ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৩৩
Arishan Nur
আজকের আকাশ নক্ষত্রবিহীন, হয়তো চন্দ্রবিহীন ও।নিকষ কালো তমসা পূর্ণ রাত। অমাবস্যা চলে বুঝি। হ্যাঁ! অমাবস্যা-ই তো। সমুদ্র-আয়নার মনেতে আজ ঘোর অমানিশা। নিশ্ছিদ্র কালো, আঁধার রাত যেন মনের ভেতরের দুঃখি বিষাদকে আরোও দ্বিগুণ হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে। আয়না নির্জীব নিথর শরীরে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে হয়তো কাঁদছে। সমুদ্র বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ফুঁকছে। কোথায় জানি কি পুড়ছে৷ পোড়ার অদগ্ধ কষ্ট সারা অঙ্গময় ছড়িয়ে যাচ্ছে। এ’ভাবে, এ’মন পরিস্থিতিতে কী আদৌ শ্বাস নেওয়া যায়?
প্রবল ঘূর্নিঝড়ের পরপর প্রকৃতি কেমন নিশ্চুপ থাকে, তাদের রুমের অবস্থাও তেমন। একদম নিরব। খামোশ। সে কাঁচের স্লাইডের ভেতর দিয়ে আয়নার পানে তাকালো। মাথা নিচু করে আছে ও। থেকে থেকে কাঁপছে। হিচকি উঠে গেছে বোধহয়। সে রুমের দিকে পা বাড়ায়, গ্লাসে পানি ঢেলে আয়নার সামনে ফ্লোরে রেখে দেয়। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। ওর হাঁটার শব্দ পেয়ে আয়না মুখ তুলে তাকায়। রুম জুড়ে তখন নিভু ড্রিম লাইট জ্বলছে। ওর চোখে পানি দেখে মায়া হলো সমুদ্রের। মায়া এক বড় কঠিন জিনিস। দু’মিনিট আগেও মেয়েটাকে সে প্রতিদ্বন্দী ভাবছিল অথচ এখন মনে হচ্ছে নিজে হেরে গেলেই ভালো ছিলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সমুদ্র টেবিল থেকে গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বলে, ” বলছিলে না? আমার সঙ্গে থাকবে না। দেখো, যাচ্ছি আমি। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি আজ এক্সি ডেন্ট করে মরি৷ ইউ নো, জীবনের এ’পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে মরনেই শান্তি। এছাড়া এই জীবনে শান্তি খোঁজা ভুল।”
আয়না বসে থাকা অবস্থাতেই ওর কথায় চমকে উঠে। তবে সমুদ্র বলে যায়, ” তোমার চিন্তাভাবনা এতো জটিল কেন আয়না? রাতের বেলা অফিস গেলে কেন খারাপ ইঙ্গিতে নিলে? আমার যাওয়া পছন্দ নাহলে ওইখানেই বাঁধা দিতে, কেনো এতো অশান্তি করলে? এমন টক্সিক রিলেশনশিপ বহন করা খুব পীড়াদায়ক। আর তুমি এই অবস্থায় বাচ্চা চাও! আহ! বাচ্চাকে কোন পরিবেশ দিবে? মা হিসেবেও ব্যর্থ হবে তখন।”
আয়না নিজের দুই কানে হাত চাপ দিয়ে ধরে বলে, ” আপনার কোনো কথা আমি শুনতে চাই না।”
সমুদ্র থামে । গটগট করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আয়না পাথর হয়ে বসে থাকে।নির্জীব দৃষ্টি মেলে। সমুদ্র বুঝেও বুঝলো না এই মুহূর্তে আয়নার আসলে একটা স্নিগ্ধ ভালোবাসার ছায়াময় স্পর্শ দরকার ছিল, দরকার ছিলো একখানা আদর টুকরো।
কথার বিপরীতে, ওকে বিপক্ষদল বানিয়ে জিতে যাওয়াই কী আসল বিজয়, সমুদ্র? কি সুন্দর কেবল নিজেরা দিকের কথা বলে জিতে যাও, বিপরীতে থাকা ব্যক্তিকে একদম বুঝো না। সে তো তোমার শক্রু নয়।
রাত বেশ গভীর হচ্ছিলো। দেড়’টা থেকে ঘড়ির কাঁটা দু’টোয় পৌঁছে। আয়না ঠায় ফ্লোরেই বসে আছে। চোখের পানির বর্ষণ থেমেছে। অশ্রুমালা গালেই শুকিয়ে কাঠ। ঘড়ির কাঁটার শব্দেও ছমছমে ভাব। আয়নার চিন্তা হতে থাকে৷ সমুদ্রের ফিরে আসার কোনো লক্ষন নেই৷ কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার রশ্মি পড়ে। উনি যাওয়ার আগে কিসব কুলক্ষণা কথা-বার্তা বলছি। এক্সিডেন্ট হওয়ার! এতো ঝগড়ার মাঝেও কেবল ভালোবাসা আছে বিধায় ওনার জন্য ভীষণ ভাবনা আয়নার। আশেপাশে চোখ বুলালো। কতোক্ষণ কেটে যায় খেয়াল নেই, তবে জোরে ফোন রিং হওয়ায় ওর অন্তর কেঁপে উঠে। কেমন ভয় কাজ করে। ফোন কানে নিলে ও’পাশ থেকে অপরচিত গলায় কেউ বলে, আপনি সাদবিন রহমানের কে হন?”
আয়না ভয় পাওয়া গলায় বলে, ” কেন? কে আপনি?”
–” আমি °°°°°° ক্লাব, বনানীর ম্যানেজার। উনি প্রায় অচেতন অবস্থায় আছে। প্রচুর ড্রিংক করেছে। এই অবস্থায় একাই ড্রাইভিং করতে চাচ্ছে কিন্তু মাতাল অবস্থায় ড্রাইভিং করলে দুর্ঘটনা হবে৷ আপনি ওনার কে হন?”
আয়না খুব মিইয়ে আসা গলায় বলে, ” ওয়াইফ৷ ”
–” ওনাকে এসে নিয়ে যান, ম্যাম। ক্লাব ক্লোজ করতে হবে। আপনি না আসলে উনি একাই চলে যাবে।”
–” ওকে অপেক্ষা করতে বলেন৷ আমি আসছি ”
আয়না কালো শাড়ি পড়েই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। যেতে সময় কম লাগে। রাস্তা একদম নির্জন, ফাঁকা। নিজস্ব গাড়ি হওয়ায় নিরাপদে বনানী পৌঁছে সে৷ ক্লাবের সামনে যেতেই দেখলো, ক্লাবের আয়োজন এখনো জমজমাট। রাস্তায় মানুষ না থাকলেও ক্লাবে অনেক মানুষই উপস্থিত। গানও বাজছে। খুব লাউন্ড ভাবে। আয়না চোখ-মুখ খিঁচে ভেতরে প্রবেশ করে। জীবনে কোনদিন এমন পরিবেশে যায় নি। ভেতরে ঢুকে সে অবাক হলো। পরিবেশ দেখে বোঝার উপায় নেই এখন মধ্য রাত। তার উপর তার বয়সী অনেক মেয়েও আছে। সে ভাবত ক্লাবে কেবল ছেলেরাই যায়। ক্লাবটা খুব বেশি বড় না। প্রবেশ গেইটে এসে দাড়াতেই সমুদ্রকে একদম শেষ প্রান্তে একটা টেবিলে বসে ওয়েটারের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেলো। ওয়েটারের হাতে হরেক রকম ড্রিংক। ও চোখের পলকে এক পে গ গিলে নিলো। আয়না হেঁটে এসে ওনার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বলে, ” সমুদ্র!”
মা তাল থাকা অবস্থাতেও সমুদ্র আয়নার কণ্ঠস্বর চিনে ফেলে ও পিছনে ফিরে বলে, ” আয়না! তুমি এসেছো!”
এরপর ওয়েটারকে বলে, ” আমার ওয়াইফ আয়না। ও আসায় সেলিব্রেশন হওয়া উচিত।” ও ফের আরেক পে৷ গ নিয়ে গিলে এক ঢোকে।
আয়না একদম সামনে এসে দাঁড়ায় এবং ওয়েটারকে ধমক দিয়ে বলে, ” দেখছেন না ওনার অবস্থা। তাও কেন দিচ্ছেন একটার পর একটা ড্রিংক।”
ওয়েটার ঝারি খেয়ে কাচুমাচু করে বলে, ” আমার কাজই তো সার্ভ করা। স্যারের অর্ডার ছিলো।”
–” আপনি অর্ডার করা ড্রিংক নিয়ে চলে যান।”
ওয়েটার চলে গেলে সমুদ্র মন খারাপ করে বলে, ” খাওয়ার পর খুব আরাম লাগে। কোনো অশান্তি থাকে না। তুমি আলম ভাইকে যাইতে কেন বল্লা?”
আয়নাকে কিছু বলতে না দিয়ে ওর আয়নার গায়ে ঢুলে পরে বলে, ” সামটাইমস নিজেই খুব ফেড আপ হয়ে যাই।”
আয়না বলে, ” কষ্ট দিলেন আমাকে, কথার আ ঘাতে টুকরো টুকরো করে শেষ করে দিলেন, অথচ এখন নিজেই ভিক্টিম রোল প্লে করছেন!”
–” আয়না, আমারও অনেক কষ্ট আছে। তোমাকে বলি না। লুকাই তোমার থেকে।”
ওনি পুরোপুরিভাবে মা তাল অবস্থায়, এমনকি বসে থাকতেও দুলছে, তবুও কী করুণ সুরে মাতলামো কথাবার্তা বললো যেন সবটা সত্য!
আয়না হাসে ওর কথা আর বলে, ” যে কষ্ট দেয়, তারও কষ্ট থাকে নাকি?”
–” তোমার কথা কিছু বুঝি না।”
বলেই উঠে দাঁড়িয়ে বা রের দিকে গিয়ে আরেকটা বোতল হাতে নিয়ে বলে, ” বিলে এড করে দিয়েন।”
চুমুক দেওয়ার আগেই আয়না ওর হাত থেকে বোতল নিয়ে বলে, ” মাতাল হয়ে আর কতো মাতলামি করবেন? নিজে যে একজন ডাক্তার সেটা মনে আছে?”
সমুদ্র একটু ভ্রু কুচকে মুখ কেমন করে এরপর বলে, ” না, ভুলে গেছিলাম। এখন মনে পড়লো। আবার বোতল দেও।”
–” প্লিজ বাসায় চলেন। আপনার অবস্থা ভালো নান।এতো ড্রিংক কেউ করে? বাসায় মা-বাবাকে কি জবাব দিবেন? লজ্জা শরম কিছু ই আর বাকি নেই আপনার। মাতাল অবস্থায় আছেন।”
সমুদ্র পিটপিট করে তাকিয়ে বলে, ” নো নো। আমি মাতাল না, বুঝছো? আমি একদম নর্মাল আছি। বিশ্বাস
তো তুমি আমায় করো না। তাই প্রমাণ দেই।”
এরপর থেমে বলে, ” আমাদের হৃদপিণ্ড বুঝছো চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট। সিস্টোল-ডায়াস্টোল মিলে হৃদস্পন্দন।”
–” আচ্ছা চুপ করুন। বাসায় যাবো।চলুন।”
–” না। আমি আর বাসায় যাবো না। তুমি আমার কথা শুনো।”
এরপর সমুদ্র আয়নার গলার কাছটার বো’নে হাত দিয়ে বলে, ” এটাকে ক্লাভিকেল বলে।”
মাতাল সমুদ্রের মনে হয় পুরাতন পড়াশোনার খেয়াল আসছিলো। আয়নার গলা থেকে আরেকটু হাত নামিয়ে বলে, “এ জায়গায় স্ক্যাপুলা থাকে।”
আয়না হাত দিয়ে ওনার হাত সরাতে চাইলে সমুদ্র ওর হাত ধরে ফেলে বলে, ” তোমার হাতের আঙুল গুলোর নাম কিন্তু ফ্যালাঞ্জেস।”
তারপর আচমকা নিচে নেমে আয়নার পা নিজের ভাজ করা হাটুর উপর রেখে পায়ের আঙুল ছু’য়ে দেয় এরপর বলে,
” এগুলোও।”
–” সমুদ্র আপনি হুশে নেই। বাসায় চলুন।”
–” নাহ, আমি আর বাসায় ফিরছি না। আই উইল লিভ সুন।”
আয়না ওকে সামলাতে পারেনা। সমুদ্র আরোও দু’ পে গ খেয়ে একদম বাজে অবস্থা করে ফেলে। উপায় না পেয়ে ক্লাবের স্পেশাল নাইট স্টে প্যাকেজ থেকে রুম বুক করে। সমুদ্রকে রুমে নিয়ে যায় ও। কিছুক্ষণ আগের তাদের দুইজনের’ বিশ্রী ঝগড়ার কথা চাপা পড়ে যায় সমুদ্রের মাতলামিতে। আয়না ঠিকই ওর দুর্দশার কথা শোনামাত্র ছুটে’ এলো কারণ ওর দিক দিয়ে সমুদ্র স্রেফ দায়িত্ব ছিলো না। ভালোবাসাও বটে।
সমুদ্র বিছানায় চিত হয়ে শু’য়ে বলে, ” আমার বুক ব্যথা করছে, আয়না৷ কিন্তু এই বুক ব্যথা সেই বুক ব্যথা নয়।”
আয়না ওর পাশে গিয়ে বললো, ” জুতো-মুজা খুলে ঘুম দেন।”
সমুদ্র শুনে না ও আপনা-আপনি বলে উঠে, ” আমাকে শুধু কষ্ট ই দেও তোমরা।”
আয়না ওর কথা তেমন শুনছিলো না। নিজ থেকে জুতো খুলে দিলো।
সমুদ্র যখন মাতাল দশায় ইউশার নাম নিচ্ছিলো আয়না চকিতে উঠে ওর দিকে তাকালো।
সমুদ্র বলে, ” ইউশা কী কম আ ঘাত দিসে নাকি? ওর আ ঘাত সহ্য করতে গিয়েই হৃদয়ের বারোটা বাজলো। আমি এমন ছিলাম না ট্রাস্ট মি! আমাকে ইন্টার্ণ করার টাইমে এক অস্টেলিয়ান বৃদ্ধ বলছিলো, রোগীর নাকি আমার হাসিমুখ দেখেই অর্ধেক অসুখ সেড়ে যাবে।”
আয়না ওর সামনে এসে বসে বলে, ” ইউশা কে?”
এরপর শ্রীমঙ্গলে সাক্ষাৎ হওয়া ইউশার কথা স্মরণ হতেই জিজ্ঞেস করলো, ” ডক্টর ইউশা? কি করেছে উনি? ”
সমুদ্র ওকে টান মেরে নিজের দিকে টেনে এনে বলে, ” আমার জীবনের সব সুখ খেয়ে নিসে। ও আমাকে অনেক কষ্ট দিসে। আমি সহ্য করতে পারতাম না আয়না। আমার এখনো কষ্ট আছে। সেই কষ্টে তুমি আরোও ঘি ঢালো। কতোখানি কষ্ট সহ্য করবো?বারো আউন্সের ছোট্ট হ্রদপিণ্ডে কতোটুকু যন্ত্রণা ধারণ করা সম্ভব? আমি পারি না, বারবার সব সামলাতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছি। দায়িত্বের জাঁতাকলে পিষে হাপিত্যেশ অবস্থা। মুভ অন করার পরও তো সুখ পেলাম না। তোমার কষ্ট, কষ্ট কারন তুমি কাঁদতে পারো, আর আমার কষ্ট পানি কারন আমি কাঁদি না। দ্যাটস নট ফেয়ার।”
সমুদ্রের মুখে মুভ অন শব্দটা শোনা মাত্র আয়না বিষ্ফোরিত চোখে তাকালো। নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিলে, ওইটুকু সময়ে সমুদ্র ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকে।
আয়না সুধালো, ” ইউশাকে ভালোবাসেন আপনি? ”
প্রশ্নটার মাঝেই যেন এক সমুদ্র বেদনা ভরা ছিলো।
সমুদ্র ঘুমের ঘোরে থাকে। আয়না ঝাঁকালে বিরক্ত হয়ে বলে, ” হু।”
আয়না দাড়িয়ে থাকে এরপর না চাইতেও সমুদ্রের ফোন হাতায়। পাসওয়ার্ড জানলেও কোনোদিন কিছু চেক করেনি এতোটাই বিশ্বাস ছিলো ওর প্রতি। ফোনের গুগল ফটোস এর একটা ফাইলে ইউশার সঙ্গে সমুদ্রের ছবি দেখে। ওর যেন দুনিয়া থমকে যায়। কেমন অবশ হয়ে আসে। সবকিছু অন্ধকার দেখে। তার সমুদ্র অন্যকাউকে ভালোবাসে।দূর থেকে কেউ বলে উঠে, ” ও তোমার সমুদ্র না বোকা মেয়ে।”
আয়না ভাবে তবে ওদের সংসার সেটা কিসের ভিত্তিতে টিকে আছে? হয়তো তাসের ঘরের মতোন। হাওয়া দিলে উড়ে যাবে। নিজের সংসার জীবন, সুখ সব ঘোলাটে হয়ে আসে। সমুদ্র অন্যকারো! এজন্য তার প্রতি এতো বিতৃষ্ণা।
বিয়ের আগেরদিনের ম্যাসেজটাও দেখে ও। তবে ইউশার দেওয়া ছবিটা ডাউনলোড হচ্ছিলো না। কিন্তু সমুদ্রের পাঠানো ম্যাসেজ দেখামাত্র ওর হাত থেকে ফোন পড়ে যায়।
এতো বিষাদ কেন তার ভাগ্যে? আদৌ ভাগ্যের দোষ নাকি তার দোষ? সে কেন ভালোবাসায় এতো অভাগী!কেন অগাছা সে? কেন সমুদ্র? আপনার হৃদয়েএ রানী হতে পারলাম? কেন আপনার হৃদে অন্যকারো বসবাস?
দুপুরের দিকে আয়না একটা কফিশপে বসে আছে। তার বিপরীতে চটপটে স্বভাবের চঞ্চল ইউশা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। আয়নাকে ওর নাম্বার দিয়েছিল কখনো ভাবেও নি তাদের আবারো দেখা হবে। ইউশা পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমির জন্য কেইস ফাইল করেছে। এজন্য দুই-তিন মাস অন্তর এসে কেইসের ডেইটে হাজিরা দিতে হচ্ছে বিধায় আজ সে আয়নাকে স্বশরীরে দেখা দিতে পারলো। তবে ইউশা জীবনেও ভাবে সমুদ্রের স্ত্রী তাকে কল দিয়ে দেখা করতে চাইবে৷
আয়নাই বলে, ” আপনি সমুদ্রের ব্যাচমেট ছিলেন?”
–” হ্যাঁ।”
আয়না একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কি বলবে ভেবে পায় না। সে মরা গলায় বলে, “আপনাদের সম্পর্ক ছিলো?”
ইউশা বেশ অস্বস্তিতে পড়লো। কিন্তু মুখে কিছু বলে না।
আয়না এক গ্লাস পানি টেবিল থেকে নিয়ে পান করে বলে, ” আমার মনে হয় আপনি সমুদ্রর ভালোবাসা। প্রথম ভালোবাসা। আর আমি কেবল দায়িত্ব। আমি ওর ভালোবাসার অধ্যায়ে কোথাও নেই। অথচ আপনাকে নিয়ে উপন্যাস অব্দি রচিত আছে ওর মনে কোণে। উনি আপনাকে এখনো ভুলতে পারেনি জন্য আমাকে মানতে পারেনা। উনি এখনো আপনাকেই চায়। এখনও!”
ইউশা বলে উঠে, ” কি বলছো এসব? তুমি নিজের হাসব্যান্ড নিয়ে এসব বলছো?”
আয়নার চোখে পানি চিকচিক করে। সে বলে, ” বিশ্বাস নাহলে, ওনাকেই জিজ্ঞেস করে দেখেন।”
ইউশার এখনো সমুদ্রর বলা কঠিন কথা গুলো ইয়াদ আছে, তবুও ভাগ্য এতো সহায় যে আরেকবার সমুদ্রকে পাওয়ার লোভ সামলাতে পারে না। তবুও বলে, ” আমি সমুদ্রকে খুব ভালো করে চিনি। ও তোমাকে বিয়ে যখন করেছে, দায়িত্ব পালন করে যাবে।”
–” আমি চাই উনি সুখে থাকুক, দায়িত্বর খাতিরে সুখ বিকিয়ে দিক এটা চাই না। হয়তো আমার কাণ্ড দেখলে মানুষ বলবে আমি পাগল৷ কিন্তু ট্রাস্ট মি, আমি চাই আমার সমুদ্র সবসময় ভালো থাকুক। সুখী হোক।”
–” এখন এসব বলে লাভ আছে? আমি আসি আয়না।”
–” না, বসুন।”
প্রাক্তনের স্ত্রীর কান্ড ইউশার কাছে সুবিধার লাগে না৷ মেয়েটাকে স্টেবেল লাগছে না। মেন্টালি উইক লাগছে। কেমন এলোমেলো কথা বলছে৷
ইউশা বলে, ” কি চাচ্ছো তুমি? ”
–” আপনি সমুদ্রের সঙ্গে কথা বলুন। আমি ফোন দিয়ে ডাকছি ওনাকে।”
আয়না কল লাগায়। দুপুরের দিকে ওকে জেগে গেছে এতোক্ষণে। দু’বার রিং হতেই সমুদ্র কল রিসিভ করে বলে, ” আয়না, আই এম সর্যি। কালকে আমি খুব খারাপ করেছি…….. ”
–” এক জায়গায় আসতে বললে আসতে পারবেন এখন?”
–” হ্যাঁ। তুমি লোকেশন দাও। আমি এক্ষুনি আসছি।”
এরপরের প্রহর গুলো আয়নার ভারী লাগে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। সমুদ্র খুব দ্রুত এসে পৌঁছে। আয়নার সঙ্গে ইউশাকে দেখে সে ঘাবড়ে যায়৷ নিজের স্ত্রী আর প্রাক্তন কে একসাথে দেখে যে-কেউ হতভম্ব হবে। আয়নার মনে কি চলছে ও জানে না।
ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৩২
প্রশ্ন করে, ” ও এখানে কি করছে।”
আয়না উঠে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছে। ওর চেহারা ই বলে দিচ্ছে ওর কিছু একটা হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় নেই ও। কেমন বিধ্বস্ত। আনস্টেবেল। টলছেও বুঝি।
আয়না বলে, ” সমুদ্র, বারো আউন্সের হৃদয়ে আর দুঃখ পুষতে হবে না। আপনারা কথা বলে নিজের মধ্যে ভুল বুঝা-বুঝি ঠিক করে নিন। আমি তো থার্ড পার্সন। আমি সরে যাবো। অনেক সুখী হন, সমুদ্র।”
কথাটা বলার সাথে সাথে সমুদ্র আয়নার গালে চ৷ ড় বসায়। ক্যাফেতে উপস্থিতি সবাই ওদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো।