উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৮

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৮
দিশা মনি

নেহা ভয়ার্ত চোখে তার নতুন বস শাহরিয়ার কায়সারের দিকে তাকাচ্ছিল। শাহরিয়ার কায়সার ধীর পায়ে নেহার দিকে এগিয়ে আসছিল। নেহা বুঝতে পারছিল এখন হয়তোবা তাকে খুব কড়া কিছু কথা শুনতে হবে তাই আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে নিলো। শাহরিয়ার কায়সার একদম নেহার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি তো এটা ভেবেই অবাক হচ্ছি যে এত বড় একটা কোম্পানিতে আপনি জব পেলেন কিভাবে! আপনার মাঝে তো ম্যানারস নামে কিছু নেই দেখছি!”

নেহার গায়ে লাগে কথা টা। তবে এখন সে আর কিছু বলে শাহরিয়ার কে চটিয়ে দিতে চায় না এজন্য চুপ থাকে। তখন খালেক ইসলাম বলে ওঠেন,
“স্যার, উনি আমাদের কোম্পানির একজন বিশ্বস্ত ও পরিশ্রমী কর্মী। আপনার বাবার অনেক স্নেহভাজনও। হয়তো ওনার কোন কারণে ভুল হয়ে গেছে কিন্তু..”
শাহরিয়ার এবার রক্তিম চোখে খালেক ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ভুল? কিসের ভুল? শাহরিয়ার কায়সারের ডিকশনারিতে ভুল বলে কোন শব্দই নেই। না, আমি কোন ভুল করি না না কোন ভুল পছন্দ করি। যদি কেউ ভুল করে তাকে তার উপযুক্ত শাস্তিও আমিই দেই।”
বলেই সে নেহার দিকে তাকিয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আর এই মেয়েটিকেও ওর ভুলের শাস্তি পেতে হবে। ওকে ডিমোশন করে দেয়া হোক!”
নেহা আতকে উঠল! ডিমোশন! কত কষ্ট করে সে এই কোম্পানিতে নিজের একটা অবস্থান তৈরি করেছিল আর এক নিমেষেই তাকে কিনা ডিমোশন দেয়া হবে। নেহা এবার আর চুপ থাকতে না পেরে বলে উঠল,
“স্যার, আমি প্রথমেই নিজের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু..আপনি কি এটা ঠিক করছেন? আমার সামান্য একটা ভুলের জন্য..”
শাহরিয়ার চেচিয়ে উঠে বলল,

“সামান্য? এই ভুলটাকে তোমার সামান্য মনে হচ্ছে? তুমি যেই টোনে আমার সাথে কথা বলেছ আজ অব্দি কারো সাহস হয় নি এভাবে আমার সাথে কথা বলার। এই ব্যাপারটা আমি মেনে নেবো না। আর কি বললে আমি ঠিক করছি না? শাহরিয়ার কায়সার যা করে তা সবসময় ঠিকই করে। বললামই আমার ডিকশনারিতে ভুল বলে কোন শব্দ নেই। আর তুমি যদি এর থেকে বেশি আর একটা কথা বাড়াও তাহলে চাকরিটাও আর থাকবে না।”
নেহা এবার পুরোপুরি দমে গেল। নিজের আত্মসম্মানে আঘাত পেলেও এই মুহুর্তে তার আর অন্য কোন উপায় নেই। নিয়া বড় হচ্ছে, তার খরচ বাড়ছে। এই উচ্চমূল্যের বাজারে নিজের মেয়েকে নিয়ে টিকে থাকতে নেহার এই চাকরিটা করা প্রয়োজন। তাই আপোষ তাকে করতেই হলো নিজের সম্মানের সাথে। নেহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
“ঠিক আছে, স্যার। আপনি যা বলবেন তাই হবে।”

শাহরিয়ার হাসল। তার হাসিতে বিজয়ীসূচক একটা আভা দেখা যাচ্ছে। এই অসহায় আত্মসমর্পণই তো সে দেখতে চায় সবার চোখে। শাহরিয়ার প্রসন্ন হয়ে নিজের কেবিনের দিকে ফিরে যায়। এদিকে নেহা নিজের চেয়ারে বসে পড়ে। খালেক ইসলাম তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
“চিন্তা করো না, নিজের কাজ করে যাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
নেহা চুপচাপ সেখানে বসে থাকে। এই সান্ত্বনাও আজ তার জন্য যথেষ্ট নয়। নেহা ভাবে,
“কেন এমন হলো আমার সাথে? শামিম স্যারের মতো এতো ভালো একজন লোকের ছেলে এত নির্দয়, এত পাষাণ কিভাবে হতে পারে? ওনাকে দেখে আজ যেন আমার অতীতের কারো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে..”
অতীতের কিছু স্মৃতি মানসপাটে ভেসে আসতেই নেহা নিজেই নিজেকে তিরস্কার করে বলে,
“না, নেহা। এই অতীত নিয়ে তুই আর ভাববি না। তোর অতীত যাই হোক, তোর মেয়ের ভবিষ্যৎ অনেক সুন্দর হবে। আর এজন্য তোকে চেষ্টা করে যেতে হবে যেন অতীতের কোন ছায়া তোর মেয়ের উপর না পড়ে।”

আহির অফিসে এসে নিজের কেবিনে বসেছিল। আজকাল তার দিনগুলো বড্ড খারাপ যাচ্ছে। আহিরার অসুস্থতার জন্য কানাডায় অন্তত গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং ছেড়ে আসতে হয়েছে। এদিকে বাড়িতে ফিরে আহিরার শীতল ব্যবহার তাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। এমন সময় হঠাৎ করে মুমিনুল পাটোয়ারী আহিরের কেবিনে এসে বলল,
“কি ভাবছ আহির?”
আহির দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল,
“কিছু না, আব্বু। কানাডায় একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং স্থগিত করে আসতে হয়েছে সেটা নিয়েই ভাবছি। কানাডার অন্যতম বড় কোম্পানি ইনফিনিক্স যা মূলত একটি বাংলাদেশী ব্যান্ড তার নতুন সিইও শাহরিয়ার কায়সারের সাথে একটা মিটিং করার কথা ছিল আমার। কোন একটা বিজনেস ডিল করতে পারলে কোম্পানির অনেক উপকার কত। এমনিতেই শেয়ারবাজারে কিছুটা ধ্বস নেমেছে তার উপর..”
আহিরকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে মুমিনুল পাটোয়ারী বললেন,
“এসব ব্যবসার কথা পড়ে থাকে। তোমার নিজের জীবনে যে ধ্বস নেমেছে সেটা তুমি দেখছ না?”
“মানে?”

“আর কতকাল তুমি এভাবে কাটাবে? ৫ বছর আগে একটা বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে এসে বললে, ও তোমার মেয়ে। আমি বিনাবাক্যে সব মেনে নিলাম। কিন্তু এবার তো তোমার নিজের জীবন নিয়েও ভাবতে হবে। নিজের বিয়েশাদি..”
“আব্বু প্লিজ..এই বিষয় নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না।”
“কেন তুমি নিজেকে একাকীত্বের মাঝে এভাবে কষ্ট দিচ্ছ আহির? আমি হয়তো তোমার নিজের বাবা নই কিন্তু আমি এটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে, তুমি বিগত ৫ টা বছর ধরে এক মুহুর্তও শান্তিতে ছিলে না। সবসময় তোমার চোখে কোন একটা ভয়, একটা গভীর অপরাধবোধ দেখতে পাই আমি। এর কারণ কি আহির?”
আহির কিছুই বলে না। কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে বলে,
“অনেক সময় তো অনেকের দীর্ঘ শ্বাসও মানুষের শাস্তির কারণ হয় আব্বু।”
“ঠিক বুঝলাম না।”

আহির কিছু বলতে যাবে এমন সময় তার কোম্পানির একজন কর্মচারী এসে বলে,
“স্যার, একটা ভালো খবর আছে। আমি ইনফিনিক্স কোম্পানিতে যোগাযোগ করেছিলাম। ওখান থেকে ওরা জানিয়েছে ওনাদের সিইও শাহরিয়ার কায়সার আপনার সাথে একটা মিটিং করতে চান ঢাকায়। বর্তমানে উনি বাংলাদেশেই আছেন।”
আহির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“বাহ, এটা তো অনেক ভালো খবর। তুমি সব আপডেট আমাকে জানাতে থাকো।”
“আচ্ছা, স্যার।”
আহির প্রসন্ন হয়। মুমিনুল পাটোয়ারীর উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“যাক, নিশ্চিত হলাম। এবার একটা ইতিবাচক কিছু আশা করছি।”
“বিজনেসে নাহয় ইতিবাচক আশা করছ কিন্তু তোমার জীবনে কি কোন ইতিবাচক কিছু আসবে?”

নেহা নিজের কেবিনে বসে বসে অনেক গুলো ফাইল ঘাটছিল। শাহরিয়ার কায়সারের মতো প্রতিশোধপরায়ণ লোক শুধু তাকে ডিমোশন করেই ক্ষান্ত হন নি বরং নেহার কাজের চাপ আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন এমনকি অতিরিক্ত কয়েক ঘন্টা কাজ করতে হচ্ছে তাকে। শাহরিয়ারের নামে মনে মনে হাজারটা খারাপ কথা বলে নেহা নিজের কাজগুলো করে যাচ্ছে।
এমন সময় খালেক ইসলাম এসে নেহাকে বলে,
“তোমাকে একটা কথা জানানোর ছিল।”
নেহা ফাইল ঘাটতে ঘাটতেই বলে,
“জ্বি, বলুন।”

“আগামীকাল শাহরিয়ার স্যার পাটোয়ারী গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্টিজের সাথে একটা মিটিং করবেন আর সেখানে প্রেজেন্টেশনের দায়িত্ব তোমায় দিয়েছেন উনি।”
নেহা আৎকে উঠে বলল,
“আমাকেই কেন? এমনিতেই এত গুলো ফাইলের কাজ করতে হচ্ছে। তার উপর এখন আবার সারা রাত জেগে প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে হবে। কোন জন্মের বদলা নিচ্ছেন উনি আমার উপর?”
“আস্তে বলো। উনি শুনলে আবার রেগে যাবেন। এতদিন তো শামিম কায়সার স্যার ছিলেন তখন আমাদের জীবন অনেক সুন্দর ছিল। তবে এবার মনে হচ্ছে, শাহরিয়ার স্যার আমাদের জীবন একদম ওষ্ঠাগত করে দেবেন।”
এরমধ্যে শাহরিয়ার কায়সার নিজের কেবিন থেকে খালেক ইসলামকে ডাক দেয়। যার ফলে তাকে চলে যেতে হয়। এদিকে নেহা ভাবতে থাকে,

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৭

“পাটোয়ারী গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্টিজ! নাম তো শুনেছি। কিন্তু এই কোম্পানির ওনারকে তো কখনো দেখি নি। যাইহোক, আমার কি তাতে? আপাতত দ্রুত বাসায় ফিরে নেহার জন্য রাতের খাবার বানাতে হবে তারপর আবার প্রেজেন্টেশনও তৈরি করতে হবে। আমি কাজে লেগে পড়ি।”

উত্তল তরঙ্গ পর্ব ১৯