একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৬ (৪)

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৬ (৪)
রনীতা তুশ্মি

গত সাত বছর আগে ঘটে যাওয়া রহস্যে ঘেরা সেই কালরাত্রি। যে রাতেই কেনীথের জীবন থেকে আনায়ার অস্তিত্ব নিমিষেই ফুরিয়ে গিয়েছিলো। কেনীথ জেনেছিলো তার আনায়াকে এই রাতেই কয়েকটা মানুষরূপী জা”নোয়ার ছিঁ”ড়েখুঁ”ড়ে খেয়ে শেষ করে ফেলেছিলো। অর্ধেক শরীর পর্যন্ত পুড়ি”য়ে দেওয়া হয়েছিলো। বারবার নিশ্চিত হতে ডিএনএ টেস্ট করেও রিপোর্ট একটাই এসেছিলো। তা হলো সেই পুড়ে যাওয়া লা”শটা আনায়ারই।
কেনীথ শুরুতে বিশ্বাস করতে পারেনি।কোনোভাবেই সে এসব বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু শেষমেশ তার মস্তিষ্ক মন সব মেনে নিয়েছে যে আনায়া আর পৃথিবীতে নেই। সে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। অথচ সাত বছর পর আজ এক ঝাঁক বিস্ময়ের সাথে আনায়া আবারও ফিরে এসেছে।

এইসব কিছুই যেন ছিলো এক অপ্রত্যাশিত সাজানো-গোছানো পরিকল্পনা।তবে শুরুতে আনায়ার নিজস্ব কোনো পরিকল্পনা ছিলো না এতে। শুরুটা হয় সেদিন রাতে আনায়া যখন ওই বখাটে খারা”প লোকেদের মুখোমুখি হয়। সেসব নিত্যান্তই আনায়ার কাছে অপ্রকাশিত এক পরিস্থিতি ছিলো। তবে সেজন্য তার নিজস্ব কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং তার নিজের হাতেই সে রাতে দুজনের প্রাণ হারাতে হয়।
পাঁচ জন মানুষ রুপী জা”নোয়ারের মাঝে হসপিটাল ড্রেস পড়া এক একাকী মেয়ে। নিত্যান্তই সেসব জা”নোয়ারদের মাঝে মেয়েটিকে ছিড়েখুঁ”ড়ে খাওয়ার এক অসীম নেশা জাগ্রত হয়েছে।
আনায়ার কাছে লোকগুলো এগিয়ে গেলেই কিছু মূহুর্তের জন্য আনায়া নিজের জীবনের পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিলো। ভেবেছিলো এই পৃথিবীতে অন্তত তার থাকার আর কোনো প্রয়োজন নেই। সে এখন সবার জন্য অ”ভিশাপ হয়ে গিয়েছে। প্রত্যেকের জীবন তার জন্য ধ্বং”স হয়ে গিয়েছে। আর সবকিছুর উৎস হিসেবে সে নিজেকেই দোষারোপ করছিলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

যথারীতি লোকগুলো তার কাছে এগিয়ে আসা পর্যন্তও সে একদম নিস্তব্ধ ছিলো। পাগলের মতো নিজের জীবনকে তাচ্ছিল্য করে হাসতে ব্যস্থ ছিলো সে। কিন্তু লোকগুলো তার কাছে চলে এলেই তার সিদ্ধান্ত নিমিষেই বদলে যায়। লোকগুলোর মাঝে একজনের হাতে কাঁচের বোতল সাথে নিয়েই আনায়ার দিকে হেলতে দুলতে এসে আনায়ার কাঁধে হাত দিয়ে ওর কানের কাছে ফিসফিস করে কিছু কথা বললো। যেসব শোনা মাত্রই আনায়া ত্বরিত লোকটির দিকে শক্ত চোখে তাকালো।
লোকটি ওর এহেন চাহনিতে দাঁত কেলিয়ে হাসতে ব্যস্থ হয়ে পড়লো। সেই লোকটির সাথে সাথে বাকি চারজনও অট্টহাসিতে মেতে উঠলো। এদিকে আনায়া আচমকা এদের হাসির মাঝেই তার পাশে থাকা লোকটির মুখে সজোরে ঘু”ষি মারলো। যার ফলে মাতাল লোকটির ছিটকে খানিকটা দূরে সরে গেলো। সঙ্গে তার হাত থেকে কাঁচের মদের বড় বোতলটা পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে দু টুকরো হয়ে গেলো।

এদিকে পড়ে যাওয়া লোকটি সহ বাকি চারজনও আনায়ার কাজে ক্ষে”পে গিয়ে ওর দিকে রাগান্বিত হয়ে এগিয়ে আসতে নিলে আনায়া দ্রুত নিচ থেকে কাঁচের চোখা একটা অংশ তুলে নিলো। এরপর তার পাশে থাকা হ্যাংলা পাতলা লোকটির পেট বরাবর সো”জা ঢুকিয়ে দিলো।
আনায়ার চোখ-মুখ হতে আচমকাই যেন আগুন ঝড়ছে। মন মস্তিষ্ক এখন এটাই বলছে,”তোর জীবন এমনিতেই শেষ হয়ে গিয়েছে আনায়া। এবার নিজের আর নতুন করে বাঁচার চিন্তা বাদ।শুরু এই জানো”য়ারগুলো শেষ করতে হবে।”
এরই মাঝে আনায়া কাঁচের বোতলটা টেনে পেট থেকে বের করে নিয়ে এলো। আনায়ার শরীর, হাত সহ চারপাশ র”ক্তে ছড়াছড়ি। এরই মাঝে সেই চারজন লোকের মাঝে একজন এসে আনায়ার মাথার পেছনে আরেকটা কাঁচের বোতল দিয়ে সজোরে বারি মা”রলো। নিমিষেই যেন আনায়ার সর্বস্ব দুনিয়া ঘুরে গেলো। নিশ্বাসের গতি কমে গেলো। মাথা ঘুরে পড়ে নিতে নিয়েও আবারও শক্ত হলো।

হুট করেই পুনোরায় হিং”স্র হয়ে উঠে লোকটির চুল টেনে হিঁচড়ে কাঁধে হাতে কা”মড়ে রাস্তায় ফেলে দিলো। তবুও আনায়া লোকটিকে ছাড়ছে না। এই পর্যায়ে আনায়াকে সম্পূর্ণ বিধস্ত এক ধ্বং”’সকারী মনে হচ্ছিলো। আনায়া আকস্মিক লোকটির উপর চড়ে বসলো। অতঃপর লোকটির মাথা ধরে রাস্তায় মধ্যে আঁচড়াতে লাগলো। এটি বেশি সুবিধার মনে হলো না তার। আচমকাই পাশ থেকে মাঝারি আকারের একটা পাথর তুলে এনে আবারও লোকটিকে মুখে অনবরত মা”রতে লাগলো। লোকটি চিৎকার করলো, মুখ থেঁতলে গিয়ে র”ক্ত বের হলো তবুও আনায়া থামলো না। সম্পূর্ণ উম্মাদে পরিণত হয়েছে সে। মানুষ হ”ত্যার উম্মাদ সে এখন।

এদিকে আবার সেই কখন থেকে বাকি দুজন লোক তাকে অনবরত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। বারবার আনায়াকে থামাতে চাইছে কিন্তু পারছে। এই দুজন অবশ্য একটু বেশিই মাতাল হয়ে গিয়েছে। যে কারণে দুজনে মিলেও আনায়াকে সরাতে পারছে না। অন্যদিকে আরেকজন গিয়েছিলো আনায়ার প্রথম আ”ঘাত করা লোকটির কাছে। সে এখন অনেকটাই অচেতন হয়ে পড়েছে। এদিকে আবার আনায়া এই লোকটিকে প্রায় মে”রেই ফেলছে দেখে সেই লোকটি ছুটে আনায়াকে থামাতে এলো। আনায়ার চুল ধরে টেনে হিঁচ”ড়ে সেই লোকটির পেটের উপর হতে আনায়াকে সরিয়ে আনলো।
এই পর্যায়ে লোকটি আনায়ার সাথে খা”রাপ কিছু করার জন্য উদ্বেগ হলো। আনায়াকে শুয়েই সে লোকটিই গিয়ে ওর উপর চড়ে বসলো। আনায়া হাত পা ছোটাছুটি করছিলো দেখে স্বাস্থ্যবান পুরুষটি আনায়ার হাত দুটো চেপে ধরে আনায়ার দিকে মুখ এগিয়ে নিলো।

এদিকে আনায়ার চোখমুখ অত্যন্ত নিরেট। চোখমুখে নেই কোনো ভয় কিংবা আ”তংক। ও যেন কোনো যুদ্ধের ময়দানে নেমেছে। লোকটি আনায়ার মুখের কাছে আনতেই আনায়া সজোরে মাটি থেকে মাথা তুলে লোকটির মুখ বরাবর আ”ঘাত করলো। আকস্মিক আঘাতে লোকটির নাক ফেটে র’ক্ত গড়ালেও লোকটি যেন এতে আরো হিং””স্র হয়ে উঠলো। আনায়ার হাত দুটো চেপে ধরলো আরো জোরে। কিন্তু আনায়া তবুও ভয় পাচ্ছে না। ওর আসলে বাঁচা-ম”রার কোনো ভয়ই নেই। না কোনো জানো”য়ারের কাছে নিজের স”তিত্ব হারানোর। আনায়ার কাছে সেই সময় কেনীথ আর এই লোকগুলো যেন একই ছিলো। ও বুঝতেও পারছিলো না যে তার মানসিক পরিস্থিতি ঠিক কোন পর্যায়ে চলে গিয়েছে।

আনায়া এবারও নিজের সর্বস্ব শক্তি প্রয়োগ করে মাটি থেকে খানিকটা ওঠার চেষ্টা করেই লোকটির কাঁধে সজোরে কামড়ে ধরলো। লোকটি আনায়ার হাত ছেড়ে দিয়ে আনায়ার চুপ পেছন থেকে টেনে ধরে ওকে সরাতে চাইলো কিন্তু আনায়া যেন ছাড়ছেই না। লোকটি একটা পর্যায়ে ব্যাথায় চেঁচাতে লাগলো কিন্তু আনায়া যেন এসব কিছুই কানে নিচ্ছে না। ওদিকে বাকি দুই মাতাল এখন আনায়াকেই ভয় পাচ্ছে। সবকিছু ছেড়ে হুট করেই দুজন জঙ্গলের ভেতরের দিকে পালাতে লাগলো।
এদিকে লোকটির কাঁধের মাংস উঠে গিয়ে রক্ত গড়িয়ে আনায়ার সম্পূর্ণ মুখে দাঁতে লেগে গিয়েছে। তবুও আনায়ার শান্ত হওয়ার নাম নেই। এরই মাঝে আনায়া অনুভব করলো হুট করেই লোকটি কেন অদ্ভুত ভাবে শব্দ করে কেঁপে উঠলো। আনায়া কাধঁ থেকে মুখ সরাতেই দেখলো লোকটি অদ্ভুত ভাবে তার দিকে একপলক তাকিয়ে। বড়বড় চোখ যেন এ মূহুর্তেই তার দেহ থেকে প্রাণটা কেউ তুলে নিয়েছে। লোকটি নিমিষেই আনায়ার উপর ভর ছেড়ে দিতেই লোকটি মুখ থুবড়ে আনায়ার কাঁধের একপাশে গিয়ে পড়লো। আর সেই মূহুর্তেই আনায়ার চোখের সামনের এক অপ্রত্যাশিত মানবের মুখ দৃশ্যমান হলো।

কালো রংএর হুডি আর প্যান্ট পড়া। মাথায় একঝাঁক কোঁকড়ানো চুল। চোখে-মুখে গাম্ভীর্যের স্পষ্ট ছাপ। হাতে থাকা বন্ধুকটা আনায়ার উপর পড়ে থাকা লোকটির দিকে তাক করা। আনায়ার এই অর্ধ অন্ধকার পরিবেশেও এই মানবটিকে চিনতে আর বাকি নেই। এই মুহূর্তে পাভেলকে সে হয়তো আশা করেনি।
এরই মাঝে পাভেল এসে আনায়ার উপর থেকে টেনেটুনে লোকটি সরিয়ে দিলো। অতঃপর হাঁটুগেড়ে আনায়ার পাশে বসে আনায়াকে দু’হাতে আলতো হাতে বসালো। আনায়া বসে পাশে পড়ে থাকা লোকটিকে খেয়াল করে দেখলো লোকটির পিঠে গুলির দুটো নিশানা। আনায়া ঘুরে পাভেলের দিকে তাকালো।একবার ওর হাতে থাকা বন্দুকটাও দেখলো। মনে হলো হয়তো বন্দুকে সাইলেন্সার লাগানো। নয়তো গুলি করার শব্দ সে ঠিকই শুনতে পেতো। পাভেলকে নিয়ে আনায়ার চোখে-মুখের বিস্ময়তা কেটে গিয়েছে। পুনোরায় চোখ-মুখ কঠোর হয়েছে।
এদিকে পাভেলের নিরেট গম্ভীর্যে আচ্ছন্ন চেহেরা গায়েব হয়ে গিয়ে একদম নরম হলো। হুট করেই কেমন যেন ইনোসেন্ট হয়ে পড়লো। অতঃপর তড়িঘড়ি করে আনায়ার উদ্দেশ্যে বললো,

“আপনি ঠিক আছেন তো? ওরা আপনার কিছু করেনি তো?”
আনায়া মাথা নাড়িয়ে না সূচক সম্মতি দিলো। পাভেল আবারও অস্থির হয়ে বললো,
“এখানে কি করে এসেছেন। কখন এসেছেন, হসপিটাল থেকে বের হওয়া মানা ছিলো আপনার। আপনি পুরোপুরি ঠিক নন”
আনায়া পাভেলের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। হুট করে ওর একথা শুনে তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,
“পুরোপুরি ঠিক নই? আরো ঠিক হওয়ার কিছু রয়েছে? আমি তো জানি আমি সবটাই ভুল। আমার জীবনটাই তো ভুল।”
পাভেলের বুঝতে বাকি নেই আনায়া সত্যিই আর ঠিকঠাক নেই। ওর কথায় কিছুক্ষণ চুপচাপ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“ওদের এই অবস্থা কি করে হয়েছে। এখানে তো আপনি ছাড়া…আরো কেউ এসেছিলো কি?”
—“কেউ আসেনি,আমিই করেছি।”
আনায়ার এহেন নির্বিকার কথা শুনে পাভেল থমকে গেলো। আনায়া এসব করছে মানে। কেনো যেন ওর এহেন অবস্থা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। কিছুটা বিস্ময়ের সাথে বললো,
“আপনি? ”
আনায়া কিঞ্চিৎ রুক্ষ হাসিতে মুচকি হেসে বললো,
“কেনো করতে পারি না? আমি কি অনেক ভালো? সবাই তো আমায় কষ্ট দেয়। আমি কি তবে কাউকে কষ্ট দিতে পারবো না? আমিও কষ্ট দিতে চাই। মানুষকে কষ্ট দিয়ে তার সর্বস্বকে নিঃস্ব করতে চাই। আমি কি এমনটা করতে পারবো না?”
পাভেল আনায়ার দিকে অপলক তাকিয়ে ওর কথা গুলো শুনলো। আনায়া নিজের মধ্যে নেই। এমনিতেই ওর মানসিক পরিস্থিতিটা খুব বেশি ভালো ছিলো না আর তার মধ্যে আজকের এই ঘটনা! পাভেল ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
“উঠে আসুন, যেতে হবে।”

—“কোথায় নিয়ে যাবেন? আবার ওই জা”নোয়ারটার কাছে?”
আনায়ার নির্বিকার কথায় পাভেল আবারও থমকে গেলো।
—“মানে কার কথা… কেনীথ ব্রো এর কথা বলছেন।”
আনায়া নির্বিকারে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
“হুম।”
—“এমনটা কেনো বলছেন। আমি জানি উনি ভুল করেছেন কিন্তু…”
পাভেলের কথা শেষ হওয়ার আগেই আনায়া আবারও বললো,
“আপনি আপনার হাতের গানটা দিয়ে আমায় মে’রে ফেলুন।তাহলেই সব সমস্যা শেষ হয়ে যাবে।তবুও আর আমায় ওই লোকটার কাছে নিয়ে যাবেন না। ওনার মুখটাও দেখতে চাইনা আর আমি৷”
পাভেল আনায়ার ছলছল চোখ আর তাচ্ছিল্যে ভরা হাসিমাখা মুখটার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইলো। ঠোঁট চেপে কিছু একটা ভাবার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“ঠিক আছে, আপনাকে আর বসের কাছে যেতে হবে না। এবার আপনাকে অন্য একটা জায়গায় যেতে হবে।”

—“কোথায়?”
—“রাশিয়া।”
আনায়া খানিকটা কপাল কুঁচকে ফেললো। যা দেখে পাভেল ইতস্ততভাবে বললো,
“চিন্তা করবেন না। এখানের সব কিছু আমি সামলে নেবো। আজকের পর আপনি যতদিন না চাইবেন ততদিন পর্যন্ত আপনাকে সবাই মৃত হিসেবে জানবে। আর রাশিয়াতে কেনীথ ব্রো এর বাবুশকা মানে নানী থাকেন। উনিই আপনার সব দেখভাল করবে না। আপনি রাজি কি না… ”
—“উনিও জানবেন না যে আমি রাশিয়ায়?”
পাভেল অকপটে বললো,
“নাহ! আপনি না চাইলে, বস কিচ্ছু জানবে না”
আনায়াও ছোট করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

“ঠিক আছে, আমার যেতে কোনো অসুবিধা নেই। শুধু আমার বোনটা যেন ঠিকঠাক থাকে। আর কিছু চাই না আমি। কে বাঁচল, কে মরলো তাতে আর কিছু যায় আসে না আমার। আর হ্যাঁ,আরেকটা রিকুয়েষ্ট রাখবেন?”
পাভেল ইতস্ততভাবে বললো,
“জ্বী বলুন!”
আনায়া খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলতে লাগলো,
“এই পৃথিবীতে রেহান নামের একজন রয়েছে। যে কিনা আনায়া নামক অভি”শাপের জন্য নিজেকে প্রতিনিয়ত শেষ করছে। যদি সম্ভব হয় তবে তাকেও জানিয়ে দিবেন, তার আনায়া আর নেই। সে যেন তার বউপাখির স্মৃতির ইতি এখানেই ঘটিয়ে নেয়। আজ থেকে আনায়া নামক অভি”শা’পের সমাপ্তি এখানেই ঘটলো।”

কেনীথের কাছে আনায়া সেদিনের ঘটনাটা মোটামুটি এভাবেই ব্যাখা করলো। এরপর পাভেল আনায়াকে পাঠিয়ে দেয় রাশিয়ায়। আর এদিকে সে একটা সুন্দর পরিকল্পনা সাজিয়ে নেয়। সে রাতের মধ্যেই তার লোকজন সহ কিছু নিজস্ব পুলিশকেও সেই জায়গায় ডেকে আনা হয়। সঙ্গে মর্গ থেকে জোগাড় করে আনা হয় আনায়ার মতো শারিরীক গঠনের একটি মেয়েও। অতঃপর সেই মেয়েটির দেহটাকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে আনায়ার হাতে অলরেডি দুজনের প্রাণ চলে গিয়েছে। তারা দুজন বেশিক্ষণ বাঁচতে পারেনি। পাভেল সে লা”শ দুটোকেও সরিয়ে দেয়। সাথে তার নিজের হাতে প্রাণ নেওয়া লোকটিরও। এছাড়া জঙ্গল থেকে খুঁজে, পালিয়ে যাওয়া সে দুজনকেও সেই রাতের মধ্যেই বের করে প্রাণ নিয়ে নেওয়া হয়।
পাভেল আনায়ার খোঁজেই সে রাতে যখন জঙ্গলের রাস্তায় চলে আসে তখন সে নিজ চোখেই দুজন লোককে জঙ্গলের দিকে পালাতে দেখেছিলো। যথারীতি তারা দুজনও বাঁচতে পারেনি।

আর এইসব বিষয় গুলো খানিকটা গোপনেই ধামাচাপা দেওয়া হয়। মিডিয়াতেও এই নিয়ে তেমন কোনো সোরগোল পড়তে দেওয়া হয় না। আর কেনীথের কাছে সুন্দর ভাবে বর্ননা করা আনায়ার নৃ””শংস মৃ”ত্যুর ঘটনা। কেনীথকে তিন চারবার দেখানো নতুন ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট কিংবা তাকে বলা গল্পের সবকিছুই ছিলো সাজানো। এমনকি কেনীথ যেন কিছু বুঝতে না পারে সেজন্য আলাদা ভাবে এই কাজে পুলিশকেও যুক্ত করা হয়। যেন কেনীথ তাদেরকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর একটাই আসে যে আনায়া আর নেই।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। শীতের সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতে বেশি দেরী নেই। কেনীথ চুপচাপ মাথা নিচু করে এসব ঘটনা শুনে যাচ্ছিলো। তার হাতের কনুই দুটো হাঁটুতে ঠুকে রাখায় তা এখন শুন্যে ঝুলছে। আনায়ার কথা শেষ হতেই আনায়া জোরে শব্দ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সোফায় হেলান দিয়ে দুহাত দুদিকে এলিয়ে দিলো। পায়ের উপর পা তুলে তা অনবরত নাড়াতে লাগলো। আনায়ার নির্বিকার হাভভাব, ঠোঁটে বিস্তৃত মুচকি হাসি৷ কেনীথ কিছু বলছে না দেখে আনায়া নির্বিকারে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হলো? ছ্যাকা খাওয়ার গল্প শুনে ব্যাকা হয়ে গেলে। এখন তো দেখছি সোজাও হচ্ছো না।”
কেনীথ আনায়ার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের সাথে কিঞ্চিৎ হাসলো। অতঃপর ঝুকিয়ে রাখা মাথাটা তুলে আনায়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

“সত্যিই একটা জানোয়ার আমি, তাই না?”
আনায়াও রুক্ষ হেঁসে বললো,
“হয়তো, আবার না। মানে দেখতে মানুষের মতো, কিন্তু ভেতরটা জানো”য়ারের মতো।”
কেনীথ আবারও তাচ্ছিল্যের সাথে হেঁসে সোজা হয়ে বসলো। আনায়া আবারও বললো,
“এতো হা হুতাশের কিছু নেই। আমিও এক সময় ভেতর বাহিরে সব মিলিয়ে মানুষই ছিলাম। এরপর তুমি নিজ হাতে আমায় শেষ করলে আর আমিও তোমার মতো মানুষরূপী জানো”য়ার হয়ে গেলাম।
এখন দুজনই সমান সমান। আমারও আর কোনো জানো”য়ারের সংসার করতেও আর কোনো সমস্যা নেই। সবকিছুই এবার ঝাক্কাস হবে।”

কেনীথ অমায়িক বিস্তৃত হেসে পুনোরায় গম্ভীর্যের সাথে বললো,
“তুই বলিসনি যে এই কাগজগুলো তুই কোথায় পেলি? আর এগুলো দেখে তো মনে হচ্ছে এগুলো কপি পেপার্ এন্ড সম্পূর্ণও নয়। আরো কিছু অংশ থাকার কথা এখানে।”
“ঠিক ধরেছো,এটা সম্পূর্ণ নয়। তবে এটা আমি কোথায় পেয়েছি তা বলবো না। ধরে নেও, বাবুশকার কোনো সাজানো গোছানো কারসাজি থেকে গোপনে পেয়েছি।”
আনায়ার হাসিখুশি মুখ দেখে কেনীথ কপাল কুঁচকে ফেললো। আনায়া ঠিক কি চাচ্ছে সেটা তার কাছে পরিষ্কার নয়।
“আমার যদি ভুল না হয় তবে তোর এখানে আসার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হয়তো ইনায়াকে খুঁজে বের করা। তবে তোর উদ্দেশ্যের সমাপ্তি এখানে হলে ভালোই হতো কিন্তু আমার মনে হয় না তুই এখানেই থেমে থাকবি। একটু ক্লিয়ার করে বলতো তুই কি চাচ্ছিস?”

আনায়া হুট করেই মাথা সোফা থেকে হেলিয়ে কেনীথ কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।পায়ের উপর পা তুলে নাচাতে থাকলো। আনায়া নির্বিকারে চোখ বুঁজে বললো,
“মাথা ধরেছে, টিপে দেও তো!”
কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও আনায়া কেনীথের কোনো প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে না পেরে চোখ খুললো। খুলতেই কেনীথের ভ্রু উঁচিয়ে থাকা বিরক্তিমাখা গম্ভীর মুখটা দৃশ্যমান হলো। কেনীথ ওর দিকেই তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে রইছে। আনায়া পুনোরায় মুচকি হেসে বললো,
“বউয়ে মাথা টিপে দিলে জাত যাবে বুঝি?”
—“আমি আমার উত্তর পায়নি।”
—“উত্তর পেলে পত্নীসেবা করবে?”

—“শুধু পত্নী কেনো, তুই ম”রার পর পেত্নী হলে তারও সেবা করতে রাজি আমি। ফালতু কথা না বলে যা জানতে চাইছি তা বল। আমি বিরক্ত হচ্ছি। তোর কথা এখনো অসম্পূর্ণ।”
—“আপনার বিরক্তিতে তো আমার কিছু আসে যায় না।”
কেনীথের চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। ত্বরিত আনায়ার মাথাটা টেনে উঁচিয়ে বসাতে চাইলে আনায়া কেনীথের ঘাড়ের পেছনে দু-হাত দিয়ে চেপে টেনে ধরে উল্টো কেনীথের মুখটা নিজের কাছে নিয়ে এলো। অতঃপর বিস্তৃত বাঁকা হেঁসে ফিসফিস করে বললো,
“চাই তো আমি অনেক কিছুই কিন্তু এক্সাক্ট কি চাই আমি? ওহ,ধ্বং’স! ধ্বং’স চাই আমি।”
এই বলেই আনায়া অমায়িক হেসে টুপ করে কেনীথের নাকের ডগায় ঠোঁট ছুঁইয়েই কেনীথকে ছেড়ে দিয়ে সোজা উঠে দাঁড়ালো। অতঃপর পানি ভর্তি জগের মধ্যে কাগজগুলো ডুবিয়ে সেগুলো একটা কাঠি দিয়ে নেড়েচেড়ে গুলিয়ে ফেলতে লাগলো। এদিকে কেনীথ ওর কাজকর্মে বেশি একটা অবাক হলো না। ও আনায়ার দিকে তাকিয়ে অকপটে বললো,
“এই পেপারস্ এর আসল কপিটা কোথায় আনায়া?”
আনায়া বেডসাইড টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে নিজ কাজে ব্যস্থ ছিলো। কেনীথের কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে নির্বিকারে হেঁসে বললো,

“বলতে চাইছি না, আবার হয়তো আমি জানি না।”
—“তুই কি পাভেলকে কোনো ভাবে সন্দেহ করিস? নয়তো তুই এসব কথা ওর সামনেও তো বলতে পারতি। পাভেল তো এখন পর্যন্ত তোর সব কাজে যুক্ত ছিলো।”
আনায়া আবারও মুচকিে হেঁসে বললো,
“উনি মানুষটা অদ্ভুত। মনে হয়, ভুলবশত আমার মতো উনি নিজেও ফেঁসে গিয়ে অন্ধকার দুনিয়ায় প্রবেশ করছে। এছাড়া তার আরো এক মহা গুন কি জানো? উনি সবার হয়ে খেলেন। উনি তোমার সাথে থেকে যেমন তোমার হয়েও কাজ করে তেমনি সে বাবুশকা কিংবা আমার হয়েও কাজ করে। সবটাই ব্যালেন্স করতে চান তিনি।কিন্তু উদ্দেশ্যটা হয়তো তার সবকিছু ভালো করা। অন্ধকার জগতের এক অদ্ভুত ভালো মানুষ উনি।”
কেনীথ কিছু বললো না। এদিকে আনায়া আবারও মুচকি হেসে বললো,

“কলিজা! তুমি কিন্তু ভালো রকমের ভ’ণ্ড হয়ে গিয়েছো।”
কেনীথ চুপচাপ রইলো। মন বলছে আনায়া আবারও একটা ফাও কথা বলতে প্রস্তুত। কেনীথের হাভভাব দেখে আনায়া নিজেই হাসতে হাসতে বললো,
“একে তো বারবার বলো, আমায় দূরে সরে থাকতে। এদিকে আমি নিজ থেকে তোমার কাছে গিয়ে কিছু একটা করে নিলেও ঢং করে নাক ছিটকাও। অথচ তোমার মতো লোক চাইলেই আমাকে কোনো না ভাবে আঁটকে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু তুমি কাজের বেলায় তেমন কিছুই করো না।
ফুলের মধুও খাবা, আবার নাকও ছিকটাবা। ভালোই ভ’ণ্ডামি শিখেছো কিন্তু। এসব ভ’ণ্ডামি কোন শয়তানে শিখায় শুনি?”
কেনীথ আচমকাই বিড়বিড় করে বললো,
“ভ’ণ্ড তুশ।”
আনায়া কপাল কুঁচকে বললো,
“এটা আবার কে?”

—“বোন হয় আমার।”
—“কিহ! তোমার আরো কয়টা বোন আছে? রোজ আর ইনায়া…আমি তো এখন বউ হই। তবে এটা আবার কোথায় থেকে আসলো।”
—“তোর না জানলেও চলবে। নিজের কাজ কর।”
আনায়াও আর কিছু না বলে নিজের কাজে মনোযোগী হলো। পানিতে সম্পূর্ণ কাগজ গুলো গুলিয়ে ফেলা হলে আনায়া সেগুলো নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে কমডের ভেতর ফেলে দিয়ে ফ্ল্যাশ করে দিয়ে আবারও রুমে চলে এলো। অতঃপর কেনীথের সামনে দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুঁজে অকপটে বললো,
“কাল রেহানের সাথে দেখা করতে চাই।”
কেনীথ ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“তো আমাকে কেনো বলছিস?”
—“তুমি আমার দশটা না বিশটা না, একটা মাত্র জামাই। এটুকু অনুমতি নিয়ে কাজকর্ম না করলে কি করে হয়। যতই হোক, রেহান আমার হয়েও না হওয়া এক্স জামাই।”
—“তো এক্স জামাইয়ের সাথে শুধু দেখা কেনো, বিয়ে করে সংসার করে তাকে সারাজীবন চোখের সামনে সাজিয়ে রাখেন। আমার তো কোনো আপত্তি নেই।”

আনায়া কেনীথের অকপটে বলা কথাগুলো শুনে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। মাঝেমধ্যে কেনীথের না চাইতেও ছ্যাত করে ওঠার বিষয়টা ভালোই লাগে।
“কলিজা! আবারও জ্বলছে বুঝি?”
কেনীথ কটমট চোখে তাকাতেই আনায়া আবারও হেঁসে ফেললো। এরই মাঝে রুমের দরজায় শব্দ হলো। আনায়া গিয়ে দরজা খুলে দিতেই আনায়ার সমানে পাভেল দৃশ্যমান হলো। হাতে একটা ট্রে তার মধ্যে দুটো শরবতের গ্লাস সাজিয়ে রাখা। আনায়া দেখামাত্রই ইতস্ততভাবে মুচকি হেসে বললো,
“ডিস্টার্ব করলাম না তো?”
আনায়া বিস্তৃত হেসে বললো,
“আরেহ নাহ, ভেতরে আসুন।”

পাভেলও মুচকি হেসে রুমে প্রবেশ করলো। কেনীথের গম্ভীর আর তির্যক চাহনিতে নজর পড়তেই ওর কলিজা কেঁপে উঠলো। পাভেল আর কেনীথের দিকে এগিয়ে গেলো না। দূর থেকেই আনায়ার আর কেনীথের উদ্দেশ্যে বললো,
“রাতে কি খাবেন আপনারা,ওটাই জানতে এসেছিলাম।”
পাভেলের কথা শেষ হতে না হতেই কেনীথ গম্ভীর্যের সাথে বললো,
“রাতে কিছু খাবো না আমি। এসব নিয়ে টেনশন না করলেও চলবে তোর।”
কেনীথ যেন কথাটা অনেকটা ধমকের সুরেই বললো। তবে আনায়া মুচকি হেঁসে বললো,
“আমারও আজ রাতে খাওয়ার কোনো মুড নেই। এমনিতেও একটু পর আমি চলে যাবো।”
পাভেল কিছুটা তাড়াহুড়ো করে বললো,

“চলে যাবেন মানে?থাকবেন না আপনি? এটা কি করে হয়। আপনি এখানেই থাকুন…”
পাভেল নিজের কথা আর শেষ করতে পারলো না। কেনীথের রক্তগরম চোখের দিকে নজর পড়তেই তব্দা খেয়ে গেলো। আনায়া এসব দেখে আবারও মুচকি হেসে বললো,
“ইচ্ছে তো ছিলো চলে যাবার।তবে এখন মনে হচ্ছে থাকা উচিত।”
এটা শোনা মাত্রই কেনীথ জোর গলায় বললে,
“এমন ইচ্ছে থাকলে মে”রে ফেল। আর যেটাই করিস, আমার রুমে থাকতে পারবি না তুই।”
আনায়াও কেনীথের রাগের আগুনের মাঝে ঘি ঢালার ন্যায় বিস্তৃত শয়তানি হাসি উপহার দিয়ে বললো,
“ঠিক আছে। তোমার রুমে থাকবো না কিন্তু তোমার সাথে চিপকে থাকলে তো আর কোনো সমস্যা নেই, তাই না?”
কেনীথ চোখমুখ শক্ত হতেই পাভেল ত্বরিত বলতে লাগলো,
“রাতের খাবার না খান, ঠিক আছে। আপাতত দুজনে এই শরবতটা খেয়ে নিন। মাইন্ড ফ্রেস হয়ে যাবে।”
কেনীথ রেগে গিয়ে আওড়ালো,

“মীর জাফরের মতো সবকিছুর আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়িয়ে এখন এসেছে মাইন্ড ফ্রেস করাতে।”
আনায়া পাভেল দুজনেই চুপচাপ কথা শুনে হজম করে নিলো। তবে আনায়া দুটো গ্লাস ট্রে থেকে তুলে নিয়ে একটা কেনীথের সামলে ধরলো। কেনীথ প্রথমে মানা করলেও অনেকটা বিরক্তি আর অনিহা নিয়েই অর্ধেকটা শরবত খেয়ে নিলো।আর বাকিটুকু টেবিলের উপর রেখে দিলো। এটা দেখামাত্রই হঠাৎ পাভেল ইতস্ততভাবে বললো,
“বলছিলাম বস, পুরোটা খেয়ে নিলে ভালো হতে না?”
পাভেলের কথায় কেনীথ রেগে গিয়ে বললো,
“আমার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না, তুই খা বলদ।”

পাভেল আর এখানে নতুন করে কিছু বলার সাহস পেলো না।এদিকে আনায়ার আরেক কান্ড করে বসেছে। নিজের গ্লাসের পুরো শরবতটা একেবারে খেয়ে নিয়ে কেনীথের রেখে দেওয়া অর্ধেক শরবতের গ্লাসটা তুলে নিয়ে বললো,
“চিন্তা নেই দেবর মশাই। আপনার কেনীথ পীর-বাবাজি পুরোটা না খেলে, তার বিবি রয়েছে কোন কাজে!আমিই না হয় এটুকুও খেয়ে নিচ্ছি।”
—“আরেহ নাহ!আরেহ!আমি আপনার জন্য নতুন করে আরো এক গ্লাস…”
পাভেলের কথা আর শেষ হলো না বরং এর আগেই আনায়ার বাকি শরবতটুকুও খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে। স্বস্তির দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পাভেলের উদ্দেশ্যে বললো,
“পুরো ঝাক্কাস হয়েছে দেবোর মশাই।”
কেনীথ আনায়ার আচরণে আবারও বিরক্তি প্রকাশ করলো। এদিকে পাভেলও কেমন যেন প্রচন্ড দুশ্চিন্তা নিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে বললো,
” এবারও গড়বড় হয়ে গেলো। না জানি এর ফল কি হয়।”

রাত কতটা গভীর তা জানা নেই। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরের মাঝে টেবিল ল্যাম্পের হলুদ আলোয় রুমের অনেকটা অংশই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বিছানার দুই পাশে দুজন মানব উল্টোপাল্টা হয়ে শুয়ে রইছে।একজন বেঘোরে ম”রার মতো ঘুমাচ্ছে তো অন্যজন ঘুমের মধ্যেও কেনো যেন হাত পা ছোটাছুটি করে গড়াগড়ি করছে।
আনায়ার চোখেমুখে দিব্যি ঘুৃম তবুও এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে চোখবুজেই বিছানায় গড়াগড়ি করছে। অন্যদিকে কেনীথ সেই যে ঘুমিয়েছে আর ওঠার নাম নেই। হুট করে দুজনের কি হয়েছে তা নিজেরাও জানে না। সেই শরবত খাওয়ার আরো কিছুক্ষণ দুজনে মিলে তর্কবিতর্ক করছিলো। মাঝেমধ্যে কাজের কথা বলছিলো তো আবার কখনো কখনো ভুংভাং কথা-কাটাকাটি। এরই মাঝে কেনীথের প্রচন্ড ঘুম পেলে সে আনায়াকে চলে যেতে বলে কিন্তু আনায়া যেতে নারাজ। সে অবশ্য তখন কেনীথের পারসোনাল ইনফরমেশন গুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলো কেনীথের লেপটপে।

তবে কেনীথের আর এতো ধৈর্য হয়নি। আচমকাই মাথা অনেক বেশি ব্যাথা করছিলো বিধায় বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেয়। এদিকে আনায়ার শুরু থেকে অস্বস্তি হচ্ছিলো। মাথাটাও ঝিমঝিম করছিলো আবার কাজেও মনোযোগ দিতে পারছিলো। আবার মনে হচ্ছিলো ঘুম পেয়েছে তার। হঠাৎ তার নিত্যদিনের রুটিনে আজ এমন গড়মিল হলো কেনো তা আনায়ার জানা নেই। তবে আনায়াও আর বেশিক্ষণ না জেগে থেকে কেনীথের পাশেই শুয়ে পড়েছিলো।
আনায়া আরো কিছুক্ষণ বিছানায় হাত পা ছোটাছুটি করার কর হুট করেই বসে পড়লো। মাথা নিচের দিকে কিছুক্ষণ ঝুকিয়ে রেখে এলোমেলো চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে সোজা হলো। পাশে তাকিয়ে দেখলো কেনীথ নির্বিকারে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। আনায়ার কপালে ভাজ পড়লো। হাভভাবও ঠিকঠাক মনে হচ্ছে না। আচমকাই কেনীথের গায়ে হাত দিয়ে ঠেলাঠেলি করে ডাকতে লাগলো। কেনীথ আনায়ার এহেন কাজে ঘুমের মধ্যেও বিরক্ত হলো। বিরক্ত নিয়ে এক ঝটকায় আনায়ার হাত গা থেকে সরিয়ে দিলো। এদিকে আনায়া এবার দু-হাতে কেনীথকে ঠেলাঠেলি করে বলতে লাগলো,

“ঐ বুড়াই বেডা উঠো! উঠো বলছি, তাড়াতাড়ি উঠো।”
প্রায় অনেকক্ষণ আনায়ার ডাকাডাকি আর জোরাজোরির পর কেনীথ উঠে বসলো। চোখমুখ থেকে গভীর ঘুম যেন কাটছেই না। হঠাৎ এমন ঘুম কোথায় থেকে জেঁকে বসেছে তার জানা নেই। প্রচন্ড অসহ্য আর বিরক্তি নিয়ে পাশে তাকিয়ে আনায়ার উদ্দেশ্যে বললো,
“কে তুই? কি চাই তোর?”
আনায়া কিছুটা কপাল কুঁচকে নেশাগ্রস্তের মতো করে বললো,
“ভুলে গিয়েছো?বউ আমি…বিয়ে করা বউ আমি তোমার।কি জামাই কপালে জুটালে বাবা, দিনের মধ্যে একশোবার এটাই ভুলে যায় তার বউ আমি।”
কেনীথ ঘুৃম নেশায় আসক্ত ব্যক্তির মতো বিরক্ত হয়ে বললো,
“হুম…জানি আমি জানি। মনে পড়েছে, এতো বারবার বলতে হবে না।
আনায়া কিছুটা মুচকি হেসে বললো,
“যাক, ভুলে যাওনি তবে।”
—“তো আমায় ডেকেছিস কেনো?দেখছিস না আমি ঘুমিয়ে ছিলাম!”
কেনীথের ঘুমে গা এদিক ওদিক ঢুলে পড়ছে। নিজেকে বারবার ঠিক করে সামলাতে চাইলো। আনায়ার দিকে তাকিয়ে কিছুটা গম্ভীর স্বরে বললো,

” এতো রাতে কি চাই তোর?”
“জান একদমই ঘুম আসছে না, চলো খেলি!”
আনায়া একগাল মুচকি হেসে বলা কথায় কেনীথ ঘুমঘুম চোখে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বললো,
“মাথা খারাপ নাকি? এই বাড়িতে খেলার মতো লুডু, চেস কিংবা ক্যারাম কিছুই তো নেই। কি খেলবি তুই?”
আনায়ার চোখের পাতাও কেমন নিভে নিভে আসছে। অথচ ও লজ্জামাখা আর শয়তানি হাসিতে বিস্তৃত মুচকি হেসে বললো,
“আরে ওসব না, ওসব খেলা।”
কেনীথের চোখমুখ কুঁচকে গেলো। মাথা খারাপ করে কিসব বলছে আনায়া নিজেও বুঝতে পারছে না।
“গাধী কিসের কথা বলছিস, ঠিক করে বল। কিছু খেয়েছিস? নেশা…”

আনায়া কেনীথের কথা শেষ হাওয়ার আগেই গিয়ে কেনীথের কোলের উপর চড়ে বসলো৷ নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে অনেকটা বাবু হয়ে মাথা ঝুকিয়ে নিলো। অতঃপর কেনীথের গলায় নিজের দুহাত মালার মতো পেছিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। এদিকে কেনীথের ইচ্ছে হচ্ছে আনায়াকে ধরে একটা আছাড় দিতে। মাঝ রাতে ঘুম আর মুডের পুরো পয়তাল্লিশটা বাজিয়ে দিয়েছে। কেনীথের চোখেমুখে প্রচন্ড বিরক্তি।চুপচাপ আনায়ার অদ্ভুত ভাবভঙ্গি দেখছে। কেনীথ বিরক্তি নিয়ে বললো,

“আনায়া, প্লিজ বিরক্তি করিস না।হয় ঘুমা নয়তো, ঠিকঠাক বল কি চাইছিস?”
আনায়া মুচকি হাসলো। মাথা খানিকটা নীচু করে বললো,
“বললামই তো… বুঝে নেও না একটু।”
কেনীথ আচমকা ভাবুক চিত্তে ভাবতে বসলো। হুট করেই নিমিষেই ওর চোখমুখের রং উড়ে গেলো। তব্দা খাওয়ার মতো করে বিস্ময়ের সাথে মাথা নিচু করে আনায়ার মুখটা দেখার চেষ্টা করে বললো,
“তারা তুই…”

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৬ (৩)

কেনীথের কথা শুরু হওয়ার আগেই আনায়া থামিয়ে দিয়ে মাথা তুলে তড়িঘড়ি করে ইনোসেন্ট মুখ বানিয়ে বললো,
“বেশি না! যাস্ট চার-পাঁচ রাউন্ড খেলেই ঘুমিয়ে যাবো,পাক্কা!”
এই বলেই আনায়া আবার কেনীথের দিকে বিস্তৃত হেঁসে বাম চোখ মা”রলো।

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৭