এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৩

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৩
Yasira Abisha

প্রায় ২ বছর পর কোনো নারীকে এভাবে স্পর্শ করলো ইরাদ তাও এমন কাউকে যার চেহারা তার প্রাক্তনের অবিকল। অচেতন অবস্থায় রুহি ইরাদের কোলে, সে মুহুর্ত গুলো ইরাদের জন্য প্রচন্ড কষ্টের হলেও কর্মস্থলে তার ভুল শুধরাতে হবে।
যখন ড্রাইভার বললো, আসলে রুহির দোষ নেই তখন ইরাদ এক মুহুর্ত ও দেরি করেনি ছুটে যায় রুহির পেছনে আর ভাবে, “আমি ভুল বুঝেছি ওকে!”
কেবিন থেকে বেড়িয়ে করিডোরের শেষ প্রান্তে তাকিয়ে দেখে রুহি,
তারপর আর দেরি করল না, দৌড়ে বেরিয়ে গেল ইরাদ রুহিকে থামানোর জন্য। কিন্তু বেরিয়েই যে দৃশ্য দেখল, তাতে তার পা যেন জমে গেল!

ধীরে ধীরে রুহি করিডোরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছে।
সেই মুহূর্তে তার চারপাশের পৃথিবী থমকে গেল।
ইরাদ ছুটে গিয়ে রুহিকে নিজের বাহুডোরে জড়িয়ে নিল। রুহির নিস্তেজ মুখটা তার বুকে হেলান দিয়ে আছে, নিঃশ্বাস ধীর হয়ে আসছে। অরসদের হাত গুলো থরথর করে কাপছিলো বুকের গভীরে কোথাও কষ্টের এক তীব্র স্রোত বয়ে গেল। একই চেহারার মানুষ হলেও তো তারা দুজনই ভিন্ন তবে আমার এমন লাগছে কেনো?
“আমি কী করলাম! প্রতিশোধের আগুনেই কি একটা অচেনা অসুস্থ মেয়েকে এতটা কষ্ট দিলাম?”
দ্বিধা না করে সে দ্রুত রুহিকে কেবিনে নিয়ে গেল।
রুহির অজ্ঞান দেহ দেখে আনাই ছুটে এসে কাঁদতে লাগল, “আম্মু! আম্মু, উঠে দেখো না!”
ইরাদের বুকের মাঝে শূন্যতা জন্ম নিল। এই ছোট্ট মেয়েটি রুহিকে মা বলে ডাকছে। মেয়েটা ওর মা না, বরং কেউই না। কিভাবে এই কঠিন সত্যি গুলো আনাইকে বুঝাবে ও?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিছুক্ষণের মধ্যে সে আনাইকে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। কিন্তু তার মনের মধ্যে একরাশ অস্থিরতা জমা হয়ে থাকল। এখানে একা একটা কেবিনে রুহির সাথে অনেক পুরোনো স্মৃতি মনে হচ্ছে ইরাদের যা ঘিরে ছিলো শুধুই অহনা।
তবুও ভুল যেহেতু ইরাদের তাই রুহির পাশে বসে থাকল ইরাদ।
চোখের সামনে ভেসে উঠল পুরনো দিনগুলোর স্মৃতি।
কলেজের প্রথম দিনটা ইরাদের স্পষ্ট মনে আছে। শরতের নরম রোদ মিশে ছিল বাতাসে, ক্যাম্পাস ছিল নতুন মুখের গুঞ্জনে মুখর। কিন্তু সেদিন ইরাদের চোখ কেবল একজনের দিকেই আটকে গিয়েছিল—অহনা।
সে প্রথম দেখায় প্রেম বলে কিছুতে বিশ্বাস করত না, কিন্তু অহনাকে দেখেই যেন মনে হলো, “এ মেয়ে আমার জীবনে বিশেষ কিছু হতে চলেছে।”

অহনা ছিল প্রাণবন্ত, স্বপ্নবাজ, আর অসম্ভব সুন্দর। তার চোখের চাহনিতে ছিল একটা আলাদা আত্মবিশ্বাস, যা ইরাদকে এক মুহূর্তেই মুগ্ধ করেছিল।
প্রথম কয়েকদিন শুধু দূর থেকেই দেখত ইরাদ। এরপর ধীরে ধীরে পরিচয়, বন্ধুত্ব, আর সেই বন্ধুত্ব কখন যে প্রেমে রূপ নিল, কেউ বুঝতেই পারেনি।
কলেজের ক্যান্টিনের কোণে বসে লুকিয়ে চা খাওয়া, ক্লাসের নোট ভাগাভাগি করা, বৃষ্টির দিনে ছাতা ভাগ করে নেওয়া—সবকিছুতেই একটুকরো সুখ লুকিয়ে ছিল। অহনার হাসির শব্দ যেন ইরাদের জন্য একধরনের নেশা হয়ে উঠেছিল।
“আমরা তো চিরকাল একসাথে থাকব, তাই তো?” অহনা একদিন প্রশ্ন করেছিল।
ইরাদ এক মুহূর্তও না ভেবে বলেছিল, “অবশ্যই! আমি তোমাকে কখনো ছাড়ব না।”
কিন্তু বাস্তবতা সব প্রেমের গল্পের মতো সুন্দর হয় না। অহনার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। সে চেয়েছিল তার ক্যারিয়ার আগে গড়ে তুলতে, নিজের পরিচয় তৈরি করতে।
ইরাদ চেয়েছিল অহনাকে নিয়ে ঘর বাঁধতে। কিন্তু অহনা চেয়েছিল আরও অপেক্ষা করতে।
প্রেমের মাঝখানে সময়ের দেয়াল তৈরি হলো।
একদিন অহনা বলেছিল, “ইরাদ, আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু এখনই তোমার হাতটা ধরে রাখতে পারব না। আমার স্বপ্নগুলো এখনো পূর্ণ হয়নি।”

রুহির চোখ ধীরে ধীরে খুলল। মাথাটা ভারী লাগছিল, চোখে কেমন যেন ঝাপসা অনুভূতি। চারপাশটা নিস্তব্ধ, শুধু কেবিনের ছোট্ট বাতির আবছা আলো পড়ে আছে দেওয়ালে। চোখের পলক ফেলতেই সে দেখতে পেল ইরাদ ওর পাশেই বসে আছে, গভীর চিন্তায় ডুবে।
রুহি অবাক হয়ে চারপাশে তাকিয়ে বলল, “স্যার? আমি… এখানে কেন? আর আপনি?”
ইরাদ একটু হালকা শ্বাস ফেলে বলল, “আপনি অতিরিক্ত স্ট্রেসের কারণে জ্ঞান হারিয়েছিলেন।” কণ্ঠে অপরাধবোধ স্পষ্ট। একটু থেমে সে চোখ নামিয়ে বলল, “আর আমি… আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনাকে না বুঝে এত কিছু বলে ফেলেছি।”
রুহি কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকল ইরাদের দিকে।

“আমার মেয়ে আপনাকে ওর মা ভেবেছিল,” ইরাদের কণ্ঠটা ভেঙে আসল, “আসলে ওর মা নেই। কিন্তু আমি বুঝতে না পেরে আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। এটা আমার ভুল, রুহি। পুরো ব্যাপারটাই একটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল।”
কথাগুলো শুনে রুহির বুকের ভেতরটা কেমন যেন নরম হয়ে এলো। সে জানে, ভুল বোঝাবুঝি অনেক সময় সম্পর্ক গড়তেও পারে, আবার ভেঙেও দিতে পারে।
সে মৃদু হাসল, ক্লান্ত চোখে বলল, “স্যার, এটা ঠিক আছে। আমি বুঝতে পারছি।”
ইরাদ একটু হেসে মাথা নাড়ল, কিন্তু চোখে তখনো অপরাধবোধের ছায়া।
“আমি চাই না আমার ব্যক্তিগত জীবনের জন্য আপনার মনে কোনো ভুল ধারণা তৈরি হোক। প্লিজ, কাল থেকে অফিসে আসবেন।”

রুহি কিছুক্ষণ ইরাদের দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর আস্তে করে মাথা নাড়ল সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে।
কেবিনের ভেতর তখনো সেই নরম আলো ছড়িয়ে আছে, বাতাসে যেন কিছু অব্যক্ত অনুভূতি মিশে আছে। দুজনেই জানে, এই কথোপকথনের পর তাদের গল্পটা এখানেই শেষ নয়… বরং শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়।
সূর্যের আলো জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকছিল। নিস্তব্ধ দুপুরের গুমোট ভাবটাকে খানিকটা দূরে ঠেলে, হালকা বাতাস পর্দা উড়িয়ে দিচ্ছিল বারবার।

রুহি আয়নার সামনে বসে। চোখ দুটো তার উদাস, হাতের ব্রাশটা চুলে চালাচ্ছিল অন্যমনে। তার প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজ ছুটির দিন, মা বাবা ভাই গ্রামে গেছে বেড়াতে, রুহিকে বলেছিলো তবে এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না বিধায় আর যাওয়া হয় নি।
প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে কাজে যাচ্ছে রুহি। তারপর থেকে আনাইকে আর দেখেনি সে। বাচ্চাটার কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে, তবে ইরাদের সাথে কথাই বলা যায় না।
ইরাদ খুবই স্ট্রিক্ট, প্রতিদিন ঠিক সময়ে কাজে আসে ঠিক সময়ে বেড়িয়ে যায়। রুহিকে সে যেনো দেখেও না। যদিও কাজ ছাড়া তেমন একটা কথা বলে না কারো সাথেই কিন্তু রুহিকে যেনো ইচ্ছে করেই কিছুটা অপছন্দ করে সে, রুহির তাই মনে হয়।

আনাইয়ের জন্য ইরাদের আত্মসমর্পণ
আজকের শীতল বাতাসটা ইরাদের গায়ে লেগে আসছে ঠিকি, কিন্তু তার মন যেন অস্থির আগুনে জ্বলছে। দুই সপ্তাহ ধরে আনাইকে আটকে রাখা হয়েছে, কিন্তু কোনো উন্নতি নেই। ছোট্ট মেয়েটার দেহে কেমন যেন প্রাণহীন ছাপ পড়ে গেছে, খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক করছে না, কারও কথায় সাড়া দিচ্ছে না।
ইরাদ জানে, ওর মেয়ে কার জন্য এমন হয়ে গেছে। রুহি।
আনাইয়ের মুখে একটাই নাম, একটাই দাবি— “আমি আম্মুর কাছে যাবো আমাকে নিয়ে চলো, বাবা।”
প্রথম দিকে ইরাদ চেয়েছিল এটা সামলে নিতে। ও কখনো নিজের ব্যক্তিগত সমস্যায় কাউকে জড়ায় না। আর রুহি? সে তো কাছের কেউ না, ওকে এসব ঝামেলায় টানাটা অন্যায়। কিন্তু এখন? আনাইয়ের দিন দিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে, মেয়েটা যেন নিঃশ্বাসের মতো রুহিকে চাইছে।
আনাইয়ের কথা শুনেই তো অহনা ফিরে এসেছিলো দেশে তবে ভাগ্যের পরিহাসে সেও চলে যায় বহু দূরে যেখান থেকে আর ফেরনো যায় না…..…

মেয়ের রাত থেকে খুব জ্বর এমন অবস্থায় আজ ইরাদ রুহির বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
ডাক্তার ইরাদ আহসান যে কঠোর নিয়ম মেনে চলে, যার জীবনে অনুভূতির জায়গা খুব কম, আজ সে নিজের সব আত্মসম্মান ভুলে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, শুধু মেয়ের জন্য।
সে জানে না রুহি দরজা খুললে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে। হয়তো বিরক্ত হবে, নাও করা দিতে পারে সাহায্য করতে। কিন্তু ওর মেয়ে? সে তো ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে।
“মেয়ের জন্য, শুধু একবার…”—এই কথাটা মনে করেই ইরাদ দরজায় কড়া নাড়ে।
বাইরে গাড়ির শব্দ। একটা সাদা গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে। রুহি জানালার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল না, কে এসেছেন?

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ২

ভেতর থেকে ধীর পায়ে এসে দরজা খুলল রুহি। তার চোখে বিস্ময়, মুখে কিছুটা অবিশ্বাস।
আসলে কি ডাক্তার ইরাদ এসেছেন?
ইরাদ এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল, তারপর ধীর কণ্ঠে বলল—
“আমাকে সাহায্য করুন, রুহি। আমার মেয়ে আপনাকে ছাড়া বাঁচতে পারছে না।”

এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৪