। বিয়ের আগে আগে মা আর ইভানা আন্টি মিলে এ’রুমের ফার্নিচার চেঞ্জ করেছে আগের বেড এতো বড় ছিলো না। বিয়ের আগে ইভানা আন্টির বুদ্ধিতে বড় বেড কেনা হয়েছে যেন বউ-বাচ্চা সহ এক বিছানায় শু’তে পারে সে! এর আগে তার রুমটায় এতো শোভা বর্ধিত হয়নি। আজকে যেন তার রুমে কোনো সদ্য ফো’টা পদ্ম ফুল এনে সাজানো হয়েছে, আয়নার উপস্থিতি ঠিক তেমনি করে রুমটার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে দিলো যেন।
সেও নিজেও আয়নার পাশ ঘেঁষে শু’য়ে ঘুমিয়ে পরে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়না নিজেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একরুমে আবিষ্কার করে। সামনের দেয়ালে চোখ যেতেই দেখে তার স্বামীর তিনটা বাঁধাই করে ফটোফ্রেম ঝুলানো। একটা সমুদ্রের পাড়ে নিশ্চয়ই অস্ট্রেলিয়ায় মেডিকেলে পড়া অবস্থায় তো’লা ছবি। পাশে আরেকটা নটোরড্রামের ইউনিফর্ম পরা অবস্থার ছবি। ওনাকে ইউনিফর্মে দেখে আয়নার মনের মধ্যে ভালোলাগার বাতাস বইতে লাগে। অন্য ছবিটা ওর ছোটবেলার মনে হয় স্কুলের প্রথম দিনের।পাঁচ-ছয় বছর বয়সী ছবি। পানির লাল বোতলটা গলায় নিয়ে ওর হাসি-হাসি চেহারা। এত্তো কিউট ছিলো উনি? দ্রুত ফোন বের করে নিয়ে ক্যামেরাবন্দী করে ফেলে ও। ইশ এত্তো কিউট যে এখনি গাল টিপে দিতে মন চাচ্ছে।
ও ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হয়। ডাইনিং রুমে মিসেস রোদেলা আর পিউয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। পিউ বসে নাস্তা খাচ্ছিলো। মিসেস রোদেলা আয়নাকে দেখামাত্র এগিয়ে বসে জড়িয়ে ধরে বলে, ” গুড মর্নিং, আম্মুজান!”
আয়না হেসে বলে, ” কেমন আছো, মামনি?”

–” এইতো ভালো। তোমার জন্য নাস্তা রেডি করে অপেক্ষায় আছি। আসো, খেতে আসো।”
আয়না একবার সমুদ্রের রুমের দিকে তাকায়, উনি বেহুশের মতো ঘুমাচ্ছে৷
মিসেস রোদেলা বলে, ” সমুদ্র ঘুমাক। তুমি খেয়ে নাও। জার্নি করে এসেছো ”
আয়না পিউয়ের সঙ্গে খেতে বসে। মিসেস রোদেলা রান্নাঘরে গেলে পিউ বলে উঠে, ” ভাবীমনি, হানিমুন কেমন কাটলো তোমার ? ভাইয়া বলেছে খুব নাকি জোশ ছিলো তোমাদের হানিমুন।”
আয়না চোখ গোল গোল করে বলে, ” তোমার ভাই এসব বলেছে?”

–” ইয়েস, ভাই আবার নাকি যাবে, নেক্সটে গেলে নাকি টানা একমাসের জন্য যাবে।”
আয়নার লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা। এ কেমন আজব লোক। নিজের ছোট বোনকে কেউ এসবও বলে?
মিসেস রোদেলা এসে ওদের সঙ্গে বসে বলে, ” আজ সকাল থেকে দু’টো ভালো ঘটনা ঘটলো।”
আয়না প্রশ্ন করে, ” কি মামনি?”
–” প্রথম তো তোমার শ্বশুড় আব্বু আজকে অনেকদিন পর অফিস গেলো। আর দ্বিতীয় হলো আমার বউমা আজ আমার বাসায় এসেছে।”
আয়নার কথাগুলো বেশ ভালো লাগলো। শ্বাশুড়িমা বেশ ভালো বটে।
মিসেস রোদেলা বলে, ” তুমি আসবে কবে মা?তোমার জন্য আমরা দিন গুনছি। আমি আর পিউ কতো এক্সাইটেড জানো?”

পিউ আগ্রহ নিয়ে বলে, ” জানো ভাবী কি হইছে, ভাইয়ার রুমে আগে কোনো ড্রেসিং টেবিল ছিল না। ভাইয়ার পছন্দ না ড্রেসিং টেবিল। বিয়ের আগেও সে কোনোদিন কিনতে দেয়নি ড্রেসিং টেবিল।বিয়ের পর তোমার জন্য ভাইয়া আমাকে নিয়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিল কিনে এনেছে। তুমি সাজুগুজু করবা সেজন্য।”
মিসেস রোদেলা কোথা থেকে একটা সোনার চেইন এনে ওর গলায় পড়িয়ে দিলেন। এরপর কপালে চু–মু খেয়ে বলেন, ” তুমি প্রথম এলে এ’বাসায়। আমি খুব খুশি৷ এবার পার্মানেন্টলি আসার অপেক্ষার পালা। ”

ওইসময় সমুদ্রর ফুপি ইভানা শিকদার ভাইয়ের বাসায় এলেন। শ্রাবণকে ভার্সিটি ড্রপ করে গাড়ি নিয়ে ভাইয়ের বাসায় আসলেন। ওরা সবাই গল্প-গুজব শুরু করে৷ রোদেলা কোথা থেকে সমুদ্রের পুরাতন এলবাম এনে দেখাতে লাগে। আয়নাও আগ্রহ নিয়ে ওনার ছোট কালের ছবি দেখে। জন্মের প্রথম দিনেই মা রোদেলার সঙ্গে ছোট্ট সমুদ্রের একখানা ভারী বিমুগ্ধকর ছবি রয়েছে। আয়না বেশ খানিক সময় নিয়ে ছবিটা দেখে। এরপর ওনার তিন-চার মাস বয়সী একটা ছবি। ওনার দাদীর সাথে। কিন্তু ওই ছবিতে সমুদ্র একদম বিনা কাপড়ে। আয়নার এতো হাসি পায়। ও দ্রুত ছবিটার ছবি নিজের ফোনে তুলে নেয়৷ ওর মনে একটা প্রশ্ন জাগে, সমুদ্রের চোখের মনি নীল কেন? ওদের পরিবারের কেউ কী ভিন্নদেশী ছিলো?

ইভানা আন্টি পিউয়ের প্রথম জন্মদিনের ছবি দেখাচ্ছিলো। ছোট্ট পিউ বড়ভাইয়ের কোলে বসে কান্না করছে৷ আর ওর বড় ভাই ওর হয়ে কেক কাটছে।
আয়না একবার ভাবলো জিজ্ঞেস করবে, পরবর্তীতে ভাবে উচিত হবে কি? তবুও বলেই ফেলে,” মামনি, ওনার চোখের মণি নীল কেন?”
ইভানা ভ্রু কুচকে বলে, ” এই ‘উনি’ টা আবার কে?”
আয়নার ওইসময় প্রচুর লজ্জা লাগে। কি বললে ভেবে পায় না৷ অর্ধ পরিচিত শ্বশুড়বাড়ির মানুষজনের সঙ্গে এই প্রথম সে গল্প করছে৷ নার্ভাস ও লাগছে বেশ৷

মিসেস রোদেলা বলে উঠে, ” সমুদ্রের আব্বুর দাদা ব্রিটিশ আমলে এক ব্রিটিশ মহিলাকে বিয়ে করেছিলো। ওই সুন্দরী মহিলার চোখ নীল ছিলো। কিন্তু মহিলার ছেলে-মেয়েদের আবার নীল চোখ হয়নি। এমনকি তোমার শ্বশুড় আব্বুর প্রজন্মেও কারো নীল মনি নাই। শুধু আমার সমুদ্রের নীল চোখের মণি হলো। তিন প্রজন্ম পর!”
ইভানা আন্টি বলে উঠে, ” এবার দেখার পালা পরের প্রজন্মে কী ঘটে? সমুদ্রের ছানা-পোনাদের চোখের মণির রঙ কী হয় এইবার সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি।”

রোদেলা আর ইভানা হাসলেন খুব৷ আয়না উঠে সমুদ্রের রুমের পা বাড়ায়। উনি এখনো ঘুমে। দু’রাত ঠিকমতো ঘুমায়নি বিধায় এখন বেহুশের মতো ঘুমাচ্ছে। আয়না আস্তে করে ওনার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুমন্ত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে, ” ভালোবাসি, মিষ্টার অশেন৷”
সমুদ্রের ঘুমের একচুলও ডিস্টার্ব হয় না। আয়না ওর কপালে একটা চু–মু দিয়ে বলে, ” আসি তাহলে। ”
আয়নাকে ওদের বাসায় থাকার জন্য রোদেলা ইভানা অনেক বলছিলো কিন্তু আয়না থাকেনি। ফিরে যায় ওর বাসার পথে। ওদের বাসার ড্রাইভার নামিয়ে দিতে যায়।

সমুদ্রের ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন অলমোস্ট দুপুর। দুপুর একটা বাজে। সে তড়িঘড়ি করে উঠে আয়নাকে খুঁজতে থাকে। বেড থেকে উঠতেই ড্রেসিং টেবিলের আয়নার উপর একটা স্টিকি নোট আটকে রাখা। সে উৎসুক হয়ে নোটটা খুলে নেয়। নোটে লেখা ছিলো, ” আপনাকে ঘুমন্ত অবস্থায় খুব কিউট লাগে তো, মিস্টার অশেন।”
জীবনে প্রথম এমন কমপ্লিমেন্ট পেলো সমুদ্র। এতোকাল যাবত তাকেই প্রশংসা করতে হতো। আজ নিজে এমন সুন্দর প্রশংসা পায়। কিন্তু আয়না কোথায়? সে ফোন হাতে নেয়। আয়নার ম্যাসেঞ্জার থেকে একটা ছবি পাঠানো হয়েছে। সে ছবিটা দেখা মাত্র চোখ কপালে উঠে যায়। তার ছোট্টবেলার একটা বিনা- জামাকাপড় পরা ছবি। এই ছবি ও কোথায় পেলো? হায় খোদা,ওর সব সম্মান ধুলায় মিশে গেলো। আবার টেক্সট ও দিয়েছে, আপনাকে খুব কিউট লাগছে। কিউট বাবু!

সে দ্রুত কল লাগায়। আয়না রিসিভ করে বলে, ” আপনি ছোট্টবেলা থেকেই কিউট।”
–” তোমারি ভাগ্য! আমাকে ছোট-বড় সব অবস্থায় বিনা কাপড়ে দেখলে। ইউ ভেরি লাকি।”
–” মুখ সামলে কথা বলুন।”
–” কই তুমি?”
–” বাসায় যাচ্ছি।”

মুহুর্তের মধ্যে সমুদ্রের হাসি মুখ ফোটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। ঘর ও মনময় একটা শূন্যতা কাজ করে। এ কেমন আজব শূন্যতা? ওর যাওয়ার দরকার কী ছিলো? বিয়ের পর থেকে এটাই তো ওর বাসা৷ সমুদ্রের মনের ভেতরে কেমন কু-ডাকে৷ মা একবার এসে ওকে খাওয়ার জন্য ডাকে। তার খাওয়ার রুচি থাকে না। কিচ্ছু খায় না সে। রুমে ফিরে আসে। একটু পর রুম থেকে বের হয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলে। তখন ডাইনিংরুমে ইভানা আন্টিও ছিলো বসে।

সমুদ্র সবার সামনেই বিনা সংকোচে বলে, ” আম্মু, আমি আমার বউকে চাই।”
মিসেস রোদেলা আর ইভানা দু’জনেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন৷ কারো মুখেই কোনো রা নেই।
সমুদ্র-ই বলে উঠে, ” বিয়ে করে আলাদা থাকবো এজন্য নিশ্চয়ই বিয়ে করিনি। এখন আমি আমার বউকে চাই। আলাদা থাকবো না।”
মিসেস রোদেলা বলে, ” তুমি ই তো বলেছো আগে আকদ হবে। বউমা নিজের বাসায়ই থাকবে। তোমার দেওয়া শর্ত মোতাবেক সব হচ্ছে।”
সমুদ্র বিরক্তি নিয়ে বলে, ” আমি এতোসব জানি না। তোমরা তোমাদের স্বামীর সঙ্গে আছো না? তাহলে আমার বউ কেনো স্বামী ছাড়া থাকবে। আম্মু, সাতদিনের মধ্যে আমি আমার বউকে এ’বাসায় চাই। ব্যাস, বাকিসব কিছু জানি না। এতোদিন বিয়ে-শাদি, সংসার নিয়ে বয়ান দিলে, এখন নিজে সংসার চাচ্ছি এখন কেন ব্যবস্থা নিবে না?”
ছেলের চিৎকার-চেচামেচিতে অতিষ্ঠ হয়ে রোদেলা বলে, ” কেমন অসভ্য ছেলে! মায়ের সামনে এসব কেউ মুখে আনে?”

–“ভুল কী বললাম? বিয়ে করেছি বউয়ের সঙ্গে থাকব। তুমি সাতদিনের মধ্যে আয়োজন কর বউ ঘরে তোলার।”
–” ফাহাদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলবো।”
তখন ইভানা আন্টি বলে, ” তারচেয়ে বরং শায়লার সঙ্গে কথা বলো, ভাবী। ওর সাথে কথা বললেই কাজ হবে, আমার মনে হয় ওই বাসার সব নিয়ন্ত্রণ শায়লা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে।’
সমুদ্র না খেয়েই চলে যায়। ছেলেকে পিছু ডেকে বলে, ” খেয়ে নে এট লিস্ট।”
–” বউ আসুক, তারপর খাবো।”
–” এরমধ্যে আর খাবি না?”
–” কিছুটা এমনই!”

–” সাতদিনের মধ্যে কীভাবে সম্ভব? তাছাড়া আয়নার সেমিস্টার ফাইনাল, পড়াশোনা ও আছে।”
–” আমি কী বাচ্চা নাকি যে ও পড়তে বসলে কান্না করব, মু–তে দিবো, বইখাতা ছিঁড়বো? এ’বাসায় এসে পড়ে ফাইনাল’স দিবে ও।”
মিসেস রোদেলা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে সমুদ্রকে৷ কিন্তু ছেলে তার বেকে বসেছে। সাতদিনের মধ্যেই কোনো অনুষ্ঠান-প্রোগ্রাম ছাড়াই নর্মালভাবে আয়নাকে এ বাসায় আনবে। ছেলের জেদের সঙ্গে পারেন না সে এবার। এমন জেদের কারণ কী তাও বুঝে পান না। অবশ্য ইভানা বলে উঠে, ” ভাবী, আমাদের পরিবারের ছেলেগুলো একটু স্বভাবতই বউ পাগল। তোমার ছেলে একটু বেশিই বউয়ের জন্য কাতর। একসঙ্গে থেকেছে এখন দূরে থাকবে ভেবেই বিরহে কাতর হচ্ছে৷ ”

আয়না যখন বাড়ি পৌঁছে তখন দরজা শায়লাই খোলে৷ তা দেখে বিষ্মিত ও ক্ষুব্ধ হয় আয়না। সে আন্দাজ করে শায়লা চৌধুরী নিশ্চয়ই এ’বাসায় থাকছেন। তার আন্দাজই সঠিক হলো। শায়লা চৌধুরী নিজে থেকে বলতে লাগে, ” আমার ও’বাসায় একা একা ভালো লাগে না। মেয়ে দুটোকে নিয়ে শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি নিয়ে থাকতে চাই, পরিবারের জন্য মন খারাপ হয়৷”
আয়না রাগী গলায় বলে, ” ওসব কিছু না। আপনি বাবার সঙ্গে থাকতে চান এটাই আসল। আমাদের মোটেও পছন্দ করেন না আপনি।”

ঝগড়ার সূত্রপাত এখান থেকেই। অবশ্য শায়লা চৌধুরী ঠাণ্ডা মাথায় সব সামলাতে চান। দাদী এসেও আয়নাকে চুপ থাকতে বলে। কিন্তু শেষে আয়না একদম ঝগড়ার শেষ মুহুর্তে বলে, ” আই হেইট ইউ শায়লা চৌধুরী। আপনি আমার বাবাকে আমার থেকে আলাদা করে ফেলেছেন। কোনোদিন ক্ষমা করবো না আপনাকে।”
শায়লা চৌধুরী এসব কটাক্ষের তোপে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন। ওনি শুধু বলেন, ” আমি সারাটা জীবন একাই কাটালাম। পরিবার হীন। আমি কী সুখে থাকার আশা রাখতে পারি না?”

আলিয়া অবশ্য চুপই থাকে। আপার সঙ্গে তাল মেলায় না আজ। তবে আয়না ওনার ইমোশনাল কথায় গলে না। বাবা না থাকায় ও আরোও শক্ত অবস্থান নিয়ে বলে, ” আপনি এ’বাসায় থাকবেন না। চলে যান প্লিজ। এটা আমার বাসা।”
–” এটা তোমার আব্বুর বাসা। তুমি যেমন ওনার মেয়ে, আমিও তার স্ত্রী, আয়ু। আগে ছোট ছিলে, ছেলেমানুষী মানাতো। কিন্তু এখন এতো ম্যাচুরিটি আসার পরও এসব বিহেভিয়ার মানায় না৷”
আয়না নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। শায়লা চৌধুরী নিজের জন্য এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসে৷ তখনই তার ফোনে রোদেলার ফোন আসে। সে রিসিভ করতেই রোদেলা অনুরোধের সুরে আয়নাকে ওদের ঘরে তুলে নিতে চাইল। সমুদ্রের ব্যাকুলতার কথাও জানালো।

শায়লা প্রতিশ্রুতি দিলো খুব শীঘ্রই আয়না শ্বশুড়বাড়ি যাবে।
ফাহাদ সাহেব সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলে শায়লা সব জানায়। এটাও জানায় আয়না চায় না সে এ’বাসায় থাকুক। দু’জন মিলে সিদ্ধান্ত নিলো সমুদ্রের ইচ্ছা অনুযায়ী আয়নাকে তুলে দিবে বড় অনুষ্ঠান করে। আয়নার কান অব্দিও এ’কথা যায়৷
সে শুধু বাবাকে একটা কথাই বলে, ” আমি এখন তোমাদের কাছে বিষের কাঁটা তাই না? ঠিক আছে চলে যাবো এ’বাসা থেকে।”
আয়না যে কথাগুলো কতোটা অভিমান নিয়ে বলে তা কেউ উপলব্ধি করতে পারে না।
সেদিন রাত বারোটার পর সমুদ্র ওকে কল করে বলে, ” আয়না তুমি আসতে না চাইলে, আমি তোমাকে তুলে নিয়ে আসবো। বুঝছো?”
আয়না ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো, ” আপনি আচানক এতো ব্যস্ত হলেন কেনো?!
–” মনে কু ডাকছে।”

সমুদ্র ফোন রেখে অতীতের ভাবনায় ডুব দেয়। ইউশা যে ইহুদি এটা সে প্রথমে জানত না। ইউশা ছোট থেকে আমেরিকা থাকত মায়ের সঙ্গে। বাবার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিলো না ওর। ও জানত ওর বাবা ওকে একদম ভালোবাসে না। সেকেন্ড ম্যারেজ করেছে৷ ওর মা আরেকবার বিয়ে করে যেদিন, সেদিন ওকে সত্য বলা হয়, ওর বাবা আসলে মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত হন কোনো এক কারণে। অস্ট্রেলিয়া থাকাকালীন মারা গেলেন৷ ওর বাবার ইতিহাস শুনে সমুদ্র নিজে হতভম্ব হন।

ভদ্রলোক বাংলাদেশী। রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলো। নব্বই দশকে পিএইচডি করতে আমেরিকা যান৷ ওইসময় ইউশার মার সঙ্গে দেখা৷ ভদ্রলোক বিয়ে করেন ইউশার মাকে। ইউশা যখন হয় তখন নাকি ওর নাম ওর বাবাই ইউশা রাখে৷ কিন্তু ইউশার দু’বছর বয়সে উনি জানতে পারেন তার স্ত্রী তাকে প্রতারণা করছে। মানসিক ভাবে ভেঙে পরেন। একসময় পিএইচডি করতে আসা জ্ঞানী মানুষটা পাগল হয়ে যায়। বোনের কাছে অস্ট্রেলিয়ায় চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান৷ ইউশা এসব ওর মায়ের বিয়ের পর জানে। তারপর আঠারো বছর হলে বাবার স্মৃতি চারণ করে অস্ট্রেলিয়ায় মেডিকেলে পড়তে আসে। ওর সার্টিফিকেট নেম টুইংকেল হলেও মেডিকেলে ও ইউশা নামে নিজের পরিচয় দেয়৷

সমুদ্র যেদিন প্রথম ইউশা দেখে এক দেখায় প্রেমে পড়ে যায়। ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিলো ও। তাও বাঙ্গালী চেহারার। প্রথম দিকে ইউশা ওকে পাত্তা দিতো না৷ পরে যখন টানা কয়েকটা পরীক্ষায় সমুদ্র সবচেয়ে ভালো করে, সেদিন থেকে নিজে থেকে সমুদ্রের সঙ্গে কথা বলে পড়াশোনা বিষয়ে। এভাবে আগাতে থাকে। থার্ড ইয়ারের শুরুতে জানতে পারে ও ইহুদি। বাসায় জানাজানি হলে বাবা ঘোষণা দেয় এ মেয়ের থেকে দূরে সরে আসতে। কিন্তু সে পারেনা ইউশাকে ভুলতে। বাবার সঙ্গে সম্পর্ক এক প্রকার শেষ করে ও ইউশার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। আস্তে আস্তে ওর রেজাল্ট খারাপ হতো। আগের মতো ভালো রেজাল্ট আসত না৷ ইউশা-ই সবসময়ই প্রথম হত৷ এসব কখনোই আমলেই নেয়নি সমুদ্র।

ইন্টার্ণ করার সময় ওদের এক ইয়ং প্রোফেসারের সঙ্গে ইউশা সম্পর্কে জড়িয়ে চিট করে। সমুদ্র মানতে পারে না৷ সমুদ্র ভেঙে পড়ে একদম। ইউশার হাত-পাও ধরে৷ কিন্তু ততোদিনে ইউশা দূরে সরে গেছে৷ সমুদ্র একপ্রকার মেডিকেল যাওয়া ছেড়ে দেয়। ওই সময় শায়লা চৌধুরী অস্ট্রেলিয়া ভাইয়ের বাড়ি আসেন। সমুদ্রের এ অবস্থায় দেখে অবাক হন। রোদেলাকে জানান। রোদেলা সব শুনে সিদ্ধান্ত নেন অস্ট্রেলিয়া আসবে সমুদ্রের কাছে। তার আগেই সমুদ্র সু–সাইড এটেম্প করে৷ ওইদিন শায়লা আন্টি না থাকলে আজ নতুন জীবন পেতো না সমুদ্র। আন্টি ওইসময় ওর অনেক যত্ন নিয়েছে। একদম নিজের ছেলের মতো। সাইক্রিয়াটিস্টও দেখান। এরপর ওর মা আসার পর, সব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে ইন্টার্ণ শেষ করে ও দেশে ফিরে। ইউশা ওকে খুব অদ্ভুত ভাবে দুর্বল করে রেখেছিলো। সমুদ্র ওকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না। সম্পূর্ণ আন্ডার কন্ট্রোলে ছিল সে।

নীলা তো এসব শুনে বলেছে, মা-মেয়ে জ্ঞানী মানুষদের ফাঁসিয়ে ইচ্ছা করে পাগল বানানোর পায়তারা করে।ওর বাবা-মাও একসাথে পিএইচডি করছিলো। ওর মা ঠিকই পরে ডক্টরেট ডিগ্রি পান কিন্তু ওর বাবা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পরে। ই৷ সরায়েলীরা নাকি নিজেদের চেয়ে জ্ঞানীদের সহ্য করতে পারেনা।

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ২৮

সমুদ্রের মনে ভীষণ কু ডাকে। আয়নার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হবে তো? তাদের মধ্যে কী বিচ্ছেদ আসবে কোনোদিন? মনের মধ্যে কুৎসিত এক কোকিল কু ডাকে৷ কোকিল খুব যত্ন করে কু ডাকছিলো যেন বেদনার ঋতু সন্নিকটে।
এজন্য চারদিনের মাথায় ঘরোয়া প্রোগ্রাম করে আয়নাকে নিজের বাসায় আনে। ঘরোয়া অনুষ্ঠানে অফিসের মানুষ-জনও ছিলো। সমুদ্রের অফিসের পক্ষের মানুষজন আয়নাকে শায়লার সৎ মেয়ে হিসেবেই চিনে।
ওইদিন লাল বেনারসি পরে আয়না নিজের শ্বশুড়বাড়ি পা রাখে। সমুদ্র কোলে তুলে ওকে নিজের সাজানো ঘরে নিয়ে যায়।

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৩০