উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন সিজন ২ পর্ব ১৫

উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন সিজন ২ পর্ব ১৫
আফিয়া আফরোজ আহি

স্তম্ভিত, হতবাক, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে আছি। দৃষ্টি যেন সরছেই না টিভির স্ক্রিন থেকে। শুধু আমি না সবার অবস্থাই এক। কেউই কিছু বুঝতে পারছি না। সব যেন আমাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। একে ওপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছি শুধু। টিভিতে ব্রেকিং নিউজ চলছে। সাংবাদিক মাইক নিয়ে উৎকণ্ঠা হয়ে লাইভ নিউজ করছে। নিউজ টা এমন,

“বিগত কয়েক দিন পূর্বে অস্ত্র পাচার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ইলিয়াস সাহেবকে গ্রেফতার করার পর গ্রেফতার করা হয়েছে তার একমাত্র কন্যা ইরা কে। গতকাল রাতে অস্ত্র পাচার করার সময় তিনি এবং তার সকল সহকারীদের অন স্পট গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জানা গেছে ইনভেস্টিগেশন অফিসার ইফরান খান ইভানের দেওয়া সকল তথ্য ও প্রমানের ভিত্তিতে মিস ইরাকে ও তার সহকারীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। জানা গেছে মিস ইরা মিস্টার ইভানকে ব্ল্যাকমেল করে তার পরিবারের ক্ষতি করতে চেয়েছিলেন। তেমন ঘটনা ঘটার পূর্বেই মিস ইরাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন ওনাকে জেল খানায় রাখা হবে। আগামীকাল তাকে কোর্টে তোলা হবে।সরাসরি সকল নিউজ জানতে চোখ রাখুন আমাদের চ্যানেলে”
নিউজ শুনে আমাদের সকলের মাথায় যেন বাজ পড়েছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দিনটা শুক্রবার হওয়ায় সবাই বাসায়। সকালের খাওয়া শেষে আব্বু আর বড় আব্বু বসেছে নিউজ দেখতে তার সাথে টুকটাক বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। আমি, ঈশিতা আপু, ইভা, রোশনি খাচ্ছি আর গল্প করছি। হঠাৎ রোশনি আফসোসের সুরে বলে উঠলো,
“আমার ক্রাশ ইভান ভাই যে কোথায় উধাও হয়ে গেল কে জানে? গেল তো গেল ইরা, চিড়া শা*ক*চু*ন্নিটাকেই নিয়ে গেল। আমায় নিয়ে গেলে কি এমন হতো? আমায় একটু বলেও গেল না, হুহ”
ইভা বলল,

“এর আগে মনে হয় তোকে বলে যেত? আগে সিঙ্গেল ছিলো তাতেই বলেনি এখন বলবে ভাবিস কিভাবে? আর ভাইয়া এগুলো শুনলে কানের নিচে দুটো দিবে দেখবি দুদিন পর্যন্ত কানে কিছুই শুনতে পারবি না”
“এই তুমি এভাবে আমায় ভয় দেখাচ্ছ? আমি মোটেও ভয় পাচ্ছি না। পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া?”
অতঃপর আস্তে আস্তে বলল,
“যদি মানুষটা ইভান ভাই হয় তাহলে অন্য কথা। ঠাস করে চড় বসিয়ে দিতেও দুবার ভাববে না। আমার সাধের গাল”

রোশনি কাঁদো কাঁদো মুখ করে শেষের কথা গুলো বলে উঠলো। রোশনির কথায় আমরা তিনজনই হেসে দিলাম। মেয়েটা পারেও পা*গলামো করতে। ইভান ভাই সেই যে বেরিয়েছে আর বাড়ি ফিরেনি। অন্য সময় তো দুই থেকে তিন দিনের মাঝে একবার হলেও বাড়ি আসেন। কিন্তু এবার সপ্তাহ খানেক হয়ে গেল ইভান ভাই এলো না। মানুষটা ঠিকঠাক আছে তো? সুস্থ আছে তো?
আমরা কথা বলছি এমন সময় আব্বু ডেকে উঠলো,
“তোমরা সবাই কোথায়? এদিকে আসো। বড় ভাবি, রুদ্রর আম্মু, তাড়াতড়ি সবাই এদিকে আসো”
টেবিল থেকে উঠে হুড়মুড়িয়ে ছুটলাম ড্রয়িং রুমের দিকে। টিভিতে লাইভ নিউজ চলছে। নিউজ দেখে সবার চোখ কপালে। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে ইরাকে পুলিশ হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ইন্সপেক্টর এর দিকে ক্যামেরা ধরলে তিনি বললেন,

“অস্ত্র পাচারকারি গ্যাং কে ধরার জন্য আমরা অনেক দিন অপেক্ষায় ছিলাম। আমাদের এই মিশনকে সফল করতে, অপরাধীদের ধরতে সাহায্য করেছে মিস্টার ইভান। তিনি গত কয়েকমাস আগে ইনভেস্টিগেশন অফিসার হিসেবে জয়েন করেছে। তিনি নিজ উদ্যোগে এই কেস টা নিজের আন্ডারে নিয়েছেন। তার এই দুর্দান্ত বুদ্ধিমত্তা, অক্লান্ত পরিশ্রম ও কাজের জন্য আমরা পুরো চক্রটা ধরতে পেরেছি। আপনাদের কিছু জানার থাকলে মিস্টার ইভানের কাছ থেকে জেনে নিন”
অফিসার তার পাশে থাকা মেয়ে পুলিশকে বললেন ইরাকে ভিতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যাওয়ার আগে ইরা চেঁচিয়ে ইভান ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে গেল,

“তোমায় আমি ছাড়বো না মিস্টার ইভান। তোমায় আমি ছাড়বো না। তোমার প্রাণ ভোমরা আমি কেড়ে নিবো দেখে নিও”
ইভান ভাই ইরার কথা শুনে হাসলেন। তবে সেটা মুচকি হাসি নয় কেমন রহস্যময় হাসি। এই হাসির মানে নিশ্চই অন্য কিছু। কিন্তু কি? ইভান ভাইকে কেসের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলা শুরু করলেন। আমি অবাক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছি। ইভান ভাই ইনভেস্টিগেশন অফিসার হলেন কিভাবে? ৪-৫ মাস আগে জয়েন করে তিনি এতো কিছু করে ফেলেছেন? আর উনি এই প্রফেশনেই বা কেন যোগ দিলো? কারণ কি? মাথায় প্ৰশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র ইভান ভাই দিতে পারবেন।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে এখনো ইভান ভাইয়ের আসার নাম নেই। ওনার অপেক্ষায় বসে আছি আমরা সবাই। কখন উনি আসবে আর আমরা আমাদের সকল প্রশ্নে উত্তর পাবো। হাঁটাহাঁটি করছি ড্রয়িং রুম জুড়ে। এর মাঝে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো ইভান ভাই। কতদিন পর তাকে দেখলাম। মনে হচ্ছে এই কয়েক দিনে অনেকটা শুকিয়ে গেছে। ক্লান্তিতে চুপসে যাওয়া মুখ খানা। পরনের কালো শার্ট শরীরের সাথে মিশে আছে। ঘামে ভিজে আছে কপাল। শার্টের হাতা কনুই অবধি গোটোনো। ওনার এই লুক কোনো সিনেমার নায়কের চেয়ে কম না। ইভান ভাইকে পুরো সাউথ ফিল্মের নায়কদের মতো মনে হচ্ছে। ইভা চেঁচিয়ে ডাকলো,
“আম্মু, আব্বু তোমরা কোথায়? দেখ ভাইয়া এসেছে”
রুম থেকে ছুটে এলো বড় আম্মু। পিছন পিছন বড় আব্বু ও এলো। সোজা এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো,

“কেমন আছিস বাবা? এতদিনে মায়ের কথা মনে পড়লো? এতদিন বাড়ি আসিস নি কেন? মাকে ভুলে গেছিস বাবা?”
বড় আম্মুর আরো কতো শত আহাজারী। বড় আব্বু গম্ভীর স্বরে সুধালো,
“এসব কি ইভান?”
“কোন সবের কথা বলছেন?”
“নিউজে যেটা দেখাচ্ছে”
“ও আচ্ছা বলছি পরে”
থেমে বড় আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল,
“অনেক ক্লান্ত লাগছে আম্মু। ভীষণ খিদে পেয়েছে। কতদিন তোমার হাতে খাই না”
বড় আম্মু তড়িঘড়ি করে বললেন,
“তু্ই ফ্রেশ হয়ে আয় আমি তোর খাবার রেডি করছি। আজকে আম্মু তোকে খাইয়ে দিবে। যা বাবা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়”

ইভান ভাই ধুপ ধাপ পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। আচমকা খেয়াল করলাম ইভান ভাইয়ের হাতে ব্যান্ডেজ করা। কি হয়েছে তার? উৎকণ্ঠা হয়ে ছুটলাম তার পিছু। ইভান ভাই দরজা আটকাবে এমন সময় হাত দিয়ে আটকে দিলাম। ইভান ভাই ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
“কি সমস্যা?”
“আপনার হাতে কি হয়েছে? ব্যান্ডেজ করা কেন?”
“তোর আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। তু্ই যা। আমি এখন শাওয়ার নিবো”

কথা গুলো বলে মুখের ওপর দরজা আটকে দিলেন। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছি দরজার দিকে। ইচ্ছে করছে এক লাথি দেই দরজায় ম কিন্তু সেটা তো করা যাবে না। রাগে ফোঁস ফোঁস করছি। ইভান ভাই পারলো আমার মুখের ওপর দরজা আটকে দিতে? ওনার সাহস তো কম না! লেট সাহেব একটা। হাতে ব্যান্ডেজ থাকলে থাকুক এতে আমার কি? উনি যা ইচ্ছে করুক গে। তাতে আমার কি? আমি আমার মতো থাকি। নিচে নেমে গেলাম। নামতেই সামনা সামনি হলাম আদ্র ভাইয়ের। ওনাকে এই সময় এখানে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো। উনি কখন এলো?

“কোথায় গিয়েছিলি?”
“ওপরে”
“ইভান কোথায়?”
“শাওয়া নিতে গিয়েছে”
“ও আচ্ছা”
আদ্র ভাই কথা বাড়ালেন না। তাই আমিও আর দাঁড়ালাম না। উনাকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে হাত ধরে আটকে দিলেন। কপাল কুঁচকে ইশারা করলাম,
“কি?”
“ইগনোর করছিস?”
“আমি নাকি তুমি?”
“তু্ই”
“উহু, আমি না তুমি”

“আমি তো অভিমান করেছি। আর তু্ই তো তু্ই’ই। অভিমান ভাঙানোর বদলে উল্টো ইগনোর করছিস। নিষ্ঠুর রমণী”
“তুমি আমায় নিষ্ঠুর বললে?”
“বললাম তো?”
“তোমার সাথে কথাই বলবো না”
“কথা না বলে যাবি কোথায়?”
“যেখানে দু চোখ যায় সেখানে”
আদ্র ভাই চোখে চোখ রেখে বলল,
“তোকে যেতে দিলে তো? শক্ত করে বেঁধে রাখবো নিজের সাথে। তু্ই কোথাও যাওয়া তো দূর আমার দৃষ্টির আড়ালও হতে পারবি না”

আদ্র ভাইয়ের কথা শুনে চুপ হয়ে গেলাম। এই মানুষটা মাঝে মাঝে এমন এমন কথা বলে যার মানে বোঝা যায় না। সব কেমন গুলিয়ে যায়। ওনার কথার পৃষ্ঠে কিছু বলার মতো ভাষাই খুঁজে পাই না। এ কেমন জ্বালা? দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। কারো মুখে কোনো কথা নেই। পাশ থেকে কেউ কাশি দিয়ে উঠলো। তাকিয়ে দেখি আরু দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরুকে দেখে আদ্র ভাই সুধালো,

“তু্ই এখানে কি করছিস?”
“আমি তো এমনি হাটছিলাম। তোমাদের দেখে দাঁড়ালাম। তোমরা কি করছিলে?”
“ঝগড়া করছিলাম। দেখবি? তাহলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাক”
“দাড়াও পপকর্ন আর কোক নিয়ে আসি। আমি একা দেখবো কেন? ঈশিতা আপু, রোশনি আপু, ইভা আপু ওদেরও ডেকে নিয়ে আসি। একা দেখলে মজা পাবো না”
“তবে রে আরুর বাচ্চা”
আরু দৌড় দিলো। ওকে আর পায় কে? এক দৌড়ে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে কিচেনে চলে গেল। আরুর দৌড়ে দেখে দুজনই হেসে দিলাম। বাচ্চা একটা মেয়ে।

ড্রয়িং রুম জুড়ে নীরবতা। সবাই চুপ করে বসে আছে। সবার মাঝেই উত্তেজনা কাজ করছে আসল ঘটনা জানার জন্য। কি হয়েছে যে ইরাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে? ইভান ভাই কেন এই পেশা বেছে নিলেন। কবেই না জয়েন করলেন। আমাদের একটা বার জানালেন ও না! পেশার তো অভাব ছিলো না তবে কেন এই পেশাই? আর ইরা যদি অস্ত্র পাচারকারী ব্যক্তির মেয়ে হয়ে থাকে সাথে নিজেও সেই ব্যাবসার সাথে যুক্ত তাহলে ইভান ভাই কেন তাকে বিয়ে করলো? সব জানার পরও কেন তাকে নিজের জীবনের সাথে জড়ালো? এতো ভয়ানক একটা মেয়েকে কেন আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলো?মেয়েটা যেই পরিমান ভয়ানক সে যদি আমাদের কারো ক্ষতি করতো তখন কি হতো? এতো সব প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে সবাই বসে আছে। কখন ইভান ভাই আসবে আর তাড়া তাকে খপ করে ধরে প্রশ্ন গুলো জিজ্ঞেস করবে।

উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন সিজন ২ পর্ব ১৪

ইভান ভাইকে বড় আম্মু খাইয়ে দিচ্ছে। ইভান ভাই আমাদের বাড়ির সবার অনেক আদরের ছেলে। বিশেষ করে বড় আম্মু আর দাদুমনির চোখের মনি। তার একটু আঁচড় লাগলে তারা উন্মাদ হয়ে ওঠে। সেই ইভান ভাইয়ের এই অবস্থা বড় আম্মু মেনে নিতে পারছে না। তাই ছেলেকে বসিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। খাওয়া শেষে ইভান ভাই ড্রয়িং রুমে এলো। সবাই উৎসুক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান ভাই ধীরে সুস্থে বলল,
“তোমাদের কার কি জিজ্ঞেস করার আছে করতে থাকো। আমি একে একে সবার প্রশ্নের জবাব দিবো”

উষ্ণ প্রেমের আলিঙ্গন সিজন ২ পর্ব ১৬