ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৪০

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৪০
Arishan Nur

আয়নার করা আক্রমণের তোপ সামলাতে না পেরে ব্যালেন্স হারা হয়ে একটু কাত হয়ে সোফায় পরে সমুদ্র। দুইজন মানুষের ভর একসাথে সোফায় পরতেই বিকট আওয়াজ হয়। আয়না ওর গলা চেপে রেখেছে। তবে এখন এতো শক্তি প্রয়োগ করেনি। চোখ-মুখ লাল হয়ে আসছে মেয়েটার। সমুদ্রের সময় লাগে না ওর হাত সরিয়ে নিতে কিন্তু আয়না ধস্তাধস্তি করে। ওকে নিয়েই সোফায় কাত হয়ে শুয়ে পরে। আয়নার আক্রমণত্মক আচরণ লাঘব পেলো যেনো, হয়তো নার্ভ রিল্যাক্সশন মেডিসিন কাজ করছে। ও চুপটি করে সমুদ্রের গায়ের সঙ্গে লেগে থাকে। নিজ থেকেই চোখ বুজে ফেলে। সমুদ্র নড়ে না একদম। ওকে বুকে নিয়ে কাত হয়ে থাকে। দু’দণ্ড সেভাবে থাকতেই কোমড় লেগে যায় তাও অভিযোগ নেই তার। এভাবে যদি আয়না চুপটি করে ঘুমায়, সে সারারাত কাত হয়ে থাকতেও রাজী। সারা শরীর টান-টান লাগায়, সমুদ্র সামান্য নড়তেই আয়না চোখ খুলে ফেলে। ও হাল্কা হাসলে, আয়না বলে, ” সমুদ্র কোথায়? ও কী চলে গেছে?”

সমুদ্রের প্রশ্নটা শোনামাত্র খুব যন্ত্রণা হলো। নিজের জন্য করুণা হলো বেজায়৷
সে বলে, ” তুমি ঘুমাও। তুমি ঘুমালেই সমুদ্র সকালে আসবে। আর না ঘুমালে, ওকে আমরা এখানে আসতে দিবো না।”
আয়না হচকচিয়ে উঠে বলে, ” কেনো আসতে দিবেন না। ওকে এক্ষুনি আসতে বলুন। আর কতো বাইরে থাকবে?”
–” তুমি ঘুমাও, আয়না। তুমি ঘুমাও। ও সকালেই চলে আসবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সে আয়নাকে নিজের বুকের মধ্যেই নিয়ে শুয়ে থাকে। বেশি একটা নড়ে না। নড়লেই আয়না চোখ খুলে তাকিয়ে থাকছে। সারা শরীর ব্যথায় জমে আসলেও, সে নড়চড় করে না। আয়নার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় না। এখন সত্যি আয়না ঘুমাচ্ছে। তাকে পরখ করছে সমুদ্র। হয়তো সারারাতই আয়নাকে এভাবে চোখের সামনে পরখ করতে থাকবে সে। আয়নার নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সমুদ্রের নিজেরও খুব ক্লান্ত লাগে। ঘুমাতে মন চায়। কিন্তু চোখ বন্ধ করে শান্তি মেলে না। দু’টো চোখের পাতা এক সেকেন্ডের জন্যও বন্ধ করে না সে।

আয়না একটানা প্রায় অনেক ক্ষণ সমুদ্রের বুকে মাথা রেখে ঘুমায়। সকালের দিকে আয়নাকে বেডের উপর আস্তে করে শুইয়ে দেয় ও। বেডে শুইয়ে দেওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে ওর ঘুম ভাঙ্গে। তখন সকাল সাতটা বাজছিলো। সমুদ্রের চেহারা দেখে যে’কারো মায়া হবে। নির্ঘুম রজনী পাড় করে ও যেন একদিনেই কাহিল হয়ে গেছে৷
আয়না চোখ খুলে ওর দিকে তাকালো এরপর রিনরিনে সুরে বলে, ” সমুদ্র, আপনি এপ্রোন পরে আছেন কেনো?”
আয়নাকে এহেন কথা বলতে শুনে সমুদ্র আনন্দে আত্মহারা হয়৷ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। নিজের অনুভূতি সামলে, ধাতস্থ হতে সময় নেয়৷

আয়না পুনরায় প্রশ্ন করে, ” আপনি কেনো এপ্রোন পরে আছেন?”
সমুদ্র সঙ্গে সঙ্গে এপ্রোন খুলে ফেলে দিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আয়না সত্যি তাকে চিনতে পারছে! নাকি সে ভুল দেখছে। আয়না তবে সুস্থ হয়ে গেলো। তার চোখে জল এসে চিকচিক করতে থাকে। সে চোখের জল মুছতে থাকে। সে চুপ করে কেবল আয়নাকেই দেখে যায়। আয়না পুনরায় চোখ বন্ধ করে।
কিন্তু একটু পরেই যখন নার্স এলো। নার্সকেই দেখেই আয়না আবার আগের মতো চিল্লাপাল্লা শুরু করে দেয়। রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। পারলে নার্সকে এটাক করবে। ও বারবার বলতে থাকে, আমার কি হয়েছে কেন নার্স আসবে? সে সুস্থ থাকলে নার্স কেনো?

সমুদ্র ওকে ধরে রেখে শান্ত করার চেষ্টা চালায়। মেয়েটা রেগে গেছে। নাকের ডগায় ঘাম জমে যাচ্ছে। সমুদ্র ওর ঘাম মুছে দিয়ে বলে, ” তুমি একটু অসুস্থ। এজন্য হাসপাতালে এসেছি। নার্স ঔষধ দিতে এসেছে। তুমি এমন করো না আয়না। নার্সকে ওনার কাজ করতে দাও।”
কিন্তু আয়নার কেনো যেন এখন নার্সকে সহ্য হচ্ছে না। কোনোভাবেই চাচ্ছে না নার্স এখানে থাকুক। ভদ্রমহিলা দ্রুত ঔষধ রেখে প্রস্থান করেন। উনি যাওয়ার পর নাস্তা দিয়ে যাওয়া হয়৷
সমুদ্র কোমল সুরে বলে, ” আয়না, আসো, খেয়ে নাও।”
আয়না ভ্রু কুচকে বলে, ” আমাকে আয়না বলে ডাকছেন কেনো?”

এহেন প্রশ্নে সমুদ্রের চেহারার রঙ পালটে যায়। ভয় পাওয়া গলায় বলে, ” তোমার নাম আয়না তাই।”
আয়না মাথা নেড়ে জানান দিলো তার নাম আয়না না। সে বলে উঠে, ” সবাই আমাকে আয়ু বলে ডাকে। আপনিও আয়ু ডাকবেন।”
সমুদ্রের কলিজা ঠাণ্ডা হলো। আসলেই তাই সে বাদে আয়নাকে সবাই আয়ু-ই ডাকে। আশ্চর্য এতোদিনেও সে বউকে আদর করে একবারও আয়ু ডাকে নি!

আজ বিবাহের তিন মাস পর সে খুব স্নিগ্ধ গলায় বলে, ” আয়ু, এসো নাস্তা খাবে এখন।”
আয়না কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না। সমুদ্র গিয়ে ওকে উঠে বসালো। এরপর আস্তে করে নামিয়ে বাথরুমে নিয়ে যায়। নিজেই ওকে ব্রাশ করে দিয়ে ফ্রেশ করিয়ে দেয়। তারপর চুল চিরুনি দিয়ে আছড়ে দেয়। চুল গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখলো। এই সুন্দর মায়া-মমতায় ভরা চেহারার মেয়েটাকে দেখলে কে বলবে ও মানসিক ভাবে অসুস্থ এই মুহূর্তে?

আয়নাকে খেতে দিলে ও কোনোকিছুই মুখে তুলে খায় না। চুপচাপ বসে আশেপাশে তাকিয়ে থাকে। সমুদ্র উঠে ওর পাশে বসে রুটি ছিঁড়ে দিয়ে সবজির সঙ্গে মাখিয়ে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়৷
খেতে খেতে আয়না সুধালো, ” সমুদ্র, আমি কী পাগল হয়ে গেছি? এজন্য হাসপাতালে এসেছি?”
–” এসব কি বলছো? কে বলেছে তোমাকে এসব কথা?”
–” ডাক্তার বলেছে।”
সমুদ্র বলে, ” না, সোনা। তোমার পেটে ব্যথা এজন্য হাসপাতালে এসেছি।”
–” ও।”

আয়না সমুদ্রের হাতে বাকি খাবার টুকু খায়। চেচামেচিও করে না। সমুদ্র ঔষধ খেতে বললে সেটাও খেয়ে নেয়। এরপর নিজ থেকেই বলে, ” আমি ঘুমাবো।”
ডাক্তার রোকসানা বলেছিলে, আয়না এখন যত ঘুমাবে, ততো বেশি ইম্প্রুভমেন্ট আসবে ওর। আয়না বেডে নিজ থেকে গিয়ে শোয়া’মাত্র সমুদ্রকে খুঁজে। ওকে ডেকে উঠে। কেনো সমুদ্র তার পাশে নেই এজন্য প্যানিক করা শুরু করল।
হয়তো ওর অবচেতন মন সমুদ্রের সঙ্গ চাইতো কিন্তু সমুদ্রের সময় থাকত না ওর জন্য! এখন সবটা ব্যাক ফায়ার করছে। প্রতি মুহূর্তে সমুদ্রের উপস্থিতি চাই ওর।
রোকসানা ম্যাডাম এসে আরেকবার মর্নিং ভিজিটিংয়ে চেক করে যান। তখনো ও রোকসানা ম্যাডামের উপর চিল্লাচ্ছে। আয়না একদম অন্যকারো উপস্থিতি চায় না।
উনি বলে উঠে, ” তুমি কার সঙ্গে থাকতে চাও?”

–” সমুদ্র ছাড়া আর কারো সাথে থাকবো না। তুমি যাও এখান থেকে। ”
রোকসানা ম্যাডাম হেসে বলে, ” আচ্ছা মা। তুমি সমুদ্রের সঙ্গে থাকো। আমি যাচ্ছি। আবার একটু পর এসে অল্প একটু দেখেই চলে যাবো।”
আয়না কিছু বললো না। সত্যি পরবর্তীতে আয়না এক মুহুর্তের জন্যও সমুদ্রকে কোথাও যেতে দিলো না। ওর ধারণা সমুদ্র চোখের আড়াল হলেই ওকে রেখে চলে যাবে। ও বেডে শুয়ে চোখ বুজে দু’মিনিট পর চোখ খুলেই সমুদ্রকে খোঁজে। সমুদ্র বেচারা প্রত্যকবারই ধৈর্য্যর চরম পরীক্ষা দেয়। প্রতিবারই ওকে আদুরে গলায় বলে, ” আমি আছি, আয়ু সোনা, এবার একটু ঘুমাও।”

আয়না ওর শার্ট খামচে ধরে রাখে এমন করে চব্বিশ বার আয়না চোখ খুলে ওকে হন্ন হয়ে খুঁজে। চব্বিশ বারই সমুদ্র ওকে আদর করে বুঝায় ও আছে এবং থাকবে৷ তখন বেলা বারোটা বাজছিলো। সমুদ্র সকাল থেকে কিছু ই খায় নি। ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে। তবুও চেয়ার ছেড়ে উঠে না। আয়নাকে একা ছাড়ে না। ওকে সুস্থ করতে যা যা করতে হবে, সে সব করবে। হয়তো এটাই তার অপরাধের সামান্য প্রায়শ্চিত্ত হবে!
আয়না বলে উঠে, ” আমি শায়লা আন্টির হাতের কচুর ভর্তা দিয়ে ভাত খাবো।”

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৩৯

সমুদ্র হতভম্ব হয়ে যায়, আয়না কেনো শায়লা চৌধুরীর হাতের রান্না কেনো খেতে চাচ্ছে? এ’অবস্থায় কেনো এর উত্তর খুঁজা বোকামি। সে বিচলিত বোধ করে। কোথা থেকে কচু ভর্তা আনবে সে?
বলে উঠে, ” পিজ্জা বা রামেন খাবে?”
আয়না মাথা নাড়িয়ে না বোধক অর্থ প্রকাশ করে বলে, ” না। আমি দুপুরে শায়লা আন্টির হাতের কচু ভর্তা দিয়ে ভাত খাবো।

ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব ৪১