উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৭
দিশা মনি
নেহা আরাভকে সাথে নিয়ে নিজের বাসায় এসে উপস্থিত হলো। যদিও তার মনে শুরুর দিকে খানিক সংশয় কাজ করছিল যে কিভাবে আরাভের সাথে নিয়ার পরিচয় করিয়ে দেবে তবুও শেষ অব্দি সব সংশয় কাটিয়ে সে আরাভকে নিয়ে আসতে পেরেছে। আরাভ অবশ্য নেহার সাথে এসে ভীষণ ভালো বোধ করছে। তার মনে এখনো একটা আশা আছে যে নেহাকে সে আবার নিজের করে ফিরে পাবে। সেই আশাটা এতদিনে মলিন হয়ে এলেও এখন যেন আবার নতুন করে স্বপ্নটা দেখছে সে।
নেহা আরাভকে বলে,
“আমার মেয়ে নিয়া স্কুলে আছে..ও ফিরে এলে আমি ওকে সবটা বুঝিয়ে বলে তারপর নাহয় গাজীপুরের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেব।”
আরাভ হঠাৎ করে নেহার কাছে এসে বলে,
“তুই নিজের মেয়েকে অনেক ভালোবাসিস তাই না?”
“আমি ছাড়া যে ওকে ভালোবাসার মতো এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই!”
আরাভ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নেহা নিজের দূর্বলতা দেখাতে চায় না কারো সামনে৷ তাই অজুহাত দিয়ে বলল,
“তুমি একটু বসো..আমি তোমার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করছি।”
“আমার সাথে তোকে এত ফর্মালিটি করতে হবে না। আমি তো তোর আপনজনই।”
“সত্যিই কি তুমি আমার আপন? যদি আপন হতে তাহলে এই ৫ বছর কিভাবে আমার থেকে দূরে থাকলে?”
“বিশ্বাস কর নেহা..তোকে আমি কোথায় কোথায় না খুঁজেছি কিন্তু..”
“থাক। তোমায় আর আমাকে কিছু বিশ্বাস করাতে হবে না। আমার যা বোঝার আমি বুঝেছি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আহিরা ও নিয়া দুজনেই একসাথে বসে আছে তাদের স্কুলের অডিশনের মঞ্চে৷ তাদের দুজনের মনেই আশা আছে তারাই স্নো হোয়াইট হবে। তবে দুজনের মানসিকতা ভিন্ন। আহিরা, যে ছোটবেলা থেকে যখন যা চেয়েছে তাই পেয়েছে তার কাছে এটা একটা জেদ, তার প্রিয় কোন খেলনার মতো। যেটা তাকে আদায় করে নিতেই হবে। অপরদিকে নিয়া, সে নিজের মায়ের পরামর্শমতো নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করবে। তবে সে এতটাও ব্যাকুল নয়। বরং সে আশাবাদী।
হঠাৎ করে তাদের স্কুলের একজন ম্যাম এগিয়ে এসে বলেন,
“এবার নিয়ার পালা..নিয়ামনি তুমি এসো তো। দেখি তুমি স্নো হোয়াইট এর অভিনয় কেমন করতে পারো।”
নিয়া খুশিমনে এগিয়ে যায়। মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে গভীর শ্বাস নেয়। তার চোখে মুখে ছিল শান্ত আত্মবিশ্বাস। সে ধীরে ধীরে তার সংলাপ বলতে শুরু করে। নিয়ার কণ্ঠস্বর স্পষ্ট এবং মিষ্টি। নিয়া এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে যেন সে আসলেই গল্পের স্নো হোয়াইট। তার সারল্য আর নিষ্পাপ ভঙ্গি উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করে তোলে। ম্যামরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসেন, যা নিয়ার অভিনয়কে আরও উৎসাহিত করে।
নিয়া যখন তার অভিনয় শেষ করে, তখন সবার অলক্ষ্যে আহিরার চোখে মুখে ঈর্ষার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে মনে মনে ভাবে,
“এই মেয়েটার অভিনয় হয়তো ভালো হয়েছে, কিন্তু আমার চেয়ে ভালো নয়। স্নো হোয়াইট তো আমিই হব!”
এরপর আসে আহিরার পালা। ম্যাম ডাকতেই আহিরা আত্মবিশ্বাসের সাথে মঞ্চে ওঠে। তার পোশাকে, হাঁটার ধরনে এমনকি তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি পর্যন্ত ছিলো আত্মবিশ্বাসে ভরা। আহিরা জানত সে কতটা সুন্দর ও কতটা নিখুঁত। সে নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে নিয়ার মতো তার অভিনয়ে সেই স্নিগ্ধতা বা নিষ্পাপ ভাবটি ছিল না, যা স্নো হোয়াইটের জন্য প্রয়োজন।
আহিরা চেষ্টা করছিল তার ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে। যা আসলে স্নো হোয়াইটের চরিত্রের থেকে বেশ ভিন্ন ছিল। অডিশন শেষ হলো। দুজনেই তাদের জায়গায় ফিরে বসল। অতঃপর অধীর আগ্রহে ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর ম্যামরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে রায় ঘোষণা করার জন্য প্রস্তুত হলেন। সবার দৃষ্টি মঞ্চের দিকে। প্রধান ম্যাম মাইক হাতে নিয়ে বললেন,
“আমরা অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই বছরের স্নো হোয়াইট নির্বাচিত হয়েছে… নিয়া!”
হলভর্তি হাততালির শব্দে নিয়া প্রথমে একটু হকচকিয়ে যায়, তারপর তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। আহিরার পাশেই নিয়া আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। কিন্তু আহিরা জমে যায়। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে, তার চোখে অবিশ্বাস আর ক্রোধ স্পষ্ট ফুটে ওঠে। সে যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার সব স্বপ্ন, সব জেদ মুহূর্তেই যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
আহিরা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। সে উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়াল এবং বলে উঠল,
“আমিই বেস্ট অভিনয় করেছি। এই মেয়েটা কিছুতেই স্নো হোয়াইট হতে পারে না।”
বলেই আহিরা এগিয়ে এসে হিংসার বসে নিয়াকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। নিয়া পড়ে গিয়ে অনেক ব্যথা পায়। তার চোখ জলে ভড়ে ওঠে। শায়লা নামের শিক্ষিকা এগিয়ে এসে নিয়াকে টেনে তুলেন। অতঃপর আহিরার উদ্দ্যেশ্যে রেগে বলেন,
“এটা কেমন ব্যবহার তোমার? ও তো তোমার ক্লাসমেট।”
আহিরা কান্না কান্না স্বরে বলে,
“আমার পাপা বলেছে আমিই বেস্ট, আমিই স্নো হোয়াইট হবো। অন্য কেউ না।”
“এতটুকু বাচ্চার এত জেদ ভালো না।”
“আপনি আমায় বসলেন মিস! আমি আমার পাপাকে বলে দেব। আমিই স্নো হোয়াইট হবো।”
বলেই আহিরা স্থান ত্যাগ করে।
নিয়া স্কুলশেষে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে৷ একটু পরই নেহা আসে তাকে নিয়ে যেতে। কিন্তু নিয়া একদম স্তব্ধ ছিল। নেহা নিয়াকে এমন চুপচাপ দেখে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে নিয়া? তুমি এত চুপচাপ কেন? অডিশন ভালো হয়নি?”
নিয়া বলে,
“আমি স্নো হোয়াইট হয়েছি আম্মু!”
“এটা তো অনেক খুশির খবর৷ তাহলে এত দুঃখী দুঃখী ভাব করে আছ কেন?”
কথা বলতে বলতেই নেহা খেয়াল করল নিয়ার হাত ছিলে গেছে। মূলত তখন আহিরার ধাক্কার কারণেই এমন হয়েছে। নেহা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“দেখি..এটা কিভাবে হলো?”
নিয়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। সে ভাবে, এসব কথা শুনে যদি নেহা দুশ্চিন্তা করে তাই সে বলে,
“এমনি আসলে পড়ে গিয়ে..”
“তোমাকে কতবার বলেছি নিয়া সাবধানে চলতে।”
“সরি আম্মু।”
নিয়াকে ধাতস্থ দেখে নেহা বলে ওঠে,
“তোমাকে আজ একজনের সাথে দেখা করাবো৷”
উত্তল তরঙ্গ পর্ব ২৬
“কার সাথে আম্মু?”
“তোমার মামার সাথে।”
“আমার মামা?”
“হুম, আজ প্রথম তুমি দেখা করবে তার সাথে।”
নিয়া খুবই উদগ্রীব হয়ে যায় তার মামার সাথে করার জন্য।