উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৫
দিশা মনি
নেহা তার মেয়ে নিয়াকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। নেহার জীবনটা এখন বড্ড এলোমেলো হয়ে গেছে হঠাৎ করে। সে যা আশা করেনি তাই ঘটে গেছে তার সাথে। সামনেই নতুন মাস পড়তে চলেছে। বাসা ভাড়া, নিয়ার স্কুলের ফি সহ আরো অনেক খরচ আছে। এজন্য তার টাকার প্রয়োজন। তাই তাকে খুব জলদি একটা নতুন চাকরির বন্দোবস্ত করতে হবে যেকোন মূল্যে। নেহা চোখ বন্ধ করে দৃঢ় সংকল্প করে বলল,
“কাল সকালেই আমায় নতুন চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে।”
নেহা জলদি করে উঠে এসে কম্পিউটারে কিছু জব সার্কুলার চেক করতে লাগল। তারপর নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী সেখান থেকে কিছু জবের জন্য ইন্টারভিউ ফরম পূরণ করে। নেহা ফরম গুলো পূরণ করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“আশা করি এর মধ্যে থেকে কোন একটা চাকরি আমি পেয়ে যাব। তাহলে আর এসব নিয়ে কিছু ভাবতে হবে না৷ তবে যাই হয়ে যাক, ইনফিনিক্সে আমি আর কখনো ফিরব না।”
অতঃপর নেহা আবারো গিয়ে নিয়াকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। নিয়াকে নিজের বুকের অনেক কাছে আগলে নেয় নেহা। তার মনে পড়ে আহিরের সাথে দেখা হবার কথা। নেহা বলে ওঠে,
“অতীতের কালো ছায়া থেকেও আমার নিজের মেয়েকে দূরে থাকতে হবে। আমি জানি, সবটা এত সহজ হবে না। কিন্তু আমায় পারতেই হবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মুমিনুল পাটোয়ারী রাতে ডিনার করছিলেন। এমন সময় নাতাশা হাসিমুখে তার সামনে উপস্থিত হয়ে বলে,
“আঙ্কেল, আসব?”
“আরে নাতাশা, এসো বসো আমার পাশে।”
নাতাশা মুমিনুল পাটোয়ারীর পাশে বসে। মুমিনুল পাটোয়ারী বলেন,
“ডিনারটা আজ আমাদের এখানেই করে যাও।”
“আহির ও আহিরা ডিনার করে নিয়েছে?”
“হ্যাঁ, ওরা অনেক আগেই করে নিয়েছে। আমি কিছু জরুরি কাজে একটু বাইরে গেছিলাম। ফিরতে একটু রাত হলো..তাই আরকি ডিনার করতে দেরি।”
“ওহ।”
নাতাশা নিজের প্লেটে ভাত বেড়ে নিয়ে খেতে শুরু করল। মুমিনুল পাটোয়ারীও খাওয়ায় মনযোগী ছিলেন। এমন সময় নাতাশা হঠাৎ করে বলে ওঠে,
“আঙ্কেল, আপনাকে একটা কথা অনেক দিন থেকে বলব ভাবছি কিন্তু কিছুতেই বলার সাহস পাচ্ছি না।”
“কি কথা?”
“আসলে আপনি তো জানেন, আহিরের জীবনটা কত কষ্টের। ছোটবেলা থেকে ও কতোটা কষ্টে বড় হয়েছে। তারপর ওর মা, প্রিয় বন্ধু মৃদুল সবাই ওকে একা একা ছেড়ে চলে গেল। এখন ও আহিরাকে নিয়ে জীবন কাটাতে চাইছে কিন্তু আহিরা..মেয়েটা যে কেমন আপনিও জানেন। এমন কঠিন হৃদয়ের বাচ্চা আমি নিজের জীবনে দেখি নি। জানিনা, আহির বাকিটা জীবন এভাবে কিভাবে কাটাবে।”
মুমিনুল পাটোয়ারী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,
“আমার মাথাতেও তো সবসময় এসব চিন্তাই ঘুরপাক খেয়ে। আমি আহিরকে নিজেদের ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমিও চাই ও জীবনে সুখী হোক। কিন্তু ও যে আমার কোন কথাই শুনতে চায় না।”
“আপনি একটু আহিরকে ভালো ভাবে বোঝান না আঙ্কেল যেন ও এবার নিজের জীবন নিয়ে ভাবে৷ কিসের অভাব আছে ওর? সহায়-সম্পত্তি, রূপ সব দিক দিয়ে ও পারফেক্ট।”
“হুম কিন্তু আহিরের তো একটা মেয়ে আছে..এটাই সমস্যা।”
“এটা কোন সমস্যাই না। আহিরাকে তো আমিও নিজের মেয়ে মনে করি।”
মুমিনুল পাটোয়ারী বলেন,
“আমি জানি নাতাশা, তুমি আহিরকে পছন্দ করো। আমিও চাই তোমার ও আহিরের একটা সুখের সংসার হোক। কিন্তু আহির রাজি থাকলে আমি কিভাবে কি করি?”
“আপনি চাইলেই সব করতে পারেন আঙ্কেল। আহির আপনাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। আপনি বললে ও যদি রাজি হয়। আমি ওকে অনেক বার বলেছি কিন্তু ও আমায় ফিরিয়ে দিয়েছে।”
“আমার মনে হয় না আহির রাজি হবে কারণ আমি ওকে অনেকবার বিয়ের ব্যাপারে বলে নেতিবাচক উত্তর শুনেছি।”
“সোজা পথে হয়তো হবে না কিন্তু..”
“কিন্তু কি নাতাশা?”
“আপনি যদি আহিরকে কোনভাবে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে পারেন তাহলে কাজ হতে পারে।”
“মানে?”
“ধরুন আপনি অসুস্থ হওয়ার অভিনয় করলেন আর এটা নিয়ে আহিরকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করলেন।”
“কি বলছ তুমি? এটা করা কি ঠিক হবে?”
“আহিরের ভালোর জন্য যে এটা আপনাকে করতেই হবে আঙ্কেল। আমার ফ্যামিলিও আমায় বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু আপনি তো জানেন যে, আমি শুধু আহিরকে ভালোবাসি তাই ওকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
“সবটাই বুঝতে পারছি। কিন্তু এমন অভিনয় করাতে আমার মনটা সায় দিচ্ছে না।”
নাতাশা এবার কান্নার ভান করে মুমিনুল পাটোয়ারীর হাতটা আলতো করে স্পর্শ করে বলে,
“আমার দিকটা একবার ভাবুন আঙ্কেল, আহিরকে ছাড়া আমি বাঁচব না। আপনি ছাড়া আর কেউ নেই যে আমার এই ভালোবাসার পূর্ণতায় সাহায্য করবে। আহির যেমন আপনার ছেলে তেমনি আমিও তো আপনার মেয়ে। আপনি আমার জন্য এটুকু করবেন না? আর এতে তো আহিরেরও জন্য ভালো হবে।”
মুমিনুল পাটোয়ারী বলেন,
“আচ্ছা, আমি চেষ্টা করে দেখি।”
নাতাশার মুখে স্বস্তির হাসি দেখা দেয়। সে মনে মনে বলে,
“এবার আমাকে আর আহিরকে এক হওয়া থেকে আর কেউ আটকাতে পারবে না।”
আরাভ কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছে ট্রেন থেকে নামল। তার হাতে সার্টিফিকেট সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। আরাভ নিজের ফোন বের করে তার ইন্টারভিউ দেওয়া অফিসের ঠিকানা বের করল। অতঃপর বলল,
“রয়াল প্যালেস। এখন এখানেই যেতে হবে আমায়। দেখা যাক, এখানে যদি চাকরিটা পেয়ে যাই তাহলে আব্বুর চিকিৎসাসহ সংসারের অন্যান্য খরচ অনেকাংশেই মিটবে।”
এমন ভাবনা থেকেই আরাভ এগিয়ে যেতে থাকে। তার চোখে অনেক আশা। এই ইন্টারভিউ শেষ করেই সে যতটা পারবে নেহাকে খুঁজবে এই ঢাকা শহরে। তার কেন জানি আজ বারবার মনে হচ্ছে, নেহাকে পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক। ঢাকা থেকে আসার সময় সে জোড়া শালিক দেখেছিল গাজীপুর রেলওয়ে স্টেশনে। আরাভ শুনেছিল তার দাদির কাছে যে, জোড়া শালিক দেখলে নাকি হারিয়ে যাওয়া কারো সন্ধান পাওয়া যায়। যদিও সবসময় সে এসবকে কুসংস্কার ভেবে এড়িয়ে গেছে কিন্তু আজ কেন জানি তার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে এই কথাটা।
নেহা রয়াল প্যালেসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখানেই আজ তার জব ইন্টারভিউ। নেহাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েই নেহা সেখানে যাবে। নিয়া স্কুলড্রেস পড়ে নেহার সামনে এসে বলল,
“আমাকে কেমন লাগছে আম্মু?”
নেহা হাস্যজ্বল চেহারায় নিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“আমার নিয়ামনিকে তো সবসময় ভালো লাগে৷ আজকেও বরাবরের ভীষণ ভালো লাগছে।”
“জানো আম্মু, আগামী সপ্তাহে আমাদের কলেজে একটা ড্রামা হবে। তার জন্য আজ অডিশন নেয়া হবে। আমি কি স্নো হোয়াইট চরিত্রের জন্য চান্স পাবো।”
“তুমি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করো৷ তবে যদি চান্স না পাও তবুও নিরাশ হয়ো না।কারণ মনে রাখবে, যে সত্যিকারের যোগ্য সেই সুযোগটা পাবে। তাই তোমাকে অবশ্যই তাকে এপ্রিশিয়েট করতে হবে।”
“আচ্ছা।”
“আমিই স্নো হোয়াইট হবো, তাই না পাপা?”
আহিরার প্রশ্নের জবাবে আহির হেসে বলে,
“অবশ্যই। আমার প্রিন্সেস হলো সবথেকে বেস্ট। তাই এই ড্রামায় সবথেকে বেস্ট পার্টটা আমার মেয়েই করবে।”
“ঠিক বলেছ। এই স্কুলে কি আমার থেকে বেস্ট আর কেউ নেই।”
“ঠিক, আমার প্রিন্সেসের কাছে বাকিরা কিছুই না। আমি তো ১০০% শিওর যে আমার মেয়েই হবে স্নো হোয়াইট।”
আহিরার বুকটা গর্ভে ফুলে ওঠে নিজের বাবার প্রশংসা শুনে।
নেহা নিয়াকে তার স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে রয়্যাল প্যালেসের দিকে রওনা দেয়। রয়্যাল প্যালেসে পৌঁছে সে দেখে তার কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। তাই নেহা দ্রুত ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করে। এমন সময় হঠাৎ করে একজনের সাথে ধাক্কা খায়। নেহা তার চেহারাটা ভালোভাবে খেয়াল না করেই বলে ওঠে,
“সরি!”
উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৪
তারপর চলে যেতে নেয়। এমন সময় আরাভ একইসাথে বিস্ময় ও খুশির অনুভূতি নিয়ে তাকায় নেহার দিকে। তার সাথেই নেহা ধাক্কা খেয়েছে। নেহা একটু এগিয়ে যেতেই আরাভ পেছন থেকে তার নাম ধরে ডেকে বলে ওঠে,
“নেহা!”