একঝাঁক জোনাকি পর্ব ২৭

একঝাঁক জোনাকি পর্ব ২৭
ইশরাত জাহান অধরা

বাথরুমের আয়নার সামনে নিহানকে ইচ্ছামতো বকে বাথরুম থেকে বের হলো।সামনে তাকাতেই দেখল নিহান অরিনের সাথে খেলছে।কই লোকটাকে দেখে তো বুঝাই যায় না লোকটা তলে তলে এমন।বাইরে এমন ভাব দেখায় যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না!
“ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়িয়ে কি ভাবছেন?”

নিহানের কথায় হুশ আসলো অনিমার।হঠাত নিহান বসা থেকে উঠলো। এগিয়ে গেল অনিমার দিকে।অনিমার ভ্রু কুচকে এলো।এই লোক এখন ওর দিকে এগিয়ে আসছে কেন?কয়েক পা এগিয়ে অনিমার সামনে এসে দাঁড়ালো।ওদের মাঝে এখন আর কয়েক ইঞ্চির দুরত্ব।অনিমা পিছাতে পিছাতে ওয়াশরুমের দরজার সাথে পিঠ লেগে গেছে।অনিমাকে অবাক করে দিয়ে নিহান হাত বারিয়ে ওয়াশরুমের লাইটের সুইচ বন্ধ করে দিয়ে সরে এসে বলল,
“দিনের বেলা যে লাইট জ্বালিয়ে ওয়াশরুমে যেতে হয় সেটা আজ জানলাম!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অনিমা মনে মনে নিজেকে বকলো।লাইট কখন জ্বালালো সে?এমন ঘটনা কেন ঘটছে তার সাথে।
“ভুলে মেবি জ্বালিয়ে ফেলেছি।ধন্যবাদ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। ”
নিহান হেসে বলল,
“আরেহ!ইট’স ওকে।”
অনিমা অপ্রস্তুত হেসে বিছানায় বসে পরল।নিহানও কিছু না বলে বাইরে বেরিয়ে গেলো।দাদীর রুমের সামনে গিয়ে দরজায় নক করতেই দাদী বললেন ভিতরে আসতে।নিহান রুমে ঢুকে বলল,

“দাদী আজ বিকালেই আমরা চলে যাব। ”
দাদী চেয়ারে বসে ছিলেন। নিহানের কথায় অবাক হয়ে বললেন,
“সেকি!গতকাল রাতেই না এলি!আজই চলে যাবি!অন্তত একটা দিন থাক!তোর বউকে নিয়ে ঘুরে আয় কোথাও!মেয়েটা তো আশেপাশের কিছুই দেখলো না!”
“আমি জাস্ট একদিনের ছুটি নিয়ে এসেছি হাসপাতাল থেকে।আর অরিন তো ছোট!এ অবস্তায় অনিমা কি করে ঘুরতে বের হবে?অরিন একটু বড় হোক তারপর আমরা সবাই মিলে আসবো। টানা এক সপ্তাহ থাকব।আশেপাশের সবকিছু অনিমা আর অরিনকে ঘুরে দেখাবো!”

“আচ্ছা যাস আজকে।তোকে তো আর আটকাতে পারব না!এতদিন তোর মা তোকে আসতে দেয়নি তোর পড়ালেখায় ক্ষতি হবে বলে।আর এখন তুই আসবি না তোর বিয়ে হয়েছে বলে! অরিন ছোট বলে।ওরাই তোর সব আমরা কেও কিছুই না তোর কাছে।”
নিহান কিছুটা এগিয়ে দাদীর সামনে হাটু গেড়ে বসে পরল।দাদীর কোলে মাথা রেখে বলল,
“এরকটা কেন বলছো?আম্মু না চাইলেও আমি চুরি করে লুকিয়ে যে কতবার এসেছি সেটা ভুলে গেছো?”
দাদী কোন কথা বলল না।

“অরিন বড় হোক প্রতি বছরে একবার আসব!না না ছুটি পেয়েই চলে আসব।আর তুমি তো অনিমাকে দেখতে চেয়েছিলে আমি ওকে নিয়ে এসেছি।তোমার মন খারাপ দেখে আমি ঢাকায় চলে গেলেও শান্তি পাবো না!একটু বুঝার চেষ্টা করো!”
“হয়েছে!যাহ,কিন্তু অরিন বড় হলে আসবি কিন্তু…”
নিহান মিষ্টি হেসে বলল,
“অবশ্যই!”

নিহান ট্রেন স্টেশনে টিকেট কাউন্টারে টিকেটের জন্য দাঁড়িয়ে আছে।আর অনিমা একটু দুরে। টানা ১০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে টিকেট পেয়ে অনিমার কাছে যেতেই অনিমা বলল,
“আসার সময় তো বাসে করে এসেছিলেন।তাহলে এখন ট্রেনে করে যাচ্ছেন যে?”
“ট্রেনে করে গেলে তাড়াতাড়ি হবে।আজকে নাইট ডিউটি আছে আমার।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে পারলেই বাঁচি।”
কিছু একটা ভেবে আবার বলল,

“আপনার ট্রেনে যেতে অসুবিধা আছে?”
“নাহ!কি অসুবিধা থাকবে?জাস্ট জিজ্ঞেস করলাম এই আরকি!”
“ট্রেনে উঠতে পারবেন তো?”
বলতে না বলতেই ট্রেন এসে পরল।
অনিমা একবার ট্রেনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পারব!”

নিহান অরিনকে অনিমার থেকে নিজের কোলে নিয়ে নিলো।নিজে ট্রেনে উঠে তারপর হাত বারিয়ে দিলো অনিমার দিকে। অনিমা একবার নিহানের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার হাতের দিকে।নিহান বিরক্ত হয়ে বলল,
“কি হলো?হাত ধরছেন না কেন?ট্রেন ছেড়ে দিবে তো!”

অনিমা ডান হাত এগিয়ে নিহানের হাতে রাখল।সিটে বসে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল।কিছুক্ষন বাদেই ট্রেন তার নিজের গতিতে চলতে শুরু করল।অনিমা একবার নিহানের দিকে তাকালো।অনিমার এই মুহুর্তে অনেক জানতে ইচ্ছা করছে নিহান যাকে ভালোবাসতো সে দেখতে কেমন!নিশ্চয়ই সুন্দরী!বুঝালো নিজের মনকে যে মেয়েটা সুন্দরী। কারন এই মুহুর্তে এসে এই প্রশ্ন করাটা মানায় না।উফফ এতদিন তো প্রশ্নগুলা মাথায় আসেনি।তাহলে এখন একের পর এক অই মেয়েকে নিয়ে কেন প্রশ্ন জাগছে মনে?নিহান কি ভাববে?নিশ্চয়ই ভাববে আমি অই মেয়েটাকে নিয়ে অনেক কৌতুহল!বিরক্তিকর!

মন বলছে জিজ্ঞেস করতে।ওর অধিকার আছে জানার।আর ব্রেন বলছে কি দরকার পুরনো অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করার!সবার জীবনেই কেউ না কেউ থাকে!নিহানও এর ব্যতিক্রম নয়।সোহানের প্রেমের বিষয়টা তো স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছিলো তাহলে নিহানের পুরনো প্রেমের কথা মানতে পারছেনা কেন?কই যখন সোহান বলেছিল সে একটা মেয়েকে ভালোবাসে তখন তো সে অই মেয়ের বিষয়ে জানার একটা ফোটাও আগ্রহ দেখায় নি।বরং মেয়েটার মুখ যাতে না দেখতে হয় সেজন্য তাড়াতাড়ি ভোর হতেই বাড়ি ছেড়েছিলো।তাহলে নিহানের ক্ষেত্রে এত তফাৎ কেন?
শেষমেষ নিজের মন আর মস্তিষ্কের সাথে যুদ্ধ করতে করতে বলেই ফেলল,

“অই মেয়েটা দেখতে কেমন ছিলো?”
অনিমার কথা শুনে নিহান ভ্রু কুচকে বলল,
“কোন মেয়ে?”
অনিমার রাগ হলো। এই ছেলের জীবনে কয়টা মেয়ে ছিল যে সে চিনতে পারছে না কোন মেয়ে।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“যে মেয়ে আপনার প্রথম ভালোবাসা ছিল!পনেরো বছরের ভালোবাসা!”
নিহান বুঝতে পেরে বলল,
“হুম সুন্দর ছিলো।প্রথম দেখায় প্রেমে পরে গিয়েছিলাম তাহলে বুঝুন কেমন সুন্দর! ”
“অহ আচ্ছা।”

অনিমাকে জ্বালাতে নিহানের ভালো লাগছে।আরেকটু জ্বালানের জন্য বলল,
“আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে ছিল।ওকে দেখার পর আর কাওকে মনে ধরেনি।”
অনিমা কোন উত্তর না দিয়ে জানলার বাইরে তাকালো।কথা বলতে ইচ্ছা করছে না আর।এই ছেলে কেমন নিজের বউয়ের সামনে অন্য মেয়ের প্রশংসা করছে!বলছে কিনা অই মেয়েকে দেখার পর আর কাওকে মনে ধরেনি!কেন উনার মনের স্পেস কি এতোই কম?
“আপনার অই মেয়ের প্রতি এতো ভালোবাসা দেখে আপনাদের মাঝে নিজেকে কেমন যেন ভিলেন লাগছে।”
অনিমার কথা শুনে নিহান কিছু না বলে জানলার দিকে তাকিয়ে হাসলো।

অনিমাকে বাসার সামনে দিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে চলে গেলো নিহান।নিহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা শ্বাস ফেলে বাড়ির দিকে পা বারালো।বাড়িতে ঢুকতেই দেখলো মুক্তা বেগম সোফায় বসে সিরিয়াল দেখছেন!অনিমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।অনিমা একটা শ্বাস ফেলে সিড়ি বেয়ে উঠছিলো হঠাত পিছন থেকে মুক্তা বেগম বললেন,

“নিহান কোথায়?ওকে দেখলাম না যে?”
“উনার রাতের বেলা হাসপাতালে ডিউটি আছে।ফিরতে অনেক রাত হবে।”
“অহ!অরিনকে আমার কাছে দিয়ে যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।”
নিহানের মার কথা শুনে চমকে নিহানের মার দিকে তাকাতেই মুক্তা বেগম বিরক্ত হলেন।
“কি হলো এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে কি দেখছ?বাচ্চাটাকে রেখে যাও ফ্রেশ হয়ে আসো!রহিমাকে বলছি যাতে তোমার জন্য খাবার রেডি রাখে।”

অনিমা সিড়ি থেকে নেমে কয়েক পা এগিয়ে নিহানের মার দিকে অরিনকে বারিয়ে দিলো। নিহানের মা হাতে থাকা টিভির রিমোট সামনের টেবিলে রেখে অরিনকে নিজের কোলে নিয়ে নিলেন।অনিমা রুমের দিকে চলে গেলো।
রাত ১২ টা,
নিহান ঘরে ঢুকতেই দেখল পুরো বাড়ি অন্ধকার!অবশ্য অন্ধকার থাকারই কথা।সবাই নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে।গায়ে থাকা সাদা এপ্রোনটা খুলে সোফার উপর রেখে হাতে থাকা ঘড়ি খুলতে খুলতে ড্রয়িংরুমের লাইট অন করলো।সোফায় বসে কিছুক্ষন রেস্ট নিলো।

আজকে অনেক দখল গেছে তার উপর দিয়ে।ক্লান্তিতে শরীর এক ফোটাও নড়তে চাচ্ছে না।ইচ্ছা হচ্ছে এখানে শুয়ে ঘুমিয়ে পরতে।শরীরে এক ফোটাও শক্তি নেই যেন।শরীরের সাথে যুদ্ধ করে এক প্রকার উঠে পরল।গরম লাগছে অনেক।গোসল করতে হবে ভেবেই নিজের রুমে গিয়ে আলমারি থেকে ট্রাউজার আর গেঞ্জি বের করলো। তাওয়াল নিতে গিয়ে চোখ পরল ঘুমন্ত অনিমার দিকে।এগিয়ে গিয়ে বসলো ফ্লোরে হাটু মুড়ে।গালের উপর চুল পরে আছে।আর এজন্যই বারবার বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে ফেলেছে।নিহান হেসে ডান হাত দিয়ে বারিয়ে দিয়ে চুলগুলাকে সরিয়ে দিলো।

“অনিমা আপনি জানেন আপনি লাখে একজন।লাখ লাখ মানুষের মাঝে দাঁড় করিয়ে যদি বলা হয় যেকোন একজনকে চুজ করো আমি আপনাকেই চুজ করব।কবে আমাকে চিনবেন?কবে আমাকে একটু বেশি না একটু ভালোবাসবেন?অই সময়টার জন্য আমি দিন দিন লোভী হয়ে যাচ্ছি।এই লোভ কিছুতেই কমছে না।তার উপর গতকাল আমার কাছে এসে আমার লোভটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।এই লোভ কমানোর সম্পূর্ণ ভার আপনার অনিমা।কারন আমার লোভের কারন একমাত্র আপনি!আমি অপেক্ষা করব সেদিনটার জন্য যেদিন আপনি নিজ থেকে আমার কাছে এসে ধরা দিবেন।”

বলেই অনিমার একটু ঝুঁকে অনিমার কপালে ঠোট ছুয়ালো।বেশ কিছুক্ষন ঠোট ছুইয়ে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে পরল শাওয়ার নেওয়ার উদ্দশ্যে বাথরুমে চলে যেতেই অনিমা উঠে বসলো।বড় একটা শ্বাস নিলো।নিহান কি বললো এসব?অরিন একটু আগেই জেগে গিয়েছিলো কান্না করছিলো।কান্না থামিয়ে ঘুম পাড়িয়ে চোখ দুটো বন্ধ করতেই নিহানের আসার শব্দ শুনলো।চোখ মেলতেই যাবে হঠাত নিহান এসে সামনে বসে কথাগুলো বলাতে আর চোখ খুলেনি।

লম্বা শাওয়ার নিয়ে ট্রাউজার পরে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হয়ে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে একটু সামনে যেতেই দেখলো অনিমা হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্রই গরম করেছে খাবারগুলো কারন প্লেট থেকে ধোয়া বেরুচ্ছে।অনিমা চোখ তুলে তাকাতেই নিহানকে এমন খালি গায়ে দেখে চিৎকার দিতেই যাবে হঠাত নিহান দৌড়ে এসে অনিমার মুখ চেপে ধরল।
“এত রাতে চিৎকার করলে মানুষ কি ভাববে?”

অনিমা ইশারায় বলল যাতে মুখ থেকে হাত সরায় নিহান সরিয়ে তাড়াতাড়ি করে হাতে থাকা টি শার্টটা পরে ফেলল।
“সরি!আসলে টিশার্টটা ভিজে গিয়েছিলো।তাই এসেছিলাম আরেকটা টিশার্ট নেওয়ার জন্য।আর তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম আপনি ঘুমাচ্ছেন।তাই খালি গায়ে বেরিয়ে এসেছিলাম।”
অনিমা কিছু না বলে বিছানায় খাবারের ট্রে বিছানার উপর রেখে বলল,

একঝাঁক জোনাকি পর্ব ২৬

“খেয়ে নিন।দুপুর থেকে তো মনে হয় না কিছু খেয়েছেন!”
নিহান খাবার খেতে বসে পরল।খাওয়া শেষ করে বলল,
“অনিমা আপনি কি জানেন আপনি ধীরে ধীরে আমার প্রেমে পরে যাচ্ছেন?”

একঝাঁক জোনাকি পর্ব ২৮