এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ২৬

এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ২৬
তানিশা সুলতানা

মুখোমুখি বসে আছে তারেক এবং অর্ণব৷ তারেকের দৃষ্টি অর্ণবের মুখপানে। ভেতরে ভেতরে তিনি বেশ হতাশ। নিজ কপালকেও দোষারোপ করতে পিছপা হচ্ছেন না। প্রাণ চলে গেলেও এই ছেলের নিজের ফুটফুটে মেয়ের সাথে মানবেন না বলেও প্রতিজ্ঞা করছেন প্রতি মুহুর্তে। আসলেই কি এই ছেলেটা তার মেয়ের যোগ্য? সৎ নিষ্ঠাবান নামকরা উকিল তারেক। দুই চার দশ গ্রামে বেশ নামডাক রয়েছে তার। কখনো কোনো মক্কেলের থেকে দুই টাকা বেশি নেয় নি। কখনো অন্যায়ের হয়ে কেচ লড়ে নি। সন্তানকেও গড়েছে তেমন ভাবে।
ন্যায় নিতি শিখিয়ে শেষ মুহুর্তে একটা বেহায়া বেয়াদব বেপরোয়া ছেলের হাতে তুলে দিবে?
ইট’স নট পসিবল।

তন্নিকে অথৈ নিয়ে গিয়েছে তার রুমে। সারাদিনের অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনায় মেয়েটা কাহিল হয়ে পড়েছে। তাছাড়া তারেকের কড়া হুকুম তাদের পার্সোনাল আলোচনায় ছোটরা থাকতে পারবে না।
অগত্যা সকলেই পালিয়েছে।
আদিল চলে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। এসব ফ্যামেলি ড্রামা দেখার ইচ্ছে তার নেই। রাগান্বিত হয়েছেন অর্ণবের ওপর। সারাজীবন অর্ণবের দোষ গুলো ঢাকার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু আজকে যেটা করেছে সেটা ঘোর অন্যায়।
আনোয়ার মনে মনে কথা সাজাতে ব্যস্ত। কোথা থেকে শুরু করবে? কিভাবে হ্যান্ডেল করবে গোটা ঘটনা? চিন্তায় মুখখানা শুকিয়ে যাচ্ছে তার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আশা বেগম মিষ্টি নিয়ে এসেছে। টি টেবিলে রাখতেই তারেক হুঙ্কার ছেড়ে বলে ওঠে
“মিষ্টি মুখ করার মতো কোনো কাজ আপনার ছেলে করে নি।
চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে অর্ণবের। আশা বেগম লজ্জিত হয়। মিষ্টির ট্রে আবার তুলে নেয়।
ফের তারেক আবার বলে ওঠে
” আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাবো। এবং এই বিয়ের ঘটনা আমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছুক নই আমি।
ঘোর প্রতিবাদের সুরে অর্ণব বলে ওঠে
“আমি বউ ছাড়া থাকতে পারবো না।

তারেক গর্জে উঠে কিছু বলার আগেই পরিস্থিতি সামাল দিতে আনোয়ার বলে
” বেয়াদব মুখে মুখে তর্ক করবে না। তন্নি যাবে ওর বাবার সাথে। বউ ছাড়াই থাকবে তুমি।
জীবনে প্রথমবার বোধহয় আনোয়ার ছেলেকে ধমক দিয়ে কোনো কথা বললো। চমকেছে আশা বেগম। সরু দৃষ্টিতে স্বামীর পানে তাকিয়ে আছে।
অর্ণব সোফায় পা তুলে গোল হয়ে বসে জবাব দেয়
“কি করে বউ ছাড়া থাকবো পাপা?
২৬ বছর যাবত দেখে যাচ্ছি তুমি মাম্মামকে ছাড়া একটা দিনও থাকো না।
আমি তোমার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছি। তোমায় অপমান করতে পারবো না।

হতদম্ভ হয়ে যায় আনোয়ার। বেশ বুঝতে পারে ধমকে কথা বলার ফলাফল হাতে নাতে দিলো। আশা বেগম লজ্জায় আঁচল টেনে মুখ ঢেকে ফেলেছে। তারেকের আঁখি পল্লব বড়বড় হয়ে গিয়েছে। পরপর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে
” দেখুন এমপি সাহেব আপনার ছেলে না জানে ভদ্রতা, না জানে সভ্যতা আর না আছে যোগ্যতা। পারেই শুধু মা রা মা রি, কা টা কা টি করতে। পড়ালেখায়ও ভালো না।
এমন ছেলের হাতে আমি আমার কলিজার টুকরোকে তুলে দিবো? ও যোগ্য আমার মেয়ের?
আপনার ছেলেকে বলুন নিজেকে বদলাতে। আই প্রমিজ নিজেকে পাল্টে নিজের একটা পরিচিতি তৈরি করতে পারলে আমি ভেবে দেখবো।

তারেকের কথা ভালো লাগে না আনোয়ারের। একটা মেয়ের জন্য নিজের ছেলের যোগ্যতার দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে? আনোয়ার যথেষ্ট প্রভাবশালী বিজনেসম্যান। তার যা অর্থ আছে অর্ণবের বাচ্চা কাচ্চারাও রাজার হালে রাজত্ব করে যেতে পারবে। কখনো ছেলেকে চোখ রাঙিয়ে কথা বলে নি আনোয়ার। সেই ছেলেকে আজকে যোগ্যতা নিয়ে অপমান করা হলো?
অর্ণবের মুখের দিকে তাকায় তিনি। এই অপমানের জবাব কি তার ছেলে দিবে না? একটা মেয়ের জন্য মান অপমান খেয়ে বসবে?
আনোয়ারকে ভুল প্রমানিত করে অর্ণব স্পষ্ট স্বরে বলে ওঠে

“আমি যদি নিজেকে পাল্টে ফেলি। তাহলে আপনার মেয়ে আমার যোগ্য থাকবে তো?
তাচ্ছিল্য হাসে তারেক এবং বলে
” আমার মেয়ের যোগ্য আগে হয়ে ওঠো। তারপর দেখা যাবে।
মাথা নিচু করে ফেলে অর্ণব। হাত মুষ্টি বদ্ধ করে ফেলে।
“আমি অথৈয়ের তন্নির মুখে শুনতে চাই। যে আমি ওর যোগ্য নই।
তারেক বোধহয় জানতো এমনটা হবে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন। হুঙ্কার ছেড়ে ডাকেন তন্নিকে। তন্নি সবেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলেন। অথৈ ওয়াশরুমে ঢুকেছে। বাবার ডাকে দৌড়ে আসে। দুরু দুরু বুক কাঁপছে তার। ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে তার সাথে ঠিক জানে।

তারেকের পাশে দাঁড়ায় তন্নি। হাঁপাতে হাঁপাতে শুধায়
” ক..কি হয়েছে বাবা?
তারেক কিছু বলার আগেই অর্ণব বলে।
“তোমার বাবা বলেছে আমি তোমার যোগ্য নই। তোমার মতামত বলো।
শুকনো ঢোক গিলে তন্নি। মাথা তুলে এক নজর তাকায় অর্ণবের মুখপানে। বিলাই আঁখি জোড়া টকটকে লাল রং ধারণ করেছে। ভীষণ রেগে আছে? মনটা আনচান করে ওঠে তন্নির।
বাবা বলেছে মানে তাকেও সেটাই বলতে হবে। বাবার মুখের ওপর কথা বলার সাধ্য কোনোকালেই ছিলো না৷ আজকেও নেই।

তবে “অর্ণব তার যোগ্য নয়” কথাটা মানতে মন সায় দিচ্ছে না।
“এন্সার মি ইডিয়েট
ধমকে বলে অর্ণব। কেঁপে ওঠে তন্নি। বাবার হাত খানা জাপ্টে জড়িয়ে ধরে কাঁপা-কাঁপি গলায় বলে
” বা..বাবা যা বলেছেন তাই ঠিক।
অর্ণব বোধহয় একটু আহত হলো। আশা করেছিলো তন্নি বলবে “বাবা ভুল বলছো”
ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে অর্ণব। তারেক বিশ্বজয়ের হাসি হাসে।
“আগে নিজে যোগ্য হও।তারপর আসবে আমার কাছে আমার মেয়ের হাত চাইতে। ততদিন আমার মেয়ের আশেপাশেও আসবে না।

সঙ্গে সঙ্গে অর্ণব জবাব দেয়। যেনো জবাব তার জিব্বার আগায় এসেছিলো।
” আমি যদি সাকসেস হই। আই এম সরি টু স্যে আপনার মেয়ে আমার যোগ্য থাকবে না। আমার পাপা মানিকগঞ্জের শ্রেষ্ঠ ধনীর তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে। আর আপনারা মধ্যবিত্তের তালিকায় সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছেন।
টাকাপয়সার হিসেব বাদ দিলাম। কারণ আমি আপনার মেয়েকে চেয়েছিলাম।
আপনার মেয়েও আহামরি সুন্দরী কোনো নারী নয়৷ পারফেক্ট সে না।
তবুও চোখে ধরেছিলো। আনফরচুনেটলি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আমার ধারণা ছিলো সেও আমাকে আমার মতো করেই পছন্দ করে। ভুল ছিলাম আমি।
আপনার মেয়ের যোগ্যতা লাগবে।
ওর কি যোগ্যতা আছে?

গায়ের রং শ্যামলা ধবধবে ফর্সা নয়,লম্বা নয়, বোকা আর সবথেকে ইরিটেটিং যে বিষয়টা অতিরিক্ত নেকা।
আপনারা দয়া করে আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। বিয়েটা যখন করেই ফেলেছি দ্রুত ডিভোর্স দিয়ে দিবো।
বুকের ভেতরটা অসম্ভব ভাবে কাঁপছে তন্নির৷ পা ভেঙে আসছে। নিজের শরীরের ভর সইতে পারছে না। বাবার হাতটা আরও একটু শক্ত করে ধরে। দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি ঝড়ছে। থুতনি ঠেকেছে বুকে।
অপ্রিয় কিছু সত্যি কথা। আসলেই তন্নি নেকা আর বোকা।
তারেক আঙুল তুলে কিছু বলতে যায়। অর্ণব নিজেও আঙুল তুলে ধমকে বলে ওঠে
“বের হতে বলেছি আমার বাড়ি থেকে। আপনার ভাষণ শুনতে ইচ্ছুক নই আমি।
গেট আউট ফ্রম মাই হাউজ।

থমথমে মুখে তন্নির হাত ধরে বেরিয়ে যায় তারেক। শেষবারের মতোও মুখ তুলে তাকায় নি তন্নি। মাথা নিচু করে বেরিয়ে এসেছে। তবে কি শেষ গেলো তাদের গল্প?
অর্ণব নামক পাগলটা কি আর তন্নিকে মায়াবতী বলে ডাকবে না?
গভীর রাতে হুটহাট বাড়িতে চলে যাবে না? গলায় থাকা কালো তিলটাতে চুমু খাবে না?
তন্নি তার বাবার সাথে চোখের আড়াল হতেই অর্ণব বাবা মাকে উদ্দেশ্য করে বলে
” পাপা আই’ম গো টু সিঙ্গাপুর টু ডে।
সিদ্ধান্ত জানিয়ে নিজ কক্ষের দিকে অগ্রসর হয় অর্ণব। আনোয়ার জীভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। কয়েকমাস যাবত সিঙ্গাপুর যাওয়ার তোরজোর করেছে অর্ণব। আনোয়ার সহায়তা করেছে। আজকে রাত ১১ টায় ফ্লাইট ছিলো। অর্ণব জানিয়েছিলো আজকে যাবে না। ফ্লাইট মিস করবে।

বাসায় ফিরে তারেক নিজে নিজে দীর্ঘ সময় বিলাপ বকেছে। মাথা নিচু করে তন্নি শুনেছে। অথৈয়ের সাথে কথা বলাও বন্ধ। তন্নির থেকে ফোন খানাও নিয়ে নিয়েছে তারেক। এক সপ্তাহের মধ্যে শহর ছাড়ার খবরটাও জানিয়ে দিলো তারেক।
বাবার বকা শুনে ধীর পায়ে নিজের রুমে যায়। দরজা আটকে খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। পরপর ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ে।
বিরবির করে বলে
“আপনার জন্য আমি অথৈকে হারিয়ে ফেললাম অর্ণব।

কেটে যায় চার বছর।
তন্নি এখন অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। এই চার বছরে একবারও দেখা হয় নি অথৈয়ের সাথে।
এসএসসি পরীক্ষার সিট পড়েছিলো দুজনের দুই স্কুলে। সেইদিন তন্নি বুঝেছিলো ভাগ্যও চাচ্ছে না তার আর অথৈয়ের দেখা হোক।

রাত দশটা বেজে চল্লিশ মিনিট। তারেক দুই ছেলেমেয়েকে পড়াতে বসেছে। বরাবরই তন্নি পড়ালেখায় ফাঁকি দেয় না। বাবার দেওয়া সকল পড়াই ঠিক ভাবে সম্পূর্ণ করেছে।
তামিম ফাঁকিবাজ। সে হোমওয়ার্ক করে নি। মস্ত বড় মোটা লাঠি নিয়ে বসেছে তারেক। হোমওয়ার্ক না দেখাতে পারলেই পিঠে ভাঙবে। তামিমের এখন একটাই কাজ। তারেককে হোমওয়ার্কে কথা ভুলিয়ে দেওয়া।
তাই লাঠিখানার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে

“দেখো বাবা
একদিন আমার নামেই সবাই তোমাকে চিনবে।
তামিম শার্টের কলার ঠিক করে বলে।
” কি করে?
তারেকের সন্দিহান গলার স্বর। তন্নিও মন দিয়েছে তামিমের দিকে। কি বলতে চলেছে তার বিচ্ছু ভাই জানাটা জরুরি।

এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ২৫

“দুই তিনশো মেয়েকে তুলে এনে বিয়ে করবো। সমাজ আমায় লাভ গুরু মানবে। পত্রিকায় আমার পিকচার বের হবে। আমাকে এওয়ার্ড দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করা হবে। তখন আমি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলবো “বন্ধুগন আমি লাভ গুরু হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছি আমার বাবা অশিক্ষিত টাকলু রহমান এবং আমার বস অর্ণব চৌধুরীর থেকে৷
তখন সবাই চিনবে তোমায়।

এক মায়াবতীর প্রেমে পর্ব ২৭