উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন সিজন ২ পর্ব ১৪
আফিয়া আফরোজ আহি
বাড়িতে ফিরেছি দিন দুয়েক হবে। সবার আদরে, যত্নে দিন গুলো সুন্দর করে কেটে গেছে। ফুপ্পির বাসায় থেকেছি তিনদিনের মতো। এতেই যেন আমি আমার বাড়িতে আসার জন্য উতলা হয়ে যাচ্ছিলাম। সব সময় মনে হতো এটা আমার বাড়ি না। আমি আমার বাড়ি যাবো। বাড়ি থেকে কেউ কল দিলেই কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলতাম,
“আমায় নিয়ে যাও, আমি এখানে থাকবো না”
ঠিক আমার মতো আম্মু, আব্বু, বাড়ির সবাই আমার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিল। তাঁদের বাড়ির মেয়ে তাঁদের বাড়িতেই চাই। তাদের নাকি আমায় ছাড়া চলছেই না। আদ্র ভাই কে কতো বার বলেছি তার ইয়াত্তা নেই। মাঝে মাঝে বেচারা বিরক্ত ও হয়েছে। তাতে আমার কি? আমি তো উনাকে জ্বালিয়ে মজা পেয়েছি। সেদিন আমায় কি ভয়টাই না দেখিয়েছিলো। অতঃপর আমার আর সবার জ্বালায় টিকতে না পেরে দুদিন আগে আদ্র ভাই নিজে এসে বাড়ি দিয়ে গেছে। তবে একটা জিনিস আমার ভালো লেগেছে সেটা হলো এই কদিন আদ্র ভাই আমার অনেক যত্ন নিয়েছে। নিজ হাত খাইয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে আমার যত্ন নেওয়া বেশির ভাগ উনিই করেছে। ফুপ্পি তো আমার এই পা*গল পনা দেখে বলেই দিয়েছে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“আমার বাড়ির বউ আমি কোথাও যেতে দিবো না। তোর না বিয়ে হয়ে গেছে? এখন আবার কিসের বাপের বাড়ি? বিয়ের পর শশুর বাড়িই থাকতে হয় মেয়েদের। এখন থেকে এখানেই থাকবি। তোকে আমি কোথাও যেতে দিবো না”
কান্না কান্না মুখ করে মৃদু কণ্ঠে ডাকলাম,
“ফুপ্পি”
ফুপ্পি গম্ভীর হয় কঠিন স্বরে বলে উঠলো,
“কিসের ফুপ্পি? কে তোর ফুপ্পি? শাশুড়ি হই। হয় শাশুড়ি আম্মু বলবি না হয় আম্মু বলে ডাকবি। কোনো ফুপ্পি টুপ্পি না”
ফুপ্পির ধমকে আমার চোখে পানি টলমল করে উঠলো। মনে হচ্ছে এই বুঝি চোখ বেয়ে অশ্রুর বৃষ্টি নামবে। ফুপ্পি আমার অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে। হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে মাথায় ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
“বোকা মেয়ে কান্না করছিস কেন? আমি তো মজা করছিলাম। তু্ই ইচ্ছে হলে বাড়ি যাবি, ইচ্ছে হলে এখানে এসে থাকবি। এতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই”
“তুমি সত্যি বলছো?”
“হ্যাঁ রে বাবা”
“এখন থেকে কি তোমায় শাশুড়ি আম্মু বলে ডাকতে হবে?”
আমার প্রশ্ন শুনে ফুপ্পি উচ্চ শব্দে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে বলল,
“পা*গলী মেয়ে আমার। তু্ই না আমার মেয়ে? তাহলে আম্মু ডাকতে কি সমস্যা? তাও যদি তোর সমস্যা হয় তবে তোর যেটা ডেকে কমফোর্টেবল মনে হবে তু্ই ওটাই ডাকিস”
একটু থেমে নরম স্বরে বলল,
“তবে আম্মু ডাকলে আমি অনেক খুশি হবো”
আমি ফুপ্পির গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,
“ঠিক আছে আম্মু। আজ থেকে তোমায় আম্মু বলেই ডাকবো”
ফুপ্পির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সাথে আমিও হেসে দিলাম।
বাড়ি আসার পর দুদিন হয়ে গেল আদ্র ভাই একটা বার ও কল করেনি। একবারও খোঁজ নেন নি। এই তার আমার প্রতি দায়িত্ব বোধ। এই তার আমার খেয়াল রাখার নমুনা? উনি কি এতটাই ব্যাস্ত যে একটা বার ফোন দিয়ে আমার খবরও নেয়ার সময় নেই উনার? নাকি ইচ্ছে করেই এমন করেছে? মনে পড়লো আসার দিনের কথা। আমায় বাড়ি দিয়ে আসার কথা শুনে উনার মুখে যেন অমাবস্যা জেঁকে বসেছিল। হাসি মুখটা এক নিমিষে আঁধারে ছেয়ে গেছে। খাবার না খেয়েই উঠে পড়লো উনি। সদর দরজার দিকে যেতে যেতে আমায় উদ্দেশ্য করে বলল,
“রেডি হয়ে নিচে আয় আমি গাড়িতে আছি”
ফুপ্পি আরুর থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়িতে বসার পর মুখ ফুটে শুধু একটা কথাই বলেছেন,
“সিট্ বেল্ট লাগা”
অতঃপর একদম চুপ। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে মুখে কুলুপ এটেছে। কোনো সারা শব্দ নেই। পুরো রাস্তায় একটা কথাও বলেনি। অন্য সময় কি সুন্দর গল্প করেন। এটা সেটা বলেন কিন্তু সেদিন পুরো চুপচাপ ছিলো। বাড়ির সামনে গাড়ি থামালে আমি নেমে যেতে নিলাম। পিছন থেকে বলে উঠলেন,
“সাবধানে থাকিস, নিজের খেয়াল রাখিস”
“তুমি ভিতরে আসবে না?”
“আমার কাজ আছে। পরে আসবে”
সেই যে মানুষটা গেল এরপর আর একটা বারের জন্য খোঁজ খবর নেয় নি। বাজে লোক একটা। ফোন হাতে নিয়ে রুমে পায়চারি করছি আর ভাবছি কল দিবো কি না! ভাবতে ভাবতে ডায়াল করেই বসলাম উনার নাম্বারে। রিং হচ্ছে,দুবারের মাথায় কল রিসিভ হলো। অপর পাশের মানুষটা সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। কোনো কথা নেই তার মুখে। বাধ্য হয়ে আমিই প্রথমে কথা শুরু করলাম,
“কেমন আছো? বেশি ব্যাস্ত?”
“এইতো আছি কোনো রকম। ব্যাস্ত না একটু কাজ করছিলাম।”
“জিজ্ঞেস করবে না আমি কেমন আছি?”
“ও আচ্ছা ভুলে গিয়েছিলাম। তু্ই কেমন আছিস? অবশ্য ভালোই তো থাকবি। ভালো থাকারই তো কথা। ভালো থাকার জন্যই তো এতো হুরুস্থূল করে যাওয়া”
বুঝতে অসুবিধে হলো না আদ্র ভাই রাগ করেছে। তাই ইচ্ছে করে ঠেস দিয়ে কথা বলছে। কিছু বললাম না চুপ করে রইলাম।
“দুপুরে খেয়েছিস?”
“হ্যাঁ, আমার খবর নেওয়ার সময় তোমার আছে?”
“তোর খবর নেওয়ার জন্য আমি না থাকলেও তোর আশেপাশে মানুষের তো অভাব নেই। কিন্তু আমার খবর নেওয়ার মানুষের অভাব, বড্ড অভাব”
“তোমার কি মন খারাপ? রাগ করেছো আমার ওপর?”
“মন থাকলে তো খারাপ হবে। আমার তো মনই নেই। মানুষ ভাবে আমার কোনো অনুভূতি নেই, আবেগ নেই। তু্ই রাগ করার মতো কিছু করেছিস যে রাগ করবো?”
“এই আদ্র ভাই এমন করছো কেন? বলো না তোমার কি হয়েছে? রাগ করেছো কেন?”
“তু্ই বল কি করছিলি? হঠাৎ আমায় মনে পড়লো যে? আমি তো ভেবেছিলাম তু্ই বোধ হয় ভুলেই বসেছিস তোর লাইফে আদ্র নামক একটা মানুষ আছে। তার অস্তিত্ব তোর আশেপাশে আছে”
আদ্র ভাইয়ের কথার অভিমানের সুর ভেসে আসছে। মানুষটা যে অভিমান করেছে। এখন আমি উনার অভিমান ভাঙ্গাবো কিভাবে? আদ্র ভাই মানুষটা এমমি এমনি তো এমন করে না। আজ করেছে তার কারণ কি? আমি কি এমন করেছি যার জন্য তার এতো অভিমান? ভাবছি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। কি বলবো সেটাও বুঝতে পারছি না। আমায় চুপচাপ থাকতে দেখে আদ্র ভাই গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
“কথা বলতে ইচ্ছে না হলে রেখে দে। জোর জবরদস্তি কথা বলার প্রয়োজন নেই”
“আরে আমি….”
খট করে কল কেটে গেল। ফুরফুরে মন এক নিমিষে খারাপ হয়ে গেল। আমি নিশ্চই এমন কিছু করেছি যার জন্য আদ্র ভাই আমার ওপর রেগে আছে। কিন্তু কি এমন করলাম? গবেট মাথা হলে যা হয় আরকি! কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। আমি কোনো ভুল করলে আগে তো কি সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতো আর আজ মুখের ওপর কল কেটে দিলো? হুহ, কথাই বলবো না উনার সাথে। এখন আদ্র ভাইয়ের সাথে সাথে আমার নিজের ও অভিমান হলো। সেঁধে কথা বললে বলবে নাহয় নাই। আমি আর ওনাকে কল দিচ্ছি না।
মুখ আঁধার করে হাঁটা দিলাম ঈশিতা আপুর রুমে। এখন কিছুই ভালো লাগছে না। আপুর কাছে বললে আপু নিশ্চই কোনো না কোনো বুদ্ধি দিবে। ঈশিতা আপুর রুমে ঢুকে দেখলাম পুরো রুমে কোথাও আপু নেই। গেল কোথায়? একটু আগেই তো রুমে আসতে দেখলাম। ব্যালকনি থেকে কথার শব্দ ভেসে আসছে। হাঁটা দিলাম ব্যালকনির দিকে। ওমা বোন আমার গ্রিলের সাথে হেলান দিয়েছি কারো সাথে কথা বলছে। কথা না বলে প্রেম আলাপ বললে ভালো হয়। লাজুক ভঙ্গিতে হেসে হেসে কথা বলছে। আমি নিশ্চিত আপু শিহাব ভাইয়ার সাথে কথা বলছে। শিহাব ভাইয়া আপুর ভার্সিটির সিনিয়র। দুজনের মাঝে ভীষণ ভাব। একে ওপরের বই আদান প্রদান হয়। আপুর কোনো সমস্যা হলে ভার্সিটিতো সবার আগে তাকেই পাওয়ার যায়। দুজন এমন ভাবে কথা বলে দেখে মনে হয়ে জামাই বউ কথা বলছে। ভাইয়া কল দিলেই আপুর মুখে লাজুক হাসি ফুটে উঠে। আমার বোন যে প্রেমে পড়ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। দুজন দুজনকে পছন্দ করে তবে কেউ মুখে প্রকাশ করছে না। হঠাৎ মাথায় দুস্টু বুদ্ধি চেপে বসলো। এক মিনিট ও দেরি না করে এপ্লাই করে ফেললাম।
“ভাউ”
ঈশিতা আপু চমকে পাশে তাকালো। হাতে থাকা ফোন পড়তে যেয়েও পড়েনি। আরেকটু হলেই পরে ইন্নালিল্লাহি হয়ে যেত। আপু বুকে ফুঁ দিতে দিতে বলল,
“বজ্জাত এভাবে কেউ ভয় দেখায়? এখন ফোন পরে গেলে কি হতো?”
“কি আর হতো তোমার প্রেম শুরুর আগে শেষ হয়ে যেত”
“ফাজিল বাজে বকছিস কেন?”
“বাজে বকবো না তো কি করবো? আমার মন খারাপ আর তুমি বসে বসে প্রেম আলাপ করছো? সেটা তো হতে পারেনা। আমার মন খারাপ মানে তুমি আমায় সান্তনা দিবে। তা না করে তুমি প্রেম আলাপ করছো?”
“হুস! আসতে বল। উনি লাইনে”
“বাহ্! উনি?”
“হ্যাঁ। তু্ই রুমে যেয়ে বস আমি আসছি”
আমি চলে এলাম। কানে ভেসে এলো ঈশিতা আপুর কথা। আপু ধীর কণ্ঠে বলছে,
“আচ্ছা ভাইয়া আমি কল রাখছি আমার বোন এসেছে তার নাকি মন খারাপ। ওর কথা শুনে নেই। পরে কথা বলছি”
ওপাশ থেকে কি বলল শুনতে পেলাম না। আপু রুমে এসে পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“এবার বল কি হয়েছে? মন খারাপ কেন?”
“আদ্র ভাই আমার ওপর রাগ করেছে”
“কেন? কি কাণ্ড ঘটিয়েছিস? আমি যতদূর আদ্র ভাইকে চিনি তিনি এমনি এমনি রাগ করার মানুষ না। নিশ্চই তু্ই এমন কিছু ঘটিয়েছিস যার জন্য ভাইয়া রাগ করছে। কাহিনী খুলে বল”
ঈশিতা আপুকে পুরো ঘটনা খুলে বললাম। ঘটনা শুনে আপুর মাথায় হাত। মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“গাধী মেয়ে কি করেছিস? তু্ই কি এই জীবনে বড় হবি না?”
আপুর কথার মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি করেছি আমি? বুঝিয়ে বলবে তো”
“আদ্র ভাই তোকে নিজের কাছে রাখবে বলে তোকে নিয়ে গেছে। তোর সেবাযত্ন করার জন্য, তোকে যেন সামনে থেকে দেখতে পায় তাই নিজের কাছে নিয়েছে। আর তু্ই গাধী বারবার বাড়ি বাড়ি করে বেচারাকে কষ্ট দিয়েছিস। তোর মতো গবেট দুটো আছে? আমার ভাইয়ের যে কপাল পুড়েছে সেটা আমি শিওর। বেচারা ভাই আমার”
ঈশিতা আপু শেষের কথা গুলো আফসোসের সুরে বলে উঠলো।
“তো আমি কি করবো? আমার বাড়ির জন্য খারাপ লাগবে বলবো না?”
“বাড়ির জন্য খারাপ লাগলে বাড়ি কোলে নিয়ে বসে থাক। আদ্র ভাইকে কল দিয়ে জ্বালাচ্ছিস কেন?”
“আমার জামাই আমি জ্বালাবো। একশো বার জ্বালাবো। উঠতে বসতে জ্বালাবো। জ্বালাতে জ্বালাতে কয়লা বানিয়ে ফেলবো। তাও আমায় সহ্য করতে হবে। গাল ফুলানো যাবে না”
“বাহ্! বাহ্, জামাই জামাই করছিস যে? তিনদিনে প্রেমে পড়ে গেলি নাকি? যদিও আদ্র ভাই এমন একটা ছেলে যে কোনো মেয়ে তার প্রেমে পড়তে বাধ্য”
লজ্জা পেয়ে গেলাম। লাজুক ভঙ্গিতে বললাম,
“তুমি কি যে বলো না? প্রেমে ট্রেমে পড়িনি। এমনি মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে”
“বুঝি! বুঝি! খাই না সুঝি”
“কঁচু বোঝো”
ঈশিতা আপু মুখ ভেংচি কাটলো। আমি পড়েছি জ্বালায়।
“কিছু তো বলো?”
“কি বলবো?”
“বুদ্ধি দেও কিভাবে আদ্র ভাইয়ের রাগ ভাঙ্গাবো”
“কাছে আয়”
ঈশিতা আপু কাছে যেতে আপু ফিসফিস করে কিছু বলল। যতো সব লজ্জা মার্কা কথা বার্তা। আপুর কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে কপোল।
উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন সিজন ২ পর্ব ১৩
“সরো আমি এসব পারবো না”
“না পারলে নাই। থাকুক আদ্র ভাই রাগ করে। তু্ই তোর মতো থাক”
“এই আপু এমন করো না প্লিজ”
“তাহলে যেটা বলেছি সেটাই কর”
আপুর কথা শুনে শুকনো ঢোক গিললাম। এরা যে আমার ফাঁসাচ্ছে সেটা আমি দিব্বি বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছু করার নেই। আদ্র ভাইয়ের রাগ ভাঙাতে চাইলে আমায় এটা করতেই হবে। আপুর কথা ভাবলেও গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। আমার যে কি হবে আল্লাহ মালুম।