একঝাঁক জোনাকি শেষ পর্ব
ইশরাত জাহান অধরা
অনিমা ঘর গুছাচ্ছিলো।ঘড়ির কাটার দিকে তাকাতেই দেখল রাত ৮ টা বাজে।এতক্ষনে তো নিহান এসে পরে।তাহলে আজ আসতে এত দেরি করছে কেন?ভাবতে ভাবতেই অনিমার মোবাইলে কল এলো।নিহান ফোন করেছে।কল রিসিভ করে বলল,
“আপনি এত দেরি করছেন কেন নিহান?রাত আটটা বাজে এখনো আপনার আসার কোন নাম গন্ধ নেই!”
“আপনি কি অনিমা?”
অপরিচিত কন্ঠ শুনেই অনিমার গলা শুকিয়ে এলো।
“জ্বি!কিন্তু আপনার কাছে….”
“এখানে একটু আগে একটা গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়েছে।ড্রাইভার সিটে যিনি ছিলেন উনার পকেট থেকে ফোনটা পাওয়া।কল লিস্টে দেখলাম আপনার নাম্বার আগে তাই কল করলাম।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কথা শুনেই অনিমার হাত থেকে ফোন পরে গেলো।পাশেই মারিয়া বসে ছিল।অরিনের সাথে খেলছিলো।অনিমার এমন আচরন দেখে অনিমার কাছে এসে বলল,
“কি হয়েছে ভাবি?তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
“নিহান!”
“ভাইয়ার কি হয়েছে?”
অনিমা,মারিয়া আর মুক্তা বেগম হাসপাতালের চেয়ারে বসে আছেন।অনিমা এক দৃষ্টিতে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে।মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তার।মারিয়া অনিমা আর তার মাকে শান্তনা দিচ্ছে।কিছুক্ষন বাদেই ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এলো।মারিয়া দৌড়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলল,
“পেসেন্টের কি অবস্তা?”
“আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করেছি।এখন জ্ঞান ফিরা আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগবে।এছাড়া আর কিছু বলতে পারছিনা।”
মুক্তা বেগম বললেন,
“কেবিনে যাওয়া যাবে?”
“এখন যাওয়া যাবে না। পরে যেতে পারবেন।তবে যেকোন একজন যেতে পারবেন।”
বলেই চলে গেলো।
অনিমা নিহানের সামনে বসে আছে।মুক্তা বেগমই পাঠিয়েছেন।মেয়েটার চেহারা দেখা যাচ্ছিলোনা।তাই ভাবলেন অনিমাকে নিহানের কেবিনে পাঠালেই ভালো হবে।নিহানের মুখে অক্সিজেন মাস্ক দেওয়া।সারা হাতে পায়ে প্লাস্টার করা।অনিমার কান্না পেলো খুব।কান্নাটাকে থামিয়ে নিহানের হাত ধরে বলল,
“উঠে পরুন প্লিজ!আমি আপনার জন্য ওয়েট করছি।আপনাকে আমার অনেক কিছু বলা বাকি আছে!আপনাকে এখনো বলা হয়নি যে আমিও আপনাকে ভালোবাসি!আমি আপনার প্রতি ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পরেছি। আপনি তো ডাইরিতে লিখেছিলেন আমার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করবেন। এখন আমার মুখে ভালোবাসি না শুনেই চলে যাচ্ছেন?এটা একদমই ঠিক না!আমার মনে অনুভূতি জম্মিয়ে এখন আমার থেকে দুরে চলে যাচ্ছেন! আপনার মতো কেও আমাকে ভালোবাসেনি।নিজের বাবাও না!প্লিজ আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন।আপনি যা বলবেন আমি তাই করব!আপনি তো চেয়েছিলেন অরিনের জম্মদিন পালন করতে!অরিনের মুখে বাবা ডাক শুনতে।তাহলে এখন কেন আমাকে আর অরিনকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন?প্লিজ উঠুন!ভালোবাসি আপনাকে!”
সকালে নিহানের চোখ খুলল।পাশেই অনিমা ঘুমিয়ে পরেছিলো।সারারাত কেঁদে ভোরের দিকে ঘুমালো।নিহানের নড়চড়ায় অনিমার ঘুম ভেংগে গেলো।
“ঠিক আছেন আপনি?ব্যথা হচ্ছে কোথাও!ডাক্তারকে ডেকে আনছি।”
বলে চলে যেতে নিলেই নিহান হাত ধরে ফেলল।অনিমা চেয়ারে বসলো নিহানের সামনে।নিহান দূর্বল কন্ঠে বলল,
“আপনি ঠিক আছেন অনিমা?চোখ মুখ এমন লাগছে কেন?”
অনিমার কান্না পেলো।লোকটা এ অবস্তায়ও তার খোজ খবর নিচ্ছে।ভালো আছে কিনা তা জিজ্ঞেস করছে।
“আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না!আপনি নিজের কথা ভাবুন!কি গাড়ি চালাচ্ছিলেন যে এক্সিডেন্ট হয়ে গেলো?”
“আমি কি ইচ্ছা করে এক্সিডেন্ট করেছি নাকি?মোবাইলে কল এসেছিলো। সেটা ধরতে যেতেই দেখলাম একটা বাচ্চা আমার গাড়ির সামনে চলে এসেছে।বাচ্চাটাকে বাঁচানোর জন্যই…”
“বাচ্চাটাকে বাঁচানোর জন্য আপনি এক্সিডেন্ট করে বসলেন?”
অনিমা কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,
“ভালোবাসি?”
নিহান প্রথমে ভাবলো ভুল শুনেছে তাই বলল,
“কি বললেন শুনিনি।”
“আপনাকে ভালোবাসি!”
নিহান অবাক হয়ে বলল,
“আপনি সত্যি বলছেন?মিথ্যা বলছেন না?”
অনিমা নিহানের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
“এখন বিশ্বাস করেছেন?”
নিহান উপর নিচ মাথা নাড়লো।মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে।
“মনে হচ্ছে এক্সিডেন্ট করে ভালোই করেছি।নইলে আপনার মুখে ভালোবাসি শুনতে পেতাম না!”
অনিমা রেগে নিহানের বুকে মারলো।নিহান ব্যথা পেয়ে চোখ মুখ কুচকে বলল,
“আহ অনিমা!আপনি সবসময় আমার ব্যথার জায়গাতেই মারেন কেন?সকালে খামচি দেওয়ার জায়গায় মারলেন আর এখন বুকে….”
অনিমা নাক ফুলিয়ে বলল,
“বেশ করেছি।”
প্রায় তিন বছর পর,
নিহান অরিনকে নিয়ে হাঁটছে।পাশেই অনিমা।অরিন বায়না ধরছিলো অনেক ঘুরতে নিয়ে যাবার জন্য।অরিন নিহানের ঘাড়ে বসে আছে।আর কিছুক্ষন বাদেই বাবা মেয়ে হাসিতে মেতে উঠছে।নিহান কৌতুক বলছে আর অরিন তা শুনে হাসছে। অনিমাও নিহান আর অরিনের খুনশুটি দেখে হেসে দিয়েছে।হঠাত অনিমার বাবার সাথে দেখা হয়ে গেলো রাস্তায়।অনিমার বাবা অবাক হয়ে অনিমা আর নিহানকে দেখছে।নিহান অনিমাকে বলল,
“আপনি আপনার বাবার সাথে কথা বলুন।আমি অরিনকে আইস্ক্রিম কিনে দিচ্ছি!ও আইস্ক্রিম খেতে চেয়েছে।”
অনিমা সম্মতি জানালো।অনিমা জানে নিহান মিথ্যা বলেছে।অরিন আইস্ক্রিমের খেতে চায়নি।বরং অনিমাকে ওর বাবার সাথে একান্ত সময় কাটানোর জন্যই নিহান একথা বলেছে।অরিন আইসক্রিমের কথা শুনে খুশি মনে বাবার সাথে চলে গেছে।
“কেমন আছিস মা?”
“হুম।ভালো আছি।”
“আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবি না?”
“ভালোই আছো।তোমার আদরে মেয়ের সাথে আছো।খারাপ থাকার প্রশ্নই উঠেনা।”
“তুইও তো আমার মেয়ে!”
“কিন্তু তোমার আচরনে কোনদিন তা প্রকাশ পায়নি!তুমি সবসময় তিথিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছো আমার থেকে।আসলে তুমি কোনদিন আমাকে মেয়ে হিসেবে ভাবোইনি।আমি তোমার নিজের মেয়ে হয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে গেছো।অথচ নিহানকে দেখো অরিনকে কত সুন্দর করে লালন পালন করছে।জানো অরিনের কোন কাজ আমার করা লাগে না।
সব নিহানই করে।নিহানকে দেখে কেও বুঝতে পারবে না অরিন যে তার নিজের মেয়ে না!ওদের দেখেই আমি বুঝেছি বাবা মেয়ের সম্পর্ক শুধু রক্তের হলেই হয় না। আমি তো কোনদিন আমার বাবার ভালোবাসা পাইনি।কিন্তু আমার মেয়েটা পাচ্ছে।আর এতেই আমি অনেক খুশি।নিহান আমাকে একটা পরিবার দিয়েছে সেখানে আমি একটা মা পেয়েছি,ছোট বোন পেয়েছি আর নিহানের মতো স্বামী পেয়েছি।আল্লাগ আমার কপালে এত সুখ রেখেছিলো সেটা আমি জানতামই না!আমি অনেক সুখে আছি।”
কথাগুলা শুনে অনিমার বাবার নিজেকে নিজের কাছে বড্ড অপরাধী লাগছে।আসলেই প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর অনিমাকে কোনদিন মেয়ের স্নেহ দেয়নি।ভালোভাবে তাকায়ইনি মেয়েটার দিকে।লজ্জা লাগছে অনিমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে।তবুও মুখ ফুটে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দে মা!”
অনিমা হেসে বলল,
“কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি।তুমি আমাকে তোমার মেয়ে না ভাবতে পারো কিন্তু আমি তোমাকে আমার বাবা হিসেবে ভেবে এসেছি।আর বাবারা যেমনই হোক না কেন তাদের প্রতি কোন অভিযোগ রাখতে নেই মনে।”
“আব্বু!তুমি এখানে!আর আমি তোমাকে পুরো রাস্তা খুুজে বেরাচ্ছি।”
কথাটা বলেই তিথি সামনে তাকাতেই অনিমাকে দেখল।
“আপু!ভালো আছিস?”
“হুম!”
“দুলাভাই কোথায়?উনাকে আমার কিছু কথা বলার ছিলো।”
অনিমা দেখিয়ে দিতেই তিথি গেলো।নিহান তাকিয়ে আছে।অরিন আইস্ক্রিম খেতে খেতে বলল,
“আব্বু!এই মেয়েটা কে?”
নিহান হেসে বলল,
“তোমার আন্টি!”
“আটি?”
তিথি হেসে দিলো অরিনের কথা শুনে।
“হুম।আমি তোমার আটি।”
নিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভয় পাবেন না!আমি আজ আপনাকে কোন খারাপ কথা শুনাতে আসিনি।আপনি বলেছিলেন না সবার জীবনে এমন এক মানুষের আগমন ঘটে যাকে দেখলে পুরো দুনিয়া থমকে যায়?সবার থেকে আপন মনে হয়!আমি সেই মানুষটাকে পেয়ে গিয়েছি।আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আমি বোধহয় আপনাকে ভালোবাসি কিন্তু পরে বুঝলাম অনিমার উপর হিংসা, আর অপমান বোধ করেই আপনাকে আমার করতে চেয়েছিলাম।আপনার জন্যই আমি আমার সত্যিকারের ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে ধন্যবাদ! ”
নিহান হেসে বলল,
“তা সে ছেলেটার নাম কি যে আমার শা*লীর মন চুরি করে নিলো?”
“তাহসান!”
অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপু!সামনের মাসে আমার বিয়ে! তুই আসবি কিন্তু!”
“অবশ্যই! ”
বাসায় ফিরতেই মুক্তা বেগম অরিনকে কোলে নিয়ে অনিমাকে বললেন,
“এই গরমে খুব কষ্ট হয়েছে না?”
অনিমা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝালো।
“সোফায় বসো।আমি তোমার জন্য ঠান্ডা শরবত নিয়ে আসছি।”
নিহান মুখ ফুলিয়ে বলল,
“এটা একদমই ঠিক না। কই নিজের ছেলেকে আগে বলবে, শরবত খাওয়াবে তা না করে বউমাকে আদর করছো?আমি ও তো বাইরে থেকে ঘুরে এসেছি!”
নিহানের মা হেসে বললেন,
“আমার বউমাকে নিয়ে হিংসা করা হচ্ছে?নিজের শরবত নিজে বানিয়ে খা!”
বলেই অরিনকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো।অনিমা নিহানের মুখের দিকে তাকালো।হাসি আসছে ওর।
“একদম ঠিক হয়েছে!”
“আমার নিজের মা ই আমার জন্য শরবত বানায় না!আপনি তো হাসবেনই! ”
অরিন মারিয়ার ঘরে শুয়েছে।তার আজকে ফুফুর সাথে থাকার ইচ্ছা হয়েছে।আর নিহান আর অনিমা বারান্দায় বসে আছে।অনিমার নিহানের কাধে মাথা রেখে চাঁদ দেখছে।নিহান অনিমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
“অনিমা আপনার কি মনে হয় না অরিন একা একা বেড়ে উঠছে।ওর একজন খেলার সাথি প্রয়োজন!”
অনিমা কাধ থেকে মাথা উঠিয়ে নিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মানে?”
“মানে চলুন অরিনের ভাই বা বোন আনার ব্যবস্তা করি!এতে ওর বোরিংনেস কমবে।”
অনিমা কিছু বললনা।
“তাহলে কি আমি চুপ করে থাকাটাকে সম্মতির লক্ষন ভেবে নিবো?”
অনিমা লজ্জা পেয়ে নিহানের বুকে মুখ গুজলো।নিহান হেসে অনিমাকে কোলে নিয়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেল।বিছানায় শুইয়ে কপালে চুমু দিলো।চোখের পাতায়,গালে চুমু দিলো।অনিমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
একঝাঁক জোনাকি পর্ব ৩০
“চলুন অরিনের খেলার সাথী আনার প্রসেসিং শুরু করি!”
“আপনার মুখে কিছুই আটকায় না!”
নিহান হেসে অনিমাতে ডুব দিলো।