উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৪
দিশা মনি
নেহা নিয়াকে নিজের বুকের কোণে জড়িয়ে ধরল। আহিরা নেহার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। আচমকা তাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো,
“আন্টি..তুমি এখানে? তোমায় দেখে অনেক খুশি হয়েছি। জানো তোমাকে কতদিন থেকে আমি কত মিস করি।”
নেহা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। আহিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“আপনি এখানে কি করছেন?”
আহির বললো,
“এই প্রশ্ন তো আমার তোমাকে করা উচিৎ।”
“মানে?”
এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলো নাতাশা। নাতাশা এসেই আহিরের পাশে দাঁড়িয়ে তার হাতটা আলতো করে ধরে বলল,
“আজ এই কমিউনিটি সেন্টারে আমার সাথে আহিরের এনগেজমেন্ট। সেজন্যই আমরা এখানে এসেছি।”
নেহা চরম অবাক হলো নাতাশার কথা শুনে। সে তো ভেবেছিল তাদের বিয়ে আগেই হয়ে গেছে, তাহলে এখন এনগেজমেন্টের মানে কি? আহির নেহার চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব বুঝতে পারল। নেহা জিজ্ঞেস করলো,
“আপনাদের এনগেজমেন্ট মানে..”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আহির নাতাশার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। নাতাশা শুকনো ঢোক গিলল। আহির আর কিছু না বলেই আহিরাকে কোলে তুলে নিয়ে চলে গেল অন্যদিকে। নাতাশাও নিজের মতো চলে গেল। নেহাকে এক গভীর প্রশ্নের ফাঁদে রেখে গেল তারা। নেহা মনে মনে ভাবল,
“আমি তো ভেবেছিলাম মিস্টারের আহিরের সাথে নাতাশার বিয়ে হয়ে গেছে এবং আহিরা তাদেরই সন্তান। কিন্তু যদি তাদের বিয়ে না হয়ে থাকে তাহলে এই বাচ্চাটা..”
নেহার মনে কেমন সংশয় জাগলো। প্রথমবার আহিরাকে দেখার পর তার ভীষণ আপন আপন ঠেকছিল। এখন সেই অনুভূতি যেন আরো গাঢ় হচ্ছিল৷ নেহা মনে মনে বলে,
“আমাকে এবার সত্যটা জানতেই হবে। হয়তো আসল সত্য এতদিন আমার আড়ালে থেকে গেছে। আহিরা কি সত্যিই নাতাশা-আহিরের মেয়ে। হ্যাঁ, এমনটা হতে পারে যে বিয়ের আগেই তাদের সন্তান হয়েছে। এমনটা হলে আমি অবাক হবো না। কিন্তু আদোতে কি এটা সত্য? আমারও তো দুই যমজ মেয়ে হবার কথা ছিল। সব যমজরা তো দেখতে একরকম হয় না। তার মানে কি হতে পারে যে, আহিরা আমার মেয়ে…আমাকে সত্যটা এবার জানতেই হবে। যদি ও সত্যিই আমার মেয়ে হয় তাহলে ওকে আমি নিজের কাছে নিয়ে আসব। ঐ রাক্ষসটার কাছে কিছুতেই থাকতে দেব না।”
এনগেজমেন্টের স্থানটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চারিদিকে সুন্দর সাজসজ্জা ও লাইটিং এর পাশাপাশি হাজারো অতিথির পদচারণা মিলে সে এক অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে। আরাভ নিজের কাজগুলো ঠিকভাবে সমাপ্ত করতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। রিনা আরাভকে দূর থেকে দেখছিল। এমন সময় তার চোখ যায় সামনের দিকে। এনগেজমেন্টের মূল অনুষ্ঠান শুরু হবার পথে। সে কখনো এমন ধনীদের অনুষ্ঠানের সাক্ষী হয় নি। তাই নিজ চোখে তার সবকিছু দেখার ইচ্ছা মনে জাগলো। আহির মঞ্চের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ফোনে কারো সাথে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল সে। আহিরকে দেখেই রিনা অবাক হয়ে যায়। আমতাআমতা করে বলে,
“আহির ভাই..উনি এখানে..তাহলে কি নাতাশাও আশেপাশে কোথাও আছে? ও যদি আমাকে দেখে নেয় তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
ভেবেই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায় রিনা। তার মনে পড়ে যায়, পুরানো কিছু স্মৃতি। রিনা আহির, নাতাশা ও মৃদুলের সাথে একই কলেজে পড়ত। তবে সে ছিল তাদের জুনিয়র। রিনার সাথে অবশ্য তাদের কারো তেমন ভাব ছিল না। তবে একটা ঘটনায় তাদের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করে। রিনা স্কুলের একটা অনুষ্ঠানে আহিরের সাথে মিলে অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। তখন তাদের হালকা পরিচয় হয়। মৃদুল ও নাতাশার সাথেও এভাবেই তার পরিচয় গড়ে ওঠে।
এভাবেই সময় কাটতে থাকে। একদিন রিনা যখন কলেজ শেষে বাসায় ফেরার জন্য রওনা দিচ্ছিল তখন এমন এক দৃশ্য তার চোখে আসে যা তাকে অবাক করে দেয়। রিনা দেখতে পায়, নাতাশা মৃদুলকে ঝোপের ঝাড়ে নিয়ে গিয়ে গোপনে কিসের জানি একটা প্যাকেট তার হাতে তুলে দিচ্ছে। প্রথম দিকে সে ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছিল। কিন্তু এরপরই রিনা এমন কিছু দেখে যা দেখে তার পিলে চমকে ওঠে। মৃদুল সেই প্যাকেটটা পাবার পরই উন্মাদের মতো সেটা চেটে খেতে থাকে। এই দৃশ্য দেখে রিনার কাছে সবটা পরিস্কার হয়ে যায়। সে আর কোন কথা না বলে ভয়ে নিজের বাড়িতে চলে যায়।
এই ঘটনার কিছুদিন পরেই মৃদুল সুই**সাইড করে। পরবর্তীতে তার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখে জানা যায় সে নেশায় আসক্ত ছিল৷ সবাই ভাবে, কোন একটা মেয়ের রিজেকশনের ফলেই হয়তো মৃদুল এভাবে নেশায় আসক্ত হয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়। এমন কথাই কলেজে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রিনা আসল সত্যটা অনুধাবন করতে পারে। তাই সে তখনই নাতাশার সাথে যোগাযোগ করে। নাতাশাকে হুমকি দেয় তার সত্য ফাঁস করে দেবে। তখন নাতাশা রিনাকে অনুরোধ করতে থাকে সত্যটা গোপন করার জন্য। রিনা কোনভাবে রাজি না হওয়ায় সে নিজের এই নেশাজাতীয় দ্রব্য বিক্রির টাকার একটা বিরাট অংশ রিনাকে দেয়ার অফার করে। রিনা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিল৷ খুব একটা স্বচ্ছলতা ছিল না তার জীবনে। সেজন্য সে লোভে পড়ে যায়। এরপর সেও নাতাশার সাথে এই কাজে জড়িয়ে পড়ে। গোপনে অনেক যায়গায় ড্রাগ সাপ্লাই দিত সে নাতাশার সাথে। এক কথায় নাতাশার ক্রাইম পার্টনার হয়ে উঠেছিল সে। এভাবেই সময় কাটতে থাকে। নাতাশার সাথে রিনার সখ্যতা বজায় থাকে৷ নাতাশা রিনার সাথে এতোটাই ফ্রি হয়ে যায় যে, তাকে নিজের সব পরিকল্পনাও বলে৷ নাতাশা রিনাকে বলে, সে আহিরকে একটা মেয়ের বিরুদ্ধে উস্কানি দিচ্ছে যাতে মৃদুলের মৃত্যুর দোষ সেই মেয়ের উপর চাপানো যায়।
তবে রিনা জানতো না সেই মেয়ে নেহা। বা কখনো তার চেহারাও দেখেনি। এরমধ্যে নাতাশা একদিন জানতে পারে, রিনা তাকে ঠকাচ্ছে, নেশাদ্রব্য বিক্রি করে যত টাকা সে লাভ করছে তার কিছু অংশ সরিয়ে রাখছে। এই প্রতারণার কথা জেনে নাতাশা অনেক রেগে যায়। নাতাশা রিনাকে ডেকে এনে অনেক রাগারাগি করে এবং মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তখন রিনা নাতাশার পায়ে পড়ে। নাতাশা এরপর ঠান্ডা মাথায় রিনাকে বলে,
“তুই আমার অনেক সত্য জানিস। তাই তোকে বাঁচিয়ে রাখার রিস্ক আমি নেবো না। তার উপর আজ যা বেঈমানি করলি…এখন যদি বাঁচতে চাস তাহলে তোর হাতে একটাই উপায়। এই দেশ ছেড়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যা। আর কখনো ফিরবি না।”
রিনা ভয়ে তখনই রাজি হয়ে যায়। রিনার বাবা একজন প্রবাসী ছিলেন যিনি সৌদিতে থাকতেন। রিনা এরপর সেখানে চলে যায়। তবে সেখানে বেশিদিন টিকতে পারে নি। কিছুদিন পরই সে দেশে ফিরে আসে। তবে রিনা বুঝতে পারে, নাতাশা একবার তাকে দেখে ফেললে তার বেঁচে থাকা মুশকিল। এজন্য সে নিজের বাড়ি, নাম, পরিচয় সব বদলে ফেলে। তার আসল নাম ছিল সুমাইয়া। এরপর সে গোপনে অন্য এলাকায় থাকতে শুরু করে। বাড়ি থেকে বেরও হতো না কোথাও। এরপর সেখানেই আরাভরা বাড়িভাড়া নিলে তাদের সাথে পরিচয় হয়।
এই কয়েক বছরে সে বাড়ির বাইরে দূরে কখনোই বের হয় নি। আজই প্রথম আরাভের সাথে এভাবে বাইরে আসা। এসেই কিনা এমন এক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের সাক্ষী হলো সে। আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
“আহির ভাই এখানে মানে নাতাশা আপুও চলে আসবে। আমায় এখনই এখান থেকে সরে যেতে হবে।”
বলেই সে দ্রুত বেরিয়ে যায় কমিউনিটি সেন্টার থেকে। ততক্ষণে আহির ও নাতাশা এনগেজমেন্টের উদ্দ্যেশ্যে মঞ্চে উঠে দাঁড়ায়। মুমিনুল পাটোয়ারী বলেন,
“আহির দ্রুত আংটিটা পড়িয়ে দে। মেয়েটা আর কত অপেক্ষা করবে।”
আহিরের নজর যায় নাতাশার দিকে। একটু দূরেই সে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে যেন কিছু যায় আসে না। আহিরের বুক কেপে উঠলো। তার মন চাইল যেন, নেহা তাকে থামাক। কিন্তু এমন কিছু হলো না। আহির আর মেনে নিতে পারল না। নাতাশা বলল,
উত্তল তরঙ্গ পর্ব ৪৩
“কিরে! আংটিটা পড়িয়ে দে।”
আহিরের হাত থেমে গেল। সে পারলো না আংটিটা পড়াতে। আংটিটা না পড়িয়েই সে দূরে সরে গেল। সবাই হতবাক হয়ে গেল আহিরের প্রস্থানে!