এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৮
Yasira Abisha
আনাই আর রুহির দুষ্টুমি যেন শেষই হচ্ছে না।
সকাল থেকে কখনো বালিশ দিয়ে একে অপরকে আঘাত করছে, কখনো ছোট ছোট চকোলেটের টুকরো ছুড়ে মারছে। আনাই খিলখিল করে হাসছে, আর রুহি তো ওর সাথে তাল মিলিয়েই একদম শিশুর মতো হয়ে গেছে।
“এই ধরো! এইবার তো তুমি হেরে গেলে!” আনাই উচ্ছ্বাসে বলে উঠল, এক হাতে ছোট্ট একটা বালিশ তুলে ধরে।
রুহি চোখ কুঁচকে বলল, “আমি হারিনি! শুধু তোমাকে জিততে দিয়েছি!”
আনাই একগাল হেসে বলল, “উফফ! বাহানা দিচ্ছো!”
ওদের এই প্রাণোচ্ছল দুষ্টুমির মাঝেই হঠাৎ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পরিচিত কণ্ঠ শোনা গেল—
“তোমরা আজ বেশ ভালোই মজা করছো, তাই না?”
রুহি আর আনাই চমকে তাকিয়ে দেখে, গৃহপরিচারিকা রাজিয়া খালা ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছেন।
রাজিয়া খালা ইরাদদের বাড়ির অনেক পুরনো কাজের মানুষ, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি।রুহিকে সেদিন অহনা ভাবলেও আজ সে বুঝে গেছে মেয়েটি রুহি।
খালা দেখলে ছোটখাটো গড়ন, গায়ে হালকা নীল রঙের শাড়ি, আর মুখে চিরচেনা এক মমতামাখা হাসি।
“মা, কিছু খাবেন? আজ আপনাদের জন্য খাসির রেজালা আর পরোটা করেছি।”
রুহি মাথা নাড়িয়ে বলল, “এখন না, একটু পরে খাব। তবে খালা, আপনি আসেন, বসেন আমাদের সাথে।”
রাজিয়া খালা একটু হেসে রুহির পাশে বসলেন।
“আপনার সাথে গল্প করতে মন চাইলো, মা।”
রুহিও আগ্রহ নিয়ে খালার দিকে তাকাল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাজিয়া খালা একটু সময় নিয়ে বললেন, “আপনাকে দেখে ভালো লাগে। আপনাকে দেখে মনে হয়, যেন পুরনো দিনের কিছু হারিয়ে যাওয়া রোদের মতো।”
রুহি অবাক হয়ে বলল, “মানে?”
খালা মৃদু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“ইরাদ বাবা খুব হাসিখুশি ছিলেন, জানেন তো? সবসময় প্রাণবন্ত, সবসময় হাসিতে ভরা থাকতো উনি। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে সেই হাসিটা অনেকটাই হারিয়ে গেছে।”
রুহি চুপ করে রইল।
খালা একটু থেমে আবার বললেন, “আর বিশেষ করে শেষ দুই বছর… উনার হাসিটা একদমই ফিকে হয়ে গেছে।”
রুহি অবাক হয়ে খালার দিকে তাকাল।
তার ভেতর কেমন একটা অজানা অনুভূতি খেলে গেল।
সে কখনো ভাবেইনি, ইরাদ এমন ছিলো! সে তো সবসময় একটা গম্ভীর, ভারী ভাব নিয়ে থাকে, যেন জীবন তার জন্য নিছক একটা দায়িত্ব ছাড়া কিছুই নয়।
“কিন্তু কেন?” রুহি ধীরে ধীরে বলল।
রাজিয়া খালা একটু চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন, যেন ভাবছিলেন বলবেন কি বলবেন না।
তারপর আস্তে করে বললেন, “কারণ, উনার জীবন থেকে একটা বড় কিছু চলে গেছে, মা।”
রুহি কিছু বুঝতে পারলো না।
সে অনেক সাহস নিয়ে বলল, “ইরাদ স্যার কি… তার স্ত্রীর সাথে কি হয়েছিলো?”
রাজিয়া খালা একটু চুপ করে বললেন, “উনার বিয়ে হয় নি আগে তবে ঠিক হয়েছিলো।”
রুহির নিঃশ্বাস এক মুহূর্তের জন্য আটকে গেল।
“বিয়ে হয় নি? ক…কার সাথে ঠিক হয়েছিলো? ”
খালা শান্ত গলায় বললেন, “অহনা ম্যামের সাথে। ইরাদ বাবা এতো একা দেখেই সারাদিন কাজে ডুব দিয়ে থাকে আগে এমন ছিলোনা উনি”
রুহি স্তব্ধ হয়ে গেল।
এমন কিছু শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।
রাজিয়া খালার কথায় রুহির মাথায় যেন একগুচ্ছ প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো।
“অহনা ম্যামের সাথে? কিন্তু তাহলে…”
তার বাক্যটা শেষ হওয়ার আগেই রাজিয়া খালা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন।
“আরে, আমি তো কাজ ভুলেই গেছি! রান্নাঘরে গিয়েই তো রেজালা ভুনা দেখতে হবে!”
বলেই খালা দ্রুত উঠে গেলেন, যেন কিছু বলতে গেলে সময় নষ্ট হয়ে যাবে।
রুহি থমকে বসে রইলো।
সে একদম প্রস্তুত ছিল না এই কথাগুলো শোনার জন্য।
“বিয়ে ঠিক হয়েছিলো… কিন্তু হয়নি? তাহলে আনাই… কার মেয়ে?”
তার বুকের ভেতর ধক করে উঠলো।
“তাহলে কি… ইরাদ স্যার কারও সাথে বিবাহিত ছিলেন না? নাকি…”
তার মাথায় সন্দেহের একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়ছিলো।
সে আনাইয়ের দিকে তাকালো। ছোট্ট মেয়েটা এখনো তার পুতুল নিয়ে খেলায় মগ্ন।
রুহির হঠাৎ মনে হলো, আনাইয়ের চোখগুলো ঠিক তার বাবার মতো। এতো মিল কি করে?
কিন্তু অহনার মতো দেখতে ছিল বলে যে কথাটা সবাই বলে, সেটাও কি সত্যি? কারণ রুহিকে দেখলে আর আনাইকে দেখলে অনেক মিল দেখা যায়। তার মানে আনাই অনেকটা অহনার মতোই ছিলো।
“তাহলে অহনার সাথে ইরাদের সম্পর্ক আসলে কী ছিল?”
তার নিজের প্রশ্নের উত্তর যেন কোথাও নেই।
কিন্তু এক জিনিস সে খুব ভালো করে বুঝতে পারছিল— এই রহস্যের মাঝেই হয়তো ইরাদ স্যারের গভীর বিষাদের আসল কারণ লুকিয়ে আছে।
আর রুহি সেটা জানতেই চায়।
রুহি গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগল।
“আমি যদি ইরাদ স্যারকে জিজ্ঞেস করি, উনি কি রেগে যাবেন?”
প্রথম দিনটার কথা মনে হতেই ওর গলা শুকিয়ে এলো।
সেদিন তো সামান্য দেরি করায় কেমন ধমকে দিয়েছিলো! আর মাঝে মাঝেই ওর দিকে এমন কঠোর দৃষ্টিতে তাকায়, যেন কোনো ভুল করলেই আবার সেই শীতল রাগটা ঝরে পড়বে।
রুহির বুকের ভেতর কেমন জানি একটা অস্বস্তি কাজ করল।
সে ওনাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারবে না।
অন্তত এখন না।
তাহলে কী করবে?
“রাজিয়া খালা তো অনেক কিছু জানেন… কিন্তু উনিও তো হুট করে চলে গেলেন। উনার কাছে আবার প্রশ্ন করা কি ঠিক হবে?”
রুহি খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেল।
এদিকে ইরাদ স্যারও তো খুব সহজে কিছু বলেন না। উনি বরং একটা দেওয়ালের মতো, যার ওপাশের কিছুই বোঝা যায় না।
কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত— অহনা, ইরাদ আর আনাইয়ের সম্পর্কের মাঝে এমন কিছু লুকিয়ে আছে, যা এতদিন ও জানতোই না।
আর এখন, ওর ভেতরে একটা তীব্র কৌতূহল জেগে উঠছে।
“আমি কি সত্যিটা জানার জন্য অপেক্ষা করব, নাকি অন্য কোনো উপায়ে খুঁজে বের করব?”
ওর মনে হচ্ছিল, সত্যিটা হয়তো একদিন এমনিই প্রকাশ পাবে।
কিন্তু সে কি সে পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারবে?
ইরাদ অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল— প্রায় চারটা বাজে।
প্রতি বারের মতো এবারও, আলহামদুলিল্লাহ, অপারেশন সফল হয়েছে।
কিন্তু আজ একটু অন্যরকম লাগছে। একটা অদ্ভুত প্রশান্তি ওর ভেতর ছড়িয়ে পড়ছে।
রোগীর সুস্থতার নিশ্চয়তা পেয়ে একটা স্বস্তি তো সবসময়ই আসে, কিন্তু আজ যেনো একটু বেশি ভালো লাগছে।
হয়তো ক্লান্তি নেই বলে, বা হয়তো—
সে ভেবে পায় না।
বাইরে বিকেলের নরম রোদ। বাতাসটাও যেন হালকা মিষ্টি হয়ে আছে।
ইরাদ ধীর পায়ে নিজের কেবিনের দিকে যেতে যেতে ভাবল— এতদিন পর কেন যেন মনে হচ্ছে, জীবনটা শুধু দায়িত্ব আর শূন্যতায় মোড়ানো নয়।
এখন যদি আনাইকে নিয়ে একটু বেরোনো যেত…
ওর মনে হঠাৎ করেই রুহির— না, আম্মুর মুখটা ভেসে উঠল।
একটা হাসি উঁকি দিলো ঠোঁটের কোণে, যেটা ও টের পেলেও পাত্তা দিলো না।
ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে থাকা নাম দেখে ইরাদের ঠোঁটের হাসিটা আরেকটু গভীর হলো—
“আব্বু!! যাবো???????”
ওপাশ থেকে আনাইয়ের চেনা উচ্ছ্বাসমাখা কণ্ঠ!
ইরাদ হেসে বলল, “আমি তো বের হচ্ছি মা। তুমি কী করছো?”
“আম্মুর সাথে খেলছিলাম!” আনাই খিলখিল করে বলল। “আব্বু তুমি আসবে কবে? একদম এই এক্ষুনি আসবে?”
ইরাদ হেসে ফেলল। “এই এক্ষুনি আসা তো কঠিন, মা। তুমি বলো, কী চাই তোমার?”
আনাই একটু ভাবল, তারপর বলল, “আব্বু,ঘুরি দিবো, আমরা কি আম্মুকে নিয়েও যাব? একটু শুধু?”
ইরাদের বুকের ভেতর কেমন এক অজানা অনুভূতি খেলে গেল।
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সে শান্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ মা, যাব তো।”
ওপাশ থেকে খুশিতে ছোট্ট একটা চিৎকার ভেসে এলো, “ইয়াহহ!! আম্মু!! আব্বু রাজি!!”
রুহি একটু লজ্জা পেয়ে হাসলো, যখন আনাই এভাবে ওদের মা বাবা বলে ওর কাছে ভালো লাগে।
কিন্তু রুহি ভাবছে ইরাদের কাছে কেমন লাগে?
এক চিলতে রদ্দুর পর্ব ৭
ইরাদ ফোনটা নামিয়ে ফেলল। ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির একটা হাসি রয়ে গেল।
কবে থেকে যেন এই “আম্মু” শব্দটা ওর মনে প্রশান্তি নিয়ে আসছে, সেটা ও নিজেও জানে না.