উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৬
দিশা মনি
নেহা আরাভকে দেখে চরম পর্যায়ের অবাক হয়। নেহা ভাবতেও পারে নি দীর্ঘ ৫ বছর পর আবারো আরাভের মুখোমুখি হতে হবে এভাবে। নেহার মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। সে সহাস্যে এগিয়ে যেতে নেয় আরাভের দিকে। এমন সময় হঠাৎ করে তার মনে পড়ে যায় ৫ বছর আগের আরাভের সেই অবিশ্বাসের কথা। নেহার পা থেমে যায়। আরাভ তার দিকে এগিয়ে আসলেও সে এবার একাই নিজের মতো এগিয়ে যেতে থাকে। আরাভ পেছন থেকে বলে ওঠে,
“নেহা দাঁড়া, তোর সাথে আমার জরুরি কথা আছে।”
কিন্তু নেহা দাঁড়ায় না। সে নিজের মতো রয়্যাল প্যালেসে প্রবেশ করে চুপচাপ বসে পড়ে। আরাভ এসে ঠিক নেহার পাশে বসে। অতঃপর মলিন স্বরে বলে,
“তুই আমার উপর রাগ করে আছিস তাই না নেহা? রাগ করাটাই স্বাভাবিক। পাঁচ বছর আগে আমি তোকে বিশ্বাস করি নি। তুই আমাকে সবটা বলার চেষ্টা করেছিলি। কিন্তু তোর বিপদে তোকে সঙ্গ না দিয়ে আমি..”
নেহা আরাভের উদ্দ্যেশ্যে বলে ওঠে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“অতীত থেকে আমি অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছি। দয়া করে আমাকে আর ঐ জঘন্য অতীতে ফিরতে বাধ্য করবেন না। আমি এখন শুধু আমার সামনের দিন গুলোর কথা ভাবি।”
“তুই আমার সাথে এমন অপরিচিতর মতো ব্যবহার কেন করছিস নেহা?”
“বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তাই তো? আমারও কষ্ট হয়েছিল যখন ৫ বছর আগে আমি অনেক ভরসা নিয়ে তোমার কাছে, বড় আব্বুর কাছে আশ্রয়ের জন্য ছুটে গেছিলাম। কিন্তু তোমরা…”
“আমি জানি, আমি যা করেছিলাম তা অনেক বড় অন্যায় ছিল। কিন্তু এই অন্যায়ের জন্য যথেষ্ট ফলভোগও করতে হয়েছে আমাকে..আর আব্বু..ঐ মানুষটা তো দীর্ঘ ৫ বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছেন।”
আরাভের কথা শুনে নেহা হতবাক করেন,
“কি বলছ তুমি আরাভ ভাই? কি হয়েছে বড় আব্বুর?”
নেহার কন্ঠে উদ্বিগ্নতা। যতোই তার বড় আব্বুর প্রতি অভিমান থাকুক, লোকটাকে তো নিজের বাবার মতোই দেখেছে সে। তাই তার এই অবস্থার কথা শুনে আর চুপ থাকতে পারল না। আরাভ কষ্ট মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“তোকে ওভাবে বের করার কিছুদিন পর আব্বুর হঠাৎ করে স্ট্রোক হয়…তাঁর জ্ঞান হারানোর আগেই সে আমায় বলেছিল যে..তুই কোন দোষ করিস নি..এটাই ছিল ওনার শেষ কথা। এরপর আব্বুকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। উনি প্রাণে বেঁচে গেলেও কোমায় চলে যান। আমাদের ব্যবসাও ডুবে যায়।”
“কি বলছ তুমি এসব?”
“ঠিকই বলছি। হয়তো তোর উপর করা অন্যায়ের ফলই ভোগ করছি আমরা। এটাই হয়তো হওয়ার ছিল।”
“আমি কখনোই এমনটা চাই নি ভাইয়া।”
‘অনেক সময় তো মানুষের দীর্ঘ শ্বাসও অভিশাপের কারণ হয়। তেমনটাই হয়তো হয়েছে।’
“বড় আব্বু কেমন আছেন এখন? উনি ঠিক হয়ে যাবেন তো?”
“জানি না, দীর্ঘ ৫ বছর থেকে ডাক্তাররা শুধু একের পর এক আশার বাণীই শোনাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন দেখতে পারছি না। তবে আমার স্থির বিশ্বাস, তুই যদি একবার গিয়ে আব্বুর সাথে দেখা করিস তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আব্বু আবার আগের মতো হয়ে যাবে।”
আরাভের কথা শুনে নেহা বুঝতে পারে না কি বলবে। আরাভ অনেক আশা নিয়ে নেহার হাত আলতো করে স্পর্শ করে বলে,
“তুই ফিরবি তো নেহা?”
নেহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“কিন্তু আমি যে ৫ বছর আগেই অতীতকে পেছনে ফেলে চলে এসেছি…”
“আব্বুর ভালোর জন্যেও কি তুই ফিরবি না?”
নেহা চুপ হয়ে যায়।
“ভেবে দেখছি।”
বলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে।
ইন্টারভিউটা কোনরকমে দিয়ে আরাভের সাথে বাইরে এসেছে নেহা৷ দুজনেই একসাথে রেস্টুরেন্টে বসে আছে। দুজনের মধ্যেই বিরাজ করছিল নিস্তব্ধতা। আরাভ নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে ওঠে,
“এই ৫ বছর তুই একা কিভাবে এই শহরে টিকে আছিস নেহা? তোকে নিশ্চয়ই অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।”
“হুম, শুরুর দিকে কিছুটা কষ্ট ছিল। তবে ধীরে ধীরে আমার গা শয়ে গেছে। এখন আর কষ্টগুলোকে বড় মনে হয় না।”
আরাভ কিছুটা ইতস্তত বোধ করে বলে,
“আর তোর সন্তান? সে কি এখনো আছে?”
নেহা বলে,
“হুম, আছে। ওকে নিয়েই এখন আমার জীবন। এখন ওর বয়স ৫৷”
আরাভ আর কিছু বলার সাহস পায় না। নেহা বলে,
“আমি বড় আব্বুকে দেখার জন্য একবার গাজীপুরে যেতে চাই৷ তবে আমি সেখানে বেশিদিন থাকব না। গিয়েই আবার ফিরে আসব।”
“আমি তো তোকে আটকে রাখার ক্ষমতা অনেক আগেই হারিয়েছি নেহা। এখন যে তুই এত কিছুর পরও আব্বুর ভালোর জন্য গাজীপুরে ফিরতে রাজি হয়েছিস এটাই আমার কাছে অনেক।”
“আমি নিজের মেয়েকে সবসময় আমার অতীত থেকে দূরে রাখতে চেয়েছি। এখনো আমি চাই না, হঠাৎ করে ও এমন কোন সত্যের মুখোমুখি হোক যা ওর অস্বস্তির কারণ হবে। আমি নিজের মেয়েকেও ঢাকায় একা রেখে যেতে পারব না। তাই শুধু তোমার কাছে এতটুকু নিশ্চয়তা চাই যে..আমার মেয়ে যেন কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির স্বীকার না হয়..বিশেষ করে বড় আম্মুর কারণে।”
“এই পাঁচ বছরে আম্মুর মধ্যে অনেক বদল এসেছে নেহা৷ তুই কোন চিন্তা করিস না, আম্মু তোকে দেখলে বরং খুশিই হবে। আর তোকেও কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না। ”
এই কথা শুনে নেহা একটু স্বস্তি পায়।
আহির সবেমাত্র আহিরাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল। এমন সময় মুমিনুল পাটোয়ারী এসে আহিরের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে বললেন,
“ভেতরে আসব?”
“জ্বি, আব্বু। এসো।”
মুমিনুল পাটোয়ারী ভেতরে এলেন। আহির তার চিন্তিত মুখ দেখে বলল,
“কিছু বলবে?”
“কিছু না অনেক কিছু। এবার তোমাকে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেই হবে।”
“কোন সিদ্ধান্ত?”
“আমি এবার পণ করে নিয়েছি। তোমায় আর একা থাকতে দেব না। তোমায় এবার বিয়ে করতেই হবে।”
আহির বিরক্তির স্বরে বলে,
“তুমি আবার আমার বিয়ে নিয়ে পড়েছ আব্বু? তোমাকে তো কতবার বলেছি যে…”
“দেখো, এসব অনেক শুনেছি আর না। বেঁচে থাকতে থাকতে তোমার একটা ব্যবস্থা আমি করে দিয়ে যাবোই। ”
“আব্বু..”
“তোমাকে আমার কথা রাখতেই হবে আরাভ। এমনিতেই আমার হার্টের রোগটা এখন বেড়েছে। আমি তো এটাই ভাবি যে, আমার মৃত্যুর পর তোমার কি হবে!”
“এসব কথা বলো না আব্বু। তোমার কিছু হবে না।”
“তুমি যদি বিয়ে না করো তাহলে আমার দুশ্চিন্তা কমবে না। তাই এমন কিছু ঘটলে অবাক হবার কিছু নেই।”
“তুমি কি আদাজল খেয়ে পড়েছ যে আমার বিয়ে দেবেই?”
“হ্যাঁ, সেটাই। এবার তোমায় বিয়ে না দিয়ে আমি শান্তি পাবো না।”
“আব্বু আমি..”
উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৫
“আমার শেষ ইচ্ছা তুমি বিয়ে করো। যদি আমাকে নিজের আব্বু হিসেবে মেনে নিয়ে থাকো তাহলে এই ইচ্ছা তোমায় পূরণ করতে হবে। নাহলে আমি ভাববো তুমি কখনো নিজের বাবার স্থানটা আমাকে দাও নি।”
আহির এবার চরম সংকটে পড়ে। এমতাবস্থায় তার আর না করার সাহস হয় না। তাই সে বলে,
“আচ্ছা, ভেবে দেখছি..”
এমন সময় নাতাশা সেখানে চলে আসে। আহিরের কথা শুনে হাসি ফুটে ওঠে তার মুখশ্রীতে। নাতাশা আনমনে বলে ওঠে,
“এবার আহির আমার হবে..শুধুই আমার।”