এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ১৯
তানিশা সুলতানা
থেমে যাওয়া তন্নি দৃষ্টি ঘুরিয়ে অর্ণবের মুখপানে তাকায়। গম্ভীর মুখে বসে ঠোঁটের ভাজে সিগারেট দিয়ে আশেপাশে কিছু একটা খুঁজছে। তন্নি ঢেড় বুঝতে পারছে লাইটার খুঁজছে। অতঃপর নিজের পকেটে লাইটার খুঁজে পায়। মুহুর্তেই বড় মোটা আঙুলের ভাজে লাইটার ফেলে বৃদ্ধ আঙুল দ্বারা চেপে আগুন বের করে সিগারেট জ্বালায়। ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে লাইটার জায়গা মতো রেখে তন্নির পানে তাকায়।
ধবধবে ফর্সা গালে, চোখের ঠিক একটু নিচে র ক্তের ছোঁয়া। বিলাতী নয়ন জোড়া জ্বলজ্বল করছে সূর্যের সংস্পর্শে। গোলাপি অধরের র ক্ত শুকিয়ে গিয়েছে।
তন্নি মাথা নিচু করে ফেলে। বুক কাঁপছে তার। চিন্তা এবং অস্বস্তিতে হাঁটু কাঁপছে। মাথা ভনভন করছে। কাঁধের ব্যাগখানা খুলে বুকে চেপে রেখেছে। ইচ্ছে করছে লোকটাকে টেনে ডাক্তার খানায় নিয়ে যেতে। হাতের ক্ষত নিয়ে বেশি চিন্তিত সে। এখন রক্ত চুয়িয়ে সাদা শার্ট ভিজে যাচ্ছে। গভীর ক্ষত না হলে এমনটা হতো? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তন্নি। লোকটা শুনবে না তো তার কথা। উল্টে অশ্লীল কিছু শুনিয়ে বসবে।
অর্ণবের থেকে কোনো প্রকার সাড়া না পেয়ে তন্নি নিজেই মুখ খুলে
“বাসায় যাবো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ভ্রু কুচকায় অর্ণব। ঠোঁটের ভাজ হতে সিগারেট সরিয়ে ভরাট গলায় বলে
“ তোর নাক উঁচু বাপকে বলবি তোকে ফোন কিনে দিতে।
রাগ হয় তন্নির। মনে মনে বকে দেয় পাষাণ মানবকে।
“ফোন বাবা কেনো কিনে দিবে? বাবা কি ভেঙেছে? যে ভেঙেছে তার কিনে দেওয়া উচিত নয় কি?
“কানে ঢুকেছে?
আকষ্মিক অর্ণবের ধমকে কেঁপে ওঠে তন্নির সত্তা। কাচুমাচু হয়ে জবাব দেয়
“ পরিক্ষার পরে দেবে।
গাড়ির অপর পাশের দরজা খুলতে খুলতে অর্ণবের বলে
“তখন আমাকে সামলাতেই হিমশিম খাবি। ফোনের প্রয়োজন পড়বে না।
তন্নি চুপ করে যায়। পাল্টা জবাব দেওয়ার মতো কথা খুঁজে পায় না।
“গাড়িতে বসো।
তন্নি আবারও চমকায়। গাড়ি করে বাড়িতে পৌঁছে দিবে না কি? বাই এনি চান্স বাবা দেখে ফেললে একদম মে রে ফেলবে।
চট করে তন্নি বলে ওঠে
“না না আমার এখনো ক্লাস শেষ হয় নি।
“কোলে করে আনবো তোকে?
সুরসুর করে গাড়িতে বসে পড়ে তন্নি। অর্ণব সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটা ফেলে গাড়ি চালানো শুরু করে।
তন্নি দাঁত দিয়ে নখ কাটছে আর এদিক সেদিন তাকাচ্ছে। কোর্টের পাশ দিয়েই যেতে হবে। কোনোভাবে বাবার সামনে পড়ে গেলে? মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে যেনো তারেক না দেখে। কিছু মুহুর্তের জন্য তন্নি ভুলেই গিয়েছে তার পাশে আঘাতপ্রাপ্ত অর্ণব বসে রয়েছে। তার হাত হতে রক্ত ঝড়ছে।
তন্নি উত্তেজনা দেখে বিরক্ত হয় অর্ণব।
“তোর বাপ থানায় গিয়েছে। দেখবে না তোকে। সোজা হয়ে বস।
শান্ত হয় তন্নি। ইতোমধ্যে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে থাকা বুকটা স্বস্তি পায়। চোখ বন্ধ করে করেকবার জোরে জোরে শ্বাস টানে। তারপর অর্ণবের আদলে নজর দেয়।
বরাবরই তন্নির ছোট্ট মনে ঘুরতে থাকে অর্ণবকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে “সে কি ভালোবাসে তন্নিকে?”
তন্নির মন বলে প্রশ্ন খানা করে ফেলতে। কিন্তু সাহস পায় না। যেচে ধমকে উঠবে পাষাণ লোকটা।
দূরে দেখা যাচ্ছে সদর হাসপাতালের বড় বিল্ডিং। টনক নড়ে তন্নির। লোকটাকে কি বলবে হাসপাতালের কথা?
বলতে তো হবেই। নাহলে দেখা গেলো ডাক্তার দেখালোই না।
“ও…..ওই তো হা….সপাতাল।
যাবেন?
অর্ণব স্পষ্ট জবাব দেয়
“না
আহত হয় তন্নি। ডাক্তার না দেখালে ক্ষত স্থান ভালো হবে কি করে? ইনফেকশন হবে তো। তখন? লোকটাকে কে বোঝাবে?
অভিমানে সিক্ত রমনী মুখ ভার করে ফেলে। নজর ফেরায় রাস্তায়। শো শো করে গাছপালা বাড়ি ঘর পেছনে ফেলে ছুটে চলেছে জিপখানা। দূরের আসমানে মেঘ জমেছে। কালো মেঘ ধেয়ে আসছে ওদের দিকে। সূর্য ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মেঘের আড়ালে। গুড়ুম গুড়ুম শব্দ করে জানান দিচ্ছে তার আগমন।
এই তো একটু আগেও প্রকৃতি স্বাভাবিক ছিলো। ঝলমল করছি রোদ। এতোদ্রুত কি করে পরিবর্তন হয় প্রকৃতির?
মুহুর্তেই ঝমঝম শব্দ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। বড়বড় ফোঁটার বৃষ্টি মুহুর্তেই ভিজিয়ে দেয় গাছপালা সহ জমিনে অবস্থিত সকল কিছু।
বরাবরই বৃষ্টি পছন্দ তন্নির৷ চিকচিক করে ওঠে তার নয়ন জোড়া। অধর প্রসারিত হয়। চঞ্চল হরিণীর ন্যায় বৃষ্টি উপভোগ করতে প্রস্তুত সে। হাত মেলে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি গায়ে মেখে অনুভব করতে চাচ্ছে। কিন্তু গাড়ির কাঁচ কি করে নামাতে হয় জানা নেই তার।
হঠাৎ করে গাড়ি থেমে যায়। তন্নি পাশ ফিরে তাকায়। অর্ণব তারই দিকে তাকিয়ে আছে অন্য রকম দৃষ্টিতে। অর্ণবের নয়নে নয়ন মেলানোর সাহস কখনোই ছিলো না তার। আজকেও পারলো না। অশ্রের ন্যায় ধারালো নয়নের গম্ভীর দৃষ্টি তন্নির বুকে কাঁপন ধরায়।
সেই কাঁপন আরও একটু বাড়িয়ে দিতে পাষাণ পুরুষ তার শক্তপোক্ত পুরুষালি হাত দ্বারা তন্নির কোমল নরম হাতে আকড়ে ধরে। আঙুলের ভাজে আঙুল ঢুকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে
“তুই ই তো আমার মেডিসিন। একটু ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দে। এমনিতেই সেরে যাবে।
লজ্জায় নুয়িয়ে পড়ে তন্নি। অস্বস্তিতে বুক কাঁপছে। ঠিক তখনই খুব জোরে বাঁচ পড়ে কোথায়। ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠে তন্নি। অর্ণব দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তন্নিকে। থরথর করে কাঁপছে মেয়েটা। বেশ ভয় পেয়ে বুঝতে পারে।
পিঠে হাত বুলিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলে
“হেই
আই এম হেয়ার টু প্রটেক্ট ইউ
ভয় পায় না জান।
ভয় কমে তন্নির। মুখ তুলে অর্ণবের বুক থেকে। সোজা হয়ে বসে মাথা নিচু করে ফেলে। রিনরিনিয়ে শুধু একটাই কথা বলে
“আমি বাড়ি যাবো প্লিজ।
অর্ণব আর কথা বাড়ায় না। গাড়ি স্ট্রাট দিয়ে ছুটে চলে গন্তব্যে। বৃষ্টি স্রোত কমে এসেছে। এখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।
গাড়ি থামে তন্নির বাড়ির সামনের রাস্তায়।
“রাত বারোটার পরে তোমার বাবার ফোনে কল দিবো। ফোন সাথে রেখো।
তন্নি ফোনের বিষয়ে হ্যাঁ না কিছু বলে না। যেনো সে এটা শুনতেই পায় নি। তার মনে অন্য চিন্তা ঘুরছে। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে নেয় তন্নি।
“চু…চুমু দিলে ডাক্তার দেখাবেন?
এতোটাই আস্তে বলেছে যে অর্ণব ঠিকঠাক শুনতে পায় নি। তাই কান এগিয়ে ফের প্রশ্ন করে
“শুনতে পাই নি। ডাক্তার কি?
তন্নি জবাব না দিলে ফট করে চুমু খায় অর্ণবের গালে। পরপরই গাড়ির দরজা খুলে এক দৌড়ে চলে যায় বাড়ির ভেতরে। অর্ণব হতদম্ভ হয়ে গিয়েছে। এমনটা একদমই আশা করে নি। তন্নির ঠোঁট ছোঁয়ানো স্থানে হাত বুলিয়ে বাঁকা হাসে
“এই চুমুতে কি আর মন ভরবে মায়াবতী?
আমার তো লম্বা চুমু চাই। রাত পেরিয়ে সকাল হবে তবুও আমার চুমুর দৈর্ঘ্য ফুরবে না।
রাতের খাওয়া শেষে তারেক দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বসেছে পড়াতে। কারেন্ট চলে গিয়েছে।।গরম পড়লেই কারেন্টের যন্ত্রণা বাড়তে থাকে। তারওপর বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া খারাপ। এখন বিদ্যুৎ থাকার কথাও না৷
বারান্দায় চার্জার লাইট জ্বালিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছে। ইতি বেগম হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে ওদের।
তন্নির মাথায় পড়া ঢুকছে না। তার চিন্তা অর্ণবকে নিয়ে। কল দিবে বলেছিলো বাবার ফোনে। তাছাড়া সে কি ডাক্তার দেখিয়েছে? ঔষধ খেয়েছে? অথৈকে কল করে জিজ্ঞেস করা দরকার।
“বাবা তোমার ফোনটা আজকে দিবে আমায়?
ঘড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছে টাইম দেখে উঠতাম।
ভয়ে ভয়ে বলেই ফেলে তন্নি। তারেক মাথা নারিয়ে সম্মতি জানায়।
ইতি বেগম বলে
“ বাবা আর ভাই আসবে কাল। ভাইকে বলেছি তন্নির ফোন হারিয়ে গিয়েছে। সে আবার কিনে দিতে চাচ্ছে।
তারেক চোখ পাকিয়ে তাকায় বউয়ের দিকে। ইতি শুকনো ঢোক গিলে আবারও বলে
“তুমি তো বাড়িতে থাকো না। আমারও ফোন নেই৷ কারো সাথে যোগাযোগ করার উপায় থাকে না। তাই বলেছিলাম।
তামিম বলে ওঠে
“তুমি তো আর কিনে দিবে না। কিপ্টা কি না।
মামু দিচ্ছে তাতেও নাক উঁচু করছো কেনো? বস বলেছে কিপ্টামি করা এবং নাক উঁচু করা পরক্রিয়ার লক্ষণ। তুমি কি দ্বিতীয় বিয়ের চিন্তা ভাবনা করছো না কি?
মুহুর্তেই পরিবেশ স্তব্ধ হয়ে ওঠে। তন্নির হেঁচকি উঠে যায়। তারেক দাঁতে দাঁত চেপে তামিমের পানে তাকায়। ইতি বেগম ঠোঁট চেপে হাসে। অর্ণব দারুণ কথা শিখিয়েছে ছেলেকে।
বাবাকে রাগতে দেখে তামিম আবারও বলে
“রেগে দাঁত কটমট করিও না বাবা। অর্ণব বস বলেছে তোমার দাঁত দুর্বল হয়ে পড়েছে কটমট করতে করতে। এবার দাঁত ভেঙে গেলে অন্নিতো তোমাকে দাঁত ছাড়া নানা ডাকবে। তাছাড়া বসের বিয়েতে গরুর গোস্ত খাবে কি করে? কোর্টের সকলেও বলবে দাঁত ছাড়া নাক উঁচু উকিল। আর আমার গার্লফ্রেন্ড?
এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ১৮
দাঁত ছাড়া শশুরের ছেলের সাথে প্রেম করবে না তো। এই বয়সে অনাথ হবো?
ইতি বেগম আঁচল মুখে দিয়ে হাসতে থাকে। তন্নির হাসিও পাচ্ছে আবার দুঃখও হচ্ছে।
তারেক আশেপাশে কিছু একটা খুঁজে। অতঃপর পেয়েও যায়।